সায়নীর স্বপ্ন-১৩
Summary:
তিতলি কোন অবস্থাতেই এটা মেনে নিতে পারছে না।
রাগে অপমানে চোখ দিয়ে যেন আগুনের ফুল্কি বেরুতে লাগল। প্রচণ্ড রাগ হল শান্তনুর উপর। ক্লাসে স্যার আছেন, তাই এই মুহূর্তে কিছু বলা ঠিক হবে না। স্যার গেলেই ব্যাপারটা নিয়ে বোঝাপড়া করা যাবে। এর একটা বিহিত না করে যেন তিতলির নিস্তার নেই। শান্তনুর কোন রুচি আছে বলে মনে হচ্ছেনা। এই অসুস্থ মেয়েটাকে কি করে নিজের পাশে এনে বসায়। ছিঃ ছিঃ লজ্জায় মাথা কাটা যায়।
হঠাৎ তিতলির ভাবনায় ছেদ পরে স্যারের কথায়।
অঙ্কের স্যার ক্লাসে এসে ঢুকেছেন। মুখে একটা কোমল হাসি।
হ্যালো! তোমরা কেমন আছো সবাই। হলিডে কেমন কাটল তোমাদের? আর সায়নী, তুমি কেমন আছ? তোমার শরীর কেমন এখন?
সবাই এক সাথে বলে উঠল: ভাল স্যার। সায়নী আলাদা ভাবে বলল-আমি এখন ভাল আছি স্যার।
তারপর যথারীতি ক্লাস শুরু হল। আজ সায়নীকে সামনের সারিতে বসতে দেখে স্যার খুব অবাক হলেন এবং মনে মনে খুশি হলেন খুব। সায়নীকে বেশ পছন্দ করেন। অঙ্কে খুব ভাল বলে সায়নীর প্রতি স্যারের একটু অন্য রকম মনোযোগ আছে। স্যারের ধারনা একটু গাইড করতে পারলে সায়নী অলিম্পিয়াডে ভাল করবে তাতে সন্দেহ নেই।
এবার স্যার একটা লিস্ট বের করলেন ফাইল থেকে। সেই কাগজের লিস্টটি এবার টেবিলের উপর রাখলেন। সামনের দিকে তাকালেন বেশ মনোযোগ দিয়ে। এবার বললেন-শোন সবাই। আজ আমি নাম ঘোষণা করব অলিম্পিয়াডের জন্য। আমাদের ক্লাস থেকে মোট পাঁচ জনকে বাছাই করা হয়েছে। জুনিয়র স্কুল অলিম্পিয়াডের পরীক্ষা হবে ডিসেম্বরের বারো তারিখ সোমবার দিন। সর্বমোট পনের জন আমাদের স্কুল থেকে জুনিয়র অলিম্পিয়াডে অংশগ্রহণ করবে। জানুয়ারিতে হবে থানা পর্যায়ে। থানা পর্যায়ের পরীক্ষা কিন্তু আমাদের স্কুলে হবে না। হবে অন্য জায়গায়। মার্চ এবং এপ্রিল মাসে জেলা এবং বিভাগীয় পর্যায়ে পরীক্ষা হবে। এখন নামগুলি পরে শোনাচ্ছি। তারপর স্যার নাম ঘোষণা করলেন-সায়নী, শান্তনু, তিতলি------। পাঁচজনের নাম ঘোষণা করেই স্যার সবাইকে অভিনন্দন জানালেন।
তারপর স্যার আরও বললেন- আমি খুব খুশির সাথে জানাচ্ছি যে আমাদের ক্লাসে সায়নী সবার ছেয়ে বেশি নাম্বার পেয়েছে। সে জন্য সায়নীকে স্পেশাল ধন্যবাদ এবং অভিনন্দন। ওয়েল ডান সায়নী। কিপ ইট আপ।
সায়নী তখন অন্য দিকে তাকিয়ে কি যেন ভাবছে। স্যারের পরের কথাগুলি যেন শুনতে পায়নি। নিজের নামটা সবার আগে ছিল বলে খুব ভাল লাগছিল সায়নীর। খুশিতে চোখের পাতাগুলি নেড়ে উঠেছিল, গালের হাল্কা চামড়াগুলি তির তির করে দোলে উঠেছিলো, চোখে মুখে ছিল আনন্দের পরাগ, এক উচ্ছলতা। এতো ভাল আগে কখনও অনুভব করেনি স্কুলে। আজ যেন মনে হচ্ছে ও আর একা নয়। শান্তনু আছে ওর পাশে, স্যারও ওকে খুব ভাল বাসে, রিমা ম্যাডামতো সায়নীর খুব পছন্দের।
