নিস্তব্ধ নিশীথ


ভেনু গোপাল ধীর পায়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরের দিকে উঠছিল।

তার মন ভারী, চোখে ক্লান্তির ছাপ। কাঁধে একটি ব্যাগ। কাপড়-চোপড় আর কাগজ পত্রে ঠাসা। এম ভি সুন্দরবন-১৬ নামের লঞ্চে করে বরিশাল থেকে সদরঘাটে পৌঁছে সোজা রিকশায় চড়ে বসে। গন্তব্য বংশালের এই বাড়িটি। তখন সকাল প্রায় আটটা বাজে।

সেপ্টেম্বরের এই শহরটা যেন প্রভাতের কোমল আলোয় ঢাকা মুগ্ধ মেঘের আঁচলে। নির্জন রাস্তায় বাদল দিনের গন্ধে ভাসছে বাতাস। বৃক্ষরাজির পাতায় ঝরে পড়া শিশিরের স্পর্শ, মৃদুমন্দ হাওয়ায় কাঁপছে পথের ধূলিকণা। ভেনু গোপালের রিক্সা এগিয়ে চলছে বুড়ি গঙ্গার পাশ দিয়ে নির্জন পথ ধরে। প্যাডেলের স্নিগ্ধ ঘূর্ণনের সাথে চেনের মৃদু কাঁচা শব্দ, চাকার হালকা গড় গড় আওয়াজ, এবং পিচঢালা পথে চাকার মোলায়েম ঘর্ষণে সৃষ্ট কি সুন্দর একটি সুরেলা সঙ্গীত কানে এসে বাজছে। সারা রাত বৃষ্টি ছিলো। এখনো ঘন ঘন মেঘ আকাশে ভেসে বেড়াচ্ছে। মৃদুমন্দ হাওয়ার সঙ্গে তাল মিলিয়ে পাতাগুলো কাঁপছে তির তির করে। ভেনু গোপালের চোখে পড়ে দূরে নদীর উপড়ে ভেসে বেড়ানো এক দল পাখি। পাখিরা জাগছে ধীরে ধীরে।  তাদের ডানার আওয়াজে শহরের নীরবতা ভেঙে যাচ্ছে।  কি অপূর্ব এ শহরের সকাল। মনে মনে ভাবছে ভেনু গোপাল।

হঠাৎ খ্যাচ করে রিক্সাটা এসে থামলো গলীর সামনে।

খুব সরু গলি। সামনের পথটা হেঁটেই যেতে হবে। ভাড়াটা দিয়ে এগিয়ে চললো ভেনু। কিছু দুর এগিয়ে বা দিকে মোড় নিয়ে আবার এগিয়ে চললো। চার নম্বর গেইটটি খোলাই ছিলো তখন। গেইটের নীচের অংশটি হাত দিয়ে খুলে মাথাটা নুইয়ে একটু বাঁকা হয়ে ভেতরে ঢুকলো। দুতলার বাড়ীটির দুতলার ডান পাশে থাকে ভেনু গোপাল। সিঁড়ির প্রতিটি ধাপে পা রেখে ভেনু একটু একটু করে উপরে উঠছে। উপরে উঠতেই ডানপাশের ছোট্ট রান্না ঘরটির সামনে  চোখ পড়ল তার। মেয়েটি দাঁড়িয়ে আছে সেখানে। তার নরম মুখমণ্ডল মৃদু আলোয় আলোকিত। রান্নাঘরের ভিতর থেকে বৌদির কণ্ঠস্বর শোনা যাচ্ছে। সেই কণ্ঠে যেন এক অদ্ভুত কৌতূহল মিশে আছে।

