সায়নীর স্বপ্ন-নয়


Author: ড. পল্টু দত্ত

সায়নীর স্বপ্ন-নয়

Summary:

আগামী শুক্রবারে তমালের জন্মদিন।

এই নিয়ে পুরো বাড়ীতে বেশ হৈ চৈ চলছে। সায়নীদের বাড়ীর ছাদে জন্মদিনের কেক কাটা হবে। সেখানেই খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা হবে। ছাদে সামিয়ানা টাঙ্গানো হয়েছে। দাদীমার কাছে শুনেছে প্রায় শতকের বেশী লোকের আয়োজন। তবে বাড়ীর নীচ তলার একটি অংশকেও ব্যবহার করা হবে। সায়নীদের বাড়ীর নীচ তলাটি বেশ সুন্দর এবং বড়ো সড়ো। সেখানে মূলতঃ গাড়ী রাখা হয়। জন্মদিনের দিন সে জায়গাটিও ব্যবহার করা হবে।

সেখানে খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থাও থাকবে। তবে এতিম ও গরীব লোকদের জন্য। প্রায় পাঁচ শতকের মতো গরীব লোকদের খাওয়ার ব্যবস্থা থাকবে সেদিন। তাছাড়া প্রত্যেকটি এতিম ও গরীব লোকদেরকে নতুন জামা কাপড় দেয়া হবে। দাদাীমা বলেন এতে পরিবারের মঙ্গল হয়। যারা এতিমদের সহায়তা করে তাদেরকে আল্লাহ জান্নাতে ডেকে নেন। তাদের দোয়া আল্লাহ কবুল করেন।

 

তমালের জন্ম দিনটা তাই সব সময়ই বাড়ীতেই করা হয়। দাদীমাও সেটা পছন্দ করেন। অন্তত এই উপলক্ষে প্রায় অনেক আত্মীয় স্বজনের সাথে দেখা হয়।

 

সায়নীর মা যদিও এতে প্রথম প্রথম আপত্তি করতেন কিন্তু এখন বরং বাড়ীতে জন্মদিন করাটাকেই বেশী পছন্দ করেন। এতে করে নিজকে ভালোভাবে তুলে ধরার ভালো একটা সুযোগ থাকে। জন্মদিন উপলক্ষে বেশ কয়েকদিন রম রমা পরিবেশ থাকে। উৎসবটাকে নিজের মতো করে সাঁজানো যায়। পারিবারিক সম্পৃক্ততাকেও উৎসাহিত করে। বাড়ীতে হৈ চৈ করতেই সবাই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। শিশুরাও বাড়ীর আশে পাশের প্রশস্থ জায়গায় খেলায় মশগুল থাকতে পছন্দ করে।

কোনদিন সায়নী ছোট ভাইটিকে জন্ম দিনে কিছু দেয়নি। এখন বড়ো হয়েছে। বুঝতে শিখেছে। তাই এবার তমালকে একটি সুন্দর উপহার দিবে বলে ঠিক করে রেখেছে।

সায়নী বেশ ভালো পেইন্টিং করতে পারে।

গত কয়েকদিন যাবৎ খুব মনযোগ দিয়ে পেইন্টিং করছে। খুব যত্নের সাথে কমলা ও গোলাপী রঙের তুলিতে যেন ফুটে উঠেছে এক প্রানবন্ত অস্তরাগ। ঢাকার কোলাহলপূর্ণ নগরীর আকাশে সূর্য যখন হেলে পড়ে, তখন একটি উষ্ণ সোনালি আভা ছড়িয়ে থাকে বুড়িগঙ্গা নদীর উপর। সেই দৃশ্যটিই তুলে ধরেছে সায়নী। প্রতিটি স্ট্রোকের সাথে সে তার হৃদয়কে একান্তভাবে ক্যানভাসে ঢেলে দিয়েছিলো।

