পর্ব-তিন
Summary:
সায়নীর দুঃখ, কেউ ওকে বুঝতে চায় না, জানতে চায় না। বন্ধুত্বের হাত বড়িয়ে একটু ভলোবাসে না। চোখে চোখ রেখে কথা বলে না। আদর করে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় না। গভীর সখ্যতায় হাতে হাত ধরে লাফাতে চায়না। খেলার সাথী হয় না।
পুরনো স্কুলে কিছু বন্ধু থাকলেও নতুন স্কুলটিতে সায়নী খুব একা। কেউ আজ পর্যন্ত ওর সাথে বন্ধুত্ব করতে হাত বাড়ায়নি। ওকে দেখলেই সবাই ঘাড় ফিরিয়ে চলে যায়। কখনো কখনো মুখ ভেঙ্গচায়। আড় চোখে তাকায়। বির বির করে অনেকে আবার কিছু একটা বলে। সায়নীর এতে দুঃখ হয়। বুক ফুলিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। কান্নায় চোখে জল আসে। দুহাতের তালুতে জল মুছে, না দেখার ভান করে চলে যায়। এই ভাবেই কাটে সায়নীর স্কুল।
সায়নী ছাড়া সবাই এই স্কুলে পুরাতন। এই স্কুলের প্রাথমিক শাখায় সহপাঠীরা পড়াশুনা করতো। এই স্কুলের আদব-কায়দা সহপাঠীদের বেশ চেনা। ওরা একে অপরের বন্ধু। শুধু সায়নী যেন বাইরের কেউ।
প্রথম দিকে ওর আরো বেশী কষ্ট হতো। ওর অন্যদিকে তাকিয়ে কথা বলাটা ওর ক্লাশের কেউ পছন্দ করতো না। আর ওর অনবরত প্রশ্ন শোনার ভয়ে সবাই ওর কাছ থেকে পালিয়ে বেড়ায়।
প্রথম যেদিন স্কুল করতে আসে সেদিনের কথা সায়নীর বেশ মনে আছে। মাসটা ছিলো জানুয়ারী। রবিবার দিন। স্কুলের প্রথম ক্লাশ। নতুন স্কুল পোশাক পড়ে সবাই এসেছে। ক্লাশ শুরু হওয়ার আগে এক সহপাঠী সায়নীর কাছে এসে হাত বাড়িয়ে দেয়-
-মাই নেইম ইজ রিয়া। হোয়াট এবাউট ইউ?
সায়নীর চোখ অন্যদিকে। উত্তর দিলো-রিয়া
-নো, নো, দিস ইজ মাই নেইম। হোয়াট ইজ ইউর নেইম?-মেয়েটি আবার জিজ্ঞেস করলো।
-তোমার নাম রিয়া কেন?-সায়নী অন্যদিকে তাকিয়ে উত্তর দেয়
-কারন আমার নাম রিয়া। আমার আব্বু-আম্মু এ নামটা দিয়েছে। এবার তোমার নামটা বলো।
-সায়নী। পুরো নাম নুসরাত জাহান সায়নী।-সায়নী অন্যদিকে তাকিয়েই ওকে আবার জিজ্ঞেস করলো-
-আচ্ছা তুমি কি জানো টিকটিকির লেজ একটুতেই খসে যায় কেন?
-টিকটিকি? দি লিজার্ড। হোয়াই ইউ আর আস্কিং এবাউট লিজার্ড।
ওদের কথা-বার্তা শুনে আরো কয়েকজন যোগ দেয়। খুব মনযোগ দিয়ে ওদের কথা শুনছিলো।
-টিকটিকি আমার বন্ধু
-ইয়োর ফ্রেন্ড?
