সায়নীর স্বপ্ন-ছয়
Summary:
আজকের ঘটনাটির জন্য সায়নী প্রস্তুত ছিলো না।
ভাবতেও পারেনি এমন এক প্রচন্ড মানষিক ঝড় ওর উপর দিয়ে বয়ে যাবে। কেমন লন্ড ভন্ড লাগছে সব কিছু। বিষাদের কালো ছায়ায় ঢেকে যাচ্ছে সায়নীর চির চেনা পৃথিবীটা। এক নিরবচ্ছিন্ন ঝড় মনের মধ্যে যেন অনবরত বোমাবর্ষণ করে যাচ্ছিলো। অপ্রতিরোধ্য আবেগের সাগরে যেন হাবুডুবু খাচ্ছিলো।
মাঝে মাঝে সায়নী ভাবে এই মা কি সত্যিই তার নিজের আপন মা? কেমন করে একজন মা তার সন্তানের প্রতি এমন দূর্ব্যাবহার করে, তাচ্ছিল্য করে, খারাপ খারাপ ভাষায় বকাবাদ্য করে, মারধর করে। কই তমালকে তো কখনো বকা দেয় না? ঘরে যতোক্ষন থাকে ততোক্ষনই তমালকে নিয়ে ব্যস্ত থাকে, খেলাধূলা করে, গান শুনায়।
সায়নীর খুব আপসোস সত্যিকারের মায়ের ভালোবাসা কোনদিন সে পায়নি। সে বুঝতে পারে মায়ের ভালোবাসা সত্যিই অমলীন। খেলার মায়াবী নৃত্যে, একজন মায়ের ভালবাসায় থাকে অগণিত সুন্দর অভিব্যক্তি। তমালকে দেখলেই তা বুঝা যায়। মা যখন ওর সাথে পুতুল নিয়ে কিংবা গাড়ী নিয়ে খেলতে বসে তখন তমালের মুখের হাসি বাতাসে বেজে ওঠে, আনন্দের ঝর্নার ফোয়ারা যেন সারা চোখে মুখে লেগে থাকে। মায়ের কোমল স্পর্শ এবং উষ্ণ আলিঙ্গনে ভালবাসা তার মৃদু পথ খুঁজে পায়, তমালের ছোট্ট জগতে নিরাপত্তা এবং আরাম নিশ্চিত করে।
সায়নীও চেয়েছিলো মায়ের চোখের ঝলকানি আর দুহাতের মাঝে নিজকে জড়িয়ে নিতে, চোখে মুখে নাকের ডগায় আলতো করে ঘষতে। অসংগঠিত খেলার সরলতায় মেতে থাকতে, মায়ের বুকে আচল দিয়ে নিজকে ঢেকে নিশ্চিন্তে শুয়ে থাকতে আচলের গন্ধ শুঁকতে শুঁকতে।
কিন্তু সায়নীর কপালে এতো সুখ নেই। ছোট কাল থেকেই ভালোবাসাহীন ভাবেই বেড়ে উঠেছে। কেউ কখনো ওকে আগলে ধরে জড়িয়ে ধরেনি। আদর করে চুমু খায়নি। মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়নি, শুধু দাদীমা ছাড়া।
বুজ হওয়ার পর থেকেই দাদীমার সাথেই থেকেছে বেশীর ভাগ সময়। দাদীর কোলে শুয়ে শুয়ে ঠাকুর মার ঝুলির অনেক গল্প শুনেছে। কাকনমালা, কাঞ্চনমালা, নীলকমল আর লাল কমল, ঘুমন্ত পুরী আর দুধের সাগরের গল্প শুনতে শুনতে পরম নিশ্চিন্ত শুয়ে পড়তো। মাথার চুলে দাদীর ডান হাতের আঙ্গুলগুলো তখনো বিনুনী কাটতো।
সায়নীর খুব ইচ্ছে করে তমালের সাথে খেলে। ওর সাথে কিছুটা সময় কাটায়। তমাল খুব হাসি খুশী। সবসময় ঘরে হৈ চে করে বেড়ায়।পুতুল নিয়ে খেলতে ভালোবাসে। গাড়ী ওর খুব পছন্দের। প্রতি সপ্তাহেই বাবা তমালের জন্য গাড়ী নিয়ে আসে। নানা ধরনের মুভি ক্যারেক্টারের গেইম কার্ডও নিয়ে আসে। কার্ডগুলো নিয়ে তমাল নিজে নিজেই খেলে। এতে খুব মজা পায়। তবে তমালের প্রিয় গেইম কার্ডের গাড়ীগুলোর মধ্যে পোকেমন, ইউ-গি-ওহ!, এবং ম্যাজিক: দ্য গ্যাদারিং খুব প্রিয়। ডিজনী মুভির প্রায় সবগুলো ক্যারেক্টারের জনপ্রিয় কার্ডগুলো সংগ্রহে আছে।
