গঙ্গা খুব অসুস্থ।
গত কয়েক দিন ধরে সারাদিন কিছুই খাচ্ছে না। বড় বড় চোখে যেন দুঃখের সাগর বয়ে যাচ্ছে। গভীর বিষণ্ণতায় ভরা চোখের দুকোন বেয়ে জল পড়ছে। থক থক কালো হয়ে গেছে চোখের পাতাগুলো।
এই কয়েক দিনেই বেশ শুকিয়ে গেছে, দূর্বল হয়ে পড়ছে। হাড়গোড়গুলো স্পষ্ট হয়ে উঠছে। আগের মতো আর তেমন শক্তি নেই। কেবল মাটিতে চুপচাপ বসে থাকে, কখনো ঘাড়টা নেতিয়ে শুয়ে থাকে। দাঁড়ানোর চেষ্টা করলেও পায়ে জোর পায় না। তার নিস্তেজ চোখের চাহনিতে যেন এক অনন্ত কষ্ট লুকিয়ে আছে। একসময় যে গাভীটি সবুজ ঘাস খেয়ে খুশিতে লাফিয়ে বেড়াতো, নিজের ছোট্ট বাছুরটিকে নিজের দুধ খাওয়াত, চোখে চোখে রাখত, আজ তার মধ্যে কোন সুখ নেই, আনন্দ নেই। বাছুরটির প্রতিও কোন যত্ন নেই। এক হতাশার ছাপ সারা চোখে-মুখে। নিজের বাছুরটির গায়ে মুখ বুলিয়ে দেয়ার সেই প্রাণবন্ত দৃশ্যটি যেন আজ কেবলই স্মৃতি।
গোয়ালের চৌহদ্দির মধ্যেই ছট পট করছে। ঘন ঘন লেজ নাড়ছে। নরম সবুজ ঘাস দেখেও খুশিতে টগবগ করে না।
আজ প্রায় দশ দিন হতে চলল গঙ্গার খাওয়ায় রুচি নেই। তীব্র ব্যাথায় ছটপট করছে। কেমন অস্থির হয়ে উঠছে, ঘন ঘন ঘুরে বেড়ায়। একটু পর পরই কি করুন সুরে হাম্বা—হাম্বা করে ডাকছে। জোড়ে জোড়ে নিঃশ্বাস নিচ্ছে। কেমন এক অস্বাভাবিক ভঙ্গি করে মাঝে মধ্যে, কাছে কেউ গেলেই আক্রমণাত্মক আচরণ করে।
গঙ্গার এমন দশায় ছোট বাছুরটিও মায়ের কাছে আসতে চায় না। দুরে দুরে থাকে। পিট পিট করে মায়ের দিকে তাকায়। ছোট ছোট চোখগুলি আদ্র হয়ে উঠে। মুখটা নীচু করে চলে যায়। অসহায় গাভীটির করুণ অবস্থা দেখে বুকটা ভারী হয়ে আসে ছোটনের। তার মা-বাবাও বেশ চিন্তিত গঙ্গার জন্য, বাছুরটির জন্য। গঙ্গার দুঃখ যেন চারপাশের বাতাসেও মিশে গেছে। চারিদিকে কেমন নিস্তব্ধতা, কান্নার মৃদু আওয়াজ যেন বাঁশ ঝাড়ের পাতাদের তিরতির আওয়াজে বেজে উঠে। পাশের কুয়ায় বাড়ীর হাঁসগুলিও যেন আগের মত জলকেলিতে মেতে উঠে না।
বাছুরটিকে ছোটন খুব ভালোবাসে। আসলে পরিবারের সবাই ভালোবাসে।
