শেষ বিকেলের ঝড়


বিষ্ণুপুর গ্রামটি খুব ছোট। মাত্র দুইশত পরিবারের বসবাস।

পাশের গ্রামটি খন্জনাপুর। কুমিল্লার এক অজ পাড়াগ্রাম। একসময় যাতায়াতের প্রধান বাহন ছিলো গরুর গাড়ী। দুর দুরান্তে যাওয়ার জন্য উত্তম ব্যাবস্থা ছিলো নৌকা। গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে কৃশকায় ডাকাতিয়া নদীটি। সে নদীটির সাথে যুক্ত একটি খাল চলে যায় খঞ্জনাপুর গ্রামের জমিদার বাড়ীর বড়ো পুকুরের এক পাশ দিয়ে। পুকুরটি বিশালাকার আর চারিদিকে অসংখ্য তালগাছ ছিলো বলে এলাকায় তালদিঘী নামে বেশ সুপরিচিত।

জমিদার পালবাবুর ছিলো বেশ হাঁকডাক। সজ্জন মানুষ হিসেবে আশে-পাশের গ্রামে তার বেশ সুনাম ছিলো। তিনিই গ্রাম বাসীর সুবিধার জন্য পুকুরের পাশের খাল দিয়ে নৌকায় চলাচলের জন্য বেশ সুন্দর একটা ব্যবস্থা করেছিলেন। বজরা থেকে শুরু করে ডিঙ্গি ও পানসী নৌকার চল ছিলো সেই সময়। নৌকা নোঙ্গর করার জন্য পাল বাবু ভালো ব্যবস্থা করেছিলেন। জমিদার বাবুর সাজানো বজরাটিও ঐখানে নোঙ্গর করা থাকতো। প্রতি সপ্তাহে একদিন বজরা নিয়ে নদী ভ্রমনে বেরুতেন। কিন্তু বৃটিশ শাসন শেষ হতে না হতেই জমিদারী প্রথা বাতিল হওয়ায় জমিদারিত্বে নামে ধ্বস। পঞ্চাশের দশকের শেষ দিকেই পালবাবু এক রাতে পরিবারের সবাইকে নিয়ে বাপ-দাদার বানানো ভিটে বাড়ী ছেড়ে ভারতে পাড়ি দেন।  তারপর থেকে এই বাড়ীটি খালি পড়ে আছে। বাড়ীর নীচ তলায় অবশ্য জমিদার বাড়ীর দূর সম্পর্কের একটি পরিবার থাকে। সূর্য সেন গ্রামের প্রাইমারী স্কুলের অংকের শিক্ষক।

 

এই বাড়ীটিই এ অঞ্চলের ইতিহাসের সাক্ষী।

বিস্মৃত ইতিহাসের পাতায় এই  অঞ্চলে দাঁড়িয়ে আছে এক সময়ের শক্তিশালী জমিদার পাল বাবুর ক্ষয়িষ্ণু সম্পত্তি। বিগত যুগের এই ধ্বংসাবশেষের প্রতি সময় যেন বেশ নির্দয় ছিল। গৌরব গাঁথা এর মহিমা এখন ভেঙে পড়া দেয়াল এবং অতিবৃদ্ধ উঠানে নেমে এসেছে। একসময় ধন ও ক্ষমতার ঐশ্বর্যের ঢেউ খেলানো, প্রাসাদটি এখন সময়ের ব্যবধানের একটি ভুতুড়ে বাড়ীর মতোই যেন দাঁড়িয়ে আছে। তার পরিত্যক্ত হলগুলোর  ভগ্নদশা যেন নীরব বিলাপের প্রতিধ্বনি। অন্ধকারময় এক নীরবতা যেন ভর করেছে এই জমিদার বাড়ীটিতে। সময়ের সাথে কালের ইতিহাসে হারিয়ে গেছে জমিদার বাড়ির বিগত দিনের স্মৃতিগুলো।

