সায়নীর স্বপ্ন-চার


Author: ড. পল্টু দত্ত

সায়নীর স্বপ্ন-চার

Summary:

ইয়েস, প্লিজ-অবাক দৃষ্টিতে সায়নী তাকিয়ে থাকে ছেলেটির দিকে। অনেক দিন পর ওর কিশোরী মনটাতে কে যেন ভলোলাগার একটা হালকা পরশ বুলিয়ে দিলো। জানালা দিয়ে আসা মৃদু বাতাসে কালো চুলগুলি দুলে উঠলো। কয়েকটি চুল আছড়িয়ে পড়লো ওর চোখে-মুখে। হাত দিয়ে সেগুলি সরিয়ে নিলো। এমন করে আর কেউ আজ পর্যন্ত সায়নীকে অনুরোধ করেনি পাশে বসার জন্য।

-আই এম শান্তনু। থ্যাংকিউ-শান্তনু খুব নরম গলায় সায়নীকে বলে এবং পাশের সীটে বসে পড়লো।

-আই নো ইউর নেইম। সবাই তোমার নাম জানে। তুমি ক্লাশের সেরা ছাত্র।-সায়নীর জবাব।

শান্তনু খুব শান্ত স্বভাবের। মুখটাতে বেশ মায়া মেশানো। একটু মোটা, বেশ নাদুস-নুদুস, গোল গাল চেহারা। গায়ের রং বেশ ফর্সা। শান্তনুকে দেখলেই মনে হয় পাশের ঘরের ছলে, যেন অনেক দিনের চেনা। ঘাড়টা একটু ছোট। কালো ফ্রেমের চশমা পড়ে। সব সময় সামনের সারির ডান পাশের সীটে বসে। এই সীটে আর কেউ বসে না। এই সীটটি যেন ওর জন্য বরাদ্দ। সব সময় খুব হাসি খুশী থাকে। ওকে দেখলে মনে হয় ওর কোন দুঃখ নেই, কোন রাগ নেই। কাউকে কখনো হিংসা করে না। সবাই শান্তনুকে পছন্দ করে। সবচেয়ে ভালো স্টুডেন্ট বলে শিক্ষকরাও ওকে খুব পছন্দ করেন। ক্লাশে সব সময় সবার আগে উত্তর দেয়।

এই স্কুলে ভর্তি হওয়ার পর শান্তনু এর আগে কখনো সায়নীর সাথে তেমন কথা বলে নি। তবে সায়নীকে এরিয়ে যেতো না কখনো। দেখা হলে একবার হলেও হ্যালো বলতে ভূল হতো না। তবে দুষ্ট মেয়েদের মধ্যে একটি হলো তিতলি। সারাক্ষন শান্তনুর পাশে পাশে থাকে।  অন্যরা শান্তনুর সাথে কথা বলতে আসলে তিতলি ফোস ফোস করতে থাকে। চোখ পাকিয়ে দেয়। বিশেষ করে অন্য মেয়েদেরকে শান্তনুর পাশে দেখলে ওর মেজাজ গরম হয়ে যায়। হাত ধরে শান্তনুকে টেনে নিয়ে যায় দুরে। শান্তনু-তিতলির মধ্যে বেশ ভাব।

তবে তিতলির আচার ব্যাবহার শান্তনুর পছন্দ নয়। না চাইলেও তিতলি ওর সাথে কথা বলবে, অবসরে ওর সাথে থাকবে, খেলার সময় ওর সাথে খেলবে এমন কি টিফিনের সময় ওর লাঞ্চ বক্স থেকে জোড় করে শান্তনুকে খেতে দিবে। মাঝে মাঝে তিতলির আচরনে শান্তনুর খুব রাগ হয়। আর রাগ হলেই নিজের চুল ধরে টানতে থাকে বা গাল ফুলিয়ে চুপ চাপ বসে থাকে কিছুক্ষন। কখনো কখনো উচ্চ কন্ঠে সুরহীন গান গাইতে থাকে বা বুক ফুলিয়ে জোড়ে জোড়ে নিঃশ্বাস নিতে থাকে। কিন্তু তাও দুঃখ পাবে বলে তিতলিকে বকা দেয় না।

 

