সায়নীর স্বপ্ন-১৬
Summary:
আজ স্কুলে বছরের শেষ অনুষ্ঠান।
গত দুই দিন পর পর সংগীত এবং ক্রীড়া প্রতিযোগীতা অনুষ্ঠিত হয়। এই প্রথম বারের মতো সায়নী গানের প্রতিযোগীতায় অংশ গ্রহন করে। বেশ ভালো ভাবে নাজমা ম্যাডামের কাছে তালিম নিয়েছিল। মুহুর্মুহু করতালিতে বুঝা যাচ্ছিলো সায়নীর গান ভালো হয়েছে। তিতলি এবং শান্তনু জোড় গলায় বলেছে সায়নীর গাওয়া নজরুল গীতিটিই সবচেয়ে সেরা গান ছিল।
বার্ষিক স্কুল প্রোগ্রামের জন্য আজ ছাত্র, শিক্ষক এবং অভিভাবকরা জড়ো হয়েছে স্কুলের এই বিশাল থিয়েটার রুমে। সায়নীর পরিবারের সবাই এসেছে। শুধু তমাল আসেনি। মা, বাবাকে আগেই বলে রেখেছিল আজ যেন অফিসে না যায়। সকলের উপস্থিতিতে স্কুল হলটি গুঞ্জনের ব্যাঞ্জনায় মুখরিত ছিল। টান টান উত্তেজনাকর পরিবেশ। শিক্ষকরা সামনের সারিতে বসেন, তারপর অভিভাবকগন। পিছনের সারিতে বসে ছাত্র-ছাত্রীরা। সবাই অধীর আগ্রহে প্রধান শিক্ষকের মুখে স্কুলের ফলাফল ঘোষণার অপেক্ষায় ছিল।
আজ হলটিকে বর্ণিল সাজে সজ্জিত করা হয়েছে প্রতিবছরের মতোই। দেয়ালে ঝোলানো উজ্জ্বল ব্যানার। খেলাধুলা, একাডেমিক শ্রেষ্ঠত্ব এবং শৈল্পিক ক্ষেত্রে বিজয়ের চিহ্ন দেয়ালগুলিতে। মঞ্চটি ফুল এবং ফিতা দিয়ে সজ্জিত। মাথার উপরের পাখাগুলি সাঁ সাঁ করে অনবরত ঘুরছে। জায়গার অভাবে অনেক শিক্ষার্থী ডানে-বায়ে-পিছনে দাঁড়িয়ে আছে। ফিস ফিস করে অনেকেই কথা বলছে। অভিভাবকরাও একে অপরের সাথে কথা বলছে।
এক সময় প্রধান শিক্ষক মঞ্চে উঠলেন। সাথে সাথে হল রুমটিতে এক নিস্তব্ধতা নেমে আসে। তার উপস্থিতি সকলের মনোযোগ কেড়ে নেয় তার দিকে। সমস্ত দৃষ্টি তার দিকে স্থির হয়ে যায় যখন তিনি বহু প্রত্যাশিত সংবাদ প্রদানের জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলেন।
"এই বছরের একাডেমিক যাত্রায়," প্রধান শিক্ষক শুরু করলেন। হলের মধ্যে তার কণ্ঠ প্রতিধ্বনিত হচ্ছে, "এই বছর আমরা অধ্যয়ন এবং পাঠ্য বহির্ভূত কার্যকলাপের ক্ষেত্রে এক অসাধারণ সাফল্যে অর্জন করেছি। সকলেই বেশ ভালো করেছে। কিন্তু একজন শিক্ষার্থী আছে যার কৃতিত্বগুলি সত্যিই আলাদা, অসাধারন এবং চমকপ্রদ।"-এই ভাবে তিনি শুরু করলেন। খুব সংক্ষিপ্ত বক্তৃতা দিলেন।