সাথে সাথে সবাই হা হা, হি-হি, হু-হু করে হাসা শুরু করলো। কেউ কর্কস স্বরে। কেউ বা তীর্যক ভাবে। ওদের হাসি দেখে সায়নীর খুব রাগ হলো। নিজকে অপমানিত বোধ করলো। অস্বাভাবিক কিছু মনে হলেই ওর মাথা গরম হয়ে যায়। দুকান দিয়ে মাঘ মাসের কুয়াশায় ঢাকা দূর্বা ঘাসের মতো ধোঁয়া বেরুতে থাকে।
মুহুর্তেই চোখ দুটি ছানাবড়া হয়ে উঠলো। ডানহাতের তর্জনী চোখের সামনে এনে জোড়ে ঘুরাতে লাগলো। চোখ দিয়ে যেন আগুনের গোল্লা বেড়িয়ে আসবে। চোখ দুট পেন্ডুলামের মতো অতিবেগে অনবরত ঘুরতে লাগলো। ভয়ে সবাই হুর মুর খেয়ে দৌড়াতে শুরু করলো। কেউ আবার হুমড়ি খেয়ে ক্লাশ রুমের দড়জার সামনে গিয়ে পড়লো। মুহুর্তের মধ্যে খবরটা ছড়িয়ে পড়লো সহপাঠিদের মধ্যে।
সেই থেকে এখন পর্যন্ত কেউ সহজ ভাবে সায়নীর সাথে কথা বলেনি। ওকে দেখলেই সবাই ভয়ে ভয়ে থাকে। দৌড়িয়ে পালিয়ে যায়।
তাই সায়নী খুব একা। একাই পিছনের একটি বেঞ্চে বসে। খেলার সময় একা একা মাঠের এক পাশে ফুলের বাগানের পাশে বসে থাকে। পোকামাকড়ের অন্বেষনে বসে থাকে। পোকামাকড় দেখলে খুশিতে উৎফুল্ল হয়ে উঠে। পুরো খেলার পিড়িয়ডটা ওদের সাথেই কাটায়। এতেই সায়নীর আনন্দ।
তবে কখনো কখনো সায়নী স্বপ্নে বিভোর থাকে। সায়নীর দাদীমা প্রায় সময়ই বলে-
-দাদীভাই, মাঝে মাঝে ঘুমুনোর আগে কল্পনা করো। দেখবে কল্পনা করতে করতে তুমি ঘুমিয়ে পড়বে। সায়নী শুনছে কল্পনায় নাকি সৃজনশীলতা বাড়ায়। তাই সে অনেক কিছু কল্পনা করে করে আঁকতে পারে।
কল্পনা করে বলেই সায়নী মাঝে মধ্যে ভাবে সে একদিন খুব বড়ো মানুষ হবে। একজন ভলো মানুষ হবে। অন্যানদের মতো একজন নভোচারী, ডাক্তার বা শিল্পী হওয়ার উচ্চাকাঙ্ক্ষা ওর মধ্যে নেই। তবে সায়নী জানে না ভালো মানুষ হতে গেলে কি করতে হয়। একদিন দাদীমাকে জিজ্ঞেস করেছিলো-
-আচ্ছা দাদীমা, ডাক্তার হতে গেলে কি গুন থাকতে হয়?
-তোমাকে ভালো করে সায়েন্স পড়তে হবে, পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করতে হবে। পড়াশুনার জন্য কঠোর পরিশ্রম করতে হবে।
-আচ্ছা। এখন বলো ভালো মানুষ হতে গেলে কি কি করতে হবে?-সায়নী আবার প্রশ্ন করেছিলো। দাদীমা সায়নীর এই ধরনের প্রশ্নে একটু অবাক হয়ে যায়। একটু হেসে দাদীমা বলতে থাকে-
-প্রথমেই অন্যের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। মনে রাখতে হবে পৃথিবীর প্রতিটি মানুষ সমান। কেউ ছোট-বড়ো নয়। সবাইকে শ্রদ্ধা করবে। কারো সম্পর্কে কখনো খারাপ কিছু বলবেনা। অন্যের ভালো দিকটার প্রশংসা করবে। ভালোটাকে গ্রহন করবে। আর সব সময় খোলামেলাভাবে কথা-বার্তা বলবে। কখনো কোন কিছু লুকাবে না। আর সবচেয়ে যেটা বেশী প্রয়োজন সেটা হলো ভালোবাসা। মানুষের প্রতি থাকতে হবে ভালোবাসা। কাউকে কখনো অবজ্ঞা করতে নেই।
-আচ্ছা, দাদীমা। আমার মা যে আমাকে কখনো ভালোবাসেনা। সে কি তা হলে খারাপ মানুষ
-না, না তা হবে কেন? তোমার মা একটু অন্য রকম ভালো মানুষ
-আর আমার স্কুলের সহপাঠীরা?
