সায়নীর স্বপ্ন দুই


Author: ড. পল্টু দত্ত

সায়নীর স্বপ্ন-দুই

Summary:

মাত্র ছয় মাস হলো সায়নী এই নতুন স্কুলে এসেছে।

স্কুলটি বসুন্ধরায়। ছেলে-মেয়েরা একসাথে পড়াশুনা করে এই স্কুলে। ইংরেজী মিডিয়াম। বিদেশী স্কুল। বেশ নামী-দামী।

সায়নীর মা বলতো সায়নীর নাকি বুদ্ধি কম। পড়ালেখায় নাকি মন নাই। ওর দ্বারা নাকি তেমন কিছু হবেনা। তবে এই সব ভাবলেও সায়নীকে ইংরেজী মিডিয়াম স্কুলে পাঠাতে ভূল করেনি।

-ওকে কিন্তু ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পাঠাবে। কু-এডুকেশান। ছেলে-মেয়েরা যেখানে এক সাথে পড়ালেখা করে। এ জাতীয় এডুকেশান সিস্টেমে মেয়েরা ভালো করে। সেখানে ছেলেরা এবং মেয়েরা আলাদাভাবে চিন্তা করে। ক্লাশরুম আলোচনায় গতি আসে। আদব কায়দা শিখতে পারবে। বিদেশী মেম সাহেবদের মতো তর তর করে ইংরেজীতে কথা বলতে পারবে। বড়ো হয়ে বিদেশে যেতে পারবে। নরমাল স্কুলে পড়ে ওর কিচ্ছু হবে না।

 

মায়ের কথায় সায় দিয়েছিলো সায়নীর বাবা। তাছাড়া উপায়ও নেই। অযথা ঝগড়া-ঝাটি সায়নীর বাবা চায় না।

কে,জি থেকে পুরো প্রাইমারী স্কুল পুরনো ঢাকার একটি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়াশুনা করে সায়নী।

সব সময় কয়েকজন করে টিউটর রেখে দেওয়া হয়েছে বাড়ীতে। সাইন্স, ম্যাথস, ইংলিশ এমনকি জিওগ্রাফির জন্যও একজন টিচার ছিলেন। ইংলিশ মিডয়ামটা দাদীর একেবারে অপছন্দের। কিন্তু নিজের ছেলেকে বলার সাহস পেলেন না। তবে একদিন ফিস ফিস করে সাহস নিয়ে যেটা বললেন-

-ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ুক সেটা ভালো কথা। কিন্তু ইংরেজীর ঠেলায় বাংলাটা যেন ভুলে না যায়। তাই ওর জন্য একজন বাংলা পড়ানোর শিক্ষক নিয়ে আসবে। আমি অন্ততঃ ওর লগে কথা বলতে পারবো।

-ঠিক আছে মা তাই হবে-ছেলে জবাব দিলো।

মা-ছেলের কথা শুনে সায়নীর মা দৌড়ে এসে ফোড়ন কাটে-

-বাংলার শিক্ষক রাখার কি দরকার? এতে ইংরেজী শেখার ভারী অসুবিধা হবে।

-কোন অসুবিধা হবে না। বাংলার মেয়ে বাংলায় কথা না বলে ইংরেজীতে ঢিং ঢিং করে কথা বলবে? এতে তোমরা খুশি, তাই না?-বেশ রাগ করেই মেপে মেপে কথাগুলি বললেন সায়নীর দাদী।

-আপনি এতো রাগ করছেন কেন মা? আমি কি কিছু খারাপ বললাম-সায়নীর মার নরম সুর।

-তোমরা অবান্তর কথা বলায় কোন দোষ নেই। আমার রাগটাই তোমাদের ধরা দেয়। আমি কি খারাপ কথাা বললাম। সায়নী যদি ঘরেও বংলায় কথা না বলে আমি কি করে থাকবো? কার সাথে কথা বলবো?

