হাড় কিপটে


Author: ড. পল্টু দত্ত

হাড় কিপটে

Summary:

যোগেন মিত্তির খুব কৃপন। একেবারে হাড় কিপটে।

পুরনো ঢাকার কোর্ট পাড়ায় তার নিত্য আসা-যাওয়া। কোর্ট কাচারিতে কেরানীর কাজ। অল্প বেতন। কোন রকমে সংসারটা চলে। সংসার বলতে দুজন। থাকে রামপুরায় বস্তি সংলগ্ন ঘিঞ্জি এলাকায় মাছির উৎপাত আর মিউনিসিপ্যালিটির নর্দমা ফেলার জায়গার একটু দুরে। নর্দমার পাশ দিয়ে বাসায় যেতে হয়। রুমাল দিয়ে নাকটা চেপে ধরে দম বন্ধ করে তর তর করে জায়গাটা পাড় হয় প্রতিদিন। তার পরেও গন্ধ পায়। মাঝে মধ্যে ওয়াক ওয়াক করে বমির ভাব করে। তাও জায়গাটা ছাড়বে না। স্ত্রী সুরবালা এই জায়গা ছেড়ে পুরান ঢাকায় থাকতে চায়। স্বামীর অফিসের কাছাকাছি। পরিচিত অনেকেই নদীর পারে থাকে। কিন্তু যোগেন মিত্তিরের একই কথা-“সেই জায়গাটা দুষিত, ভয়ানক। যে কোন সময় বিপদ হইতে পারে। অফিসে ত তুমি কষ্ট করে যাও না। আমি যাই। তোমার এত চিন্তা কা?”

সুরবালা সবই বুঝে। ভালো করেই জানে তার স্বামী কতো বড় কিপ্টে। তাই মুখ বুঝে সব সহ্য করে। গতকাল কী কান্ডটাই না ঘটালো অধীর ঠাকুরপোর সাথে। এমনিতেই আসেন না। অনেক দিন পরে এলেন। একটু চাও খেলেন না। যোগেন মিত্তিরের কাকাত ভাই অধীর। পাশেই থাকেন। গতকাল সন্ধ্যায় ঢু মেরেছিলেন। 

অধীর (ঘরে ঢুকে) কেমন আছো, মিত্তির দা?

যোগেন মিত্তির: (চোখ কুঁচকে) ভালো আছি, অধীর। তুমি এ সময়ে? কোন দরকার?

অধীর: (হাসি মুখে) আমি ভাবলাম তোমার সাথে একটু আড্ডা দিই। আর শুনলাম, আজ তুমি নতুন আলু কিনেছো বাজার থেকে?

যোগেন মিত্তির: (গামছায় হাত মুছতে মুছতে) হ্যাঁ, কিন্তু বেশি না, হাফ কেজি মাত্র। আলুর দাম খুব বেড়েছে।

অধীর (অবাক হয়ে) হাফ কেজি? এতো কম আলুতে কী হবে?

যোগেন মিত্তির: (চোখ মটকে) কম খেলেই তো ভালো। পেট খারাপ হবে না। এখন তো বয়স হইছে।

অধীর: (হাসি, বৌদি যেন শুনতে পায়) আরে, বৌদি মিষ্টি কিছু বানানোর ইচ্ছে আছে? একটু সেমাই ক্ষীর?

যোগেন মিত্তির: (তাড়াতাড়ি) সেমাই! না না, দুধ নেই, চিনি নেই। এসব এখন অনেক দামী। তাছাড়া, এসব না খেলেই ভালো। বেশী সুগারে শরীর পচে যায়।

অধীর: (কৌতুক করে) ঠিক বলেছো, মিত্তিরদা। কিন্তু আজ আমার যে খুব খেতে ইচ্ছে করছে।

যোগেন মিত্তির: (অস্থির হয়ে) আচ্ছা, তুমি চা খাবে? তোমার বৌদি এক কাপ চা করে দিতে পারে।-এই বলেই জোড়ে হাঁকাতে থাকে।