তিনি কিছুক্ষণের জন্য থামলেন এবং সকলের দিকে দৃষ্টি নিবন্ধ করলেন। সামনে কাগজটি লেকটন থেকে তুলে নিয়ে তা হাতে নিলেন, "আমি আজ এই ঘোষণা করতে পেরে সত্যিই গর্বিত যে, এই বছরের সর্বোচ্চ সম্মান এমন একজনকে দেওয়া হচ্ছে যে শিক্ষার্থী স্কুল জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের জন্য নানা-ঘাত-প্রতিঘাতকে অতিক্রম করেছে। এই প্রথম এই শিক্ষার্থী অনেক ক্ষেত্রে প্রথম স্থান অধিকার করে আমাদের সবাইকে গৌরবান্বিত করেছে। আমার কাছে এখনো এইটা অলৌকিক বলেই মনে হচ্ছে। কিন্তু সে পেরেছে। কঠোর অধ্যবসায়, পরিশ্রম আর উৎফুল্ল মন থাকলে মানুষ সব কিছুকেই জয় লাভ করতে পারে। আমি সত্যিই আনন্দিত ও গর্বিত এই বছর সংগীত প্রতিযোগীতায় প্রথম হয়েছে সায়নী।-এই কথা শুনে শিক্ষক-ছাত্র-ছাত্রী সবাই হতবাক। অনেকে বাকরুদ্ধ। অনেকে একে অপরের দিকে তাকাচ্ছে। ভ্রুকুঁচকে হাতের ইশারায় এই ব্যাপারটা যে একেবারে অসম্ভব বা কোথাও ভূল ছাড়া কিছুই নয় তা বুঝানোর চেষ্টা করছে।
কিন্তু কিয়ৎ পরেই হল শুদ্ধ সকলেই করতালিতে মুখর হয়ে উঠলো।
“শুধু সংগীতেই নয়। এই বছর সায়নী হয়েছে ক্লাশে প্রথম, স্কুল অলিম্পিয়াদে প্রথম, `এ সেলেব্রেশান অব ডিফরেন্সে` প্রথম।“-প্রধান শিক্ষক গর্ব ভরে হলের দিকে তাকালেন। সহপাঠিরা বিস্ময়ে হতবাক।
ঘোষণাটি শেষ হওয়ার সাথে সাথে একটি স্তব্ধ নীরবতা নেমে আসে পুরো হলে। তারপরে গোটা দর্শক ও শ্রোতাদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে একটি গোঙানির ঢেউ, মুখরিত করতালি এবং ফিসফিস। সমবয়সীরা, যারা সায়নীর সংগ্রাম দেখে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিল, যারা এক সময় সায়নীকে অবহেলা আর অবজ্ঞা করত, তারা যা শুনছিল নিজের কানে, তা বিশ্বাস করতে পারেনি। কিন্তু খবরটি ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথে, নীরবতা করতালি এবং উল্লাসের একটি চমক সৃষ্টি করে। অভিভাবক আর শিক্ষকরা সবাই দাঁড়িয়ে যয়। আনন্দের ঝলকানি সকলের চোখে মুখে। সায়নীর প্রসংশায় পঞ্চমুখ সকলেই। অনান্য ক্লাশের শিক্ষার্থীরাও অনবরত করতালি দিয়ে যাচ্ছে।
এবার সায়নীর সহপাঠিরা তাদের আসন থেকে উঠে। তাদের সহপাঠী সায়নীর অসাধারণ কৃতিত্বের জন্য সকলেই সায়নীকে অভিনন্দন দেয়। প্রশংসায় সায়নীকে ঘিরে রাখে, উত্সাহের সাথে হাততালি দেয়। তিতলি সায়নীকে জড়িয়ে ধরে-“আই এম প্রাউড অব ইউ, ইউ আর সো জিনিয়াস।“
শান্তনু এসে বলে-“কনগ্র্যাচুলেশনস, সায়নী। আমি তোমার সাফল্যে সত্যিই আনন্দিত।“
এবার প্রধান শিক্ষক সায়নীকে মঞ্চে আসার জন্য ডাকলেন।
করতালি ও উল্লাসের মধ্যে, অটিস্টিক মেয়েটি মঞ্চে এসে উপস্থিত হলো। মিস রিমা হাত ধরে সায়নীকে মঞ্চে নিয়ে আসেন। মাইক্রোফোনের সামনে দাঁড়িয়ে, একটি দীপ্তিময় হাসি তার মুখে আলোকিত করে সকলের দিকে একবার তাকাল সায়নী।