এই উপহার যে ছোট ভাই তমালের জন্য। অটিজমের কারনে নানা চ্যালেঞ্জ থাকা সত্বেও প্রতিদিন স্কুল থেকে এসে অবসর সময়ে প্রিয় তোতা পাখির (সুইটির) সামনে বসে পেইন্টিং করতে বসে যেতো। আঁকতে বসে প্রতিটি ব্রাশস্ট্রোকে যেন তার আবেগের অভিব্যাক্তি ফুটে উঠতো সুন্দরভাবে। আঁকতে আঁকতে কখনো-সখনো মন খোলে গুন গুন করে সুর তুলতো।

সায়নীর পেইন্টিং যেন খুব মনযোগ দিয়ে উপভোগ করত পাশের খাঁচায় থাকা তোতা পাখিটি (সুইটি)। মাঝে মধ্যে ফোড়ন কাটতো-

সুইটি (মুখটা একটু বেকিয়ে): কি করো বন্ধু

সায়নী (কিছুক্ষন পর): পেইন্টিং করছি। তুমি বুঝতে পারছো না?

সুইটি: পেইন্টিং? কেন?

সায়নী (গুন গুন করে তখন গান গাচ্ছিলো। গান থামিয়ে,): তমালকে দেবো।

সুইটি: কেন দেবে?

সায়নী (একটু বিরক্ত হয়ে): বেশী কথা বলো না। ভূল হয়ে যাবে। তমালের জন্মদিন পরশু। শুক্রবারে। ওকে এইটা দেবো

সুইটি: মজা..মজা..মজা…তমালের বার্থ ডে।

তমালের জন্ম দিনের কথা শুনে সুইটি যেন খুশিতে আত্মহারা। কি সুন্দর করে ডানা ছড়িয়ে দিয়ে পালক ফুঁকতে ফুঁকতে নাচানাচি করছে। মাথাটা কি সুন্দর এক  ছন্দময় গতিতে দুলাচ্ছে। সুইটি সায়নীর কথা শুনে প্রফুল্লভাবে কিচিরমিচির করতে লাগলো। আবার মাঝে মধ্যে শিস দিতে লাগলো। বন্ধুর এই সব আচরন দেখে সায়নী অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে-

-এতো খুশী হচ্ছো কেন বন্ধু। তমালের জন্ম দিন। তাতে তোমার কি?

সুইটি: কি মজা…কি মজা…কি মজা….

সায়নী: ঠিক আছে। এখন একটু চুপ করো।

সায়নীর আদেশে পাখিটি চুপ হয়ে গেলো। সায়নী আবার পেইন্টিং-এ ধ্যান দিলো।

 

পেইন্টিং-এর কাজ প্রায় শেষ। ফাইনাল টাচ দিচ্ছে এখন।

তার আঁকা পেইন্টিংটিতে একটি ছোট্ট ছেলে বাড়ীর ছাদে দাঁড়িয়ে অস্তগামী সূর্যের শ্বাসরুদ্ধকর দৃশ্যে খুব গভীরভাবে উপভোগ করছে কোন এক সন্ধ্যার আগ মুহূর্তে। তার পেইন্টিং এ ছোট ভাই তমালকেই তুলে ধরা হয়েছে। তমালের দৃষ্টি দিগন্তে স্থির ছিলো দিব্যজ্যোতির মতো। সে তার সামনে উন্মোচিত নির্মল সৌন্দর্যে ছিলো বিমোহিত। বুড়িগঙ্গার ঢেউগুলি যেন আকাশের রঙের ক্যানভাসে প্রতিফলিত হচ্ছে। আলো এবং জলের কি অপূর্ব এক দৃশ্যে। সায়নীর এই পেইন্টিং শুধু  একটি দৃশ্যই নয়, এ যে এক পরম অনুভূতি। ছোট ভাইয়ের প্রতি সায়নীর  গভীর ভালোবাসার প্রকাশ।  মমতাময়ী বোনের গভীর স্নেহের একটি চাক্ষুষ অভিব্যক্তি।

 

