সায়নীর স্বপ্ন-১২
Summary:
আজ দুদিন হলো ফিরে এসেছে সায়নীরা।
রবিবার থেকে স্কুল শুরু হবে। ডিসেম্বরে ফাইনাল পরিক্ষা। এর মধ্যে আর কোন ছুটি নেই।
লন্ডন আর ম্যালোর্কাতে সময়টা খুব ভালোই কেটেছে সকলের। এই কয়েকদিন যেন এক নিমিষেই চলে গেল। কেউ বুঝতেও পারেনি। খুব হৈ চৈ করেছে সবাই। লন্ডনে প্রতিটি জায়গা উপভোগ করেছে সায়নী। প্রাচীন ক্যাথেড্রালগুলি দেখে বিস্মিত হয়েছে। বুঝ হওয়ার পর থেকে এই প্রথম বারের মতো তাকে সত্যিকারের জীবিত বলে মনে হয়েছিল। তার চোখ বিস্ময় এবং উত্তেজনায় জ্বলজ্বল করতো সব সময়। এমনটি আগে কখনো অনুভব করেনি। এ যেন তার জীবনের পরম প্রাপ্তি। এই কয়দিন সে একা ছিল না। সকলেই ছিল তার আশে-পাশে। বাবা-মা আর ছোট ভাইয়ের কাছা-কাছি থাকার পরম আনন্দ যে কি এই প্রথমবার যেন উপলব্ধি করার সুযোগ হয়েছে সায়নীর।
নিজের বেডে বসে বসে অসুস্থ সায়নী গত কয়েক দিনের কথাই ভাবছে। মাঝে মধ্যে বন্ধু সুইটির দিকে তাকিয়ে থাকে অলস ভাবে। কোন কিছুই ভালো লাগছে না সায়নীর। মনটা খুব খারাপ। সুইটির সাথে কথা বলতেও ভালো লাগছে না।
হলিডে থেকে আসার পর অনেকক্ষন বন্ধু সুইটি কোন কথাই বলেনি সায়নীর সাথে। বেশ মন খারাপ করেছিলো। সায়নী বাড়িতে এসে রুমে ঢুকেই প্রথমে সুইটির কাছে আসে। সায়নীর আগমন টের পেয়ে সুইটি নড়ে চড়ে উঠে। সায়নীর দিকে না তাকিয়ে কেমন নিরব এবং বিষন্নতার সাথে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। সায়নী তখন সুইটির কাছে গিয়ে শীস দিল, কোন সাড়া নেই। তারপর আঙ্গুল দিয়ে সুইটির পালক ছুঁতে যাবে এমন সময় সুইটি সরে গেল। সুইটির আচরনে সায়নী বেশ অবাক হলো। বুঝতে পারলো কোন কারনে সুইটি মন খারাপ করেছে।
সায়নী: ওহ, সুইটি, তোমাকে একটু বিষন্ন লাগছে। তোমার কি মন খারাপ? কোনো সমস্যা? এখন পর্যন্ত তুমি আমার দিকে তাকালেও না। এতোদিন পর তোমার সাথে দেখা হল। কি ব্যাপার?
সুইটি (এবার সায়নীর দিকে তাকাল, একটু জোড়ে শব্দ করে উঠলো, যার মানেটা সায়নী বুঝতে পারে): তুমি চলে যাওয়ার পর কেউ আমার ঠিক মতো যত্ন নেয়নি, স্কোয়াক! (জোড়ে শব্দ করে উঠা)। আমার সাথে এসে কেউ কথা বলত না। খুব একা একা ছিলাম আমি।
সায়নী: আমি খুব দুঃখিত সুইটি। আমি আসলে বুঝতে পারিনি। তোমার নিশ্চয়ই এই কয়দিন খুব কষ্ট হয়েছে?