“সম্মানিত প্রধান শিক্ষক, আমার অতি শ্রদ্ধেয় শিক্ষকমন্ডলী, সম্মানিত অতিথি এবং আমার প্রিয় সহপাঠীরা।“
“আজ আমি সত্যিই খুব আনন্দিত।
আমার এই আনন্দ শুধু আমার সাফল্যের জন্য নয়, তার পেছনে রয়েছে একজন কিশোরীর স্বপ্নপূরনের সাফল্য। আজ আমি যখন আপনাদের সকলের সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলার সুযোগ পেয়েছি, আমার বলতে দ্বিধা নেই যে আজ আমি সকলের কাছে কৃতজ্ঞ, আমাকে আমার স্বপ্নপূরনে সফল করে তোলার জন্য।
আমার মন আজ আবেগে ভরা যা আমার পক্ষে ভাষায় প্রকাশ করা সত্যিই একটি কঠিন কাজ। সেরা ছাত্র পুরস্কার জেতা শুধু আমার জন্য একাডেমিক কৃতিত্বের স্বীকৃতি নয়, এটি আমার জীবনে সেরা পাওয়া। যে জীবনকে নিয়ে দূর্ভাগ্যের গন্ডোলায় নানা ঘাত-প্রতিঘাতকে বুকে ধারন করে হেঁটে চলেছি সে জীবন চলার পথকে নিজের মনের মাধুরী দিয়ে বুকে ধারন করতে পারার এ যেন এক সত্যিকারের বৈধতা-আমার আত্মপরিচয়ের স্বীকৃতি। বেঁচে থাকার গর্বিত তিলক, শেষ পর্যন্ত বিজয়ে ভরা একটি যাত্রা।“
“আমি আজ সত্যিই আনন্দিত।
আপনারা যারা এখানে বসে আছেন, বিশেষ করে আমার শিক্ষক এবং প্রিয় সহপাঠিরা। একবার একটু ফিরে তাকান গত এক বছরের দিকে। একজন কিশোরীর কথা ভাবুন। একজন অটিস্টিক শিশু। ১২ বছরের একটি মেয়ে যার জগৎটা ছিল অন্যরকম, অনেকের কাছে যা অস্বাভাবিক, অসহ্যের। যে মেয়েটি প্রায়শই তার নিজের জগতে হারিয়ে যেত, ক্লাসরুমের কোলাহল এবং বিশৃঙ্খলার মধ্যে তার জায়গা খুঁজে পেতে লড়াই করতো, পিছনের চেয়ারে একা একা বসে থাকতো একাকীত্বের বেদনাকে পাষানে বেঁধে। যার কাছে মনে হত পৃথিবীর সবচেয়ে দরিদ্র সে। কেউ তাহার সাথে কথা বলত না, ক্লাশ পিড়িয়ডে খেলতে ডাকতো না। এমনকি অনেক শিক্ষকও কখনো ভালোবাসার দৃষ্টিতে সেই মেয়েটিকে ক্লাশে প্রশ্ন করতো না। ভাবত প্রশ্ন করে বাড়তি ঝামেলা নিয়ে লাভ কি? ক্লাশ পরীক্ষায় ভালো করত না বলে সহপাঠিরা ভাবত সেই মেয়েটি খারাপ ছাত্রী, এই স্কুলে পড়ার অযোগ্য। `মাথা খারাপ`, `পাগল মেয়ে`, `অসভ্য মেয়ে`, `অসুস্থ মেয়ে`,`বিশ্রী মেয়ে` কতো নামে না সেই মেয়েটিকে ডাকত, তিরস্কার করত, অবহেলার চোখে দেখত। তার কারন? কারন মেয়েটি ছিল একটু অন্যরকম। কোলাহল তার অপছন্দের। একা একা থাকত, পোকা-মাকড়ের সাথে খেলতে বেশী পছন্দ করত, সেই মেয়েটি কখনো কারো দিকে চেয়ে কথা বলত না, রাগ হলে তর্জনী ঘুরাতো, চোখ রক্ত জবা হয়ে যেত। আরেকটি দোষ ছিল মেয়েটির। প্রশ্ন করত বেশী। কারো সাথে কথা শুরু হলে অনবরত প্রশ্ন করে যেত। যা অনেকে পছন্দ করত না। তাই সব সময় মেয়েটিকে এড়িয়ে চলত। একাকীত্ব এবং প্রিয়জনদের সহানুভূতি না পাওয়ার অনুভূতি যে কতো বিষাদের তা সেই মেয়েটি জেনেছে প্রতিটি মুহূর্তে। এইটাই হয়তো জীবনের সবচেয়ে বড়ো দারিদ্রতা।
