সায়নীর স্বপ্ন-পাঁচ


Author: ড. পল্টু দত্ত

সায়নীর স্বপ্ন-পাঁচ

Summary:

ক্লাশ শেষ হতেই শান্তনু সায়নীর দিকে এগিয়ে এলো। কাছে এসেই বললো-

-কন্গ্রেচুলেশন, সায়নী। তুমি কি করে এতো তাড়াতাড়ি সব প্রশ্নের উত্তর দিলে? বিশেষ করে শেষ অংকটি

সায়নী: কি বলছো? স্যারতো খুব সহজ অংক জিজ্ঞেস করেছে। আমি অনেক বড়ো বড়ো অংক ছু মন্তর মতো কষতে পারি। তুমি জিজ্ঞেস করে দেখতে পারো।

শান্তনু: না, না আমি জিজ্ঞেস করবো না। আমি শুধু ভাবছি তুমি এতো তাড়াতাড়ি উত্তর দিলে কি করে? চলো আমরা বাইরে যাই। পরের ক্লাশ শুরু হতেতো একটু দেরী আছে।

 

বাইরে তখন ক্লাশের ছাত্র-ছাত্রীরা হৈ চৈ করছে। কড়িডোরে জটলা পাকিয়ে কেউ কেউ কথা বলছে সায়নীকে নিয়ে। সবাই সায়নীর ব্যাপারে খুব উৎসুক। আবার কারো কারো মুখে হিংসের বানী উচ্চারিত হচ্ছে-

-ও একটা পাগল! ওকে দেখলেই আমার ভয় লাগে। কখন আবার তর্জনী ঘুরানো শুরু করে। ওরে বাপরে বাপ কি ভয়ানক মেয়ে।

আরেক জন ফিস ফিস করে মুখ ভেংচিয়ে ফোরন কাটে-কি বিশ্রী কান্ড! সারাক্ষন দেখি পোকামাকর নিয়া পইরা থাকে। বস্তীর মেয়ের চেয়েও খারাপ। আর রাগ হলে দেখছিস চোখগুলি দিয়া যেন লাভা বেড়িয়ে আসে। জঘন্য!

আরেক জন কায়দা করে হাত নাড়িয়ে বলে উঠে-শুনছি ও নাকি পঙ্গু। মাথায় গন্ডগোল আছে। ওর কাছ থেকে সাবধান! না হলে বিপদ আছে।

নানা ধরনের কথা-বার্তার যেন জম্পেস আড্ডা বসেছে। একজনে বলছে আর বাকীরা হিল হিল করে হাসতে হাসতে লুটোপুটি খাচ্ছে। সায়নীকে নিয়ে কথা বার্তা বেশ জমে উঠেছে।

 

তবে সবই নেগেটিভ। সায়নীর ম্যাথস সাফল্যে সবাই জ্বলছে। হিংসে হচ্ছে সকলের। মাথার মগজে শয়তান ভর করেছে। ভালো কিছু চিন্তা করতে পারছে না। তাই ওর দূর্বল জায়গায় লবনের ছিটা মারছে। খারাপ খারাপ কথা বলছে।

 

তবে দু এক জন আবার সায়নীর প্রশংসায় পঞ্চমুখ-কি বুদ্ধিমান মেয়েটা। অথচ আজ অব্দি আমরা কেউ জানতে পারেনি ও ম্যাথসে এতো ভালো।-সহপাঠিদের একজন বলে উঠলো। সাথে সাথে আরেকজন বললো-

-কি সাংঘাতিক ব্যাপার! এক সেসনেই স্যার কাবু। অলিম্পিয়াদে ওকে নিয়ে নিলো।

আরেক জন বলে উঠলো-কি ভাগ্য সায়নীর!