-কেন, সায়নীতো বাংলায় কথা বলেই। তোমার সাথেইতো ও সবসময় থাকে। তোমার কথা বলতেতো কোন অসুবিধা হচ্ছে না।

-এখন হচ্ছে না। এখনো তো ও ঠিকমতো পড়াশুনা শুরু করেনি। যখন শুরু করবে তখন আর পারবে না। দেখনা পাশের বাড়ীর রফিকের মেয়েটা? মেয়ে না যেন একটা বান্দর। সারাক্ষন ইংরেজীত কথা বলে। ইংরেজ মেয়েদের মতো জামা-কাপড় পড়ে। মাডাও হইছে একটা বজ্জ্বাতের হাড্ডি। বাংঙালীও না ইংলিশও না। একটা বাংলিশ।

-কেন, ওর মা কি করছে?

-কেন, দেখলে না সেদিন কি বলে গেলো।-আমার মাইয়া বাংলাদেশী মেয়েদের মতো সেলোয়ার কামিজ পড়তে চায় না বিদেশী জিন্স পড়ে। ছেলেদের মতো সার্ট পড়ে। বিদেশী কেডস পড়ে। আই ফোনে টিক টক বানায়। বিদেশী পারফিউমে ওর ঘর নাকি ভরে গেছে। ফাষ্ট ফুড ছাড়া পেটে কিচ্ছু নাকি ঢুকে না। ওর বাবা ওর জন্য একটা কুকুর আনবে বলেছে। -আরো কতো কি। কথা শুনলে একেবারে ঘেন্না ধরে যায়। গা জ্বলে। বাঙালীর ঘোড়ারোগ। একটু পয়সা কড়ি হলেই ঘরে কুত্তা-বিড়াল নিয়া আসবে। ছেলে-মেয়েকে ইংরেজীতে পড়াবে। কাড়ি কাড়ি শিক্ষক রাখবে। যতো সব হতোচ্ছারির দল।

-ঠিক আছে মা। সায়নীর জন্য বাংলার টিচার থাকবে। আর আপনিতো সবসময় বাংলায় ওর সাথে কথা বলবেন। সায়নী বাংলাটা কখনো ভুলবেনা।

-তাই যেন হয়

 

সায়নীর বাবা খুব বড়লোক। এক্সপোর্ট-ইম্পোর্ট এর ব্যাবসা। ঢাকায়-চিটাগাং এ বড়ো অফিস। অনেক লোকজন কাজ করেন অফিসে। ঘন ঘন সায়নীর বাবাকে বিদেশে যেতে হয়। তবে চীন আর সিংগাপুরেই বেশী যান।

সায়নী এখন বড়ো। বুঝার বয়েস হয়েছে। মাঝে মধ্যে সায়নীর মা-বাবা ঝগড়া করেন। মা জোড়ে জোড়ে বাবার সাথে চীৎকার করে উঠেন। বাবা তখন রাগে মাকে ঠাস ঠাস করে থাপ্পর কষান। এই সব দেখে সায়নীর বুকটা ধরপর করে উঠে। রাগে মাথার চুলগুলি ছিড়তে থাকে। তর্জনী মুখের সামনে এনে ঘুরাতে থাকে। দৌড়ে গিয়ে দাদীমার পাশে শাড়ীর আচলে মুখ লুকিয়ে থাকে। সায়নীর মাথায় ঘুরতে থাকে মা-বাবার কথাগুলো-

-তুমি এতো নীচ, এতো ছোটলোক। শেষ পর্যন্ত অফিসের সেক্রেটারীর সাথে…ছিঃ ছি;-সায়নীর মায়ের ধীক্কার

-তুমি এতো বড়ো বড়ো কথা না বললেও পারো। সাড়াক্ষনতো সপিং আর বন্ধু-বান্ধবীদের সাথে পড়ে থাকো। সাঁজ-গোজ, ঘুরে বেড়ানো এইতো তোমার সংসার। স্বামীর দিকে নজর দিবে কখন?