ছোটনদের সংসারটা খুব দরিদ্র। বাবা কৃষক। গঙ্গাই যেন তাদের একমাত্র অবলম্বন। তাদের একমাত্র সম্পদ। তার ক্রিম সাদা গায়ের রংটি প্রশান্তি বাতির মতো সূর্যের আলো প্রতিফলিত করে ছোটনদের সংসারে। গঙ্গা শুধু একটি গরুই না। সে যেন পরিবারের একজন লালিত সদস্য, সকলের প্রিয় আদরের। খুব দয়ালু এই গঙ্গা বছরের পর বছর ধরে তাদের পুষ্টি প্রদান করে যাচ্ছে কার্পন্যহীন ভাবেই। হয়ে উঠেছে ছোটনদের পরিবারের আয়ের অংশও। এই গাভীর দুধ বিক্রি করেই ছোটনদের পরিবারের অনেকটাই চলে। অন্যের জমিতে কৃষি কাজ করে যা আসে তাতেই ছোটনদের পরিবার মোটামুটি চলে যায়। গরিব হলেও, ছোটনরা গঙ্গার যত্ন খুব ভালোভাবে করে।
ছোটনের বয়েস মাত্র এগার। স্কুলে যায়। বাড়ীর কাছেই স্কুল। স্কুলে যাওয়ার আগে পাড়ার ছেলেদের সাথে ডাংগুলি খেলে। বন্ধুদের সাথে খুনসুটি করে। জিতে খিল খিল করে হাসে। হারার ভয়ে আবোল তাবোল বকতে থাকে। তাড়াতাড়ি খেলা শেষ করে। গঙ্গাকে দেখতে যায়। বাছুরটিকে দুহাত বুলিয়ে আদর করে। হাত দিয়ে টিপে টিপে পাকা কলা খাইয়ে দেয়। তারপর দুটি চুমু দিয়ে ধ্যাং ধ্যাং করে বই-খাতা বগলে পুতে স্কুলে রওনা দেয়। যাওয়ার সময় বলতে ভুলবেনা-“”চন্দ্রা, আমি এহন স্কুলে যাই। তুই কোথাও যাইস না। স্কুল থেকে এসে তুকে খাবার দেবো।“
চন্দ্রা তখন ছোটনের দিকে তাকিয়ে থাকবে আর লেজ নাড়বে।
মাত্র তিন মাস হল গঙ্গার নতুন বাছুরটির। ছোটন আদর করে ডাকে `চন্দ্রা`। এখন এই নামেই বাড়ীর সবাই ডাকে। এমন কি পাড়া প্রতিবেশীরাও এই নামে ডাকে। এই নামটি অবশ্য ছোটনের দিদা দিয়েছে। সেদিন দাঁতহীন দিদা মুখ বাঁকিয়ে অর্ধ চন্দ্রাকৃতির হাসি দিয়ে নাতীর পিঠে হাত বুলোতে বুলোতে বলেছিল-
দিদা: ছোইট্টা রে, তুই জানসনি 'চন্দ্রা' মানে কী? (ছোটনকে ছোট করে এবং আদর করে ছোইট্টা বলে ডাকে)।
নাতি: না দিদা, 'চন্দ্রা' মানে কী? তুমি বুঝি জান?
দিদা: (হাসতে হাসতে)আহা, 'চন্দ্রা' মানে হইলো চাঁন্দ। চাঁন্দ বলতে সেই সুন্দর গোল-গাল সাদা জিনিসটা, যেইডা আকাশে রাতে ঝকমক কইরা থাকে।
নাতি: ও! তাই নাকি? আমি তো ভাবলাম 'চন্দ্রা' বুঝি কোন খাবারের নাম।
দিদা: (হেসে) না রে, এইডা কোনো খাবার না। তবে চাঁন্দের আলোতে তোমার দিদার রান্না করা মিষ্টি দেখতে এক্কেবারে ঠিক ঐ আকাশের চাঁইন্দের মতোই লাগে। দেহস নাই রাইতের আকাশে কত সুন্দর চাঁন্দ।
নাতি: আচ্ছা দিদা, চাঁন্দ কী সব সময় গোল থাকে?
