সায়নীর স্বপ্ন-১০


Author: ড. পল্টু দত্ত

সায়নীর স্বপ্ন-১০

Summary:

তমালের জন্ম দিনের পর মাস খানেক কেটে গেল।

নিয়মিত সায়নী স্কুলে যায়। ঐদিনের ঘটনার পর সায়নীর মধ্যে একটা পরিবর্তন আসে। আগের মতো উত্তেজিত পরিবেশ হলে আর বেশী রাগ করে না। পড়াশুনায় আগের চেয়ে একটু বেশী মনোযোগী হয়েছে। দাদীমার সাথে আগের চেয়ে বেশী সময় কাটায়। গল্পশোনে। সুইটির সাথেও সময় কাটায় বেশ। মর্জিনার সাথে ঘন ঘন পাশের খালুদের বাগানে যায়।

তবে সেদিনের পর থেকে সায়নীর মায়ের মধ্যেও যেন একটা সুক্ষ্ম পরিবর্তন এসেছে। এখন সপ্তাহে অন্তত কয়েকবার সায়নীর রুমে আসে। আগের মতো আর দড়জায় নক করে না, বরং দড়জার কাছে এসে ডাকে-মা সায়নী, তুমি রুমে আছো?

সায়নীর দরজা অবশ্য সব সময়ই খোলা থাকে। শুধুমাত্র রাতে ঘুমুতে যাওয়ার সময় দড়জা বন্ধ করে দেয়।

মায়ের শব্দ শুনেই সায়নী দড়জার সামনে এসে হাজির হয়। মুখটা হাসিতে ফুটে উঠে। মাকে নিয়ে নিজের রুমে বসায়। মায়ের দিকে তাকিয়ে বলবে-কেন এসেছো মা? কিছু বলবে?

মা: তোমাকে দেখতে এলাম। কি করছিলে?

সায়নী: পড়াশুনা

মা: খুব ভালো

তারপর দুজনে বেশ কিছুক্ষন গল্প করবে। কখনো সখনো সায়নীর মা সায়নীর চুল আঁচড়িয়ে বেনী বেঁধে দিবে। আবার এক সাথে সুইটির সাথে খেলায় যোগ দিবে।

 

মায়ের এই পরিবর্তনে সায়নী খুব খুশী।

এখন তমালের সাথেও সায়নী সময় কাটায়। বিশেষ করে যেদিন স্কুল থাকে না।

গত সপ্তাহে মা সায়নীকে ডেকে বলেছে-“মা সায়নী, তুমি মাঝে মধ্যে তমালের সাথে খেলো। ওতো এখন বড়ো হচ্ছে। তোমার সঙ্গ পেলে তমালেরও খুব ভালো লাগবে।

-ঠিক আছে মা, আমিতো তমালের সাথে খেলতেই চাই। আমি খেলব।

মা: তবে পড়াশুনার যেন ক্ষতি না হয়। উইকেন্ডে বেশী সময় দিবে।

সায়নী: ঠিক আছে মা। তাই হবে।

 

সেই দিনের পর থেকে সায়নী তমালের সাথে নিয়মিত খেলে। শুক্রবারটা এলেই তমাল নিজেই সায়নীর রুমে চলে আসে। এক সাথে গেইম খেলে। সুইটির সাথে কথা বলে। ছাদে গিয়ে সময় কাটায়। খুব ভালোই সময় কাটে দুজনের।

হঠাৎ একদিন সন্ধ্যায় বাবা-মা মর্জিনাকে পাঠালেন সায়নীকে ডাকতে। নীচের সীটিং রুমে দাদীমা এবং তমালও ছিলো। সায়নী রুমে ঢুকেই সবাইকে এক সাথে দেখতে পেয়ে একটু অবাকই হয়ে গেল। আগে কখনো বাবা-মাকে এক সাথে বসে এই ভাবে আনন্দে হাসতে দেখেনি। আর দাদীমাকেও এই ভাবে মন খুলে মার সাথে কথা বলতে দেখেনি। সায়নী মনে মনে ভাবছে -ব্যাপারটা কী?