সুইটি: স্কোয়াক!মর্জিনা আমাকে খাবার দিতে ভুলে গেছে কয়েকবার। স্কোয়াক ! কোন ফল দেয়নি।
সায়নী: এটা অবশ্যই খারাপ। আমি মর্জিনাকে বকে দেব। আমি কথা দিচ্ছি এটা আর হবে না। আমি পরের বার দাদীমা এবং মর্জিনাকে সব বুঝিয়ে দেব। এবার একটু রাগ থামাও।
সুইটি: স্কোয়াক! তুমি আমার বন্ধু। আই লাভ ইউ। তোমার সাথে কথা বলতে আমার ভাল লাগে। আমি তোমাকে মিস করেছি।
সায়নী: আমিও তোমাকে মিস করেছি, সুইটি। আমি বুঝতে পারিনি যে তোমার এতো কষ্ট হবে। আর কক্ষনো এমনটি হবে না। তুমি এবার রাগ থামাও।
সুইটি: স্কোয়াক! সত্যিই বলছো! প্রমিজ!
সায়নী: প্রমিজ
সুইটি: স্কোয়াক! ঠিক আছে, আমি তোমাকে ক্ষমা করে দিচ্ছি, স্কোয়াক! আর কিন্তু এমনটি করবে না।
সায়নী: ধন্যবাদ, সুইটি। তুমি সত্যিই খুব ভলো। এবার আমার হাতে একটা চুমু দাও। তা হলে বুঝব তুমি আমাকে সত্যি আগের মতো ভালবাস।
সুইটি: স্কোয়াক! হ্যা, চল! স্কোয়াক ! এই বলেই সায়নীর ডান হাতে ঠোঁট বসিয়ে দেয় সুইটি। পর পর তিনবার। পালক নাচাতে থাকে। পা ঘুরাতে থাকে খুশীতে।
সায়নী: থ্যাংকিউ সুইটি। আচ্ছা তোমাকে এমন লাগছে কেন। আমি লক্ষ্য করেছি তোমার পালকগুলো কিছুটা এলোমেলো। তুমি কি এ কয়দিন স্নান মিস করেছ?
সুইটি: স্কোয়াক! হ্যাঁ, আমাকে তোমার মতো গান করে কেউ স্নান করিয়ে দেয়নি। স্কোয়াক!
সায়নী: বলো কি? আমি সত্যিই দুঃখিত, সুইটি. আমি যাবার আগে নিশ্চিত হওয়া উচিত ছিল সব কিছুর যত্ন নেওয়া হবে। এটা সত্যিই খুব খারাপ! তাইতো তোমার পালকগুলো কেমন শুকনো শুকনো লাগছে।
সুইটি: স্কোয়াক! আমি তোমাকে ক্ষমা করে দিচ্ছি, কিন্তু দয়া করে আমাকে আর একা ছেড়ে যেও না, স্কোয়াক!
সায়নী: আমি করব না, সুইটি। আমি পরের বার যখন কোথাও যাবো তখন তোমার যত্ন নেওয়ার জন্য আমি ঠিক ঠাক ভাবে বলে যাবো। যেন তোমার কোন অসুবিধা না হয়।
সুইটি: স্কোয়াক! ধন্যবাদ বন্ধু. স্কোয়াক !
সায়নী: এবার আমি তোমাকে একটি মজার গল্প পড়ে শুনাই। ঠিক আছে?