দিদা: না, চাঁন্দ তো মাঝে মাঝে একটু পাতলা হইয়া যায়। হেইডারে বলি 'অমাবস্যা'। আর যহন পুরা গোল থাকে, তখন 'পূর্ণিমা' কয়।।
নাতি: তাহলে দিদা, আজ রাতে আমরা চাঁন্দ দেখে চাঁন্দের মত রুটি খাইতে পারি না?
দিদা: (হেসে) চাঁন্দের রুটি? ঠিক আছে, চাঁন্দের মতো রুটিই তরে বানাইয়া দেয়াম। কিন্তু মনে রাইখতে অইব, রুটি পুরইরা গোল হইতে হইব, চাঁন্দের মতো!
নাতি: (হেসে) ঠিক আছে দিদা, আমিও চাঁন্দের মতো গোল রুটি খেতে চাই।
দিদা: (হেসে) তাইলে ত আমার দাদুর জন্য রুটি বানাইতেই অইব!!
সেইদিন হাসতে হাসতে লুটোপুটি খেয়েছিল দুজনে।
তিন মাস বয়সী চন্দ্রা এখন বেশ চঞ্চল আর মিষ্টি। তার গায়ের লোমগুলো নরম ও মসৃণ, সাদা আর বাদামী রঙের মিশ্রণে সে দেখতে অপূর্ব, যেন রুপশী। বড় বড় উজ্জ্বল চোখ দুটি কৌতূহলে ভরা, সবকিছু নতুন করে দেখার চেষ্টা করে। তার ছোট ছোট শিংগুলোও একটু একটু করে গজাতে শুরু করেছে। মায়ের পেটে মাঝে মাঝে ঠেসে ধরে।
চন্দ্রার গায়ে জোর আছে। দেখতে বেশ নাদুস নুদুস হয়েছে। আগে মায়ের সাথেই থাকত বেশীটা সময়। কিন্তু মায়ের অসুস্থতার পর সে মায়ের কাছ থেকে কিছুটা দূরে গিয়ে মাঠে ঘাস খেতে শুরু করেছে। সাথে ছোটনও থাকে। তবুও মায়ের উষ্ণতা তার কাছে সবচেয়ে প্রিয়। তার ছোট পা গুলো দিয়ে দৌড়াদৌড়ি করে এবং মাঝে মাঝে লাফিয়ে উঠে খেলা করে। তার মিষ্টি আওয়াজে যেন পুরো বাড়িটি প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে। ছোটনের কাছে চন্দ্রার সব কিছুই যেন আনন্দের শিহরন নিয়ে আসে। নতুন করে প্রতিটি দিন চন্দ্রার সাথে উপভোগ করে। ছোট্ট বাছুরটির প্রতিটি মৃদু পদক্ষেপ, দৌড়ানোর ভঙ্গি, লাবন্যময় চেহারা আর প্রতিটি মৃদু ডাকে যেন প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক অদ্ভুত ছোঁয়া লেগে থাকে। দুহাত দিয়ে জড়িয়ে যখন চন্দ্রাকে আদর করতে থাকে, কানে ফিস ফিস করে কথা বলে, সারা শরীরে হাত বুলোতে থাকে চন্দ্রা চুপ করে দাঁড়িয়ে সুখ অনুভব করে। তিন মাস বয়সী এই চন্দ্রা সত্যিই যেন এক টুকরো খুশির প্রতীক।
কিছুদিন আগেও ছোটনদের জীবন ছিল সরল। খুবই প্রাণবন্ত। পাখিদের কিচিরমিচির সুরে আর ধুলোময় রাস্তায় শিশু কিশোরদের দৌড় ঝাপ- হাসিতে ভরা থাকত এই বাড়ীর চার পাশ। কিন্তু যেদিন থেকে গঙ্গা অসুস্থ হয়ে পড়ে সেদিন থেকে সব কিছু বদলে যায়। চন্দ্রা যেন একেবারে দিশেহারা। মায়ের দুধ খেতে গেলেই গঙ্গা পাদুটি দিয়ে ঝাটকা মেড়ে সরিয়ে দেয়। লাথি মারছে অনবরত।
একদিন গোয়ালে ঘাস দিতে এসে ব্যাপারটি ছোটনের বাবার নজরে পরে। তাছাড়া এখন দুধ দোয়ানোরও সময়। কিন্তু তিনি গঙ্গার এমন আচরনে বেশ অবাক হলেন। আগেতো এমনটি কখনো দেখেনি!
