কুমিল্লার টমছম ব্রীজ থেকে পূর্ব দিকের সোজা রাস্তাটি দিয়ে মিনিট দশেক হেঁটে গেলে চোখে পড়বে ডান দিকে একটি খোলা জায়গা। নর্দমায় ভরা এক পাশ। তার ঠিক উল্টোদিকে চোখে পড়বে বেশ কয়েকটি পাঁচতলা বিশিষ্ট পুরনো ধাচের মলিন ফাঙ্গাসে ভরা ফ্লাট বাড়ি। দেয়ালে নানা ধরনের আঁকি-ঝুকি, গনতন্ত্রের বুলি আওরানো রাজনৈতিক দলের স্লোগান। এলাকাটি দেখলে কারো মনে হবেনা কোন ভদ্দরলোকের পাড়া হবে। চারিদিকে বেশ নোংরা, জরাজীর্ন পরিবেশ। বিক্ষিপ্ত ইট আর দূর্বল কংক্রিট দিয়ে নির্মিত ফ্লাটগুলি সময়ের দাগ বহন করে ন্যুজভাবে দাঁড়িয়ে আছে।
আশে-পাশে বিক্ষিপ্তভাবে নান ধরনের ঘর বাড়ি থাকলেও খালি জায়গাটির লাগোয়া এই পাশটিতে পর পর তিনটি ফ্লাট বাড়ি। প্রধান সড়ক থেকে যে চিকন এলো মেলো ইট বাঁধানো গর্তে পূর্ন গলিটি এই ঘিঞ্জি এলাকাটির সাথে এসে মিশেছে তা দিয়ে একটা রিক্সা কোন রকমে হেলে দোলে আসতে পারে। পাঁচ মিনিটের গলি পাড় হতেই অনেকেই আবার মিউনিসিপ্যালিটির চৌদ্দগুষ্ঠি উদ্ধার করতে হয়। আর যারা একটু ভদ্র কিসিমের তারা মুখে ব্যাঞ্জনা ফুটিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে শক্ত করে বসে থাকে। ঘরে গিয়ে কোমড়ে মলম ঢেলে মালিশ করতে করতে নিজের ভাগ্যের উপর দুঘা বসিয়ে দেয়। বির বির করে কেউবা বকতে থাকে-“কপালে কবে যে শান্তি আসবে। এভাবে আর কতো?”
তবে এই ঘিঞ্জি এলাকাটিতেই অনেকে স্বাচ্ছন্দ্যে বসবাস করছে। মেইন শহর থেকে একটু দূরে বলে শহরের কোলাহল মুক্ত। আর ভাড়া অনেকটা কম বলে অনেক নিম্ন-মধ্যবিত্তের জন্য একটি সুন্দর বসবাসের অভয়ারন্য।
এখানেই দুই নম্বর বিল্ডিংটির দুই তলায় থাকে বি কম পড়ুয়া অতীশ ভক্ত। পরিবারে চারজন লোক। বাবা-মা আর জ্যাঠু মশয়। জ্যাঠু বিয়ে করেননি। এখন বয়সের ভারে বেশ ন্যুজ। মাথাটা একটু নিচের দিকে হেলে গেছে।একটু গুঁজো হয়েই হাটতে হয়। তবে রক্ত এখনো গরম। একটু এদিক সেদিক হলেই তেতিয়ে উঠেন। দাঁত কেলিয়ে মুখ দিয়ে অগ্নি বর্ষন করতে কাউকে ছাড়েন না। সারাক্ষন শুধু বকবক করেন। তবে অতীশকে খুব পছন্দ করেন।