আর গাড়ী আছে অসংখ্য। রেস কারগুলি প্রায়শই মসৃণ, রঙিন। নামী-দামী সব স্পোর্টস কার। ল্যাম্বরগিনি, ফেরারি এবং পোর্শের মতো স্পোর্টস কারের খেলনা গুলি তমালের খুব পছন্দ। আগে বাথরুমে স্নান করার সময় অনেকগুলি খেলনা গাড়ী নিয়ে যেতো। বাথটাবের জলে নিয়ে অনেকক্ষন ধরে খেলতো। সবগুলো খেলনা গাড়ীগুলো রিমোর্ট দিয়ে চলে। দাদীমার সাথেও তমাল গাড়ীগুলো নিয়ে খেলে। দাদীমা ল্যাম্বরগিনিকে লম্বা গিন্নি বলে ডাকে। তমাল তখন হাসতে হাসতে লুটো পুটি খায়। দাদীমাকে শিখিয়ে দেয়-
-লম্বা গিন্নি না দাদীমা। ল্যাম্বরগিনি
দাদীমা তাও বলতে পারে না। দূর থেকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সায়নী ওদের খেলা দেখে।
তমাল যখন ছোট ছিলো তখন সায়নী তমালের সাথে খেলতো। খুব মজা করতো। পুতুল নিয়ে খেলতো। গায়ে কাতুকুতু দিতো। সাথে সাথে তমাল খিল খিল করে হেসে উঠতো। কি আনন্দের ছিলো সেই দিনগুলো।
কিন্তু একদিন কি হোল, সায়নী জোড়ে একটা টেনিস বল দেয়ালে মারতে গিয়ে বলটা দেয়ালে না গিয়ে সোজা গিয়ে পড়লো বাড়ীর ছাদে দোলনায় দাদীমার কোলে বসে থাকা তমালের কপালে গিয়ে। তখন তমালের তিন বছর। সাথে সাথে তমাল চীৎকার করে উঠলো। সায়নী একেবারে হতভম্ব। কি করবে বুঝতে পারছিলো না। খুব ভয় পেয়ে যায়। কাঁদতে শুরু করে। ভাবছে তমালের কোন ক্ষতি হলো কিনা।
তমালের কান্নার শব্দ শুনে মা দৌড়ে এসে সায়নীকে খুব বকাবাদ্য করে। বলে উঠে সায়নী নাকি অলক্ষী। তারপর থেকে সায়নীকে তমালের সাথে আর খেলতে দেয়নি।
সায়নীর ভাবনারা আবার পাখা মেলতে থাকে।
মায়ের কোলে কখনো শুয়েছিলো কিনা সায়নীর মনে পড়ে না।
অথচ তমালের জন্য মায়ের কতো চিন্তা। স্কুলে নিজে নিয়ে যায় এবং নিয়ে আসে। নিজের হাতে মজার মজার খাবার বানিয়ে দেয়। আদর করে ঘুম পাড়ানিয়ার গান শুনিয়ে ঘুম পারিয়ে দেয়।
সায়নীর মা কখনো সায়নীকে ঘুম পারিয়ে দিয়েছে বলে তো মনে হয় না? কখনো তো সায়নীর জন্য খাবার বানিয়ে আনে নি? সায়নীর কতো কিছু না খেতে ইচ্ছে করে। আগে মাকে বলতো-
-মা আমি চাইনিজ সুইট পটেটো স্যুপ আর গ্রীন চিলির হট পাস্তা খেতে চাই।