মাঝে আর একটা দিন। পরশু তমালের জন্ম দিন।

সায়নীর বেশ ভালো লাগছে। মনটা বেশ ফুর ফুরে। এই প্রথম তমালকে কিছু দেবে। নয় বছরে পড়বে তমাল। এখন তমাল অনেক কিছুই বুঝে। বেশ শান্ত হয়ে উঠছে দিন দিন। তবে সায়নীর মাঝে মাঝে খুব দুঃখ হয় তমালের সাথে খেলতে না পারায়।

এবার জন্ম দিনে সায়নী বেশ মজা করবে। তমালকে নিজের হাতে পেইন্টিংটা দেবে। ওকে আদর করবে। হাগ দেবে। কেক খাইয়ে দেবে। অন্যান্য শিশুদের সাথেও খেলবে। আনন্দে সায়নীর বুকটা ফুলে উঠে।

 

দিনটি যতো ঘনিয়ে আসছে রঙিন ব্যানারে আর ফুলে ফুলে ছাদের চারিপাশ মুড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। সামিয়ানার নীচে সাড়িবদ্ধভাবে টেবিল চেয়ার বসানো হয়েছে। ছাদের ঠিক মাঝখানে বড়ো একটি টেবিল পেতে রঙিন কাগজে সাঁজানো হয়েছে। এখানেই কেক কাটা হবে।  বাড়ীতে আত্মীয় স্বজনদের কেউ কেউ এসেছে বাবার গ্রামের বাড়ী থেকে। জন্ম দিনের পরে আবার চলে যাবে। বাড়ীটা তাই বেশ গম গম করছে।

কিন্তু আনন্দের মধ্যেই লুকানো থাকে বিষাদের ছায়া।

একদিন রাতে যেন হঠাৎ করেই সব কিছু ওলোট পালোট হয়ে গেলো।

সায়নীর আনন্দের জোয়ারে নেমে এলো কর্দমাক্ত লোনা জলের দুর্গন্ধ। সব ভাবনারা যেন থেমে গেলো। জন্ম দিনের আগের রাত্রে দাদীমার সাথে দেখা করতে নীচ তলায় যাচ্ছিলো সায়নী। তখন রাতের খাওয়া শেষ। চারিদিকে আলোয় ঝলমল করছে। আগামীকাল তমালের জন্ম দিন। বাড়ীতে বেশ হৈ চৈ। দাদীমাও বেশ সময় কাটাচ্ছে গ্রাম থেকে আসা আত্মীয়দের সাথে। দাদীমা নীচের গেস্টরুমে আত্মীয়দের সাথেই ছিলেন সেই সময়। গেস্ট রুমটি বাবা-মায়ের রুমের এক পাশে। সেখানে পর পর দুটি গেস্ট রুম। বাবা-মায়ের রুম পার হয়েই গেস্ট রুমগুলো।

 

সায়নী হঠাৎ করেই বাবা-মায়ের রুমের জানালার পাশে থেমে যায়। ভেতর থেকে বাবা-মায়ের কথা শুনতে পেলো। মা বেশ উত্তেজনা কন্ঠে বাবাকে কিছু বলে যাচ্ছে। মায়ের একটি কথা স্পষ্টভাবে সায়নীর কানে এসে আছড়িয়ে পড়লো। হঠাৎ করেই যেন ভূমধ্যসাগরের উতাল পাতাল ঢেউ এসে বুকের পাজরের উপর ধপাস ধপাস করে ধাক্কা মারলো প্রচন্ড জোড়ে। কিছুক্ষনের জন্য সায়নীর হৃদপিন্ডের স্পন্দন থেমে গেলো। ভীষন কান্না আসছিলো। চোখের কোন বেয়ে অশ্রু গাল বেয়ে পড়তে লাগলো। সারা গা যেন থর থর করে কাঁপতে লাগলো।

 

সায়নীর মায়ের উত্তেজিতভাবে বলা  কথাগুলো তার বাবার কানের কাছে যেন নিস্তব্ধ সুরে ফিসফিস করে উচ্চারিত হয়ে রাতের নিস্তব্ধতা ভেদ করে সায়নীর কানে এসে বজ্রাঘাত করলো।