পুরো বাড়িটিতে মোট আট পরিবার ভাড়াটিয়া। চার তলায় থাকেন বাড়ির মালিক। সাথে মেয়ে আর মেয়ের জামাই। বিয়ের পর থেকেই ঘরজামাই। শ্বশুরের সম্পত্তির প্রতি বেশ লোভ। লোক জন তাই বলে। অতীশরা থাকে দুতলার একটি ফ্লাটে। পাশের ফ্লাটে আরেকটি পরিবার। অতীশদের ফ্লাটটি তিন রুম বিশিষ্ট হলেও রুমগুলি বেশ সংকুচিত। ভেতরে পুরনো দিনের আসবাবপত্রগুলি বেশ কায়দাকরে রাখা হয়েছে। বাড়ির সিঁড়িগুলো বেশ সরু। খুব সতর্কতার সাথে পা ফেলতে হয়।
অতীশ যে রুমটাতে থাকে তার সবগুলি দেয়াল বলিউড তারকাদের বিবর্ন পোস্টারে সজ্জিত। ছোট্ট একটি নির্জন কাঁচের জানালা। চারিদিকে মরচে ধরা। কাঁচের বাইরের দিকটা ধূলোয় ঢাকা। পরিস্কার ভাবে বাইরের সবকিছু দেখা যায় না। তবে এই জানালা দিয়েই অতীশ মাঝে মধ্যে রাস্তার সব্জী বিক্রেতা, হকার আর মানুষের হেঁটে যাওয়ার দৃশ্য তন্ময় হয়ে দেখে।
এই বাড়ির তিন তলায় থাকে দুটো পরিবার। পাঁচ তলায় এবং নীচ তলায়ও থাকে কয়েকটি পরিবার। একেকটা ফ্লাট একেক রকম। তিন তলার একটি ফ্লাটে যে ভদ্রলোকটি থাকেন তিনি সরকারি চাকুরিজীবি। একাই থাকেন। এক মেয়ে আর এক ছেলে রাজধানী শহরে সংসার পাতিয়েছে। কয়েক বছর আগেই বউ মারা গেছেন অসুখে। তবে পয়সা কড়ির অভাব নেই। ছেলে-মেয়েরা এই পুরনো বাড়িটি ছেড়ে শহরের ভিতরে ভালো একটি জায়গায় যাওয়ার জন্য বললেও উনি এখানেই থাকবেন বলে সাফ জানিয়েছেন।
তিন তলার পশ্চিম দিকের ফ্লাটে যারা আছেন তারা দুই ভাই। একজন মাস্টার মশয়। বেশ বুড়ো বয়সেই মাস্টার মশয় বিয়ে করেন। এখনো সন্তান হয়নি। আর এই বয়সে সন্তান হবে বলেও মনে হয় না। দেখলে অনেকেই মুখ ভেচকিয়ে চলে যায়। অনেকে যে বুড়ো বয়সের বিয়েটাকে ভালো চোখে দেখছেন না সেটা মাস্টার মশয় বুঝেন। কিন্তু কাউকে কিছু বলেন না। তবে অল্প বয়সী সুন্দরি বউকে সাবধান করে দিয়েছেন একা একা যেন ঘর থেকে না বেরোয়। মেজাজটা প্রায় সময়ই বিগড়ে থাকে। বেশ পাগলাটে টাইপের। সাড়াক্ষন মুখে পান-সুপারি, চুন আর জর্দায় ঠেসে রাখেন। এখানে সেখানে পিক করে পিচকি ফেলেন। বাড়ির চারিদিকে মাস্টার মশয়ের পান খাওয়ার পাগলামীর আলামত পাওয়া যায়। এ নিয়ে বাড়িওয়লার হরহামেশা বকবকানি লেগেই আছে।
মাস্টার মশয় অতীশকে দেখলেই কাছে ডাকতো-
-এই যে অতীশ, এদিকে একটু আসতো বাবা।
অতীশ কাছে যেতেই বলতো- আমার মাথার স্ক্রুগুলো বেশ ঢিলে হয়ে গেছে। হাতুরি দিয়ে একটু ঠুকে দাওতো।
অতীশের তখন অল্প বয়েস। কলেজে পড়ত। হাতুরি নিয়ে এসে মাস্টার মশয়ের মাথার চারিদিকে আস্তে আস্তে ঠুকে দিত।
