সায়নীর স্বপ্ন-১৪
Summary:
দিন বদলের পালা শুরু হয়ে গেছে।
আজ স্কুলের ঘটনায় সায়নী অবাক। শান্তনু সত্যিই ওকে খুব ভালোবাসে। তিতলিকে কি সুন্দর করে ধৈর্য ধরে এত সব বুঝিয়েছে। তিতলিও তার ভুল বুঝতে পেরেছে। সায়নীকে কেমন করে আলিঙ্গন করল।
হঠাৎ করেই সায়নীর জীবনে যেন এক নতুন পরিবর্তন শুরু হয়। সব কিছুতেই কেমন ভাল লাগছে। মনে সবসময় একটা খুশির ভাব। আকাশটাকে কি সুন্দর মনে হচ্ছে। সাদা বলাকারা দিগন্তে পত পত করে উড়ে গেলে মনে দোলা লাগে। চারিপাশের সবকিছুই যেন এক নতুন পরশ বুলিয়ে দিচ্ছে সায়নীর জীবনে।
পুরনো ঢাকার এই ঘিঞ্জি এলাকার মধ্যে সায়নীর এলো মেলো জীবনে যেন বিশৃঙ্খল স্বপ্নের নির্মলতার দেখা মিলল। সায়নীর জীবনের এক নতুন অধ্যায় ধীরে ধীরে উন্মোচিত হতে থাকে। মিস রিমা হলেন সেই পরিবর্তনের অনুঘটক। সায়নী এবং তার সহপাঠীদের জন্য যেন আলোর দিশারি, পথনির্দেশক এবং উৎপলতার সাথে বেঁচে থাকার নির্ভরতা। প্রতিটি ক্লাসেই তিনি কিছু না কিছু নতুনত্ব নিয়ে এসেছেন। সবাইকে খুব ভাল বাসেন। ক্লাসে মনোযোগ দিয়ে পড়ান। যত্ন করে বুঝিয়ে দেন বার বার যদি কেউ না বুঝে। নানা ধরনের গল্প শোনান নৈতিক শিক্ষার জন্য। গত ক্লাসের গল্পটিই সায়নীর জীবনে যেন এক নতুন পরিবর্তন নিয়ে এসেছে। তিতলিও এখন সায়নীর প্রিয় বন্ধু। দুহাত দিয়ে গলা জড়িয়ে ধরার অনুভূতিটি সায়নী সাড়া জীবন মনে রাখবে। জীবনে এমন পাওয়া সত্যি দুর্লভ। চোখে জল এসে গেছিলো সায়নীর। শান্তনুর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানানোর ভাষা নেই। কিশোরী মনের আকাশটা যেন অস্তগামী লাল সূর্যের আভায় রাঙিয়ে আছে।
একদিন, এক বর্ষার দিনে বাহিরে যখন মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছিল, গাছের পাতারা বাতাসে এলোমেলো হেলে দোলে উড়ে যাচ্ছিল, পাখিরা ঘরে ফেরায় ব্যস্ত, তখন সায়নী ক্লাসের জানালা দিয়ে বাইরে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বৃষ্টি পড়ার ছন্দে ছিল বিভোর। এমন সময় মিস রিমা ক্লাসে এসে ঢুকলেন। বরাবরের মতো মুখে একটি কোমল হাসি। ক্লাশে ঢুকেই সবাইকে জিজ্ঞেস করবে কেমন আছে সবাই। কেমন কাটলো গত কয়েক দিন। কারো মন খারাপ দেখলে কাছে এসে খুব আস্তে করে শুধাবে-তোমার কি খুব মন খারাপ? কেন খারাপ আমাকে বলতে পার।