বিষ্ণুপুর গ্রামটি ছোট হলেও এটি যেন বাংলাদেশের সবুজ প্রাকৃতিক শ্যামলিমার মাঝে ফুটে উঠা একটি পদ্ম। চারিদিকে সবুজের আথালি-পাথালি শিহরন। এই গ্রামে বাস করত সামন্ত নারায়ন দাস ও তার ছোট পরিবার। খুব সাদামাটা, সহজ সরল ছিলো এই দাস পরিবারটি। দারিদ্রতার চিহ্ন চোখে মুখে, ঘর-দুয়ারে, বাসন-কুশনে, পোশাক-পরিচ্ছদে, চলনে -বলনে। কিন্তু সবার মধ্যে ছিলো প্রাঞ্জল ভালোবাসা আর একতার ছোঁয়া। পরিবারের কর্তা সামন্ত দাস ছিলেন একজন কৃষক যার হাতে বহু বছর ধরে উর্বর মাটির যত্ন নেওয়ার দাগ লেগে আছে। তার সহধর্মীনি স্ত্রী পুতুল দাস যেন শক্তির স্তম্ভ যার অটল ভক্তি তাদের বিনম্র আবাসকে ধরে রেখেছে পরম মমতায়। দুই সন্তান-রেখা আর বিনয়। বিনয় সবার ছোট। কৈশোরের হাওয়া লেগেছে মনে-প্রানে। হাসিতে ভরে থাকে উচ্ছ্বাসে ভরা মুখ। হাসির মৃদু শিহরন যেন ভেসে বেড়ায় দিগন্ত জোড়া মাঠের শূন্য আকাশে পরম যত্নে। রেখা বড় মেয়ে যার স্বপ্ন দিগন্তের বাইরে প্রসারিত। সুন্দর এক ভবিতব্যকে যত্ন করে বুকে ধরে রাখতো সারাক্ষন।

 

খুব ছোট কোমলমতি বয়স থেকেই রেখার আকাঙ্ক্ষার পরিধিটা ছিলো বেশ প্রশস্থ। গ্রামের অতি সাধারন আটপৌরে গন্ডির বাইরে প্রসারিত। যখন গ্রামের সমবয়সী অন্যান্য শিশুরা ধানের শীষের মধ্যে ঝাঁকুনির তালে তালে খেলায় মগ্ন থাকতো, গাঁয়ের পুকুরে ডিগবাজীতে লুটোপুটি খেতো, তখন সে ছোট্ট রেখা ছিন্নভিন্ন পাঠ্যপুস্তকের পাতায় সান্ত্বনা ও সুখ খুঁজে পেতো। তার হৃদয় গরীব অসুস্থদের নিরাময় এবং গ্রামবাসীদের দুঃখকষ্ট দূর করার তীব্র আকাঙ্ক্ষায় জ্বলে ওঠতো। স্বপ্নের রাজ্যে ভেসে বেড়াতো আশার আলোকবর্তিকা হয়ে। সহানুভূতি আর দয়ায় ভরা মনটা অন্যের দুঃখে কেঁদে উঠতো। অন্যদের মধ্যে আনন্দ ছড়িয়ে দেওয়ার এক অতৃপ্ত আকাঙ্ক্ষায় পূর্ণছিলো তার মন। প্রতিটি ক্ষণস্থায়ী মুহুর্তের সাথে সাথে তার সংকল্পরা যেন আরও দৃঢ় হয়ে ওঠতো। নিজের পরিবার খুব গরীব বলে অন্যের কষ্টটাকে বুঝতে পারতো খুব সহজে। আর তাইতো শুধুমাত্র কম ভাগ্যবানদের সাহায্য করার বিশুদ্ধ চেতনায় স্বপ্নের বাগানে পাতাকুড়োনীদের মতো সাফল্যের পাতা কুড়াতো। কখনো বা রাতের আকাশে মিটমিট করা তারাগুলির সাথে তাকিয়ে থাকতো, উচ্ছ্বাসে বুকটা ফুলে উঠতো কোন এক সুন্দর সকালের আশায়।

গ্রাম থেকে প্রায় আট মাইল দূরে ছিলো নিকটতম হাসপাতাল। গ্রামের পথ দিয়ে তখন পর্যন্ত কোন পাকা রাস্তা গড়ে উঠেনি। খুব কষ্ট করে গরুর গাড়ী করে স্বাস্থ্যসেবা সুবিধা নিতে আকাঁ-বাকা অমসৃন মেঠো পথ ভেঙ্গে যেতে হতো গ্রামবাসীদের। অনেক দরিদ্র গ্রামবাসীর জন্য স্বাস্থ্যকেন্দ্রের পরিষেবাগুলি নেওয়াটাও ছিলো অপ্রাপ্য। মানুষের দুর্ভোগে রেখার মনটা ভারাক্রান্ত হতো, ধুক ধুক করে বুকটা কেঁপে উঠতো। সে বড়ো হয়ে কিছু একটা করতে চায়। আশায় বুক বাঁধে। প্রত্যয়ের শিহরনে শিহরিত হয়। সংকল্পের বুদ্ বুদ্ শিখা জ্বলতে থাকে দুচোখে।

