ফিল্টারে হারানো জীবন


 

সুরভি বিবাহিতা। মাত্র চার বছর বয়সের একটি ছেলে।

স্বামী সরকারী চাকুরি করেন। নতুন মডেলের গাড়ী চালান। রোলেক্স ঘড়িতে সময় দেখেন। বেশ কাটছে জীবন।

সুরভি শিক্ষিতা, ফিলসোফিতে এম এ করেছে।  দেখতেও খুব মার্জিতা। তাঁর চুলের রঙ আর শৈলীতে পশ্চিমা ধাঁচ। বিদেশী স্টাইলের হেয়ার কাট। একেবারে আধুনিক, বব কাট বা লেয়ার কাটের মতো। মাঝে মাঝে চুলে ছোট ছোট কার্ল করে। কখনো বা স্ট্রেটেনিং করে স্টাইলিশ লুক আনে। ঘন ঘন স্টাইলিশ পার্লারে যায়।

চলনে বলনে কথা বার্তায় বেশ ঝটপট। মিষ্টি ও সাবলীল ভাষায় কথা বলে। যে কারোরই মনে ধরার মত কিন্তু অফিসে গিয়ে ৫-৯টা কাজ করতে নারাজ। মা যদি কাজ করে সন্তানের নাকি কষ্ট হয়। তাই স্বামীকে একদিন এক লম্বা খিস্তি খেউরির লেকচার দিয়ে এমন একটা আইন পাশ করিয়ে নিয়েছে যে সে সব সময় ঘর সামলাবে,সংসারের দেখ ভাল করবে। স্বামীও খুশীতে গদগদ। আফিস করে এসে মজা করে ভূড়ি ভোজন করে সোফায় পিঠ এলিয়ে কাত ফিরে টিভির পর্দায় হাবি জাবি দেখতে দেখতে একটু পাতলা ঘুমে লুটিয়ে পড়বে একি কম সুখের কথা? বৌ ঘরে থাকলেই বেশী সুবিধা।

 

ঢাকার শীতের সকালটা সুরভির খুব পছন্দের। হালকা কুয়াশার চাদরে মোড়ানো ঢাকা শহরটা তখন অন্যরকম হয়ে যায়। চারিদিকে এক ধরনের নির্জনতা। গাছের পাতাগুলো শিশিরে ভিজে, একেকটি মুক্তার মত ঝলমল করতে থাকে। রাস্তায় হালকা ঠান্ডার অনুভূতি, মানুষজন গায়ে গরম পোশাক জড়িয়ে তাড়াহুড়ো করে তাদের গন্তব্যে রওনা দেয়। এ সব  দৃশ্য ফুটে উঠে সুরভির টিক টকে।

 

সুরভিরা যে এলাকাটিতে থাকে তা বেশ পরিচ্ছন্ন, আভিজাত্যের ছাপ চারিদিকে। সুউচ্চ ফ্লাট বাড়ীর আট তলার জানালা দিয়ে পশ্চিমে তাকালেই কয়েকটি ছোট ছোট চায়ের স্টল আর মুদি দোকান নজরে পড়ে। পাশেই ছোট্ট একটি লেক। তবে নর্দমায় ভরা লেকটি এই এলাকার সৌন্দর্যের বেশ কিছুটা ক্ষতি করছে। শীতের সকালে লেকের পাশে থাকা ছোট্ট চায়ের দোকানে কুন্ডলী পাকিয়ে ধোঁয়া উঠতে দেখা যায়। ভাপা পিঠা, চিতই পিঠা আর পুলি পিঠার মিষ্টি গন্ধ বাতাসে ভাসতে থাকে। বয়স্ক লোকেরা চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে আড্ডায় মেতে উঠে। শীতের সকালে এক কাপ গরম চা যেন তাদের নতুন উদ্যমে ভরিয়ে তুলে। সূর্য যখন ধীরে ধীরে কুয়াশা ভেদ করে উঁকি দেয়, তখন পুরো শহর যেন নতুন করে জেগে ওঠে। শীতের মিষ্টি রোদ সবাইকে উষ্ণতার পরশ বুলিয়ে দেয়। শীতের এই সকালে ঢাকার জীবন যেন একটু ধীর,একটু প্রশান্ত। এ সবে সুরভির প্রান আনন্দে নেচে উঠে।