আজ আমি চীৎকার করে বলছি , সে মেয়েটি আমি। হ্যাঁ, আমি একজন অটিস্টিক।
তাই আমার জীবনটা একটু অন্যরকম। আমার কাছে পৃথিবীটা একটু আলাদা। কি ঘরে কিংবা স্কুলে বা কোন আত্মীয়ের বাসায় যখন বেড়াতে যেতাম আমি খুব নিঃসঙ্গ বোধ করতাম। আমার জীবনের বেশিরভাগ সময়, একজন বহিরাগতের মতো অনুভব করেছি। আমি এমন একজন ছিলাম যে বিশ্বটাকে দেখেছে অন্য চোখে, অন্য দৃষ্টিতে। যে বিশ্বের বাকি অংশের সাথে পুরোপুরি খাপ খাইয়ে নিতে পারত না। আর তাই সব জায়গায় আমি ছিলাম অবাঞ্চিত।
চলার পথে আমি অনেক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছি। তা সত্ত্বেও, আমি একটি অমলিন স্বপ্নকে বুকে ধরে রেখেছিলাম, লালন করেছিলাম এবং মনে-প্রানে বিশ্বাস করেছিলাম যে একদিন আমার এই স্বপ্নটা পূরন হবে। একদিন আমার মনের আকাশেও জেগে উঠবে সোনালী সূর্য। নরম রোদের সোনালী আলোয় উৎপল হবে আমার কিশোরী প্রান। একদিন সবাই আমাকে ভালোবেসে বুকে টেনে নেবে। আমাকে আমার মতো করে বাঁচতে উৎসাহিত করবে। আমাকে, আমার দুঃখকে, আমার ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখা পৃথিবীটাকে আপন করে নেবে অমলিন বিশ্বাসে পরম মমতায়। এইটাই ছিল আমার স্বপ্ন।
এই স্বপ্নটাকে ধরে রাখা সহজ ছিল না। আমার সহপাঠিরা কেউ আমাকে ভালো চোখে দেখত না। এক দাদীমা ছাড়া বাড়ীতেও আমি ছিলাম বড্ডো একা। আমার বন্ধু হয়ে উঠে আমার বাবার দেয়া উপহার আফ্রিকার তোতা পাখি। আমার প্রিয় বন্ধু সুইটি। তোতা পাখির এই নামটি আমিই দিয়েছিলাম। কখনো কখনো এমন সময় ছিল যখন মনে হয়েছিল যে পৃথিবীর সমস্ত ওজন আমার উপর পিষে যাচ্ছে, আমার মধ্যে আশার সেই ভঙ্গুর স্ফুলিঙ্গকে ছিঁড়ে ফেলার হুমকি দিচ্ছে। দিশেহারা হয়ে উঠতো আমার সমস্ত মন-প্রান। একা একা চুপি চুপি কতো কেঁদেছি আমি। কিন্তু কাউকে বুঝতে দেই নি। বুকের ভেতরে সমস্ত দুঃখ-কষ্টকে চেপে রেখেছি। কোন শিক্ষক যখন বলতো “তুই একটা গর্দভ, মাথায় গোবর ছড়া কিছুই নেই।“ আমার বুকের ভেতরটা তখন হুহু করে উঠতো। কিছুই বলতে পারতাম না। পাছে আরো বকাবাদ্য শুনতে হয়।