মেয়েটির চোখে চোখ পড়তেই, ভেণু গোপালের হৃদয়ে এক আশ্চর্য অনুভূতি জেগে উঠল। মেয়েটি তাড়াতাড়ি চোখ ফিরিয়ে নিল। মাথায় ওড়নাটি টেনে দিল। তবে মাথাটি ঘুরিয়ে নেওয়ার আগে ভেনু ওর মুখে একটা মৃদু হাসির রেশ দেখতে পায়। একেবারে মোহনীয়। অজ্ঞান করা, ভালো লাগার। কী এক অজানা আকর্ষণ তাকে টানছে সেই মেয়েটির দিকে। বেশ অবাকই হলো মেয়েটিকে দেখে। আগে কখনোই দেখেনি। বেশ সুন্দর গায়ের রং। হঠাৎ যেন সময় থমকে যায় ভেনু গোপালের। ভাবছে “কে এই মেয়েটি।“ হঠাৎ বৌদির কন্ঠ-“বেনুদা আইছেন? কেমন আছেন?”-বৌদি রান্না ঘর থেকে মুখটি বেড় করে ভেনু গোপালের দিকে চেয়ে একটি প্রচ্ছন্ন হাসিতে ফেটে পড়লো।

“কেমন আছেন বৌদি? সব ঠিক ঠাক তো?”-স্মিত হেসে ভেনু গোপাল বৌদিকে জিজ্ঞেস করে। সাথে সাথে চোখের ইশারায় মেয়েটি কে জানতে চায়।

মেয়েটি তখনও ঠায় দাঁড়িয়ে ছিল। হাতে একটি তেলের শিশি। পড়নে সেলোয়ার কামিজ। বেশ লম্বা গাঢ়ো কালো চুল। বয়স সম্ভবত বিশ-একুশ।

“ওর নাম দেবকী। দুই দিন আগেই আইছে।“-বৌদি পরিচয় করিয়ে দেয়।

“নমস্কার”-দু হাত তুলে ভেনু নমস্কার জানায় মেয়েটিকে। মেয়েটিও সাথে সাথে প্রনাম জানায়। তার পর ভেনু গোপাল নিজের রুমে চলে যায়।

ভেনু গোপাল ২৮ বছর বয়সী এক তরুণ। বাড়ী ফরিদপুর শহরে। ভেনুর সুদর্শন রূপ এবং সৌম্য ব্যবহার যে কোনো মানুষের মন সহজেই জয় করে নিতে পারে। এখনও অবিবাহিত। উপযুক্ত সঙ্গিনী খুঁজে পাওয়ার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে।

এই বাড়ীতে আছে প্রায় তিন বছর হতে চললো। পেশায় একজন ঔষধ বিক্রয় প্রতিনিধি। মালিকের ব্যাবসা মিটফোর্ডে। সারাদেশে ঔষধ সাপ্লাই। তাই প্রতি মাসেই বরিশাল সহ নর্থ বেঙ্গলে যেতে হয়। সপ্তাহ দুয়েক কাটিয়ে আবার চলে আসে। ভেনু খুব ভ্রমন রসিক। কথা-বার্তা বেশ গুছিয়ে বলতে পারে। বেশ শুদ্ধ বাংলায় কথা বলে। পেশার কারনে ভ্রমন করতে হয় ঘন ঘন। আর ভ্রমণের মধ্য দিয়ে সে জীবনের নানা রূপ দেখতে পায়। কাজের জন্য তাকে অনেক দূরে দূরে যেতে হয়, কিন্তু এ সমস্ত ক্লান্তি সে হাসিমুখে মেনে নেয়। এই যাযাবরের জীবনটাই ওর ভালো লাগে।

বৌদি কুমিল্লার মেয়ে। তবে ভেনু গোপালের সাথে কথা বলার সময় খুব কষ্ট করে শুদ্ধ বাংলাটাই বলার চেষ্টা করে। কিন্তু মুখ ফসকে কখনো সখনো কুমিল্লার গ্রামাঞ্চলের ভাষাটাই বেড়িয়ে আসে। তাতে বৌদির আফসোস নেই। ভেনু দা খুব কাছের লোক।