মাস্টার মশয় তখন আরামে চোখ বুঝে থাকতেন। একটু পর পর অতীশকে বলতেন পিছনের দিকে একটু ঠুক…এবার ডান দিকে---বা পাশটায় আস্তে করে ঠুক…
দুই নম্বর ভাইটি জেলা কোর্টে উকালতি করেন। বয়সে মাস্টার মশয়ের ছোট। তিনি চিরকুমার। তবে খুব শয়তান প্রকৃতির। মাথায় সারাক্ষন উকালতি বুদ্ধি উঁকি মারে। অন্যকে কিভাবে হেনস্থ করা যায় সে নিয়ে বুদ্ধি আঁটে। তবে কথা বলে খুব মিষ্টি করে। কিপটে হাড্ডিসার। সব সময় রিক্সাওয়ালাদের সাথে ঝগড়া করে। দাম নিয়ে কথা কাটা কাটি বকা বকি চলে। দু পয়সা কম দিতে পারলেই যেন আনন্দে গদ গদ হয়ে উঠতেন।
একদিনতো এক রিক্সাওয়ালার সাথে বেশ হাতা হাতির পর্যায়ে চলে যায়। অতীশ তখন কলেজ থেকে বাড়ী ফিরছিল। ছোট্ট চিকন গলি দিয়ে খুব সাবধানে হাঁটছিল। হঠাৎ পরিচিত গলার শব্দ শুনে পেছনে তাকায়। উকিল বাবু রিক্সা থামাতে বলেন। রিক্সা থেকে নেমে পকেট থেকে গুনে গুনে নেতিয়ে পড়া দুটি এক টাকার নোট আর পন্চাশটি পয়সা রিক্সাওয়ালাকে দেয় আর বলতে থাকে-
-এখনো বাড়ি পর্যন্ত যেতে এক মাইল বাকি আছে। পুরো রাস্তাটা পাঁচ মাইলেরও কম। তুই চার মাইল পর্যন্ত এসেচিস। ভাড়া হবে দুই টাকা চল্লিশ পয়সা। নে দশটা পয়সা বেশী দিলাম।
-কি বলছেন স্যার। আমিতো আপনারে নামতে বলি নাই। এইডা অইব না। তিন টাকাই দিতে অইব।
উকিল-এইডা মঘের মুল্লুক নাকি তিন টাকা দিতে অইব।
অতীশ সে সময় সেখানে না থাকলে হয়তো একটা অঘটন ঘটে যেতো।
সত্তরের দশকের শেষ দিকে অতীশের বাবা একটি সাদা-কালো টিভি নিয়ে আসেন। অন্যের ফ্লাটে গিয়ে অতীশের টিভি দেখাটাকে পছন্দ করেতেন না। অ্যান্টেনা লাগিয়ে সে সময়ে বলিউডের সিনেমা দেখার একটা হিড়ি ছিল। অতীশও তাই একটা পুরনো অ্যান্টেনা কিনে এনে লোক দিয়ে বাড়ির ছাদে লাগিয়ে দেয়।
তবে কখনো কখনো হাওয়াতে অ্যান্টেনা ঘুরে যেত। তখন তাকে আবার জোড়ে টাইট দিতে হতো।
একদিন হঠাৎ অতীশদের অ্যান্টেনাটা চুরি হয়ে যায়।
অতীশের মাথা খারাপ হয়ে যায়। রক্ত গরম অতীশ ক্ষেপে গিয়ে হন হন করে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে সোজা থানায় চলে যায়।
দড়জায় ঠক ঠক না করেই ঢুকে যায় পুলিশ ইন্সপেক্টরের রুমে। ইন্সপেক্টর অবাক হয়ে অতীশের দিকে তাকিয়ে থাকে।
-কি ব্যাপার!
