সায়নীর স্বপ্ন-১১


Author: ড. পল্টু দত্ত

সায়নীর স্বপ্ন-১১

Summary:

উইজ এয়ার যখন মালোর্কার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর পালমা দে ম্যালোর্কাতে অবতরন করে তখন কাটায় কাটায় মধ্যদুপুর। খরা রৌদ্দুরে আকাশটাকেও কেমন যেন বিমর্ষ লাগছিল, যেন মধ্য দুপুরে রোদেলার কান্না। বিমান বন্দরটি রাজধানী পালমা থেকে 8 কিমি পূর্বে অবস্থিত এবং ক্যান প্যাস্টিলা গ্রামের সংলগ্ন।

বিমান থেকে বেড় হয়ে ইমিগ্রেশন চেক আপের জন্য যখন প্রধান হলে আসল তখন মানুষের বহর দেখে হতবাকই হল সায়নী। এতো মানুষের ভীড় কোন বিমান বন্দরে এর আগে কখনো দেখেনি। এ যেন কলকাতার হাওড়া রেল ষ্টেশন কিংবা ঈদের সময় ঢাকার কমলাপুরের মানুষের উত্তাল সমুদ্র। কোন কূল কিনারা নেই।

লম্বা লম্বা ইউরোপীয়ান মানুষগুলো জোড়ে জোড়ে পা ফেলে হন হন করে এগিয়ে যাচ্ছে এই ভীরের মধ্যেই। অনেকেই আবার বড়ো বড়ো চোখ তুলে তাকাচ্ছে কিছুটা বিরক্তি ভরেই। কিন্তু কে কার দিকে তাকায়। সবাই গন্তব্যের খুঁজে ব্যাস্ত। আর সায়নীর বাবা এবং মা ব্যাস্ত যেন তমাল আর সায়নীর কাছ থেকে ছিটকে না পড়ে। তমালকে শক্ত করে হাত ধরে রেখেছে তমালের মা। এর মধ্যে প্রকৃতির নিম্নচাপ উপভোগ করল সায়নীর বাবা। সম্ভবত সায়নীরা সবাই। হঠাৎ করে তমাল আওয়াজ করে উঠল-টয়লেট কই মা? শুরু হলো টয়লেট খোঁজার পালা। স্পেনিশ ভাষায় যাকে “ইনোডরো” (inidiro) বলে। শেষ পর্যন্ত সায়নীর চোখে পড়লো এই প্রয়োজনীয় জায়গাটির তীরচিহ্ন। ঐদিকে সবাই ছুটল। চোখে পড়লো এক লম্বা লাইন। একি ব্যাপার! এতো বড়ো লাইন। সায়নীর মা ভাবল এই লাইন হয়তো অন্যদিকে যাবে। কিন্তু কেউ যখন সায়নীকে বললো “আপনি  লাইন ছাড়া কোথাও যেতে পারবেন না. অনুগ্রহ করে সারিতে ফিরে যান” (You can't go anywhere without que. Please return to the queue) তখন সবার টনক নড়লো কিছুটা ভোগান্তি আছে। কি আর করা। অগত্যা তাই করল। সভ্যতায় বন্যতায় একেবারে অসম্ভব। প্রায় ত্রিশ মিনিট পরে প্রকৃতির সাথে বোঝাপড়া করে বেড়িয়ে আসল প্রশান্তির ছোঁয়া নিয়ে।

শুরু হলো পরবর্তী অভিযান। এখনো ইমিগ্রশন পাড় হয়নি। এবারের লাইনটির কোন আগা-মাথা দেখছে না। শুধু একজন মহিলা চীৎকার করে বলে যাচ্ছে Que for all arrivals (আগমন কারীদের জন্য লাইন)। ইমিগ্রেশন চেক আপ করে যখন বেড় হল সবাই তখন প্রায় দুটো বাজতে চললো। সূর্যও হেলতে শুরু করেছে, কিন্তু রোদের দাবদাহ যেন বেড়েই চলছে। একটু পরপরই আগুনের হলকার মতো গরমের ছোঁয়া লাগছে চোখে মুখে। কি অসহ্য গরম। খুব ব্যাস্ততম একটি এয়ারপোর্ট। তবে লোক বলের অভাব বেশ দৃশ্যতঃ ছিলো।

 

