চেহারার মধ্যে কী যেন একটা যাদু ছিল অর্পিতার।
চোখ ধাঁধানো, মন কাড়ানো, কেমন কেমন লাগা ভাব। ঠিক যেন সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে চোখ কচলাতে কচলাতে দরজা খুলতেই প্রথম রোদের সোনালী আভা মুখে আছড়িয়ে পড়লে হঠাৎ প্রানটা খুশীতে উছলে উঠার মত। অথবা অবিশ্বাস্যভাবে ভাগ্যের কপালে তীলক পড়িয়ে ধুম করে লটারীতে কোটি টাকা পাওয়ার খবরে মনের ভেতরে উচ্ছ্বাসের দাপানি শুরু হওয়ার মতো।
হঠাৎ করেই যেন সব কিছু উলোট-পালট হয়ে গেল ইশানের জীবন।
এক সন্ধ্যায় ফেইসবুক ব্রাউজ করতে করতে হঠাৎ একটি ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট এল। অর্পিতা নামটি দেখেই ইশানের মনটি ছ্যাৎ করে উঠে। নামের মধ্যেই যেন যাদু। বেশ কৌতূহলী হয়ে ইশান রিকোয়েস্টটি গ্রহণ করল। শীঘ্রই প্রোফাইল স্ক্রল করতে শুরু করল। প্রোফাইল ছবিটিতেই চোখ আটকে যায়। ছবিটি যেন এক উষ্ণতা ও আত্মবিশ্বাসে ভরা। দুষ্টুমীর এক হাসি যেন ইশানের বুকে দাপড়িয়ে গেল।
স্ক্রীনে নানা ভাবে, ছোট বড়ো করে, ডানে-বায়ে ঘুড়িয়ে-ফিরিয়ে, নিজের চোখের পাতা বড় বড় করে বেশ মনযোগ দিয়ে বার বার ছবিটি দেখছিল। এর আগে ইশান কখনো মেয়েদের ছবি এমন ভাবে এতো খুশী মনে দেখেনি। মুখশ্রী যেন এক অপূর্ব কবিতার পঙক্তি। চোখ দুটি বিশাল আকাশের নীলিমার মতো প্রাঞ্জল। চোখ থেকে যেন একঝাঁক স্বপ্নের আলো ছড়িয়ে পড়ছে। চুলগুলি মেঘের মতো নরম। বেশ লম্বা, ঘাড় বেয়ে পা ছুঁই ছুঁই করছে। দেখে মনে হচ্ছে দূর থেকে ভেসে আসা ভোরের হালকা বাতাসে দোলে উঠছে। আর সেই দোল খাওয়া চুলে গোধূলির সূর্যরশ্মি আলতো করে চুমু খেয়ে যাচ্ছে। কান দুটি যেন ছোট্ট ফুলের কুঁড়ির মতো। অপূর্ব সুন্দর!