-দেখ, কথা ঘুরাবেনা। আমি সবই শুনতে পাই।

-কি শুনতে পাও-রাগান্বিত সায়নীর বাবা।

এইভাবেই শুরু হয় ওদের ঝগড়া-ঝাটি। একসময় তা রুপ নেয় হাতা-হাতিতে। এই ঝগড়া-ঝাটির ব্যাপারটা ইদানীং বেশী বেড়ে গেছে।

সায়নীর দাদীমা বলেন-সায়নীর মা নাকি বড্ডো পাঁজী। সংসারী নয়। খুব আড্ডাবাজ। উগ্র আধুনিকতা সারা শরীরে। কি লম্বা লম্বা কালো চুল ছিলো এক সময়। বাঙালী বউদের মতো খুব সুন্দর করে শাড়ী পড়তো। প্রতিদিন দুবেলা রান্না করতো। সংসারের দিকে বেশ নজর ছিলো। ছেলে অফিসে যাওয়ার সময় জুতাগুলি এগিয়ে দিতো। কোর্টটা দুহাতে পড়িয়ে দিতো। এই সব দেখে দাদীমার আনন্দে বুকটা ফুলে উঠতো।

 

হঠাৎ করে একদিন কি হলো।

পাশের বাড়ীর বান্ধবীর সাথে ঢাকার নিউমার্কেটে গেলো। যখন ফিরে এলো তখন দাদীমা নিজের ছেলের বউকেই চিনতে পারেননি। অনেকক্ষন মুখের দিকে তাকিয়েছিলো। একি কান্ড! চুলগুলি কেটে একেবারে ছোট করে ফেলেছে। দাদীমা রাগের মাথায় বলেই ফেললেন-

-একি করেছ বৌমা? এতো সুন্দর চুল কাইটা ফালাইলা? আবার কি সব রং মাখছো?

-না, না মা। রং না।  এইটাকে পিক্সি হেয়ার স্টাইল বলে। হেয়ার কালার দেওয়া হয়েছে। লম্বা চুলে বড্ডো অসুবিধা। স্নান সেরে চুলগুলাকে সামলানো খুব কষ্ট।

-ভালোই করেছ। কয়দিন পরে দেখবো শাড়ী ছেড়ে মেমসাহেবদের জামা কাপড় পড়বে।

-তাই করবো মা।-এই বলেই মুখের উপর ব্যাগটি তুলে ধরলো-এই যে স্কাট আর গাউন কিনে নিয়ে এসেছি।

এই বলেই হর হর করে সায়নীর মা ভিতরে চলে গেলো।অবাক হয়েই তাকিয়ে রইলো দাদীমা। আর কিছু বলার সাহস পেলে না।

 

সেই থেকেই শুরু হলো সায়নীর মায়ের নতুন জীবন।

ঘন ঘন পার্লারে যাওয়া। চুলে নতুন নতুন রং বসানো। বিদেশীদের মতো গাউনের সাথে হাই হিল পড়া, পার্টিতে যাওয়া এমনকি মাঝে মাঝে ওমেন্সদের ক্লাবেও যাওয়া শুরু করেছে। ইদানীং তাসও নাকি খেলে। ঘরেও সারাক্ষন ম্যাক্সী পড়ে থাকে। দাদীমা শুধু দূর থেকে এ সব দেখে যায়। গা ঘিন ঘিন করে উঠে। কিন্তু কিছু বলতে পারে না। এ সব নিয়ে ছেলের সাথেও বেশ কয়েকবার বাক-বিতন্ডা হয়েছে। তার পর আস্তে আস্তে ছেলেও সব কিছু মেনে নেয়।

 

সায়নীর এই সব কিচ্ছু ভালো লাগে না। বেশীর ভাগ সময়ই তাই নিজের রুমে কাটায়। দাদামী ছাড়া এই রুমটাতে আর কেউ সচরাচর আসে না। সায়নীর মা কখনো সখনো আসে। তবে রুমে ঢোকার আগে দড়জায় তিনবার ঠক ঠক করে আওয়াজ করে। সায়নী যখন-`ইয়েস কাম ইন`বলে তখনই রুমে ঢুকবে। তা ছাড়া ঢুকবে না। বিদেশী কায়দায় নিজকেও তৈরী করার চেষ্টা করছে।

 

সায়নীর শয়নকক্ষটি সায়নীর খুব প্রিয়। পূর্বমূখী বিশাল একটি কাঁচের জানালা। দক্ষিন পাশের জানালাটির পাশেই বারান্দাটি। বারান্দার পাশেই শয়নকক্ষে সকালের নরম সূর্যের স্নিগ্ধ আভা ঢুকে পড়ে। আর দক্ষিনের জানালা দিয়ে শির শির করে বাতাস আছড়িয়ে পড়ে। খুব ভালো লাগে সকালের মৃদু উষ্ণ পরিবেশটা।