সায়নী ম্যালোর্কা সম্পর্কে অনেক কিছু জেনেছে ঢাকা থেকে কেনা বইটি পড়ে।

ম্যালোর্কা হল পশ্চিম ভূমধ্যসাগরের একটি স্প্যানিশ দ্বীপ, যা বালিয়ারিক দ্বীপপুঞ্জের স্বায়ত্তশাসিত দ্বীপপুঞ্জের অন্তর্গত। দ্বীপটি ইউরোপীয় ইউনিয়নের অংশ এবং এর সরকারী মুদ্রা ইউরো। ৩৬০৩ কিমি স্কয়ার আয়তনের ম্যালোরকা । এই দ্বীপটির উত্তর-পশ্চিমে, সেরা দে ট্রামুন্টানা পর্বতশ্রেণী প্রায় ৯০ কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত।  এর সর্বোচ্চ শৃঙ্গ হল পুইগ মেজর (১৪৪৫ মিটার এবং এটি বালিয়ারিক দ্বীপপুঞ্জের সর্বোচ্চ পর্বত)। এর পরে রয়েছে পুইগ ডি ম্যাসানেলা, যা ১৩৬৪ মিটার। ম্যালোর্কা দ্বীপের নামটি একটি পুরানো ল্যাটিন শব্দগুচ্ছ 'ইনসুলা মায়োর' থেকে এসেছে যার অর্থ 'বৃহত্তর দ্বীপ', কারণ ম্যালোর্কা পুরো স্পেনের একটি বৃহত্তম দ্বীপ। 

 

৭০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে এই দ্বীপে মানুষ বসবাস করে আসছে। ভূমধ্যসাগরের মাঝখানে গুরুত্বপূর্ণ ভৌগলিক অবস্থানের কারণে, অনেক সেনাবাহিনী ম্যালোর্কা আক্রমণ করার চেষ্টা করেছে। ১২৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দে, রোমানরা দ্বীপটি দাবি করে।

আধুনিক মালোর্কার গোড়াপত্তন শুরু হয় প্রায় পনের শতাব্দীর মধ্যভাগে। ১৪৭৮ সাল থেকে, আরাগনের মুকুট ক্যাস্টিলের সাথে রাজবংশীয় ইউনিয়নে ছিল। উত্তর আফ্রিকার বারবারি কর্সাইররা প্রায়শই বালিয়ারিক দ্বীপপুঞ্জে আক্রমণ করত। আর তাই শত্রু পক্ষ থেকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য এই অঞ্চলের লোকেরা উপকূলীয় ওয়াচ টাওয়ার এবং সুরক্ষিত গীর্জা তৈরি করেছিল। ১৫৭০ সালে, স্পেনের রাজা দ্বিতীয় ফিলিপ এবং তার উপদেষ্টারা বালিয়ারিক দ্বীপপুঞ্জের সম্পূর্ণ উচ্ছেদ করার কথা ভাবছিলেন। কিন্তু ১৮ শতকের গোড়ার দিকে, স্প্যানিশ উত্তরাধিকারের যুদ্ধের ফলে সেই রাজবংশের ইউনিয়নকে নতুন বোরবন রাজবংশের শাসনের অধীনে একটি ঐক্যবদ্ধ স্প্যানিশ রাজতন্ত্রের সাথে প্রতিস্থাপন করা হয়েছিল। স্প্যানিশ উত্তরাধিকার যুদ্ধের শেষ পর্বটি ছিল ম্যালোর্কা দ্বীপের বিজয়। সময়টা ছিল ২রা জুলাই ১৭১৫, যখন দ্বীপটি বোরবন নৌবহরের আগমনের জন্য আত্মসমর্পণ করেছিল। ১৭১৬ সালে, নুয়েভা প্ল্যান্টা ডিক্রি ম্যালোর্কাকে স্পেনীয় প্রদেশ বালিয়ারেসের অংশে পরিণত করে।

 

মালোর্কার যে জায়গাটিতে সায়নীরা এসে একটি সুন্দর নিরিবিলি হোটেলে উঠে, সেটি সমুদ্রের পাশে অবস্থিত একটি ছোট্ট গ্রাম। গ্রামটির নাম ক্যাপডেপেরা। এ যেন ম্যালোরকান লেভান্টের প্রাচুর্য। এক দিকে সাগড় আর তিন দিকে সবুজের মাধুর্য।