হঠাৎ ছোটনের বাবার নজড় পড়ল গরুর দুধের থলিতে। জায়গাটা বেশ লাল হয়ে আছে। ভালো করে দেখার চেষ্টা করলেন। সাপে কাটা দাগের চিহ্ন পেলেন। এবার আর বুঝতে অসুবিধা হল না যে রাতে সাপ এসে গঙ্গার স্তন চুষে দুধ খেয়ে নেয়। এমনটি তিনি আগেও অনেকের কাছে শুনেছেন। এবার বেশ চিন্তিত হয়ে পড়লেন। সাপ এসে যখন দুধ চুষে নেয় গঙ্গা তখন কিছুই করতে পারত না, শুধুই অসহায়ভাবে দাঁড়িয়ে থাকত। এই ঘটনা প্রতিদিনের নিয়মে পরিণত হয়ে যায়। প্রতিদিন সকালে গরুটি স্তনে প্রচণ্ড ব্যথা নিয়ে উঠত। বাছুরটি দুধ খেতে পারত না। বাছুরটি ক্ষুধার্ত থেকে যেত এবং তার পুষ্টির অভাব দেখা দিলো। ছোটনদের পরিবারে এ নিয়ে বড্ডো চিন্তিত। গরুটি দুধ না দিতে পারায় তাদের দুধ বিক্রির আয়ও কমে যায়।
সাপটি যে কিভাবে গরুর দুধ খেয়ে ফেলে, তা নিয়ে সবার মনেই কৌতূহল তৈরি হয়। কিন্তু সমস্যার সমাধান করতে না পেরে, অবশেষে ছোটনের বাবা পাড়া-প্রতিবেশীদের সহায়তা চাইল। খবরটি দাবানলের মতো গ্রামে ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু কোন সমাধান খুঁজে পেল না। যতই দিন যেতে লাগল চন্দ্রা দুধের অভাবে দুর্বল এবং পাতলা হয়ে উঠল। মায়ের বিষাক্ত দুধ খাওয়াতে না পেরে সে শুকিয়ে গেল। তার একসময়ের উজ্জ্বল সুন্দর মায়াবী চোখ এখন ক্ষুধা ও দুঃখে নিস্তেজ হয়ে পড়ছে। ছোটনের পরিবার চন্দ্রাকে বাঁচানোর জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করছিল। ছোটন এখন চন্দ্রার সাথেই বেশীরভাগ সময় থাকে।
যেদিন ছোটনের দিদা গঙ্গার দুধ সাপে খাওয়ার কথা শুনেন তিনি বসা থেকে লাফ দিয়ে উঠেন: “কি অলুক্ষনে কথা গো! রাম রাম! অমন কথা মুহেও আনতে নাই। সাপে আবার দুধ খায় কেমনে? অমন কথা বাপ-দাদার আমলেও হুনি নাই।“
ছোটনের বাবা এসে তখন অবাক বিস্ময়ে চোখ বড় বড় করে মায়ের দিকে সোজাসুজি তাকিয়ে ডান হাত নেড়ে বলতে থাকে-“না মা, দুধরাজ সাপ এসে গঙ্গার দুধ খাইয়া নেয়।“
ছোটনের দিদা (ধমকের সুরে): তরে কইছে? তুই দেখছস দুধরাজ সাপ? আমিওত দেহি নাই?