তিতলি ওকে ভাল না বাসলেও এখন আর আগের মত খারাপ আচরণ করে না।
ধীরে ধীরে সায়নী নিজের প্রতি আত্মবিশ্বাস বাড়তে শুরু করল। নিজের সম্পর্কে ইতিবাচক মনোভাব তৈরি হতে শুরু করল। স্বপ্নেরা যেন নতুনভাবে পাখা মেলে উড়তে শুরু করেছে। এ মুহূর্তে ওর আনন্দে নাছতে ইচ্ছে করছে। হঠাৎ স্যারের আওয়াজে ওর যেন ভাবনায় ছেদ পরে। স্যারের দিকে তাকাতেই স্যার বলে উঠল: কি ব্যাপার সায়নী, তুমি কি কোন কিছু নিয়ে ভাবছ মনে হয়।
সায়নীঃ না স্যার, আমি সরি
স্যারঃ ঠিক আছে। বলছিলাম, তুমি মনোযোগ দিয়ে পড়াশুনা করবে। ডিসেম্বরে অলিম্পিয়াড। তোমাকে কিন্তু ভাল করতে হবে। তাছাড়া ডিসেম্বরে তোমাদের বার্ষিক পরীক্ষাও আছে।
সায়নী- ঠিক আছে স্যার।
এই তোফায়েল স্যারকে সকলেই ভয় পায়। এক কথার মানুষ। খুব কড়া মেজাজের। যেখানে প্রশংসা করার প্রয়োজন সেখানে অবশই প্রশংসা করবে, এতটুকুও কার্পণ্য করবেন না। কিন্তু যেখানে প্রয়োজন সেখানে শাস্তি দিতেও ভয় পান না। যেমন এক হাত দিয়ে ভালোবাসা দিতে জানেন ঠিক তেমনি অন্য হাতেও তিরস্কার ও শাস্তির বিষ উগড়ে দিতে দ্বিধা-বোধ করেন না।
হঠাৎ স্যারের দৃষ্টি গেল তিতলির দিকে। তিতলি অবয়বে যেন বৈশাখী আকাশের কৃষ্ণকায় মেঘ জমা হয়েছে। বিড়বিড় করে কিছু একটা বলছে। ঠোঁটের উঠানামা দেখেই বুঝতে অসুবিধা হল না যে তিতলি কোন কারণে অখুশি। ভ্রূ-কুচকে অঙ্গুলি হেলিয়ে বেশ ধমকের সুরে এবার তিতলিকে ডাকলেন-তিতলি কি হয়েছে? বিড়বিড় করে কি বলছ? আর মুখটা এত গম্ভীর কেন?কোন সমস্যা
স্যারের কথা শুনে তিতলি চমকিয়ে উঠে। পাছে ওর বিরক্তি-ভাব প্রকাশ পায় নিজকে সামলিয়ে নিয়ে একটু স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করলো। নড়ে চড়ে বসে মুখে একটা অপ্রয়োজনীয় হাসি চেপে বলে উঠল-না স্যার। আমি ঠিক আছি। আপনার কথা শুনছিলাম।
স্যারঃ বেশ ভালো।
তারপর বেশ কিছুক্ষণ ক্লাস নেওয়ার পর অংকের শিক্ষক বিদায় নেন। স্যার ক্লাস থেকে বের হতে না হতেই তিতলি নিজের চেয়ার থেকে উঠে এসে শান্তনুর ডান পাশে এসে দাঁড়ায়। শান্তনু কিছু বুঝে উঠার আগেই তিতলি শান্তনুর ডান হাত খাবলে ধরে টানতে টানতে ক্লাসের বাইরে নিয়ে আসে আর জোড়ে জোড়ে বলতে থাকে-শান্তনু, তুমি কেন সায়নীকে আমার পাশে ডেকে এনে বসালে? তুমি ভালভাবে জানো আমি ওকে পছন্দ করি না। তুমি কি ইচ্ছা করেই কাজটা করলে, আমাকে অপমান করার জন্য?