অধীর: (হাসি চাপা দিয়ে) না না, তুমি বারণ করো, আমি চলে যাচ্ছি। আজ থাক, অন্য দিন চা খাবো।

যোগেন মিত্তির: (বেশ খুশিচ্ছলে) ঠিক আছে, অধীর। আবার এসো। (মনেমনে) ভালোই হলো, কিছু খরচ করতে হলো না।

 

কেউ যদি তার বাড়ির সামনে দিয়ে হেঁটে যায় যোগেন মিত্তির তাদের দিকে এমন ভাবে তাকাবে যেন তারা তার সারা জীবনের সঞ্চয় চুরি করতে এসেছে। কখনো কখনো বির বির করে মিন মিনিয়ে শাসিয়ে দেয়।

এই বস্তি সংলগ্ন পুরো এলাকায় যোগেন মিত্র তার কৃপনতার জন্য বেশ পরিচিত। নানা নামে ডাকে প্রায় বৃদ্ধ বয়েসী যোগেনকে। কেউ বলে -`কিপটে কাকা`, `হাড় কিপটে চাচা`, `যোগেন চাচা আর পেয়াজু চুরি করবে না` `যোগেন গায়ক কৃপন`,  `না পোসানো কাকা`, `আমার ত পোষায় না` ইত্যাদি ইত্যাদি। তবে বেশীর ভাগ সময় এ পাড়ার বাচ্চা ছেলেরাই বলে। যোগেন মিত্র এতে তেলে বেগুনে জ্বলে উঠে। হাতে রাখা পুরনো দিনের রং উঠা  বিধ্বস্ত ছাতা দিয়ে তাড়া করে। ছেলেগুলিও বেশ বজ্জাত। কান ধরে বাধ্য বালকের মতো দাঁড়িয়ে যাবে আর বলবে-“আর বলবো না। এবার মাফ করে দাও।“

যোগেনের আবার দয়ার শরীর-“ঠিক আছে। বড়দেরকে এ ভাবে বলতে নেই। এবার আমি মাফ করে দিলাম। আর কক্ষনো এ সব বলবে না।“-এ সব বলে যে মাত্র যোগেন হাঁটা শুরু করে ঠিক তখুনি ছেলেগুলি মুখ ভেংচিয়ে শিস দিতে দিতে ঐ কথাগুলিই ইনিয়ে বিনিয়ে রঙ মাখিয়ে ভেঙ্গে চুরে অশ্রাব্য ভঙ্গিতে বলতে থাকে আর অন্যদিকে দৌড়াতে থাকে।

 

যোগেন সারাটা জীবন খুব মেপে মেপে চলেছে। একটা টাকা বাঁচানোর জন্য মাইলের পর মাইল হেঁটে গিয়েছে। চপ্পল জোড়া যত্ন করে পুরনো একটা পলিথিনের ব্যাগে রেখে বগল দাবা করে রাখে সবসময়। ঠিক কোর্ট পাড়ায় ঢোকার আগেই পায়ে দিবে। এতে নাকি চপ্পলের আয়ু বাড়বে। রাস্তায় নানা ঝঞ্জালের উপর দিয়ে খালি পায়ে হাঁটলে চপ্পল বাঁচবে বৈকি কিন্তু পায়ের যে করুন দশা হচ্ছে তাতে যোগেনের কোন কষ্ট নেই। আর ছাতিটাও যেন খুব কষ্টে আছে। অসহ্য রোদ্রের তাপ মাথায় নিয়ে ঘাম ঝড়িয়ে হাঁটবে অথচ ছাতাটা খুলবে না। যখন কোন গাছ তলায় বসবে তখনই এর উপযুক্ত ব্যাবহার নাকি জরুরী। ইদানীং নাকি গাছে বসে থাকা পাখিদের উৎপাত বেড়েছে। যে কোন সময় চোখে, মুখে, নাকে, মাথায় বিষ্ঠা ছাড়ে।

