জন্মের পর থেকেই আজন্ম আমি চলিতেছি জীবনের বিষাদ বয়ে
ঘুরিতেছি দিকবিদিক নিশানাহীন তীরবিদ্ধ পাখিদের মতো
কতো অজানা রাত কেটেছে স্বাপদ অরন্যে
কতো ভোর প্রহরের মিন্ময়ী বাতাস দোল খেয়েছে শিশিরের ঘাসে
পরম মমতায়
কতো না আদিম সুখে মেতে উঠেছিল আফ্রিদিতি-হিমেরস
তবুও পাইনি এক দন্ড শান্তি।
আমার অন্তর্চেতনায় বার বার ঝড় উঠে সামুদ্রিক ঢেউয়ের মতো
দিগন্তের ওপাড় থেকে আছড়িয়ে পড়ে সেই ঝড়
আমার দেহ, মন, প্রান, চেতনারা কেমন বুদ হয়ে থাকে সারাক্ষন
থেমে যায় পৃথিবীর সব কলরব, বাসন্তী বাতাস, পূর্নিমার চাঁদ
আমার বেঁচে থাকার নির্ভরতা, শ্রাবস্তীর আকাশ, আমলকী ঘাস।
আমি ধীরে ধীরে শৈশব আর কৈশরের পথ পেড়িয়ে
যৌবনে আত্মসমর্পন করলাম,
ভুলে গেলাম, সেই-যে পাতাকুড়োনির দিনগুলিতে উড়ে যাওয়া শুকনো পাতার কথা
ভুলে গেলাম, সেই- যে বিস্মৃত হওয়া শৈশবের সাঁজ বেলাতে ডাংগুলি খেলার মোহতা
ভুলে গেলাম, সেই- যে স্কুলের দক্ষিনের পুকুরে জলকেচি খেলা আর সাঁতারের উৎশ্বাস
গোল্লাছট, দাঁড়িবাধা আর লুকোচুড়ি খেলার উন্মাদনা, উত্তাপ মিলিয়ে যায়
দূর আকাশের নীলে-
কিছুই আর দেখিনা, মনের উপরে কালো মেঘেরা দাপাদাপি করে অবলীলায়।
দোয়েল-কোয়েলের গান শুনিনা আজ
বাসক পাতার রসে ভিজে না গলা, কাশের মাত্রাটা বেড়ে যায় তাই
শিশিরের ঘাসে বসে না ফড়িং, বনলতা কেশে আর হাঁটে না কেউ
চারিদিকে শুধু অস্থির অশ্বেরা সময়ের বুকে হামাগুড়ি দেয়
পাই না খোঁজে আর হেমন্তের স্নিগ্ধতা, বসন্তের শোক
পাই না খোঁজে আর আষারের বৃষ্টি ধোয়া কদমের গন্ধ
পাই না খোঁজে আর বাঁশঝাড়ের ভেতর দিয়ে হেঁটে যাওয়ার উন্মাদনা
মেঠো পথের উস্বাস কিংবা বৈশাখী শব্দের জলসিড়ি
কোথাও আর অবশিষ্ট নেই জীবনের স্বাদ, স্বপ্ন ভালোবাসা
গ্রামের উত্তর পাড়ার মায়াবী হরিনচোখা লাজুক মেয়ের
হালকা কাজলের পোঁচে আকাশও কেমন কালো হয়ে যায়।
আমার চোখের অস্পষ্টতার মধ্যে টপ টপ করে জল পড়তে থাকে অবিরাম
থেমে যায় পৃথিবী, অনিকেত সময়, রোদেলার উত্তাপ।
আমি কিমিমান্জারোর বুকে হামাগুড়ি দিয়ে ধরতে চেয়েছিলাম আকাশের বুক
আমি অলকানন্দার সফেদ জলে ডুব দিয়ে তুলতে চেয়েছিলাম রাক্ষস-খোক্ষসের
লুকানো মনি-মুক্তো
