সায়নীর স্বপ্ন-আট
Summary:
একমাত্র দাদীমাই সায়নীর কথা বুঝে, সায়নীর ব্যাথায় কষ্ট পায়। সায়নীকে খুব ভালোবাসে। দাদীমাই যেন সায়নীর একমাত্র বন্ধু। তবে মর্জিনাও সায়নীর মনের কথাগুলো বুঝতে পারে। সায়নীকে চোখে চোখে রাখে। কয়েক বছর ধরে এ বাড়ীতে আছে। থাকতে থাকতে সায়নীর প্রতি মর্জিনার কেমন একটা মায়া লেগে যায়। ইদানীং এই মায়া ভাবটা আরো যেন বেড়েছে। এখন সায়নীর সব কিছুই মর্জিনার নখ দর্পনে। দুজনের মধ্যে এক প্রাঞ্জল অব্যক্ত ভালোবাসার বন্ধন তৈরী হয়।
এই পুরানো ঢাকার কোলাহলপূর্ণ রাস্তায়, যেখানে ডাস্টবিন আর মেনহোলের গন্ধে বাতাস ঘন হয়ে উঠে। রিকশার টুংটাং ঘণ্টার শব্দ আর ঘন কালো ধূয়া নির্গত টেম্পুর বিরক্তিকর কান ঝাঁ ঝাঁ করা আওয়াজে বাতাস ভরে যায়, সেখানেই এক বিশাল সুন্দর প্রাসাদোপম পরিপাটি বাড়ীতে বাস করে সায়নীরা।
আর এই বাড়ীতেই একদিন পা রাখে মর্জিনা সায়নীর দেখভাল করার জন্য, বাড়ীর কাজের একজন সার্ভেন্ট হিসেবে। সায়নীর বয়স তখন ছয় বছর। মর্জিনার আঠারো।
প্রথম যখন মর্জিনা সায়নীর ঘরে ঢুকে সায়নীর মার সাথে সেই দিনটা ছিলো শনিবার। সে দিনটার কথা মর্জিনার বেশ পরিস্কার মনে আছে।
মর্জিনা সায়নীর ঘরে ঢুকেই অবাক হয়ে যায়। সায়নী তখন মেঝেতে বসে ছিলো। তার চোখ দুটি স্থির ছিলো তার সামনে ছড়িয়ে থাকা একটি রঙ্গিন পুতুলের উপর। হাতের কাছে ছিলো জিগস পাজলের টুকরোগুলি। সায়নী তখন আঙ্গুল দিয়ে টুকরোগুলো নাড়াচাড়া করছিলো মৃদু ভাবে আর ড্যাব ড্যাব করে পুতুলের দিকে তাকিয়ে আছে।
মর্জিনা কীভাবে সায়নীর দিকে এগুবে বুঝতে পারছিলনা। সায়নীর মা মর্জিনার সাথেই দড়জায় দাঁড়িয়ে ছিলো। এবার সায়নীর মা ডাকলো:
-মা সায়নী। দেখ কে এসেছে? তোমার বুবু। দেখ দেখ…এদিকে তাকাও…
বেশ কয়েক সেকেন্ড পর সায়নী সংক্ষিপ্তভাবে তাকালো। তারপর আবার নিজের কাজে ফিরে যায়। তার দৃষ্টি ছিলো ক্ষণস্থায়ী। ঠিক সেই সময় বেশ জোড়ে জোড়ে শব্দ করা শুরু করলো সায়নী ই ই ই ই------ই ই ই ই……ই ই ই------
মর্জিনা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে সায়নীর দিকে। আগে কখনো এমন শিশুর দেখাশুনা করেনি। গরীব ছিলো বলে স্কুল আর শেষ করতে পারেনি মর্জিনা। পনের বছর বয়সেই একটা হোটেলে রান্না ঘরের কাজে ঢুকে পরে। মর্জিনার আয়েই ওদের সংসারটা চলছে। বাবা পঙ্গু হয়ে ঘরে বসে আছে গত তিন বছর। আগে রিক্সা চালাতো। একদিন এক এক্সিডেন্টে ডান পাটা কেটে ফেলতে হলো। সেই থেকে মর্জিনা সংসারের হাল ধরে।
সায়নীর এই অবস্থা দেখে মর্জিনা বুঝতে পারলো যে সায়নীর সাথে যোগাযোগ করাটা অতো সহজ হবে না।
হঠাৎ সায়নীর মা বা হাত দিয়ে মর্জিনাকে হালকা করে ধাক্কা দিয়ে বললো: মর্জিনা, ওর কাছে যাও।
এবার মর্জিনা সায়নীর কাছে খুব আস্তে আস্তে পা টিপে টিপে এলো। সায়নীর পাশেই মেঝেতে বসে পড়লো। তারপর সায়নীকে ডাকলো:
-সায়নী। তুমি কেমইন আছো? কিতা খেলতেছ?