যোগেন মিত্তির কৃপণতার কথা এতটাই ছড়িয়ে পড়েছিল যে, পাড়ার বাচ্চা ছেলে-মেয়েরা টিটকারি মেরে একে অপরকে সাহস করিয়ে বলতো, "এই কে যাবে, যোগের চাচার কাছ থেকে এক টাকা চেয়ে আনতে।" আর তখন এই কথা শুনে বৃদ্ধ যোগেন তাদের দীর্ঘক্ষণ ধরে সঞ্চয়ের গুণাবলী নিয়ে বক্তৃতা দিতেন। চুপ করে বাচ্চারা তখন শুনত আর একে অপরের দিকে তাকিয়ে দুষ্টুমীর হাসিতে চোখ টিপাটিপি করত।

একদিন এক কান্ড ঘটলো। প্রচন্ড গরম ছিল সেদিন।

কারো কাছে যোগেন শুনলো পাড়ায় এক বিশাল বিয়ের অনুষ্ঠান হচ্ছে। কনের পরিবার খুব ধনী। আশে পাশের এলাকায়  তাদের আভিজাত্যের জন্য বিখ্যাত। বড় লোকের বিয়ে বলে কথা। অনেক মানুষ আমন্ত্রিত। শুনেছে সবচেয়ে ভাল বিরিয়ানি, মাটন কারি এবং মিষ্টি পরিবেশন করা হবে। এটা শুনে যোগেনের মুখে জল এসে গেল। বস্তি পাড়ার কাউকে নিমন্ত্রন করবে এটা কারো ভাবনায়ও আসে না। তবে শুনেছে গরীব মানুষদের জন্য আলাদা ব্যাবস্থা আছে।

কিন্তু তাতে তো যোগেনের চলবে না। গরীব মিস্কিনদের সাথে যোগেনের এক সাথে বসে খাওয়াটা বেশ বেমানান। অপমানের ব্যাপার। তাই যে করেই হোক সোজাসুজি বিয়ে বাড়ীতে গিয়ে বিরিয়ানী মাটন খেয়ে আসতেই হবে। কতোদিন এ সব ভাগ্যে জুটে না। এবার বেশ পেট ভরে খেয়ে আসবে।

এই ভেবে খুশিতে গদগদ যোগেন। কিন্তু বিয়ে বাড়ীতে উপহার নিয়ে যাওয়ার কোন ইচ্ছা নেই তার। "উপহারের জন্য টাকা নষ্ট করার কি দরকার যখন বিনামূল্যে পেট ভরতে পারি?" যোগেন ভাবল।

 

বিয়ের দিনে যোগেন তার সেরা পোশাকটি পরে। এই একটি মাত্র পায়জামা-পাঞ্জাবি। অনেক পুরনো। টিনের বাক্সে মেনথলিনের টেবলেট দিয়ে তালা বন্ধ করে রাখে। বেশ দামী দামী একটা সুগন্ধ জানান দিয়ে দেয় বেশ খান্দানি ভাব।

 

এবার তিনি বিয়ের বাড়ীর দিকে রওনা দিলেন। কিন্তু তার পরিকল্পনা মূল গেটে এসে থমকে গেল। এক দশ বছরের বাচ্চা ছেলে গেট পাহারা দিচ্ছিল। প্রত্যেক অতিথির কাছে আমন্ত্রণ পত্র চাইছিল। যোগেন মিত্তির তো কোন আমন্ত্রণ পত্র নেই? বিপদের আশংকায় মাথাটা কেমন ঝিম মেরে গেল।

কাছে আসতেই  দ্রুত চিন্তা করে যোগেন মিত্তির নিজের গুরুত্ব জাহির করে বললেন, "আমি ঢাকা থেকে আসা বর এর হারিয়ে যাওয়া কাকা। আমার প্রিয় ভাতিজা আমাকে বিশেষভাবে আমন্ত্রণ করেছে।" বাচ্চাটি, তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে, সন্দিহান হয়ে বলল, "আপনি যদি সত্যিই তার কাকা হন, তবে অবশ্যই বর এর নাম জানেন।"