 

গরীব হওয়া সত্বেও বাবা- মা মেয়ের স্বপ্নকে লালন করতেন। মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরতেন। মাথায় হাত বুলিয়ে বলতেন-

-তুমি স্বপ্ন দেখে যাও মা। ভগবান একদিন তোমার স্বপ্ন পূরন করবেন।

-কিন্তু আমরা যে গরীব বাবা। আমি যে ডাক্তার হতে চাই। অনেক টাকার ব্যাপার। আমরা কোথায় পাবো মা?-নিরাশ চোখে তাকিয়ে থাকে বাবা-মার দিকে।

-তুমি টাকা-পয়সা নিয়ে চিন্তা করো না। তোমার স্বপ্নটাকে পূরন করতে হলে আগে তোমাকে ভালো করে পড়াশুনা করতে হবে। -বাবা মেয়ের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে মেয়েকে বুঝাতে থাকে।

 

বাবা বৃটিশ আমলের মানুষ। ইংরেজীতে লেখা পড়া করেছিলেন। এন্ট্রান্স পরীক্ষা দিতে পারেননি। ভারত ভেঙ্গে দুই টুকরো হয়ে যায়। কলকাতার রায়টের খবর শুনে সামন্তলালের পিতা একদিন বাড়ীর উঠোনেই অজ্ঞান হয়ে যান। রাত পার হতে না হতেই দেহটা নিথর হয়ে যায়। বাবার মৃত্যুর পর সংসারটার হাল ধরে সামন্ত। ভেঙ্গে যায় জীবনের সব স্বপ্ন। সংসারে মা এবং দুটি ছোট ছোট বোন। শুরু হয় সামন্তের নতুন জীবন। জমি-জমা নিয়েই সময় কাটে। বাবা যে কৃষি জমি রেখে গেছেন তা দিয়ে গ্রামের পরিবেশে বেশ আরামেই চলে যাচ্ছে সামন্তের সংসার।

সময়ের বুকে হামাগুড়ি দিয়ে চলতে চলতে কখনো টেরও পায়নি যে বোন দুটি বাড়ন্ত হয়েছে। দেখতে শুনতে বেশ ভালো ছিলো বলে বিয়ে দিতে তেমন কোন অসুবিধা হয়নি। শুধু দুইটা ফসলী জমি কম দামে বিক্রি করতে হয়েছে। বোন দুটির বিয়ের পর সংসারটাকে যেন আর সংসার মনে হচ্ছিলো না। খুব খালি খালি মনে হচ্ছিলো।

মায়ের পীড়াপীড়িতে একদিন সামন্ত বিয়ের পিঁড়িতে বসে।

সামন্ত শিক্ষার কদরটা বেশ বুঝে। মেয়ের মধ্যে পড়াশুনার স্বপ্নে ওর চোখ কেমন ভিজে উঠে। নিজের স্বপ্ন-ভাঙ্গা প্রাসাদের উপর মেয়ের স্বপ্নের প্রাসাদকে দেখতে পায়। এই ভেবেই এক প্রাঞ্জল খুশিতে মনটা ভরে উঠে। প্রতিজ্ঞা করে মেয়ের স্বপ্নের পথে পথ চলার। প্রয়োজনে সব ফসলি জমি বিক্রি করে দেবে। তবু মেয়েকে ডাক্তার বানাবে। মেয়ে ডাক্তার হয়ে গ্রামের মানুষের সেবা করবে-ব্যাপারটা ভাবতেই সামন্তের খুব ভালো লাগে।

 