খুটিয়ে খুটিয়ে ফেইসবুকের ছবিগুলো দেখছে ইশান। কোন কিছুই বাদ যায়নি। ইশানের চোখের পাতায় যেন আনন্দের আবেশ ছড়িয়ে পড়ছে। চঞ্চল ময়ুরী সন্ধ্যা যেন দেবদারু গাছের মদীরা ঘ্রান ইশানের নাকে-মুখে অবলীলায় উগড়ে দিচ্ছে। ভীষন ভালো লাগছে ইশানের। একেই যেন এতোদিন খুঁজে আসছিলো ইশানের মা। বন্ধুদেরকে নিয়ে কতো জায়গায় না গিয়েছে। মেয়ে দেখার নেমন্তন খেয়েছে। এতো করেও মনের মানুষটাকে কিন্তু পায়নি। তাই একদিন আশায় বুক বেঁধে পরম দেবতার কাছে সবকিছু ন্যাস্ত করে ছেলের ভবিতব্যকে সঁপে দিয়ে পরম পূজ্য ইশানের মা না ফেরার দেশে চলে গেলেন। এই নিয়ে ইশান কতোনা দীর্ঘশ্বাস ফেলেছে।
অথচ সেদিন সে সন্ধ্যায় না চাইতেই অর্পিতার ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট।
নাকটি যেন তিলের মতো, সূক্ষ্ম এবং তীক্ষ্ণ। পুরো মুখে সৌন্দর্যের নিখুঁত ভালোলাগার আল্পনা আঁকতে যেন এই নাকটিই যথেষ্ট। আর ঠোঁট দুটি যেন গোলাপের পাপড়ির মতো, কোমলতা আর মাধুর্যের প্রতীক। সন্ধ্যার সেই মায়াময় শ্রাবনের প্রকৃতি যেন ইশানের মোবাইলে এক নিখুঁত শিল্পকর্ম গড়ে তুলছিল সেই ক্ষনে।
ইশান বর্ধিত ঢাকার এক কোনে সবুজে ঘেরা ছোট একটি মফস্বল শহরে একটি দুই রুমের ফ্লাট ভাড়া নিয়ে থাকে। বাড়ীর খুব কাছেই রয়েছে একটি জমজমাট বাজার। বাজারের ঠিক পাশেই অবস্থিত একটি স্কুলে শিক্ষক হিসেবে কাজ করছে ইশান। এখানেই অনেক বছর মাকে নিয়ে ছিল ইশানের সংসার। মায়ের মৃত্যুর পর ইশান এখানে রয়ে যায়। সংসারে আপন বলতে আর কেউ নেই। ছোট থাকতেই বাবাকে হারায়। মাই ছিল একমাত্র সম্বল। কোলে পিঠে মানুষ করেছে ইশানকে। খুব কষ্টে কেটেছে ইশানদের দিনগুলি। রোজগার বলতে মার সেলাই করা একটি মেশিন। অত্র এলাকার বউ-ঝিরা আসতো মার কাছে টুক টাক সেলাই এর কাজ নিয়ে। তাছাড়া বাজারের দর্জিরাও মায়ের কাছ থেকে কিছু কিছু কাজ করিয়ে নিতেন। এই ভাবেই কোন ভাবে চলে যেত দিনকাল।
এই এলাকায় ইশানকে অনেকেই চেনে। সন্মানও করে। পথে স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীরা দেখলেই শ্রদ্ধা জানাত। নমস্কার, প্রনাম আর আদাবের উত্তর দিত ডান হাত তুলে স্মিত হেসে। স্কুল থেকে হেঁটেই বাড়ীতে আসা যাওয়া করত ইশান। সব সময়ই বগলে একটা পুরনো কাঠের ছাতা থাকত।
গনিতের শিক্ষক ছিল বলে ছাত্র-ছাত্রী আর এলাকার লোকজন একটু আলাদা ভাবেই কদর করত। বেশ কিছু টিউশনিও করতো অবসর সময়ে।
ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠানোর কিছু ক্ষনের মধেই ইশানের মেসেঞ্জারে একটি মেসেজ আসে। অর্পিতার পাঠানো।
সাথে সাথেই ইশানের হৃৎপিন্ডে ধমাধম স্পন্দন শুরু হলো। কেমন এক ঝলক আনন্দের বাতাস মনে এসে আছড়িয়ে পড়ে। মেসেজটা দেখেই মুখটা হাসিতে ভরে উঠে। বুকের ভিতরটাও একটু থরথর করে কেঁপে ওঠে। ইশান মনে মনে ভাবছে, "আরে, এতো সুন্দরী মেয়ে আমাকে মেসেজ করেছে!" এরপরে একটা কৌতূহলের জন্ম হয় ওর মধ্যে, উচ্ছ্বাসে ডগবগ সারা দেহ মন—"মেয়েটি কী লিখেছে দেখিতো?”