বরাবরের মতো সেদিনও তিনি খুব সুন্দর একটা সৃজনশীল একটিভটি দিয়ে ক্লাস শুরু করেছিলেন যা শিক্ষার্থীদের আরও কাছে নিয়ে আসে। ভালবাসার বন্ধনে আবদ্ধ করে এবং একে অপকে বুঝার, জানার-চেনার আগ্রহ বাড়ায়। মিস রিমা প্রতিটি শিক্ষার্থীকে একটি ব্যক্তিগত গল্প অন্যের সাথে শেয়ার করার জন্য বলেন। এতে সবাই খুব খুশী হয়। প্রতিটি শিক্ষার্থী তার বাঁদিকে বসা শিক্ষার্থীর সাথে গল্পটি শেয়ার করতে হবে। সায়নীর বা দিকে ছিল শান্তনু।
প্রাথমিকভাবে একটু দ্বিধা হচ্ছিলো সায়নীর। কিন্তু প্রাণবন্ত মনের মধ্যে বিদ্যমান বিশ্বকে প্রকাশ করার এই সুযোগটি বেশ খুশি-মনে গ্রহণ করেছিল সায়নী।
মিস রিমা সায়নী-শান্তনুকে তাদের গল্পগুলি শেয়ার করতে প্রথমে বললেন। সায়নী শুরু করল প্রথম। দৃষ্টি ছিল অন্যদিকে। তার স্বপ্নের কথা দিয়ে বলা শুরু করল সায়নী। তার কথায় ছিল বেশ আন্তরিকতা এবং বেদনার প্রকাশ। সাথে সাথে তার কথার আন্তরিকতায় রুমটি নীরব হয়ে পড়ে। সায়নীর সহপাঠীরা, যারা তাকে একসময় খারাপ ভাবত, রহস্য হিসেবে দেখত, কথা বলত না, এমন কি একসাথে বসত না পর্যন্ত, এখন সায়নীর কথা শুনে নিজেদের স্বপ্নের মতোই আকাঙ্খা ও আনন্দ নিয়ে একজন সহপাঠীকে উপলব্ধি করছে। এ যেন চমৎকার একটি মুহূর্ত, একটি টার্নিং পয়েন্ট এবং একে অপরকে বোঝার এক সন্ধিক্ষণ যা শ্রেণীকক্ষের গতিশীলতাকে বদলে দিয়েছে এক মুহূর্তে। পুরো ক্লাস রুমে নেমে আসে পিন পতনের শব্দহীন নীরবতা। অনেকের চোখ ছল ছল করছিল। কারো বেদনায় ঠোঁট কেঁপে উঠছিল।
বলতে বলতে সায়নীও কেমন একটু অন্য রকন হয়ে যায়। গলা ভারী হয়ে আসছিল। চোখ দুইটি কেমন ছল ছল করে উঠছিল। সায়নী সপ্নের কথা শুনে সকলের মাঝে এক অন্যরকম সহানুভূতি বসন্তের প্রথম ফুলের মতো ফুটতে শুরু করে। সায়নীর সহপাঠীরা, তার সাহসে অনুপ্রাণিত হয়। চির চেনা পৃথিবীটাকে নতুন করে উপলব্ধি করতে থাকে। তারা বুঝতে পারল যে সায়নীর অনন্য দৃষ্টিভঙ্গি একটি বাধা নয় বরং সৃজনশীলতা এবং কল্পনার জগতে নিজকে প্রকাশিত করার একটি উত্তম উপায়।
এক নতুন উপলব্ধির ঢেউ যেন বয়ে গেল শ্রেণীকক্ষের ভিতরে যা বাইরেও প্রসারিত হয়। সায়নীর সহপাঠীরা সায়নীর আরও কাছে আসতে থাকে। একসময়ের দূরে থাকার সহপাঠীরা মিত্র হয়ে ওঠে। ভালবাসার সিঁড়ি বেয়ে হাতে হাত ধরে সকলে একসাথে উপরে উঠতে থাকে। আনন্দে উৎপল সকলের মন-প্রাণ। বিশেষ করে সায়নীর।
এক নতুন বাস্তবতাকে সামনে রেখে সায়নী তার গল্প বলা শেষ করল।
সাথে সাথে সকলে করতালিতে মুখর হয়ে উঠল ক্লাশ রুমটি। আশে পাশের সবাই দৌড়ে এসে সায়নীকে জড়িয়ে ধরে। শান্তনুর চোখ কিছুক্ষন স্থির হয়ে ছিল সায়নীর দিকে। মনে মনে কি যেন ভাবছিল-“তুমি সত্যিই সুন্দর, সায়নী। তুমি উজ্জ্বল নক্ষত্রের মত। তোমার চোখ যেন অলকানন্দার জলে ভাসা স্বচ্ছ পদ্মের দোলা। কী অনবদ্য তোমার কথামালা। কী সুন্দর এবং অবলীলায় তুমি তোমার সপ্নের কথা বলে গেলে।“