এবার বৃদ্ধ যোগেন ঘামতে ঘামতে বললেন, "অবশ্যই জানি! তার নাম... উম... তরুন?" বাচ্চাটি মাথা নেড়ে বলল, "বরের নাম বরুন। দয়া করে সরে যান, দাদু।"

 

যোগেন হতাশ কিন্তু হাল ছাড়েনি।  এবার তিনি একটি কোণে গিয়ে ভাবতে লাগলেন। তার তীক্ষ্ন চোখ বিয়ের জন্য ভাড়া করা বাদ্যযন্ত্র দলটির উপর পড়ল। এবার বুদ্ধি পাকাতে লাগলেন। কি করা যায় এই ভেবে এপাশ ওপাশ পায়চারী করতে লাগল। এবার মাথায় একটা বুদ্ধি আসল। তিনি বাদ্য দলের দলনেতার কাছে গিয়ে বললেন, "ভাই, আমি ঢাকার একজন বিখ্যাত গায়ক। আমাকে দম্পতির জন্য একটি গান গাইতে বিশেষভাবে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। আপনি কি আমাকে আপনার দলের সাথে ঢুকতে দেবেন?"

দলনেতা খুব রসিক মানুষ। সব সময় মজা করতে ভালবাসে।  রাজি হয়ে গেল। সে বৃদ্ধকে একটি হারমোনিয়াম এবং একটি নকল দাড়ি পড়িয়ে দিল। বেশ খাসা লাগছিল যোগেনকে। দলের সবাই গেট দিয়ে ঢুকে গেল। বৃদ্ধও সাথে সাথে নার্ভাসভাবে হারমোনিয়াম ধরে এগিয়ে চলছে আর প্রার্থনা করছিল যেন কেউ তাকে সত্যি গান গাইতে না বলে।

ভেতরে ঢুকে তিনি দেখতে পেলেন বিরিয়ানি এবং সুস্বাদু কাবাবের বিশাল আয়োজন। জিহ্বা দিয়ে জল এসে গেল। আর যেন তর সইছিল না।  দ্রুত খাবারের টেবিলের দিকে এগিয়ে গেলেন। পাশ থেকে একটি প্লেট নিয়ে খাবার দিয়ে প্লেট ভরাতে লাগলেন। ঠিক যখন তিনি খাবার খেতে যাচ্ছিলেন, তখন একটি ঘোষণা শোনা গেল, "প্রিয় অতিথিবৃন্দ, আজকের বিশেষ অতিথি ঢাকার একজন বিখ্যাত গায়ক আমাদের গান শোনাবেন!"

এই ঘোষনা শুনেই যেন যোগেন একেবারে বরফ হয়ে গেলেন। হৃদয় ডুবে গেল গভীর অন্ধকারে। দ্রুত সবার চোখ তার দিকে ফিরল। বাদ্য দলের নেতা হাসি চেপে তথাকথিত ঢাকার গায়ককে মঞ্চে আসতে ইশারা করল। কোন উপায় না দেখে, বৃদ্ধ এবার মঞ্চে উঠলেন। হাত কাঁপছিল, থর থর করে গা কাঁপছিল। যেন সাহারার মরুভূমিতে দাঁড়িয়ে আছেন। সারা গা ঘামে জুবজুবা হয়ে গেল। তিনি হারমোনিয়ামের উপর এলোমেলোভাবে কিছু বোতাম চাপতে লাগলেন, যা এক ধরনের হাস্যকর শব্দের সৃষ্টি করল।

 

প্রথমে অতিথিরা বিভ্রান্ত হয়ে গেল, পরে হাসতে লাগল। কনের বাবা, একজন সদয় এবং রসিক মানুষ, বৃদ্ধ গায়কের কাছে গিয়ে বললেন, "আপনি হয়তো গায়ক নন, কিন্তু আপনি আমাদের আজকে আনন্দ দিয়েছেন। আসুন, আমাদের সাথে ভোজে যোগ দিন।"