-এটা ভাগ্য নয়, এটাকে বলে প্রতিভা এবং কঠোর পরিশ্রম। -পাশে দাঁড়ানো একটি ছেলে গলা বাড়িয়ে হাঁকায়। হাত নেড়ে নেড়ে বলতে থাকে-আমাদেরও উচিৎ কঠোর অধ্যাবসায় আর পরিশ্রমের মাধ্যমে এই প্রতিভাকে বিকাশ করা।

একটি মেয়ে পিছন থেকে কুঁজো হয়ে সামনে এসে ছেলেটির থুতুনি ডান হাতের তিন আঙ্গুলে চেপে ধরে ঠোঁট মুখ কিছুটা ভেংচির মতো বাঁকা করে পুতো পুতো কন্ঠে ধমক দিয়ে উঠলো-

-এই যা এখান থেকে! ইনি জ্ঞান ছড়াচ্ছে। পারলে তুই প্রতিভা বানা! যত্তোসব পন্ডিতের দল।

 

তবে যে যাই বলুক সায়নীকে নিয়ে, তিতলি কিন্তু ব্যাপারটাকে সহজ ভাবে মেনে নিতে পারেনি। ক্লাশে ওর খুব অসহ্য লাগছিলো। মনে হচ্ছিলো সায়নীর চুল টেনে ধরে, জোড়ে একটা থাপ্পর কষায় ওর গালে। এতো ঢং কেন? বার বার সবাইর আগে হাত তুলতে হবে কেন? এই সব ভেবে মাথা যেন গরম হয়ে উঠছে। দাঁত কিড়মিড় করে উঠছে। গা জ্বলছে। কিছু একটা করতে হবে। তা না হলে তিতলির বিপদ হবে। নিজের অবস্থানের অবনতি হবে। ও এটা কিছূতেই হতে দেবে না।

 

ছটপট করতে থাকে তিতলি। রাগে কড়িডোরে পায়চারি করছে উদ্ভ্রান্তের মতো। দাঁত দিয়ে হাতের নখ খুটছে অনবরত। মাথা গরম হলেই তিতলি এ কাজটা করে।

 

কতোবার ওর মা তিতলিকে বারন করেছে দাঁত দিয়ে হাতের নখ না খুঁটতে। নখ কামড়ানোর ফলে নখের ক্ষতি সহ দাঁতের সমস্যা যেমন চিট বা ফাটা দাঁত হতে পারে এবং  চোয়ালের ক্ষতি করতে পারে। বাবার মুখেও শুনেছে নখ ব্যাকটেরিয়া এবং অন্যান্য অণুজীবকে আশ্রয় করে। নখ কামড়ানোর ফলে এই জীবাণুগুলি মুখের মধ্যে প্রবেশ করতে পারে, সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়ায়। কিন্তু কে কার কথা শুনে। উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে নখ কামড়ানোটা তিতলির জন্য প্রায়শই একটি স্নায়বিক অভ্যাসে পরিনত হয়েছে ইদানীং।

 

কড়িডোরে অন্যান্যদের কথা শুনে ওর মেজাজ বিগড়ে গেছে। কারো কারো মুখে সায়নীর প্রশংসা আর শুনতে পারছে না। এবার হন হন করে ক্লাশে ঢুকতে যাচ্ছিলো। এমন সময় দেখতে পেলো শান্তনুকে সায়নীর সাথে কথা বলতে। ক্লাশের বাইরে কড়িডোরের এক পাশে খুব কাছাকাছি দাঁড়িয়ে কথা বলছে। লক্ষ্য করলো শান্তনুর বা হাতটা সায়নীর ডান হাতে মাঝে মধ্যে এসে ঠেকছে। দুইজনেই হেসে হেসে কথা বলছে।

 

ওদেরকে এইভাবে দেখে তিতলির মাথায় যেন কেউ গরম তেল ঢেলে দিলো। সাহারা মরুভূমির জুলাই-অগাষ্টের তীব্র তাপদাহ যেন সারা শরীরে আছড়িয়ে পড়লো। কিশোরী প্রানটাতে হঠাৎ কে যেন হাতুরী দিয়ে পেটাস পেটাস করে পিটাতে লাগলো।