সায়নীও বিশ্বাস করতে পারেনি সে আজ প্রথমবারের মতো সকলের সাথে তার নিজের স্বপ্নের কথা শেয়ার করতে পেরেছে। এমনটি আগে কল্পনাও করতে পারেনি। আজ মিস রিমা ম্যাডামের জন্য সম্ভব হয়েছে। কৃতজ্ঞতার দৃষ্টিতে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ম্যাডামের দিকে চোখ তোলে তাকালো সায়নী। খুব আস্তে করে অস্ফুট সুরে মুখ থেকে বেড়িয়ে এলো -থ্যাংকিও ম্যাডাম।
মিস রিমাও মুখে সুন্দর একটি হাসি ফুটিয়ে অব্যাক্ত ভাষায় চোখের পাতা নেড়ে সায়নীকে প্রশংসা করলো।
এই রূপান্তরের মাঝে সায়নী একটি ক্রমবর্ধমান সংযোগের উষ্ণতা অনুভব করলো।
যে স্বপ্নটিকে সে তার হৃদয়ে এতদিন আগলে ধরে রেখেছিল, তা যেন বাস্তবের আরও কাছাকাছি বলে মনে হতে লাগল। সে ভাবতেও পারেনি যে একদিন নিজের ভিতরে লুকিয়ে থাকা আলোর রশ্মিটি ভালোবাসার পথকে এমনভাবে আলোকিত করবে। বোঝাপড়ার ভিত্তি স্থাপন এবং সহানুভূতির বীজ রোপণের সাথে সাথে সায়নীর পৃথিবী বন্ধুত্বের একটি প্রাণবন্ত বাগানে রূপান্তরিত হতে শুরু করে। যে শ্রেণীকক্ষ একসময় একাকীত্ব আর অনিশ্চয়তায় ছিল পূর্ন, এখন সেখানে বইছে হাসি আর আনন্দের ফোয়ারা।
আজ মিস রিমা শিক্ষার্থীদের মধ্যে এক নতুন ঐক্যের বোধ জাগিয়ে তুললেন। সকলের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ, টিমওয়ার্ক এবং পারস্পরিক সমর্থনে আজকের গল্প শেয়ার করার আয়োজনটি ছিল চমৎকার।
সায়নী নতুন করে আজকের এই ক্লাশের উপকণ্ঠে নিজেকে সকলের মধ্যে আবিস্কার করতে পেরে নিজকে খুব ধন্য মনে করছে। সায়নীর সহপাঠীরা সহযোগিতার এক পরম আনন্দ আবিষ্কার করেছিল আজকের ক্লাশে। বুঝতে পেরেছিল যে প্রত্যেকের মধ্যেই একটি অনন্য শক্তি রয়েছে যা সমগ্র সৌন্দর্যকে ছাপিয়ে যায়।
সেইদিন থেকে সায়নীর সহপাঠীরা সব সময় খেলাধুলায় তাদের সাথে যোগ দেওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানায়। যে বাধাগুলি তাকে একসময় সায়নীকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছিল সকলের কাছ থেকে, সেগুলি যেন ধীরে ধীরে চলে যেতে শুরু করে। হাসি এবং বন্ধুত্বের বন্ধন যেন সকলের মধ্যে প্রতিধ্বনিত হতে শুরু করে, গ্রহণের সুর অনুরণিত হতে থাকে সকলের মনে-প্রানে।