শান্তনু-তোমাকে অপমান করব কেন। সায়নীতো আমাদেরই সহপাঠী। সামনে সারিতে বসলে ক্ষতি কোথায়। আর ওতো আমার পাশে বসেছে। সেতো তোমার কোন ক্ষতি করেনি?
তিতলিঃ তুমি কি বলছ এইসব। তুমি জানো না ও একটা অসুস্থ মেয়ে। আমাদের ক্লাসেতো কেউ ওকে দেখতে পারে না।
শান্তনু: শুধু তুমি দেখতে পার না। তুমিই সবাইকে বলে রেখেছ যেন সায়নীর সাথে কথা না বলে। কেন তুমি এসব করছ তিতলি। সায়নী তো কারো কোন ক্ষতি করছে না? সব সময় তো চুপচাপই থাকে স্কুলে। আর তুমি ওকে অসুস্থ বলছ কেন। আমরাতো সবাই জানি ও একজন অটিস্টিক। তাছাড়া সেতো এমন কিছু করছেনা যাতে আমাদের কোন ক্ষতি হচ্ছে। বরং আমাদের সকলেরই উচিত সায়নীকে ভালবাসা, ভালো ব্যাবহার করা। একজন সহপাঠীর সাথে মিলেমিশে থাকাটাইতো আমাদের সকলের উচিত। দেখনা রিমা মাডাম সবসময় কিভাবে কথা বলে, সবার সাথে কি সুন্দর করে কথা বলে। আমাদের সবাইকে একসাথে পড়াশুনা করতে বলে। মিলেমিশে থাকার মধ্য একটা আনন্দ আছে। তুমি একটু চেষ্টা করে দেখ খুব আনন্দ পাবে।
তিতলিঃ উম, হ্যাঁ, মানে, আমি সত্যিই তাকে পছন্দ করি না। সে সবসময়... আমি জানি না... সে আমাকে অস্বস্তিকর করে তোলে। ওকে আমি কেন জানি একদম সহ্য করতে পারি না।
শান্তনু: সত্যি? কেন তুমি তার সম্পর্কে এত বিরক্ত? তুমি তো খুব ভালো ছাত্রী। আমিতো জানি তোমার মনটা খুব ভাল। তুমি সামনা সামনি যাই বল না কেন তুমি আসলে একটা ভাল মানুষ।
তিতলিঃ তোমাকে এটা বোঝানো সত্যিই কঠিন। আমি শুধু তার চারপাশে এক অদ্ভুত অনুভূতি পাই। আমি দুঃখিত, আমি জানি এটা সম্ভবত নির্বোধ শোনাচ্ছে। তবু কেন জানি ওর অদ্ভুত আচরণ আমার ভালো লাগে না। তাছাড়া পোকামাকড় আমি একেবারে সহ্য করতে পারি না। দেখনি ও সারাক্ষণ পোকামাকড় নিয়ে থাকে। কি বিচ্ছিরি কাণ্ড! আমাকে তুমি বোঝানোর চেষ্টা করো না।
শান্তনু: না না নির্বোধ শোনাবে কেন। তোমার অনুভূতিকে আমি মানছি এবং অবজ্ঞাও করছি না কিন্তু, আমার মনে হয় সায়নীকে আমাদের বন্ধু হিসাবে নেওয়াটাই সবচেয়ে ভাল দেখাবে। তুমি অন্তত আমাকে বিশ্বাস করতে পার, তাই না? তুমি আমাকে ভুল বুঝ না। চল আমরা সবাই এক সাথে চলি। আমরা একে অপরের কাছ থেকে অনেক কিছু জানতেও পারব। এতে আমাদের সকলেরই মঙ্গল।
তিতলিঃ আমি জানি, আমি তোমাকে বিশ্বাস করি। এটা সে সম্পর্কে নয়, এটা শুধু... আমি জানি না এটা কিভাবে ব্যাখ্যা করব।
শান্তনু: ঠিক আছে,তিতলি। তোমাকে আর আমতা আমতা করতে হবে না। তোমাকে কোন কিছু ব্যাখ্যাও করতে হবে না। তবে আমার অনুরোধ একজন ভাল বন্ধু হিসাবে তুমি সায়নীর প্রতি রাগ করো না। আজ থেকে সায়নীকে এখানেই বসতে দাও। দেখবে আমাদের ভালবাসা পেলে সায়নী একেবারে স্বাভাবিক হয়ে যাবে।
তিতলিঃ কিন্তু আমি সবই বুঝলাম। তারপরেও---
