পর্ব-২৫
Summary:
প্রথম দেখাতে অপুর্বর মেয়ে পছন্দ হয়ে গেল।
ভারী সুন্দর নাম তনুশ্রী। পদবী রায়। তবে পদবী নিয়ে অপুর্বর কোন ভাবনা নেই। ওরা আলাদাভাবে কথা বললো প্রায় অনেকক্ষন। এদেশে জন্ম হলেও আদব কায়দা বেশ খাঁটি বাঙালীদের মতোই। কথা-বার্তা, পোশাকে, ঢংএ সব কিছুতেই বাঙালিত্বের ছাপ। কিছুক্ষনের দেখায় অন্ততঃ তাই মনে হলো।
বেশী পড়াশুনা করেনি। এ লেবেল শেষ করে আর ইউনিভার্সিটি পর্যন্ত যেতে পারেনি। হঠাৎ করেই একদিন বাবা কার এক্সিডেন্টে মারা গেলেন। তনুশ্রী তখন স্কুল শেষ করে কলেজে ঢুকেছে। বড় দাদা আর মা। ছোট সংসার। কিন্তু দাদার আয়ে যেন সংসারটা ঠিক-ঠাক মতো চলছিলো না। তাই তনুশ্রীও কলেজ শেষ করে বাড়ীর পাশেই একটি সুপার ড্রাগস-এ ফুল টাইম কাজ করছে। দুজনের আয়ে ধীরে ধীরে সংসারে বেশ স্বাচ্ছন্দ্য ফিরে এসেছে। অবসর সময়ে মাকে রান্না-বান্নায় হাত দেয়। সখ করে মাঝে মধ্যে নানা ধরনের খাবার তৈরীর প্রচেষ্টা চালায়। রান্না করতে ওর ভালো লাগে- এই কথাগুলি তনুশ্রীর মা অপুর্বকে বলে।
বিলেতে জন্ম হলেও বাংলাটা খারাপ বলেনা। ভালো ভাবেই কথা-বার্তা চালিয়ে যেতে পারে। শুধু কঠিন বাংলা শব্দ হলে বেশ অসুবিধে হয়।
তবে তনুশ্রীর বাংলা ভাষাটা বুঝতে আবার অপুর্বর সমস্যা হয়। এই ভাষাটার সাথে অপুর্বর পরিচয় বিলেতে এসে। সিলেটে কখনো যায়নি বলে এ ভাষার সাথে তেমন পরিচয় ছিলো না। ভাষাটা সিলেটি। তনুশ্রীর বাবা-মা সিলেট অঞ্চলের। প্রথম দিকে সিলেটি ভাষাটা বুঝতে অপুর্বর বেশ অসুবিধে হতো। মাঝে মধ্যে বেশ অস্বস্থিকর পরিস্থিতিতেও পরতে হতো। তবে ইদানিং মোটামুটি সবই বুঝতে পারে এবং বলতেও পারে।
প্রথম সাক্ষাতেই তনুশ্রী অপুর্বকে বলে-
-তোমার নামডা কিতা?
-অপুর্ব
-তোমার?
-তনুশ্রী
-তোমার এডুকেশান?
-আমি ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে আইছি। ডিগ্রী শেষ করছি
-কোন দেশে? এ দেশেনি?
-না, না, রাশিয়া থেইক্যা।
-তুমি রাশিয়া গেছিলা পড়ালেহার লাইগ্যা?
-হাঁ
-কবে এ দেশে আইলা?
-প্রায় এক বছর
-কিতা কইরুন?
নানা বিষয়ে তার সঙ্গে অনেক কথাই হয়। তারপর এক সময় এখান থেকে বিদায় নেয়। তবে যাওয়ার আগে মেয়ের মা অপুর্বকে জিজ্ঞেস করতে ভুলেনি-
-তোমার পুরী (মাইয়া) পছন্দ হইছে নি?
-হইছে-একটু আস্তে করেই অপুর্ব কথাটা বললো। আরিফ ভাই অপুর্বর পাশে বসেই কথাগুলি শুনছিলো।
-আমার পুরী কিছু কইছেনি?
-কিতা নিয়া?