মর্জিনার কথায় সায়নীর কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। যেন কিছুই শুনতে পায়নি। এবার মর্জিনা আবার ডাকলো: সায়নী, আমার দিকে দেখ। আমার লগে কথা বলো।
হঠাৎ করেই সায়নী আবার ই ই ই ই------ই ই ই ই……ই ই ই------করে আওয়াজ শুরু করে দিলো। আঙ্গুল দিয়ে জিগস পাজলের টুকরোগুলিকে জোড়ে জোড়ে ঠেলা দিতে লাগলো। মর্জিনা এবার কিছু একটা বলতে যাবে ঠিক তখনি সায়নী বড়ো বড়ো চোখ করে ভয়ানকভাবে মর্জিনার দিকে তাকালো এবং সাথে সাথে ডান হাতের তর্জনী মর্জিনার মুখের সামনে এনে অনবরত পেন্ডুলামের মতো ঘুরাতে লাগলো। মুখে তখনো অনবরত ই ই ই ই------ই ই ই ই……ই ই ই------আওয়াজ করে যাচ্ছে। সায়নীর মুখ থেকে তখন লালাও পড়ছিলো। চোখ দুটিও এখন ডানে বায়ে ঘুরাতে লাগলো।
সায়নীর এই অবস্থায় মর্জিনা ঘাবড়ে যায়।
হুরমুর করে উঠেই দড়জার দিকে পা বাড়ায়। দেখতে পেলো সায়নীর মা তখনো দড়জায় ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। মর্জিনার দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বললো-কি রে? ভয় পেয়ে গেছিস?
মর্জিনার মুখটা কেমন ফ্যাকাসে হয়ে গেলো। পাছে খালাম্মা মর্জিনার ভয়কাতুর মুখটা দেখতে পায় সে ভয়ে আর লজ্জায় মুখে জোড় করে এক ঝলক হাসি লেপ্টে দিয়ে মাথা ডানে-বায়ে নেড়ে বলে উঠলো `না না খালাম্ম। ও যেন বিরক্ত না অয় এলাইগ্যা আর বইলাম না। আইজগা প্রথম বারতো। ঠিক দেখবেন আমি হামলাইয়া নেয়াম`।
-তাই যেন হয়। চল, তোকে সায়নীর দাদীমার কাছে নিয়ে যাই। উনি তোকে সব কিছু বুঝিয়ে দিবে। তার পর আমি সব কিছু দেখিয়ে দিবো-সায়নীর মা এই কথাগুলি বলে মর্জিনাকে নিয়ে এখান থেকে চলে যায়।
সায়নী আবার নিজের মনে পুতুলের সাথে খেলা শুরু করে। মুখের আওয়াজটা এখন আর নেই।
যত দিন যাচ্ছে, মর্জিনা ক্রমশ হতাশ হতে লাগল।
সায়নী সব সময় উদাসীন থাকে। একা একা খেলে। কথা বললে কোন উত্তর দেয় না। আবার কখনো উত্তর দিলে অন্যদিকে তাকিয়ে থাকে। মর্জিনার উপস্থিতি সম্পর্কে উদাসীন বলে মনে হয়। বুঝতেও পারেনা মর্জিনা ওর পাশে আছে বা ওকে কিছু বলছে। সবসময় তার নিজের ধাঁধা, খেলাধুলা এবং প্যাটার্নের জগতে হারিয়ে যায়। কোন টিকটিকি বা পিঁপড়ে দেখলেই খুব খুশিতে ধরার চেষ্টা করে। খুশীতে উৎফুল্ল হয়।
সায়নীর কারনে মাঝে মধ্যে মর্জিনা বেশ মন খারাপ করতো। কখনো বা উত্তেজিত হয়ে যেতো। রাগ করতো। ইচ্ছে হতো গালে এক থাপ্পর কসায়। কিংবা নখ দিয়ে পেটে চিমটি কেটে দেয়। কিন্তু মনে মনে এসব ভাবলেও পরক্ষনেই মনটা মায়ায় ভরে যেত।
"কেন বিরক্ত হও মর্জিনা?" নিজের সাথে নিজেই মর্জিনা কথা বলতে থাকে। মনে মনে ভাবে- "সে এখনো ছোট। ও যে স্বাভাবিক নয়। এমনকি সায়নী এটাও জানে না আমি এখানে আছি।"এ সব ভাবতে ভাবতে মর্জিনার মনে সান্তনার হাওয়া আছরিয়ে পড়ে।
মাঝে মাঝে হতাশা থাকা সত্ত্বেও মর্জিনা বেশ অনড় থাকে।