সুরভি টিকটকের পাগল ভক্ত। সারা দিন টিকটক ভিডিও তৈরি করেই কাটিয়ে দিতে পছন্দ করে। সংসারের কাজ বলতে রান্না-বান্না আর রাজুর দেখাশুনা করা। তবে বেশীর ভাগ কাজই করে ঘরের কাজের মেয়ে। রাজুকে-নার্সারীতে নিয়ে যাওয়া, নিয়ে আসা, খেলা-ধূলা করা, স্নান করিয়ে দেওয়া, রান্না-বান্নায় সাহায্য করা, সব কিছুই মেয়েটি করে। তাই সুরভির এই টিকটক জীবনটাই সবচেয়ে বেশী প্রিয় হয়ে উঠেছে।

 

সুরভি চাইতো, তার ভিডিওগুলো যেন বেশি বেশি ভিউ আর লাইক পায়। সুরভি টিকটকে বিভিন্ন ধরনের ভিডিও বানাতো। কখনো মেকআপ টিউটোরিয়াল, কখনো কুকিং ভিডিও, আবার কখনো মজার প্র্যাঙ্ক ভিডিও তৈরি করতো। তার একাধিক ভিডিও ভাইরালও হয়েছে। এতে সুরভি নিজকে সেলেব্রিটি ভেবে সেলেব্রিটি স্টাইলে চলে, কথা বলে, হাসে, মুখে মেকআপ করে, হাই হীল পড়ে, পিঠের আশি শতাংশ উন্মুক্ত রেখে শাড়ী পড়ে। সুরভির সব আদব কায়দায় নেমে এসেছে সেলিব্রিটি স্টাইলের জম্পেস উপস্থিতি।

এখন তার অনেক ফলোয়ার।

কিন্তু সুরভির এই ভিডিও বানানোর আসক্তি এমন পর্যায়ে চলে যায় যে, সে নিজের স্বামী ও সন্তানের যত্ন নেওয়াও ভুলে যায়।

সুরভির স্বামী সৈকত কাজ করে একটি বহুজাতিক কোম্পানিতে। মোটা বেতনের চাকুরি। সাথে একটি আধুনিক ফ্লাট ঢাকার এক অভিজাত এলাকায়। নতুন মডেলের জাপানিজ গাড়ী। বেশ স্বাচ্ছন্দ্যের জীবন। একমাত্র পুত্র রাজু। সুরভিদের দিন শুরু হয় প্রভাতের প্রথম আলোয়। স্বামী ভোর ৬টায় ঘুম থেকে উঠে সজীব হাওয়ায় এক চক্র দৌড়ান। পাশেই একটি ছোট পার্ক আছে। সেখানেই যায়। তারপর পরিপাটি পোশাকে সকাল ৮টায় সে কোম্পানির দেওয়া গাড়িতে চেপে অফিসের দিকে রওনা দেয়। ঢাকার তীব্র যানজটের মধ্য দিয়ে পথ অতিক্রম করলেও, তার মুখে ক্লান্তির ছাপ পড়ে না। সব সময় প্রাণবন্ত।

অন্যদিকে, স্ত্রী সুরভি ঘুম থেকে উঠে দেরী করে। সকালটা কাটে তার নিজের এবং ছেলের জন্য সকালের খাবরটা তৈরি করতে। তবে তার মোবাইল ফোনটি থাকে হাতে। কখনও হাত ছাড়া হয় না। দুপুরবেলা ছেলে রাজু প্রি-স্কুল থেকে ফিরে আসে। সে সময় সুরভি ছেলের জন্য খাবার তৈরি করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। তা ছাড়া দিনের প্রায় বাকী সময়টাই সুরভি টিকটকে ডুবে থাকে। কাজের মেয়েটিই রাজুর সাথে থাকে সারাক্ষন। সৈকত যখন কাজ থেকে বাসায় ফিরে তখনও টিকটকের শব্দ কানে এসে বাজে।

 

একদিন সুরভি সোফায় বসে মোবাইলের স্ক্রিনে একের পর এক টিকটক ভিডিও দেখে যাচ্ছিল।  রাজু কয়েকবার মায়ের কাছে গিয়ে বলল, "মা, তুমি কি আমার সাথে খেলবে?" কিন্তু সুরভি রাজুর গালে হালকা চিমটি কেটে মিষ্টি হেসে উত্তর দিল, "একটু পর, বাবু। মা এখন ব্যস্ত।" উত্তর শুনে মায়ের দিকে কয়েক সেকেন্ড ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে রাজু। মনটা খারাপ হয়ে গেল। সে ভালো করেই জানে, 'একটু পর' মানে আর কখনো না। মুখটা ভার করে অন্য রুমে চলে যায়।