প্রচন্ড রাগে ক্ষোভে সেখানটাই দাঁড়িয়ে পড়লো হুট করে। সামনের দিকে যেন আর পা এগুচ্ছে না। সারা শরীরটা গির গির করে উঠলো। তুষের আগুনের মতো গায়ের পশমগুলি জ্বলতে লাগলো।

কিছুক্ষন ভাবলো। তারপর ধীরে ধীরে শান্তনুর দিকে এগিয়ে গেলো। মুখে একটা মেশিন চাপা কৃত্রীম হাসি মেলে ধরলো-

তিতলি: হায় শান্তনু, তুমি এখানে? ক্লাশ শেষ হওয়ার পর তোমাকে পাশের বেঞ্চে না দেখে ভাবলাম তুমি হয়তো কড়িডোরে আছো। অনেকক্ষন খুঁজেও তোমাকে পেলাম না। এখানে তুমি কি করছো?

শান্তনু: দেখছো না সায়নীর সাথে কথা বলছি। কেন কোন কিছু বলবে?

তিতলি: হ্যা, বলবো। কিন্তু তুমি আমার সাথে না এলে বলবো কি করে? এসো আমার সাথে।-এই বলেই তিতলি শান্তনুর ডান হাত ধরে জোড়ে টানতে লাগলো।

হঠাৎ টানা টানিতে অপ্রস্তুত শান্তনু হাতটা জোড়ে সড়িয়ে আনার সময় পাশে থাকা সায়নীর ঘাড়ের বা পাশে ঠাস করে গিয়ে লাগে। সায়নী বেশ অপ্রস্তুত। ঠাহর করে উঠতে পারেনি। হঠাৎ ওফ্ফ করে উঠে। একেবারে হতভম্ব। এতে করে সায়নীর রাগ হয় তিতলির প্রতি। বড়ো বড়ো চোখ করে বিড় বিড় করতে লাগলো: এই কি করছো তুমি? এ কি ধরনের অসভ্যতা!

 

হঠাৎ তিতলি সায়নীর দিকে তাকিয়ে গর্জন করে উঠলো: এই চুপ কর তুই। ফ্যাস ফ্যাস করে আমার দিকে তাকিয়ে আছিস ক্যা। আমি শান্তনুর সাথে কথা বলছি। তোর তাতে কি? ও আমার বন্ধু। নাক গলাবিনা কিন্তু। ভোঁতা করে দেবে।

তিতলির কথা শুনে সায়নীর বেশ রাগ হলো। ঠোঁটে দাঁত চেপে অন্য দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো: বড্ডো বেহায়া মেয়েতো। অসভ্য কোথাকার!

কথাটা শেষ করতে না করতেই তিতলি চীৎকার করে উঠলো-খবরদার, মুখ সামলিয়ে কথা বলিস। দাঁত ভেঙ্গে মুখ থোতা করে দেবো। ইবলিশ মেয়ে কোথাকার। গায়ে পেখম গজিয়েছে না? সব কেটে দেবো। তুই অসভ্য, তোর চৌদ্দগোষ্ঠী অসভ্য!

পাথরের মূর্তির মতো ঠায় দাঁড়িয়ে আছে শান্তনু। তিতলির আচরনে সে একেবারেই হতভম্ব। ভাবছে, কি হয়েছে তিতলির। সায়নীর সাথে এমন করছে কেন? নাকি সায়নীকে হিংসে করছে। হঠাৎ ভাবনায় ছেদ পড়লো সায়নীর চীৎকারে-

সায়নী: তুই অসভ্য। তোর চোদ্দগোষ্ঠী অসভ্য। গায়ে পড়ে ঝগড়া করতে তোর লজ্জা লাগে না। বেহায়া-শয়তান মেয়ে কোথাকার।