সায়নীর বেডটও বেশ বড়ো। মখমলে বিছানা। দেয়ালগুলি ফ্রেমযুক্ত ফটোগ্রাফ এবং রঙিন পেইন্টিং দিয়ে সজ্জিত। টেলি টাবিজ আর পাওয়ার রেইঞ্জারের বেশ কয়েকটি ছবি দেয়ালে আটকানো আছে। ছবিগুলোর সাথে সায়নীর যেন একটা ব্যাক্তিগত সম্পর্ক রয়েছে। কোণে একটি আরামদায়ক পড়ার জন্য ভাল আর্মচেয়ার। তার পাশেই  ভাল সব পছন্দের বইগুলির একটা ছোট্ট ঘুরানো রেক। রেকটা ঘুরিয়ে পছন্দের বইটা হাতে নিয়ে সায়নী পায়ের উপর পা দিয়ে কখনো সখনো পড়তে ভীষন পছন্দ করে।

বিছানার পাশের টেবিলে ফুলের একটি ছোট তোড়া থেকে নির্গত ল্যাভেন্ডারের সুগন্ধি সাড়া রুমটিতে ছড়িয়ে পড়ে। এইখানে সায়নীর সময় কাটে। কিন্তু খুব একাকীত্বের।

 

সায়নী তিনতলার যে রুমটাতে থাকে তার সাথে লাগোয়া বারান্দাটি। দক্ষিনমূখি। তার পাশেই কৃষ্ণচূড়ার গাছটি। কৃষ্ণচূড়ার রংএ সায়নীর উচ্ছ্বাস বেড়ে যায়। ছোট ছোট চড়ুই পাখি মাঝে মধ্যে খেলতে আসে। কৃষ্ণচূড়ার ডালে ডালে খুনসূটি করে। কিচির মিচির করে আওয়াজ তুলে। লাফ দেয় এক ডাল থকে অন্য ডালে।  সায়নীর মনটা তখন একাকীত্বের বন্দিদশা থেকে কিছুক্ষনের জন্য মুক্ত হয়ে আসে। চড়ুই পাখির মুভমেন্ট খুব মনযোগের সাথে লক্ষ্য করে।

এই তলার বারান্দাটি বেশ রাজকীয়। বেশ প্রশস্থ। তিনদিকে রঙিন লোহার রডদিয়ে মোড়ানো। সায়নীর কাছে এই সুন্দর সাঁজানো বারান্দাটি একটি পরিমার্জিত অভয়ারণ্য মনে হয়। যেন কমনীয়তার আচ্ছাদনে প্রকৃতির এক অনবদ্য সিম্ফনি। অলঙ্কৃত লোহার রেলিংয়ে আবদ্ধ, বারান্দাটি সুন্দরভাবে প্রসারিত। অভিনব স্থাপত্যের একটি উত্তম উদাহরন যা আভিজাত্যেরই প্রতীক।

নানা ধরনের কয়েকটি ফুলের টবও আছে। তারমধ্যে আরাবিয়ান জেসমিন, আফ্রিকান ম্যরিগোল্ড, পরসেলেইন ফ্লাওয়ার আর পারপল হার্ট। একটা লাল ফুলের ক্যাকটাসও আছে। বারান্দাটা সায়নীর খুব প্রিয়। স্কুল থেকে এসেই এই বারান্দায় একবার ঢু মারবেই।

ভোরের প্রথম আলো যখন বারান্দায় এসে পড়ে তখন আলো-ছায়ার এক অপূর্ব দৃশ্য তৈরী হয়। বারান্দায় ঝুলন্ত ঘন্টাগুলো সকালের হাওয়ায় টুং টাং করে বাজতে থাকে। মার্বেল টাইলসগুলি চকচক করতে থাকে। বারান্দার একপাশে সায়নীর বসার জন্য খোদাই করা কাঠের আসবাবপত্রের একটি রাজকীয় সেট রেখে দেওয়া হয়েছে। যেন - জাঁকজমকের মধ্যে আরাম করার একটি উত্তম জায়গা।