আনন্দ ও উত্তেজনা মিলিয়ে একটা মিশ্র অনুভূতি কাজ করছে ইশানের মধ্যে। মনের মধ্যে এক ধরনের উত্তেজনা, যেমন কোনো অজানা অ্যাডভেঞ্চারের শুরু। মাঝে মাঝে কিছুটা নার্ভাসনেসও কাজ করছে, "কীভাবে জবাব দেবে, কি বলবে?" এই সব ভাবনা মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকে।
তবে যাই হউক না কেন হৃদয়ের কোনে কিন্তু ঝড় তোলে এক চিলতে আলো। মুখের কোণে ফুটে ওঠে এক বিন্দু মিষ্টি হাসি।
মনের অজানা এক কোণে বাজে সুরেলা বীণার তার, "কী লিখেছে সে?" প্রশ্নে ভরে যায় সব দিকের আকাশ। বুকের ভেতর কৌতুহল, আনন্দের স্রোতে ভাসে মন। এ যেন কোন ক সুন্দরী মেয়ের প্রথম মেসেজে সৃষ্টির আনন্দ।
সেই থেকে শুরু হয় এক নতুন জীবনের।
প্রায় রোজ কথা হয়। ইনিয়ে-বিনিয়ে, কখনো বা কবিতার ছন্দে জীবন সংসার পৃথিবীর রুপ রস আঁকতে থাকে কথার ফুলঝুড়িতে। অর্পিতার সাথে কথা বলতে বলতে ইশানের মনে এক অদ্ভুত অনুভূতি জন্মালো। সে বুঝতে পারলো, তার হৃদয় অর্পিতার প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ছে। ইশান অর্পিতার সরলতা ও মেধায় মুগ্ধ।
যেদিন তারা প্রথমবারের মতো মুখোমুখি হলো, অর্পিতার মনে এক রকম উত্তেজনা এবং ভয় কাজ করছিল। মধ্য ঢাকার একটি ক্যাফেতে তাদের প্রথম সরাসরি সাক্ষাৎ। একদিন ইশানই অর্পিতাকে সরাসরি দেখা করার প্রস্তাব দিল।
ইশান আগে থেকেই অপেক্ষা করছিল অর্পিতার জন্য। প্রথম দেখাতেই একেবারে মুগ্ধ। হুবহু যেন ফেইস বুকের অর্পিতা। অবাক হয়েই তাকিয়ে ছিল অর্পিতার দিকে ইশান অনেক ক্ষন। ঘন কালো লম্বা কেশে মাথার এক পাশে এক গুচ্ছ লাল গোলাপের সৌন্দর্য্যের বাহারটা চোখে লাগার মতো। তারা দুইজন ক্যাফেতে বসে অনেকক্ষণ কথা বলল। অর্পিতার কথা-বার্তায় ইশান বেশ খুশী হলো। খুব সুন্দর করে কথা বলে অর্পিতা। মুখের ভঙ্গিতে ফুটে উঠে এক স্বর্গীয় প্রাঞ্জলতা।
তখনই ইশান স্থির করে অর্পিতাকেই একদিন নিজের করে নেবে। আর তাই হলো।
বেশ ভলোই কাটছিলো ইশানের নতুন সংসার। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে বদলাতে থাকে জীবনের চাওয়া-পাওয়া, আনন্দ-উল্লাস আর চলার পথ। অর্পিতার এখন বেশ কিছু বান্ধবী এ পাড়ায়। মাঝে মধ্যেই বান্ধবীদের বাসায় যায়। সব বান্ধবীরাই বেশ সচ্ছল। শুনেছে স্বামীরা ঘুষের চাকুরী করে। বান্ধবীরা আবার বলে ঘুষ না নিলে নাকি বিপদ। চাকুরীর জন্যই নাকি ঘুষ নিতে নয়। বড় সাহেবদেরকে খাজনা দিতে হয় প্রতি মাসে মাসে। সবাই নিজের বাড়ীতে থাকে। কারো আবার ঢাকায় দুই তিনটি বাড়ী আছে।