রেখাও তার স্বপ্নকে বুকে বেঁধে চলতে থাকে।

বাড়ীতে যতোটুকু সময় পায় মাকে রান্না-বান্নায় হাত দেয়, আর বাকী সময়টা পড়াশুনা নিয়ে ব্যাস্ত থাকে। স্কুলে রেখা কোনদিন দ্বিতীয় হয়নি। সবসময় ক্লাশে ফার্স্ট হয়। গ্রামের আশে-পাশে কোন স্কুল ছিলোনা। প্রতিদিন এক ঘন্টা হেঁটে স্কুলে আসতে হতো। কর্দমাক্ত রাস্তা বর্ষাকালে চলাচলের ছিলো অযোগ্য। বৃষ্টিতে মাথায় ছাতা ধরবে সে সাধ্যিও ছিলো না। প্রায় সময় রাস্তা থেকে বড়ো কোন বনজ কচু গাছের পাতা মাথার উপর ধরে রাখতো। হাত দিয়ে বুকে ধরে রাখা বইগুলি রক্ষা পেলেও গায়ের জমা কাপড় বৃষ্টির জলে আধ ভিজে হয়ে গায়ের সাথে লেপ্টে থাকতো।

কিন্তু রেখা হাল ছাড়েনি। বৃষ্টি ও কাদার মধ্যে দিয়েই হেঁটে যেতো। প্রতিকূলতার মুখে তার সংকল্প ছিলো অটুট। রেখার মধ্যে কিন্তু  ক্লান্তি নেই। চোখে-মুখে সব সময় একটা প্রশান্তির ভাব, অমলীন সৌন্দর্যের ছোঁয়া।

দুঃখ কষ্ট আর নানা প্রতিকুলতার মধ্যে দিয়ে পথ চলতে চলতে একদিন রেখা স্কুলের গন্ডি পার হয়ে পাশেই থানা শহরে একটি কলেজে ভর্তি হয়। মেট্রিকে খুব ভালো রেজাল্ট করে বলে পুরো বিনা খরচে কলেজে পড়ার সুযোগ পায়। সাথে মেধাবী বৃত্তি পাওয়া শুরু করে।

রেখার ভালো রেজাল্টের খবর দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে পুরো আশে-পাশের গ্রামে।

গ্রামের একটি দরিদ্র পরিবারের একটি তরুণী অসাধারণ কিছু অর্জন করেছে বলে সকলের মধ্যে ছিলো উচ্ছ্বাস আর উত্তেজনা। নিখুঁত সংকল্প এবং অটল পরিশ্রমের কারনে সামন্তের মেয়ে তার স্কুল পরীক্ষায় শীর্ষস্থান অর্জন করেছে, এমন একটি খবর যেন গ্রামবাসীদের কল্পনার বাইরে ছিলো।

 

একদিন সূর্যাস্তের সাথে সাথে পুরো গ্রাম খোলা আকাশের নীচে গ্রামের খোলা প্রান্তরে জড়ো হয়েছিলো রেখার সাফল্যে। তাদের মুখগুলি যেন তেলের প্রদীপের জ্বলন্ত শিখায় আলোকিত ছিলো। আনন্দে সবাই নেচে-গেয়ে সেদিন খুশীতে লুটোপুটি খেয়েছিলো। ঢোলের ছন্দময় তাল এবং ঐতিহ্যবাহী সঙ্গীতের সুরেলা গান বাতাসকে ভরিয়ে দিয়েছিলো সেদিন। সবার মধ্যে মনি হয়ে দাঁড়িয়েছিলো গ্রামের শান্তিপ্রিয় কিশোরি মেয়েটি যা আগামী প্রজন্মের জন্য আশা এবং অনুপ্রেরণার প্রতীক হয়ে থাকবে। আনন্দের অশ্রু তার বাবা-মায়ের চোখে জ্বলজ্বল করছিলো। অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছিলেন রেখাকে শিক্ষা অর্জনের সুযোগ দেওয়ার জন্য। সেই মুহুর্তে, পারিবারিক ভালবাসার উষ্ণতা এবং গ্রামের সংহতির মধ্যে এক সীমাহীন সম্ভাবনার অনুভূতির স্বপ্নের পায়রা যেন পেখম মেলে পত পত করে উড়তে শুরু করেছে।