হঠাৎ মা সায়নীকে ডাকলো-মা সায়নী, আসো, ভিতরে আসো। আমার পাশে বসো। না না, তুমি বরং সামনের চেয়ারটায় বসো।

-হ্যা, মা এখানেই বসো। তা হলে কথা বলতে সুবিধা হবে।

সায়নীর বুকটা কেমন হঠাৎ আকাশে বজ্রপাতের শব্দ শুনে যেমন কেঁপে উঠে ঠিক সেভাবেই কেঁপে উঠলো। কোন এক অজানা আশংকার ভয় এসে ভর করেছে যেন। কিছুই ঠাহর করতে পারছে না। আগে তো এই ভাবে সায়নীকে ঘটা করে ডাকেনি? আজকে কী বলবে? খারাপ কিছু নাতো। এই সব আগড়ম বাগড়ম ভাবতে ভাবতে সামনের চেয়ারটায় খুব আড়ষ্টভাবে বসে সায়নী। সাথে সাথে তমাল এসে সায়নীকে জড়িয়ে ধরে। দাঁত কেলিয়ে বলতে থাকে-আমি জানি আপু তোমাকে কেন ডেকেছে।

সায়নী (একবার বাবা-মায়ের দিকে তাকায়। তারপর তমালের দিকে তাকায়): তুই জানিস তমাল। বল ভাই বল।

তমাল (দুষ্টুমী ভরা মুখ): না, না আমি বলবো না। আমি জানি না---

বাবা: হ্য। মা। তোমাকে বলেছি একটা সারপ্রাইজ খবর দেয়ার জন্য

সায়নী (কনফিউজড দৃষ্টিতে এবার দাদীমার দিকে তাকায়। দাদীমা মিট মিট করে হাসছিলো)।: দাদীমা, তুমি কি কিছু জানো? প্লীজ বলো না।

দাদীমাঃ একটু অপেক্ষা কর। তোর বাবাই বলবে।

এবার সায়নীর মা মুখ খুললো।–“তোমাকে একটা সারপ্রাইজ দেবো। আগামী মাসে আমরা ইউরোপে যাচ্ছি। তোমার বাবা সব বন্দোবস্ত করে ফেলেছে। তোমার স্কুল মিড টার্মে দুই সপ্তাহের জন্য যাবো। তোমাকে নিয়ে এর আগে কখনো ইউরোপে যাওয়া হয়নি। খুব ভালো হবে। কি বলো তুমি।

 

সায়নী বাকরুদ্ধ। নিজের কানকেও যেন বিশ্বাস করতে পারছে না। কখনো ইউরোপে যায়নি। দুই তিনবার দেশের বাইরে গেলেও সেগুলি পার্শ্ববর্তী দেশগুলিতে। দুই দুইবার গিয়েছে ইন্ডিয়াতে, একবার নেপালে আর দুই বছর আগে গিয়েছিলো মালয়েশিয়া আর সিংগাপুরে। গত বছর সিলেটের একটা রিসোর্টে ছিলো এক সপ্তাহের জন্য। এই বার ইউরোপ! ভাবতেই অবাক লাগছে।

সায়নী (উচ্ছ্বসিতভাবে): আমরা ইউরোপ যাচ্ছি! সত্যি বলছো মা!

বাবা: তোর মা সত্যিই বলছে। তোদেরকে ইউরোপের একটা ভালো দেশ দেখিয়ে নিয়ে আসবো। দেখবি তোদের খুব ভালো লাগবে।

সায়নী: ইউরোপের কোন দেশে যাবো বাবা। কিছু ঠিক করেছো?