ভেনু তার বসের বাড়িতেই থাকে। তার জন্য আলাদা কোন ভাড়া দিতে হয় না। কেমন একটা আত্মীয়তার সম্পর্ক বাড়ীর সকলের সাথেই। বিশেষ করে বসের স্ত্রীর সাথে। বৌদি বলে ডাকে ভেনু। আর বৌদি ডাকে ভেনুদা বলে। যেন ভাই-বোনের সম্পর্ক। বাড়ীর আরেক জনের সাথেও খুব ভালো সম্পর্ক। আর সে হলো বসের ছোট ভাই ধীমান। কলেজে পড়ে। দুজনের মধ্যে বেশ দহরম মহরম ভাব। ঢাকায় আসলেই ধীমানকে নিয়ে সিনেমায় যায়। সাত মসজিদ হয়ে সোহরোওয়ার্দী উদ্যানে যায়। শরীরের কসরত করে, ঘন্টা খানেক হেঁটে আবার বাসায় ফিরে আসে। আসার পথে বংশাল থানার পাশের রেস্টুরেন্ট থেকে গরম গরম দুটি সিঙ্গারা আর আলু পুরী খেয়ে আসে। ভেনু গোপালই পয়সা দেয়। ছোট ভাইয়ের মতো আদর করে ধীমানকে। ভেনু দাদা যেন ধীমানের খুব প্রিয়।

 

সেদিন বিকেলেই ভেনু বৌদিকে মেয়েটির সম্পর্কে জানতে চায়।

 

ভেনু: বৌদি, এই নতুন মেয়েটি কে? আগেতো ওকে এখানে দেখিনি?

বৌদি: ওহ, দেবকীর কথা কইছেন? বেচারি খুব দূর্ভাগা। তার জামাইটা কয়দিন আগে মইরা গেছে। এহন আমাদের কাছেই থাকব কিছুদিন। শ্বশুর বাড়ীতে আর ঠাই নাই। শ্বশুর বাড়ীর লোকগুলা খুব ইতর, বদমাইশ!

ভেনু: আরে সত্যি, তাই নাকি? খুব দুঃখজনক। কিভাবে স্বামীটা মারা যায়? ও কি আর শ্বশুর বাড়ী যাবে না?

বৌদি: হ্যাঁ ভাই, দেবকী খুবই ভালো মেয়ে। অনেক কষ্টে আছে। আমাদের লগে থাকলে হয়তো একটু ভালো লাগবে তার। মাত্র কয়েক মাস হইলো বিয়া হইছে। জামাইটা খুব ভালা ছিল। নিজের একটা দোকান ছিল বাজারে। তাইরে খুব ভাল পাইত। আদর যত্ন করত। একদিন শহরে গেছিল মাল টাল কিনার জন্য। আইয়নের সময় বেবী ট্যাক্সী ট্রাকের লগে ধাক্কা খায়। গাড়ীর হগলে নাকি মইরা গেছে। তার কয়দিন পরেই এই নতুন বউডারে অপবাদ দিয়া বাপের বাড়ী থেইক্যা বার কইরা দেয়।

ভেনু: বলছো কি বৌদি! এতো অন্যায়।

বৌদি: গ্রামের বাড়ীতে থাকলে নানা জনে নানা কথা কয়। মাইয়াডা জলে ডুইব্বা মরতে গেছিল এক দিন। আমার দুর সম্পর্কের মাসতুত ভাই দেখতে পায় বোনকে জলের মধ্যে হাবু ডুবু খাইতে। একটু দেরী হইলে ঐদিনই অক্কা পাইতো। আমি খবর পাইয়া এহানে নিয়া আইলাম। আপনার দাদা বলছে যে করেই হোক ওর আবার একটা বিয়ার ব্যবস্থা করবে।

ভেনু : বৌদি,খুব ভালো করেছেন।

এমন সময় দেবকী ঝাল মুড়ি নিয়ে এলো। ভেনুর চোখ গিয়ে পড়ে দেবকীর হাস্যোজ্জ্বল মুখ খানির দিকে।

“আয় বস দেবকী। আমাদের ভেনুদা। তুইও দাদা বলে ডাকিস। আমাদের সাথে থাকে। ফরিদপুরে বাড়ী।“-বৌদি দেবকীকে বলে।

“প্লীজ বসেন।“-ভেনু দেবকীর দিকে চেয়ে বলে।

পাশ থেকে একটি কাঠের পিড়ি টেনে দেবকী বৌদির পাশে বসে। “মুড়িতে একটু ঝাল দিয়েছি। ঝাল খানতো আপনি?”-দেবকীর কন্ঠ।