-আমার সময় নেই। আমি মর্জিনাকে বলে দিয়ে যাচ্ছি, ও তোমাকে বানিয়ে দেবে। -মর্জিনা কাজের মেয়ে। শুধু মাত্র সায়নীকে দেখাশুনা করার জন্য ওকে আনা হয়েছে এ বাড়ীতে। ও নাকি একটা বিদেশী রেষ্টুরেন্টে কাজ করতো। প্রধান শেফকে সাহায্য করতো। রান্না-বান্নায় বেশ হাত আছে। বাঙ্গালীর-চাইনিজ-টার্কিস-ইংলিশ-সাউথ ইন্ডিয়ানের পপুলার ডিসগুলি বেশ খাস্তা করে বানাতে পারে।
মর্জিনাকে এই বাড়ীতে আনা হয়েছে শুধুমাত্র সায়নীকে দেখাশুনার জন্য। খাবার থেকে শুরু করে, স্কুলে যাওয়া আসা, জামা-কাপড় পরিস্কার করা, শোয়ার রুম, বাথ রুম সহ যেখানে যেখানে সায়নী এ বাড়ীতে যায় সব নিঁখুতভাবে পরিস্কার করে রাখা মর্জিনার কাজ। রাতে সায়নীর বেডে না যাওয়া পর্যন্ত মর্জিনা জেগে থাকবে। আবার সকালে সায়নী ঘুম থেকে উঠার আগেই জেগে উঠতে হবে। স্কুলের দিন হলে সায়নীর স্কুলের ব্যাগ গুছাতে হবে, সকালের খাবারের ব্যাবস্থা করতে হবে, সায়নীকে তৈরী হওয়ার জন্য সাহায্য করতে হবে। মর্জিনার সকালটা খুব ব্যস্ততায় কাটে।
স্কুল থেকে আসার পর সায়নীর আজ কিছুই খাওয়া হয়নি। এর আগেই ঘটে গেলো তুলকালাম কান্ডটি।
নিজের রুমের কড়িডোরের গ্রীল ধরে অশ্রুসজল চোখে উদাস ভাবে দুরের আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে সায়নী। মনটা ভীষন খারাপ। বুকের উপর যেন একটা ভারী পাথর চাপা আছে। কিছুক্ষন আগে যা ঘটে গেছে তা নিয়েই ভাবছে। মাঝে মধ্যে নিজকে খুব অসহায় মনে হয় সায়নীর। এক দাদীমা ছাড়া কেউ যেন সায়নীকে সহ্য করতে পারে না। একা একা কাঁদে। কেউ তার দুঃখের সাথী নেই। হাত দিয়ে চোখ মুছিয়ে দিয়ে সান্তনা দেবার কেউ নেই।
তবে তার প্রিয় বন্ধু তোতাপাখিটার মন কাঁদে। সায়নীর মন খারাপ হলে ও বুঝতে পারে। সায়নী যখন ডুকরে কেঁদে উঠে তখন পাখিটির মনটাও যেন হাহাকার করে উঠে। কালো চোখ দুটি জলে ভরে যায়। অস্থিরতায় অনবরত এপাশ ওপাশ করতে থাকে। মাঝে মধ্যে ফিস ফিস করে বলে উঠে-
-সায়নী, সায়নী, তুমি কেঁদো না।
আজ সকালে স্কুলের প্রধান শিক্ষক সম্ভবত মাকে ফোন করে সব জানিয়েছিলেন।
যথা সময়েই স্কুল থেকে সায়নী ঘরে ফিরে আসে। নিজের রুমে এসে স্কুল ড্রেসটা খুলতে যাবে এমন সময় সায়নীর মা দরজায় কোন ঠক ঠক আওয়াজ না করেই সায়নীর রুমে ঢুকে পড়ে সরাসরি। মাকে অগত্যা এ ভাবে আসতে দেখে সায়নী একটু ঘাবড়ে যায়। মাকে কখনো এ ভাবে রুমে আসতে দেখেনি সায়নী। আজ বেশ রুক্ষ মূর্তি। মুখটা যেন তেলে-বেগুনে জ্বলছে। মায়ের দিকে তাকাতেই সায়নীর মা চীৎকার করে উঠলো-
-কি করেছ তুমি স্কুলে? কার সাথে তুমি মারামারি করেছ? তুমি কি স্কুলে যাও বদমাইশি করতে? অসভ্য মেয়ে কোথাকার! দস্যিপনা দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে, না?