তিতলি শান্তনুর সাথে সব সময় একটা অন্যরকম ভাব নিয়ে চলে। এতে তিতলির বেশ সুখ সুখ অনুভব হয়। নিজকে ভাগ্যবান মনে করে। ক্লাশের সবচেয়ে ভালো ছাত্রটি ওর প্রিয় বন্ধু, এ ভেবেই ওর মেজাজটা বেশ ফুরফুরে থাকে। অন্যরা ওকে দেখে হিংসে করে, হরহামেশাই তাকিয়ে থাকে। আবার অনেক সহপাঠিরা তিতলির কাছে ঘেঁষতে চায়। এতে ওর বেশ আনন্দ হয়। একটু উঁচু স্তরের মনে হয়। অন্যদের থেকে একটু আলাদা।

তিতলির ফ্যামেলী খুব বড়লোক। বাবার অনেকগুলো ব্যাবসা। মা নাকি বড় চাকুরি করেন। পেশায় ইঞ্জিনিয়ার। এ কথাগুলো তিতলি বলেছে। সময় আর সুযোগ পেলেই সবাইকে তিতলি তার কথা বলে। পরিবারের কথা বলে। সব সময় সাঁজগোজ করতে পছন্দ করে। দেখতেও খুব সুন্দর। ভাসা ভাসা চোখ। দামী মোবাইল নিয়ে স্কুলে আসে। মার্সিডিজে চলাফেরা করে। প্রায় সময়ই দামী দামী চকলেট আর বিস্কিট নিয়ে আসে। সবাইকে দেয়।

কিন্তু সায়নীকে আজ পর্যন্ত দেয়নি। ভালো করে কথাও বলেনি কোনদিন। অনেকেই তিতলির দলে। তাই ক্লাশের সহপাঠিরা কেউ সায়নীর সাথে ঠিক মতো কথা বলে না। সবাই সায়নীকে এড়িয়ে চলে।

 

সায়নীর একাকীত্বের জীবনে আজ শান্তনুকে পেয়ে খুব ভালো লাগলো। পাশে বসে শান্তনু সায়নীকে জিজ্ঞেস করলো-

-তুমি সব সময় একা একা থাকো কেন?

সায়নী: কারন আমি একা। কেউ আমার সাথে কথা বলে না। খেলার সময় কেউ আমার সাথে খেলে না। আমাকে কেউ পছন্দ করে না

শান্তনু: তুমি আমার বন্ধু হবে?

 

অবাক সায়নী। চোখ দুটি নিজের অজান্তেই ভিজে গেলো। কেমন ঝাঁপসা ঝাঁপসা মনে হলো। কান্না কান্না ভাব। শান্তুনু তখনো এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সায়নীর দিকে উত্তরের আশায়। মুখে কি এক চমৎকার অমলীন কিশোর হাসি। সায়নী চোখ টিপে সায় দিলো।

 

তার পর ওরা অনেকক্ষন কথা বললো। এই প্রথম ক্লাশের কেউ একজন সায়নীর কাছে এতো ঘনিষ্ঠভাবে বসে, আলাপ করে এবং বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দেয়। সায়নীর মনটা খুশিতে ভরে গেলো। হঠাৎ মনে হলো ও আর একা না। ওর সাথে সময় কাটানোর জন্য, কথা বলার জন্য কিংবা স্পোর্টস পিরিয়ডে খেলার জন্য একজন ভালো বন্ধু আছে। সায়নীর মুখ থেকে ওর অজান্তই বেড়িয়ে গেলো `থ্যাংক ইউ`।

শান্তনু: থ্যাংক ইউ কেন?

সায়নী: বন্ধুত্বের জন্য

শান্তনু: আমরাতো এমনিই সহপাঠি। তাহলে আমাকেও তো বলতে হয়-তোমাকে থ্যাংকস

সায়নী: হোয়াই

শান্তনু: আমাকে বন্ধু হিসেবে গ্রহন করার জন্য।

সাথে সাথে দুজনে হেসে উঠলো। করিডোরে এর মধ্যেই স্টুডেন্টসদের আনাগোনা বেড়ে গেছে। সহপাঠিরা ক্লাশে ঢুকে পড়ছে। কিছুক্ষনের মধ্যেই নেকস্ট লেসনটা শুরু হবে। শান্তুনু তার সীটে গিয়ে বসলো।

 

একদিন লাঞ্চ ব্রেকের পর সায়নী স্কুলের এক তলার লাইব্রেরীর পাশের কড়িডোরের একটি বেঞ্চিতে বসে খুব মনযোগ দিয়ে একটি বই পড়ছিলো। দূর থেকে শান্তনু সেটা লক্ষ্য করে এবং ওর দিকে এগিয়ে আসে। হাতে আরো বেশকিছু সময় আছে ক্লাশ শুরু হওয়ার।

শান্তনু: আরে সায়নী? কি পড়ছো?