এসব দেখে অর্পিতার মাথায়ও শয়তান ভর করতে থাকে।
এক রাতে খাবারের সময় ইশানকে বলে-“তুমি এই চাকুরীটা ছেড়ে ঘুষের চাকুরী নিতে পার না? তাহলে আমাদেরও একটা ফ্লাটবাড়ী হবে। গাড়ী হবে।“
ইশান: হঠাৎ আজ এ কথা।
অর্পিতা: (ডিনার সার্ভ করছে) জানো, আজ রিনা'র সাথে কথা হচ্ছিল। বিশ্বাস করতে পারবে না ওরা কত ভালো আছে। ওর স্বামী সরকারী চাকরিতে যোগ দিয়েছে মাত্র তিন বছর হলো, আর এখন টাকা যেন ঝরছে। ওদের তিন বেড রুমের ফ্লাটটা নব্বই লাখ টাকা দিয়ে কিনেছে। নতুন গাড়ী আসছে আগামী মাসে। আর টিভিটা ষাট ইঞ্চি। কি সুন্দর লাগছিল নাটক দেখতে।
ইশান: (প্লেট থেকে মুখ তুলে) সত্যি? ভালো। কিন্তু তুমি জানো, আমি আমার শিক্ষকতার চাকরিতে খুশি আছি। অতো বেশী টাকার আমাদের দরকার নেই।
অর্পিতা: (নিঃশ্বাস ফেলে) জানি তুমি শিক্ষকতা ভালোবাসো, কিন্তু ভেবে দেখো। সরকারী চাকরির অনেক সুবিধা আছে। আর সত্যি বললে, ঘুষের অতিরিক্ত টাকায় আমাদের জীবন অনেক সহজ হয়ে যাবে। আমরা বড় বাড়ি কিনতে পারব, ভালো গাড়ি কিনতে পারব, আর ভবিষ্যতের জন্য আরও সঞ্চয় করতে পারব।
ইশান: (দৃঢ়ভাবে) তোমার কথা বুঝতে পারছি, কিন্তু ঘুষ নেওয়া? এটা ঠিক নয়। এটা আমার নীতির বিরুদ্ধে। শিক্ষকতা হয়তো আমাদের ধনী করবে না, কিন্তু এটা আমাকে এক ধরনের সন্তুষ্টি আর তৃপ্তি দেয়।
অর্পিতা: (বিরক্ত হয়ে) নীতি তো আমাদের বিল পরিশোধ করে না, তাই না? আমি দেখি তুমি কত পরিশ্রম করো, আর এটা আমার মন খারাপ করে যখন দেখি আমরা আরও ভালো থাকতে পারতাম যদি তুমি একটু চেষ্টা করে একটা সরকারী চাকুরী নাও। সবাই ঘুষ নেয় মানেই সবাই খারাপ লোক নয়। রিনাতো বলে ঘুষ নাকি নিতে হয়। এইটাই নাকি নিয়ম। আর নাজমাকে দেখ। ওদের তিন তিনটি গাড়ী। কতো চাকর বাকর।
ইশান: (মৃদু হেসে) এটা কে ঘুষ নিচ্ছে সেটা নয়, এটা আমাদের কি করছে সেটা গুরুত্বপূর্ণ। ঘুষ হচ্ছে এক ধরনের দুর্নীতি। এটা সমাজে ক্যান্সারের মত। ঘুষখোররা সমাজের শয়তান। ওদের শরীরে প্রেতের বসবাস। ঈশ্বর সব দেখেন। ঘুষখোররা ইশ্বরের বড়ো শত্রু। নরকেও ঠাঁই পাবে না। তুমি তো ধর্মো কর্মো করো। পাপী হবে না?