কিন্তু আমি হেরে যেতে চাই নি। দূর্বল হতে চাই নি। মনকে শক্ত করে চারিপাশের সব কিছুকেই গ্রহন করতে শিখলাম। আমি পড়াশোনায় মনোযোগী হলাম। বই, পোকা-মাকড় এবং সংখ্যার জগতে সান্ত্বনা খুঁজে পেয়েছি। সব কাজে আমার হৃদয় এবং আত্মাকে ঢেলে দিয়েছিলাম। নিজেকে এবং অন্যদের কাছে প্রমাণ করার জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলাম। যে কথা প্রতিবাদ করে আমি বলতে পারিনি যে “না আমি অসুস্থ নই, আমি পাগল নই, আমি অযোগ্য নই, আমি তোমাদের মতোই স্বাভাবিক”, আজ সে কথাই বলছি, আমি পেরেছি। আমিও মহত্বের ভাগিদার। অটিজম কোন ঘৃনার নয়, অটিস্টিক শিশুরা একটু অন্য রকম, অন্যরকম ওদের দৃষ্টি, তাই পৃথিবীটাকে ওরা একটু অন্যভাবে দেখে। ওদের মনও বেদনায় হাহাকার করে উঠে, দুঃখে প্রান বিচলিত হয়ে উঠে, অবহেলা আর বঞ্চনার রুদ্ররোষে মরুভূমির তপ্ত দাহে পোড়া বালুকনার মতো চুপষে যায়। বাসন্তী বাতাসে সামুদ্রীক ঢেউয়ের মতো মনের আকাশে বলাকারা পত পত করে নাচতে থাকে। তাই অবহেলা নয়, ভালোবাসা দিয়ে একজন অটিস্টিক শিশুকে বুকে টেনে নিতে হয়।
আমার জীবনেও অলৌকিক কিছু ঘটতে শুরু করে। একটু একটু করে, আমি সেই দেয়ালগুলো ভেঙে ফেলতে শুরু করলাম যা আমাকে আমার সহপাঠীদের থেকে আলাদা করে রাখতো। আমিও ধীরে ধীরে অন্যদের সাথে মিশতে শুরু করলাম যারা আমার অপরিচিত আগ্রহগুলিকে আপন করে নিয়েছে, বন্ধুত্ব তৈরি করেছে যা আমি কখনই ভাবিনি। যে মুহূর্তে আমি নিজেকে বিশ্বের কাছে উন্মুক্ত করে দিলাম ঠিক সেই মুহূর্ত থেকেই বিশ্বটা আমার কাছে খুলতে শুরু করেছে।
আজ, আমি আপনাদের সকলের সামনে সেই হারিয়ে যাওয়া, অস্বাভাবিক, অন্যরকম এবং একাকী মেয়ে হিসাবে নয়, বরং এমন একজন হিসাবে দাঁড়িয়ে আছি যে তার সমবয়সীদের মতোই প্রিয় এবং গ্রহণযোগ্য। সহপাঠিরা যাকে খুব ভালোবসে। যার মা আদর করে বুকে জড়িয়ে ধরে। মেয়েকে গুনগুন করে গাইতে দেখে হারমোনিয়াম কিনে দেয়। গানের শিক্ষক রেখে দেয়। আমার এই ভালোলাগার-ভালোবাসার অনুভূতিগুলি আমি যে পর্যাপ্ত ভাবে শব্দে প্রকাশ করতে পারছি না। আজ গ্রহণযোগ্যতার উষ্ণতা, আর আত্মীয়তার আনন্দে পূর্ন আমার পৃথিবী। এই ভালোবাসার প্রাঞ্জল অনুভূতিকে বুকে ধারন করে আমি এগুতে চাই। আমি আমার বাকি দিনগুলোকে লালন করতে চাই ভালোবাসার ছোঁয়ায়।“
“আমার শিক্ষকদের কাছে আমি কৃতজ্ঞতার ঋণে আবদ্ধ।