রাজুর বাবা সৈকত অফিসের কাজ নিয়ে সারাদিন ব্যস্ত থাকে। সে যখন বাসায় ফেরে, তখন প্রায়ই দেখতে পায় যে রাজু একা একা খেলছে আর সুরভি মোবাইলে ব্যস্ত। সৈকতের মনটা খারাপ হয়। মাঝে মধ্যে রাগে নিজের মাথার চুল ছিড়তে থাকে। ঠোঁট কামড়াতে থাকে। কখনো বা কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। ঘামটি মেরে সোফার এক কোনে বসে থাকে। কিছুক্ষন কথা বলা থেকে বিরত থাকে। মাঝে মাঝে, তার রাগ এতটাই বেড়ে যায় যে সে উচ্চস্বরে কথা বলতে শুরু করে। তর্কে লিপ্ত হয়। একদিন, সৈকত এতটাই রেগে যায় যে সে ঠাস করে সুরভির গালে একটা চড় মেরে বসে।  শুরু হয় তুমুল ঝগড়া। সৈকতের কন্ঠে উত্তজনা।–“তুমি কি একটুও বোঝো না, তুমি সারাদিন এই টিকটক আর সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যস্ত থাকো। আমাদের ছেলে তোমার সময় পায় না, আমি বাড়ি এসে দেখছি তুমি শুধুই মোবাইল নিয়ে বসে আছো। তোমার কি কোন কান্ডজ্ঞান আছে?”

স্ত্রী: (রাগান্বিত হয়ে) “জানোয়ার কোথাকার! চড় মারলে কেন? তুমি কী বলতে চাইছো? আমি কি কিছুই করি না? আমি তো বাড়িতেই থাকি, তোমার আর ছেলের সব দেখাশোনা করি। একটু নিজের জন্য সময় নিলে সেটা দোষের কী?

স্বামী: (গর্জন করে) নিজের সময় মানে সারাদিন মোবাইল হাতে নিয়ে বসে থাকা? ছেলের দিকে তো একবার তাকাও, দেখ ও কতটা একা থাকে। মুখের দিকে একবার চেয়ে দেখ আমাদের ছেলে কেমন আছে? আমাদের পরিবার যে ভেঙে যাচ্ছে, তুমি সেটা বুঝছো না?

স্ত্রী: আমার সাথে এ ভাবে চেঁচা মেচি করবে না। ভদ্রভাবে কথা বলো। তুমি বাপ হয়ে ছেলের জন্য কি করছো?  আমিইতো ওর জন্য সব করছি। সংসারটা সামলাচ্ছি। ঘরে এসে যে মজা করে ঘাপুস ঘুপুস করে খান তার ব্যাবস্থা করছে কে? আমি ওর মা, আমি জানি ওর ভালো-মন্দ।

স্বামী: (বিরক্তির সাথে) মা হয়ে যদি ওর ভালো-মন্দ বুঝতে, তাহলে মোবাইলের চেয়ে একটু বেশী ওকে সময় দিতে।

 

ওদের কথা-বার্তা দূরে দাঁড়িয়ে চুপচাপ শুনে রাজু। ভয়ে পা কাঁপে। চোখে-মুখে আতংকের ছাপ। চোখের কোনে অশ্রু জমতে থাকে। ঠোঁট কেঁপে উঠে। বাবা-মায়ের এই ঝগড়া দেখে ওর মন খুব ভারী হয়ে যায়। সে কিছু বুঝতে পারছে না, কেবল বুঝতে পারছে বাবা-মায়ের মধ্যে কিছু একটা খুবই খারাপ হচ্ছে। তার ছোট্ট মন কেঁদে উঠে। সে চায় মা তাকে কোলে নেবে, আদর করবে। কিন্তু মায়ের চোখ মোবাইলের দিকে, বাবার মুখ রাগে লাল। এই ঝগড়ার মাঝখানে, তার ছোট্ট হৃদয় কেঁপে উঠে, অজানা এক ভয় নিজকে আচ্ছন্ন করে। বাবা-মায়ের ভালোবাসা পাওয়ার আশা নিয়ে, সে কাঁদতে কাঁদতে নিজের ঘরে চলে যায়।