-“স্যার আমার একটা এফ আই আর লিখতে দেন”-অতীশ হর হর করে বলে যায়। চোখে মুখে বেশ গম্ভীরতা। তখনো জোড়ে জোড়ে নিশ্বাস নিচ্ছে।
-FIR? কেন? কি হয়েছে? চুরি? ডাকাতি? মাড়ামাড়ি?
অতীশ: চুরি হয়েছে স্যার।
ইন্সপেক্টর: কি চুরি হয়েছে?
অতীশ: বাড়ির ছাদ থেকে আমাদর অ্যান্টেনা চুরি হয়ে গেছে।
পুলিশ ইন্সপেক্টর অতীশের কথা শুনে কিছুক্ষন ওর দিকে তাকিয়ে থাকে। এমন ঘটনা আগে আর কখনো দেখেননি। অ্যান্টেনা চুরির কারনে কেউ থানায় এসেছে বলে শুনেননি।
ইন্সপেক্টর:অ্যান্টেনা চুরির জন্য তুমি এসেছ?
অতীশ: হ্যাঁ স্যর
ইন্সপেক্টর:অ্যান্টেনার দাম কতো?
একথা শুনে অতীশ একটু মুশকিলে পড়ে যায়। এমনি পুরনো অ্যান্টেনা। তার আবার দাম কী? তবে কোন দেরী না করে ঝটপট উত্তর দেয়-সাতশ টাকা।
ইন্সপেক্টর: নতুন অ্যান্টেনা?
অতীশ: হ্যা সার। গত মাসে কিনেছি।
এবার পুলিশ ইন্সপেক্টর একজন কনস্টেবলকে আদেশ দিলেন একটা জেনারেল ডায়রী করতে। যথারীতি জিডি করা হলো। তারপর অতীশকে বললো-পুলিশ যাবে। ইনভেস্টিগেশন করবে। তারপর দেখা যাবে।
অতীশ বাড়ি ফিরে আসে। সপ্তাহ যায় কিন্তু পুলিশ আর আসে না। মেজাজ বিগরে যায়। আবার থানায় আসে।
অতীশ (বেশ রাগের সুরে)- কি হোল। গত সপ্তাহে জিডি করে গেলাম। আমাদের অ্যান্টেনা চুরির ব্যাপারে। জিডি নাম্বার এতো। কি ব্যাপার বলুনতো। পুলিশ এখনো যায়নি কেন?
কনস্টেবলটি এবার আমতা আমতা করে দুঃখের কাহিনি শুনাতে লাগল।–“আপনি তো জানেন দেশের অবস্থা। সরকার সাড়াদিনে মাত্র আট লিটার তেল দেয়। তার মধ্যে এতো সিরিয়াস চুরি-ডাকাতি হচ্ছে। আগে তেল যোগাড় করি। তারপর যাবো। একটু ধৈর্য ধরুন। নিজের পকেটের পয়সা দিয়েতো আর তেল কিনতে পারি না? তেল টেক হোক। তারপর আপনাদের বাড়ি যাবো। ইনভেস্টিগেশন করবো। এখন আপনি বাড়ি যান।
খুব মন খারাপ করে অতীশ বাড়ি ফিরে এলো।
ঠিক দুদিন পরে পুলিশ এলো। ঠক ঠক করে অতীশদের দড়জায় নক করতে লাগলো। অতীশের বাবা এসে দড়জা খুলে দেয়। পুলিশ দেখেই একটু ঘাবড়ে যায়। তারপর তেলে বেগুনে জ্বলে উঠে। জোড়ে জোড়ে ডাকতে থাকে-
-অতীশ! অতীশ! বাড়িতে পুলিশ কেন?