হঠাৎ সায়নীর মাথা গরম হয়ে যায়। চোখ বড়ো বড়ো করে ফোঁস ফোঁস করতে থাকে। তর্জনী ঘোরাতে থাকে।  ঘাড় ডানে বায়ে ঘোরাতে থাকে। সায়নীর অগ্নি মূর্তি দেখে শান্তনু ঘাবড়ে যায়। ভয় পেয়ে যায়। কিংকর্তব্যবিমূঢ় শান্তনু কি করবে বুঝে উঠার আগেই তিতলি সায়নীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো। সায়নীর চুল ধরে টানা হেচড়া করতে লাগলো। আর একাধারে বকে যাচ্ছিলো-পাঁজি মেয়ে কোথাকার! অসুস্থ, পাগল, বদমাইশ…গায়ে রং ধরেছে! আয় মজা দেখাচ্ছি,,,

সায়নী নিজকে ছোটানোর জন্য হাত দিয়ে তিতলির মাথায় ধরার চেষ্টা করছে। শান্তনুও ওদেরকে থামানোর চেষ্টা করছে।

কোলাহলপূর্ণ স্কুল করিডোরে এই উত্তেজনাপূর্ণ পরিস্থিতি দেখে আশে-পাশের ছাত্র-ছাত্রীরা জড়ো হতে লাগলো। তিতলি-সায়নীর উত্তপ্ত সংঘর্ষে বেশ যেন মজা পাচ্ছিলো সকলে। তিতলি-সায়নীর উচ্চ কণ্ঠস্বরের তীক্ষ্ণ প্রতিধ্বনি কৌতূহলী দর্শকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে বিলম্ব হয়নি। কেউ কারো থেকে কম নয়। কথা কাটাকাটি থেকে হাতাহাতি। পরিস্থিতি এখন তুমুল পর্যায়ে।

সায়নী ক্রোধে ফোঁসে উঠছে। তার প্রতিপক্ষের সাথে মৌখিক বজ্রাঘাতের বিনিময়ে তার চোখ জ্বলন্ত সংকল্পে জ্বলে উঠল। তিতলিও পাঁজির পাঁজি। বেশ আগ্রাসী হয়ে উঠছে। হাত-পা যেন সমান ভাবে চলছে। বিদ্বেষের জ্বলন্ত লাভা বুদ বুদ করছে দুই চোখে।

হট্টগোলের মধ্যে চিন্তিত শান্তনু দায়িত্ববোধের সাথে পরিস্থিতিকে সামলিয়ে নেওয়ার প্রয়াসে ঝাঁপিয়ে পড়লো। তার মুখে উদ্বেগ এবং সংকল্পের মিশ্রণ প্রতিফলিত হচ্ছিলো। নিজকে বেশ অপরাধী মনে হচ্ছিলো শান্তনুর। আজ ওর কারনেই যেন ঘটনাটা ঘটলো। শিক্ষকদের কেউ এসে পড়লে মহা বিপদ। কিন্তু কোন ভাবেই ওদেরকে থামাতে পারছে না। বরং তেলে ঘি ঢালার মতো পরিস্থিতি আরো উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। আর অন্য সকলেই উৎসুক দৃষ্টিতে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। ঝগড়া থামানোর বিন্দুমাত্র প্রয়াস নেই কারো মধ্যে। কেউ কেউ আবার ভ্রু কুঁচকে মুচকি হাসছে। যেন সার্কাস বসেছে।

 

হঠাৎ সায়নী ক্ষীপ্র হয়ে উঠে।

ডান হাত দিয়ে প্রচন্ড জোড়ে তিতলির মুখে একটি ঘুষি মারে। ডান পা দিয়ে লাথি মারে তিতলির পায়ে। তিতলি ছিটকে পড়ে ফ্লোরে। প্রচন্ড ক্রোধে সায়নী ঝাঁপিয়ে পড়ে তিতলির উপর। এলো পাথারী থাপ্পর মারতে থাকে তিতলির গালে মুখে, আর রাগের মাথায় ফোঁস ফোঁস করতে থাকে।