বাবা: হ্যারে, সবই ঠিক। টিকেট কাটা হয়ে গেছে। হোটেল বুকিং দেয়া হয়ে গেছে। সব রেডি।

সায়নী: কিন্তু কোথায় যাবো, সেটাতো বলবে আগে।

বাবাঃ আমরা যাচ্ছি মালোর্কা। তার আগে লন্ডনে দুই দিন।

সায়নী: মালোর্কা? মানে স্পেনে। লন্ডনেও থাকবো দুদিন। সত্যিই বলছো?

বাবা: সত্যিই বলছি। আর মাত্র দুই সপ্তাহ বাকী।

সায়নী খুশীতে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ায়। খুশিতে আত্মহারা। বাবা-মাকে দুহাতে জড়িয়ে ধরে বলতে থাকে-থ্যাংকিউ মা মনি। থ্যাংকিউ বাবা। পাশে দাঁড়িয়ে তমাল খুশিতে হাততালি দিতে থাকে।

তবে দাদীমা ওদের সাথে যাবেন না। দাদীমা এ কয়দিন বাড়ীতেই থাকবেন।

এবার সায়নী দাদীমার দিকে তাকিয়ে বলে: দাদীমা সত্যিই তুমি যাবে না?

দাদীমা: আমি গিয়ে কী করবো, দিদিভাই? আমার কি আর সে বয়েস আছে যে বিদেশ ঘুরতে গিয়ে আনন্দ ফূর্তি করবো?-এই বলেই দাদীমা হাসিতে ফেটে পরে।

 

সেদিনের পর থেকে সায়নী দিন গুনতে থাকে। মালোর্কা সম্পর্কে অন লাইনে ভিডিও দেখতে থাকে। মালোর্কা নাকি চুনাপাথরে ঢাকা পাহারের দ্বীপ।

কেমন করে যে অপেক্ষার দিনগুলি চলে গেলো সায়নী বুঝতেও পারেনি।

একদিন সকালে ঢাকা হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর থেকে লন্ডনের পথে বিমানটি উড়াল দিলো। দুবাই হয়ে লন্ডন।

 

ঠিক সময়েই এমিরেটস বিমানটি লন্ডনের হিথ্রো বিমান বন্দরে এসে পোঁছালো। আট ঘন্টা লেগেছে দুবাই থেকে লন্ডনে আসতে।

এই প্রথম লন্ডনে আসা সায়নীর। দাদীমার কাছে বিলেতের অনেক গল্প শুনেছে। বাবা-মা আগে কয়েকবার এসেছিলো। বিশাল এয়ারপোর্ট। অনেক মানুষের ভীর ইমিগ্রেশনের বিশাল হলে। খুব উচ্ছ্বসিত সায়নী। এতোদিন লন্ডনকে কল্পনায় ভাবতো। আজ সে লন্ডনে। ভাবতেও খুব ভাল লাগছে।

এয়ারপোর্ট থেকে বেড় হয়েই একটা ব্ল্যাক ট্যাক্সী নিয়ে সোজা চলে এলো লন্ডনের প্রানকেন্দ্র হাইড পার্কের কাছে অবস্থিত হোটেলে। হোটেলে এসে যখন পোঁছে তখন প্রায় সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসে। এই বিখ্যাত কালো ট্যাক্সীর কথা সায়নী অনেক শুনেছে। বেশ কয়েকটি ফিল্মেও দেখেছে সায়নী। এই কালো ক্যাব বিশ্বব্যাপী অসংখ্য চলচ্চিত্র এবং টিভি শোতে প্রদর্শিত হয়েছে। এই ব্ল্যাক ক্যাবটি সায়নী প্রথম দেখে ডক্টর হু ছবিতে। তারপর থেকেই এই ক্যাবের প্রতি সায়নীর আগ্রহ বেড়ে যায়। জেমস বন্ড এবং এমনকি শার্লক হোমসের মতো বিখ্যাত সিনেমা এবং শোতেও এই ক্যাবটি  ব্যাবহার করা হয়। ব্ল্যাক ক্যাবে চড়ে সায়নীর খুব ভাল লাগে।