পরিকল্পনা মতো সায়নীর বাবা একটি ব্যাক্তিগত গাড়ী ভাড়া করে আট দিনের জন্য। সাথে একজন ব্যাক্তিগত ড্রাইভারও নেওয়া হলো। যেহেতু প্রথম বার এখানে এসেছে। তাই ভালো ভাবেই এই দ্বীপটিকে অন্বেষন করতে চায়। চলা ফেরায় যেন কোন অসুবিধা না হয় সেই কারনেই ব্যক্তিগত গাড়ী নিয়ে ঘোরাফেড়া করাটাই উত্তম মনে হলো সায়নীর বাবার। আনুষঙ্গিক কাজ কর্ম শেষ করতে প্রায় ঘন্টা খানেক লেগে গেলো। গাড়িতে উঠে এয়ার কন্ডিশনারের শীতল হাওয়ায় খড়া রৌদ্রের উত্তপ্ত শরীরটা যেন কিছুটা হালকা হলো সকলের। এক মোলায়েম শান্ত এবং শীতলতার আনন্দের দোল খেয়ে গেল সারা শরীরে। পাশ থেকে হঠাৎ করে মৃদু নাক ডাকার শব্দ কানে আসল সায়নীর। বুঝতে পাড়ল কি প্রশান্তির মহিমা। বাবা সামনের সীটে বসে নাক ডাকছে। গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন মনে হলো।

 

বিদেশী ড্রাইভার সানগ্লাস পড়ে স্টীয়ারিংএ আছে। তমাল আশে পাশের দৃশ্য বেশ উপভোগ করছে। সায়নীও বেশ ফুর ফুরে মেজাজে। সর্পিলাকারের রাস্তাগুলো বেশ সাজানো গুছানো। রাস্তা মোটামুটি খালিই বলা যায়। দুর থেকে চুনাপাথরের পাহারগুলোকে দেখতে পাচ্ছে। আকাশের বুকে যেন মাথা ঠুঁকে আছে। কি সৌহার্দপূর্ন বন্ধুত্বের আলিঙ্গন। স্বর্গীয় সৌন্দর্যকেও যেন হাড় মানায়। রাস্তার দুই ধারে হলম ওক, লরেল, ক্রাউন পাইন এবং বন্য জলপাই গাছ যা হাজার বছরেরও বেশি পুরানো হতে পারে, যেন আমন্ত্রনের আনন্দ বার্তা নিয়ে সবাইকে স্বাগতম জানাচ্ছে। যতোদুর চোখ যায় জলপাইয়ের বাগান গুলোকে রাজশাহীর আমবাগান গুলির মতোই লাগছে। চোখ জুড়িয়ে যাওয়ার কি এক নৈসর্গিক সৌন্দর্য।

 

মা জানালা দিয়ে এক দৃষ্টিতে বাইরের নৈসর্গিক সৌন্দর্যকে যেন প্রান ভরে উপভোগ করছে।

এই মুহুর্তে সায়নীর দেশের কথা খুব মনে পড়ে গেল।

ফিরে গেল মাটি আর প্রিয় জন্মভূমির কাছে। কি অপরপ মায়া আর নৈসর্গিক ভালোবাসায় বুকে ধারন করে আছে। মনে পড়ে গেল দাদীমার মুখে শুনা জননী জন্মভূমিকে নিয়ে গল্প। দাদীমা বলেছিলেন-“জননী ও জন্মভূমি স্বর্গের চেয়েও শ্রেয়।“ বিশ্ব বিধাতা নিজের হাতে যেন  বিশ্বব্রহ্মান্ডের সকল সৌন্দর্য, সকল স্নেহ, সকল আকুলতাকে বন্দি করে দিয়েছেন পরম যত্ন আর মমতায়। সেই সৌন্দর্যকে সকলে ধারন করে হচ্ছে সমৃদ্ধ। সায়নীর হঠাৎ করেই কেন জানি মনে হতে লাগল পৃথিবীর সবচেয়ে বড়ো সৌন্দর্য হলো মা জন্মভূমি। আমাদের সকলের জীবনেই মা শব্দটি যেন রক্ষাকবচ। মা হীন জীবন যেন রোদেলার কান্না, সাগড়ের শুন্যতা আর মরুদ্বীপের যন্ত্রনা। জনণী এবং জন্মভূমি পৃথিবীর সব সৌন্দর্যকেও হার মানিয়ে দেয়। স্বর্গের চেয়েও শ্রেষ্ট। হঠাৎ করে ড্রাইভারের শব্দে অন্যমনস্কতা ভেঙ্গে গেলো সায়নীর।