শান্তনু সায়নীকে দুহাত দিয়ে সরিয়ে নিয়ে আসে এক ঝটকায়। সাথে সাথে তিতলির কাছের বন্ধুরা ফ্লোর থেকে তিতলিকে তুলে নিয়ে যায়। তিতলির মুখটা বেশ ফ্যাকাসে লাগছিলো। কাঁদো কাঁদো ভাব। দেখেই বুঝা যাচ্ছে বেশ লেগেছে।

তখনো সায়নী রাগে-ক্ষোভে জ্বলছিলো।

 

পরের দিন সকালের সূর্যের সোনালী রশ্মি সায়নীর বেডরুমের জানালা দিয়ে আছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথে ঘুম ভেঙ্গে যায়। আলতো করে যেন সায়নীর চোখে-মুখে চুমু দিয়ে জাগিয়ে দিয়েছিল। ঘুম থেকে উঠে হাত-পা টান টান করে এপাশ ওপাশ মুড়ি দিয়ে ঘাড়টা একটু পেছনের দিকে বাঁক করে বাইরের পাখিদের মৃদু আওয়াজের সাথে গাড়ীর শব্দের সিম্পনি শোনার চেষ্টা করলো।

সায়নী হালকা কুইল্টা গা থেকে সরিয়ে পিছনে ফেলে দিলো এবং জানালার দিকে ধীরে ধীরে এগুতে লাগলো। পর্দাগুলি দুপাশে দুহাত দিয়ে টেনে ভোরের উষ্ণ বর্ণে স্নান করা বিশ্বকে উপভোগ করতে লাগলো। গোলাপী এবং কমলা রঙের ছায়ায় আঁকা আকাশটি একটি নতুন দিনের প্রতিশ্রুতি আলিঙ্গন করছে বলে মনে হচ্ছিলো সায়নীর। তুলতুলে মেঘ অলসভাবে ভেসে চলছে, নিচের প্রাণবন্ত ল্যান্ডস্কেপের উপর কৌতুকপূর্ণ ছায়া ফেলে। কি অপূর্ব সকাল। এক দন্ডে মনটা বেশ ভালো লাগলো সায়নীর।

জানালার পাশেই কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে থাকলো।

শীতল মৃদু বাতাস, শিশির-চুম্বিত ঘাস এবং প্রস্ফুটিত ফুলের মিষ্টি সুবাস বহন করে নিয়ে আসছে কি পরম মমতায়। সায়নী গভীরভাবে শ্বাস নিলো, চোখের পাতা বন্ধ করে সকালের সতেজতাকে প্রানভরে  অনুভব করলো। সবুজ আলপনাতে সাজানো গাছগুলো সকালের মৃদু বাতাসে দুলছে, একে অপরের কাছে গোপন কথাগুলি যেন  ফিসফিস করে বলছে। ধীরে ধীরে শহর আর এ শহরের ব্যাতি ব্যাস্ত মানুষগুলোর জেগে উঠছে। রিক্সার টু টাং শব্দ ভেসে আসছে। নীচে তাকিয়ে দেখলো কিছু লোক  ঘূর্ণায়মান পথ ধরে জগিং করেছে, তাদের পদচিহ্নগুলি নরম পৃথিবীর ইট পাথরের বুকে একটি ছন্দময় স্পন্দন তৈরি করছে। এ সবে সায়নীর প্রানটা খুশিতে ভরে উঠলো।

সায়নীর মনে হলো পৃথিবী যেন তার সমস্ত গৌরব নিয়ে জেগে উঠেছে আজ। দিনটা নিশ্চয়ই ভালো কাটবে। বাকী দিনটার অফুরন্ত সম্ভাবনার অধ্যায়গুলিতে ডুব দেওয়ার জন্য সায়নীর আর অপেক্ষা করতে পারিনি। তাড়াতাড়ি মুখ হাত ধুয়ে সকালের খাবারটা খেয়ে বাকী দিনটার রহস্যগুলি উন্মোচন করার জন্য প্রস্তুত হলো।