খুব মনযোগ দিয়ে সায়নীকে বুঝার চেষ্টা করতো, খুব শান্ত কিন্তু দৃঢ়তার সাথে সায়নীর চাহিদা পূরণ করতে লাগলো। প্রতি দিন তার হৃদয় ধীরে ধীরে নরম হতে থাকে। কেমন একটা ভালোবাসার অনুভূতি মর্জিনাকে আবিষ্ঠ করে রাখে। ঘনিষ্ঠভাবে সায়নীকে পর্যবেক্ষণ করতে শুরু করে, তার আচরণের ধরণগুলি খুব কাছ থেকে লক্ষ্য করে। যে জিনিসগুলি সায়নী খুব পছন্দ করে, যা দেখলে সে খুব স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে, চোখে মুখে আনন্দের ছোঁয়া লাগে সেগুলিকে মর্জিনা খুব গভীরভাবে লক্ষ্য করতে থাকে।
ধীরে ধীরে মর্জিনা সায়নীর বাহ্যিক আচরণকে বুঝতে লাগলো।
সে বুঝতে পারলো যে সায়নীর প্রকৃতির প্রতি নিবির ভালবাসা আছে। সবুজ গাছ পালাকে সায়নী পছন্দ করে। ছোট ছোট পোকা মাকড় ওর ভীষন প্রিয়। একা একা ড্রইং করতে সায়নী খুব ভালোবাসে। ওর ড্রইং দেখে কেউ খুশী হলে বা ওকে প্রশংসা করলে সায়নীর খুশিতে চোখ দুটি ছল ছল করে ফুটে উঠে। বাগানের মধ্য দিয়ে প্রজাপতি উড়ে যাওয়া বা মাথার উপরে উড়ে আসা পাখি দেখে তার চোখ জ্বলজ্বল করে। একা একা কোন কিছু নিয়ে খেলতে বা ভাবতে ও পছন্দ করে। এর মধ্যে কোন বিরক্তির ঘটনা ঘটলেই ও ই ই ই ই------ই ই ই ই……ই ই ই------আওয়াজ করে বিরক্তি প্রকাশ করে। খুব বেশী রেগে গেলেই চোখ ঘুরানো সহ তর্জনীর কসরত শুরু করে। এই ব্যাপারগুলি মর্জিনার এখন নখোদর্পনে।
সময় করে সপ্তাহের দুই তিনটা দিন মর্জিনা সায়নীকে নিয়ে পাশেই খালুদের বাগানে নিয়ে যায়। মাঝে মধ্যে বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে হাঁটতে নিয়ে যায় ড্রাইভারকে সাথে নিয়ে। জলের ধারে ফুটে থাকা জলজ ফুলগুলোকে হাত দিয়ে কখনো-সখনো ধরতে গিয়ে আনন্দে হেসে উঠে । তার হাসি যেন গাছেদের মধ্য দিয়ে বাতাসের মৃদু শব্দে মিশে যায় শূন্যে।
এই ভাবেই সময়ের বুকে হামাগুড়ি দিয়ে চলতে ফিরতে মর্জিনা আর সায়নীর মধ্যে হয় একটি অনিন্দ্য সুন্দর অব্যক্ত বন্ধন। একে অপরকে বুঝার ক্ষমতা বাড়তে লাগলো। মর্জিনা সায়নীর নানা কাজগুলিকে গুরুত্ব দিতে লাগলো। কোন ভাবে যেন সায়নীর কোন ব্যাঘাত না ঘটে সেভাবে চলতে শূরু করলে। এ যেন গ্রহণযোগ্যতা এবং নিঃশর্ত ভালবাসার এক অনবদ্য উপহার।
একদিন এক সুন্দর সন্ধ্যায়, সায়নীর রুমের বারান্দায় একসঙ্গে বসে পুরান ঢাকার আকাশে সূর্যাস্ত দেখছিলো দুজনে। হঠাৎ মর্জিনার ডান হাতটি সায়নীর গায়ে গিয়ে জোড়ে লাগে। সায়নীর দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে গিয়ে মর্জিনা লক্ষ্য করলো সায়নী তার দিকে তাকিয়ে মিট মিট করে হাসছে, তার চোখ দুটি নতুন উষ্ণতায় জ্বলজ্বল করছে। সেই মুহুর্তে, মর্জিনার বুকটা খুশিতে ভরে উঠলো। সে বুঝতে পারলো সায়নী ওকে সত্যিই ভালোবাসে। শুধু একজন কাজের মেয়ে হিসেবে নয়, একজন অসাধারণ বন্ধু হিসেবেই যেন মর্জিনা এ বাড়ীতে আছে। এ ভেবে মর্জিনার চোখে জল এসে যায়।
-আমার কিচ্ছু হয়নি, বুবু-সায়নী মর্জিনাকে হাসতে হাসতে বলে।-দেখ, দেখ, সূর্যটাকে লাল থালার মতো লাগছে। ঐ যে ডুবে গেল। কি সুন্দর!