সায়নী: হাই, শান্তনু! এটি একটি ডাইনোসর সম্পর্কে বই। তুমি কি জানো যে কিছু কিছু ডাইনোসর আছে যারা খুব বিশাল আকৃতির

শান্তনু: সত্যি? জানতাম নাতো? আমিও ডাইনোসর পছন্দ করি। একটা বইও পড়েছিলাম। তুমি বুঝি ডাইনোসরকে পছন্দ করো?

সায়নী: হ্যাঁ।

শান্তনু: তোমার প্রিয় ডাইনোসর কোনটি?

সায়নী: টাইরানোসরাস রেক্স! এটি ডাইনোসরদের রাজা। তোমার কাছে কোনটি প্রিয়?

শান্তনু: ওহ, আমার মনে হয় আমি ট্রাইসেরাটপস পছন্দ করি। তাদের সেই ঠাণ্ডা শিং এবং মাথায় একটা বড়ো আকারের ঝিমুনি আছে। দেখতে বড়ো পাখার মতো।

সায়নী:ট্রাইসেরাটপস? সত্যিই ইন্টারেস্টিং

শান্তনু: গত সপ্তাহে আমি একটি ভিডিও ক্লিপ দেখেছি এই ডাইনোসরদেরকে নিয়ে। তুমি কি জানো এ ডাইনোসরদের নামের মানে কী?

সায়নী: জানি।একটি গ্রীক শব্দ থেকে এসেছে "ট্রাইক্রাটপস" নামটি। "ট্রাই" মানে তিনটি এবং "কেরাটপস" যার অর্থ শিংযুক্ত মুখ। সুতরাং ` ট্রাইসেরাটপস` মানে তিনটি শিং যুক্ত মুখ। কি অদ্ভূত, তাই না?

শান্তনু: কি চমৎকার। তুমি ডাইনোসরদের সম্পর্কে এতো কিছু জানো?

সায়নী: তুমি কি দেখেছ ওদের বিশালকৃতির ভয়ানক চেহারা।

শান্তনু: ভয়ানক কেন?

সায়নী: এরা সাংঘাতিক ভয়ানক। আমি খুব ভয় পেয়েছিলাম প্রথম যখন ইউটিউবে দেখি। এরা এমনি খুব লম্বা। মাথার পিছনে একটি বিশাল দেহ। আর দেখনি এদের তিনটি ভয়ানক শিং। দুটি চোখের উপরে এবং একটি নাকের উপরে।

শান্তনু: ঠিক বলেছ। আচ্ছা সায়নী, তুমি কি সব ডাইনোসরের নাম জানো?

সায়নী: ডাইনোসর আমার খুব প্রিয়। এদের সম্পর্কে আমি অনেক পড়েছি, ভিডিও দেখেছি। আমি তাদের অনেককেই চিনি। ডাইনোসররা খুব অদ্ভুত প্রানী। অনেক মজার মজার ডাইনোসরও ছিলো। তুমি কি জানো যে কিছু ডাইনোসরের পালক ছিল? ইন্টারেস্টিং না?

শান্তনু: পালক ছিলো? সত্যিই মজার ব্যাপার। আমি ভেবেছিলাম ডাইনোসররা সব আঁশযুক্ত।

সায়নী: শুধু তাই নয়। কিছু ডাইনোসর তৃণভোজীও ছিল, যেমন ট্রাইসেরাটপস। কিছু ডাইনোসর মাংসাশী ছিল, যেমন টি. রেক্স। তুমি কি জানতে?

শান্তনু: তুমি তো দেখছি ডাইনোসরদের সম্পর্কে অনেক কিছুই জানো। তুমি আর কি কি সাবজেক্ট পছন্দ করো?