স্বস্তি পেয়ে, যোগেন মিত্র অবশেষে তার খাবার উপভোগ করতে বসলেন। তিনি বিরিয়ানি এবং কাবাব গুলো গপগপ করে খেতে লাগলেন। লজ্জা সত্ত্বেও, তিনি ভাবলেন সবই বিনামূল্যে খাবারের জন্য জীবনটা সার্থক।

বিয়ে বাড়ী থেকে বের হলেন। তার পেট ভর্তি, বেশ মজা করে খেয়েছেন। এমন সুস্বাদু খাবার আগে আর কখনো খাননি। মনটা বেশ  হালকা লাগছে।  রাস্তায় যখন এসে পৌঁছুলেন তখন হঠাৎ বাচ্চাদের চিৎকার শুনতে পেলেন, "যোগেন গায়ক কৃপণ!"

 

সেই দিন থেকে, যোগেন মিত্র শুধু তার কৃপণতার জন্য নয়, তার অবিস্মরণীয় পারফরম্যান্সের জন্যও একটি স্থানীয় কিংবদন্তি হয়ে উঠলেন।

একবার ঢাকা থেকে তিনি গ্রামে গেলেন। বাসে ঘন্টা দুয়েকের রাস্তা। বাড়ীতে ছোট ভাইদের সংসার। নিজের একটি ভাঙ্গা খালি টিনের ঘর পরে আছে। ঐখানেই দুএকটা রাত কাটিয়ে দেন। যে সময়টাতে এবার গ্রামে গেলেন সে সময় গ্রামে একটা বড় মেলা বসে। যোগেনের বাড়ীর প্রতিবেশীরা সবাই মেলায় যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। যোগেনও ঠিক করলো, সে মেলায় যাবে। তবে মেলা মানেই তো খরচ, আর খরচ মানেই তার প্রাণান্তকর কষ্ট। তাই সে ঠিক করলো, মেলার আনন্দ উপভোগ করবে কিন্তু এক টাকাও খরচ করবে না।

মেলা শুরু হলো। যোগেনও সবার সাথে গেলো। মেলায় গিয়ে সে খালি পকেট নিয়ে ঘুরে বেড়াতে লাগলো। কখনো সে মিষ্টির দোকানের সামনে গিয়ে দাঁড়াতো, মিষ্টির ঘ্রাণ নিয়ে পেট ভরাতো। আবার কখনো খেলনার দোকানের সামনে গিয়ে নিজের মনে হাসতো। কেননা সে জানতো, সে খেলনা কিনবে না।

 

হঠাৎ যোগেনের নজরে পড়লো এক খাবারের স্টল। স্টলের মালিক জোড়ে জোড়ে বলছিলো, "যে কেউ এসে আমাদের নতুন পেঁয়াজু খেলে যদি খুশী না হন তাকে আমরা বিনামূল্যে আরও একটি দেবো।" যোগেন মিত্রের চোখ চকচক করে উঠলো। বিনামূল্যে কিছু পাওয়া মানেই তার জন্য স্বর্গ। সে দ্রুত স্টলের সামনে গিয়ে বললো, "একটা পেঁয়াজু দাও, দেখি কেমন লাগে।"

যোগেন পেঁয়াজু খেয়ে মজা পেলো, কিন্তু বিনামূল্যে আরও একটি পাওয়ার জন্য সে অভিনয় করতে লাগলো। মুখে ভাব করলো যেন পেঁয়াজু খুবই বাজে, "ইস! এটা কি বানিয়েছো! এর চেয়ে আমি নিজে বানিয়ে খাই ভালো।" স্টলের মালিক কিছু না বলে তাকে আরেকটা পেঁয়াজু দিয়ে দিলো।