অর্পিতা: (নরম হয়ে) আমাকে অতো-সতো বুঝিওনা। আমি শুধু একটু আরামে থাকতে চাই।
ইশান: (তার হাত ধরে) আমিও আমাদের জন্য সেরাটাই চাই। কিন্তু আসল পথে সেটা যেন অর্জন করতে পারি। শিক্ষকতা মহান পেশা। এটা ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে গড়ে তোলে। আমি গর্বিত হতে চাই আমার কাজ নিয়ে আর আমাদের সন্তানদের জন্য কিছু করতে পেরে।
অর্পিতা: (মাথা নেড়ে) ঠিক আছে। আর ঘুষের কথা নয়।
ইশান: (তার হাতে চুমু খেয়ে) এই তো, ঠিক কথা। আমরা একসাথে চলবো সঠিক পথে হাঁটবো।
তার পর একটি বছর কেটে গেল। ঘরে এলো তাদের প্রথম সন্তান প্রজ্ঞা।
ডাক্তাররা সিজারিয়ান সেকশনের জন্য পরামর্শ দিয়েছিলেন। কিন্তু অস্ত্রোপচারের খরচ ছিল অত্যধিক। এতো খরচ বহন করা ছিল ইশানের সামর্থ্যের বাইরে। তাই কম দামের একটি হাসপাতালে অর্পিতাকে নিয়ে যাওয়া হয়। খুব কম খরচে সেখানে অর্পিতাকে সিজারিয়ান করা হয়। যদিও সুযোগ সুবিধা তেমন ছিলো না, তবুও ইশানকে তেমন টাকার জন্য অন্যের হাত পাততে হয়নি।
প্রজ্ঞার জন্মটা ঠিক ঠাক মত হলেও অর্পিতাকে বেশ কষ্ট পেতে হয়েছে। অর্পিতার ধারনা ডাক্তাররা ঠিক মতো অপারেশনটা করেনি। তাই তার পেটে যন্ত্রনা। আর যখন জানতে পারলো সিজারিয়ান করাতে ইশান খরচ করেছে মাত্র ত্রিশ হাজার টাকা আর তার এক বান্ধবী ঢাকার এক নামকরা হাসপাতালে প্রায় তিন লাখ টাকা খরচ করেছে সিজরিয়ানের জন্য তখন অর্পিতা বেশ কষ্ট পায়। একদিন দুকথা শুনিয়েও দেয় ইশানকে-“তুমি আমাকে একদম সন্মান কর না। আমার জীবনটাকে একদম নষ্ট করে দিতে চাইছিলা। ত্রিশ হাজার টাকা দিয়া এক জহল্লাদকে দিয়া আমার সিজরিয়ান করাইতে তোমার খারাপ লাগে নাই? তিন লাখ টকা খরচ করছে নুসরাতের স্বামী। ওদের ছেলেটা দেখতে ক সুন্দর।“
ইশান: আমিতো এর চেয়ে বেশী খরচ করতে পারি না।
অর্পিতা: পারনাতো বিয়ে করতে গেছিলা কেন?
তার পর থেকে নানাভাবে অর্পিতা আর ইশানের কথা-বার্তায়, প্রেম-ভালোবাসায়, আচার-ব্যাবহারে অশুভ নিশপিশের ছায়া পড়তে থাকে। অর্পিতা প্রায়ই বিরক্তি পোষণ করে। প্রায়ই তার হতাশার কথা বলে ইশানকে খোটা দেয়, "তুমি যদি আরও অর্থ ব্যয় করতে তবে আমার আজ এই অবস্থা হত না। আমাদের মেয়েও আরও ভাল হত।"
ইতিমধ্যেই অপরাধবোধে ভারাক্রান্ত ইশান অসহায় বোধ করল। ইদানীং অতিরিক্ত টিউটরিং নিয়েছে। গভীর রাত পর্যন্ত কাজ করছে, কিন্তু তাতেও যেন সংসারের নিত্যদিনের চাহিদাগুলো পূরনে ব্যর্থ হচ্ছে।