সুইটি: স্কোয়াক! স্কোয়াক! স্কোয়াক! কি মজা, কি মজা।
তারপর অনেকক্ষন সায়নী সুইটির সাথে সময় কাটায়।
ঢাকায় আসার দুইদিন পর থেকেই সায়নী অসুস্থ হয়ে পড়ে। অনবরত কাশি আর বেশ শ্বাস কষ্ট হচ্ছে। গায়ে বেশ জ্বর। গতকাল রাতে ঘুমে ঘর ঘর করে আওয়াজ করছিলো। হৃদপিন্ডের গতি কয়েকবার অস্বাভাবিক ছিল। বিকেল থেকেই শরীরটা খারাপ আর জ্বর ছিলো বলে দাদীমা সায়নীর সাথেই রাতে ঘুমিয়েছে।
প্রায় সপ্তাহ চলে যায়। কিন্তু এখনও, সায়নীর উন্নতির কোনও লক্ষণ দেখা যায়নি। পরিবর্তে, তার অবস্থা আরও খারাপ হতে থাকে। ক্রমশ দূর্বল হয়ে পড়ে। খাওয়া-দাওয়ায় কোন আগ্রহ নেই। কথাবার্তা বলতে চায় না। স্কুল শুরু হয়ে গেছে। বেশ কয়েক দিন স্কুল যাওয়া হয়নি। সায়নীর বাবা ইতিমধ্যে স্কুলের হেড স্যারকে ফোন করে সব জানিয়ে দিয়েছেন।
সায়নীকে নিয়ে পরিবারের সবাই খুব চিন্তিত। একদিন সকালে সায়নীকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়।
ডাক্তার সব কিছু পরীক্ষা করলেন। বুকে এক্সরে করা হয়। সব কিছু ভালোভাবে দেখলেন। ডাক্তারটি ছিলেন সায়নীর বাবার বন্ধু। সায়নীর সব কিছু দেখে একটু গম্ভীর হয়ে গেলেন। বেশ চিন্তিত মনে হলো।
সায়নীর বাবা-মা দুজনেই ডাক্তারের দিকে হা করে তাকিয়ে থাকে। হঠাৎ বাবা জিজ্ঞেস করলেন-“কি রে কিছু বলছিস না যে!কোন সমস্যা:
ডাক্তার: এমনটি কি করে হলো? ওর কি শ্বাসক্ষট হয়েছিলো যখন স্পেনে গিয়েছিলি? কিংবা ঠান্ডা জলে নেমেছে?
স্পেনে থাকাকালীন সায়নী গুরুতর শ্বাসযন্ত্রের সংক্রমণে আক্রান্ত হয়েছিল, যা এখন নিউমোনিয়ায় পরিণত হয়েছে। তার দুর্বল ইমিউন সিস্টেমের কারণে, পরিস্থিতি একটু গুরুতর হয়ে যায়।
ডাক্তারর নির্দেশ মতো সায়নীকে হাসপাতালে ভর্তি করানো হলো। সায়নীর নিউমোনিয়া হয়েছে শুনে সায়নী মা বেশ চিন্তিত হয়ে পড়েন। প্রতি রাতে সায়নীর সাথেই হাসপাতালে থাকেন। স্পেশাল কেবিন নেওয়া হয়েছে সায়নীর জন্য। চব্বিশ ঘন্টা নার্সিং আর পরিচর্যার ব্যবস্থা।
প্রায় সপ্তাহ ধরে,সায়নী দৃঢ় মানষিকতার সাথে অসুস্থতার বিরুদ্ধে সাহসিকতার সাথে লড়াই করেছে। মাকে রাতে সায়নীর রুমে দেখে সায়নী খুব সাহস পেত। প্রথম কয়েক রাত সায়নীর কাশির কারনে পাশের কেবিনেই থাকত সায়নীর মা। কাশির কারনে যেন নিউমোনিয়া ছড়াতে না পারে। মাস্ক পড়ে মাঝে মধ্যে সায়নীকে দেখতে আসতো। তার কাশি চলে গেলে একই কেবিনে আলাদা বেডে থাকত সায়নীর মা।
বাবা-মা এ কয়দিন সায়নীর জন্য বেশ চিন্তায় ছিলেন। দিন রাত সুস্থতার জন্য প্রার্থনা করতেন। দাদীমা এর মধ্যে মাজারে গিয়ে সায়নীর জন্য প্রার্থনা করেছেন। মর্জিনাও কয়েকবার এসেছে।