ড্রাইভার: “আর মাত্র পনের মিনিট পরে হোটেল কালা গাট-এ পোঁছে যাবো।

মা (হঠাৎ চমকে উঠে): “কালুর ঘাট”? এখানেও আছে নাকি?

ড্রাইভার: হোয়াট ডীড উ শে? কালুর ঘাট? নো, নো, কালা গাট নট কালুর ঘাট

সবাই হেসে উঠলো। মা বুঝতে পারল ওর ভুলটা।

 

পালমা ডি মালোরকা থেকে সায়নীরা যে গ্রামটিতে যাবে তার দুরুত্ব প্রায় ৭০ কিলোমিটার। গ্রামটির নাম ক্যাপডেপেড়া।

 

ঠিক সময়েই সায়নীরা হোটেলে এসে পোঁছল। রুমে যখন আসল তখন প্রায় পাঁচটা বাজতে চললো। কিন্তু এখনো মনে হচ্ছে ভর দুপুর। রৌদ্রের কোন কমতি নেই।

চুনাপাথর পর্বত এবং সমুদ্র সৈকত দ্বারা ঘেরা নৈসর্গিক সৌন্দর্যের চাদরে মোড়া মালোরকা দ্বীপপুন্জের ক্যাপডেপেড়া গ্রামটি। বিরল ইতিহাসের কিছুটা কাছে থেকে অভিজ্ঞতা অর্জনের উত্তম স্থান। বনজ পোকার ঝিঁ ঝিঁ শব্দ যেন বিটোভেন (Ludwig van Beethoven) এর মন কাড়া পিয়ানোর আওয়াজ। দ্রুপদীয় অমর সঙ্গীতের মূর্ছনা কর্নকুহরে যেন আবেগের স্নিগ্ধ দোলার হিল্লোল ছড়িয়ে দিচ্ছে। গ্রামের রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে তাই অনুভুত হল সায়নীর। সবাই যেন এই সুন্দর পরিবেশটা উপভোগ করছে। ক্যাপডেপেড়া দূর্গের চারিপাশের দৃশ্যগুলি খুবই দর্শনীয় এবং দুর্গের দেয়ালের উপর থেকে এইরকম একটি জায়গার অভিজ্ঞতা পাওয়া খুবই আকর্ষণীয়। মাটিতে বসবাসকারী পেঁচা এবং ফ্যালকনগুলি অপরুপ সৌন্দর্যের মুগ্ধতায় সবাইকে আপ্লুত হতে হবে কিছুক্ষনের জন্য হলেও।

 

তবে এমন সুন্দর জায়গায় সায়নী এর আগে কোথাও দেখেনি। পাখির কিচির মিচিরে মাতোয়ারা চারিদিক।

 

কি সুন্দর সমুদ্র পাড়ের গ্রাম কাপডেপেরা।

যদিও কিছুটা ক্লান্তি লাগছিল সকলের কিন্তু হোটেলের একমাত্র দুই রুমের বিশাল স্যুইটটিতে মোলায়েম বেডে গা এলিয়ে দেয়ার সাথে সাথেই যেন ক্লান্তিরা উবে গেল। জানালা দিয়ে সমুদ্র আর তার পেছনে সুউচ্চ পাহারগুলিকে খুব সুন্দর লাগছিল। স্যুইটের সীটিং রুমে আছে বিশাল আকারের রঙীন টিভি।

বাবা ডেকে বললেন: সায়নী, কেমন লাগছে এখানে। ক্ষিদে পায়নি তো এখন। যদি চাও চা বিস্কিট খেতে পার।

সায়নী: না বাবা। এখন খাবো না। আমার সত্যিই খুব ভালো লাগছে বাবা। থ্যাংকিউ।

বাবা: তুমি এই এলাকা সম্পর্কে কিছু জানো তুমি না বলেছিলে তুমি একটা বই কিনেছ?