সায়নী: আমি ম্যাথ খুব পছন্দ করি। সংখ্যার হিসাব কষতে আমার খুব ভালো লাগে। খুব তাড়াতাড়ি আমি ম্যাথ কষতে পারি। তুমি আমাকে একটু টেষ্ট করো-খুব উৎসাহের সাথে সায়নী জিজ্ঞেস করে শান্তনুকে।

শান্তনু: না না আমি টেষ্ট করবো না। এমনিই জিজ্ঞেস করলাম।

 

সায়নী: তুমি কি জানো - টাইরানোসরাস রেক্স নামের মনে কী? তোমাকে বলেছি, এটা আমার পছন্দের ডাইনোসর।

শান্তনু: নাতো? তুমি জানো কী?

সায়নী: অফ কোর্স। এটি একটি গ্রীক শব্দ `টাইরানস` যার অর্থ অত্যাচারী, এবং "সারোস (sauros)" যার অর্থ টিকটিকি এবং ল্যাটিন শব্দ "rex" থেকে এসেছে `রেক্স` যার অর্থ রাজা। সুতরাং, টাইরানোসরাস রেক্স এর মানে হলো এটি "অত্যাচারী টিকটিকি রাজা"

শান্তনুঃ সত্যিই ইন্টারেস্টিং তো। তার মানে ডাইনোসরের রাজা কিন্তু অত্যাচারী। আচ্ছা এ ডাইনোসরটি কি খুব বড়ো?

সায়নী: ওরে বাপরে বাপ! বড়ো মানে সাংঘাতিক বড়ো।  এই ডাইনোসরটি  মাংসাশী ডাইনোসরদের মধ্যে একটি। বিশাল লম্বা। বইতে পড়েছিলাম এরা নাকি ৫০-৬০ ফিট লম্বা এবং ওজন প্রায় ৭-৮ হাজার কিলোগ্রাম। আর জানো ওদের মাথাটি ছিলো বিশালাকৃতির। চোয়াল ছিলো খুব শক্ত। ওদের কামড় দেয়ার ক্ষমতা সব প্রানীদের চেয়ে বেশী।

শান্তনু:আমি একটি ফিল্ম দেখেছিলাম ডাইনোসরদেরকে নিয়ে। জুরাসিক পার্ক। তুমি দেখেছিলে?

সায়নী: হ্যা। আমি `জুড়াসিক পার্ক-৩ এবং লস্ট ওয়াল্ডও দেখেছিলাম

শান্তনু: আচ্ছা সায়নী। - টাইরানোসরাস রেক্স কি খুব তাড়াতাড়ি দৌড়াতে পারে।

সায়নী: ওরা ঘন্টায় ২৫-৩০ মাইল যেতে পারে।

শান্তনু: থ্যাংকস সায়নী। তুমি আজ আমাকে অনেক কিছু শেখালে

সায়নী: ও কিছু না। তোমার সাথে কথা বলে আমার খুব ভালো লেগেছে।

শান্তনু: আমারও।

সায়নী: তুমিতো সব সাবজেক্টেই খুব ভালো। তবে কোন স্পেশাল সাবজেক্ট আছে কি যেটা তুমি বেশী পছন্দ করো?

শান্তনু: আমি বিজ্ঞান পছন্দ করি, বিশেষ করে মহাকাশ সম্পর্কে আমার বেশ আগ্রহ। গ্রহ এবং ছায়াপথ খুব আকর্ষণীয়। মাঝে মাঝে আমরা আমাদের প্রিয় বিষয়গুলি শেয়ার করবো।

সায়নী: অবশ্যই, খুব ভালো লাগছে। আমি ডাইনোসর সম্পর্কে কথা বলতে পছন্দ করি, তবে আমি অন্যান্য জিনিস সম্পর্কেও বেশ জানি। যেমন পোকামাকড়। টিকটিকি, পিঁপড়ে ..