আমি ভূমধ্যসাগরের বাতাসে ছুড়ে দিয়েছিলাম পৃথিবীর সব সুখ, আনন্দ আর
জোনাকীর দেয়া ভালোবাসা, প্রেম, গৌধূলির রঙ
আমি মহেন্জদারোর চোখ দিয়ে দেখেছিলাম প্রাচাত্যের বিশালতা
সরীসৃপের মতো হেঁটে চলা ভেনিসের খাল, প্যারিসে মোনালিসা
আইফেল টাওয়ারে বসে অর্ফিয়ুসের বাঁশী, কখনো বা নীল নদের জলে মিলে যাওয়া বাতাসের শব্দ।
অথচ কৃষ্ণপক্ষের রাত দিয়েছে ঢেলে একদলা কৃষ্ণবর্ন থুতু
পূর্নিমার আকাশে নেমেছিলো পাতা ঝরার শব্দ, বালিয়ারির খাঁ খাঁ ধূসরতা
গঙ্গার জলে রক্তের ফোয়ারা, মধ্য দুপুরে রুদালীর কান্না
গাছেরা কি গভীর মৌনতায় নত হয়ে ছিলো
যেমন থাকে লজ্জায় অবনত কিশোরী মন, হলুদ ধানেরা বর্ষার বাউল বাতাসে।
যৌবনের শেষ লগ্নে এসে আমি আজ বড্ডো ক্লান্ত
হেঁটে চলেছি এক অজানা আশায় পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে
টেকনাফ থেকে তেতুলিয়া, কন্যকূমারী থেকে লাধাক, নম্রদা থেকে মহনন্দা
মুরমানস্কের শীতের তুহিনে ভেজা বাতাসকে সঙ্গে নিয়ে ভ্লাদিভস্তকের পাহারের পাদদেশে
শ্বেত পাহারের দেশ থেকে নায়াগ্রা ফল্সের ঝর্নার মদিরতায়
কখনো বা ডন থেকে ভল্গায়, থেমস থেকে মিসিসিপি, মেঘনা থেকে যমুনা
ট্রান্স-সাইবেরিান রেলে চলতে চলতে দেখেছি বৈকালের গভীরতা
আমার যাত্রা ছিলো নগর থেকে মহনগরে, দেশ থেকে মহাদেশে
নদী থেকে সমুদ্রে, সমু্দ্র থেকে মহা-সমুদ্রে
চিটাগাং এর বাটালিহীল থেকে আল্পসের মন্ট ব্লান্কে
সুন্দরবনের গভীর জঙ্গল থেকে আমাজনের গভীরতায়
কৈশরের শরৎবাবুর কোন বই পড়ার মুগ্ধতা থেকে টিক টকের বৃত্তায়নে
ভেসে চলেছি শূন্য থেকে মহাশূ্ন্যে
অথচ পাইনি এক দন্ড শান্তি।
বিকেলের শেষ বেলাতে ফিরে এলাম তোমার দুয়ারে
তোমার চরনে আমার অবনতমস্তক
মুখে হাত দিয়ে বললে-কেমন আছো বাবু? মুখটা এতো শুকনো কেন?
মুখ তোলে তাকালাম তোমার দিকে
স্থির হয়ে ছিলো অবয়বে অনেকক্ষন
যেমন থাকে দুগ্ধজাত শিশু তার মায়ের দিকে গভীর তিয়াশায়
পৃথিবীটা বদলে গেল, যেন ফাগুন এসেছে গাছে, গ্রহন লেগেছে চাঁদে
তোমার অবয়বে দেখতে পেলাম সারা পৃথিবীর সুখ!
কী গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হলাম তোমার কোলে মাথা রেখে
কেটে গেলো জীবনের সব অবসাদ।
আমার মায়ের মুখ যেন পৃথিবীর সুখ।