এই কয়দিন সায়নীদের পুরো বাড়িটিতে আশা এবং হতাশার অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছিল।
অলৌকিকভাবে, সমস্ত প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে,সায়নীর জোয়ার ঘুরতে শুরু করে। ধীরে ধীরে সে সুস্থ হয়ে উঠে। ফিরে পায় শারিরীক শক্তি। তার চোখ আবার জীবনের আলোয় ভরে উঠে।
একদিন সকালে সায়নী বড়িতে ফিরে আসে।
পুরো দুটি সপ্তাহ স্কুলে যেতে পারেনি সায়নি।
স্কুলে যাওয়ার জন্য মনটা কেমন করছিল। অনেকদিন কারো সাথে দেখা হয় না। পুরোপুরি সুস্থ হয়ে সায়নী স্কুলে আসে। মনটা বেশ ভালো লাগছে। আজ শান্তনুর সাথে দেখা হবে। অনেক গল্প শুনাবে শান্তনুকে। লন্ডনের গল্প। মালোর্কার কাপদেপেড়া গ্রামের কথা। অন্যরাও হয়তো শুনতে চাবে। আজ সবাইকে শুনাবে। আজ মিস রিমা ম্যাডামেরও ক্লাস আছে। খুব ভালো লাগছে সায়নীর।
স্কুলে আসবে বলে সকাল থেকেই মনটা বেশ ফুর ফুরে লাগছে।
গত কয়েকমাস যাবৎ সায়নীর দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় এসেছে বেশ স্বাভাবিকতা। তাড়াতাড়ি চিন্তা করা এবং কোন কিছুতে প্রতিক্রিয়া করার দক্ষতা বৃদ্ধি পেয়েছে। কেউ প্রশ্ন করলে বা কোন কিছু জিজ্ঞেস করলে আগের মতো এতো সময় নেয় না। এখন স্বাভাবিক শিশুদের মতোই আচরন করে। এখন অনেক ক্ষেত্রেই স্বাভাবিক ভাবেই জীবনযাপন করতে পারে। তবে রাগ করলে এখনো বেশ কিছু অস্বাভাবিক কান্ড করে বসে।
গাড়ী থেকে নেমেই ব্যাকপ্যাকটি শক্তভাবে আঁকড়ে ধরে ধীরে ধীরে স্কুলের গেইটে পা দেয়। এগুতে থাকে নিজের ক্লাস রুমে। মন প্রান উচ্ছ্বাসে ভরা। ক্লাশে ঢুকতে যাবে এমন সময় পেছন থেকে শান্তনু সাইয়নীকে ডাকে।
শান্তনু: হ্যালো সায়নী! ওয়েলকাম ব্যাক টু স্কুল। তুমি এখন কেমন আছো? টিচার ক্লাশে বলছিলেন তুমি নাকি অসুস্থ।
সায়নী (একটু চোখ তুলে তাকাল শান্তনুর দিকে): ভালো। অসুস্থ ছিলাম। এক সপ্তাহ হাসপাতালেও ছিলাম। এখন ভালো। দুসপ্তাহ স্কুল মিস। খুব চিন্তা হচ্ছে। তুমি কেমন আছো?
শান্তনু: আমি ভালো। তুমি স্কুল মিস করেছ বলে কোন চিন্তা করোনা। কোন ক্লাস টেস্ট ছিল না। আগামী মাসে কয়েকটা ক্লাস টেস্ট হবে। আমি তোমাকে সব নোটসগুলি দেবো। ভেবো না।
সায়নী: সত্যিই বলছো?
শান্তনু: তোমার সাথে মিথ্যা বলবো কেন? আমি ফটো কপি করে এই সপ্তাহেই সব নোটস নিয়ে আসব।
সায়নী: থ্যাংকিউ শান্তনু।
হঠাৎ পাশ কেটে তিতলি আরো কয়েকজনকে সাথে নিয়ে কথা বলতে বলতে চল যায়। সায়নীকে দেখতে পেয়েও না দেখার ভান করে মুখটা তীর্যকভাব ঘুড়িয়ে নেয়। শান্তনুকে সায়নীর পাশে দেখে বেশ রাগে ফুলছিল কিন্তু কিছু আর বলেনি। নিজেদের সীটে গিয়ে বসে।
শান্তনু এবার সায়নীকে বলে: তোমাদের ইউরোপ ট্যুর কেমন হলো। কোথায় কোথায় গিয়েছিলে?