শান্তনু: বলো কি? পোকামাকড়? দারুণ! খুব ভালো হবে। তোমার কাছ থেকে আমি তা হলে অনেক কিছু শিখতে পারবো। খুব মজা হবে।

সায়নী: হ্যাঁ, আমারও খুব মজা লাগছে।

শান্তনু: ঠিক আছে সায়নী। আমরা একে অপরের কাছ থেকে অনেক কিছু শিখতে পারবো। চল এখন ক্লাসে ফিরে যাই। আজকে গনিত ক্লাশে স্যার গনিত ক্যুইজ দিবেন বলেছিলেন। তুমি কিন্তু অংশ নিবে।

সায়নী: ঠিক আছে, কিন্তু স্যার যে আমাকে পছন্দ করেন না। আমারও স্যারকে ভালো লাগে না।

শান্তনু: কিন্তু কেন?

সায়নী: একদিন দেখনি স্যার আমাকে কিভাবে বকেছে। আমি নাকি বোকা, বুদ্ধিহীন। আমার দ্বাড়া নাকি কিচ্ছু হবে না। স্যার অন্যদেরকে সব সময় প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে। আমাকে কখনো জিজ্ঞেস করে না। তাই আমি ক্লাশে চুপ করে থাকি।

শান্তনু: আমি জানি তুমি গনিত পছন্দ করো। আজ সবার আগে হাত তুলবে।

সায়নী: চল। আমি কুইজ পছন্দ করি। গণিত ধাঁধা সমাধানের মত! অথচ স্যারের ধারনা আমি খুব খারাপ ছাত্রী। তুমি জানো শান্তনু, মিস রিমা খুব ভালো। মিস রিমা ছাড়া কেউ স্কুলে আমাকে পছন্দ করে না।

শান্তনু: ভয় নেই। একদিন দেখবে সবাই তোমাকে পছন্দ করবে।

 

কিছুক্ষন পরেই তোফায়েল স্যার ক্লাশে এসে ঢুকলেন। সব সময় স্মার্ট হয়ে ক্লশে আসেন। ইন করে শার্ট পড়েন। শার্টের উপর একটি ব্লেজার আর পায়ে কালো বিদেশী ব্র্যান্ডের জুতো। কোনদিন ক্লাশ মিস করেননি, কিংবা দেরী করে ক্লাশে আসেননি। ঠিক সময়ের আগেই ক্লশে আসেন। ম্যাথ স্যরের ক্লাশে কেউ দেরীতে আসার সাহস পায় না। বেশ কড়া মেজাজের। কেউ দেরী করলে কিংবা ক্লাশে দুষ্টুমী করলে নানা ধরনের কথা বলেন, সিরিয়াসলি বকাবাদ্য করেন। নানা ধরনের শাস্তি দেন। সায়নীর এখনো মনে আছে একদিন এক সহপাঠিকে শাস্তি দেওয়ার কথা।

নিয়মিত ক্লাশ শুরু হয়। এক সহপাঠি রুহুল পনের মিনিট লেইট করে ক্লাশে ঢুকতে জিজ্ঞেস করে-

-মে আই কাম ইন স্যার

স্যার অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে। তার পর বলে-নো। তুমি আগে স্কুলের মাঠটার চারিদিকে একবার ঘুরে আসো।

রুহেল: কেন স্যার

স্যার: আগে ঘুরে আসো তারপর বলছি।

রুহুল আর কিছু বলেনি। লজ্জায় মাথা নত করে মাঠের দিকে পা বাড়ায়।  কিছুক্ষন পরে এসে আবার জিজ্ঞেস করে-মে আই কাম ইন স্যার।

স্যার: কাম ইন। মাঠটা ঘোরা ছিলো দেরীতে ক্লাশে আসার শাস্তি। আর কখনো দেরী করবে না। স্যারের মুখের উপর তর্ক করতে কেউ সাহস পায় না। রুহুল চুপচাপ নিজের সীটে গিয়ে বসে পড়লো। আর কোনদিন ম্যাথ স্যারের ক্লাশে দেরী করেনি।

তবে সায়নী এই কয়েক মাসে এই স্যার সম্পর্কে অন্ততঃ এইটা বুঝেছে যে এই স্যরটি খুব দুষ্টু, খুব খারাপ। সবার সাথে এক রকম ব্যাবহার করে না। কেউ কেউ স্যারের খুব প্রিয় যেমন তিতলি। ওদের কেউ ভূল করলে স্যার কখনো কিছু বলেন না। কোন শাস্তি দেন না। অথচ অন্যদেরকে নানা ধরনের শাস্তি দেয়।