মোটা মোটা দুটা কুশন আছে শয়ন কক্ষে। সেরা কারিগরদের তাঁত থেকে তৈরি কাপড়ে গৃহসজ্জার সামগ্রী, একা সায়নীর জন্য খুব বেশী। এই সবে সায়নী মাঝে মধ্যে হাঁফিয়ে উঠে। সায়নীতো এই সব চায় না। এতো আয়েশ ওর প্রয়োজন নেই। ওর চাহিদা খুব কম। দাদীমার আদলেই যেন ওর জীবন। খুব সাধারন।

সায়নীর প্রয়োজন একটু ভালোবাসা। মায়ের, বাবার, সহপাঠীদের।

তবে সায়নীর সবচেয় বড়ো বন্ধু হলো তার পাখিটা। বছর দুএক আগে তার বাবা অনেক খোঁজাখুজি করে এই পাখিটি কিনে আনে সায়নীর জন্য। বারান্দার এক পাশে ওর থাকার পাকা বন্দোবস্ত করা হয়েছে। পাখিটির আদিবাস নাকি আফ্রিকার কঙ্গোতে। তাই এর নাম কঙ্গো গ্রে প্যারট। এ পাখিটি যেন সায়নীর জন্য নিয়ে এসেছে এক দন্ড শান্তি, ভালোবাসা আর বেঁচে থাকার প্রেরনা।

পাখিদের মধ্যে আফ্রিকান গ্রে প্যারট সবচেয়ে বুদ্ধিমান। গায়ের রং ধূসর। দেখতে ছোট হলেও ছোট্ট একটা মস্তস্কের চেনার ধারন ক্ষমতা খুব বেশী। এরা শব্দ অনুকরন করতে খুব ওস্তাদ। এমনকি প্রতিধ্বনিও অনুকরণ করতে পারে এই পাখি। কেউ দড়জা খুললে, কিংবা টেলিফোন বেজে উঠলে এরা বুঝতে পারে। সবচেয়ে মজার ব্যাপর হলো মানুষের কণ্ঠস্বর নকল করতে জুরি নেই গ্রে প্যারটের। এই পাখির বৈজ্ঞানিক নাম পিসিটাকাস ইরিথাকাস হলেও কঙ্গো গ্রে প্যারট, ওল্ড ওয়াল্ড প্যারট নামেও এরা বেশ পরিচিত।

সায়নী প্যারটদেরকে নিয়ে বেশ লেখাপড়া করেছে। ইন্টারনেট থেকে অনেক কিছু জেনেছে।  পৃথিবীতে এখন পর্যন্ত মানুষ ৩৪০ প্রজাতির প্যারটের সন্ধান পেয়েছে। যাদের অধিকাংশই বাস করে গ্রীস্মমণ্ডলীয় এবং নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলে।

 

তবে বাবার এই প্যারটটি আনার পিছনে কারন হলো তার এক বন্ধুর পরামর্শ। দাদীমাই সায়নীকে বলেছিলো। বন্ধুটি নাকি খুব বড়ো ডাক্তার। আমেরিকায় থাকে। সায়নীর অটিজমের কথা শুনে সেই আংকেল বাবাকে বলেছিলো পারলে একটি আফ্রিকান গ্রে প্যারট কিনে দিতে। এই পাখিগুলো নাকি অটিজমে আক্রান্ত কিশোর-কিশোরীদের জন্য ভাল পোষা প্রাণী হিসাবে বিবেচিত হয়।

মানুষদের সাথে এরা নাকি খুব তাড়াতাড়ি বন্ধন তৈরী করতে পারে। বুদ্ধিতে নাকি সব পাখিদের উপরে। অটিজম আক্রান্তদের মতো এই সব পাখিরা তাদের দৈনন্দিন জীবনে রুটিন এবং কাঠামো পছন্দ করে। এরা শব্দ অনুকরনে বেশ ওস্তাদ। তাছাড়া এইতোতা পাখির বকবক বা তার ডানার মৃদু ঝাঁকুনির ছন্দময় শব্দ একটি শান্ত পরিবেশ তৈরী করে। এটি অটিজমে আক্রান্ত শিশুদের জন্য বিশেষভাবে উপকারী। পাখি পোষার স্পর্শকাতর অভিজ্ঞতা, প্রাণবন্ত পালকের চাক্ষুষ উদ্দীপনা এবং তোতাপাখির কণ্ঠস্বরের শ্রবণ প্রতিক্রিয়া একটি সংবেদনশীল-সমৃদ্ধ এবং ইতিবাচক অভিজ্ঞতার সৃষ্টি করে।