মিস রিমা, তুমি আমাকে তোমার ভালবাসা দিয়ে আপন করে নিয়েছ, আমাকে অনুপ্রেরনা দিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়ার শক্তি যুগিয়েছ। তোমার ঋন আমি কখনই শোধ করতে পারব না। তুমি আমার মধ্যে এমন কিছু দেখেছিলে যা অন্যরা কখনোই দেখতে পায়নি, বুঝতে চায়নি। সব সময় উপেক্ষা করে গেছে। কিন্তু একমাত্র তুমিই সম্ভাবনার সেই স্ফুলিঙ্গটিকে লালন করেছিলে যতক্ষণ না এটি একটি পূর্ণাঙ্গ আগুনে জ্বলে ওঠে। তুমি এবং ম্যাথস স্যার আমাকে বিশ্বাস করেছিলে, আপন করে নিয়েছিলে এবং আমার ভেতরকার সম্ভাবনাকে বুঝতে পেরেছিলে। অথচ আমি নিজেও নিজেকে বিশ্বাস করার জন্য প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করেছি, কিন্তু পারিনি। আমি চিরকাল কৃতজ্ঞ থাকব তোমাদের এই বিশ্বাস আর ভালোবাসার জন্য।
আমার সহপাঠীদেরকে আমার কৃতজ্ঞতা জানাই। তোমাদের ভালোবাসার জন্য, আমাকে তোমাদের একজন হিসেবে গ্রহন করার জন্য, আমার দৃষ্টিকে আলিঙ্গন করার জন্য ধন্যবাদ।
তোমার কথা কখনো ভুলবনা তিতলি। আমাকে হাত ধরে সামনে এগিয়ে যাওয়ার জন্য। যেদিন তুমি দুহাত বাড়িয়ে গলা ধরে আমাকে আলিঙ্গন করেছিলে সেদিন খুশিতে আমার চোখে জল এসে যায়। তুমিই শিখিয়েছিলে যে ভালবাসা এবং গ্রহণযোগ্যতা কেবল তাড়া করার স্বপ্ন নয়, তাকে ভালোবাসা দিয়ে লালন করতে হয়। হৃদয়ে ধারন করতে হয়। তোমার কথা আমি কখনো ভুলবনা।“
“আর শান্তনুর কথা না বললে যে বড়ো অপরাধ হয়ে যাবে। আজ যে আমি এখানে দাঁড়িয়ে কিছু বলছি, স্বপ্ন পূরনের গল্প শেয়ার করছি এইটা তার জন্যই সম্ভব হয়েছে। একাকীত্বকে সঙ্গী করে ক্লাশ রুমের সবচেয়ে পেছনের টেবিলে বসে বসে যখন জানালার পাশ দিয়ে নীলাকাশের বুকে হারিয়ে যেতাম ঠিক তখনই একদিন তুমি এসে পরম মমতায় আমার পাশে বসলে। হাত বাড়িয়ে বলেছিলে-“আমি শান্তনু, তুমি আমার বন্ধু হবে?“ সেদিন থেকেই আমি অন্যরকম হয়ে গেলাম। তুমিই আমাকে সবচেয়ে বেশী অনুপ্ররনা দিয়েছে। বুঝার চেষ্টা করেছ, আমার সম্ভাবনাকে নতুন করে আবিস্কার করতে আমাকে উৎসাহ দিয়েছিলে। তোমার এই অমলিন বিশ্বাসকে আমি বুকে ধারন করে ধীরে ধীরে নতুন করে চলতে শিখেছি। তোমাকে ধন্যবাদ শান্তনু। কেমন করে যে তোমরা আমার এমন আপন হয়ে গেলে আমি বুঝতেই পারলাম না। “
“আজ, আমি আপনাদের সকলের সামনে দাঁড়িয়ে আছি, শুধু অটিজমে আক্রান্ত শিশু হিসেবে নয়, ভালোবাসা এবং কৃতজ্ঞতার পাত্র হিসেবে। আমার পিতামাতা আমার স্বপ্ন পূরনের সাথে গভীর বন্ধনে আবদ্ধ।