যোগেন খুশি মনে আরও একটা পেঁয়াজু খেলো, কিন্তু এবার স্টলের মালিক তাকে ধরে ফেললো। "চাচা, মেলার আনন্দ উপভোগ করতে চান করুন, কিন্তু এত কৃপণতা করবেন না।" যোগেন মিত্তির একটু লজ্জা পেয়ে, হেসে বললো, "আচ্ছা, এবার থেকে আর এমন করবো না।"

এই ঘটনার পর থেকে যোগেন মিত্তির চুরি করে পেয়াজু খাবারের কাহিনীটাও দ্রুত গ্রামে ছড়িয়ে পড়লো। সবাই হাসির ছলে বলতো, "যোগেন কাকা আর পেঁয়াজু চুরি করতে যাবে না।"

 

মেলাতে অপমানিত হওয়ার পর তাড়াতাড়ি এক ভোরে ঢাকার পথে রওনা দিলেন। ইচ্ছে ছিল দুএকটা দিন বেশী থাকার। কিন্তু মেলার ঘটনার পর তার মনটা ভালো লাগছিল না। তবে অপমানিত হলেও টাকা খরচ করতে নারাজ যোগেন মিত্তির। এবার সিদ্ধান্ত নিলেন বাসের ভাড়াটা দিবেন না। আর যদি দিতেই হয় তাহলে অর্ধেকের বেশী দিবেন না। তাই এবার নতুন একটা কৌশল খুঁজে বের করলেন।

যোগেন মিত্র যথাসময়ে  বাসে উঠলেন, একটা ফাঁকা সিট দেখে বসে পড়লেন। বাস চলতে শুরু করলো আর কন্ডাক্টর টিকিট চেক করতে আসলো। যোগেন মিত্তির ভাবতে লাগলেন কিভাবে কন্ডাক্টরকে ফাঁকি দেয়া যায়। তখনই তার মাথায় একটা বুদ্ধি আসলো। তিনি পকেট থেকে একটা পুরানো কাগজ বের করে খুব মনোযোগ দিয়ে পড়ার ভান করলেন।

কন্ডাক্টর যোগেন মিত্রের কাছে এসে বললো, "চাচা, টিকিট দেখান।"

যোগেন চাচা কাগজ থেকে চোখ না সরিয়ে বললেন, "টিকিট তো আগে থেকেই কেটে রেখেছি।" কন্ডাক্টর সন্দেহ করে বললো, "টিকিট দেখান তো।"

যোগেন চাচা খুব আত্মবিশ্বাসের সাথে বললেন, "এই যে, এই কাগজটা দেখুন।" কাগজটা ছিলো পুরানো, কোনো কাজের নয়। কন্ডাক্টর একটু অবাক হয়ে বললো, "চাচা, এটা তো টিকিট নয়।"

যোগেন চাচা ভান করলেন যেন কন্ডাক্টরের কথা বুঝতে পারেননি, "এই কাগজটা তো আপনি নিজেই দিলেন আমাকে!"

কন্ডাক্টর একটু রেগে গিয়ে বললো, "চাচা, মজা করবেন না। সত্যি টিকিট দেখান।"

যোগেন চাচা এবার একটু অসহায়ভাবে বললেন, "ঠিক আছে, ঠিক আছে, আমি তো বৃদ্ধ মানুষ, ভুল করেছি। টাকা নেই, এইবার মাফ করে দিন।"

কন্ডাক্টর যোগেন চাচার কথা শুনে একটু হেসে বললো, "ঠিক আছে চাচা, এইবার মাফ করে দিলাম। কিন্তু পরের বার কিন্তু টিকিট কাটতেই হবে।"

যোগেন চাচা ভয়ে ভয়ে সম্মতি দিলেন। কিন্তু হঠাৎ বাসটি ঝ্যাক করে এক বিকট আওয়াজে থেমে যায়। ড্রাইভার ষ্ট্রার্ট দেওয়ার চেষ্টা করছে কিন্তু ষ্ট্রাট নিচ্ছে না। কন্ডাক্টর সবাইকে নামতে বললেন-“গাড়ী আর যাবে না। আপনারা এখান থেকে অন্য বাস ধরে চলে যান।“