পরের দিন সকালের ব্রেকফাস্টটা সেরেই সবাই বেড়িয়ে পড়ে। আজ সাড়াদিন শহর দেখবে। ঘুরাফেরা হবে আন্ডারগ্রাউন্ড ট্রেন আর বাসে। ডে পাস কেনা হলো কর্নার সপ থেকে।

তাদের প্রথম স্টপ ছিল আইকনিক বাকিংহাম প্যালেস। প্রহরী পরিবর্তন অনুষ্ঠানের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষারত পর্যটকদের ভিড় দেখে সায়নী বিস্মিত। সবাই লাইনে যোগ দিল।  তমাল এবং সায়নী রাজকীয় বাসভবনের জাঁকজমক দেখে অবাক হয়ে যায়। বিশ্বাস করতে পারছেনা বিলেতের লন্ডনে এখন ওরা দাঁড়িয়ে আছে রানীর বাড়ীর সামনে। ভিড়ে দাঁড়িয়ে থাকা প্রতিটি শিশু সহ প্রায় সকলেই বিস্ময়ের সাথে চোখ মেলে মুহূর্তটিকে ক্যামেরায় বন্দি করার জন্য অনবরত ছবি তুলে যাচ্ছে। কেউ কেউ আবার বড়ো ক্যামেরায় খ্যাচ খ্যাচ করে ছবি তুলছে।

 

এখানে প্রায় ঘন্টাখানেক থেকে রওনা দেয় অন্যত্র। তাদের পরবর্তী গন্তব্য ছিল টেমস নদীর ধার। নদীর পাশ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে টেমসের দুপাশের দৃশ্য দেখা। টাওয়ার ব্রীজ, লন্ডন ব্রীজ ও পুরনো রাজকীয় প্যালেস দেখাও এখানে আসার কারন। দূর থেকে রাজকীয় লন্ডন আই-এর দৃশ্য সকলকে কিছুক্ষনের জন্য হলেও বিস্মিত করে রেখেছিল।

তমাল দূর থেকে লন্ডন আইয়ের ঘুরন্ত ক্যাপস্যুলগুলি দেখেই বায়না ধরে উঠার জন্য। তারা আগ্রহের সাথে আইকনিক ক্যাপসুলগুলির একটিতে আরোহণ করে। উপর থেকে লন্ডন শহরের দৃশ্য প্রতিটি মুহূর্ত যেন বিস্ময়ের সাথে উপভোগ করছিল। লন্ডন আইয়ের উচ্চতা থেকে বিগ বেন এবং পার্লামেন্ট ভবনগুলি দেখতে দেখতে সায়নী যেন কোন রুপকথার রাজপুরীর রাজ্যে হারিয়ে যায়। তমালও বেশ আনন্দ পেয়েছে। তবে ক্যাপসুলটি যখন উপরে উঠে তখন নীচের দিকে তাকাতে কিছুটা ভয় পাচ্ছিল। চোখ বন্ধ করে রাখছিল।

এই সব দেখতে দেখতে কখন যে বেলা বেড়ে যায়। তমাল আর সায়নীর পেটে যেন গর্জন শুরু হল। বাবা-মারও ক্ষিদে পেয়েছে। চার ঘন্টার উপর হাঁটাচলা হয়ে গেছে। এবার কিছু খাওয়া দরকার। রওনা দিলো কভেন্ট গার্ডেনের দিকে। এখানে সায়নীর বাবা আগেও এসেছিলো। তাই জায়গাটা বেশ চেনা-জানা। এখানে বেশ ভালো একটা ফিস এন্ড চিপস এর রেষ্টুরেন্ট আছে। তাছাড়া রাস্তার পারফর্মারদের প্রাণবন্ত পরিবেশ দেখতে দেখতে, জমজমাট বাজারের মধ্যে দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে কভেন্ট গার্ডেনের বৈচিত্রতাও উপভোগ করা যাবে। সেখানেই  সবাই ফিস এবং চিপস সহ ঐতিহ্যবাহী ব্রিটিশ খাবারের স্বাদ গ্রহণ করেছিল।