সায়নীর জন্য এ যেন এক বিশেষ পাওয়া। যে স্বপ্নটি একসময় তার কাছে অধরা মনে হয়েছিল তা এখন বাস্তবে অনুভূত হচ্ছে। তার সহপাঠীদের থেকে তাকে আলাদা করা দেয়ালগুলি পুরোপুরি ভেঙে যেতে শুরু করেছে। একসময় দ্বিধাগ্রস্ত ছাত্ররা এখন ঐক্যবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়েছে তার পাশে। তাদের মতপার্থক্য শুধু গ্রহণই করেনি, বরং সানন্দে উদযাপনও করেছে। তাদের অনেকেই জানতও না যে বন্ধুত্বের এই বন্ধনটি এমন একটি যাত্রার সূচনা করবে যা হবে বৈচিত্র্য পুর্ন এবং আনন্দঘন।
এমন একটি ক্লাশ উপহার দেওয়ার জন্য মিস রিমাকে সকলে ধন্যবাদ দেয়। সকলের মনে যেন এক নতুন দিগন্তের বাতাস বইতে শুরু করল। সায়নীর একাকিত্বের জীবনে নেমে এলো এক সুন্দরের পরাগ, উচ্ছ্বাসের ঝংকার আর অমলিন সুখ।
ঋতু পরিবর্তনের সাথে সাথে এগিয়ে চলছে সময়। সায়নীর জীবন বিকশিত হতে থাকে গ্রহণযোগ্যতার একটি সুরেলা সিম্ফনির সাথে। কি ঘরে, কি স্কুলে, স্কুলের করিডোরে, চারিপাশে যেন ভালবাসা আর বন্ধুত্বের বলাকারা পেখম মেলেছে।
মিস রিমাকে সবাই খুব ভাল বাসে। প্রতিটি শিক্ষার্থীর প্রতিভাকে তুলে ধরার জন্য শ্রেণীকক্ষের মধ্যে নানা ধরনের ক্লাশ এক্টিভিটি নিয়ে আসেন মিস রিমা। সবার মধ্যে ভালবাসার সংযোগ স্থাপনের জন্য নানাভাবে চেষ্টা করেন। মিস রিমা স্কুলে আসার পর থেকে এক নতুন পরিবর্তনের ছোঁয়া লেগেছে সব খানে, সবার মনে-প্রানে, চিন্তা-চেতনায় আর ভাবনায়, চলনে-বলনে আর চাহনিতে।
এবার মিস রিমা নিয়ে এসেছেন আরেকটি নতুন আইডিয়া। সবাই সেটাকেও লুফে নিয়েছে।
ক্লাশ শেষ করার আগে মিস রিমা ঘোষনা করলেন-আমরা এখন আরেকটি নতুন প্রকল্প শুরু করব খুব তাড়াতাড়ি। সেই প্রকল্পের নাম হবে- “এ সেলিব্রেশন অফ ডিফারেন্স.”
সকলেই মিস রিমার দিকে হা করে তাকিয়ে থাকে। বাপারটা যেন বোধগম্য হলো না। তিতলি কিছুক্ষন পরে বিস্ময়ের সাথে জিজ্ঞেস করল- এ সেলিব্রেশন অফ ডিফারেন্স? এখানে কি করবো মিস রিমা?
মিস রিমাঃ ডোন্ট অরি। আমি সব বুঝিয়ে বলছি
এই বলে মিস রিমা বলা শুরু করলেন
আমরা একটা জমকালো উদযাপনের আয়োজন করবো। একটি অসাধারণ অনুষ্ঠান যা তোমাদের প্রত্যেকের মধ্যে লুকিয়ে থাকা অনন্য প্রতিভাগুলিকে তুলে ধরবে, যেখানে তোমরা তোমাদের নিজের প্রতিভাকে প্রকাশ করবে এবং সবার সাথে শেয়ার করবে। যেদিন অনুষ্টানটা হবে সেদিন স্কুলের সকল শিক্ষক, শিক্ষার্থী এবং তোমাদের গার্জিয়ানদেরকেও আমন্ত্রন করা হবে। সেদিন কোন ক্লাশ হবে না। প্রতিটি শিক্ষার্থী এই জমকাল সেলিব্রেশন অফ ডিফারেন্স-এ অংশগ্রহন করবে। স্কুলের প্রধান হল রুমে প্রোগ্রামটির আয়োজন করা হবে। এখন বল আইডিয়াটা কেমন?