বাবার ভয়ানক কন্ঠে অতীশ হুর মুর খেয়ে নিজের রুম থেকে বেড়িয়ে আসে। সামনেই দুজন পুলিশ দাঁড়িয়ে আছে।
অতীশ: আমি থানায় গিয়েছিলাম। অ্যান্টেনা চুরি হয়ে গেছে।
বাবা: কই আমিতো কিছু জানি না?
হট্রগোল শুনে অতীশের জ্যাঠু এসে উপস্থিত হলেন।
জ্যাঠু: কি বললে? অ্যান্টেনা চুরি গেছে? আমি জানি কে চোর। বাড়ি ওয়ালার ঘর জামাই চোর। ও একটা ইবলিশ! পিশাচ!
এবার পুলিশের দিকে তাকিয়ে বললেন-চলেন যাই। ছাদের চাবি থাকে ওর কাছে। কাজটা ঘর জামাই বদমাসটার। এবার বুঝবে ঠেলা
পুলিশ: চুরি হলো কি করে?
জ্যাঠু: এটার উত্তরতো আপনারা দেবেন। চাবি যদি ঘর জামাইয়ের কাছে থাকে আর অ্যান্টেনা থাকে ছাদে তাহলে চোর কে হবে? সেটা বুঝাতো কঠিন কাজ নয়? চলুন চলুন। উপরে ঘরজামাইকে ধরুন আগে। তাহলেই সব কিছু জলের মতো পরিস্কার হয়ে যাবে।
পুলিশ: আপনি কে মহাশয়?
জ্যাঠুঃ আমি এই ফ্লাটের বড় কর্তা। এই ছেলেটির জ্যাঠু।-এই বলেই অতীশকে দেখিয়ে দেয়।
তারপর সকলেই চারতলায় হরহর করে উঠে আসে। হৈচৈ শুনে ঘর জামাইও বেড়িয়ে আসে।
জ্যাঠু: এই যে ঘরজামাই। ব্যাপারটা কি বলতো। আর কতোদিন চলবে এই খেইল। এবার পুলিশ নিয়ে এসেছি।
ঘরজামাই অবাক হয়ে পুলিশের দিকে তাকিয়ে থাকে। অতীশের জ্যাঠুর কথার আগা মাথা কিছুই বুঝতে পারলো না। এবার অতীশকে বললো-এই অতীশ কি হয়েছেরে? পুলিশ কেন:
অতীশ: ছাদ থেকে আমাদের অ্যান্টেনা চুরি গেছে। পুলিশ এসেছে ইনভেস্টিগেশন করতে। ছাদের চাবি যেহেতু তোমার কাছে থাকে পুলিশ তোমাক দিয়ে ইনভেস্টিগেশন শুরু করবে।
ঘরজামাই: তা বুঝলাম। কিন্তু তোর জ্যাঠু আমাকে দেখে আবোল-তাবোল কি বলছে।
জ্যাঠু (একটু ক্ষ্যাপা মেজাজ):কি বললে? আমি আবোল-তাবোল বলছি? শয়তান কোথাকার! জিব টেনে ছিড়ে ফেলবো বলছি। চুরিতো চুরি আবার বাহাদুরী হচ্ছে।
ঘরজামাই: কে চুরি করেছে? আমি? কি বলছেন এ সব?
জ্যাঠু: ঠিকই বলছি। তুই ছাড়া আর কে চুরি করতে আসবে!