-তারাও ভালো। শুধু ওরা তোমাকে এখনো চিনতে পারেনি। যখন তোমাকে বুঝতে পারবে তখন দেখবে ওরাও তোমার মতোই ভালো।
-তবে আরেকটা জিনিষ তোমাকে মনে রাখতে হবে ভালো মানুষ হওয়ার জন্য
-কি দাদীমা
-রাগ করা চলবে না। মাথা গরম করা যাবে না। অন্যকে ভাল করে শুনতে হব। ছোটদেরকে স্নেহ করতে হবে, আদর করতে হবে। আর কখনো মিথ্যা বলা যাবে না।-এই বলেই দাদীমা সায়নীর থুথুনীতে ডান হাতের আঙ্গুলে হালকা করে চাপ দেয়।
সায়নীও স্বপ্ন দেখে।
স্বপ্নগুলি শক্তিশালী প্রেরণা হিসাবে কাজ করে সায়নীর জন্য। স্বপ্ন আছে বলেই সায়নী এখনো আত্মবিশ্বাসটাকে ধরে রেখেছে। একাকীত্বের জীবন থেকে কিছুটা হলেও মুক্তি পেয়েছে।
এক রাতে সায়নী এক সুন্দর এক স্বপ্নে হারিয়ে যায়। সেই রাতে সায়নী স্বপ্ন দেখলো একজন নতুন শিক্ষকের আগমন ঘটেছে স্কুলে। যার আগমনের সাথে সাথে সায়নীর জীবন পাল্টাতে শুরু করে। যার মধ্যে ছিলো সহানুভূতি ও ভালোবাসার প্রান। যার মধ্যে ছিলো অন্যকে বোঝার ও জানার আগ্রহ। সায়নীর প্রতি সেই শিক্ষকের আদর-ভালোবাসা সায়নীকে অন্যরকম করে তুললো।
দিগন্তের নীচে সূর্য ডুবে যাওয়ার সাথে সাথে, ঢাকার উপর একটি উষ্ণ আভা ছড়িয়ে, সায়নীর জীবনে এক অনন্য সুরের প্রথম বীনার তান বাজতে শুরু করলো। হঠাৎ তোতাপাখিটির আওয়াজে সায়নীর ঘুমভেঙ্গে যায়।
-গুদ মর্নিং মিস সায়নী।-তোতা পাখিটি মিষ্টি করে `গুড` এর স্থলে `গুদ` মর্নিং বলে ডাকে। তোতা পাখিটিই যেন সায়নীর এলার্ম বেল। মর্নিং স্কুল। তাই সকাল সাড়ে ছয়টার মধ্যে সায়নীকে ঘুম থকে উঠতে হয়। ঠিক সেই সময়ে তার প্রিয় পাখি বন্ধুটি সায়নীকে ডেকে তুলবে। ঘুম থেকে উঠার সাথে সাথে সায়নীকে বলতে হবে-
-গুড মর্নিং, মাই ডিয়ার ফ্রেন্ড। থ্যাংকিউ।
যদি কোন কারনে সায়নি বলতে ভূলে যায় বা বলতে দেরী করে তা হলে বন্ধু পাখিটির একটু অভিমান হয়। তখন সে একটি তীক্ষ্ণ ক্লিকিং শব্দ করে। অনবরত ক্লিকিং কুহুহু ক্লিকিং কুহুহু করে শব্দ করতে থাকে।
এই পাখিটিকে সায়নী অনেক কিছু শিখিয়েছে। যেমন, নতুন কেউ ঘরে আসলে তাকে হ্যালো বলা।-হাউ আর ইউ বলা। গুদ মর্নিং, গুদ আফ্টারনুন কিংবা গুদ ইভেনিং বলা। আই লাভ ইউ কথাটাও বলতে পারে। দাদীমাকে দেখলেই বলবে-মিষ্টি দাদীমা, কেমন আছো?
-আমি ভালো আছি মাই ডিয়ার ফ্রেন্ড। তুমি কেমন আছো?-পাখিটি তখন দাদীমার দিকে তাঁকিয়ে বলবে-আমি ভলো আছি।-সাথে সাথে একটা থ্যাংকিউ দিবে
কিন্তু সায়নীর স্বপ্ন যে একদিন সত্যিতে পরিনত হবে তা সায়নী কখনো ভাবতে পারে নি।
একদিন সত্যি সত্যিই এক নতুন মিস সায়নীদের ক্লাশে এলো। সায়েন্স পড়াবেন। আগে কখনো স্কুলে দেখেনি। জিজ্ঞেস করার আগেই মিস পরিচয় করিয়ে দেন-
-হ্যালো, ক্লাশ। গুড মর্নিং
-গুড মর্নিং মিস
-মিস রিমা। এইটা বলেই ডেকো।-তোমরা সবাই কেমন আছো আজ?