কিছুক্ষন পর ঝগড়া থেমে যায়। সৈকত শান্ত হয়।

একবার সুরভি "ফানি ড্যান্স চ্যালেঞ্জ" করার পরিকল্পনা করে। তা দিয়ে টিকটিক রীল বানাবে। তাই রাজুকে ধরে নাচানোর চেষ্টা করল। কিন্তু রাজু নাচতে নারাজ। ভয়ে মায়ের কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছিল। সুরভি তখন জোড় করে কোলে তুলে নাচ শুরু করে। রাজু ভয় পেয়ে কান্না শুরু করল। সেই দৃশ্যটা সুরভী রীল বানিয়ে পোস্ট করে দিল। পোস্টের ক্যাপশন ছিল, "মায়ের সাথে নাচতে চায় না!" সাথে সাথে লাইক আর কমেন্ট আসা শুরু করে। চোখ বড় বড় করে খুশী আর উত্তেজনায় মোবাইলে থুবরে পড়ে কমেন্টসগুলো পড়তে থাকে। সেই দিনের এই ভিডিওটি প্রচুর লাইক এবং কমেন্ট পেল। সুরভি খুশীতে গদগদ।

সুরভি সব সময় ভাবত কীভাবে মজার মজার ভাইরাল ভিডিও বানানো যায়। একদিন ভেবে বের করল, তার ছেলে রাজুর কান্নার ভিডিও বানালে নিশ্চয়ই অনেক ভিউ পাবে। তাই সে রাজুকে খাবার না দিয়ে কান্না করানোর চেষ্টা করতে লাগল। রাজু ক্ষুধার্ত হয়ে কান্না করতে লাগল। বলতে লাগল-“মা খাবার দাও, আমার ক্ষীদে পেয়েছে।“ কিন্তু সুরভি খাবার না দিয়ে রাজুর দিকে তাকিয়ে ভেংচি কাটতে শুরু করল। হুতুম পেঁচার মত মুখ ভঙ্গ করতে লাগল। রাজুর কান্না আরো বেড়ে যায়। সুরভি তখন সেই কান্নার ভিডিও বানাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। ভিডিও বানাতে গিয়ে সুরভি ভুলেই গেল যে, তার সন্তান সত্যি সত্যি ক্ষুধার্ত। ভিডিওটিতে সুরভি চেয়েছিল একটি মজার টুইস্ট যোগ করতে। সে রাজুর কান্নার মাঝে মজার মজার ফিল্টার ব্যবহার করল। একবার রাজুকে বাঘের মতো, একবার হাতির মতো, আবার কখনো রাজুকে ক্লাউনের মতো ফিল্টার দিয়ে সাজিয়ে দিল। রাজুর কান্না আরও বেড়ে গেল, কিন্তু সুরভির হাসি থামছে না। একবার, সে রাজুর মাথায় একদম বড় বড় চোখের ফিল্টার দিল এবং বলতে থাকে, "আরে দেখো, আমার রাজু এলিয়েন হয়ে গেছে!" এই ভিডিওটির লাইক মিলিয়ন ছাড়িয়ে যায়। অনেকে যদিও ছেলের কান্নায় ব্যথিত হয়ে নানা ধরনের অকথ্য ভায়ায় মায়ের উদ্দেশ্যে কমেন্টস করেছে কিন্তু তাতে সুরভির কোন পরোয়া নেই।

সুরভি শুধু এখানেই থেমে থাকেননি। একদিন সে রাজুকে শান্তভাবে খেলতে দেখল। সে ভাবল, এই শান্ত মুহূর্তকে মজারভাবে উপস্থাপন করতে হবে। সে রাজুর খেলনা নিয়ে মজার মজার প্র্যাঙ্ক করতে লাগল। রাজুর পছন্দের খেলনা গাড়িটাকে সে মজার আওয়াজ দিয়ে চালু করল এবং সেটিকে ধপাস করে সান পাথরের ফ্লোরে ফেলে দিয়ে ভেঙে ফেলল। গাড়ী ভাঙ্গায় রাজু জোড়ে কান্না শুরু করল। কিন্তু সুরভি তার কান্নাকে পাত্তা না দিয়ে মনযোগ দিয়ে ভিডিও করতে লাগল।

 