সাথে সাথে সবাই করতালিতে বলে উঠল-খুব ভাল হবে মিস রিমা। আমরা খুব খুশি হব যদি আপনি এইটা করেন।
মিস রিমাঃ ঠিক আছে, ঠিক আছে। তবে পুরো প্রোগ্রামটাই করবে তোমরা। আইডিয়াটা শুধু আমার। প্রোগ্রামটির শিরোনাম হবে "এ সেলিব্রেশন অফ ডিফারেন্স।" এখন থেকেই আমাদের একসাথে কাজ করতে হবে। অনেক প্রস্তুতি নিতে হবে। আমদের প্রধান উদ্দেশ্য হলো— “বৈচিত্র্যের মধ্যে সৌন্দর্যকে তুলে ধরা।“
নেক্সট ক্লাশে আমি সব বুঝিয়ে দেবো। আগামী মাসের প্রথম সপ্তাহে আমরা এর আয়োজনটা খুব ধুম ধামের সাথে করতে চাই। হাতে আর সময় বেশি নাই। তাই তোমরা এখন থেকেই চিন্তা করো কে কি করবে। একটু ভেবে দেখবে তোমাদের মধ্যে কোন প্রতিভাটা লুকিয়ে আছে । কোনটা করতে তোমরা সবচেয়ে বশি ভালোবোধ করবে ঠিক সেটাকেই প্রাধান্য দিবে।
নতুন এই প্রোগ্রামের কথা শুনে সায়নী বেশ উৎফুল্ল হলো। মনে মনে ভাবতে শুরু করল কি করবে। খুব আনন্দের সাথে সেদিন সবাই ক্লাশ শেষ করলো।
এখন সায়নী বেশ মনোযোগ ক্লাশের প্রতি। আগের মত আর দেরী করে না কোন কিছুর উত্তর দিতে। কেউ প্রশ্ন করলে তাড়াতাড়ি বুঝতে পারে। এখন হঠাৎ কেউ দেখলে বুঝতেও পারবেনা যে সায়নী একজন অটিস্টিক শিশু। সবকিছুতেই স্বাভাবিক ভাবে আচরণ করে। তবে যে জিনিসটা এখনও আছে সেটা হল কারো চোখে চোখ রেখে সবসময় কথা বলতে পারে না। প্রায়সময়ই অন্য দিকে চেয়ে থাকে। অনবরত প্রশ্ন করাটা এখনও আছে। তবে অনেকটা কম। এইতো কয়দিন আগে সায়নীরা একসাথে চাচার বাসায় বেড়াতে যায় উত্তরাতে। শুক্রবার দিন। চাচাতো বোনের জন্মদিন ছিল। সায়নীর চাচা সায়নীকে জিজ্ঞেস করে-হ্যালো সায়নী কেমন আছো?
সায়নী (কোন উত্তর না দিয়ে)-তুমি কেমন আছো চাচা?
চাচাঃ ভাল
সায়নীঃ তুমি কেন ভাল আছো চাচা?
চাচাঃ কারন তোমার বোনের আজ জন্মদিন। তাই।
সায়নীঃ তোমার জন্মদিন কবে?
চাচাঃ আমার জন্মদিন? চাচা একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে
সায়নীঃ হ্যাঁ, তোমার জন্মদিন হবে না?
চাচাঃ হবে। তবে সেটা আরও অনেক পরে।
সায়নীঃ তুমি জন্ম দিনে কি করবে?
চাচাঃ কিছুই করবনা? কেন তুমি চাও আমি কিছু একটা করি আমার জন্মদিনে?
সায়নীঃ তুমি বিদেশে যাবেনা জন্মদিন পালন করতে?
চাচাঃ কেন? জন্মদিন পালন করতে বুঝি বিদেশে যেতে হয়?
সায়নীঃ আমার এক বন্ধুর বাবা সবসময় বিদেশে যায় জন্মদিন পালন করতে। খুব মজা করে সেখানে। আমার বন্ধুও যায় সবসময় ওর বাবার সাথে।
চাচাঃ না আমি যাই না। আমরা ঘরে জন্মদিন পালন করি। তাহলে তোমরা সবাই আসতে পারো। এতে আরো বেশি মজা হয়, আনন্দ হয়। আমরা একসাথে কত কি করতে পারি। তাইনা?