-ভালো মিস রিমা।
-আমি তোমাদের নতুন মিস। গত সপ্তাহে এই স্কুলে জয়েন করেছি। আজ থেকে তোমাদের সায়েন্স পড়াবো। আমাকে তোমরা মিস রিমা বলেই ডেকো। কিন্তু আজ যেহেতু আমার তোমাদের সাথে প্রথম দেখা তাই একটু পরিচয় হওয়াটা খুব প্রয়োজন। কি বলো?
-ইয়েস মিস রিমা।
-তাহলে শুরু হয়ে যাক। তোমরা তোমাদের নামটা বলো। বড়ো হয়ে তোমরা কি হতে চাও আর তোমাদের স্বপ্ন কি?
সবাই ম্যাডামের কথা শুনে একটু অবাক হয়ে যায়। এই ভাবে আগে কোন ম্যাডাম বা কোন স্যার তো কথা বলে নি। কথায়-বার্তায় বেশ আপন আপন। কন্ঠটা কি নরম ও মিষ্টি। আদরের ছোঁয়া। মুখে একটা মিষ্টি হাসি লেগে আছে। শাড়ীতে বেশ সুন্দর লাগছিলো মিস রিমাকে। কপালে একটা লাল টিপ। বেশ লম্বা চুল হালকা বাতাসে দুলছে। ক্লাশের সবাই অবাক হয়ে ম্যাডামের কথাগুলি শুনছিলো। বেশ কিছুক্ষন যাবৎ সায়নীও চুপচাপ। মনোযোগ দিয়েই মিস রিমার কথাগুলি শুনছিলো। বেশ ভালো লাগছিলো ওর।
তারপর একে একে পরিচয় দেওয়া শুরু হলো। কেউ বললো বড়ো হয়ে ডাক্তার হতে চায়, কেউ ইঞ্জিনিয়ার, কৃষিবিদ, পাইলট, ব্যাবসায়ী, এস্ট্রোনট, ব্যাংকার কিংবা একজন বলেছে এমবাসেডর হতে চায়। মিস রিমা প্রত্যেকের কথা শান্তভাবে শুনছিলেন।
এবার সায়নীর পালা। সে সবসময়ই পিছনের সীটটিতে বসে। কেউ ভূল করেও এখানে বসবে না।
যখন সায়নী কিছু বলতে যাবে তখন ক্লাশের সবাই ফ্যাল ফ্যাল করে তীর্যক চোখে-মুখে কেমন হালকা ভাবে সায়নীর দিকে তাকিয়ে আছে। সায়নী ব্যাপারটা বুঝতে পারলো। রাগে মাথাটা গরম হয়ে উঠলো। চোখ দুটি থেকে আগুনের ফলকা যেন বেড়িয়ে আসবে। হঠাৎ দাঁড়িয়ে গেল। ডান হাতের তর্জনী চোখের সামনে ঘুরাতে লাগলো।
সবাই জোড়ে হেসে উঠলো।
মিস রিমা ব্যাপারটা লক্ষ্য করলেন। সবাইকে হাত নেড়ে থামিয়ে দিলেন-চুপ করো তোমরা।
এবার নিজের চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালেন। ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলেন সায়নীর কাছে। মিস রিমা বুঝতে পারলেন সায়নীর কোন সমস্যা আছে। তাই তার আচরন একটু অন্যরকম। অস্বাভাবিক। কাছে গিয়ে খুব নরম ও আদরের সুরে মিস রিমা বললেন-
-তুমি কোন কারনে রাগ করেছ? যদি তাই হয় আমি সরি! এবার শান্ত হয়ে বসো। আমি তো তোমার বন্ধু।
-আমার বন্ধু! -অবাক হয়ে সায়নী মিস রিমার দিকে তাঁকিয়ে থাকে। চোখের কোনটা নিজের অজান্তেই ঝাপসা হয়ে এলো। বুঝতেও পারেনি তর্জনী ঘোরানো কখন যে থেমে যায়।
-হ্যা, তোমার বন্ধু। তোমরা সবাই আমার বন্ধু। আমি তোমাদের বন্ধু হতে পারি না?