সায়নী অন্যদিকে তখন এক দৃষ্টিতে তাকিয়েছিলো। চোখের পাপড়িগুলো যেন ক্লান্তিতে নড়ছে। ঠোঁট দুটি কেঁপে কেঁপে উঠছে। মায়ের কথায় নাকের দুপাশের হালকা পাতলা চামড়াগুলো ফুলে উঠছিলো। পায়ের আঙ্গুলগুলি শক্ত করে ফ্লোরে চেপে দিচ্ছিলো। ভীষন কান্নায় গলাটা ভিজে যাচ্ছিলো কিন্তু নিজকে সামলিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে।
-কি হলো, চুপ করে আছো কেন? আমার কথার উত্তর দাও। কি করেছিলে স্কুলে?
এবার সায়নী তার মায়ের দিকে তাকালো। ফ্যাল ফ্যাল করে সজল চোখে চেয়ে রইলো কিছুক্ষন। মনের ভিতরে তখন কষ্টগুলো আথালি-পাথালি করে উঠছিলো। এবার মুখ খুললো-
-আমি ও-কে মারিনি মা। ও আমাকে মেরেছে আগে। সে একটা পচা মেয়ে। বিশ্বাস করো
-তুই মারতি গেলি কেন? কেন বার বার সবাই তোর বিরুদ্ধে কমপ্লেইন করে। কেউ তোকে পছন্দ করে না কেন, ভেবেছিস একবার? কারন তুই অটিস্টিক। তুই একটা অসুস্থ মেয়ে। তোর পাগলামীর জন্য কেউ তোকে পছন্দ করে না। দিন দিন ধেংরি হয়ে উঠছিস আর পাগলামীও বেড়ে যাচ্ছে।
তুই বলাতে সায়নী মোটেও অবাক হয়নি। আগেও বেশ কয়েকবার এমনটি হয়েছে। মাথায় রাগ চাপলেই সায়নীর মা এমনটি করে। আবোল-তাবোল বকতে থাকে।
-কিন্তু আমি কি করবো মা? কেউতো স্কুলে আমাকে ভালোবাসেনা। তুমিও আমাকে সব কিছু না জেনে না শুনে বকলে। তোমরা কেউ আমাকে ভালোবাসো না। আমি কোথায় যাবো? আমার কথা শুনার মতো কেউ নেই। তুমি এখান থেকে যাও এখন। আমার কিছু ভালো লাগছে না।
-চুপ করো! মুখে মুখে তর্ক করো লজ্জা করে না-প্রচন্ড ধমকের সুরে চীৎকার করে উঠে সায়নীর মা।
-আমি তো কিছু বলছি না। তুমিইতো চীৎকার করে কথা বলছো।
সায়নীর কথা শেষ হতে না হতেই সায়নীর মা প্রচন্ড জোড়ে ডান গালে একটি ঠাস করে থাপ্পর কষিয়ে দেয়। সাথে সাথে বা হাতের মুঠি ধরে সায়নীর চুলে খপ করে ধরে টানতে থাকে দড়জার দিকে। আর জোড়ে চীৎকার করে বকাবকি করতে থাকে।
-আজ তোর একটা ব্যাবস্থা করবো। অসভ্য মেয়ে কোথাকার! কথায় কথায় তর্ক….