একদিন সুরভির খুব কাছের এক বান্ধবী সীমা তার ভিডিওগুলো দেখে খুবই উদ্বিগ্ন হয়। সীমা তাকে বোঝাতে লাগল, "সুরভি, তুই যা করছিস সেটা ঠিক না। তোর সন্তান তোর থেকে যত্ন আর ভালোবাসা চায়, তার কান্না দিয়ে ভিউ বাড়ানো সঠিক নয়। এসব বন্ধ কর"

কিন্তু সুরভি শুনল না, বরং আরও ভিডিও বানাতে লাগল। এমনকি, একবার রাজু যখন খেলছিল, তখন সুরভি তার পা ধরে টান দিয়ে তাকে মাটিতে ফেলে দিল এবং সেটির ভিডিও করল। মনে মনে ভাবল, রাজুর কান্না এবং হাসির ফিল্টার দিয়ে আরও একটা মজার ভিডিও সহজেই বানানো যাবে।

সুরভির প্র্যাঙ্কগুলো দিনে দিনে আরও বাড়তে লাগল। একবার সে রাজুর দুধের বোতলে চকলেট সস মিশিয়ে দিয়ে রাজুকে খেতে দিল। রাজু প্রথমে ভাবল এটা নতুন কোন টেস্ট, কিন্তু একটু খেয়ে যখন বুঝতে পারল  এটা দুধ নয়, তখন তার মুখ বিকৃত হয়ে গেল। চোখে মুখে ঠোঁটে এক অদ্ভুত বিরক্তির ছাপ ফুটে উঠল।  সুরভি ঠিক সেই মুহূর্তটা ক্যামেরায় বন্দী করল এবং সাথে সাথে পোস্ট করল। আবার একদিন, রাজু ঘুমিয়ে থাকার সময় সুরভি তার মুখে রং মেখে দেয়। রাজু যখন ঘুম থেকে উঠে নিজের চেহারা আয়নায় দেখল, তখন সে ভয়ে চিৎকার করে উঠল। সুরভি তখনও সেই মুহূর্ত ক্যামেরায় বন্দী করতে ভুলল না।

 

এরপর একদিন ঘটল এক ভয়ানক দুর্ঘটনা।

 

সুরভি তখন টিকটকের জন্য নতুন একটি ভিডিও বানাতে ব্যস্ত ছিল। সে রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে নতুন একটি রেসিপি বানাচ্ছিল এবং সেটি লাইভ শেয়ার করছিল। রাজু তখন সিঁড়ির কাছে খেলছিল। সুরভি রাজুকে ডাকল, "রাজু, একটু হাসো তো, আমি ভিডিও করব।" রাজু সিঁড়ির উপর থেকে মায়ের দিকে আসার চেষ্টা করল। হঠাৎ করেই তার পা পিছলে গেল এবং সে সিঁড়ি থেকে নিচে পড়ে যায়।

সুরভি লাইভ ভিডিওতে মগ্ন ছিল, তাই প্রথমে কিছু বুঝতে পারেনি। যখন রাজুর চিৎকার শুনল, তখনই দৌড়ে আসে। তখন রাজু মাটিতে পড়ে আছে, অচেতন। সুরভির মাথা ঘুরে গেল। সে বুঝতে পারল না কী করবে। রাজু বলে চীৎকার করে উঠল। দ্রুত রাজুকে কোলে তুলে সে হাসপাতালে ছুটল।

হাসপাতালে পৌঁছানোর পর চিকিৎসকরা জানান যে, রাজুর আঘাত খুবই গুরুতর। তারা রাজুকে দ্রুত অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে গেলেন। সুরভি হাসপাতালের করিডোরে বসে কাঁদতে লাগল। তার মনে হতে লাগল, "আমি কী করলাম? আমি কেন তার দিকে খেয়াল দিলাম না?"

বেশ কয়েকদিন হাসপাতালে থাকে রাজু।

সুরভি বুঝতে পারল, সন্তানের শৈশব এবং স্বাস্থ্যের থেকে টিকটকের ভিউ আর লাইক কোনো অংশেই বেশি গুরুত্বপূর্ণ নয়। সুরভি এবার টিকটকের আসক্তি থেকে মুক্তি পেতে চেষ্টা শুরু করল। সে তার সন্তানকে সময় দেওয়া শুরু করল, তার যত্ন নেয়া, তার সাথে খলা করা, হাসি তামাশা করা, আদর করে চুল আচড়িয়ে দেয়া, স্নান করিয়ে সারা গায়ে তেল মাখিয়ে দেওয়া থেকে শুরু করে সত্যিকারের মজার মুহূর্ত কাটাতে শুরু করল।

একদিন সুরভি রাজুকে কোলে নিয়ে রুপ কথার গল্প শুনাচ্ছিল। এমন সময় রাজু খুব দূর্বল কন্ঠে মাকে বলল-“মা, তুমি আগে কেন আমার সাথে খেলতে না?”