 

এই ভাবেই দেবকীর সাথে প্রথম আলাপ চারিতা ভেনু গোপালের।

দেবকীর মা-বাবা খুব গরীব। সংসারে দুই বোন এক ভাই। বড় বোনের অনেক আগেই বিয়ে হয়। সুখেই আসে স্বামী সন্তান নিয়ে। ভাইটি এখনো ছোট। টাকার অভাবে দেবকী হাই স্কুলে যেতে পারেনি। এ বাড়ী ও বাড়ী কাজ করে সংসারের ভার কিছুটা কমাতো। বাড়ন্ত মেয়েকে নিয়ে বাবা মার চিন্তার অন্ত নেই। রাস্তা একা একা বেরুলেই বদ মানুষদের অশুভ নজরে পড়ে। সাপের মতো ছোবল মারতে চায়। নানা রকমের কথা বলে।

সুন্দরী বলে নানা জায়গা থেকে বিয়ের আলাপ আসে। কিন্তু মেয়েকে দেখতে আসে। পছন্দও করে। তারপর একটা বড় লিস্ট থেকে দেওনা-পাওনার হিসেব কষতে থাকে। এ যেন বাড়ী নয়, কোন বাজারে এসে দেখে শুনে পন্য বিক্রি করা। নিজের ছেলেকে বিক্রি করতে চায়। মেয়েকেও সুন্দরী, দেখতে শুনতে ভালো, আদব-কায়দায় বেশ সামাজিক, রান্না-বান্নায় বেশ পাকা, ঘর-গেরস্থালীতে বেশ দক্ষ, স্বভাব চরিত্রে একেবারে চব্বিশ ক্যারটের সোনা, গায়ের রং মোলায়েম ফর্সা, বনলতা কেশী টানা টানা চোখ আরো কতো কি গুন থাকতে হবে। তার পর চলবে যৌতুকের দর কষাকষি। এ যেন ব্যাবসায় মুনাফা বানানোর উত্তম নারকীয় পন্থা। ছেলে বেচা-কেনার উত্তম হাট বাজার। মেয়ের পরিবার ছেলে কেনার দর দাম করে আর ছেলের বাবা বড় বিক্রেতা, যতো দাম পাওয়া যায় ততোই ভালো।

 

কি অদ্ভুত বেদনাদায়ক এক সামাজিক প্রথা। সবাই নগদ টাকা সহ গয়না, আসবাবপত্র, রেলী সাইকেল, সিকো ঘড়ি ইত্যাদি ইত্যাদি কতো কিছুই না চায়। দেবকী জানে বাবা মায়ের যৌতুক দেওয়ার সামর্থ্য নাই। তাই মাকে বলতো-“আমার জন্য কোন ছেলে দেখো না মা। আমাকে পারবে না দুবেলা দুটি রুটি দিতে?না হয় বলো পুকুরে ডুবে মরি।“

আঙ্গুল দিয়ে মেয়ের মুখ চেপে ধরে মা। চোখ দিয়ে কল কল করে জল ঝড়তে থাকে-“অমন অলুক্ষনে কথা আর কক্ষনো মুখে আনবি না। কিন্তু মেয়ে হয়ে জন্মছিস যে মা, বিয়ে থা যে করতে হবে। স্বামীর ঘরই যে মেয়েদের আসল ঘর। মেয়েকে স্বামীর ঘরে পাঠানো যে বাবা-মায়ের কর্তব্য।“

 

একদিন দেবকীর ভাগ্য ফেরে। পাশের জেলা থেকে এক বিয়ের প্রস্তাব আসে। ছেলের মুদি দোকান আছে বাজারে। সংসারে বাবা-মা আর একটি ছোট বোন। ক্ষেতী জমিও আছে গ্রামে। সংসারের আর্থিক অবস্থা ভালই। তাই বেশী দেনা-পাওনার ঝক্কি ঝামেলা নেই। শুধু ক্যাশ পঞ্চাশ হাজার টাকা হলেই চলবে। ছেলের ব্যাবসায় লগাবে। এমন ছেলে হাত ছাড়া করা যায় না। তাই বিয়ের প্রস্তাবে রাজী হয়ে যায়।