-না, মানে তোমারে ভালা পাইছে নি। এহানে তো সব অন্য রহম। পুরীর যদি ভালা লাগে তা অইলে তো আর সমস্যা নাই
-আপনি আপনার পুরীরে জিজ্ঞেস কইরেন।
-ঠিক আছে। পুরীর লগে মাইত্যা আমরা পরে আপনাগরে জানাইতাম। ঠিক আছেনি আরিফ ভাই।-আরিফ ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে কথাটা বললেন। আরিফভাইও ঠিক আছে বলে সায় দিলেন।
-এক হপ্তার মাঝেই খবর দিবনি।
-ঠিক আছে-এই বলেই অপুর্বরা বিদায় নেয়।
তারপর সময় এগুতে থাকে। অপুর্ব কাজে খুব ব্যাস্ত। অফিস-ঘর-রান্না সামলাতেই পুরো সময়টা চলে যায়। কোন কিছু নিয়ে যেন ভাবনার ফুরসৎ নেই।
তবে এই কয়দিন তনুশ্রীর মুখটা মনে পড়ছিলো, ওকে নিয়ে ভাবতো। ভবিষ্যতের ভাবনায় মাঝে মধ্যে বুঁদ হয়ে থাকতো।
এভাবে এক সপ্তাহ যায়, দু`সপ্তাহ চলে গলো। কিন্তু আরিফ ভাই কোন খবর নিয়ে এলো না। একটু ভাবনায় পড়ে যায়। মনে মনে ভাবে বন্ধের দিনে আরিফ ভাইয়ের সাথে দেখা করবে। একটু খবরটা নিয়ে আসবে।
কিন্তু অপুর্বকে আর যেতে হলো না। সেই শনিবারই সন্ধ্যায় আরিফভাই এসে উপস্থিত। অপুর্ব ঘরে রান্না করছিলো। দরজা খুলতেই সেই অর্ধ চন্দ্রাকৃতির হাসিটি দেখতে পায়। শীত এখনো জাঁকিয়ে না বসলেও গলায় বেশ করে একটা মাফলার জড়িয়ে নিয়েছে। হালকা একটা জ্যাকেট পরনে। হাতে একটা পলিথিনের ব্যাগ।
-আপনার এতো দেরী কেন? কতোক্ষন ধরে দড়জায় নক করছি-আরিফ ভাই বলতে বলতে ঘরে এসে ঢুকলো
-রান্না করছিলাম, রান্না ঘরের দরোজাটা বন্ধ ছিলো। তাই শুনতে পাইনি। জানালাটা খুলতেই দড়জায় নক করার শব্দ পেলাম-সরি
আরিফ ভাই।
-সেটার আর প্রয়োজন নেই। তবে আপনার বুঝা উচিৎ ছিলো আজ আমি আসবো-বলেই হিল হিল করে হাসতে লাগলো।
-কি করে বুঝবো?
-তাও ঠিক, আপনি তো আবার টেলিপ্যাথি ব্যাপারটা বুঝেন না! যাক সে কথা। আগে রান্না শেষ করেন। আমি কিন্তু হাফ লিটারের
বোতল নিয়ে এসেছি। এইটা গিলতে গিলতে সব প্লান করে নেওয়া যাবে। তবে আজ কিন্তু ল্যাম্বের মাংস চাই। তাছাড়া কিন্তু জমবে
না। মাংস আছেতো?
-মাংসইতো রান্না করছি। বন্ধের দিনগুলিতে ল্যাম্ব ভূনা আমার রান্না করা চাই। তা ছাড়া কেমন শুকনো শুকনো মনে হয়।
-একটু কষা করে বানাবেন কিন্তু। আর একটু ঝালটা বেশী দিবেন।
-ঠিক আছে তাই হবে। কিন্তু আপনি কি বলছিলেন প্লান করবেন-কিসের প্লান?-অপুর্ব অধীর আগ্রহে তাকিয়ে রয় আরিফ ভাইয়ের দিকে।
-ধ্যাৎ মশায়, আপনি কি ছোট্ট খোকা কিছু বুঝতে পারেন না?