শান্তনু তিতলির কথা থামিয়ে দেয়। সাথে সাথে বলতে থাকে-আমি এটা বুঝি, কিন্তু আমার মনে হয় একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আছে যা তুমি হয়তো উপেক্ষা করছ। সায়নী অটিস্টিক, এবং সে পৃথিবীটাকে ভিন্নভাবে দেখে। এটা তার দোষ নয়, সে কেমন আছে। অন্তত তুমি সেটা ভুল করতে পারনা। তুমি খুব বুদ্ধিমান। তুমি বরং তোমার বন্ধুদেরকে বোঝাবে যেন সায়নীর সাথে ভালো ব্যবহার করে। তাছাড়া তুমি যখন সায়নীকে ভালভাবে গ্রহণ করতে পারবে অন্যরাও তখন দেখবে তোমাকে ফলো করবে।
তিতলিঃ আমি জানি কিন্তু তার সাথে খুব তাড়াতাড়ি সম্পর্ক তৈরি করা আমার পক্ষে এখনও কঠিন।
শান্তনু: আমি বুঝতে পারি যে এটি চ্যালেঞ্জিং, কিন্তু তার কথা ভেবে একটু চিন্তা করো। বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের মাধ্যমে, আমরা সায়নীর জীবনে একটি বড় পার্থক্য নিয়ে আসতে পারি।
তিতলি (একটু গভীরভাবে কিছু ভাবল): আমি বুঝছি তুমি কি বলছ। আমি আগে কখনো বুঝতে পারিনি এটা এত বড় একটা ব্যাপার।
শান্তনু: এটা সত্যিই একটা বড় ব্যাপার। তবে একটু অন্যভাবে দেখলেই ব্যাপারটা সত্যি সহজ। শুধু কল্পনা করে দেখ যে সায়নীর কাছে এটা কতটা অর্থবহ হবে যদি সে দেখতে পায় তার সমবয়সী ক্লাস সহপাঠীরা তার সাথে মন খুলে কথা বলে, এক সাথে খেলাধুলা করে, মিলেমিশে পড়াশুনা করে, একে অপরকে সাহায্য করে এবং ভালবাসে। সে বুঝতে পারবে সেও সকলেরই একজন। নিজকে আর কখনো একা একা ভাববে না। এছাড়া, এটি আমাদের জন্য অন্যদের প্রতি আরও সহানুভূতিশীল হয়ে মানুষ হিসাবে শেখার এবং বেড়ে উঠার একটি সুযোগ তৈরি করবে।
তিতলিঃ তুমি ঠিক বলেছ। আমি তার প্রতি এতটা নেতিবাচক থাকার জন্য দুঃখিত। আমি এখন থেকে বন্ধুত্বপূর্ণ ভাবে চলার চেষ্টা করবো এবং ওকে ভালভাবে বোঝার চেষ্টা করব।
শান্তনু: শুনে খুব খুশি হলাম তিতলি। আমি জানি তুমি সত্যি ভালো। তোমরা এই ইতিবাচকতার জন্য মন খুলে কথা বলার জন্য আমি তোমার জন্য গর্বিত। এবং কে জানে, হয়তো তুমি দেখতে পাবে যে সায়নীর কাছে বন্ধু হিসেবে অনেক কিছু দেওয়ার আছে।
তিতলি ক্লাস রুমে ঢুকে সোজাসুজি সায়নীর কাছে চলে আসে। এক মুহূর্ত সায়নীর দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর সায়নীকে আলিঙ্গন করার জন্যে দুহাতে বুকে টেনে নেয়।
এমন সময় মিস রিমা মুখে উজ্জ্বল হাসি নিয়ে ক্লাসে প্রবেশ করলেন। ক্লাসের সামনে বসার সাথে সাথে সে লক্ষ্য করলো কৌতূহলী সব দৃষ্টি তার দিকে স্থির হয়ে আছে। তিতলি তখনো সায়নীর সাথে আলিঙ্গন বদ্ধ। মিস রিমার কণ্ঠ শুনেই সবাই যার যার চেয়ারে বসে পরল। তিতলির এমন ব্যাবহারে সায়নী একেবারে বাকরুদ্ধ। নিজের চোখে মোটেও বিশ্বাস করতে পারছিলনা।
হ্যালো, ক্লাস, শুভ সকাল, তোমরা কেমন আছ সকলে।
আজ আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি তোমাদের সাথে ক্লাস শুরু করার আগে একটা গল্প শেয়ার করব। আশা করি তোমাদের ভাল লাগবে। কি বল। বলব?