একদিন দেবকী নতুন সংসারে পা দেয়। কিন্তু কথামত দেবকীর বাবা পনের পুরো টাকাটা বিয়ের লগ্নের আগে দিতে পারেনি। বাকী বিশ হাজার টাকা পরে দেবে বলে হাত পা ধরে কোন রকমে রাজি করিয়েছে।

নতুন সংসারে দেবকীর সুখের সীমা ছিল না। কিন্তু বিধি বাম। বিয়ের কয়েক মাস পরেই তার স্বামী একটি দুর্ঘটনায় মারা যায়। শ্বশুরবাড়ির লোকজন, বিশেষ করে শাশুড়ি, এই ঘটনা মেনে নিতে পারেনি। শাশুড়ি ধারনা দেবকীই এই অমঙ্গল বয়ে এনেছে। ছেলের মৃত্যুর শোক কাটতে না কাটতেই একদিন শ্বাশুরী অগ্নি মূর্তি হয়ে উঠে-"তুই একটা সর্বনাসিনী! তোর জন্যই আমার ছেলেটা মারা গেছে। তুই একটা শয়তান! অলুক্ষুনী, ডাইনি"

দেবকী তখনো শোকের সাগড়ে হাবু ডুবু খাচ্ছে। শ্বাশুরীর কথায় চমকে উঠে: "মা, আপনি এ সব কি বলছেন? আমি কি করেছি? আমি তো ওকে ভালোবাসতাম।"

শাশুড়ি: "ভালোবাসা? তোর ভালোবাসা বিষ, তুই একটা সর্বনাসি! তুই এই বাড়ি থেকে চলে যা! কার জন্য এই বাড়ীতে আছিস? তোর বাবাত বাকী টাকাটা এখনো দিল না? সব পাপীষ্টের দল। দূর হ এই বাড়ী থেকে। তুই একটা ডাইনি! তোর জন্যই আমার ছেলে মরে গেল। তোর সাথে আমার ছেলের বিয়ে না হলে আজকে সে বেঁচে থাকত।“

দেবকী: "মা, আমি এমন কিছু করিনি যাতে সে মারা যায়। দয়া করে আমাকে এইভাবে দোষারোপ করবেন না।"

শাশুড়ি: "চুপ কর, ডাইনি! তোর জন্যই আমাদের এত বড় ক্ষতি হয়েছে। এখনই আমার বাড়ি থেকে বের হয়ে যা!"

দেবকীর জীবন এক নিমিষেই অন্ধকারে ডুবে যায়। শ্বশুর বাড়ির সবাই তাকে অপমান করে, সমাজের লোকজনও তাকে সন্দেহের চোখে দেখে। একদিন শাশুড়ি তাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেয়। চুল ধরে টানতে টানতে ঘর থেকে বেড় করে দেয়। ধাক্কা দিয়ে দড়জার বাইরে ফেলে দেয়।

তারপর ঠাস করে মুখের উপর দরজাটা বন্ধ করে দেয়।

সেদিন কেউ তাকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসেনি। সমাজের চোখে সে এক অভিশপ্ত নারী। দেবকী অসহায় হয়ে নিজ বাড়ীতে চলে আসে।