তার পর শুরু হয় তুমুল ঝগড়া। কথা কাটা-কাটি থেকে এক পর্যায়ে হাতা-হাতি।
পুলিশ (ধমক দিয়ে): থামুনতো আপনারা? এই সব কি করছেন? আমাদের সামনে আপনারা ঝগড়া ফেসাদ করছেন? সাহসতো কম না আপনাদের।
জ্যাঠু: আমি আবারো বলছি! এই ঘরজামাই চোর! চাবি ওর কাছে থাকে। তাহলে অ্যান্টেনা গেল কই? স্যার ঘর জামাইকে আ্যরেস্ট করুন।
পুলিশ: থামুন আপনি? আপনার কাছে কোন প্রমান আছে? ওকে চুরি করতে আপনি দেখেছেন? এভাবে কাউকে আ্যারেস্ট করা যায় না। আমাদেরকে ইনভেস্টিগেশন করতে দিন।
এবার সকলেই ছাদে উঠে। ঘরজামাই অনবরত চেচাচ্ছে। পুলিশকে কড়া সুরে বললো-স্যার উনাকে বলুন এক্ষুনি ক্ষমা চাইতে।
জ্যাঠু: আমার ক্ষমা চাইতে বইয়ে গেছে। আর ক্ষমা চাবো কেন?-তর্জন গর্জন করে উঠলেন জ্যাঠু।
ঘরজামাই: সে তখন থেকে আপনি আমাকে ঘর জামা বলে যাচ্ছেন! আপনি আমার নাম জানেন না?
জ্যাঠু: ঘরজামাইকে ঘরজামাই বলবো না আর কি বলবে। এতে দোষ আছে, না?। কিন্তু চুরি করার সময় হুঁশ ছিল না।
ঘর জামাই: দেখুন। আপনি কিন্তু বেশী বাড়াবাড়ি করছেন। জানেন, শ্বশুর মহাশয় আমাকে রিকোয়েষ্ট করেছিলেন এখানে থাকতে। তাই থাকি। আর আপনি আমাকে চোর বলছেন কেন? মান হানির মামলা ঠুকে দেবো কিন্তু। সোজা জেলে যেতে হবে।
এবার পুলিশের একজন একটা ডায়েরি খোলে একটি পেন্সিল দিয়ে ছাদের ছবি আঁকা শুরু করলেন।
উত্তর-দক্ষিন-পূর্ব-পশ্চিম।
তারপর জিজ্ঞেস করলেন ঘর জামাইকে: আচ্ছা বাড়ির উত্তর দিকে কে থাকে? তার নাম কি? এভাবে একের পর এক প্রশ্ন করে যাচ্ছেন। আর ঘর জামাই উত্তর দিয়ে যাচ্ছে।
এসব করতে করতে প্রায় মিনিট পনের পার হয়ে গেল। অতীশ খুব মনোযোগ দিয়ে শুনছিলো ওদের কথাবার্তা। মনে মনে ভাবল খুব বড় ধরনের ইনভেস্টিগেশন হবে। ম্যাগনিফাইং গ্লাস দিয়ে ঘর জামাইয়ের হাতের ছাপ নিবে হয়তো। পুলিশ ইনভেস্টিগেশনের ব্যাপারে অতীশের কোন ধারনা নেই। তাই এমনটি ভাবা।
এবার পুলিশ ভদ্দরলোকটি থামেন। ডায়রিটি ব্যাগে ঢুকাতে যাবেন, ঠিক এমন সময় অতীশ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে-“স্যার, আপনি আজ ইনভেস্টিগেশন করবেন না। ম্যাগনিফাইং গ্লাস তো দেখছি না? হাতের ছাপ নেবেন না?
এবার পুলিশটি ক্ষেপে যায়। দ্বিতীয় পুলিশটি একটু দূরে দাঁড়িয়ে মুচকি হাসছে আর তামাশা দেখছে।
পুলিশ:মহাশয়, আমি কি শার্লক হোমস? ম্যাগনিফাইং গ্লাস দিয়ে আমি কি করবো? আপনি এসব কি বলছেন?
অতীশ: আমি ভাবলাম আপনি আজ ইনভেস্টিগেশন করে যাবেন।
পুলিশ: এটাই ইনভেস্টিগেশন। জিজ্ঞেসাবাদ করছি। চোখে দেখছেন না?
অতীশ: কিন্তু আপনি হাতের ছাপ নেবেন না?