ছোটনের বাবা (ধীরে ধীরে): তা হইলে দুধের জায়গাগুলি সাপে কাটার মত। শংকর কবিরাজত তাই কইল। এইডা নাকি সাপের কাজ। মলম দিয়ে গেছে।
ছোটনের দিদা: শংকর কবিরাজ কহনও দেখছে সাপকে গরুর ওলান থেইক্যা দুধ খাইতে? আমার বাবা কইত সাপ নাকি গরুর ওলানকে ইন্দুর মনে কইরা কামড়াইয়া ধরে, ইন্দুরের মাথা খুঁজে। ইন্দুর খাইওইন্যা সাপের কাজ এইডা।
ছোটনের বাবা: শংকর কবিরাজ কইছে মলমটা গরুর ওলানে মাখতে আর চন্দ্রা যেন এই বিষাক্ত দুধ না খায়।
দিদা:অতো চিন্তা করিস না। চন্দ্রা অহন দুধ না খাইলেও চলব। প্রথম থেইক্যা গরুর বাট চুষে সকাল বিকাল সইন্ধ্য খুব শাল দুধ খাইছে। অহন তিনডা মাস অইছে। সবুজ কচি নরম লতাপাতা, ঘাস দিলেই খাইব। কচি কলাপাতা কাইট্যা আনিছ। চোট্ট কইরা কাইট্যা খাওয়ান জাইব। পারলে কয়েকটা শবরী কলা নিয়া আইস।
দিদার কথায় ছোটন বাবাকে দিয়ে বাজার থেকে সবরী কলা নিয়ে আসে। প্রতিদিন সকালে, দুপুরে, বিকেলে এবং রাতে একটা করে কলা খাইয়ে দেয়। ঘরের বারান্দার এক পাশে কলাগুলি ঝুলানো থাকে। দুই একদিন পর চন্দ্রা ঠিক সময় মতো বারান্দার সামনে এসে দাঁড়িয়ে ওয়া হাম্বা –ওয়া হাম্বা—ওয়া হাম্বা করে আওয়াজ করবে আর ঝুলানো কলাগুলির দিকে তাকিয়ে লেজ নাড়াতে থাকবে। ছোটন তখন দৌড়ে এসে একটি কলা ছোলে চন্দ্রার মুখের সামনে ধরবে। তারপর বা হাতে চন্দ্রার ঘাড় পেচিয়ে ধরে খুব সোহাগ করে খাওয়াবে।
একদিন ছোটনের স্কুল থেকে আসতে বেশ দেরী হয়। চন্দ্রা কয়েকবার কলার আশায় বারান্দার সামনে এসে অপেক্ষা করে। কিন্তু ছোটনকে দেখতে না পেয়ে চিন্তিত মনে ফিরে যায়। আবার বন্ধুকে পাওয়ার আশায় চন্দ্রা বারান্দার সামনে এসে উঠোনে দাঁড়ায়। কেন জানি চন্দ্রার মনে হল ছোটন ফিরে এসেছে
চন্দ্রা (বাছুর): ওয়া হাম্বা—ওয়া হাম্বা—ওয়া হাম্বা।
তিন তিনবার এই আওয়াজটি করলেই ছোটন বুঝতে পারে চন্দ্রা ওকে খুঁজছে।
ছোটন: "আমি এখানে, চন্দ্রা। আজকে তোমার জন্য তাজা নরম সবুজ ঘাস নিয়ে এসেছি। তাই একটু দের হলো। তুমি রাগ করেছ বুঝি?"-এই বলেই একটি কলা ছোলে চন্দ্রার সামনে রাখলো।
চন্দ্রা এবার লেজ নাড়াতে থাকে। খুশিতে ছোটনের দিকে চেয়ে চেয়ে ঘাড় ঘুরাতে লাগলো। ছোটনের গা ঘেঁসে এসে দাঁড়ালো। অর্থাৎ চন্দ্রার কাছে যে ছোটন খুব প্রিয় বন্ধু এটাই বুঝাতে চাইছে।