অপুর্ব আর কথা বাড়ায়নি। রান্না ঘরে চলে যায়। আরিফভাইও রান্না ঘরে গিয়ে ঢুকে।
ঘন্টা খানেকের মধ্যেই রান্নার কাজ শেষ। কথা বলতে বলতেই দুজনে মিলে সব কিছু শেষ করে। সাথে একটু একটু বোতল থেকে
গ্লাসে নিয়ে গিলতেও থাকে। ভোদকার সাথে বরফ দেওয়া কোকে চুমুক দেওয়ার মজাটাই একটু অন্য রকম।
রান্না করতে করতে অপুর্ব আরিফ ভাইকে দুএকবার ব্যাপারটা খুলে বলার জন্য জিজ্ঞেস করেছিলো। কিন্তু আরিফ ভাইয়ের একই
কথা-
-খাওয়া-দাওয়া শেষ করেই সুখবরটা বলবো এবং প্লান করবো। এখন না।
তাই তাড়াতাড়ি খাওয়া-দাওয়ার কাজটা অপুর্ব শেষ করলো। গ্লাসে আরক পেগ ঢেলে হাতে একটা সিগারেট পুঁতে দিয়ে এবার অপুর্ব জিজ্ঞেস করে-
-আরিফ ভাই, এবারতো খাওয়া দাওয়া হলো। এবার সুখবরটা দেন
-একটু বসুন, তাড়া কিসের? আগে একটা টান দেই-এই বলেই একটা লম্বা করে সিগারেটে টান দিলো। এবার অপুর্বর দিকে ঘাড় একটু বাঁকা করে তাকালো।
-এবার তাহলে বলেই ফেলি। আপনার মনে হয় আর দেরী সহ্য হচ্ছে না।
-একেবারে ঠিক, কি বলবেন, তাড়াতাড়ি বলে ফেলুন।
-আপনার শীঘ্রই বিয়ে হচ্ছে। মেয়ে আপনাকে পছন্দ করেছে। পরিবারের সবাই আপনার সাথে বিয়ে দিতে কোন আপত্তি নেই।
শুভস্যই শীঘ্রম। কনগ্র্যাচুলেশন অপুর্ব দা!
-সত্যিই বলছেন? -অপুর্বর চোখে মুখে বিস্ময়ের ভাব। বিশ্বাস হচ্ছেনা।
-সত্যি, সত্যি, সত্যি-মেয়ের মা আজ বিকেলেই আমাকে নিজে এসে খবরটা দিয়ে যায়। আমি আর দেরী করিনি, সোজা এখানে চলে আছি। পথে শুধু বোতলটা কিনে নেই।
-আমার কিন্তু এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না আরিফ ভাই
-আপনার কি করে হবে? খবরটা পেয়ে আমিওতো অবাক হয়ে যাই। কিন্তু সত্যি সত্যি আপনার খুব শিঘ্রই বিয়ে হচ্ছে। আপনার
ভাগ্যটা সত্যিই ভালো।
-কেমন করে?
-আরে মহাশয়, এক দেখাতেই বিয়ের পিঁড়ি। কতোলোক মেয়ে দেখতে দেখতে পায়ের জুতো ক্ষয় করে ফেলেছে, সেই হিসেব কি জানেন? আপনি মাত্র একজনকে দেখেছেন। এক দেখাতেই ফাটাফাটি। ভাগ্যবানতো বলতেই হবে।
-এখন কি করতে হবে?
-আগামী সপ্তাহেই যেতে বলেছে। বিয়ের ব্যাপারে কথা বলবে। দিন-তারিখ ঠিক করবে। পন্ডিতের সাথে কথা বলেছে। পঞ্জিকা দেখে ভালো লগ্ন বের করে আগামী মাসেই কয়েকটি তারিখ দিয়েছে। আপনাদেরতো তিথি-লগ্ন ছাড়া বিয়ে হয় না।
-এতো তাড়াতাড়ি? সব কিছু ম্যানেজ করবো কি করে?
-ম্যানেজ করার কি আছে!-আরিফভাই একটু ধমকের সুরে বলে।
-কেনা-কাটা, টাকা পয়সা?