-অফ কোর্স মিস রিমা-এই বলেই সবাই হাততালীতে মেতে উঠলো। সায়নীও সবার সাথে যোগ দিল। এবার সোরগোল থামলে সায়নী বলতে শুরু করে-
-আমার নাম সায়নী। বড়ো হয়ে আমি একজন ভালো মানুষ হতে চাই। আমার স্বপ্ন হলো একদিন সবাই আমাকে ভালোবাসবে। সবাইকে নিয়ে আমি খেলে বেড়াবো, মনের কথাগুলিকে ভাগ করবো সবাইর সাথে। আমার পরিবারের সবাই আমাকে ভালোবাসবে। আদর করে কাছে টেনে নিবে। আমি সবার ভাল বন্ধু হতে চাই।
ওর কথাগুলি শুনে ক্লাশের সবাই বেশ অবাক হয়ে যায়। বিশেষ করে মিস রিমা। এক দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে। ধীরে ধীরে ওর কাছে আসে। ডান হাত বাড়িয়ে দেয়।
-আজ থেকে তুমি আমার বন্ধু। -এই বলেই সায়নীকে বুকে জড়িয়ে নেয়।
এই ভাবেই শেষ হলো সেদিনের প্রথম ক্লাশটি নতুন ম্যাডাম মিস রিমার সাথে।
হঠাৎ করেই যেন সায়নীর স্কুলের কড়িডোরে পরিবর্তনের একটি মৃদু বাতাস বয়ে গেল। কিছু পাখি কিচির মিচির করে জানালার পাশ দিয়ে উড়ে গেল। মনটা বেশ উৎপল আনন্দে নেচে উঠছে সায়নীর। কেমন উদাস করা ভাব। কিশোরী বয়সের মনের উচ্ছ্বাস অনুভব করতে পেরে বুকটা আনন্দে নেচে উঠলো। এই প্রথম এমন একটি মুহুর্ত সায়নী এই স্কুলে এসে উপলব্ধি করলো। ভীষন ভালো লাগছে ওর। নিজের অজান্তেই চোখের কোন দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়লো দুগাল বেয়ে।
বাইরে তখন নরম রোদের হালকা আলোয় একদল ঘাস ফড়িং ডানা মেলে ছন্দের দোলায় উড়ে বেড়াচ্ছে।
মিস রিমা ছিলেন পদ্মা নদীর মতো বিস্তৃত হৃদয়ের নতুন শিক্ষিকা। ক্লাশের প্রতিটি শিশুর মধ্যে এক নতুন সম্ভাবনাকে দেখতে পেয়েছেন। প্রথম দিনেই আদর আর ভালোবাসা দিয়ে মন জয় করেছেন সকলের।
ধৈর্য এবং বোঝাপড়ার ক্ষমতা মিস রিমার খুব প্রখর। আর তাইতো সায়নীর তর্জনী ঘুরাতেও তিনি রাগ করেননি। বরং সায়নীকে বুঝতে পেরেছিলেন, তার সমস্যাকে অনুধাবন করতে পেরেছিলেন।
মিস রিমা অত্যন্ত ভালো একজন শিক্ষক। তিনি জানেন এবং বুঝেন যে শৈশবের যাত্রা একটি অসাধারণ অভিযান। নতুনত্বের আবিস্কার, চ্যালেঞ্জ এবংউচ্ছ্বাসে ভরা। জীবনের এই গুরুত্বপূর্ণ সময়ে, শিশুরা কোমল চারাগাছের মতো, সাগ্রহে তাদের চারপাশ থেকে পুষ্টি শোষণ করে। একটি শিশুর সামগ্রিক বিকাশে উল্লেখযোগ্যভাবে অবদান রাখে এমন সবচেয়ে গভীর উপাদানগুলির মধ্যে একটি হল উত্সাহ এবং ভালবাসা। তাই উৎসাহ আর ভালোবাসাই হলো একটি শিশুর আত্মমর্যাদা গড়ে তোলার ভিত্তি।
শিশুরা যখন তাদের ভালো কাজের ইতিবাচক স্বীকৃতি পায়, তখন তারা তাদের ক্ষমতার প্রতি মূল্যবোধ এবং আত্মবিশ্বাসের বিকাশ ঘটায়। শিশুরা, স্পঞ্জের মতো, তাদের পরিবেশ থেকে প্রতিটি শিশু শুধুমাত্র জ্ঞানই আহরন করে না, আবেগের আনন্দও আহরন করে। অসুবিধার সম্মুখীন হলে শিশুরা ভালোবাসার মানুষটির কাছেই তাদের আবেগ প্রকাশ করতে সাচ্ছন্দ্যবোধ করে। শিশুদের মানসিক স্থিতিশীলতা জীবনের উত্থান-পতনের মুখোমুখি হওয়ার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ হয়ে ওঠে।