জী ম্যাডাম-সকলে এক সাথে সায় দিলো।-খুব ভাল হবে মিস রিমা
গল্পটি একটি অসাধারণ মেয়েকে নিয়ে। তাহলে মনোযোগ দিয়ে শোন। মেয়েটির নাম কেয়া। তোমাদের মতই বয়স হবে। হাইস্কুলে পড়ে।
কেয়ার কথা শোনার পর ছাত্রদের মধ্যে ফিসফিস ও কৌতূহলী দৃষ্টির উদ্রেক হয়। ক্লাসরুমের কোণে বসে থাকা শান্ত মেয়ে সায়নীকে নিয়ে ক্লাসের সকলেই প্রায়শই ভাবত।এ আবার কোন কেয়া?
-“কেয়া একজন অসাধারণ মেয়ের নাম-মিস রিমা এবার শুরু করলেন, তার কণ্ঠ উষ্ণতায় ভরা। -কেয়ার কাছে বিশ্বটা একটু অন্যরকম ছিল। তাই অনেকেই তাকে বুঝতে পারতোনা। কেয়া ছিল একজন অটিস্টিক শিশু।“
মিস রিমা কেয়া সম্পর্কে বলে যাচ্ছেন। তিনি কেয়ার অটিজমের কারণে যে চ্যালেঞ্জগুলির মুখোমুখি হতে হয়েছিল - সামাজিক যোগাযোগের অসুবিধা, নিজের সাথে লড়াই এবং মাঝে মাঝে অনেকের সাথে ভুল বোঝাবুঝি-এসব কথা বলছিলেন। স্কুলে কেয়াকে কেউ ভালোবাসতো না। কেয়াদের পরিবার ছিল খুব দরিদ্র। কিন্তু সব কিছুর মধ্যেও একটা জিনিস লক্ষণীয় ছিল – শিল্পের প্রতি কেয়ার অদম্য আগ্রহ এবং আবেগ। সে প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হওয়া সত্ত্বেও, কেয়া কখনোই তার স্বপ্ন ছেড়ে দেয়নি।
মিস রিমা বলে চললেন, কিন্তু, তার চোখ ছিল প্রশংসায় জ্বলজ্বল। “-কেয়া তার শিল্পকর্মে তার হৃদয় এবং আত্মা ঢেলে দিয়েছিল। গান করতে খুব ভাল বাসত কেয়া। রেডিও কিংবা টিভিতে কোন গান শুনেই নিজে নিজে সুর তুলে গাইতে পারত। কেয়ার কণ্ঠ ছিল অসাধারণ এবং মিষ্টি, যাকে বলে কোকিল কণ্ঠি।“
ছাত্ররা মনোযোগ দিয়ে শুনছে আর কেয়াকে নিজেদের মধ্যে কল্পনা করছে। মিস রিমার গল্প বলার ঢং দেখে সবাই যেন মুগ্ধ। তন্ময় হয়ে শুনছে মিস রিমাকে।
-“আমি কেয়াকে চিনতাম। তার জীবনের নানাদিক আমাকে ভীষণভাবে নাড়া দিয়েছে, অনেক কিছু শিখিয়েছে”- মিস রিমার কণ্ঠ আবেগে ভরা।
-“তোমাদের সব সময় মনে রাখতে হবে যে আমাদের কখনই সংকল্প এবং আবেগের শক্তিকে অবমূল্যায়ন করা উচিত নয়। আমাদের প্রত্যেকেরই নিজস্ব একটি অনন্য শক্তি এবং প্রতিভা রয়েছে। সেগুলিকে সম্পূর্ণরূপে আমরা লালন এবং ধারণ করব কিনা সেটা সম্পূর্ণরূপে আমাদের উপর নির্ভর করে। কেয়ার ক্লাসের সহপাঠীদের মধ্যে একজন ছিল খুব দুষ্ট স্বভাবের ধনীর দুলারী। সংসারের দারিদ্রটা কাকে বলে সে সম্পর্কে মেয়েটির কোন ধারনা নেই। অহংকারে ভরা ছিল মেয়েটির মন। কেয়াকে দুচোখে দেখতে পারতোনা। নানা ধরনের অসভ্যতা করত কেয়ার সাথে। অথচ একদিন সেই ক্লাসের দুষ্ট মেয়েটিই কেয়ার সবচেয়ে কাছের মানুষ হয়ে উঠে। কেয়ার সমস্যাগুলিকে বুঝতে শুরু করে। কেয়ার দুঃখ-কষ্টগুলিকে নিজের মধ্যেই ভাগ করে নিতে শুরু করে। খুব উপলব্ধি করতো কেয়াকে। দুজনের মধ্যেই খুব ভাব হয়ে যায় এক সময়। সে থেকে এক সাথে বসত, খেলত, সময় কাটাত এবং খেলাধুলা করতো। সে মেয়েটি কেয়ার জন্য সব সময় লাঞ্চ নিয়ে আসত।