তন্ময় হয়ে শুনছিল ভেনু গোপাল দেবকীর কাহিনী বৌদির মুখে।

বাড়িতে ফিরেও শান্তি মেলে নি দেবকীর। পাড়াপ্রতিবেশীরা নানা কথা বলে। বাবা-মা ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েন। দেবকীকে দেখলেই লোকে নানা রকমের কটুক্তি করে-"ওর তো সব কিছু শেষ হয়ে গেছে। এমন মেয়ে নিয়ে কী হবে!""দেখলে মনে হয় বাড়ির সম্মান শেষ করে দিলো!" কেউবা কৌতুহলজনক মন্তব্য করে-"দেবকী এতদিন কোথায় ছিল?" "ওর সাথে আসলে কী হইছে? কেউ কিছু জানে?" "ও মাইয়া নাকি ঢাকায় যাবে শুনলাম। কার কাছে যাইব?" আবার মানুষ যখন বিপদে পড়ে অনেকেই তখন গদগদ হয়ে সহানুভূতির পসরা সাঁজিয়ে বসে। সহানুভূতির ফোড়ন কাটতে কম যায় কিসে?- "কত কষ্ট সহ্য করতে হইতাছে মাইয়াডারে। কেউ তো পাশে দাঁড়াতেছে না।" আবার গ্রামের সেকেলে মানুষজন আতংকও ছুড়ে মাড়তে ছাড়ে না-"ওর কারণে আমাদের পাড়ার সুনাম নষ্ট হইব না তো?" "আমাদের সন্তানদের ওর থেকে দূরে রাখতে হইব।" এত্তোসব যখন ঘটে চলছে দেবকীকে নিয়ে তখন সব আশা ভরসা হারিয়ে দেবকীকে ঢাকায় আমাদের কাছে পাঠিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় দেবকীর বাবা।

বৌদির মুখে এই সব শুনতে শুনতে ভেনু গোপালের হৃদয় ভারাক্রান্ত হয়ে পড়ল। সমাজের কঠোরতা, পাড়াপ্রতিবেশীদের নির্মম মন্তব্য, এবং দেবকীর নিজের বাড়িতে ফিরে এসেও শান্তি না পাওয়া—এসব কাহিনী ওকে গভীরভাবে স্পর্শ করল। একজন মেয়ের জীবনে এতোটা কষ্ট ও লাঞ্ছনা সহ্য করতে হয়, ভেনু কখনো ভাবতেও পারেনি। চোখ দুটি ভিজে আসছিলো। হাতগুলো যেন অবশ হয়ে পড়ছিলো। মনটা বেশ ভারী ভারী লাগছিল। দেবকীর মতো একজন মেয়ের জীবন এভাবে ভেঙে পড়া এবং নিজের বাড়িতেও আশ্রয় না পাওয়ার বেদনা তাকে অত্যন্ত মর্মাহত করল।

দেবকীকে দেখছে আজ কয়েকদিন হলো।

বেশ সুশ্রী, হালকা পাতলা গড়ন। চোখ, বড়ো এবং হরিণীর মতো। দেখলেই ভেনুর প্রানটা উদাস হয়ে যায়। মনে মনে ভাবে এমন মেয়েকেই শুধু ভালোবাসা যায়। চোখে চোখ রেখে ইশারায় জীবনের কাব্য লেখা যায়। এক গভীর আবেগের আধার যেন দেবকী। ওর কাছে এলেই যেন এক উজ্জ্বল আলো আছড়িয়ে পড়ে ভেনুর চোখে মুখে। মেঘলা দিনকেও তাড়িয়ে দিতে পারে এ আলো। ঠিক যেন প্রভাতের প্রথম আলো বাংলার সবুজ ধানক্ষেতের ওপর দিয়ে ভেঙ্গে পড়ছে। ভেনুকে দেখলেই কেমন এক কোমল হাসির ফোয়ারা ভেসে উঠে দেবকীর মুখে। মুখটা আলতো করে ঘুরিয়ে নেয়। কিন্তু ভেনুর চোখে পড়ে সে সুন্দর হাসিটি। তার এ হাসিতে যেন লেগে থাকে বসন্তের প্রথম ফুলের স্বচ্ছতা। খুব ভালো লাগে ভেনুর।

এই বাড়ীতে তার উপস্থিতি যেন এক শীতল বাতাসের মতো। যা গ্রীষ্মের প্রচন্ড গরমের দিনে পদ্মা নদীর ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া এক স্বস্তির মুহূর্ত এনে দেয়। এই কয়দিনেই যেন ভেনু গোপাল দেবকীকে ভালো বেসে ফেলে।

বৌদিকে রান্না-বান্নায়ও সাহায্য করে। তার হাতের রান্না যেন অতুলনীয়। গতকাল খেতে বসেই ভেনু টের পায়। জিহব্বায় লেগে থাকার মতো স্বাদ। বৌদিও বলেছিল “আজকের রান্না সব দেবকীর।“