স্যার এবার ক্লাশ শুরু করলেন। ডিসেম্বরে জুনিয়র স্কুল অলিম্পিয়াদ। এই ক্লাশ থেকে বেশ কয়েকজন নাম দিয়েছে। প্রতিযোগীতা হবে ক্লাশ সিক্স, সেভেন ও অষ্টম শ্রেনীর স্টুডেন্টসদের মধ্যে। প্রথম বেষ্ট তিনজন স্থান পাবে থানা পর্যায়ে, তার পর প্রতিযোগীতা হবে জেলা পর্যায়ে।  তারপর বিভাগ এবং জুন মাসে হবে জাতীয় পর্যায়ে।

কিন্তু সায়নী অলিম্পিয়াদে নাম দেয়নি। তোফায়েল স্যারই ঠিক করবেন কারা অলিম্পিয়াদে থাকবে। আজকে তাই ম্যাথস কুইজ প্রতিযোগীতা হবে। বাছাই করে মোট পাঁচজনকে ডিসেম্বরের জন্য তৈরী করবেন। স্যার আজকের ম্যাথস কুইজটি প্রসঙ্গে বিস্তারিত ধারনা দিয়ে ক্যুইজটি শুরু করলেন।

শিক্ষক: প্রথম প্রশ্নটি খুব সিম্পল। যে উত্তরটি জানো হাত তুলবে। হাত না তুলে উত্তর দিবে না কিন্তু। ঠিক আছে?

স্টুডেন্টস: ইয়েস স্যার

শিক্ষক: সংখ্যাতত্ব দিয়ে শুরু করা যাক। বলতো ক্ষুদ্রতম মৌলিক সংখ্যা কোনটি?

ক্লাশের অনেকেই হাত তুলেছে। সায়নীও হাত তুলেছে। তার মধ্যে শিক্ষক সামনের সারির এক জনকে উত্তর দিতে বলে।

ছাত্র:দুই (২) স্যার

শিক্ষক: গুড। এবার বলতো ৬ এবং ৮ এর মধ্যে সর্বনিম্ন সাধারন গুনিতকটি (Least Common Multiple) কি?

এবার ক্লাশে হাত তোলার সংখ্যার কমে গেছে। ৪-৫ জনে হাত তুলেছে। তবে সবার আগে হাত তুলেছে সায়নী। কিন্তু শিক্ষক সায়নীর প্রথম হাত তোলা দেখেও ওকে প্রশ্ন না করে অন্য একজনকে ডাকে।

ছাত্র: ১২ স্যার

শিক্ষক: তোর মাথা না ছাই। গর্দভ কোথাকার। উত্তর না জেনে হাত তুলিস কেন? বসে পড়! মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকিস না?-তারপর শিক্ষক আরেকজনকে উত্তর দেয়ার জন্য ডাকলেন। সেও ভূল উত্তর দিলো। এবার শিক্ষক একটু ক্ষেপে গেলেন

-মাথায় কি গোবর ঢুকেছে নাকি? কি হলো আজ? এতো সহজ প্রশ্ন মাথায় ঢুকছে না আবার ম্যাথস অলিম্পিয়াদে যাবে?

কিন্তু শিক্ষক তোফায়েল আহম্মেদ সায়নীর দিকে একবারও তাকালেন না। চশমার ভেতর থেকে চক্ষু যুগল এবার তিতলির দিকে পড়লো। -তিতলি তুমি বলতো সঠিক উত্তরটি কী?

তিতলি? ২৪ স্যার।

শিক্ষক: ওয়েল ডান। এবার একটা জ্যামিতি থেকে খুব সহজ একটা প্রশ্ন দেবো। সময় মাত্র এক মিনিট। এর মধ্যেই কিন্তু হাত তুলতে হবে। বলতো একটি ত্রিভুজের একটি কোণ ৪৫ এবং অন্যটি ৪৫ ডিগ্রী হলে, তৃতীয় কোণের পরিমাপ কত?