কিন্তু প্রথম দিকে সেই মেয়েটি কেয়াকে সঠিক ভাবে বুঝতে পারেনি। অটিজমের সমস্যা ছিল বলে কেয়া মাঝে মধ্যে বেশ অদ্ভুত আচরণ করত, সারাক্ষণ শুধু কথা বলতো, সব কিছু স্বাভাবিকভাবে করতে পারতোনা। যেমন ধর কেউ বলল একটা ছবি তুলে দিতে, দেখা গেল ছবি তুলতে অনেক সময় নিচ্ছে। তারপর যেটা তোলা হল সেটা হবে হয়তো পায়ের নীচের দিকটা অথবা মাথার উপরের দিকটা। কয়েকবার নেওয়ার পর হয়তো একটা নরমাল ছবি উঠবে। অনেক শিক্ষকও বিরক্ত হয়ে ক্লাসে কোন প্রশ্ন করত না। কারণ একটা প্রশ্ন করলে হয়ত কেয়া অন্য কিছু বলতো। কখনো আবার কিছু বলতও না। যার ফলে কেয়া সব সময় একা একা ক্লাসে বসে থাকত। স্যার হয়তো ক্লাস নিচ্ছে কিন্তু ও তাকিয়ে থাকবে অন্য দিকে।“
একদিন একটা ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর থেকে সেই দুষ্ট মেয়েটি কেয়ার প্রিয় বন্ধু হয়ে যায়।
এবার মিস রিমা একটু থামলেন। এক মনে কিছু একটা ভাবলেন।
সাথে সাথেই সবাই বলে উঠল এক সাথে-তারপর কি হল মিস রিমা। কি ঘটনা ঘটেছে?
মিস রিমা (সকলের দিকে তাকিয়ে)-“একদিন সায়েন্সের শিক্ষক ক্লাস নিতে এলেন। সেদিন শিক্ষকটি বেশ রুক্ষ মেজাজের ছিলেন। এমনিই শিক্ষকটি ছিলেন রগচটা, বদমেজাজি। দুষ্ট কিসিমের। সব সময় ছাত্রদের সাথে খারাপ ব্যবহার করতেন। বেত্রাঘাত করতেন। মেয়েদের চুল ধরে টেনে চেয়ার থেকে টেনে তুলতেন। গাল টিপে ধরতেন। ছেলেদের কানে বেশ জোড়ে মোড়ে দিতেন। কখনো কখনো দুপায়ের ভেতর দিয়ে দ-এর মতো করে বসিয়ে দুহাত দিয়ে কান ধরাতেন। খুব কষ্ট হতো ছেলেদের। সে তার শ্রেণীকক্ষকে লোহার মুষ্টি দিয়ে যেন শাসন করতো। কখনো হাসত না ক্লাসে। দয়া মায়া বলতে যেন কিছুই নেই স্যারটির মধ্যে। অজগরের মতো ওত পেতে থাকতো ফণা তোলে ছোবলের আশায়।
তাই ক্লাসের কেউই স্যারটিকে পছন্দ করত না।“
“সেদিন এই দুষ্ট শিক্ষকটিকে একটি উচিত শিক্ষা দেয়ার জন্য সে দুষ্ট মেয়েটি কয়েকজন সাঙ্গ-পাঙ্গ নিয়ে একটি দুষ্টু পরিকল্পনা করে। স্যারের চেয়ারে একটি হাল্কা রাবারের কুশন আটকিয়ে দেয়। শিক্ষক বসার সাথে সাথে একটি উচ্চস্বরে, বিব্রতকর আওয়াজ করে কুশনটি ফেটে যায়। ভয়ে স্যার চেয়ার থেকে হুরমুর করে পরে যায়। সাথে সাথে ক্লাসের সবাই হাসিতে ফেটে পড়ে।“