চুল ধরে টানা হেচড়াতে সায়নীর বেশ কষ্ট হচ্ছিলো। এমনটি আগে কখনো ঘটেনি। বকাবাদ্য পর্যন্তই শেষ। এই প্রথম মা সায়নীকে থাপ্পর মারলো। কেন জানি হঠাৎ সায়নী সহজ সরল কিশোরী প্রানটা ব্যাকুল হয়ে উঠলো। চোখের পাতা ভারী হয়ে উঠলো। সায়নীর চোখ দিয়ে অশ্রুগুলি গাল বেয় স্রোতের মতো চিবুক বেয়ে পড়ছিলো। প্রতিটি ফোঁটা যেন সায়নীর আত্মাকে দুঃখের পাথরে পিষে মারছে। ডুকরে কেঁদে উঠলো এবার। বাঁধ ভাঙ্গা কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো সায়নী। কম্পিত শ্বাস-প্রশ্বাস এবং কাঁপানো ঠোঁটের আবেগে অব্যক্ত বেদনারা জমে উঠতে লাগলো। মুহূর্তের মধ্যে সায়নীর পৃথিবীটা তুচ্ছতায় বিবর্ণ হয়ে গেল। মনে হলো এতো বড়ো পৃথিবীতে ও একা। অটিস্টিক হয়ে জন্ম নেওয়া যেন এক অভিশাপ, মহাপাপ। লজ্জার, ঘৃনার এবং অবজ্ঞার।
এবার দুহাত সামনে এনে করজোড়ে সায়নী কান্নাজড়িত কন্ঠে মাকে বলতে থাকে-
-আমাকে ছেড়ে দাও মা। আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। আমাকে মাপ করে দাও। আর কক্ষনো বলবো না। আমাকে আর কষ্ট দিওনা মা। আমি তাহলে মরে যাবো…
ঠিক সে সময় মাকে একটা ধাক্কা দিয়ে দাদীমা সায়নীকে মায়ের কাছ থেকে সরিয়ে নেয়। প্রচন্ড ক্ষোভে কাঁপতে থাকে। সায়নীকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে নেয়। রাগে উত্তেজিত কন্ঠ-
-তুমি কি মেয়েটাকে মেরে ফেলবে নাকি? কি শুরু করছো তুমি? ও এমন কি করেছে যে তুমি এভাবে মারছো?
-আপনিওতো শুনেছেন। ও স্কুলে মারামারি করেছে। হেড টীচার ফোন করেছিলেন।
সায়নীর মা আর কিছু বলার আগেই দাদীমা বিদ্রুপের বাক্য ছুড়ে মারলেন-বেশ করেছে। মারামারি করবে নাতো ঐ দস্যি মেয়েটার মার খাবে নাকি?
-মা আপনি কি বলছেন? আপনি কি সব জানেন ও কি করেছে?-সায়নীর মা বিরক্তিভরে দাদীমার দিকে তাকিয়ে থাকে।
-তোমার কি ধারনা আমি কিছুই জানি না? আমি সবই জানি। তুমি তো হেড স্যারের মুখে শুনেছ একটু খানি। সায়নী আমাকে একটু না, পুরো ঘটনাটাই বলেছে। বেশ ভালো করেছে। খবরদার তুমি এ নিয়ে ওকে আর কিছু বলবে না। মেয়েটা এখনো স্কুলের পোষাকটাও খুলেনি। তোমার কোন কান্ডজ্ঞানই নাই। থাকলে স্কুল থেকে আসার সাথে সাথেই মেয়েটিকে এভাবে বকতে না।
এবার সায়নীর মা বেশ রেগে গেলো।-দেখুন মা আপনি কিন্তু এখন বেশ বাড়াবাড়ি করছেন। আমি সায়নীর মা। ওর ভালো মন্দটা আমাকে ভাবতে দিন
দাদীমা: তুমি ভাববে ওর ভালোমন্দ নিয়ে? বৌমা আর হাসিও না। যে নিজের ভালোমন্দই বুঝে না সে ভাববে আরেক জনের ভালোমন্দ নিয়ে? যাক, যাক। এসব কথা এখন থাক। এখন যাও। মর্জিনাকে বলো ওর খাবারের ব্যাবস্থা করতে।
সায়নীর মা আর কথা বাড়ায়নি। মাথা নীচু করে হন হন করে ঘর থেকে বেড়িয়ে যায়।