সময়ের সাথে সাথে রেখা বড়ো হতে থাকে। বেড়ে যায় দ্বায়িত্ববোধ। তবুও তার স্বপ্ন ছিলো অটল। গৃহস্থালির কাজকর্মের সাথে সাথে তার পড়াশুনা চলছে ঠিকঠাক। তার দিনগুলি ভোরের আগে শুরু হয়ে সন্ধ্যার পরে শেষ হতো। তার বাবা, তার মেয়ের হৃদয়ের মধ্যে যে আগুন জ্বলছে তা প্রত্যক্ষ করে, তার স্বপ্নকে যে কোনো উপায়ে সফল করার সংকল্প করেছিলেন।  মেয়ের শিক্ষার জন্য অর্থায়নের যোগান দিতে তিনি তাদের জমির একটি অংশ যা ছিলো সংসারের সকলের ভরণ-পোষণের উৎস একদিন  বিক্রি করে দিলেন।

পরিবারের সকলের আত্মত্যাগ সত্ত্বেও, রেখার স্বপ্ন পূরনের যাত্রা অনিশ্চয়তায় ভরা ছিল। উচ্চশিক্ষার পথকে মনে হচ্ছিল এক অদম্য পাহাড়ের মতো। পাহারের  চূড়াটি ছিলো সন্দেহ ও হতাশার কুয়াশায় ঢাকা। তবুও, অন্ধকারের মধ্যে যেন একটি বৃত্তি আকারে আশার রশ্মি উঁকি মারছিলো। আর সেই আলোর পথ ধরেই এগিয়ে চলছিলো অজপাড়াগাঁ বিষ্ণুপুরের মেয়েটি।

তার পরিবারের সমর্থন এবং পাড়া-প্রতিবেশীদের উদারতাকে সঙ্গে নিয়ে রেখা তার যাত্রার পরবর্তী অধ্যায় শুরু করে। যে যাত্রায় ছিলো না পারিবারীক আয়েশ, বন্ধুদের সাথে মেলামেশার যৌবনের উচ্ছ্বাস কিংবা আনন্দের উল্লাসে নিজকে কোন এক সোনালী সন্ধ্যায় পাশের পুকুরের ঘাটে বসে অমিয় দৃষ্টিতে দেখবে অস্তরাগের অপূর্ব মহিমা। সব কিছুকে ছেড়ে দিয়ে পরিবার আর পড়াশুনায় মনোযোগ দেয়। হাইয়ার সেকেন্ডারীতে জেলা পর্যায়ে প্রথম স্থান পায়। স্বপ্ন পূরনের পথ যেন ধীরে ধীরে মসৃন হতে থাকে।

 

ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন বিভোর বিষ্ণুপুরের মেয়েটি একদিন ঢাকায় মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হয়। একদিকে আনন্দের উচ্ছ্বাস আর অন্যদিকে এক অজানা আতংক। এই প্রথম ঢাকায় আসা। রেখার বাবা কোনদিন জেলা শহরেও আসেনি। বাবার মুখে শুনেছে দাদু নাকি কখনো রিক্সায়ও চড়ে নাই। এতো বড়ো ঢাকা শহরে সব কিছুই অপরিচিত। চারিপাশের নানা চ্যালেঞ্জকে সামনে রেখেই  তার কাঁধে থাকা অনিন্দ্য সুন্দর প্রত্যাশার ভার নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল মন প্রান দিয়ে ডাক্তারী পড়ায়।

এখানেই কলেজে পরিচয় হয় ফরিদপুরের ছেলে অমিতের সাথে। খুব মিষ্টভাষী অমিত। সদা উৎফুল্লে ভরা চোখ মুখ। একই ক্লাশে পড়ে। বেশ মেধাবী। পরিচয় থেকে ভাবসাব, ভালোলাগা। অমিত প্রান দিয়ে ভালবাসে রেখাকে। রেখাও খুব ভালবাসে অমিতকে কিন্তু কখনো প্রকাশ করতে পারেনি। কোন এক অজানা ভয় নিজকে আচ্ছন্ন করে রাখতো সারাক্ষন। স্বপ্নের হাতছানিতে মগ্ন রেখার যেন অন্যকিছুতে মনযোগ দেয়ার কোন ফুরসৎ নেই। তাই সব সময় কলেজ আর পড়াশুনা নিয়ে ব্যস্ত।

 