কিছুক্ষন আগেও যোগেন মিত্র মনে মনে হেসেছিল এই ভেবে যে "আহা, আজকেও কিছু টাকা বাঁচলো।“ এইতো দেখছি মহা ঝামেলা।

সবাই রাস্তায় দাঁড়িয়ে বাসের জন্য অপেক্ষায় আছে। পর পর কয়েকটা বাস এলেও ভীড়ের জন্য উঠতে পারেনি। কিছুক্ষন পর কোন রকমে ঠেলে ঠুলে মাথা ঘাড় বাঁকিয়ে উপচে পড়া ভীরের ভিতর দিয়েই কোন রকমে বাসের ভিতরে গিয়ে দাঁড়ালো। তবে মানুষেরা ধাক্কা খেয়েই যোগেন কিপটে ভিতরে চলে যায়। কোনমতে ডান হাত দিয়ে বাসের শক্ত ঝুলন্ত রডে হাতের মুঠি চেপে ধরে। বাসটির অবস্থাও খুব খারাপ। মানুষে গিজ গিজ করছে। আর ড্রাইভারটিও যেন মাতাল। এমন ভাবে বাসটি চালাচ্ছে ভিতরের যাত্রীদের যেন মরণ দশা। হাড্ডি-গুড্ডি সব ভেঙ্গে যাওয়ার উপক্রম। পাশেই একটি কম বয়েসী ছেলে দাঁড়িয়ে ছিল। মুখটা যোগেনের পিঠের উপর লেপ্টে আছে। ঠিক ঠাক মত নিঃশ্বাসও নিতে পারছিলনা। হঠাৎ ড্রাইভার ব্রেক কষে ধরে। সবাই হুরমুর খেয়ে পড়ে। ছেলেটি যোগেনের উপর ঝাপটিয়ে পড়ে।

যোগেন গরম তেলে ঢালা মাছের মতো ছ্যা করে তেঁতিয়ে উঠে-“এই ছোকরা, চোখে দেখতি পাস না?”-এ বলেই অকথ্য ভাষায় গালি-গালাজ শুরু করে।

-আরে রাখুনতো মহাশয়। এই ছোট্ট ছেলের সাথে কি ঝগড়া করছেন। ওর কি দোষ। সবাইর অবস্থাতো বেহাল।“

-হ্যাঁ, নাম তার বেদানা, অথচ দানায় ভরা। ছোট্ট ছেলে। বসে তো আছেন দিব্যি। পারলে কোলে নিয়ে বসান দেহি।“

 

এমনি যোগেনের মন মেজাজ গরম। তার মধ্যে বাসের কন্ডাক্টর সবাইর কাছ থেকে টিকেটের টাকা নিচ্ছে। এতো কষ্ট করে যাচ্ছে সেই দিকে বাস ওয়ালাদের কোন ভ্রুক্ষেপ নেই অথচ টাকা চাওয়ার বেলায় উস্তাদ। মনে মনে যোগেন উদের গুষ্ঠি উদ্ধার করছে। গরমে সবার পিত্তি জ্বলছে এদিকে। তার মধ্যে কে যেন করপোরেশনের গলে পচে যাওয়া আবর্জনার মতো এক হাঁড় কাপা শরীর শীর শীর করা পেট থেকে উগরে দেয়া বমির মত বিশ্রি গন্ধযুক্ত অসভ্য বাতাস শব্দ সহকারে পুরো বাসটিতে নির্দ্বিধায় এটম বোমার মতো ছেড়ে দেয়।–“ওরে বাপরে বাপ। একি! কে এই সর্বনাসটা করলো।“-এই বলে এক বৃদ্ধ চীৎকার করে হাত দিয়ে নাকের সামনে বাতাস করতে লাগলো।

আরেকজন সুর মিলিয়ে দাঁত কিরমির করে ভারী কন্ঠে দুই আক্রোশ বসিয়ে দিল-“লজ্জা শরমের বালাই নাই। জানোয়ার, সব জানোয়ারের দল। তা না হলে অমন অলুক্ষুনি কাজ।“

 

তবে যোগেনের গন্ধ-টন্ধের দিকে কোন মন নেই। তার শূধু চিন্তা যেন পুরো ভাড়া দিতে না নয়। বুদ্ধি আঁটতে থাকে। এমন সময় কন্ডাক্টর যোগেনকে বলে-“কোথায় যাবেন?”