সায়নী: খুব ভালো হয়েছে। আমরা দুইদিন ছিলাম লন্ডনে আর বাকী আট দিন ছিলাম মালোর্কাতে।
শান্তনু: মালোর্কা? এইটা আবার কোন দেশ?
সায়নী (হাসতে হাসতে): না না এইটা কোন দেশ না। মালোর্কা স্পেনের একটা সুন্দর দ্বীপপুঞ্জ। সাগড়ের মধ্যে চুনাপাথরের পাহাড়ের দ্বীপ।
শান্তনু: তাই নাকি? আর কি কি দেখলে এই দ্বীপটিতে।
সায়নী: অনেক কিছু। খুব মজা করেছি। তবে খুব গরম ছিলো। স্পেনের ব্যালেরিক দ্বীপপুঞ্জে অনেকগুলো দ্বীপ আছে। তার মধ্যে বৃহত্তম ম্যালোর্কা। চারিদিকে শুধু পাহাড় আর পাহাড়। সবই চুনাপাথরের। তাই ম্যালোর্কাকে প্রায় সময়ই চুনাপাথরের পাহাড়ের দ্বীপ বলা হয়।
শান্তনু: তুমিতো দেখছি খুব জানো। একেবারে ট্যুরিস্ট গাইড।
সায়নী (হাসতে হাসতে): জানবইতো। ম্যালোর্কা সম্পর্কে একটা বই কিনে সব পড়েছি। একবার না কয়েকবার। জিওগ্রাফি আমার ভালো লাগে। প্রতিটি জায়গায় যাওয়ার সময় ঐ জায়গা সম্পর্কে ভালোভাবে জেনে নেই।
শান্তনু: বাহ্ বাহ্! সত্যিই সায়নী, তুমি খুব জিনিয়াস।
সায়নী: আরে নানা। কী বলছো তুমি। জিনিয়াস হলে তুমি।
হঠাৎ সায়নীর চোখ পড়লো দুরে নিজের বেঞ্চে বসে থাকা তিতলির দিকে। চোখ বড়ো বড়ো করে গাল ফুলিয়ে ওদের দিকে ফোস ফোস করে তাকিয়ে আছে। চোখে চোখ পড়তেই ঠোঁট বাকিয়ে বিড় বিড় করে কি যেন বকে যাচ্ছিল শুনতে পায়নি। তিতলি তখন মাথা ঘুড়িয়ে পাশের চেয়ারে বসে থাকা মেয়েটির সাথে কথা শুরু করে।
সায়নীর তিতলির এই কদর্যভাবে চেয়ে থাকার চেহারাটা মোটেও পছন্দ হয়নি। হঠাৎ করেই মাথায় রাগ চেপে যায়। ফোঁস ফোঁস করতে থাকে। নিংশ্বাস যেন ভারী হয়ে আসছে। হাতের আঙ্গুলগুলো রাগে কছলাতে শুরু করলো।
শান্তনু যেন সায়নীর এই অস্বাভাবিক আচরনটা বুঝতে পারলো। ঘাড় ফিরিয়ে তিতলিকে দেখতে পায়। সায়নী তখনো তিতলির দিকে তাকিয়ে আছে। চোখ দিয়ে যেন আগুন বেরুচ্ছে। পরিস্থিতিটাকে সামাল দেওয়ার জন্য এবার শান্তনু সায়নীর চোখের সামনে ডান হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলি আর মধ্যমা দিয়ে ঠোক করে একটি শব্দ করে বলতে থাকে-হ্যালো সায়নী, কী ব্যাপার? হঠাৎ করে কোথায় হারিয়ে গেলে। থেমে গেলে কেন? আর কি কি দেখলে ম্যালোর্কাতে?