স্কুলে যথারিথী আসে সায়নী।

স্কুলের সকালটা বেশ ফুরফুরে লাগছে। সকালের মৃদু শীতল বাতাস এসে ঢুকছে ক্লাশ রুমে। সবগুলি জানালাই খোলা ছিলো। আকাশটা বেশ পরিস্কার। ক্লাশ রুমে ঢুকার মুখেই শান্তনুকে দেখতে পায়। দুজনের মধ্যে চোখাচোখি হয়। সায়নী হ্যালো বললেও শান্তনু কিছু না বলেই নিজের সীটে গিয়ে বসে পড়লো। সায়নীর বুকটা কেমন ধুক ধুক করে উঠলো হঠাৎ। এক অজানা সম্ভাবনায় কিশোরী মনটা আথালি-পাথালি করে উঠলো।

কিছু বুঝতে না দিয়েই নিজের সীটে গিয়ে বসে পড়ে সায়নী।

কিছুক্ষন পরেই প্রধান শিক্ষকের পারসনাল সেক্রেটারী ক্লাশ রুমে ঢুকে সোজা সায়নীর কাছে চলে আসে। সায়নী বেশ অবাক হলো। ঠাহর করতে পারলো কিছু একটা ঘটেছে। নিশ্চয়ই হেড মাষ্টার পাঠিয়েছেন সায়নীকে ডেকে নিয়ে যাওয়ার জন্য। আগেও এমনটি দেখেছে অন্যদের ক্ষেত্রে। ভাবনাটা সত্যিই হলো।

একটা চিরকুট সায়নীর হাতে ধরিয়ে দিয়ে মি. সেক্রেটারী বলে উঠলো-

-সায়নী, তোমাকে মর্নিং ক্লাশের পর হেড মাষ্টার দেখা করতে বলেছে। ঠিক সময়ে চলে এসো কিন্তু, দেরি করো না। চির কুটটাতে টাইম দেয়া আছে।-এই বলেই মি. সেক্রেটারী হর হর করে চলে গেলেন।

সায়নীকে বেশ চিন্তিত লাগছে। নিশ্চয়ই কালকের ঘটনাটা হেড স্যারের কানে গিয়েছে। হাতে ধরা চিরকুটটার দিকে নজর পড়লো। দুহাত দিয়ে ভাঁজটা খুললো। একটি লাইনে লেখা আছে-

সায়নী,

তুমি আমার সাথে মর্নিং ক্লাশের পর ঠিক ১০টায় দেখা করবে।

হেড মাষ্টার

খন্দকার মনিরুজ্জামান খাঁন।

এবার স্কুলের ঘণ্টা বেজে উঠল। মর্নিং ক্লাশ  শুরু হওয়ার সংকেত। ম্যাথস ক্লাশ।

শিক্ষক যখন চকবোর্ডে ভগ্নাংশ এবং সমীকরণ সম্পর্কে বর্ননা করছিলেন, সায়নীর মন তখন অন্য জায়গায় ছিল। শ্রেণীকক্ষের ঘড়ির সেকেন্ডের কাটাটা টিক টিক টিক করে বেজে চলছিলো। সে ঘড়ির দিকে তাকালো, প্রতিটা মিনিটকে প্রত্যাশা আর উদ্বেগের মধ্যে গুনতে লাগলো। কখন শেষ হবে ক্লাশ।

শিক্ষক আলোচনায় ব্যস্ত তার সহপাঠীদের মধ্যে ফিসফিস কথোপকথনের গুঞ্জন একটি দূরবর্তী গুঞ্জনে পরিণত হয়েছিল।