"কাল সায়নী জন্ম দিনের পার্টিতে ছাদে যাবে না, এটাই আমার শেষ কথা" তার মা উচ্চস্বরে কথাগুলো বললেন। উদ্বেগ আর উত্তেজনায় তার কণ্ঠ ভারী মনে হলো। -সায়নী জন্ম দিনে আসলেই একটা অঘটন ঘটাতে পারে। শেষে না সব কিছুই পন্ড হয়ে যায়।

 

কথাগুলো সায়নীর কানে আসতেই ওর হৃৎপিণ্ডটা যেন কেউ খাবলে ধরেছে। টেনে হিছড়ে ছিন্ন-ভিন্ন করে দিচ্ছে। চোখের কোণে অশ্রুগুলি ঝরছে। হঠাৎ বাবা চীৎকার করে উঠলেন। সায়নী জানালার পাশেই দাঁড়িয়ে পড়লো। বেদনায় ভারাক্রান্ত মন। মনযোগ দিয়ে বাবা-মায়ের কথাগুলো শোনার চেষ্টা করলো।

বাবা: চুপ করো তুমি! নিজের মেয়ের সম্পর্কে এই কথাগুলি বলতে তোমার একটুও মুখে বাঁধলো না। আর ওতো এখন আর আগের মতো নেই। সব কিছুইতো সায়নীর প্রায় স্বাভাবিক। ভাইয়ের জন্ম দিনে বোন যাবে না, এটা কি করে হয়? আর আত্মীয়-স্বজন বলবে কী? সায়নীর দাদীমাতো এটা মানবেন না। না, না এসব আপত্তিকর কথা তুমি বলবে না।

মা: খবরদার! এ নিয়ে তুমি আর কোন প্রশ্ন করবে না কিন্তু। তোমার মাকে তুমি বুঝাবে। আমি চাই না, জন্মদিনে কোন অঘটন হোক।

বাবা: কিসের অঘটন? ও এখন বড়ো হচ্ছে। স্কুলে যায়। আর বাচ্চা মেয়ে। আর সবাইতো জানে ওর একটু অটিজমের সমস্যা আছে। ওকে একটু আদর করতে শিখো। ওর সাথে একটু সময় দাও। তাহলেই দেখবে সব ঠিক হয়ে যাবে। অটিজম কোন লজ্জা নয় বরং ভালোবাসার প্রেরনা।

মা: আমি এসব বুঝি সুজি না। আমি চাই না ও একটা অঘটন ঘটিয়ে ছেলের জন্ম দিনটা পন্ড করে দিক। তাছাড়া আমার ক্লাবের অনেক বান্ধবীরা আসবে কাল। আমি চাই না ওরা এখানে এসে ওর অপকীর্তিগুলো দেখুক।

বাবাঃ ক্লাব আর ঐসব আজগুবি মানুষদেরকে নিয়ে না ভেবে বরং সংসারের দিকে একটু তাকাও। তা না হলে একদিন সব কিছু উচ্ছন্নে যাবে। এখন এসব ছেড়ে একটু আত্মীয় স্বজনদের দিকে নজর দাও। দেখ ওদের খাওয়া দাওয়া হয়েছে কিনা।

মাঃ তুমি কথা ঘুরাবে না কিন্তু!

বাবা: কথা ঘুরাচ্ছি না। একটু সাবধান করে দিচ্ছি।

মা: কিসের সাবধান। নিজের দিকে চেয়ে দেখো আগে। আমাকে নিয়ে এতো না ভাবলেও তোমার চলবে। আর আমার বান্ধবীদেরকে নিয়ে কোন আজে-বাজে কথা বলবে না কিন্তু।

বাবাঃ তোমাকে নিয়ে ভাবতে আমার বইই গেছে। পারলে কাল মেয়েকে সাজিয়ে জন্মদিনে নিয়ে যেও। ও খুশী হবে। এতে তোমারই লাভ হবে। সবাই বলবে মেয়ের প্রতি মায়ের কি ভালোবাসা।