ছোটন (চন্দ্রার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে): "তুমি আমার সেরা বন্ধু, চন্দ্রা। তুমি জানো, তোমার সাথে সময় কাটানো আমার সবচেয়ে ভালো লাগে।"
চন্দ্রা: ওয়া হাম্বা—ওয়া হাম্বা—ওয়া হাম্বা। -এবার খুশিতে সামনের এক পা ছোটনের হাতের কাছে আনলো। চোখ কেমন ভাবে ঘুরাতে লাগলো।
ছোটন: "না, চন্দ্রা, আমি তোমাকে কখনও ছেড়ে যাব না। আমরা সবসময় একসাথে থাকব।"
চন্দ্রা যেন ছোটনের কথাগুলি বুঝতে পারে। পায়ের কাছে এসে মুখ দিয়ে ছোটনের পা ঘষতে থাকে।
একদিন ভারাক্রান্ত হৃদয়ে, ছোটনের পরিবার একটি কঠিন সিদ্ধান্ত নেয়। অসুস্থ গঙ্গাকে বিক্রি করে দেবে। ছোটনের দিদাই বাবাকে ডেকে বলে-“তাড়াতাড়ি গরুডারে বেইচা দে। এহানে যতদিন থাইকব সয়তান সাপটা আইয়া কামরাইব। এইডারে আর বাচান যাইব না। তুই বেইচা দে। পাশের গ্রামের শেইখ পাড়াতে খোঁজ নিয়া দেখ, খরিদ্দার পাইবি।
ছোটনের বাবা: দেহি
দিদা: এইডা বেইচা আরেকটা দুধের গরু কিইন্যা লইচ। টেহায় না কুলাইলে আমার হাতের বালাটা বেইচা দিস। দুধ না বেচলে সংসারটা সামলাইবি কেমনে?
ছোটনের বাবা: না, মা এইডা আমি করতে পারি না। এইডাই তোমার শেষ সম্বল। এই স্মৃতিটি তোমার থাক।
দিদা (হাসতে হাসতে): তুই কিতা কস। আগে ত সংসার। আমার দাদু ভাই আছে না? দাদু আমারে আবার কিইনা দিব দেখবি। এবার তুই যা।
ছোটনের বাবা চলে যায় শেইখ পাড়ায়। খুঁজে পায় খদ্দের। দাম একটু কম। শর্ত গঙ্গার সাথে চন্দ্রাকেও দিতে হবে। দর দাম পাকাপাকি। আগামীকাল এসে নিয়ে যাবে। টাকা নিয়ে আসবে। ছোটনের বাবা যেন কিছুটা স্বস্তির পেলেন। সোজা বাড়ীতে ফিরে এলেন। একদিকে যেমন খুশিতে মনটা দোলে উঠছে অন্যদিকে দুঃখে মনের ভেতরে সমুদ্রের আথালি-পাথালি আওয়াজ, বুকটা যন্ত্রনায় কেঁদে উঠছে। এত দিনের গঙ্গার প্রতি বিশেষ একটা মায়া পড়ে গেছে। পথে হাঁটতে হাঁটতে চন্দ্রার সুকোমল মায়াবী মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠছে।
বাড়ীতে এসেই ছোটনের দিদাকে খবরটা দেয়।
মুখ ভর্তি ঠাসা পান ফোকলা দাঁতে চিবুতে চিবুতে আনন্দের উচ্ছ্বাসের এক ঝলক মুখে ভাসিয়ে দিয়ে বলে উঠল: “খুব ভালা করছিস। নইলে একটা বিপদ অইত।“
পরের দিন যথাসময়ে খদ্দের এসে টাকা পয়সা বুঝিয়ে দিয়ে গঙ্গা ও চন্দ্রাকে নিয়ে চলে। হঠাৎ পাশ থেকে একটি কান্নার আওয়াজ আশে পাশের নিরবতাকে ভেঙ্গে চুরমার করে দেয়। পাশে দাঁড়িয়েই ছোটন কাঁদছিল। একটি বিশুদ্ধ ও কোমল হৃদয় কান্নায় ভেঙ্গে পড়ছে দেখে ছোটনের মা দৌড়ে এসে ছেলেকে বুকে ঝাঁপটে ধরে। ছোটনের চোখ দিয়ে ঝর ঝর করে জল গাল বেয়ে পড়ছে। ছোটনের মা আঁচল দিয়ে মুছিয়ে দিচ্ছে আর ছেলেকে সান্তনা দেওয়ার চেষ্টা করছে। মা জোড়ে আকড়িয়ে ধরে আছে ছোটনকে।