হঠাৎ মা এসে হাজির। হাসতে হাসতে বললো-সে জানবে না? গাড়ীতে তুমি যখন নাক ডেকে ঘুমাচ্ছিলে তখন সায়নী আমাকে এই দ্বীপটিকে নিয়ে অনেক কিছু শুনাচ্ছিলো। কি কঠিন কঠিন নাম। আমার কিচ্ছুই মনে নেই। নে সায়নী। এবার তোর বাবাকে শুনা।

সায়নী: সত্যিই তুমি জানতে চাও বাবা। বইটিতে এই অঞ্চলটিকে নিয়েও অনেক তথ্য আছে।

বাবা: তুমি বল। তোমার কাছ থেকে আজ শুনতে চাই।– এই বলেই বাবা ফ্রিজ থেকে একটি ফানতার কেন এনে সায়নীর বেডে বসে পড়ল।

সায়নী অতি উচ্ছ্বাসের সাথে বলা শুরু করলো। যেন সত্যিকারের ট্যুরিস্ট গাইড।

 

ক্যাপডেপেরার আশেপাশের এলাকাটি ব্রোঞ্জ যুগের বসতির স্থান ছিল। ১৩০০ খ্রিস্টাব্দ থেকে রাজা জাউম ক্যাপদেপেড়া গ্রামটি নির্মিত করেন যাতে করে নাগরিকদের এবং জাহাজের রাস্তাগুলিকে জলদস্যুদের আক্রমণ থেকে রক্ষা করা যায়। পাহাড়ের অভ্যন্তরে একটি সুরক্ষিত শহর গড়ে তোলার জন্য তার আদেশ স্থানীয়দের কাছে জনপ্রিয় ছিল না. কিন্তু পরবর্তীতে সুরক্ষিত প্রাচীরের কারণে অনেক যুদ্ধ এবং অবরোধ থেকে স্থানীয়রা বেঁচে যায়। বিপদ ধীরে ধীরে কেটে গেলে স্থানীয়রা পাহাড়ের তলদেশে নিজেদের স্থানান্তর করতে শুরু করে। 

 
বাবা: তুমি এতো কিছু জানো?
সায়নী: আরো অনেক কিছু আছে বাবা। চুপ করে শোন-সায়নী বলতে থাকে---

 

সেই প্রাচীনকাল থেকেই প্রাচীর ঘেরা এই শহরটি আশেপাশের এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে এবং পরবর্তীতে বাড়ি তৈরির জন্য মূল দুর্গ থেকে পাথর ব্যবহার করা হয়। 'ক্যাস্টেল ডি ক্যাপডেপেরার' ১৪ শতকের একটি মূল দুর্গ আছে। মানুষের বসতি স্থাপনের কারনে ধীরে ধীরে এই গ্রামটি আজ একটি আবাসিক শহরে রুপান্তরিত হয়েছে। যদিও এইটি একটি সুন্দর শহর কিন্তু স্থানীয় জনগন এটিকে গ্রাম বলতেই বেশ স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে।

এবার সায়নী বইয়ের পাতা উল্টোতে থাকে। ভাঁজ করা পাতা থেকে এবার পড়তে থাকে-

“গ্রামটির একটি সমৃদ্ধ ইতিহাস রয়েছে। এটি দ্বীপের উত্তর-পূর্বে অবস্থিত। গ্রামটি ১২ শতকের গোড়ার দিকে মুরদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বলে জানা যায়। ১৯৩০-এর দশকে স্প্যানিশ গৃহযুদ্ধ থেকে বাঁচতে গ্রামে আসা মহিলারা লেইস তৈরির প্রথাটি গ্রামে নিয়ে আসে। গ্রামটি একসময় লেইস উৎপাদনের কেন্দ্র ছিল, যেখানে ১০০ জনের বেশি লেইস শ্রমিক ছিল। গ্রামটির জনসংখ্যা প্রায় দুই হাজার। গ্রামটি একটি পাহাড়ের উপর অবস্থিত। বাড়িগুলি সুরক্ষিত টাওয়ারের চারপাশে নির্মিত, যা ক্যাপডেপেরার পুরানো দুর্গের একমাত্র অবশেষ। স্প্যানিশ উত্তরাধিকারের যুদ্ধের সময় গ্রামটি একটি বড় যুদ্ধের স্থানও ছিল। আজ, গ্রামটি একটি জনপ্রিয় পর্যটন এলাকা। এর সু-সংরক্ষিত মধ্যযুগীয় স্থাপত্য এবং পাহাড়ের উপর এর অত্যাশ্চর্য অবস্থানের জন্য গ্রামটিকে খুবই অপরুপ দেখায়।