আর ভালো লাগছিলো না সায়নীর বাবা-মায়ের ঝগড়া-ঝাটির কথাগুলো শুনতে। বেদনায় কান ভারী হয়ে আসছিলো। মায়ের কথা শুনে মনটা ভীষন খারাপ লাগছে। দাদীমার কাছে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। ঘুরে নিজের তলায় যাওয়ার জন্য সিঁড়ির দিকে যে পা ফেলতে যাবে ঠিক তখনই মায়ের কথায় হঠাৎ থমকে দাঁড়ায়।

মা: সায়নী আমার মেয়ে নয়, তুমি ভালো করেই জানো। ও একটা অলক্ষী। জন্মের সময়ই ওর মাকে খেয়েছে। ও শুধু অটিষ্টিক নয়। একটা অলক্ষী!

একি শুনলো সায়নী।

হঠাৎ যেন বুকটা চাপা কান্নায় ফেটে যাচ্ছিলো। মাথাটা যেন চড়কির মতো ঘুরাচ্ছিলো। শরীরটা কেমন অবশ হয়ে গেলো। পাগুলি কেমন বেঁকে যাচ্ছিলো। দাঁড়াতে পারছিলোনা। ধপাস করে মেঝেতে বসে পড়লো। দুহাত দিয়ে মুখ চেপে ধরলো। কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো।

সে কখনই কল্পনা করতে পারেনি এই ধ্রুব সত্যটা এমন ভাবে শুনতে হবে। এতোদিন যাকে সে মা বলে জেনে আসছে সে তার আপন মা নয়! আজ সে বুঝতে পারলো কেন সে মায়ের ভালোবাসা কখনো পায়নি। কেন এতোদিন মা তাকে বোঝা হিসাবে দেখেছে। গত বারো বছরেও সে জানতে পারলো না তার নিজের মা তার জন্মের সময় মারা গেছেন। এমনকি দাদীমাও সায়নীকে কোনদিন বলে নি এই মা সায়নীর আপন মা নয়। তমাল তার আপন ছোট ভাই নয়।

 

আর বসে থাকতে পারলো না। মাথাটা কেমন ঝিম-ঝিম করছে। চেনা-জানা পৃথিবীটা হঠাৎ করেই যেন অচেনা হয়ে গেলো। কাঁপানো হাত আর নিস্তেজ শরীরটাকে কোন রকমে সামলানোর চেষ্টা করলো। কিশোরী প্রান কান্নায় সাহারার মরুভূমির মতো হাহাকার করে উঠলো।

ভারাক্রান্ত হৃদয় নিয়ে খুব কষ্ট করে সায়নী আস্তে আস্তে পা ফেলে তার রুমে ফিরে এলো। বাড়ীর কেউ জানতেও পারলো না কি এক গভীর কাল বৈশাখীর ঝড় এসে সায়নীর জীবনটাকে লন্ড ভন্ড করে দিয়ে গেলো। কিছুক্ষন আগেও যার মনে ছিলো আনন্দের ঝলক, চোখে-মুখে ছিলো উচ্ছ্বাস কিছুক্ষন পরেই সব শেষ হয়ে গেলো। বিষাদের ছায়া ভর করেছে সায়নীর অস্থিত্বে।

 

সায়নী আজ বড্ডো একা। যে মাকে সে এতো দিন নিজের মা বলে জেনে এসেছে সে আজ এক লহমায় কেমন পর হয়ে গেলো।

রুমে ঢুকেই সায়নী নিজের বেডে ঝাঁপিয়ে পড়লো।

হাউ মাউ করে কেঁদে উঠলো। শরীর একেবারে জমে যেন ঠান্ডা হয়ে গেছে। শ্বাস যেন তার গলায় আটকে আছে। নিঃশ্বাস নিতে খুব কষ্ট হচ্ছিলো। চোখ দিয়ে গাল বেয়ে জল পড়ছিলো অনবরত। আবেগের ঢেউগুলো মনের মাঝে আথালি-পাথালি করে আছড়িয়ে পড়ছিলো। এ ভাবেই কাটে অনেকক্ষন। তারপর এক সময় উঠে দাঁড়ায়। শরীরটা খুব দূর্বল। চুলগুলো কেমন এলো-মেলো হয়ে ঘাড়ের চারিদিকে দলা পেকে আছে।