মাস যত গড়িয়েছে, ইশান ও অর্পিতার মধ্যে বিবাদ, ঝগড়া-ঝাটি বাড়তেই থাকে। তাদের এক সময়ের প্রেমময় ফ্লাটটি তিক্ত কথা এবং অব্যক্ত অভিযোগের রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। অর্পিতার অসন্তোষ বাড়তে থাকে। তার উন্নত জীবনের স্বপ্ন তাদের দারিদ্র্যের বাস্তবতায় ভেঙে পড়ছে । বাড়তে থকে দূরত্ব দুজনের মধ্যে।
এক পড়ন্ত সন্ধ্যা। সূর্য দিগন্তে হেলে পড়েছে। সরু গলির মধ্য দিয়ে দীর্ঘ ছায়া ফেলে ইশান কাজ থেকে বাড়ী ফিরছে। ঘরে এখনো রাতের আলো পড়েনি। ভেতরটা অন্ধকার মনে হচ্ছে। চাবি দিয়ে দড়জা খুলেই ইশান দেখতে পায় অর্পিতা অন্ধকারে বসে আসে। প্রজ্ঞাকে কোলে জড়িয়ে ধরে আছে। ঘুমিয়ে আছে প্রজ্ঞা। অর্পিতার নিঃশ্বাসে প্রজ্ঞার হালকা পাতলা চুলগুলি নেড়ে চড়ে উঠছে। ঘরে ঢুকেই ইশান সুইচটা টিপে আলোটা জ্বালিয়ে দিল। ইশান যে ঘরে ঢুকেছে সেদিকে অর্পিতার কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। চুপ করে মেয়ের দিকে মাথাটা হেলিয়ে নিথর পাথরের মতো কুঁজো হয়ে বসে আছে। চোখে মুখে উত্তজনা স্পষ্ট ছিলো। কিন্তু কোন সাড়া শব্দ নেই। কেমন শুকনো শুকনো লাগছে পুরো ঘরটা। এ যেন কোন অশুভ মেঘের পূর্বাভাস। কেমন শুকনো তেজপাতার মতো বুকটা অসার হয়ে গেলো ইশানের। কাঁধ থেকে ব্যাগটা বসার রুমে রেখে এসে মৃদু পায়ে অর্পিতার কাছে এসে দাঁড়লো। একটা জোরে শ্বাস নিয়ে বুকে এক রাশ সাহসের বাতাস ঢেলে এবার মুখ খুললো ইশান।
ইশান: (আস্তে) "অর্পিতা, তুমি এখানে চুপ করে বসে আছো কেন? শরীরটা খরাপ লাগছে বুঝি? প্রজ্ঞার পেটের ব্যাথাটা কি কমেছে?”
কিন্তু অর্পিতার কোন সাড়া শব্দ নেই। শাড়ীর আচলটা মেয়ের বুকে জড়িয়ে আছে। চুলগুলো কেমন এলো মেলো। ব্যাপারটা ইশানের তেমন ভালো ঠেকল না। কেমন একটা বিষাদের তুষ বুকের ভেতর আস্তে আস্তে জ্বলছে। স্কুলে যতক্ষন থাকে ভালোই থাকে। ঘরে এলেই সব উলোট পালোট। কিছু একটা ভেবে আবার জিজ্ঞেস করলো-“শুনতে পেলে? তোমার কি খারাপ লাগছে। সন্ধ্যার সময়ে এখানে আর কতোক্ষন বসে থাকবে। এবার উঠ। প্রজ্ঞাকে এবার খাটে শুইয়ে দাও।“
এবার অর্পিতা ঘাড় তুললো খুব আস্তে আস্তে। উপরের দিকে না তাকিয়ে খুব দূর্বল ভাবে বললো-“আমাকে নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না।“ কন্ঠে কেমন একটা খ্যাচ খ্যাচে ভাব। ভেতর থেকে কেউ যেন এক দলা রাগ উগরে দিয়েছে গলার দিকে।
ইশান: (ভ্রু কুচকে) এভাবে বলছো কেন?