সাথে সাথেই সায়নী হাত তুললো। তার পর আরো দুই জন। শিক্ষক এবার কিছুটা অবাক হলেন। কিন্তু তাও সায়নীকে জিজ্ঞেস না করে শান্তনুকে জিজ্ঞেস করে। শান্তনু যথারীতি উত্তর দেয়-৯০ ডিগ্রী স্যার।

শিক্ষক: এবার একটা সহজ বিজগনিত। ৩.৫ মিটারকে সেন্টিমিটারে রূপান্তর করলে কতো হবে। সময় মাত্র ১৫ সেকেন্ড।

বলার সাথে সাথে সায়নী হাত তুলে। স্যার এবার সত্যিই অবাক হলেন। এবার সায়নীকে উত্তর দিতে বললেন

সায়নী: ৩৫০ সেন্টিমিটার স্যার

স্যার কিছুই বললেন না।বরং সাথে সাথে আরেকটি প্রশ্ন করলেন

শিক্ষক: একটি আয়তক্ষেত্রাকার বাক্সের দৈর্ঘ ৫ সেমি প্রস্থ ৩ সেমি এবং উচ্চতা ৮ সেমি হলে, এর আয়তন কত? সময় ১০ সেকেন্ড। সায়নী তুমি বলো।-সায়নী সাথে সাথেই উত্তর দিলো- ১২০ ঘন সেন্টিমিটার স্যার

এবার সত্যি সত্যিই স্যার চিন্তায় পড়ে গেলেন। খুশি হয়েছেন কিনা বুঝা যাচ্ছে না। সায়নীর ঝটাপট উত্তরে সবাই বিস্মিত। কেউ ভাবতেও পারছে না কি করে এতো তাড়াতাড়ি সায়নী উত্তর দিচ্ছে। সায়নীর উত্তরে শান্তনু খুব খুশী। তবে একজন খুশী হতে পারছেনা। সেটা তিতলি।  তিতলির মাথা যেন গরম হয়ে যাচ্ছে। ফিস ফিস করে নিজে নিজে কি যেন বলছে।

এবার স্যার বললেন-এবারের প্রশ্নটি শেষ প্রশ্ন। কিন্তু সময় ত্রিশ সেকেন্ড। এর মধ্যেই উত্তর দিতে হবে।

শিক্ষক: ১২৪৯ এর সাথে ৩৮৯ যোগ করে ৯৭৭ বিয়োগ করলে ফল কত হবে? হিসাবটা মাথায় করবে কিন্তু। কোন কিছু ব্যাবহার করবে না।

দশ সেকেন্ডের মধ্যেই সায়নী হাত তুললো। স্যার সায়নীর হাত তোলা দেখে এখন সবার দিকে তাকাচ্ছে। দেয়াল ঘড়িতে টিক টিক করে ঘড়ির কাটাটা দৌড়াচ্ছে। তিতলি যোগ বিয়োগে মনযোগ না দিয়ে সায়নীর দিকে তাকিয়ে আছে। সায়নীর হাত তোলা দেখেই দাঁতে ঠোট কামড়াতে লাগলো।

সময় এগুচ্ছে। বিশ সেকেন্ড তার পর এক সময় ত্রিশ সেকেন্ড। কিন্তু ক্লাশের কেউ আর হাত তুললো না। স্যার এবার ভ্রু কুচকাতে লাগলেন। একটু বিরক্ত হয়েই শান্তনুকে জিজ্ঞেস করলেন-

-কি শান্তনু। তুমিও পারলেনা? ক্লাশে অনেক বারতো মেন্টাল ম্যাথ করানো হলো। বুঝছি, বাড়ীতে  তোমাদের কোন প্র্যাকটিস নাই।

এবার তোফায়েল স্যার সায়নীর দিকে এগিয়ে এলেন।

শিক্ষক:তুমি কি উত্তরটা জানো?

সায়নী: ইয়েস স্যার-তারপর সায়নী উত্তরটা দিলো

স্যার সায়নীর মুখ থেকে সঠিক উত্তরটি শুনে খুব খুশী হলেন। ওয়েল ডান বলে জোড়ে চীৎকার করে উঠলেন। সায়নীর মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন-সায়নী, ইউ আর সিলেক্টেড।

হঠাৎ স্যারের কথায় সায়নীর চোখে জল এসে গেলো। স্যারের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো-থ্যাংক ইউ স্যার।

ক্লাশের সবার চোখ তখন সায়নীর দিকে স্থির হয়ে আছে।

চলবে---)



Read full book here: Click here to download the PDF file