ক্লাশ রুমের বাতাসে সহপাঠিদের উত্তেজনা পূর্ন আলোচনা স্পষ্ট ছিল। কিন্তু সে দিকে সায়নীর কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। যদিও সায়নী স্যারের আলোচনার উপর ফোকাস করার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু তার মন আসন্ন মিটিং এর দিকে ফিরে যেতে থাকে। অজানা, অব্যাক্ত ফলাফল তার উপর অন্ধকার মেঘের মতো ঝুলে ছিল। তাই উদ্বিগ্ন মন। ঘড়ির কাটা যতো এগুচ্ছে ততই সায়নীর অস্থিরতা বেড়ে যাচ্ছিলো।

তার নিজের হৃদস্পন্দনের শব্দটি যেন শিক্ষকের কণ্ঠস্বরকে ছাপিয়ে উঠেছিলো।  মিটিং পর্যন্ত সেই উত্তেজনাপূর্ণ মুহুর্তগুলিতে, সায়নী আশা এবং ভয়ের মিশ্রণে জড়িয়ে পড়ে। তাই ক্লাশে মন বসাতে পারলো না।

 

এক সময় ক্লাশ শেষ হলো। স্কুলের ঘন্টা বেজে উঠলো।

ঠিক দশটায় সায়নী প্রধান শিক্ষকের রুমে এসে ঢুকলো।

বিদ্যালয়ের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত, প্রধান শিক্ষকের কক্ষটি যেন জ্ঞান ও নেতৃত্বের অভয়ারণ্য। টেবিলের উপর নিজের নামের নেইম প্লেইটটি পিতলের ফলক দ্বারা সজ্জিত পালিশ করা কাঠের উপর লেখা আছে। রুমটি বেশ বড়ো।

 

প্রশস্ত কক্ষে গর্বিতভাবে দাঁড়িয়ে থাকা মেহগনি আসবাবপত্রের উপর একটি উষ্ণ আভা ভারী পর্দার মধ্য দিয়ে সূর্যালোক সুন্দরভাবে প্রতিবিম্বিত হচ্ছিলো। এক পাশের দেয়ালে একাডেমিক কৃতিত্বের মুহূর্তগুলি এবং স্কুলের আনন্দদায়ক ইভেন্টগুলি ক্যাপচার করে ফ্রেমযুক্ত ফটোগ্রাফ দিয়ে সজ্জিত আছে। একটি জমকালো, মনোরম ডেস্কের পিছনে, রুমের কেন্দ্রবিন্দুতে, প্রধান শিক্ষকের চামড়ার আবদ্ধ চেয়ারটিতে  সোজা হয়ে বসে আছেন প্রধান শিক্ষক। মুখে একটা হালকা হাসির ঝলক।

পাশের একটি চেয়ারে বসে ছিলেন স্কুলের ওয়েল ফেয়ার টিউটর।

প্রধান শিক্ষক: গুড মর্নিং সায়নী। হাউ অর ইউ। প্লিজ বসো।

সায়নী: থ্যাংক ইউ স্যার

প্রধান শিক্ষক: ক্লাশে তোমার আচরন নিয়ে আমরা উদ্ভিগ্ন। তোমার সহপাঠিরা কমপ্লেইন করেছে। তিতলীর মাও আজ ফোন করে কমপ্লেইন করেছে। এ নিয়ে তোমার সাথে একটু কথা বলতে চাই।

সায়নী: বলুন স্যার-সায়নী তখন অন্যদিকে তাকিয়ে কথাগুলি বলছিলো। প্রধান শিক্ষক এবং ওয়েলফেয়াল টিউটর দুজনেই সেটা লক্ষ্য করলেন।

প্রধান শিক্ষক: গতকাল নাকি তুমি তিতলির সাথে খুব খারাপ ব্যবহার করেছ? ওকে নাকি মেরেছ?

সায়নী চুপ করে আছে। কোন উত্তর দিচ্ছে না।

প্রধান শিক্ষক: কি সায়নী কথা বলছো না কেন। আমার কথার উত্তর দাও?