দাদীমা এবার সায়নীর দিকে ফিরে তাকায়। দুহাত দিয়ে দাদীমাকে জড়িয়ে ডুকরে কাঁদছে। দাদীমা দুহাত দিয়ে মুখটা চেপে ধরে নিজের বুক থেকে সরিয়ে আলগা করে নিজের দিকে তুলে ধরলেন। চোখের আর নাকের জলে মুখটা লেপ্টে গেছে। শাড়ীর আচলে মুছতে লাগলেন আর সান্তনা দিচ্ছিলেন-আর কেঁদোনা দিদিভাই। এখন জামা-কাপড়গুলি খোলে হাত মুখটা ধুয়ে নাও। মর্জিনাকে বলছি কিছু খাবার নিয়ে আসতে।
সায়নী: (মৃদুস্বরে, অশ্রুসিক্ত চোখে) আমি এখন কিছু খাবো না দাদীমা
দাদীমা: (ফিস ফিস করে) ঠিক আছে ঠিক আছে। তা হলে হাত মুখ ধুয়ে একটু বিশ্রাম করে নাও। আমি এর মধ্যে একটু আসরের নামাজটা পড়ে আসি। ঠিক আছে দিদিভাই। আর মন খারাপ করে না।
দাদীমা এবার ধীরে ধীরে সায়নীর রুম থেকে বেড়িয়ে গেলেন।
দাদীমা সব সময়ই নামাজ পরেন। বেশ ধার্মিক। তবে আসরের নামাজের সময়টি দাদীমার খুব প্রিয়। যেন একটি ছন্দোময় মুহূর্ত।
বেলা বাড়ার সাথে সাথে, কোলাহলপূর্ণ ঢাকার রাস্তাগুলি ধীরে ধীরে শান্ত হয়ে আসে। শহরের বিশৃঙ্খল রাস্তায় মানুষের হাঁটা-চলা, কিংবা উদ্ভ্রান্তের মতো ছুটে চলা নানা ধরনের যানবাহনের উন্মত্ততা কিছুটা সময়ের জন্য হলেও কমতে থাকে। মিনার থেকে প্রতিধ্বনিত মুয়েজ্জিন ডাকের শব্দে বাতাস যেন ঘন হয়ে উঠে, আত্মদর্শন এবং আধ্যাত্মিক সংযোগের জন্য মানুষ ছুটে চলে প্রার্থনায় সামিল হতে। হঠাৎ করেই যেন শহুরে জীবনের কোলাহলের মধ্যে, একটি নির্মল নিস্তব্ধতা শহরের উপর নেমে আসে। এই মুহুর্তটি হয়ে উঠে সম্মিলিত উপাসনার মধ্যে একতা এবং শান্তির গভীর অনুভূতিকে ধারন করার এক মাহেন্দ্রক্ষন।
শুধু দাদীমাই নয়। সায়নীর জন্যও পরন্ত বিকালের এই মুহূর্তটি খুব প্রিয়। বারান্দায় দাড়িয়ে বন্ধু পাখিটির সাথে খুনসুটিতে মেতে থাকতে খুব ভালোই লাগে। জানালার পাশে দাঁড়িয়ে আকাশে মেঘের ফালিদের ভেসে যাওয়ার দৃশ্যে সায়নীর মনটা আনন্দে ভরে উঠে। মনের ভেতরের উদাসী বলাকারা পত পত করে উড়তে থাকে।
কিন্তু আজ সায়নীর মনটা খুব খারাপ।
দাদীমা রুম থেকে যাওয়ার সাথে সাথেই বাথরুমে গিয়ে ঢুকলো। দেয়ালের বিশাল বড়ো কাঁচের আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। সাথে সাথেই হাউ মাউ করে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো। দুহাত দিয়ে মুখে টেপের জল ছিটে দিচ্ছে চোখে মুখে। কান্না যেন আর কিছুতেই থামছে না।
ভয় এবং বিভ্রান্তির পাশাপাশি সায়নী যেন এক দুঃখের অপ্রতিরোধ্য অনুভূতির সমুদ্রে হাবুডুবু খেতে শুরু করলো।
স্নেহময়ী মাতৃত্বের অনুপস্থিতিতে সায়নী যেন শোকের কোলে ঢলে পড়লো। প্রচন্ড আবেগপ্রবন সায়নীকে বিচ্ছিন্ন, অসহায় এবং অনাকাঙ্খিত মনে হতে লাগলো।
অনেকক্ষন পর যখন বাথরুম থেকে বেড়িয়ে আসে সায়নী তখন বাইরে হালকা অন্ধকারের চাদরে ঢেকে যাচ্ছে পৃথিবী। গাড়ীর হর্নের আওয়াজ আর মানুষের কোলাহলের শব্দ কানে এসে লাগছিলো। রুমের লাইটটা না জ্বালিয়েই একটি নকশী কাঁথা গায়ে জড়িয়ে আড়মোড়া করে মাথাটা বালিশে দিয়ে শুয়ে পড়লো বেডে। ঘুমাবে না। একটু বিশ্রাম নেবে।
চলবে---)
Read full book here: Click here to download the PDF file