সেখান থেকে এবার রওনা দেয় ট্রাফালগার স্কয়ারের দিকে। নেলসনের কলামের ছায়ায় দাঁড়িয়ে সবাই বেশ কয়েকটি ছবি তুলে। চারিপাশ বেষ্টিত ঐতিহাসিক দালানগুলি দেখে সায়নি অবাক হয়ে যায়। তমাল আগ্রহের সাথে ব্রোঞ্জ সিংহের উপর আরোহণ করে আনন্দে হৈ চৈ করতে থাকে। সায়নীও পর্যটকদের হাসি এবং বকবকের  মধ্যে ফটো তোলার জন্য পোজ দেয়। মাকে বলে-প্লীজ মা, ছবি নাও।

ট্রাফালগার স্কয়ারে এসে সায়নীর মনে পড়ে যায় একটি হিন্দি ছবির কথা। কিন্তু মনে করতে পারছিলো না ছবিটির নাম। বেশ কয়েকবার এই ছবিটি দাদীমার সাথে বসে বসে দেখেছে। সায়নীর খুব প্রিয় ছবি এইটি। চেষ্টা করেও যখন নামটি মনে করতে পারলো না তখন বাবাকে জিজ্ঞেস করে-বাবা তুমি কি জানো হিন্দি ছবিটার নাম যেখানে শাহরুখ খান আর কাজল অভিনয় করেছিল। অমরেশ পুরীও ছিলো। এখানের একটা দৃশ্য ছিলো।

-জানিতো। আমিওতো দেখেছি। ছবিটার নাম-“দিলওয়ালে দুলহানিয়া লে জায়েঙ্গে।“

সায়নী: ঠিক বলেছ বাবা। এখানেই ছবিটির প্রথম দৃশ্যের শুটিং হয়েছিল। তোমার মনে আছে বাবা, ঐ ছবির বলদেব চরিত্রে অভিনয় করেছিলো অমরেশ পুরী। নায়িকার জাদরেল বাবা। অমরেশ পুরী এখানে এসে পায়রাকে খাওয়ান। তখন তার মনে পরে যায় তার দেশের বাড়ী পাঞ্জাবের রৌদ্রোজ্জ্বল সরিষা ক্ষেতের কথা। তোমাকে থ্যাংকিউ বাবা এখানে নিয়ে আসার জন্য। আমার সত্যি খুব ভলো লাগছে। আমি আমার ফ্রেন্ডদের সাথে খুব মজা করে গল্প করতে পারব।

 

সাড়াদিন ঘুরাঘুরি করে সকলেই বেশ ক্লান্ত হয়ে পড়ে। আর এক দিন মাত্র লন্ডনে আছে। এর মধ্যেই অনেক কিছু দেখা চাই। ইউরোপে আসার কথা শুনে সায়নী দুটি বই কিনেছে। একটি স্পেনের মালোর্কা সম্পর্কে আর লন্ডনের উপর আরেকটি বই। এই কয়েক দিনে লন্ডন সম্পর্কে বেশ ভালোই জ্ঞান অর্জন করেছে সায়নী।

হোটেলে এসেই খাওয়া-দাওয়া সেরে নেয়। রুমে এসেই লন্ডনের উপর লেখা বইটি নিয়ে বসে। পাতা উল্টোতে থাকে। আর কি কি দেখা যায় সেই নিয়ে ভাবছে। বাবাকে জিজ্ঞেস করে-বাবা, কাল কোথায় যাবো আমরা?

বাবা: তুমিই বলো মা, কোথায় যেতে চাও?