পুলিশ: না, পুলিশ এ ভাবে কাজ করে না। আমি কি ডিটেক্টিভ নাকি?
বেশ রাগ করেই পুলিশ দুটি চলে যায়।
তার পর মাস খানেক চলে গেল। কিন্তু অ্যান্টেনা চুরির কোন সুরাহা হচ্ছে না। অতীশ আবার থানায় যায়। ইনভেস্টিগেশন করে কিছু পেল কিনা জানতে। কিন্তু বেশ হতাশা হয়েই থানা থেকে বেড়িয়ে আসতে হয় অতীশকে। পুলিশ কিছুই করতে পারল না। খুব মন খারাপ হলো।
একদিন চুপি চুপি অতীশ ছাদে উঠলো। ছাদের উঠার দড়জাটা দিনের বেলা প্রায় সময়ই খোলা থাকে। তিনতলার একটা ফ্লাটে একা এক খিট খিটে মেজাজের সরকারি চাকরিজীবি যে ভদ্রলোক থাকেন তার আ্যান্টেনাটা ছাদের এক পাশে বেশ নীচু করে লাগানো। ছুটির দিনে ভদ্রলোক সারাক্ষন বসে বসে টিভি দেখেন। আজ বাসায় নেই। অফিসে গেছে। খুব সতর্কতার সাথে অতীশ ঐ লোকের অ্যান্টেনাটা খুলে অতীশদেরটায় লাগিয়ে দেয়।
সেদিন সন্ধ্যায় ঐ লোকের দড়জায় অতীশ কড়া নাড়ল।
অতীশ: দাদু, দেখেছেন তো, কয়দিন আগে এখানে পুলিশ এসেছিল।
আপনি কিন্তু খুব সাবধানে থাকবেন। ইদানিং কিন্তু অ্যান্টেনা খুব চুরি হচ্ছে। আমাদেরটাও চুরি হয়েছিল, আমি থানায় গিয়েছিলাম। আপনি কিন্তু অ্যান্টেনা সামলিয়ে রাখবেন।
ভদ্রলোক অতীশের কথা শুনে একটু চিন্তিত মনে হলো।
ঠিক পরের দিন সকালে তিন তলার ভদ্দরলোক দৌড়ে এসেছে। দড়জায় অনবরত কড়া নাড়তে লাগলো। অতীশ দড়জা খুলে দিতেই---
-এই অতীশ! আমার সর্বনাশ হয়ে গেছে! আমার অ্যান্টেনা চুরি হয়ে গেছে। কি কান্ড বলতো? এই কি নতুন উপদ্রব শুরু হয়েছে এই বাড়িতে। তুমি কি জানো কে এ কাজটা করেছে?
অতীশ: না দাদু, আমি কি করে জানবো। বললাম না, আমি থানায় গিয়েছিলাম। আমাদেরটা আর পাওয়া গেল না।
-আচ্ছা একটা কাজ করলে হয় না? আমরা সবাই যদি ডি এম (ডিস্ট্রিক ম্যাজস্ট্রেট)-কে চিঠি লিখি?
অতীশ:এটা মন্দ বলেননি। ডি এমকে আপনি অবশ্যই চিঠি লিখতে পারেন। আপনি হলেন সরকারি চাকুরিজীবি। আমার কথা শুনবে কেন? আপনি হলেন রিপ্রজেনটেটিভ অব গভর্নমেন্ট আর ডি এম হল হেড অব দা গভর্নমেন্ট অব দি ডিস্ট্রিক। আপনি লিখুন। কাজ হতে পারে।
অতীশের কথাগুলো ভদ্রলোকের তেমন পছন্দ হলো না বলে মনে হলো। খুব নিরাশ হয়েই মৃদু ভাবে পা ফেলে সিড়ি বেয়ে উপরে উঠতে থাকে। আর বির বির করে চোরের গোষ্ঠী উদ্ধার করছে।