গ্রামের মেয়েটি যখন গ্রাম থেকে এসে ঢাকার কোলাহলপূর্ণ রাস্তায় প্রথম পা দেয়, তখন সে শহরের চোখ ধাঁধানো দৃশ্য, চতুর্দিকের অনবরত শব্দ এবং অনুভূতির ঘূর্ণিতে আচ্ছন্ন হয়ে থাকত যা সে কখনও আগে গ্রামের নিরবতায় অনুভব করেনি। স্পন্দনশীল আকাশের নিচে সুউচ্চ গগনচুম্বী ভবনগুলোকে রেখার খুব ভালো লাগতো। একদিন এই বিশৃঙ্খলা আর নানা শহুরে জীবনের প্রতিকুলতার মধ্যেই যেন অমিতের অমিয় বিশ্বাসে রেখা তার সামনে এগিয়ে চলার ব্যাঞ্জনা খুঁজে পায়।  সে বুঝতে পারে তার এই যাত্রাপথে অমিত একজন বিশ্বস্থ বন্ধু। তার মাঝেই যেন শহুরে জীবনের কোলাহলের মধ্যে, গ্রামের হরিন চোখা কিশোরী তার কণ্ঠস্বর খুঁজে পায়। যখনই সময় পায় অমিত রেখাকে পড়াশুনায় সাহায্য করে। ছুটির দিনগুলিতে হাতে হাত ধরে হেঁটে বেড়ায় ধানমন্ডির লেকের পাশে কিংবা পাশাপাশি রিক্সায় চেপে ঘুরে বেড়ায় পুরনো ঢাকার অলিতে গলিতে। বুড়িগঙ্গার পাশ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে অনেক সন্ধ্যা কাটিয়েছে অস্তখামী সূর্যের লাল আভা দেখতে দেখতে।

 

দিন যায় রাত আসে। অতিবাহিত হতে থাকে রেখার -অমিতের শহুরে জীবনের দিনগুলি। ধীরে ধীরে অমিতের প্রতি রেখার ভালোবাসার উচ্ছ্বাস বাড়তেই থাকে। ভালোলাগা থেকে কখন যে অমিতকে ভালোবেসে ফেলে রেখা বুঝতেও পারেনি। এমনি করেই কেটে যায় পুরো পাঁচটি বছর। একদিন দুজনেই শেষ করে মেডিক্যাল কলেজের জীবন। রেখা-অমিত দুজনেই এখন ডাক্তার।

রেখা অমিতকে খুব ভালোবসে। রেখার শহরে জীবনের সারথী হয়ে অমিত চলার পথে এক সাথে হেঁটেছে, সুখে-দুঃখে পাশে থেকেছে, রেখার প্রতিটি অনুভূতিকে বুঝার চেষ্টা করেছে, অমলীন ভালোবাসায় রেখাকে পাশে টেনেছ এ যে জীবনের পরম প্রাপ্তি। তাই মুখে অমিতকে না বললেও মনে প্রানে অমিতকেই জীবনে পরম বন্ধু হিসেবে জেনেছে। সিদ্ধান্ত নেয় অমিতকেই বিয়ে করে গ্রামে ফিরে যাবে। অমিতও গ্রামে গিয়ে মানুষের সেবা করতে চায়। দুইজনেই ঢাকার একটি প্রাইভেট হসপিটালে চাকুরীতে যোগ দেয়।

 

কিন্তু রেখা-অমিতের জীবন আকাশে হঠাৎ করেই যেন কালো মেঘের আনাগোনা শুরু হলো। এতোদিনের সম্পর্ক। কখনোই রেখা অমিতের পরিবার সম্পর্কে কিছু জানতে চায়নি। কিন্তু গতকাল সন্ধ্যায় অমিতের কাছে যখন ওদের পরিবার সম্পর্কে জানতে পারলো তখন থেকেই এক অজানা ভয়ে রেখা আচ্ছন্ন হয়ে আছে। সারা রাত ঘুমুতে পারেনি। অমিতই গতকাল রেখাকে কাজ শেষে নিয়ে যায় লেকের ধারে। অনেকক্ষন ছিলো সেখানে। অমিতের মুখে ওর বাবা অমিতের বিয়ের বন্দোবস্ত করছে খবরটা শুনে রেখা নির্বাক হয়ে যায়। কিছুই বলতে পারেনি রেখা অনেকক্ষন। স্থিরভাবে দূরে লেকের জলে হাঁসেদের দিকে তাকিয়ে ছিল।

-কিন্তু, তুমি ভেবো না প্লিজ। আমি যে এক মাত্র তোমাকেই ভলোবাসি। তোমাকে ছাড়া আমি আর কিছুই ভাবতে পারছি না।