 
হঠাৎ সায়নী পড়া বন্ধ করে দেয়। বাবা নিদ্রায় নাক ডাকছে।

 
পরের দিন সকলে প্রথমে যে জায়গায়টায় যায় সেটা এই গ্রামেই অবস্থিত। হোটেল থেকে হেঁটেই যাওয়া যায়। তাই সকলে হেঁটেই বনের ভেতরের সরু রাস্তা দিয়ে চলে আসে। এই বিশাল পুরনো ক্যাসেলটি ক্যাপডেপেড়ার সবচেয়ে উঁচু স্থানটিতে অবস্থিত। প্রায় সাড়ে তিন শত সিড়ি বেয়ে উপরে উঠতে হয়। মা আর তমালের একটু কষ্ট হয়েছে উপরে উঠতে।

ক্যাসেল ডি ক্যাপডেপেরা নামের ক্যাসেলটি চতুর্দশ শতাব্দীর একটি সুরক্ষিত জায়গা যা সারা বছর পরিদর্শন করা যায়। প্রচুর ট্যুরিস্ট আসে এই পুরনো ক্যাসেলটি দেখতে। ক্যাসেলটিতে একটি মিউজিয়াম রয়েছে যাকে স্থানীয় ভাষায় বলে “ মিউজু দে লা লাটা”। এখানে রয়েছে স্থানীয় সংস্কৃতি নির্ভর হস্তনির্মিত পণ্য। গ্রামের প্রধান এলাকাগুলি যেমন কালা রাজাদা, ফন্ট দে সা কালা, ক্যানিয়ামেল এবং ক্যালা মেসকুইদাকে উঁচু স্থান থেকে চোখ ফেরালেই চিহ্নিত করা যায়। পুরো ক্যাসেলটা ঘুরে দেখতে দেখতে প্রায় ঘন্টা দুয়েক লাগে।

ক্যাসেল থেকে নিচে নেমে আইসক্রিমের মোবাইল সপ দেখে তমল আইসক্রিম আইসক্রিম বলে চীৎকার করে উঠে। সেদিন গরমও ছিলো অনেক। গায়ের চামড়া পুড়ে যাওয়ার মতো অবস্থা।

সায়নীর বাবা সকলের জন্য আইসক্রিম কিনলেন। পাশেই গাছের ছায়ায় বেশ কয়েকটি বসার জায়গা দেখে একটিতে চারজনই বসে পড়লেন।

 

সেখান থেকে ট্যাক্সী নিয়ে চলে আসেন সোলার দ্য ভ্যালি অফ কমলা'

 

সোলার হল মালোর্কা দ্বীপের উত্তরে। স্পেনের ট্রামুন্টানার কোমারকাতে অবস্থিত একটি পৌরসভা। পৌরসভাটি তার ঐতিহ্যবাহী স্থাপত্য, অত্যাশ্চর্য প্রাকৃতিক দৃশ্য এবং সরু সরু রাস্তার জন্য সুপরিচিত। একটি ঐতিহাসিক শহর যা বছরের পর বছর ধরে বহুদিনের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে সংরক্ষণ করছে। এখানে বিশাল একটি গির্জা রয়েছে। খুব পুরনো। গির্জার সামনের চত্তরটি বেশ সুন্দর। গির্জার অভ্যন্তরটি খুব সুন্দর। একটি অলঙ্কৃত ছাদ এবং বেশ কয়েকটি রঙিন কাচের জানালা রয়েছে। শহরের ইতিহাসের নিদর্শন সহ গির্জায় একটি ছোট জাদুঘরও রয়েছে। সায়নীরা সকলেই যেন শহরের ঐতিহ্যবাহী স্থাপত্যগুলোকে উপভোগ করেছে। সরু রাস্তা এবং সাদা বাড়িগুলি খুব মনোরম।

 

সোলারের সৈকতগুলিও সত্যিই সুন্দর। সরু রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে এক সময় সমুদ্র সৈকতে এসে পৌঁছায়।