 

জোড়ে জোড়ে কয়েকটা দীর্ঘশ্বাস নিলো। মিস রিমা একদিন ক্লাশে বলেছিলেন মন খারাপ হলে কিংবা অনেক ক্ষন কান্নার পর জোড়ে জোড়ে নিঃশ্বাস নিতে। এতে ফুস ফুসটা নাকি প্রসস্থ হয়। অকসিজেন ভালো করে ফুসফুসে ঢুকতে পারে। মনটা ভালো হয়।

 

মনটাকে শক্ত করলো সায়নী। আজ যে সত্যকে সে জেনেছে তাকে নিজের মধ্যেই চেপে রাখবে। কাউকে ঘুনাক্ষরেও বুঝতে দেবে না যে সে এক নতুন সত্যের মুখোমুখি। যে মাকে সে কোনদিন দেখেনি তার জন্য মন খারাপ কেন? যাকে এতো দিন মা বলে জেনে এসেছে, যার চোখের সামনে সে বড়ো হয়েছে, সেই তার আসল সত্য। সেই সায়নীর মা। তাকে নিয়েই তার ভাবনারা বিন্যস্ত হয়েছে। যতোই খারাপ হউক না কেন, সায়নীর দৃঢ় বিশ্বাস একদিন এই মা-ই সায়নীকে পরম যত্নে বুকে তুলে নিবে।

 

এই সব ভাবতে ভাবতে হঠাৎ তমালের মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠলো। তমালের জন্য আঁকা পেইন্টিংটি হাতে তুলে নিলো। ছোট ভাইয়ের প্রতি তার ভালোবাসার প্রতীক এই উপহারটি।  প্রতিটি রঙের স্ট্রোক যেন তার হৃদয় নিংড়ানো ভালবাসার একটি মূর্ত প্রতীক। স্থির করে, নিজের হাতে কাল তমালকে এই ভালোবাসার উপহারটি দেবে। যা হবার হবে।

সেই দিনটি এলো। আজ তমালের জন্ম দিন। সারা বাড়ীটাতে যেন আনন্দের মাতম লেগেছে। শিশুদের হাসি এবং সঙ্গীত বাতাসে ভরে উঠলো। সায়নী দাদীমার হাত ধরে এসে ছাদে উপস্থিত হলো। তার হৃদয় ধুক ধুক করে কাঁপছে বটে। কিন্তু মনটা বেশ শক্ত। বেশ স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করছে, যেন কিছুই হয়নি।

 

তবে আজ সকাল থেকেই সায়নীর মনটা একটু ভালো লাগছে। কাল রাতের মানসিক চাপটা যেন মর্জিনার কথায় কিছুটা হালকা হয়ে গেলো। আজ সকালে সায়নী তার রুমে বসে বসে কাল রাতের কথা ভাবছিলো। ঠিক এমন সময় মর্জিনা রুমে এসে হাজির। হাতে একটা প্যাকেট।

মর্জিনাঃ আপা আপনার মা আপনার জন্য একটা নতুন ড্রেস পাঠাইছে। জন্ম দিনের জইন্য এইডা পরতে কইছে। একটু পরে পার্লার থেইক্যা একজন আইসা আমনেরে সাজাইয়া দিব। নেন প্যাকেটটা।

মা ড্রেসটা পাঠিয়েছে শুনে সায়নী একটু ভালো বোধ করতে লাগলো। নিশ্চয়ই বাবা মাকে বুঝিয়েছে।

 

নতুন ড্রেসটি পড়েই দাদীমাকে নিয়ে যখন ছাদে আসে তখন ছাদের চারিদিকে হালকা বাতাসে রঙিন ব্যানার উড়ছে। প্রাণবন্ত বেলুন দিয়ে সজ্জিত সামিয়ানার সব খানে। সুস্বাদু খাবারের  সুগন্ধ বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে।