অবসর সময়ের বেশ একটা বড়ো অংশ সায়নী এই প্যারট বা তোতাপাখির সাথেই কাটায়। ওকে বাংলা কথা শেখায়। মাঝে মধ্যে দাদীমাকেও নিয়ে আসে ওর সাথে খেলতে।

সায়নী ওর একটা নাম দিয়েছে। সুইটি। এই নামেই সায়নী ডাকে।

 

বিকেলটায় সায়নীর বারান্দাটা আরো সুন্দর হয়ে উঠে। সেই সময় সায়নী বারান্দায় গিয়ে বসে। এই সময়টাতে কোন শিক্ষক পড়াতে আসেন না।

আধো আলো-ছায়ার পড়ন্ত বিকেলে হাজার ফায়ারফ্লাইসের কোমল আলোকসজ্জায় বারান্দাটি জ্বলজ্বল করে। কি আরামদায়ক একটি উষ্ণ এবং অন্তরঙ্গ আভা ছড়ায়।  মুহর্তে পরিনত হয় পরিমার্জিত নান্দনিকতার একটি জীবন্ত ক্যানভাসে। রেলিং ধরে সায়নী ফায়ারফ্লাইসের নাচা নাচি দেখে। দুরে আকাশে ডুবে যাওয়া লাল সূর্যটাকে দেখে। তোতাপাখিটির সাথে কিছু ক্ষন কথা বলে। এক সময় আবার রুমে ফিরে আসে।

তিন তলাতে মোট চারটি রুম। একটি সিটং রুমও আছে। পুরো তিন তলায় সায়নী ও সায়নীর দাদীমা থাকে। একটি রুম সায়নীর পড়ার রুম। পড়ার টেবিলটি সায়নীর খুব পছন্দের। বেশ বড়ো সড়ো। টেবিলের দুপাশেই বই রাখার রেক। থরে থরে অনেক বই সাঁজানো আছে। তবে প্রায় সব বই ইংরেজীতে। দুএকটি বাংলা বইও আছে। এডভেঞ্চার উপন্যাস। ছোটদের। তবে মায়ের কাছে বাংলা বই পড়াটা অপছন্দের। তাই রাতে লুকিয়ে লুকিয়ে পড়ে। বেশ ভালো লাগে। পড়তে পড়তে এক সময় ঘুমিয়ে পড়ে।

প্রথম দিকে বেশ কিছু শিক্ষক সায়নীকে বেশী দিন পড়াতে পাড়েনি।

অনেকে এসেছে কিন্তু বেশীদিন টিকে থাকতে পারেননি।

সায়নী যখন ক্লাশ থ্রিতে পড়ে তখন সায়েন্সের এক শিক্ষক আসেন। বয়েস সম্ভবত পয়ত্রিশের কাছাকাছি। ঢাকার এক অভিজাত স্কুলের শিক্ষক। সব সময় পায়জামা-পাঞ্জাবী পড়েন। মাথায় একটি চোঙ্গার মতো কালো টুপি পড়তেন। কাঁচা-পাকা দাঁড়িতে মুখ ভর্তি।

সেদিন ছিলো ছুটির দিন। শুক্রবার। সায়নীর মা আগেই সায়নীকে বলে রেখেছিলো শিক্ষক আসার কথা। সকাল দশটায় আসবে।

ছুটির দিন সায়নী একটু দেরী করেই ঘুম থেকে উঠে। সেদিনও তাই হলো। ঘুম থেকে উঠতে উঠতে নয়টা বেজে যায়। ঘুম থেকে উঠে চোখ কচলাতে কচলাতে বাথরুমে যায়। কাজের মেয়েটি এসে ওর হাত মুখ ধুইয়ে দেয়। তারপর খাওয়ার টেবিলে বসে খাওয়া দাওয়া করে। সেখান থেকে সোজা চলে যায় বারান্দায়।