-আমার খুব ভয় হয়, অমিত। কেমন সব কিছু ওলোট-পালোট লাগছে আমার।

-আমি সব বুঝিয়ে বলবো। কালই আমি বাড়ীতে যাবো। তুমি কিচ্ছু ভেবো না। বাড়ী থেকে বিয়ের সব ব্যবস্থা করেই আসবো। এক সপ্তাহের মধ্যেই আমি চলে আসবো।

 অমিত পরের দিন নিজের বাড়ীতে চলে যায়।

কোলাহলপূর্ণ ঢাকা শহরে, জীবনের বিশৃঙ্খল ছন্দের মধ্যে, দুটি আত্মা যেন গত কয়েকটি বছর একে অপরের উপস্থিতিতে সান্ত্বনা খুঁজে পেয়েছিল। অমিত এবং রেখা, উভয়ই নিবেদিতপ্রাণ ডাক্তার। ছিলো দুজনের মধ্যে ভালবাসার এক নিবির বন্ধন।

হাসপাতালের দিনগুলি তাদের ব্যস্ততায় কাটতো বটে, তবুও হাসপাতালের করিডোরের তারা একে অপরের সাথে শান্তির মুহূর্তগুলি খুঁজে পেয়েছিল অমলিন বন্ধুত্বের ছোঁয়ায়।

 

অমিত চলে যায়। স্বপ্নে বিভোর রেখার মন চলে যায় তার পরিবারের দিকে। সরলা মায়ের মুখটি ভেসে উঠে। বাবার কষ্টের মুহূর্তগুলি সেলুলয়েডের পর্দার মতো চোখে ঘুরতে থাকে। এক অব্যাক্ত কান্নাকে বুকে চেপে ধরে রাখে। তবুও এগিয়ে চলছে উদ্যমতাকে ভর করে। মনযোগ দেয় কাজে। দিন শেষে সপ্তাহ যায়। সপ্তাহ শেষে মাস। এমন করে পুরো একটি বছর কেটে যায়। কিন্তু অমিত আর ফিরে আসে না।

একদিন বুকে ধারন করা স্বপ্নকে নিজের হাতে গ্রামের মানুষের কল্যানে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য সামন্তের মেয়ে তার গ্রামে ফিরে আসে। গাঁয়ের মেঠো পথের পাশে সুশৃংখল ভাবে গজিয়ে থাকা দূর্বা ঘাসের গন্ধে, খঞ্জনাপুরের জমিদার বাড়ীর তাল দিঘিতে উন্মাদ সাঁতারের দিনগুলিকে পরম মমতায় আলিঙ্গনের নেশায় দুদন্ডের যেন শান্তি নেই। যেখান থেকে শুরু হয়েছিলো জীবনের পথ চলা সেই বিষ্ণুপুরে মানুষদের প্রতি পরম কৃতজ্ঞতায় চোখ ঝাঁপসা হয়ে আসে রেখার। সবুজ ঘেরা ধান আর সারি সারি আম বাগানের পাশেই একটি চম্ৎকার জায়গা দান করেন খঞ্জনাপুর গ্রামের এক ধনাঢ্য কৃষক। আর সেই জায়গাতেই গ্রামবাসীর সেবার জন্য একটা আধুনিক ক্লিনিক তৈরী করেন। হাসপাতালের নাম “খঞ্জনাপুর কমিউনিটি ক্লিনিক।“ রেখার উপরই সেই হাসপাতালের দায়িত্ব তুলে দেন। দায়িত্ব পেয়ে মাস খানেকের মধ্যেই ডা.রেখা জানাশুনা আরো কয়েকজন ডাক্তারকে শহর থেকে নিয়ে আসে।

 

ডাক্তার রেখার শুরু হয় জীবনের আরেক নতুন অধ্যায়। অতি ব্যস্ততায় কাটে তার জীবন। বাবা -মা বিয়ের জন্য চাপ দিলেও রেখার সে দিকে কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। গরীব মানুষের সেবায় কেটে যাচ্ছে সময় দ্রুত গতিতে। কেমন করে যে জীবন থেকে আরো পাঁচটি বছর কেটে গেলো বুঝতেও পারেনি রেখা। একদিন সামান্য জ্বরে বাবাও চলে গেলেন পরপারে। ছোট ভাই শহরে সরকারী কৃষি অফিসার। প্রতি মাসেই বাড়ীতে আসে।