এক বিশাল গম্বুজের মতো জন্মদিনের কেক টেবিলে রাখা আছে। মোমবাতি দিয়ে সজ্জিত করা হয়েছে কেকটি। একটু পরেই কেক কাটা হবে।

"শুভ জন্মদিন" বলতে বলতে সকলের আনন্দময় বার্থ ডে কোরাসের সাথে মোমবাতিগুলি নিভিয়ে দেওয়া হবে। ছাদটি আনন্দ এবং করতালিতে ফেটে পড়বে কিছুক্ষনের মধ্যে। জীবন এবং ভালবাসার আরেকটি বছর উদযাপন হবে। তমাল নয় বছরে পা দিবে।

 

এটাই উত্তম সময় তমালের হাতে উপহারটি তোলে দেয়ার।

আস্তে আস্তে সায়নী কেক কাটার টেবিলে এগিয়ে গেলো। তমালের জন্য আঁকা উপহারটি কাঁপতে থাকা হাতে ধরে আছে। পাশে দাদীমাও ছিলো। তমালকে ঘিরে রেখেছে অসংখ্য ছেলে-মেয়ে। সায়নীর বয়সীও বেশ কয়েক জন আছে। অনেকেই ওর আত্মীয়-স্বজন। চেনা-জানা। বড়োরা ছাদের নানা পাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। কেউ দাঁড়িয়ে আছে, কেউবা টেবিলের পাশে চেয়ারে বসে কথা বলছিলো।

 

সায়নীর বাবা-মা তমালের পাশে দাড়িয়ে ছিলো তখন। বাবা-মা সায়নীকে দেখতে পায়। মা সায়নীকে ডাকলো-আয় মা। বাবা পাশে দাঁড়িয়ে সায়নীকে দেখছে। মুখে আনন্দের ঝলক।

দাদীমা সায়নীকে তমালের কাছে নিয়ে গিয়ে তমালকে ডাকলো:-দাদু ভাই, এদিকে দেখ। এই বলেই সায়নীকে বলে-এবার তোমার উপহারটা দাও।

 

সায়নি এবার পেইন্টিংটি তমালের সামনে তুলে ধরলো। তমালের দিকে চেয়ে বললো-হ্যাপী বার্থ ডে, তমাল। আমার ছোট্ট ভাই। এইটা তোমার জন্য। এই দেখ-এইটা তোমার ছবি।

 

হঠাৎ যেন ছাদের কোলাহলের মধ্যে একটা নিস্তব্ধতা নেমে আসে। তার অপূর্ব সৃষ্টিতে বিস্ময়ে সকলের চোখ বড় হয়ে যায়। স্থির হয়ে থাকে কিছুক্ষনের জন্য পেইন্টিং এর ক্যানভাসে। সকলেই অবাক হয়ে গেলো সায়নীর আঁকা ছবিতে।।

সেই মুহুর্তে সায়নী যেন তার বুকের সমুদ্রের মাঝে মৃদু বাতাসের মতো আনন্দের ঝলক অনুভব করলো। সবাই বাহ্ বাহ্ বলে করতালিতে সায়নীকে জড়িয়ে ধরলো।

হঠাৎ সায়নি টের পেলো তমালের ছোট দুটি হাত তার গলা পেঁচিয়ে ধরেছে। -থ্যাংক কি আপু। -এই বলেই সায়নীর দুগালে দুটি চুমু খেয়ে সায়নীকে জড়িয়ে ধরে। সায়নীও খুশিতে ছোট ভাইটিকে বুকে চেপে ধরে।

সায়নীর চোখ গিয়ে পড়লো তমালের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা বাবা-মায়ের দিকে। বাবার মুখে ছিলো খুশির পরাগ। বা হাতের আঙ্গুলে মা তখন চোখের কোন মুচছে।

চলবে---)



Read full book here: Click here to download the PDF file