অর্পিতা: (উপরের দিকে তাকিয়ে, চোখে চোখ রেখে) “কীভাবে বললে খুশী হও। তোমার চোখ দিয়ে দেখতে পারো না কেমন আছি? নতুন করে বলার কি আছে। তুমি ত সুখেই রাখছো আমাকে আর তোমার মেয়েকে। দেখতে পাওনা কেমন সুখে আছি। মহা সুখে!-এই বলেই অর্পিতা একটা বিরক্তির ভাব প্রকাশ করে মেয়েকে শক্ত করে ধরে খুব আস্তে করে উঠলো। দুজনের কথা-বার্তায় মেয়েও আড়-মোড়া দিয়ে ঠোঁটটি বেঁকিয়ে কাজল দেয়া কপালের দিকে মাথাটা হেলিয়ে কেঁদে উঠলো।
ইশান: এতো রাগ করছো কেন? আমিতো কিছুই বুঝতে পারছি না।
অর্পিতা: “রাগ নয়। এটা আমার কপালের দোষ। আর তোমাকে সব কিছু বুঝে লাভ নেই। আমার জন্য আমি কিছুই চাই না। অন্ততঃ মেয়েরটার কথা একবার ভাবো। আজ সারাটা দিন কিছুই খায় নাই। সারাটা ক্ষন শুধু কান্নাকাটি আর বিরক্ত করেছে। শরীরটা খুব দূর্বল। শরীরেতো আর কোন পুষ্ঠি নেই যে সবল লাগবে। ডাক্তার বলেছে ভালো পুষ্টি দরকার, কিন্তু... যাক বাদ দাও এ সব।“
ইশান: (দীর্ঘশ্বাস ফেলে) "আমি চেষ্টা করছি, অর্পিতা। আমি সত্যিই ভাবছি। আমি আরও দুটি টিউটরিং নিয়েছি। সব ঠিক হয়ে যাবে। প্রজ্ঞার জন্য ভালো খাবার নিয়ে আসবো। পরের মাস থেকে অনেক কিছুই বদলে যাবে। একটু সবুর করো।
অর্পিতা: (কন্ঠ কাঁপতে কাঁপতে) "পরের মাস, পরের মাস। সব সময়ই পরের মাসের কথা। এখন কী হবে? এখনকার কথা একটু ভাবো!”
ইশান: (হতাশাগ্রস্ত হয়ে) "তুমি কি মনে কর আমি এটা জানি না? এসব নিয়ে ভাবি না? আমি যা করতে পারি তাই করছি! আমি তো আর চুরি -ডাকাতি করতে পারবো না।
অর্পিতা: (অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে চোখ দিয়ে গাল বেয়ে) "এটা যথেষ্ট নয়, ইশান! আমাদের দিকে তাকাও, মেয়েটাকে একটু দেখো। সে এর চেয়েও বেশি প্রাপ্য, তার চেয়েও বেশি... "-কথাটা শেষ করতে পারেনি। ইশান হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠলো।
ইশান: "আমি জানি। আর এটা আমাকে প্রতিদিন বার বার মনে করিয়ে দিতে হবে না। একটা কথা ভালো করে জেনে রাখো আমি একজন স্কুল শিক্ষক। তার উপর গত ছয় মাস ধরে কোন বেতন নেই। টিউশনি দিয়েই সংসারটা এখন চলছে। আগামীতে চলবে কিনা তাও জানা নেই। আমি রাতারাতি আমাদের পরিস্থিতি বদলাতে পারব না। আমি হাওয়া থেকে টাকা নিয়ে আসতে পারি না। একটু ধৈর্য্য ধর। তুমি যদি একটু না বুঝ তা হলে আমার কী হবে।“
অর্পিতা: (তীক্ষ্ন কন্ঠস্বর): টাকা রোজগারের মুরদ নাই, বিয়ে করতে গেলে কেন? আর এখন তো শুধু আমি না, আমাদের মেয়েও আছে। তার কথাওতো আগে ভাবতে হবে। বাপ হওয়া এতো সহজ না। মুখে অন্ন দিতে পারো না আবার সন্তান চাও। লজ্জা করে না তোমার। যে বাবা সন্তানের দেখ ভাল করতে পারে না তার সন্তান চাওয়ার অধিকারও নেই।“-এই বলেই অর্পিতা ফুঁসতে লাগলো।
ইশান: (আহত হয়ে) "এটা কিভাবে বলতে পারো? আমি যে প্রতিটা টাকা আয় করি, আমি প্রথমে তোমার আর প্রজ্ঞার কথা ভাবি। আমি আমার নিজের প্রয়োজন, আমার নিজের স্বাস্থ্য কোন কিছু নিয়েই কখনো ভাবি নাই। নিজের স্বাধ-আহল্লাদ বলতেও কিছুই নেই। যা কিছু করছি সব তোমাদের জন্যই। কে জানতো স্কুল থেকে বেতন পাবো না। পাঁচ বছর ধরে চাকুরি করছি কই কখনো তো এই রকম হয় নাই। বিপদ যখন আসে তখন এক সাথে দল বেঁধে আসে। কিন্তু তাই বলে ধৈর্য হারালে তো চলবে না। বাস্তবতাকে মেনে নিতে হবে।
অর্পিতা (রাগের স্বরে): কোন বাস্তবতা?