 

ধীরে ধীরে ডাক্তার রেখার নাম ও সুখ্যাতি তার ক্লিনিকের দেয়াল ছাড়িয়ে বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃত হয়।  

দিগন্তের উপর সূর্য অস্ত যাওয়ার সাথে সাথে গ্রামের উপর সোনালী আভা ছড়িয়ে দিয়ে ডাঃ রেখা দাস গ্রামের মানুষের মধ্যে নিয়ে এসেছেন নতুন আশা। প্রত্যন্ত গ্রামের প্রাণকেন্দ্রে খঞ্জনাপুরের ক্লিনিক স্বপ্নের শক্তির প্রমাণ হিসাবে দাঁড়িয়ে আছে - একটি আশার আলো, আগামী প্রজন্মের জন্য পথ আলোকিত করে।

 

একদিন হঠাৎ করেই এক্সিডেন্ট এন্ড ইমার্জেন্সী থেকে ডাক আসে। রেখা তখন নিজের অফিসেই বসে ছিলো।

-ম্যাডাম, আপনাকে একবার এক্ষুনি আসতে হবে।

-কেন? কী হয়েছে?-রেখার কন্ঠে বিস্ময়ের সুর

-একটা সিরিয়াস রোগী ভর্তি হয়েছে।  এক্সিডেন্ট করেছে। অবস্থা খুব খারাপ। কয়েকবার আপনার নাম উচ্চারন করেছে।

নার্সের কথা শুনে রেখার বুকটা ধুক ধুক করে উঠলো। চেয়ার থেকে উঠেই সাদা ইউনিফর্মটা গায়ে জড়িয়ে দ্রুত হাঁটা শুরু করলো। যাওয়ার পথে একজন ডাক্তারকে বলে গেল আজকের নির্ধারিত নতুন ডাক্তার নিয়োগের ইন্টারভিউর টাইমটা একটু পিছিয়ে দিতে। সোজা চলে এলো এক্সিডেন্ট এন্ড ইমার্জেন্সী ব্লকে। রোগী বেডে শুয়ে আছে। সারা শরীর রক্তে ভেজা। রক্ত দেওয়া হচ্ছে। অন্যদিকে পাশ ফিরে শুয়ে আছে রোগী।

 

রোগীর কাছে তখন দুজন ডাক্তার ও নার্স ছিলো। ওদেরকে খুব চিন্তিত মনে হচ্ছিল। রেখা রোগীর ডান হাত ধরে পালস দেখার চেষ্টা করলো। ঠিক এমন সময় রোগীটি পাশ ফিরে রেখার দিকে তাকালো।

হঠাৎ করেই রেখার বুকে যেন কেউ এক বিশাল ঠান্ডা বরফের টুকরো ছুড়ে দিলো। সারা শরীর মুহূর্তেই ঠান্ডা হয়ে গেলো। বুকের ভেতর নেমে এলো উত্তাল সমুদ্রের ধেউয়ের আথালি-পাথালি। পা দুটি কেমন অবশ হয়ে আসছিলো।

-অমিত!-অস্ফুট সুরে রেখার মুখ থেকে বেড়িয়ে এলো।-অমিত তুমি?

অমিত আর কিছুই বলতে পারলো না। চোখ দুটি বন্ধ হয়ে এলো ধীরে ধীরে। ডান হাতটি রেখার হাত থেকে বেডের পাশে লুটিয়ে পড়লো। পাশের সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে রেখার দিকে।

অমিতের বুক পকেট থেকে পত্রিকার চাকুরির বিজ্ঞাপনের কাগজের টুকরাটি তুলে নিলো রেখা।

চারপাশে ঝলসে যাওয়া ফুল এবং নীরব অশ্রুতে ঘেরা জ্বল জ্বলে চোখে, রেখার হৃদয় অব্যক্ত ভালবাসার ভারে হু হু করে কেঁদে উঠলো। যে মানুষটির প্রতি তার অনুভূতির গভীরতা তাকে চুপচাপ দূর থেকে ভালবাসতে পারায় দুদন্ড শান্তি দিয়েছিল, এখন, সে চলে গেছে, চিরতরে তার নাগালের বাইরে।