যেহেতু শহরটি ট্রামুন্টানা পর্বতমালার কাছাকাছি অবস্থিত এবং পাশেই সমুদ্র, এর চারিদিকের দৃশ্য সত্যিই মনোরম। চোখ ধাঁধানো। সোলারের উপত্যকা একদিকে পুইগ মেজর এবং অন্যদিকে ফরমেন্টর উপদ্বীপ দ্বারা ঘেরা। সোলার নদী উপত্যকার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে উপসাগরে পতিত হয়েছে। সোলারে বসবাসকারী লোকেরা খুব বন্ধুত্বপূর্ণ।

সায়নীরা যখন হেঁটে যাচ্ছে তখন প্রায় সকলেই ওদের দিকে হাত নাড়িয়ে হ্যালো বলছে। কেউ কেউ জিজ্ঞেস করছে কোন দেশ থেকে এসেছে। অনেকে আবার কাছে এসে ভাঙ্গা ভাঙ্গা ইংরেজীতে এই এলাকার ঐতিহ্য সম্পর্কে অনেক কিছু বলতে চায়।

 

এই শহরটি খুবই পুরাতন। এখানে মানুষ রোমান যুগ থেকে বসবাস করছে।

কিভাবে দেখতে দেখতে যে আটটা দিন চলে গেল সায়নীরা টেরও পায়নি। প্রতিদিন সকালে ব্রেকফার্স্ট করে বের হতো আর সন্ধ্যায় ফিরে আসতো। এই সামারের শেষ দিকে সন্ধ্যা হতে হতে নটা বেজে যায়। দুপুরে এ কয়দিন নানা জায়গায় খাওয়া হতো।

মালোর্কার প্রধান তিনটি শহর পালমা - রাজধানী, মানাকোর এবং ইনকা চসে বেড়িয়েছে এই কয়দিন। সবচেয়ে জনপ্রিয় পর্যটন রিসর্ট হল আলকুডিয়া, ক্যালা ডি'অর, পোলেনসা, ম্যাগালুফ এবং সান্তা পোনসায় ও সময় কাটিয়েছে। তমালকে নিয়ে স্যান্ডি বীচে হেঁটে বেড়িয়েছে, লাইফ জ্যাকেট পরে সমুদ্রে সাঁতার কেটেছে।

দ্বীপের ব্যস্ততম রিসর্টের মধ্যে একটি ছিল পুয়ের্তো পোলেনসা। পুরো একটা সকাল সায়নীরা কাটিয়েছে এখানে। মাছ ধরার জন্য এখানে উত্তম ব্যাবস্থা ছিল। তবে দিনটা ছুটির দিন হওয়ায় অনেক লোক বড়শী হাতে মাছ ধরায় ব্যাস্ত। আশে পাশে বেশ কয়েকটি জায়গায় বারবিকিউ হচ্ছিল।

 

বেশ ভালোই কেটেছিলো মালোর্কাতে। আবহাওয়া সব সময়ই ছিল মনোরম। খুব হৈ চৈ করে কাটিয়েছে সায়নী আর তমাল। সায়নীর জন্য এই ভ্রমনটা ছিলো মনে রাখার মতো। এই কয়দিনে ড্রাইভার গাব্রিয়েলের সাথে সায়নী আর তমালের কেমন একটা ভাব হয়ে যায়।

 

যেদিন এয়ারপোর্টে ফিরে আসে সেদিন গাব্রিয়েলের মনটা খুব খারাপ ছিল। এই কয়দিনে একদিনও বৃষ্টি আসেনি। অথচ সেদিন সকাল থেকেই গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি হচ্ছিল। আকাশটা কালো মেঘে ছিল ঢাকা।

হঠাৎ করেই সায়নীর মনটা খারাপ হয়ে গেল। ট্রলি ঠেলতে ঠেলতে ঘাড় বাঁকিয়ে পিছনে ফিরে তাকাল। তখনও গাব্রিয়েল ঠায় দাঁড়িয়েছিল। সায়নীকে দেখতেই হাত তুলে দেখাল।

মানুষের ভিড়ে এক সময় সায়নীরা হারিয়ে গেল।

 

চলবে---)



Read full book here: Click here to download the PDF file