আমার জীবনে, আমার মা, বাবা এবং দাদীমা হল প্রাণবন্ত সুতো যা বুনে উষ্ণতা, আরাম এবং অটল সমর্থন। তারা আমার সফলতার স্থপতি, আমার স্বপ্নের অভিভাবক এবং নিঃশর্ত ভালবাসার বাহক। আমার প্রিয় মা, যার মৃদু স্পর্শ আমার আত্মাকে প্রশান্তি দেয়, যার সুরেলা কণ্ঠ আমাকে জীবনের সোনালী আলোর পথ দেখায়, যার ঘুম পাড়ানিয়ার গানে আমি শুনি পৃথিবীর শ্রেষ্ট গানের ব্যাঞ্জনা, সেই মার কাছে আমি চিরকাল ঋণী। তার আলিঙ্গনে, আমি সান্ত্বনা খুঁজে পাই, তার হাসিতে, আমি আনন্দ খুঁজে পাই, এবং তার চোখে আমি সীমাহীন ভালবাসার প্রতিফলন দেখতে পাই। আমার বাবা আমার জীবনের সবচেয়ে পরম বন্ধু। নানা ব্যাস্ততার মধ্যেও আমার জন্য নতুন কোন খেলনা বা টয় গাড়ী আনতে ভুলতেন না। আমার প্রিয় বাবার দেয়া একটি প্রিয় উপহার আমার সুইটি। আর আমার প্রিয় দাদীমা, যাঁর শক্তি আমার নোঙ্গর, যাঁর প্রজ্ঞা আমার কম্পাস, যার ঠাকুর মার ঝুলি আমার কল্পনায় হারিয়ে যাওয়ার প্রেরনা। আমি অশেষ কৃতজ্ঞ। তার কোমল উৎসাহ আমার আকাঙ্খাকে জ্বালাতন করে, তার ধৈর্যশীল দিকনির্দেশনা আমার পথকে আলোকিত করে, এবং তার উপস্থিতিতে আমি বিশ্বের মুখোমুখি হওয়ার সাহস পাই। থ্যাংকিউ দাদীমা।“
“আমার পরিবার আমার অস্তিত্বের স্তম্ভ। তাদের ভালবাসা কোন সীমা জানে না। ভাষা অতিক্রম করে, বাধা অতিক্রম করে, এবং আমাকে তার অসীম আলিঙ্গনে আলিঙ্গন করে।“
“তাই, আমি আজ আপনাদের সামনে দাঁড়িয়ে আছি, শুধু অটিজমে আক্রান্ত শিশু হিসেবে নয়, ভালোবাসার শক্তি, গ্রহণযোগ্যতার সৌন্দর্য এবং পরিবারের শক্তির প্রমাণ হিসেবে। কারণ তাদের ভালবাসায়, আমি আমার কণ্ঠস্বর, আমার উদ্দেশ্য এবং আমার সর্বশ্রেষ্ঠ আশীর্বাদ খুঁজে পাই।“
“ধন্যবাদ, মা, বাবা, তমাল এবং দাদীমা, আমার সবকিছু হওয়ার জন্য। আমি তোমাদেরকে খুব ভালোবাসি।“
“আজ আমি সত্যিই আনন্দিত।
এই সুন্দর পৃথিবীতে যে শিশুরা একাকীত্ব বোধ করে,যারা অটিস্টিক কিংবা পঙ্গুত্বের যন্ত্রনাকে বুকে ধরে আছে, যারা ভাবছে যে তারা পৃথিবীতে তাদের স্থান খুঁজে পাবে কিনা, আমি তাদের জন্য আজ চীৎকার করে বলতে চাই: “তোমরা স্বপ্ন দেখতে থাক, তোমাদের স্বপ্নগুলোকে ধরে রাখ। নিজেকে বিশ্বাস কর, এমনকি যখন মনে হয় পৃথিবীটা তোমাদের বিরুদ্ধে। কারণ আমি যদি আজ তোমাদের সামনে দাঁড়াতে পারি, তাহলে তোমরাও পারবে।“
কিশোরী অটিস্টিক মেয়েটি যখন তার সহপাঠীদের সামনে দাঁড়িয়ে তার স্বপ্নের কথাগুলি বলছিল, তার কণ্ঠ তখন আবেগে কাঁপছিল। সায়নী আবেগ জড়িত কন্ঠে জীবনের সেই মুহুর্তগুলি বর্ণনা করতে থাকে। বলতে থাকে কেমন করে স্বপ্নগুলি এক সময় তার জীবনরেখা হয়ে ওঠে। সে বলে চলছে তার জেগে- শুয়ে কাটানো অগণিত রাতের কথা। তার কান্নার কথা,একাকীত্বের যন্ত্রনার কথা, প্রিয়জনের সহানুভূতি না পাওয়ার অনুভূতির কথা। কিন্তু তারপরেও অন্ধকারের সেই মুহুর্তগুলিতে, সে তার স্বপ্নকে আলোর বাতিঘরের মতো আঁকড়ে ধরেছিল, যা তাকে ঝড়ের মধ্য দিয়ে পথ দেখিয়েছিল। তার কণ্ঠে কাঁপুনির আভাস ফুটে উঠছে, চোখ ঝাপসা হয়ে উঠছে, তারপরেও বলে চলছে কীভাবে সেই স্বপ্নগুলি তার শক্তির উত্স হয়ে ওঠে। বিশ্ব যখন তাকে ভেঙে ফেলতে চেয়েছিল তখন কিভাবে ভালোবাসার উষ্ণতায় সে ধীরে ধীরে জেগে উঠে।