সায়নী (এবার শান্তনুর দিকে তাকায়):সরি সরি। দ্বীপের সবচেয়ে সুন্দর দেখার জিনিসটি হলো চারিদিকের উপকূলরেখা। স্ফটিক-স্বচ্ছ জলের মতো যেন সাগড়ের জল। চুনাপাথরের পাহাড়ের কথাতো আগেই বলেছি। অনেক ক্যাথেড্রাল এবং বহু শতাব্দী পুরনো আইকনিক ক্যাসেল রয়েছে বেশ কিছু যা চোখে না দেখলে বুঝানো মুশকি। চোখ ধাঁধানো যেন সব কিছু। পুরো দ্বীপটির যে দিকে তাকাবে সেদিকেই যেন একটা প্যানোরামিক ভিউ চোখে ভেসে উঠবে।
শান্তনু: ঐ দ্বীপটির রাজধানীর নাম কী:
সায়নী: রাজধানী পালমা দে ম্যালোর্কা। আমরা কিন্তু পালমাতে ছিলাম না। আমরা শহর থেকে দুরে অনেক শতাব্দী পুরনো খুব ঐতিহাসিক একটি গ্রামে ছিলাম। নাম কাপদেপেড়া।
শান্তনু: তাই নাকি? গ্রামে কেন? সবাইতো বহো বড়ো শহরে থাকে।
সায়নী: আরে না। ঐটাও একটা সাজানো গুছানো শহর। বেশ পুরনো। অতীতে এইটা একটা গ্রাম ছিল। তাই লোকজন এখনো গ্রাম বলেই ডাকে। আর ঐ এলাকাটি একেবারে সাগড়ের তীর ঘেঁসে আর দুপাশে পর্বতমালা। যেন একটা স্বর্গপুরী। আর ঐখান থেকে সব জায়গাগুলি খুব কাছাকাছি।
শান্তনু: কোন পাহাড়ে উঠেছ?
সায়নী: কি বলো। অবশ্যই। দ্বীপটিইতো পাহাড়ের দ্বীপ। সবচেয়ে বড়ো এবং উচু পাহাড়ে নাম হলো পুইগ মেজর। তারপর পুইগ ডি ম্যাসেনেলা। দুটো পাহাড়েই আমরা উঠেছি। ম্যলোর্কাতে যদি কখনো যাও পোর্টো ক্রিস্টোর কুয়েভাস ডেল ড্র্যাচ দেখতে কিন্তু ভুলবেনা। এটা একটা বহু পুরনো ড্রাগন গুহা। সত্যি একটি আকর্ষণীয় প্রাকৃতিক বিস্ময়। ঐ জায়গাটা ঘুরতেই আমাদের পুরো একটা বেলা কেটে যায়।
শান্তনু: ড্রাগন গুহা? ঐখানে কী বন্য মানুষেরা থাকত?
সায়নী: তা জানি না। তবে জায়গাটা মন কাড়ানো। মাটির নীচে যে আরকটি অপূর্ব সুন্দর জগৎ আছে তা এই ড্রাগন গুহাতে না ঢুকলে বুঝানো যাবে না। প্রকৃতির কারুকার্যের শ্বাসরুদ্ধকর বিস্ময়ের প্রমাণ হিসাবে দাঁড়িয়ে আছে এই গুহাগুলি।
শান্তনু অবাক হয়ে শুনছে। মনে হচ্ছে সায়নী ওকে নিয়ে গুহাতে ঢুকছে। অন্ধকারের ভেতর দিয়ে আঁকা-বাঁকা, উঁচু-নীচু সরু পথ। সায়নীর হাত ধরে শান্তনু এগিয়ে চলছে। ভয়ে ভয়ে শান্তনু সায়নীর হাত চেপে ধরছে। আর তখনই সায়নী বলছে-“আরে এতো ভয় পাচ্ছো কেন? আমিতো আছি। কোন ভয় নেই।“
হঠাৎ সায়নীর কথায় শান্তনু ভাবনার জগৎ থেকে ফিরে আসে।–“এই যে শান্তনু কি ভাবছো?”
শান্তনু: ভাবছিলাম না। শুনছিলাম।
সায়নী: কী
শান্তনু: তোমার কথা। ড্রাগন গুহার কথা। বলো। ভেতরে ঢুকার পর কি দেখলে?