কিন্তু ছোটন হাত দিয়ে নিজকে ছোটানোর চেষ্টা করছে আর কান্না করতে করতে করুন মিনতি ভরে বলছে-“গঙ্গাকে নিতে বারন কর বাবা, দয়া করে চন্দ্রাকে নিবেন না। চন্দ্রা আমাকে ছাড়া বাঁচবে না।“-ছোটনের কন্ঠে আকুতি। আবেগে তার কণ্ঠ কাঁপছে। "চন্দ্রা আমার প্রিয়। গঙ্গা আমাদের পরিবার। আমি তাদেরকে নিতে দেবো না।"
তার কথাগুলো পুরো বাড়ীর আশে পাশে প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল। যারাই ছোটনের আর্তনাদ শুনছিল তাদের সকলের হৃদয় কেঁপে উঠছিল। কিন্তু ছোটনের বাবা একবার মুখ ফিরেও তাকাল না ছেলের দিকে। বেপারীর সাথে হন হন করে এগিয়ে চলল।
ছোটনের কান্নায় হঠাৎ চন্দ্রা থেমে গেল। পিছনে ফিরে প্রিয় বন্ধু ছোটনের দিকে তাকাল। চন্দ্রার চোখে গভীর বেদনা এবং কষ্ট। হঠাৎ চন্দ্রা এক হিচকে টান দিয়ে বেপারীর হাত থেকে ছুটে এসে ছোটনের পায়ের কাছে লুটিয়ে পড়ে। মুখ দিয়ে ছোটনের পা ঘষতে থাকে। ছোটন কান্নায় খুব ভেঙে পড়ছে চন্দ্রাকে কাছে পেয়ে। তার ছোট্ট হাতগুলি চন্দ্রার গলায় জড়িয়ে ধরছে, যেন আর ছাড়বে না। চন্দ্রার মায়াবী চোখ দুটি ছোটনের দিকে তাকিয়ে আছে, যেন সে শেষ বারের মতো তার প্রিয় বন্ধুর মুখটা ভালো করে দেখে রাখছে। চন্দ্রার চোখে জল। চোখে কেমন এক বিষণ্নতার ছাপ। মৃদু কন্ঠস্বরে কেমন এক মৃদু ঘোংঙানীর আওয়াজ। চন্দ্রা কাঁদছে।
নতুন মালিক চন্দ্রাকে এসে ধরে নিয়ে যায়। জোড়ে জোড়ে টানতে থাকে। চন্দ্রার প্রতিটি পদক্ষেপে যেন ছোটনের হৃদয়টা একটু একটু করে ভেঙে যাচ্ছে। দূরে সরে যেতে যেতে চন্দ্রার সজল চোখ দুটি বারবার পিছন ফিরে ছোটনের দিকে তাকাচ্ছে, আর ছোটন অসহায়ভাবে দাঁড়িয়ে চন্দ্রার চলে যাওয়া দেখছে, চোখে অশ্রু আর হৃদয়ে গভীর শূন্যতা নিয়ে।
এক সময় গঙ্গা, চন্দ্রা চোখের অদৃশ্য হয়ে যায়। ছোটনের চোখ দুটি দুঃখ ও আকুলতায় ভরে গেল। হঠাৎ ছোটনের চির পরিচিত পৃথিবীটা যেন নিবীর অন্ধকারে ছেয়ে গেল। বুক থেকে কেউ যেন ছোটনের হৃদপিন্ডটা খাবলে তুলে নিয়ে গেল।
কেমন এক শূন্যতার অনুভূতি নেমে এলো ছোটনের বুকে। ডুকরে ডুকরে কেঁদে উঠছে ছোটন। মা আঁচলে চোখ মুছে দিচ্ছে।