মর্জিনা: ঠিক কইছো, কত্তো সুন্দর।
যদিও তাদের শুরুটা হয়েছিলো অনিশ্চয়তা এবং সন্দেহের সাথে কিন্তু বছর যেতে না যেতেই দুজনের মধ্যে একটা নিবিড় সখ্যতা গড়ে উঠে।
পুরান ঢাকার প্রাণবন্ত রাস্তায়, দৈনন্দিন জীবনের ব্যস্ততার মধ্যে, মর্জিনা এবং সায়নী সাহচর্যের প্রকৃত অর্থ খুঁজে পায়। ধীরে ধীরে দূর হতে থাকে দুটি আত্মার ব্যবধান।
মর্জিনা নানাভাবে সায়নীকে সঙ্গ দিতো। তার জুতার ফিতা বাঁধা থেকে শুরু করে , স্কুলের ব্যাগ গুছিয়ে দেয়া, স্নানের সময় সব কিছু গুছিয়ে রাখা, স্কুলে নিয়ে যাওয়া -নিয়ে আসা, এক সাথে পোকা-মাকড় কিংবা সায়নীর প্রিয় বন্ধু তোতাপাখির সাথে খেলার ছলে গড়ে উঠে নিবিড় সখ্যতা।
সায়নীর বয়েস যখন আট তখন সায়নীর বাবা বাড়ীতে নিয়ে আসেন একজন অটিস্টিক বিশেষজ্ঞ ড. রেবেকা থম্পসনকে। উনি আমেরিকান এক প্রাইভেট হাসপাতালের ডাক্তার এবং মনো বিশেষজ্ঞ। ডঃ থম্পসনের কাছে সায়নী ছিলো একটি বিরল উপহার। সপ্তাহে দুদিন তিনি সায়নীদের বাড়ীতে আসতেন স্পেশাল থেরাপি দেওয়ার জন্য।
সায়নী অটিস্টিক শিশু হলেও কথা-বার্তায় তেমন কোন অসুবিধা ছিলো না। ওকে দেখলে কারোরই মনে হবে না যে সায়নী একজন অটিস্টিক। তবে কিছুক্ষন ওর সাথে থাকলেই বুঝা যাবে তার মধ্যে বেশকিছু সমস্যা আছে। যেমন সায়নী একা একা থাকতে খুব পছন্দ করে। তার আশে-পাশে কারো উপস্থিতি কখনো-সখনো বুঝতে পারে না। সব সময় অন্য দিকে তাকিয়ে কারো সাথে কথা বলে। চোখে চোখ রেখে কথা বলতে পারে না। বিরক্ত হলেই এক ধরনের আওয়াজ শুরু করে কিংবা তর্জনী ঘুরানো শুরু করে। কারো প্রশ্নে তাড়াতাড়ি সাড়া দিতে পারে না বা মাঝে মাঝে কাউকে শুনতে পায় না বলে মনে হয়। প্রায় সময়ই পুনরাবৃত্তিমূলক নড়াচড়া করে যেমন নিজে নিজে শরীরটাকে দোলায়, ঘাড় ঘোরানো বা হাত ঝাঁকানো, একই শব্দ বা বাক্যের পুনরাবৃত্তি করে। আর সবচেয়ে যে ব্যাপারটা সবাইকে বিব্রত করে সেটা হলো অনবরত প্রশ্ন করা। যেমন যেদিন প্রথম ডাক্তারের সাথে সায়নীর দেখা হয় সেই সময় অনেকক্ষন ডাক্তার রেবেকাকে অবান্তর সব প্রশ্ন করে।
ডাক্তারঃ হ্যালো সায়নী! গুড মর্নিং। আমি রেবেকা। তোমার সাথে এইটা কে?