মা (কান্নার গলা ধরে): বাবু, মা তোমার সাথে খেলতে চেয়েছিল, কিন্তু আমি ভুলে গিয়েছিলাম কতটা গুরুত্বপূর্ণ তুমি আমার জীবনে।

ছেলে: আমি তো তোমার সাথেই থাকতে চাই, মা। টিকটকের সাথে না।

মা (ছেলের হাত ধরে): আমি জানি, বাবু। আমি প্রতিজ্ঞা করছি, এখন থেকে আমি তোমার সাথে থাকব, সবসময়।

ছেলে: তুমি আর কখনও আমাকে একা রেখে টিকটকের সাথে থাকবেনা, মা?

মা (চোখ মুছে): না, বাবা, আর কখনও না। তুমি আমার সবকিছু। আমি সব সময় তোমার সাথে থাকব।

ছেলে (দুর্বলভাবে হাসি দিয়ে): মা, তুমি জানো, আমি যখন অসুস্থ হলাম, তখন অনেক ভয় পেয়েছিলাম।

মা (অশ্রুসজল চোখে): আমি জানি, বাবু। আমি তখন বুঝতে পেরেছি, তোমাকে কত অবহেলা করেছি। আমি সত্যিই খুব দুঃখিত।

ছেলে: মা, তুমি আমাকে ছেড়ে চলে যাবে না তো?

মা (কান্না আটকে): না, বাবু। কখনও না। আমি এখন তোমার পাশে আছি এবং সবসময় থাকব।

ছেলে: মা, তুমি কি আমাকে গল্প শুনাবে?

মা (মাথা নেড়ে): হ্যাঁ, বাবা। আমি তোমাকে প্রতিদিন গল্প শুনাবো।

ছেলে (মায়ের হাত শক্ত করে ধরে): মা, আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি।

মা (চোখের জল মুছে): আমিও তোমাকে অনেক ভালোবাসি, বাবু। তুমি আমার সবকিছু। এখন থেকে আমি শুধু তোমার জন্য বাঁচব।

ছেলে (কান্না ভেজা চোখে): মা, তুমি এখন অনেক ভালো মা হয়ে গেছো।

মা (মায়ের কণ্ঠে): তোমার ভালোবাসাই আমাকে বদলে দিয়েছে, বাবু। তুমি আমার জীবনের সবচেয়ে বড়ো উপহার।

 

সুরভি এখন টিকটকে শুধু এমন ভিডিও পোস্ট করতে শুরু করল যেগুলোতে সে এবং রাজু একসাথে খুশি ও সুন্দর মুহূর্ত কাটাচ্ছে। সুরভি তার ফলোয়ারদেরও এই বার্তা দিতে শুরু করল, "প্রিয় বন্ধুরা, স্যোসাল মিডিয়া আমাদের জীবনের একটি অংশ, কিন্তু এটি কখনোই আমাদের পরিবারের থেকে বেশি মূল্যবান নয়। বাস্তব জীবনের মুহূর্তগুলো আমাদের জীবনের সবচেয়ে বড় সম্পদ। তাই আসুন আমরা আমাদের পরিবারকে ভালোবাসি এবং যত্ন করি। আমরা যেন স্যোসাল মিডিয়ার দুনিয়ায় হারিয়ে না যাই।"

একদিন কাজ থেকে ঘরে ফিরে সৈকত জিজ্ঞেস করে-“কী হচ্ছে এখানে? আমার প্রিয়জনেরা কী নিয়ে আলোচনা করছে?

মা (মুচকি হেসে): আমাদের ছোট বাবু একটু কথা বলতে চায়।

ছেলে (উত্তেজিত হয়ে): বাবা, তুমি জানো মা এখন আমাকে অনেক সময় দেয়?

বাবা (আনন্দিতভাবে): সত্যি? তা তো অনেক ভালো খবর! মা তোমাকে সময় দিচ্ছে, তাই না?