তাই একটি শিশুর মানষিক বিকাশে, এবং উৎপল আনন্দে পড়াশুনায় মনযোগ দেওয়ার একমাত্র ঔষধ ভালোবাসা আর প্রেরনা। তাই মিস রিমা সবাইকে আপন বন্ধুর মতোই ভালোবাসেন।
মিস রিমা ক্লাশে এসেই যেন নতুনত্ব নিয়ে আসেন। শিশুদের মধ্যে সৃজনশীল কাজের প্রতি আগ্রহ বাড়িয়ে দেন। এমন একটি পরিবেশ তৈরী করেন যেখানে প্রতিটি শিশু স্বাধীনভাবে নিজেদের প্রকাশ করতে পারে। প্রাণবন্ত শিশুদের আঁকা অঙ্কন এবং চিন্তাশীল ছোট ছোট ছড়া- কবিতা দিয়ে শ্রেণীকক্ষের দেয়ালগুলি সজ্জিত করে রেখেছেন। এই শৈল্পিক আশ্রয়স্থলেই সায়নী তার কণ্ঠ খুঁজে পান।
একদিন বিকেলে, ক্লাসরুমের জানালা দিয়ে সোনালী সূর্যের আলো প্রবাহিত হওয়ার সাথে সাথে মিস রিমা একটি অভিনব শিল্প প্রকল্প শুরু করেছিলেন। প্রতিটি শিশুকে ছবি আঁকার জন্য ক্যানভাসের একটি অংশ ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল। সবাই ছবি আঁকতে বসে পড়লো। সায়নী যেন এতে বেশ খুশী হলো। রং তুলি নিয়ে বসে পড়লো। কিছুক্ষনের মধ্যে একটি অপূর্ব ছবি এঁকে ফেলে।
ছবি আঁকার প্রতি তার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি এবং রঙের একটি সহজাত বোধের সাথে সাথে, স্ট্রোক যোগ করে এমন একটি গ্রাম বাংলার ক্যানভাস তৈরী করে যা এক কথায় অপূর্ব। সায়নীর ছবি আঁকার পারদর্শীতায় মিস রিমা শুধু অবাকই হননি, সবার সামনে ঐ ছবিটি তুলে ধরে সেদিন সায়নীর খুব প্রশংসা করেছিলেন। সায়নীর চোখ তখন মিস রিমার কথায় বেশ ভেজা ভেজা হয়ে উঠছিলো।
দিন যত গড়াচ্ছে, সায়নীর স্বপ্ন দূরের কল্পনা থেকে বাস্তবে রূপ নিতে থাকে। স্বপ্নদ্রষ্টার ক্যানভাস শ্রেণীকক্ষের বাইরে প্রসারিত হয়েছে। ওর সাথে এখনো সবাই কথা না বললেও, এক সাথে খেলতে না গেলেও সবাই অন্তত এটা বুঝেছে যে সায়নীর বেশ কিছু অসাধারন গুন রয়েছে। যেমন মুখে মুখে ঝট পট করে অংক কষা, সুন্দর সুন্দর ছবি আঁকা এবং ছোট ছোট পোকামাকড় সম্পর্কে বিশেষ জ্ঞান।
ধীরে ধীরে সায়নী স্কুলটাকে ভালোবাসতে শুরু করে।
একদিন এক সুন্দর সকালে ক্লাশের পিছনের সীটে তার জায়গায় সায়নী বসে আছে এক মনে। এমন সময় ক্লাশের সবচেয়ে ভালো ছাত্রটি গোল গাল চেহারার শান্তনু ওর কাছে এসে জিজ্ঞেস করলো-
-আমি তোমার পাশে বসতে পারি?
হঠাৎ করেই যেন সায়নীর মনে লুকিয়ে থাকা ঘুঘু পাখিটা গান গেয়ে উঠলো। হৃদয়ের কোনে বাজতে লাগলো গ্রহণের সিম্ফনি, প্রতিধ্বনিত হতে লাগলো স্বপ্নপূরণের মধুর সুর।
কয়েকটি পাখি পত পত করে জনালার পাশ দিয়ে উড়ে গেল। এক অবাক দৃষ্টিতে সায়নী শান্তনুর দিকে তাকিয়ে রইলো শব্দহীন।
চলবে---)
Read full book here: Click here to download the PDF file