 

এমনি করেই দুটি সপ্তাহ কেটে গেল ভেনু গোপালের। আবার যেতে হবে দক্ষিন বঙ্গে। এবার যাবে ভোলা-পটুয়াখালি। আার আসার পথে বাড়ীতে যাবে ফরিদপুরে। কিন্তু মনটা খুব উচাটন, উদাস করা ভাব। এবার কেমন জানি লাগছে। যেতে ইচ্ছে করছে না। মনে হয় আরো কয়েক দিন এখানেই থেকে যায়। দেবকীকে চোখে চোখে রাখার কী এক তীব্র ইচ্ছে মনে জেগে উঠছে। কোন এক অসতর্ক মুহূর্তে কড়িডোরে হাঁটতে গিয়ে সদ্য স্নাত দেবকীর চুলের জলজ ঘ্রানে ডুবে থাকতে চায়। উৎপল ছন্দে গলা খুলে গুন গুন করে কোন গানের দু একটি লাইন দেবকীকে শোনাতে চায়।

হঠাৎ ভেনু গোপালের ভাবনায় ছেদ পড়লো-“ভেনু দা, তুমি বাইরে কী কাল যাবা নাকি আজ রাতে?”-বৌদি জিজ্ঞেস করে।

“কাল রাতে যাবো, বৌদি।“-ভেনু খুব নরম সুরে উত্তর দেয়।

“আচ্ছা”-এই বলেই বৌদি ফিরে যায়।

হঠাৎ ভেনু অস্ফুট স্বরে ডেকে উঠল-“বৌদি”

কিন্তু সে আওয়াজ আর বৌদির কানে এসে পৌছায়নি। ভেনুর হৃদয়ে সাগড়ের আথালি-পাথালি ঢেউ। অস্থির মন। দেবকীকে দেখার পর থেকেই ভেনু অন্যরকম হয়ে যায়। সব কিছু কেমন ভালো লাগতে শুরু করে। ঘরে সারাক্ষন বসে থাকতে ভালো লাগে। কারো মুখের দুষ্টুমী হাসী দেখতে ঘন্টার পর ঘন্টা অপেক্ষা করতে ভালো লাগছে। ভালো লাগছে আকাশ, বাতাস, গাছ গাছালি, বংশালের সরু গলি, পুরনো বাড়ী, সব্জীর তরকারী, শাক, ভর্তা সব কিছু। সবচেয়ে ভালো লাগে দেবকীকে। কিন্তু মুখ ফুটে ভেনুর ভালো লাগার, ভালো বাসার কথা কাউকে বলতে পারে না। বৌদিকে বলতে গিয়েও বলতে পারলো না।

ভেনু সিদ্ধান্ত নেয় দেবকীকে বিয়ে করবে।

এই বার বাড়ীতে গিয়ে সব ঠিক ঠাক করে আসবে। সে তার পরিবারকে বিষয়টি নিয়ে কথা বলবে। দেবকীর সব কথা বলবে। এই সব ভাবতে ভাবতে ভেনুর মন আনন্দে ভরে উঠে। যেন ভোরের বসন্তের হাওয়া তার হৃদয়ে বয়ে যাচ্ছিল।

কিন্তু হঠাৎ করেই যেন সব ভেঙ্গে চূর্ন বিচূর্ন হয়ে যায়। ভেনুর বস অর্থাৎ বৌদির স্বামী এসে খবরটি দিলেন যে দেবকীর জন্য একজন পাত্র পাওয়া গেছে। বৌদিকে বলছিলেন কথাগুলো-“পাত্রের বয়স একটু বেশী। পাঁচ ছেলে মেয়ের বাবা। বৌ মারা গেছে বছর দুয়েক আগে। ছোট ছেলেটির বয়েস আড়াই বছর। তবে বড়ো মেয়েটি বিয়ের উপযুক্ত। তারা কোনো যৌতুক চান না, বরং বৃদ্ধ লোকটি দেবকীর বাবাকে আর্থিক সহায়তা করবেন। দেবকী খুব ভাগ্যবতী। তা না হলে বিধবা মেয়েকে কে বিয়ে করবে?“

বৌদি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে-“ছেলের ত অনেক বয়স!”