সায়নী তখন একটা পুতুল নিয়ে খেলছিলো। রেবেকার প্রশ্নের কোন উত্তর দিলো না। নিজের মনে পুতুলটিকে বুকে নিয়ে ঘুম পাড়াচ্ছিলো। এইবার রেবেকা পুতুলটির গায়ে হাত দিলো। সাথে সাথে সায়নী বিরক্তির চোখে রেবেকার দিকে তাকায়।
ডাক্তার (কানে হাত দিয়ে): আই এম সরি মাই ডিয়ার। তুমি কার সাথে খেলছো?
সায়নী: ও আমার বন্ধু! কিন্তু তুমি কে?
ডাক্তার: আমি ডাক্তার রেবেকা। তোমার সাথে খেলতে এসেছি।
সায়নী: (কিছুক্ষন নিরবতা, তারপর অন্যদিকে তাকিয়ে)-তুমি আমার সাথে খেলবে? তুমি কত্তো বড়ো আমার মার থেকেও বড়ো। আমার মাই কখনো আমার সাথে খেলে না আর তুমি খেলবে কী? তুমি মিথ্যে বলছো?
ডাক্তার: আমি মিথ্যে বলি না। ডাক্তার কি কখনো মিথ্যে বলে?
সায়নী: (মেঝেতে তাকিয়ে) তুমি কি পুতুলের ডাক্তার! আমার বন্ধুটি ঘুমাচ্ছে না কেন?
ডাক্তার: আমি মানুষের ডাক্তার। তোমার বন্ধুতো ঘুমিয়ে আছে। এখন বলো তুমি কেমন আছো?
সায়নী (অন্যদিকে তাকিয়ে)-আমি ভালো আছি। আচ্ছা তমি এতো সাদা কেন? তোমার গায়ের রং এতো ফর্সা কেন? তোমার চুলগুলিওতো সব পেকে গেছে। তুমি কি আমার দাদীমার চেয়েও বড়ো।
ডাক্তার (হাসতে হাসতে): এতো প্রশ্ন করলে আমি উত্তর দেবো কিভাবে? আমার বাড়ী আমেরিকাতে। আমেরিকানদের গায়ের রং ফর্সা হয়।
সায়নী: আমেরিকা কোথায়? তুমি আমেরিকায় থাকো কেন?
এইভাবেই চলতে থাকে দুজনের কথাবার্তা আরো কিছুক্ষন।
প্রথম দুদিন ডাক্তার রেবেকা থম্পসন সায়নীকে ভালোভাবে পর্যবেক্ষন করলেন তারপর ধীরে ধীরে শুরু করলেন থেরাপি সেশনগুলি।
ডাক্তার থম্পসন সায়নীকে তার চারপাশের জগত অন্বেষণ করতে উৎসাহিত করার জন্য শুরু করলেন সংবেদনশীল কার্যকলাপ। শিশুতোষ গল্প এবং ইতিবাচক খেলাধূলার সমন্বয় ব্যবহার করে আলতোভাবে সায়নীকে তার নিজস্ব একাকীত্বের খোলস থেকে বের করে আনার চেষ্টা করলেন। ঘরের দেয়ালে নানা ধরনের পশু-পাখি, আর পোকা-মাকড়ের ছবি লাগানো হলো।
প্রথম কয়েক সপ্তাহ সায়নীকে খুব ভালোভাবে পর্যবেক্ষন করা শুরু করলেন। সপ্তাহে প্রায় দুই ঘন্টা ওর সাথে নানা ভাবে সময় দিয়ে কথা বলার চেষ্টা করতেন। শুরু হলো ফিজিওথেরাপি। ঠিক মতো বসা, উঠা, দাঁড়ানো এবং হাঁটা সহ বেশ কিছু নড়াচড়ার দক্ষতার উপর সেশন শুরু করলেন। মাস খানেক পরে শুরু হলো জটিল নড়াচড়ার দক্ষতার উপর ফোকাস যার মধ্যে ছিলো লাফ দেওয়া, সিঁড়ি বেয়ে ওঠা, নিক্ষেপ করা এবং ধরার মতো ব্যায়াম গুলো।
তবে সবাই একটা জিনিস লক্ষ্য করলো যে সায়নী ডাক্তারের প্রতি কোন বিরক্তবোধ করছে না। ডাক্তারের সাথে ব্যায়ামগুলো ঠিকঠাক মতোই করছে।