সায়নী:আমরা কি বৃটিশ মিউজিয়াম আর কিউ গার্ডেনে যেতে পারি? শুনেছি কিউ গার্ডেনে নাকি মানুষ খেকো গাছ আছে? খুব ভয়ানক নাকি?

বাবা (হাসতে হাসতে): কে বলেছে তোমাকে? তোমার কি সত্যিই মনে হয় গাছ মানুষকে খেতে পারে? তবে কিছু কিছু গাছ আছে যারা খুব ভয়ানক। খুব পয়জনাস। আমি ফ্লরিডাতে এমন একটি ভয়ানক গাছের নাম শুনেছিলাম। কিন্তু দেখিনি। এই জাতীয় গাছগুলি সাধারনত ক্যারিবিয়ান এবং মেক্সিকো উপসাগরের বালুকাময় সৈকতে বেশী দেখা যায়।

সায়নী: আমি জানি একটি ভয়ানক গাছের নাম। তুমি কি ম্যানচিনেল ফ্লোরিডা গাছটির কথা বলছো?

বাবা: হ্যাঁ, হ্যাঁ। তুমি এইটার নাম জানো? তবে এরা লন্ডনের কিউ গার্ডেনে নেই। এই ম্যানচিনেল ফ্লোরিডা গাছটি খুব ভয়ানক। ফ্লোরিডায় এক ট্যুরিষ্ট গাইডের মুখে শুনেছিলাম। গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ড এই গাছটিকে বিশ্বের সবচেয়ে মারাত্মক গাছ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। গাছটির প্রতিটি অংশই বিষাক্ত এবং গাছটিকে না খেয়ে বা স্পর্শ না করেই বিষ সহজেই মানুষের শরীরে যেতে পারে। ঝড় বৃষ্টিতে গাছের নিচে দাঁড়িয়ে থাকলেই শরীরে বিষ চলে যেতে পারে।

সায়নী: তাহলে কিউ গার্ডেন এই গাছটি নাই। তিতলি তাহলে গপ মেরেছে?

বাবা: তিতলি কে?

সায়নী: আমাদের ক্লাশে পড়ে। ভারী দুষ্ট। ওর সাথেই আমার ঝগড়া হয়েছিলো। যার জন্য মা আমাকে খুব বকেছিল।

বাবা: তবে সেই ভয়ানক গাছটি না থাকলেও কিউ গার্ডেনটি খুব নাম আছে। বিশ্বের সেরা গার্ডেন। এখানে সারা বিশ্বের প্রতিটি অঞ্চল থেকে আনা প্রায়  ৭৫ লক্ষ গাছের নমুনা আছে। সারাদিন ঘুরলেও অনেক কিছুই দেখা বাকী থাকবে।

সায়নী:আমরা কিউ গার্ডেনে যাচ্ছিতো?

বাবা: অবশ্যই। দেশ থেকেই অন লাইনে টিকেট কেটেছি। লন্ডনে এসে কিউ গার্ডেনে যাবো না তা কি হয়। কাল প্রথমেই আমরা কিউ গার্ডেনে যাবো।

সায়নী: থ্যাংকিউ বাবা-এই বলেই সায়নী খুশিতে বাবাকে দুহাতে জড়িয়ে ধরে।

বাবা: ঠিক আছে, ঠিক আছে। এখন ঘুমিয়ে পড়ো। কাল সকালে উঠতে হবে।

 

পরিকল্পনা মোতাবেক দ্বিতীয় দিনটি লন্ডনের সবচেয়ে সুন্দর বিশ্ব বিখ্যাত বোটানিক্যাল গার্ডেন কিউ গার্ডেন পরিদর্শনের মাধ্যমে শুরু হয়। সাড়া সকালটা এখানেই কাটায়। এখানে এসে সায়নী যেন খুশিতে মাতোয়ারা। কীট পতঙ্গ আর গাছেদের সাথে সময় কাটানোর এ যেন সবচেয়ে উত্তম জায়গা।