-কিচ্ছু করতে হবে না। মেয়ের পরিবার সব ব্যাবস্থা করবে। মেয়ের মা আমাকে সাফ জানিয়ে গেছে-ছেলেকে কিছু কিনতে অইবো না, হগল ব্যাবস্থা আমরাই কইরাম। -সুতরাং এ নিয়ে কিছু ভাববেন না। শুভ কাজ তাড়াতাড়ি হওয়াই ভালো।
অপুর্ব আর কথা বাড়ায়নি।
উথাল-পাথাল মনের সমুদ্র। চোখে স্বপ্নের পসরা। ভাবছে আর আনন্দে উদ্বেলিত হচ্ছে।
হঠাৎ করেই জানালা দিয়ে একটি প্রজাপতি রুমে এসে ঢুকে। উড়তে থাকে দেয়ালের গা ঘেঁসে। প্রজাপতির ডানা ঝাপটানোর আওয়াজ অপুর্বর খুব ভালো লাগে। কেমন স্বাধীন অনুভূতি। ডানা মেলে উড়ে বেড়ানো প্রজাপতীর সৌন্দর্যে অপুর্ব মুগ্ধ হয়।
ছোটকালে অনেক বিয়েতে অপুর্ব শুনেছে এবং দেখেছে-্ওঁ প্রজাপতয়ে নমঃ; মন্ত্রটি উচ্চারন করতে অর্থাৎ প্রজাপতিকে দেবতাকে আবাহন করা হয়।
হিন্দুমতে একজন ব্যাক্তির বিয়ে একবারই হয়। একজন পুরুষের সাথে একজন নারীর সম্পর্ক সারা জীবনের। স্ত্রীকে জীবনের সব বাঁধা, বিপত্তি, সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা আর জীবন চলার পথে একই গ্রন্থিতে বেঁধে নেয়। স্ত্রীও একই স্বামীর সাথে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত একসাথে কাটিয়ে দেয়। সংসারের সব কিছুকেই এক সাথে ভাগাভাগি করে নেয়। শারিরীক সম্পর্কও একই স্বামী-স্ত্রীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ। স্ত্রী বা স্বামীর জায়গায় অন্য কারো ভাবনাটাই অপরাধ। ঠিক প্রজাপতির মতোই। পৃথিবীর সকল জীবজন্তু তাদের জাতের সকলের সাথে শারীরিক সম্পর্ক করতে পারলেও, শুধুমাত্র প্রজাপতি অন্য একজন প্রজাতির সাথেই শারীরিক সম্পর্ক করতে পারে। প্রজাপতিরা যখন অন্য একটি বিপরীত লিঙ্গ প্রজাপতির সাথে শারীরিক সম্পর্ক করে তারা মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সেই প্রজাপতির সাথেই শারীরিক সম্পর্কে লিপ্ত হবে। অন্য কোন প্রজাপতির সাথে নতুন করে শারীরিক সম্পর্ক করতে গেলে প্রজাপতিরা মারা যায়। কি অদ্ভুত মিল।
তাই অপুর্ব প্রজাপতীর ডানা ঝাপটিয়ে উড়তে দেখে ভীষন খুশী হলো। তাড়ানোর কোন ইচ্ছে নেই।
-দেখছেন অপুর্বদা, কি মঙ্গল সময়। প্রজাপতিটাও বিয়ের খবরটা টের পেয়েছে।
-হুম-অপুর্ব হঠাৎ ভাবনার জগৎ থেকে ফিরে এলো
এরপর আরো অনেকক্ষন গল্প চললো। এক সময় আরিফভাই বিদায় নিলো। মদের ঝাঁজ যেন সারা শরীরে। দরজার কাছে গিয়ে একটু ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ে। বেশ কয়েক প্যাগ ঢুকেছে পেটে। কথা-বার্তাও কিছুটা জড়িয়ে যাচ্ছিলো।
-যেতে পারবেন, আরিফভাই? ট্যাক্সি ডাকবো নাকি?-অপুর্ব জিজ্ঞেস করে।
-ধ্যাৎ কি যে বলেন। আমি একেবারে ঠিক। আর এতোটুকু রাস্তা কেউ ট্যাক্সিতে যায়? আলবৎ যেতে পারবো। বাই-বাই-টা-টা