সায়নী:হাজার বছরের পুরনো গুহাগুলি। পাথর দিয়ে মোড়া চারিদিক। খুব সাবধানে পা ফেলতে হয়। প্রতিটি মোচড় খুব সরু। দুপাশে কোথাও কোথাও সোনা এবং পান্নার রঙে সজ্জিত কিছু ছোট ছোট কক্ষ আছে। খুব হালকা আলো দ্বারা চারিদিক আলোকিত যা গুহার দেয়ালে আছড়িয়ে পড়ছে। আমরা যখন হেঁটে যাচ্ছিলাম সরু পথ দিয়ে আমাদের ছায়া গুহার দেয়ালে আলোতে নড়ে চড়ে উঠছিল। সত্যিই কি অদ্ভুদ জাদুকরী পরিবেশ। গুহার ভেতর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আমরা একটা ছোট্ট লেকের পাশে এসে জড়ো হলাম। শুরু হলো এক অপূর্ব সুরের মূর্ছনা। সাথে সাথে সুস্জজিত অনেকগুলো নৌকা নানা আলোর রঙে লেকের উপর দিয়ে ভাসতে ভাসতে অনেক ধরনের খেলা প্রদর্শন করলো। পরে নৌকায় চড়েই আমরা গুহার শেষ প্রান্তে চলে এলাম।
হ্যালো-সায়নী। কেমন আছো?
হঠাৎ কারো প্রশ্নে পাশ ফিরে তাকাতেই দেখল অংকের স্যার ক্লাশে ঢুকছেন। কথা বলতে বলতে কখন যে ক্লাশের সময় হয়ে গেছে কেউ বুঝতেও পারেনি।
গুড মর্নিং স্যার। ভাল আছি স্যার-সায়নী ঝট পট করে উত্তর দেয়। সায়নীর এতো তাড়াতাড়ি উত্তরে অংকের শিক্ষক কিছুটা অবাকই হলেন। আগে তো কখনো এতো তাড়াতাড়ি কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলে সায়নী উত্তর দিত না। আজ অন্য দিকে নয় স্যারের দিকে তাকিয়েই সায়নী বরং উত্তর দিয়েছে। বেশ স্বাভাবিক লাগছে সায়নীকে। অংকের স্যার মনে মনে বেশ খুশি হলেন।
তারপর সায়নী ক্লাশে ঢুকে নিজের নির্দিষ্টে জায়গায় বসতে যাচ্ছিল ঠিক এমন সময় শান্তনু পেছন থেকে ডাকলো-“সায়নী, এখানে এসে বসো। আজ থেকে তুমি এখানেই বসবে।“-এ বলেই শান্তনু নিজের পাশের চেয়ারটা দেখিয়ে দেয়। ঐ খালি চেয়ারটায় একটা বই রেখেছিল শান্তনু যেন অন্য কেউ বসতে ন। পাড়ে।
হঠাৎ ব্যপারটা সায়নী বুঝতে পারেনি। কয়েকটা সেকেন্ড সময় নেয়। ঘাড় ফিরে তাকাতেই পেছন থেকে শান্তনু চোখের ইশারায় সায় দেয় আর ডান হাতে পাশের সীটটা দেখিয়ে দেয়। তিতলি সহ সামনের দিকে বসা অনেকেই বোবার মতো তাকিয়ে থাকে সায়নীর দিকে।
সায়নীর মগজের কোষে কোষে হঠাৎ করেই যেন রক্তের প্রবাহ বেড়ে যায়। কিশোরী মনের হৃদ যন্ত্রটা ঠক ঠক, ঠক ঠক, ঠক ঠক করে যেন উদ্যাম গতিতে চলতে শুরু করে। কপালে ভাঁজে কি এক সুন্দর আল্পনা ফুটে উঠছে। মুখ থেকে বেড়িয়ে এলো অস্ফুট স্বরে-থ্যাংকিউ।
চলবে---)
Read full book here: Click here to download the PDF file