চারিদিকে সারি সারি গাছের সবুজ পাতাগুলো মৃদ বাতাসে কি সুন্দরভাবে তির তির করে দুলছে। আকাশে নীলের ছড়াছড়ি। রৌদ্রে ভরা দিন। গার্ডেনের ভেতর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে সায়নীর কানে যেন ভেসে আসছে গাছ এবং পোকামাকড়ের একটি অনবদ্য সুরেলা সংগীত। কিছু কিছু গাছ খুব লম্বা এবং মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। গাছের শাখাগুলি যেন আকাশের দিকে প্রসারিত বাহুগুলির মতো আকাশকে আলিঙ্গন করছে। কি অপরুপ সুন্দর জীববৈচিত্র্যের ভান্ডার যেন লুকিয়ে রয়েছে এই বাগানটিতে।

যে দিকে চোখ যায় সায়নীর চোখ স্থির হয়ে থাকে জাঁকজমকপূর্ণ ওক থেকে শুরু করে সুন্দর উইলো গাছগুলোর দিকে। গাছের পাতাগুলো পরম মমতায় নিচের মাটিতে ছায়া ফেলছে। শহুরে ব্যাস্ততম জীবনের তাড়াহুড়ো থেকে শান্তিতে দুদন্ড সময় কাটানোর এ যেন নন্দিত অভয়ারণ্য। খুব গভীরভাবে সায়নী গাছের পাতাগুলির দিকে তাকিয়ে থাকে। খুঁজে পায় অসংখ্য নাম না জানা কীটপতঙ্গের। মৌমাছিরা অলসভাবে গুঞ্জন করে উড়ে যাচ্ছে অমৃত সংগ্রহের আশায়। মাঝে মাঝে সায়নী বসে পড়ে কোন খালি জায়গায়। খুঁজতে থাকে পোকামাকড়।

সকাল গিয়ে দুপুর ঘনিয়ে এলো। কিউ গার্ডেনের একটা রেস্টুরেন্টেই দুপুরের খাবারটা সেরে নেয় সবাই।

সেখান থেকে একটা ট্যাক্সী নিয়ে চলে আসে ব্রিটিশ মিউজিয়ামে। সুবিশাল হল এবং গ্যালারির মধ্যে সারা পৃথিবীর সভ্যতা যেন লুকিয়ে আছে। মার্বেল পাথরে আবৃত দেয়ালগুলি। প্রতিটি শিল্পকর্মই যেন অতীতের হারিয়ে যাওয়া গল্পগুলিকে ফিসফিস করে সায়নীর কানে বলে যাচ্ছিলো, আর তন্ময় হয়ে দেখছিলো প্রতিটি হলের শিল্প কর্মগুলিকে।

প্রায় ঘন্টা দুয়েক পরে বৃটিশ মিউজিয়াম থেকে বেড়িয়ে আসে সায়নীরা।

সোজা হোটেলে। কাল সকালে ম্যালোর্কাতে ফ্লাইট। যেতে হবে লুটন এয়ারপোর্টে। খুব সকালে হোটেল থেকে বেরুতে হবে।

এই দুদিনে সায়নীরা তাদের সাথে শুধু স্মৃতিচিহ্ন এবং ছবিই নয় তার চেয়ে যেন অনেক বেশী কিছু নিয়ে যাচ্ছে। এই অবিস্বরনীয় দুইদিনের কথা সায়নী কখনোই ভুলবে না। আজীবন লালন করবে এই মধুর লন্ডনের স্মৃতিগুলোকে।

 

হোটেলে এসে যখন পৌঁছায় তখন পশ্চিমের আকাশে সূর্য হেলে পড়েছে। আবীর ছোঁয়া সূর্যাস্তের আকাশটাকে ভারী মিষ্টি লাগছিলো সায়নীর।

চলবে---)



Read full book here: Click here to download the PDF file