সায়নী: আমি তিতলির সাথে ঝগড়া করতে চাইনি স্যার। ওই প্রথম আমার সাথে খারাপ ব্যাবহার করেছে। আমাকে ধমক দিয়েছে, গাল দিয়েছে। আমি নাকি হাবাগুবা, পচা ছাত্রী। আমি নাকি অসুস্থ। আমি এবং আমার চৌদ্দগোষ্ঠী নাকি অসভ্য-বেহায়া। আরো অনেক খারাপ খারাপ কথা বলেছে। তাও আমি কিচ্ছু বলেনি। কিন্তু তিতলি আমাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়। চুল ধরে জোড়ে টানতে থাকে। আমি হাতে খুব ব্যাথা পেয়েছি। তার পর আমি ওর সাথে রাগ করি।

প্রধান শিক্ষক: তোমার সাথে তখন কে ছিলো?

সায়নী:শান্তনু। ওইতো আমাকে ম্যাথ ক্লাশের পর কড়িডোরে ডেকে নিয়ে যায়। আরো অনেক সহপাঠিরাও ছিলো।

প্রধান শিক্ষক: কেন শান্তনু বাইরে ডেকে নিয়ে যায়?

সায়নী: গতকাল ম্যাথ ক্লাশে ম্যাথ ক্যুইজে আমি সব গুলো উত্তর দিতে পেরেছিলাম। স্যার আমাকে স্কুল অলিম্পিয়াদে সিলেক্ট করে। শান্তনু আমাকে থ্যাংকস জানায়। বিশ্বাস করুন স্যার, আমার কোন দোষ নেই। আপনি শান্তনুকে ডাকুন। আমাকে ক্লাশে কেউ পছন্দ করে না। কেউ আমার সাথে কথা বলেনা। বিশেষ করে তিতলি আমাকে সহ্য করতে পারে না, হিংসে করে-এই বলেই সায়নী ফুঁফিয়ে ফুঁফিয়ে কাঁদা শুরু করলো। দুহাতের আঙ্গুল দিয়ে চোখ কচলাতে লাগলো।

এমন সময় ওয়লফেয়ার টিউটর ম্যাডাম চেয়ার থেকে উঠে এসে সায়নীকে সান্তনা দিতে লাগলো।

প্রধান শিক্ষক:ঠিক আছে, তুমি কেঁদোনা। আমরা ব্যাপারটা দেখবো। নেকস্ট টাইম এই ধরনের কোন সমস্যা হলে তুমি এই ম্যাডামকে বলবে। ঠিক আছে সায়নী?

সায়নী:থ্যাংক ইউ স্যার। আপনি আবার আমার মাকে বলবেন নাতো? -চিন্তিত চোখে প্রধান শিক্ষকের দিকে সায়নী তাকিয়ে থাকে।

প্রধান শিক্ষক: কমপ্লেইন যেহেতু তিতলির মা করেছে এবং তোমার সাথে আজ কথা হলো, ব্যাপারটা অফিসিয়ালি তোমার গার্জিয়ানকে জানাতে হবে। আমি নিজেই কথা বলবো এবং সব বুঝিয়ে বলবো। এই নিয়ে তুমি চিন্তা করবে না। এবার তুমি যেতে পারো।

সায়নী প্রধান শিক্ষকের দিকে কিছুক্ষন ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। একটা থ্যাংকস দিয়ে যখন রুম থেকে বেড়িয়ে নিজ ফ্লোরের কড়িডোরে এসে ঢুকে তখন সহপাঠিরা হৈ চৈ এ মগ্ন। ওদের কোলাহলে মাঠের উপর দিয়ে উড়ে যাওয়া এক ঝাঁক পাখির কিচির মিচির আওয়াজ আর সায়নীর কানে এসে বাজলো না। কয়েকজন ছাত্রী মাঠের এক পাশে দুই গ্রুপে খেলছিল। এক গ্রুপের এক জন সুর করে বলে যাচ্ছে-

-এলাটিন বেলাটিন সইলো, কিসের খবর কইসলো--------

চলবে---)



Read full book here: Click here to download the PDF file