-“ঢাকা”-যোগেন আস্তে করে বলে।

-“ঢাকার কোথায়? সদরঘাট, গুলিস্তান, মগবাজার নাকি রামপুরা।“

-রামপুরা-যোগেন উত্তর দেয়।

-ছয় টাকা দিন-কন্ডাক্টর হাত পাতে।

-ছয় টাকা কেন? আমি ত এতো টাকা দেব না।-যোগেন যেন তেতিয়ে উঠে। -“এমনিতে বসার জায়গা নেই। গিট গিট করছে মানুষে। দাঁড়িয়ে থাকারও উপায় নেই। এটা কি মঘের মুল্লুক নাকি?”

-“কি বলছেন চাচা। ভিড়? আপনি দেখেন নাই উঠার সময়। অতো সতো বুঝি না। কথা না বাড়িয়ে এখন টাকা দেন।“-ড্রাইভারের কন্ঠে বিরক্তির ভাব।

-“আমি ছয় টাকা দিতে পারবো না।“ -যোগেনের উত্তর।

-“দিতে পারবেন না মানি? এইটা কি সরকারি বাস নাকি? আবোল তাবোল না বইলা ভাড়াটা চুকে দিন।

-“বললাম তো আমি ছয় টাকা দিতে পারব না।“-এই বলে পকেট থেকে দুই টাকার দুটো ছেড়া ময়লা নোট বেড় করে ড্রাইভারের সামনে তুলে বলে-“এই নিন, দুই টাকা দিলাম।“

ড্রাইভার অবাক হয়ে যোগেন চাচার দিকে তাকিয়ে ধমকের সুরে বলে-“ধ্যা, চাচা। এটা আপনার মর্জি নাকি? দুই টাকা দেন কেন?”

যোগেন এবার একটু নড়ে চড়ে দাঁড়ায়। হাতটা হাতলে শক্ত করে ধরে। সোজাসুজি ড্রাইভারের দিকে তাকায় –“দুই টাকাই আমার পোষায়। ছয় টাকা আমার ত পোষায় না।“

কন্ডাক্টর এবার ক্ষীপ্র হয়ে উঠে-“পোষায় না মানে? ফাইজলামী করেন নাকি? পোষায় না মানে কী? যত্তো সব হাড় কিপটের দল।“-এই বলেই ড্রাইভারকে বাস থামাতে বলেন। চলন্ত গাড়ী থেকেই ধাক্কা দিয়ে বাস থেকে নামিয়ে দেন। হুমরি খেয়ে রাস্তায় পড়ে যায় যোগেন।

 

এই খবরটা কেমন করে যে যোগেন মিত্রের পাড়ায় ছড়িয়ে পড়ে।

পরের দিন রাস্তায় পালার ছেলেদের খপ্পরে পরে।

সবাই হাসির ছলে বলা শুরু করলো, "যোগেন চাচার মতো যদি আমরা কৃপণ হতাম, তাহলে বাসের টিকিটাও ফ্রি পেতাম!"

আর একজন মুখ ভেংচিয়ে বলতে থাকে –“আমার ত ভাই পোষায় না। কী চাচা

এই কথা শুনে যোগেন চাচাও হাসিমুখে বলতেন, "টাকা বাঁচাতে হলে বুদ্ধি খাটাতে হয়, বুঝেছো ছোকরার দল?"



Read full book here: Click here to download the PDF file