“ছেলেদের আবার বয়েস কী?”-উত্তরে স্বামী।

 

ভেনু আর কিছু শুনতে পাচ্ছিল না। কান কেমন ঝাঁ ঝাঁ করছিল। ভেনুর মনে হলো, যেন সব সুখের স্বপ্ন ভেঙে গেল। দেবকীর মুখচ্ছবি তার চোখের সামনে ভেসে উঠল।  তার হৃদয় যেন নিঃশব্দে কেঁদে উঠল। দেবকীকে সে যে খুব ভালোবাসে। তার জীবনের স্বপ্ন ছিল তাকে বিয়ে করবে। বসের কথাগুলো যেন ধারালো ছুরি হয়ে তার হৃদয়ে বিঁধে গেল। দেবকীর ভবিষ্যৎ কল্পনা করতেই তার চোখে অশ্রুর ধারা বয়ে যেতে লাগল। সে ভাবতে লাগল, দেবকীর মতো একজন স্নিগ্ধ ও কোমল মেয়ের এমন করুণ পরিণতি কেন হবে?

ভেনু নিজেকে খুব অসহায় ও নিঃস্ব অনুভব করছিল। তার হৃদয়ে যেন এক গভীর শূন্যতা নেমে এল। সে কী করবে, কীভাবে করবে—কোন কিছুই তার মাথায় আসছিল না। সে শুধু বসে বসে ভাবতে লাগল, দেবকীর জন্য তার ভালোবাসা কি কোনো মূল্যই রাখে না? কেন দেবকীকে এমন এক নিষ্ঠুর নিয়তির সামনে দাঁড়াতে হবে? তার ভালোবাসা কি এতটাই তুচ্ছ যে অর্থের বিনিময়ে দেবকীকে অন্যের হাতে তুলে দিতে হবে?

ভেনু চোখের জল আর থামাতে পারল না। তার মনে হচ্ছিল, জীবন থেকে সব রঙ হারিয়ে গেছে। সব আশা, সব স্বপ্ন যেন মিথ্যে হয়ে গেল। দেবকীকে সে কোনোভাবেই হারাতে চায় না, কিন্তু এখন তার মনে হচ্ছে যেন সবকিছু তার হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে। তার হৃদয়ে শুধু একটাই প্রার্থনা ছিল—কেন বিধাতা এমন নিষ্ঠুর খেলায় তাকে জড়ালেন?

 

সে একা একা ঘরের কোণে বসে কাঁদতে লাগল, বুক ফেটে কান্না আসছিল। সে ভাবছিল কিভাবে দেবকী তার জীবনের এমন কঠিন বাস্তবতার সম্মুখীন হবে। ভেনুর মনে হচ্ছিল যেন তার সমস্ত পৃথিবী অন্ধকারে ডুবে গেছে। একমাত্র আলোর দিশা ছিল দেবকী, আর সেই আলোও এখন নিভে যেতে চলেছে। ভেনু বুঝতে পারছিল না কিভাবে সে এই নির্মম সত্যের মুখোমুখি হবে।

প্রতিটি শ্বাস, প্রতিটি নিশ্বাস যেন ব্যথার ভারে নুয়ে পড়ছে। দেবকীর স্মৃতিতে তার হৃদয় ভরে উঠছে কান্নার সুরে।

এমন সময় দেবকী চায়ের কাপটা নিয়ে এলো। সাথে কিছু বিস্কিট-“ভেনু দা আপনার চা।“

ভেনু গোপাল সাশ্রু নয়নে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো দেবকীর দিকে। দেবকীর চোখে মুখে যেন ভিসুভিয়াসের কান্নার উদ্যামতা। বাইরে তখন ঝির ঝির করে বৃষ্টি শুরু হলো। দূর থেকে পাখিদের ডানা ঝাপটার আওয়াজ ভেনুর কানে এসে বাজলো।