বিদায় দিয়ে অপুর্ব রুমে এসে বসলো।
টের পায়নি কখন যে রাত বারোটা বেজে গেলো। এখন আর কোন কিছু নিয়ে ভাববে না। এক সময় বালিশে মাথাটা এলিয়ে দিলো।
সব কিছুই যেন বদলে যেতে লাগলো অপুর্বর জীবনে সেলুলয়েডের ফিতের মতো। ভাবনায়-চেতনায় এখন এক নতুনের পদচারনা। তনুশ্রীকে নিয়েই এখন অপুর্বর ভাবনা-ভবিতব্য। সব কিছু ঠিকঠাক। সব কথা-বার্তা শেষ। বিয়ের দিন-তারিখ নির্ধারিত। মেয়ের মা বেশ ধর্মপরায়ন। ধর্মটাকে বেশ মানেন। পন্ডিত এনে একটা ভলো দিন, মাস ও তিথি দেখে সব ব্যবস্থা নিয়েছেন।
জ্যোতিষ শাস্ত্রে উল্লেখ আছে যে, সোম, বুধ, বৃহস্পতি ও শুক্রবার হলো বিবাহের জন্য শুভ দিন। আর রবি, মঙ্গল ও শনিবারে বিবাহ অমঙ্গলের লক্ষন। মাসের মধ্যে মাঘ, ফাল্গুন, বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ, আষাঢ় ও অগ্রহায়ণ মাসে বিবাহ শুভ ও প্রশস্ত। গর্গ মুনির মতে, জন্মদিনে কন্যার বিবাহ নিষিদ্ধ। তবে জন্মমাসে বিবাহ মঙ্গলময়।জন্মদিনের আট দিন পার করে কন্যার বিবাহের বিধান আছে। কন্যার ক্ষেত্রে জন্মবার, জন্ম নক্ষত্র ও জন্মরাশিতেও বিবাহ প্রশস্ত।
-পন্জিকা দেখে দেখে পন্ডিত মহাশয় তনুশ্রীর মাকে কথাগুলো বলছিলেন।
কোন কিছুই বাদ দেন নি।
শেষ পর্যন্ত ঠিক হয় জুলাইতে বিয়ে। লগ্ন-তিথী মাস সব মিলিয়ে মাসের ১২ তারিখ খুব ভালো দিন।
হাতে মাত্র এক মাসের মতো। এর মধ্যেই সব গুছাতে হবে।
যদিও মেয়ের পরিবার সাফ সাফ জানিয়ে দিয়েছে বিয়ের সব আয়োজন, খরচ-পাতি মেয়ের পরিবার করবে। ছেলে পক্ষকে কোন কিছু নিয়ে ভাবতে হবে না। এমন কি মেয়ের মা এটাও বলে দেয়-
-তুমি হুনগ্যা, তুমি কিন্তু বিয়ার পরে আমাগো লগে থাইকবা। কত্তো বড়ো বাড়ী আমাগো। কোনতা অসুবিধা অইব না
-না,না আমি কিন্তু আমার ফ্লাটেই থাকবো। এহানে থাকবো না-অপুর্ব ঝটপট বলে উঠে
-কেনে, মাইনষে কিতা কইবনি, ঘরজামাই? এইসব মাইতনা। এইডা কিছু না
-সেটা না। আমরা আলাদা থাকলেই ভালো হইবো। প্রতি সপ্তাহে আপনার মেয়ে আপনাদের এখানে আসবে। আমিও আসবো। আর আমরাতো আপনাদের কাছেই আছি। আপনি রাগ করবেন না।
-রাগ করতাম কা? খুশিই হইছি। এহনকার পোলারা তোমার মতো না। সব লোভী। তুমি তাগর মতো না। খুব ভালো। আত্মসন্মানডা
আছে। এইডা না থাকলে কি হয়? খুব ভালা। তয় প্রতি উইকেন্ডে কিন্তু আইতে অইবো
-আসবো
-আর হুনুগ্যা, তোমার পরিবারের কেউ ঐদেশে নাই। তয় তুমি মা-বাবারে জানাইতা হইবা। গুরুজনের আশির্বাদ নিতা অইবা। এইডা পোলা হিসাবে তোমার কর্তব্য।
-আমি সবাইর সাথে মাইতাম বিয়ের ব্যাপারে।
-বিয়ের দিন তোমার যতো বন্ধু হগল আছে তাগরে নেমন্তন দিও। এইডা কিন্তু তোমার দায়িত্ব
-ঠিক আছে। আর আমি কাউকে বলতাম না। ২-৩ জন বন্ধু। আর আরিফভাইতো থাকবই।
-হুধু এই কয়ডা নি?