ঠিক কাটায় কাটায় দশটার সময়ই সায়েন্সের শিক্ষক আলী আহম্মেদ আসেন। মা যথারীতি তিনতলার সিটিং রুমে বসান এবং সায়নীকে আসতে কাজের মেয়েকে দিয়ে খবর পাঠান।

সায়নী তখন একটা ছোট্ট টেনিস বল হাতে নিয়ে খেলছিলো। কাজের মেয়েটি ডাকাতে সায়নী একটু বিরক্তি বোধ করলো। বলটি হাতে নিয়েই সিটিং রুমে ঢুকলো।

হঠাৎ কি মনে করে বলটা শিক্ষকের দিকে ছুড়ে মারলো। আলী আহম্মদ যে মুহুর্তে সায়নীর দিকে ফিরে তাকাতে যাবেন ঠিক তখনি বলটি গিয়ে দুচোখের মধ্যে কপালের অংশে ঠাস করে গিয়ে পড়ে। কয়েক মুহুর্তের জন্য শিক্ষক যেন কিছুই ঠাহর করতে পারেননি। ওফ করে উঠেন। ধীরে ধীরে চোখ খুলে অবাক বিস্ময়ে সায়নীর দিকে তাকিয়ে থাকেন। সায়নী তখন অন্যদিকে তাকিয়ে আছে।

সায়নীর মা বসেই ছিলেন। একেবারে হতভম্ব। তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়ালেন-

-ছিঃ ছিঃ সায়নী। উনি তোমার নতুন টিচার। সরি বলো-সায়নীর মার উত্তেজিত কন্ঠ

-আমি সরি বলবো না। -অন্যদিকে তাকিয়ে তাকিয়ে উত্তর দিলো সায়নী।

-না, জিদ করো না। সরি বলো। তা না হলে উনি তোমাকে পড়াবে না।

-খুব ভালো। আমি পড়তে চাই না।

-থাক, থাক। ওর সাথে আর রাগ করবেন না। ওতো এখনো ছোট। না বুঝেই বলটা মেরেছে।-এ বলেই নতুন শিক্ষকটি সায়নীর দিকে তাকিয়ে বললেন-এদিকে আসতো মা।

-আমি তোমর মা না। আমি সায়নী

-সরি। ভূল হয়ে গেছে। এবার আমার কাছে আসো সায়নী।

সায়নী আর কথা বাড়ায়নি। অন্যদিকে তাকিয়েই শিক্ষকের কাছে এলো। তার কিছুক্ষন পরে সায়নীকে নিয়ে পড়ার রুমে এসে পড়ানো শুরু করলেন।

কিন্তু টিচার লক্ষ্য করলেন সায়নী যখন কথা বলে তখন শিক্ষকের দিকে না তাকিয়ে অন্য দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে কথা বলে। শিক্ষক কিছুটা বিরক্ত হলেন। এক সময় একটু ধমকের সুরে কথা বললেন-কি অসভ্যতা সায়নী। আমার দিকে চেয়ে কথা বলো?

সায়নীর মেজাজ এবার তুঙ্গে। সির সির করে মাথায় রাগ চড়ে উঠলো। চোখ দুটি বড়ো বড়ো করে ফোঁস ফোঁস করতে লাগলো। মুহুর্তের মধ্যে ডান হাতের তর্জনী টিচারের মুখের সামনে এনে চড়কির মতো ঘুরাতে লাগলো। চোখ দুটি তর্জনীর এপাশ ওপাশ ঘুরতে লাগলো।

টিচার হতবম্ব খেয়ে গেলেন। ভয় পেয়ে গেলেন। বড়োলোকের মেয়ে, বড়লোকী হাবভাব। কখন কি করতে কি হয়ে যায় সে ভেবে এ যে বাড়ীতে গেলেন শিক্ষকটি আর কখনো সায়নীকে পড়াতে আসে নি। এক সময় ফোনে সায়নীর বাবাকে জানিয়ে দিয়েছিলেন আর আসবেন না বলে।

সবাই সায়নীকে ছেড়ে চলে যায়। কেউ ওকে ভালবাসে না। ভালোবাসাহীন ওর জীবন খুব একাকীত্বের।

 

চলবে---)



Read full book here: Click here to download the PDF file