ইশান: বাস্তবতা হলো, আমরা বস্তিতে থাকি আমি একজন দরিদ্র শিক্ষক।
অর্পিতা: (দূরের দিকে তাকিয়ে) "হয়তো এটাই সমস্যা। হয়তো এই জীবন আমার জন্য যথেষ্ট নয়। সব আমারই ভাগ্য। আমারই দোষ।“
ইশান: (অনুরোধ করে) "অর্পিতা, প্লিজ। এমনটা বল না। আমরা একটি পরিবার। আমরা একসাথে এই সমস্যা অতিক্রম করতে পারব। শুধু একটু ধৈর্য্য ধরো।"
অর্পিতা: (মাথা নেড়ে) "আমি জানি না আমরা পারব কিনা। আমি জানি না আমি এটা চালিয়ে যেতে পারব কি না। আমাকে প্রজ্ঞার ভবিষ্যত নিয়ে ভাবতে হবে।"
ইশান: (উক্তত্য কন্ঠে) "আর আমাদের কি? আমাদের ভবিষ্যৎ কি?"
অর্পিতা: (প্রজ্ঞাকে জড়িয়ে ধরে) " প্রজ্ঞার এবং আমার জন্য কোনটি ভালো তা আমাকে বের করতে হবে। হয়তো তার মানে... হয়তো তার মানে আমাদের আলাদা থাকতে হবে।"
ইশান: (মরিয়া হয়ে) "অর্পিতা, প্লিজ। হুট করে কোনো সিদ্ধান্ত নেবে না। আমরা একটা উপায় বের করতে পারি। এতো সহজে ভেঙ্গে পড়লে চলবে না।"
অর্পিতা: "আমি দুঃখিত, ইশান। কিন্তু আমি এভাবে বাঁচতে পারব না। আমাদের মেয়ের জন্য হলেও আমাকে এখান থেকে যেতে হবে। যদি সিজারিয়ানের সময় তুমি একটু বেশী খরচ করতে পারতে তা হলে আমার মেয়ের আজ এতো কষ্ট হতো না। আমার এতো কষ্ট হতো না। মেয়ের পেটের কষ্টটা তোমার জন্যই পাচ্ছে। এখন মা হয়ে আমি চাই না খেতে না পেরে সে মরে যাক।“
এই বলেই খাটের পাশে রাখা ব্যাগটি তুলে নেয় অর্পিতা। মেয়েকে কোলে জড়িয়ে ফ্লাট থেকে বেড়িয়ে যায়।
অর্পিতা যখন অস্পষ্ট আলোকিত রাস্তায় অদৃশ্য হয়ে যায়, ইশান সেখানে দাঁড়িয়ে রইল। তাদের জীবনের বাস্তবতার ভার জগদ্দল পাথরের মতো যেন হঠাৎ করেই ইশানের বুকের উপর চাপা পড়ে গেল। রাত্রি গাঢ় হতে থাকে এবং তাদের অন্তরের মধ্যে ফাটল বাড়তে থাকে।