-হ
এই ভাবে সব বিয়ের ব্যাবস্থা হয়ে গেলো।
সোমবার দিন বিয়ে। হিন্দুমতেই বিয়ে হবে মন্দিরে। তার পর রেজিষ্ট্রেশন।
সব কথা-বার্তা শেষ করে দুজনেই এক সাথে ফিরে আসে অপুর্বর ফ্লাটে। রাতের খাবার-দাবার শেষ করেই সেখান থেকে বিদায় নেয়।
অনেক আগেই সূর্য দেবতা বিদায় নিয়েছেন। রাত্রির গভীরতা চারিদিকে একটা ভিন্ন রকম আবেশ তৈরী করেছে। এক সময় আরিফ ভাইও চলে যান।
অপুর্ব এখন একা। দরোজাটা বন্ধ করে টেপ রেকর্ডারে জগজিৎ সিংয়ের গজলের একটা ক্যাসেট ঢুকিয়ে অন করে দেয়। রুমের লাইটটা নিভিয়ে দিয়ে ডিম লাইটটা অন করে দেয়। বেডে সোঁজা হয়ে বসে। গান শুনতে এই মুহুর্তে অপুর্বর খুব ভালো লাগছে। হঠাৎ যেন মনোযোগ দিয়ে কি ভাবলো। মনের দরোজায় কে যেন উঁকি মারছে। এতোদিন পর খুব মনে পড়ছে সুতপাকে আজ।
কেন জানি বিয়ের দিনটা ঠিক হওয়ার পর থেকেই মনের আনন্দটা চুপসে যায়। অথচ গত কয়েকটা সপ্তাহ বেশ উচ্ছ্বাসে দিন কাটে। কবে বিয়ের ব্যাপারটা ফয়সালা হবে। কেমন একটা উৎসুক ভাব। আজ এমুহুর্তে সুতপাই অপুর্বর ভাবনায় ঘুরাফেরা করছে। মনে মনে বলত লাগলো-
“সারাটা সপ্তাহ কাজ করতে করতে যখন কঠিন ক্লান্তিতে অবসাদগ্রস্থ দেহ তখন আকাশের খোলা প্রান্তরে লক্ষ যোজন দুরের তারকার দীপালিতে মৃদু মন্দ বাতাসের হালকা দোলায় কিছুক্ষনের জন্য ভুলে যাই আমি ক্লান্তিতে ন্যূজ একজন মানুষ। মগজের কোষে কোষে তোমার স্মৃতির আল্পনা সুগভীর মমতায় আমাকে ভাবায়-স্মৃতি রোমন্থনে ক্ষনিকের জন্য বুঁদ হয়ে যাই-কেমন আছ তুমি?”
হৃদয়ের নিভৃত গহনে কথাকলি দিয়ে মালা গাঁথে অপুর্ব-কিন্তু সুরের অপ্সরারাতো দেয় না ধরা? কি অদ্ভুত লাগছে এই ক্ষন। গলা
দিয়ে অস্ফুট স্বরে কি যেন উচ্চারিত হলো-
“এই মাধবী রাতের জোছনার চাঁদ
হাজার তারার ঝিকি মিকি
কতো সুন্দর পৃথিবী আমার
তারো চেয়ে সুন্দর প্রেয়সী তুমি।“-সুতপা আমাকে মনে পড়ে? আমি যে আজ অনেক দুরে------আর এক মাস পরে একেবারেই দুরে চলে যাবো। বহু দুরে। আর কখনো তোমাকে নিয়ে ভাবার হয়তো অবকাশ হবে না-এই ভাবতে ভাবতেই অপুর্ব ফুঁফিয়ে কাঁদতে লাগলো।
পৃথিবীর শ্যামল তরু-বীথি মাখা, ঝর্নার ছন্দোময় পতনের ধ্বনী, জ্যোৎস্নারাত, মাধবী চাঁদ, অপুর্ব মায়ায় দ্বীপ জ্বলে যাওয়া
তারকারাজী, সুহাসিনী রাতের আকাশ কি অপূর্ব মনোহরিতায় দিপ্যমান এই রাত। কিন্তু তারপরেও প্রাঞ্জল জ্বাজল্যমান হৃদয়ে
অপুর্বর ভাবনায় বার বার বিচরন করছে নতুনের অবয়ব, হৃদয় আকাশে ভেসে উঠছে তনুশ্রীর অবয়ব। ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেলো
সুতপার মিষ্টি মধুর চেহারাটা।
অপুর্বর ভাবনায় এখন শুধু তনুশ্রীর ছবি। রাত গভীর হয়। বালিশে মাথা রেখে এক সময় অপুর্ব ঘুমিয়ে পড়ে। টেপ রেকর্ডারে তখনও
জগজিৎ সিং এর সরব সুরধ্বনি।
(চলবে---)
Read full book here: Click here to download the PDF file