এতো দ্রুত ব্যাপারটি ঘটে যায় যে স্যার একেবারে হতবাক। বাকরুদ্ধ ক্ষণিকের জন্য। কিন্তু হাসি চলতে থাকলে তার মুখ রাগে লাল হয়ে গেল। তিনি কোন রকমে উঠে প্রথমে বড়ো বড়ো চোখ তোলে দুষ্ট মেয়েটির দিকে তাকালেন। তার চোখ ক্রোধে জ্বলজ্বল করছে। "এর জন্য দায়ী কে?" -উচ্চস্বরে চেঁচিয়ে উঠলেন। তার কণ্ঠ রাগে কাঁপছে।
কিন্তু মেয়েটি নির্বিকার। কেউ কিছু বলছে না।
এবার স্যার টেবিল থেকে ব্যাম্বু স্টিকটি তোলে নেন। হাত দিয়ে কচলাতে কচলাতে মেয়েটির দিকে এগিয়ে আসেন।
এদিক ওদিক আগুন জ্বলা চোখে সবার দিকে তাকালেন। আবার গর্জন করে উঠলেন। -যদি কেউ না বলিস আজ সবাইকে বেত দিয়ে পিটিয়ে পিঠের চামড়া তোলে ফেলবো। বদমাইশ কোথাকার! শয়তানের দল। বল বলছি।
হঠাৎ কেয়া মেয়েটি পিছনের সীট থেকে উঠে এসে মুখে একটা হাসি দিয়ে, সে তার হাত তুলে বলল, "আমি এটা করেছি, স্যার। আমি সরি, আমি বুঝতে পারিনি আপনি মেঝেতে পরে যাবেন। একটু মজা করার জন্যই করেছি। আমাকে শাস্তি দিন।
স্যারের রাগ ফুটন্ত বিন্দুতে পৌঁছে যাওয়ায় ক্লাসরুম একেবারে নীরব হয়ে গেল। কেয়ার কথা শুনে সবাই হতবাক। বিশেষ করে সেই দুষ্ট মেয়েটি কিছুক্ষণের জন্য একেবারে নিথর হয়ে যায়। কেয়ার স্বীকারোক্তিতে স্যার কিছুক্ষণ তাকিয়ে ছিলেন কেয়ার দিকে। তারপর কোন কথা না বলে সে স্তব্ধ এবং কিছুটা আতঙ্কিত ক্লাস রেখে রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন ক্লাস না নিয়েই।
কেয়ার জন্যই সেদিন সে মেয়েটি বেঁচে যায়।
মিস রিমা তার গল্পটি শেষ করার সাথে সাথে ক্লাসরুমের চারপাশে একবার তাকালেন। তার দৃষ্টি এবার সায়নীর দিকে গিয়ে পড়ল। কিছুক্ষণ সেখানেই স্থির হয়ে রইলো। অন্যান্য ছাত্ররা তার দৃষ্টিকে অনুসরণ করল। সবাই এবার সায়নীর দিকে তাকাল। এক নতুন উপলব্ধিতে তাদের চোখ ভরে উঠল। অনেকেরই চোখ ভারী হয়ে উঠল।
সেই দিন থেকে, সায়নীর সহপাঠীরা সায়নীকে অন্যভাবে দেখতে শুরু করে। কেয়ার গল্পের মাধ্যমে মিস রিমা সবাইকে যেন অনুপ্রাণিত করতে পেরেছে। ভালোবাসা, অধ্যবসায় এবং সাহসের সাথে সবকিছুকেই আলিঙ্গন করা সম্ভব, সেটা ক্লাসের সকলেই বুঝতে পেরেছে।
স্কুল শেষের সংকেত দিয়ে ঘণ্টা বেজে উঠলে, শিক্ষার্থীরা এক নতুন সহানুভূতি ও গ্রহণযোগ্যতার অনুভূতি নিয়ে এক একে শ্রেণীকক্ষ ত্যাগ করে। যেন খোলা হৃদয় ও মন নিয়ে বিশ্বের মুখোমুখি হতে প্রস্তুত। সকলের চোখে মুখে বাসন্তী সন্ধ্যার বাতাস যেন আছড়ে পড়ল এক নতুন সম্ভাবনার আশায়।
চলবে---)
Read full book here: Click here to download the PDF file