তবে প্রথমদিকে, সায়নীর তেমন কোন অগ্রগতি ছিলো না।
কিন্তু সময়ের সাথে সাথে যেন পরিবর্তন দেখা গেলো, যেমন করে একটি ফুল সূর্যের দিকে প্রসারিত হওয়ার সাথে সাথে ধীরে ধীরে উন্মোচিত হয়। সপ্তাহগুলি মাসগুলিতে পরিণত হওয়ার সাথে সাথে, তার বাবা-মা, দাদীমা তাদের মেয়ের মধ্যে সূক্ষ্ম পরিবর্তনগুলি লক্ষ্য করতে শুরু করলেন - তার চোখে কৌতূহলের স্ফুলিঙ্গ, তার ঠোঁটের কোণে একটি অস্থায়ী হাসি খেলা করতে শুরু করে। আগের মতো আর একটু বিরক্ত হলে ই ই ই ই------ই ই ই ই……ই ই ই------আওয়াজ করে না ঘন ঘন। এই ব্যাপারটা এখন অনেক খানিই কমে গেছে।
এক বছর পর পর থেকেই সায়নী মোটামুটি ভালোভাবেই কথা বলতে শিখেছে। কারো প্রশ্নের উত্তর দিতে এখন আর আগের মতো অতো সময় লাগে না। মানুষের উপস্থিতিটাও সায়নী এখন বুঝতে পারে।
দিন দিন সায়নীর আত্মবিশ্বাস বাড়তে থাকে।
তার একাকীত্বের নিঃশব্দ কণ্ঠ ডাক্তারের কথা-বার্তায় যেন কিছুটা সুর খুঁজে পায়।
ডাক্তার থম্পসনের নিবির ভালোবাসা ও থ্যারাপীর মাধ্যমে সায়নী ধীরে ধীরে অটিজমকে তার জীবনের সীমাবদ্ধতা হিসেবে নয়, বরং তার পরিচয়ের একটি অনন্য দিক হিসেবে গ্রহণ করতে শিখেছে। মর্জিনা খুব কাছ থেকে সায়নীর মধ্যে ইতিবাচক পরিবর্তনগুলি লক্ষ্য করছিলো। তার পরিবারও বিস্ময়ের সাথে দেখছিলো। যে বাধাগুলি একসময় সকলের কাছে অপ্রতিরোধ্য বলে মনে হতো তাদের চোখের সামনে সেগুলি সময়ের সাথে সাথে ভেঙ্গে পড়তে শুরু করে।
সায়নীর বয়েস যখন এগার তখন থেকেই সায়নীর মধ্যে অনেক কিছুতেই ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে। তিন বছর পর ডাক্তার নিয়মিত আসা বন্ধ করে দেন। যাওয়ার আগে ডাক্তার সায়নীর বাবা-মা ও দাদীমাকে অনেকগুলো পরামর্শ দিয়ে যায় সায়নীর দেখাশুনার জন্য। তখন মর্জিনাও পাশে দাঁড়িয়েছিলো।
ডাক্তার বললেন সায়নীকে নিয়ে যেন নিয়মিত হাঁটাহাঁটি করানো হয়। অন্য শিশুদের সাথে মেলা-মেশায় কিংবা খেলা-ধূলায় উৎসাহিত করা, ওর সাথে সায়নীর প্রিয় জিনিসগুলি করার সময় সঙ্গ দেওয়া। একটি খেলার মাঠ খুঁজে বেড় করা যেখানে সায়নী খেলতে পারবে, তবে আশে-পাশের পরিবেশটা যেন হয় সংবেদনশীল। অটিস্টিক শিশুদের জন্য নাকি তাজা বাতাস, রোদ, এবং নিয়মিত ব্যায়াম করা খুব প্রয়োজন।
সায়নীর জীবনে শুরু হলো নতুন এক অধ্যায়। দাদীমার মতো মর্জিনাও হয়ে উঠে সায়নীর চলার পথে সাথী।
চলবে---)
Read full book here: Click here to download the PDF file