সায়নীঃ তুমি লিলিকে কি কিনে দিয়েছ? (লিলি সায়নীর চাচাত বোন)
চাচাঃ তুমি না হয় লিলিকে জিজ্ঞেস কর
হঠাৎ সায়নীর দাদীর চোখ পরে সায়নীর দিকে। তাড়াতাড়ি এসে সায়নীকে নিয়ে যায়। সায়নীর দিকে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে বলতে থাকে-একি অসভ্যপনা সায়নী? একি করছো? বড়োদের সাথে এভাবে কথা বলতে হয় না। চুপ করে এখানে বসে থাক।
তারপর সায়নি আর বেশি কথা বলেনি সেদিন।
এখন সায়নী খুব মনোযোগ দিয়ে কাজ করছে। সুন্দর সুন্দর পেইন্টিং করছে স্কুল অনুষ্ঠানের জন্য।
একদিন দেখতে দেখতে সেই দিনটি “এ সেলিব্রেশন অফ ডিফারেন্স” এলো। পুরো স্কুল জোড়ে আনন্দের ঝলক আর উতসবের ফোয়ারা বয়ে গেল। চারিদিকে যেন হই চই আর খুশিতে সবাই মাতোয়ারা। সায়নীর সহপাঠীরা ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরে সেইদিন স্কুলে এসেছিল। বিশাল হল রুমের নানা বুথগুলিতে নিজের তৈরী জিনিসগুলি প্রদর্শন করার জন্য সকল শিক্ষার্থীরা সাঁজিয়ে রেখেছে। হলের একপাশে সাঁজানো হয়েছে নানা রকমের সুস্বাদু মুখরোচক খাবার। বাতাস ভরে উঠল বিচিত্র খাবারের মুগ্ধকর সুগন্ধে। আর হলের স্টেজে চলছে বিভিন্ন যন্ত্রের ধ্বনিতে মুখরিত সুরেলা গান বাদ্য।
সায়নী কয়েকটি পেইন্টিং এনে সাঁজিয়েছে। বেশ সুন্দর দেশীয় মার্জিত সালোয়ার কামিজ পরে আজ স্কুলে এসেছে। সুন্দর করে দাদিমা সায়নীর কালো চুলগুলোকে আঁচড়িয়ে আলগা ছেড়ে দিয়েছে। একপাশে রঙিন ফিতা দিয়ে বোনা। ঘন চুলগুলি পিঠের উপর দিয়ে বাতাসে হেলে দোলে নেচে উঠছে আর মাঝে মধ্যে এক অপূর্ব রেশমী ঢেউয়ের সৃষ্টি করছে। আজ যেন এক অনবদ্য সাঁজে সেঁজেছে সায়নী।
অভিভাবক, শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীরা বিস্ময়ের সাথে একে একে বুথগুলি ঘুরে ঘুরে দেখছে। এই প্রাণবন্ত প্রদর্শনীটিকে যেন সকলেই উপভোগ করছে। সায়নী আজ খুব আনন্দিত। উৎসবের মাঝখানে, সায়নী দেখতে পেল তার সকল স্কুল সহপাঠিরা, শিক্ষক ও অনেক অভিভাবকরা তার বুথের সামনে এসে খুব মনোযোগ দিয়ে সায়নীর পেইন্টিংসগুলো দেখছে। সকলেই সায়নীর কাজের প্রসংশা করছে আর সায়নীকে বাহবা দিচ্ছে। হঠাৎ শান্তনু এসে সায়নীকে একটা ছবি তোলার জন্য অনুরোধ করে। সায়নীতো ছবি তোলার কথা শুনে অবাক। তিতলি এসে ছবিটা তুলে দেয়।
একসময় "এ সেলিব্রেশন অফ ডিফারেন্স" সফল ভাবে শেষ হয়।
শেষ হওয়ার আগে মিস রিমা এসে ঘোষনা দিলেন যে বিচারক প্যানেল প্রতিটি আইটেম ভালোভাবে দেখবেন এবং প্রথম দশটিকে প্রথমে সর্টলিস্ট করবেন। সেখান থেকে বেস্ট তিনটিকে সিলেক্ট করা হবে। নাম ঘোষনা করা হবে ডিসেম্বরে বাৎসরিক পুরস্কার বিতরনী অনুষ্ঠানে।
আজকের এই উৎসবের দিনে সূর্য অস্ত যাওয়ার সাথে সাথে স্কুলের মাঠের উপর একটি উষ্ণ আভা ঢেলে সায়নী যেন তার অবিশ্বাস্য যাত্রার প্রতিফলন ঘটায়। যে স্বপ্নটি তার হৃদয়ে একদিন প্রস্ফুটিত হয়েছিলো তা যেন আজ গ্রহণযোগ্যতা আর ভালবাসার এক অপুর্ব ধ্বনিত সঙ্গীতে পরিণত হয়। স্কুলের করিডোর দিয়ে সেই সংগীত প্রতিধ্বনিত হয়ে ছড়িয়ে পরে চারিদিকে।
চলবে---)
Read full book here: Click here to download the PDF file