তার প্রতিটি শব্দে ছিলো তার অভিজ্ঞতার সাবলীল বর্ননা। বাতাসের স্থিরতায় তার আবেগের প্রকাশ ছিল স্পষ্ট। পুরো হল রুমে তখন এক গভীর নিস্তব্ধতা। তার সহপাঠীরা মনোযোগ সহকারে শুনছিল সায়নীকে। তাদের হৃদয় গর্বে ফুলে উঠছিল, কারো কারো চোখ ছল ছল করছিল। সেই শান্ত মুহুর্তগুলিতে হলের সকলে তার অটল সাহস এবং দৃঢ়তায় মুগ্ধ হয়ে যায়। শ্বাসের গতি কমে যায় অনেকের আবার কেউ কেউ যেন তাদের শ্বাস আটকে রেখেছিল ।
যখন সায়নী তার স্বপ্নের কাহিনীতে রেশ টানে তখন তার কণ্ঠ কাঁপছিল কিন্তু অবয়বে দৃঢ় প্রতিজ্ঞতার চিহ্ন।
সারা হলে একটি শুকনো চোখও ছিল না, কেউ কেউ ডুকরে কেঁদে উঠছিল, কেউবা হাতে চোখ মুছছিল। সেই মুহুর্তে,সকলেই বুঝতে পেরেছিল যে সায়নীর স্বপ্নগুলি কেবল ক্ষণস্থায়ী আকাঙ্ক্ষা নয়, একটি আশার শক্তিশালী আলোকসজ্জা যা এমনকি অন্ধকারতম রাতগুলিকেও আলোকিত করতে পারে। হঠাৎ করেই বজ্র করতালিতে মুখরিত হয়ে উঠে সারা হলরুমটি। সায়নীর মা দৌড়ে এসে স্টেজে উঠে সায়নীকে জড়িয়ে ধরে। তিতলি, শান্তনু সহ সব সহপাঠিরা সায়নীর সামনে এসে ভীড় জমায়, তিতলি কাঁদতে কাঁদতে সায়নীকে বুকে টেনে নেয়-“আমি সরি সায়নী! তুমি আমাদের সবচেয়ে ভালো বন্ধু।“
একটি অল্পবয়সী কিশোরী মেয়ের স্বপ্নের কথা শুনে সকলে বিস্মিত। সকলেই দাঁড়িয়ে যায়।
তখনো তিতলি সায়নীকে বুকে ধরে রেখেছে।
অশ্রুভেজা সায়নীর চোখ তখন সামনে দাঁড়ানো শান্তনুর দিকে স্থির হয়ে থাকে।
হাতের তালুতে ভেজা চোখ মুছছিলো শান্তনু তখন। সাড়া অবয়বে ছিল আনন্দের ঝলকানি।
হঠাৎ প্রধান শিক্ষের কন্ঠ কানে ভেসে এলো-
“সাব্বাস সায়নী! তুমি আমাদের গর্ব, এই স্কুলের গর্ব, আমাদের সমাজের গর্ব। তুমি প্রমান করে দিলে, অটিজম কোনো ট্র্যাজেডি নয়, অজ্ঞতা একটি ট্র্যাজেডি; অটিজম একটি অক্ষমতা নয়, এটি একটি ভিন্ন ক্ষমতা;অটিজম একটি অভিশাপ নয়, এটি চিন্তাভাবনা এবং অনুভূতির একটি ভিন্ন উপায়। তাই আমি সবাইকে বলবো অটিস্টিক শিশুদের ঘৃনা নয়, ভালোবাসার চোখে দেখবেন।“
মুহুর্মুহু করতালীর আওয়াজ হলরুম ছাড়িয়ে যেন বাহিরেও পোঁছে যায়। এক দল পাখি পত পত করে উড়ে যায় দূরে।
(শেষ)
Read full book here: Click here to download the PDF file