ছেলে: হ্যাঁ, বাবা। মা এখন আমার সাথে খেলে, গল্প শোনায়। আমি অনেক খুশি।

বাবা (মায়ের দিকে তাকিয়ে): এটা শুনে আমি খুব খুশি। আমরা সবাই একসাথে থাকবো, ঠিক আছে?

মা (হাসি মিশ্রিত চোখে): হ্যাঁ, আমরা সবাই একসাথে থাকবো।

বাবা: আমাদের জীবনে ফেসবুক আছে, টিকটক আছে, মোবাইল ফোন আছে, কিন্তু পরিবার সব সময় সবার আগে। আমরা একে অপরের সাথে সময় কাটাবো, ভালোবাসবো, যত্ন নেবো।

ছেলে (আলিঙ্গন করে): বাবা, তুমি কি আজ রাতে আমাদের সাথে গল্প শোনাবে?

বাবা (ছেলের মাথায় হাত রেখে): অবশ্যই, বাবা। আমরা সবাই মিলে গল্প শুনবো, আর একসাথে থাকবো।

মা (কান্না ভেজা চোখে): আমাদের ছেলে আমাদের জীবনে নতুন আলো এনে দিয়েছে।

বাবা: আমাদের পরিবারই আমাদের সুখের মূল। প্রযুক্তি আসবে যাবে, কিন্তু পরিবারের বন্ধন সব সময় আগে।

ছেলে (হাসি মিশ্রিত মুখে): আমি তোমাদের দুজনকেই খুব ভালোবাসি।

মা ও বাবা (একসাথে): আমরাও তোমাকে খুব ভালোবাসি, বাবু। তুমি আমাদের জীবন। আমরা সব সময় তোমার পাশে থাকবো।

একদিন এক শীতের এক সকালে, সুরভি, সৈকত, এবং রাজু একসাথে ছাদে বসে গরম চা এবং পিঠা খাচ্ছিল। সকালের রোদ তাদের গায়ে মিষ্টি উষ্ণতা এনে দিচ্ছিল। রাজু তার প্রিয় খেলনাগুলো নিয়ে মায়ের কাছে এসে বলল, "মা, তুমি আমার সাথে খেলবে?" সুরভি মুচকি হেসে রাজুকে কোলে তুলে বলল, "হ্যাঁ, বাবু। আজ থেকে আমরা প্রতিদিন একসাথে খেলবো।"

সৈকত এই দৃশ্য দেখে চোখের কোণে আনন্দের অশ্রু নিয়ে বলল, "আমাদের পরিবারের এই মুহূর্তগুলোই সব থেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।"

এইভাবে, সুরভি, সৈকত, এবং রাজু আবার সুখী ও সমৃদ্ধ জীবনে ফিরে গেল। পরিবারে ফিরে এল সুমিষ্ট হাসি আর ভালোবাসা। সুরভি এখন টিকটক করে না, বরং রাজুর সাথে একসাথে খেলে, গল্প শোনে, এবং একে অপরের সঙ্গ উপভোগ করে। পরিবারের পরিবর্তনের সাথে সাথে সুরভির চারপাশের পরিবেশেও এক নতুন সূর্যোদয়ের মতো আলো ছড়িয়ে পড়ে। ঘরের প্রতিটি কোণ যেন আবার প্রাণ ফিরে পায়, টিকটকের বিরামহীন শব্দের পরিবর্তে শোনা যায় রাজুর খিলখিল হাসি আর সুরভির স্নেহমাখা কথা। সৈকতের ক্লান্ত মুখেও এখন আনন্দের ঝলক দেখা যায়, যেন পরিবারের ভালোবাসা তার জীবনের সব ক্লান্তি দূর করে দিয়েছে। সুরভির চোখে-মুখে মাতৃত্বের জ্যোতি ছড়িয়ে পড়ে, আর রাজুর চোখে-মুখে ফুটে ওঠে নিষ্পাপ আনন্দের ঝিলিক। এই পরিবর্তন যেন এক নতুন বসন্তের আগমনের মতো, যখন প্রকৃতির প্রতিটি ফুল, প্রতিটি পাতা নতুন করে জীবন লাভ করে। সুরভি এখন বুঝতে পারে, জীবনের আসল রঙগুলো প্রযুক্তির কৃত্রিম আলোতে নয়, বরং পরিবারের অকৃত্রিম ভালোবাসা আর যত্নেই লুকিয়ে আছে