সায়নীর স্বপ্ন-পর্ব ১


Author: ড. পল্টু দত্ত

পর্ব ১

Summary:

সায়নী খুব একা।

কেউ ওকে কখনো ভালেবাসে না। ঠিকমতো কথাও বলে না। একমাত্র দাদী ছাড়া কেউ কখনো ওকে বুকে টেনে নেয় নি। আদর করে খাইয়ে দেয়নি। ঘুম পাড়ানিয়ার গান শুনিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেয় নি। কেউ তেমন করে ওকে নিয়ে ভাবে না কখনো। মাঝে মাঝে সায়নীর মনে হয় ও যদি না জন্মাতো তা হলে হয়তো সবাই খুশীই হতো।

 

ছোট কাল থেকেই নিজের ভাবনায় সাঁতার কেটেছে, নিজের মতো করে পুতুলের সাথে খেলেছে। আকাশের দিকে এক মনে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে তাঁকিয়ে থেকেছে। পাখিদের কিচির মিচির আওয়াজ আর পাশের গলি দিয়ে যাওয়া সাইকেল-রিক্সার টুংটাং শব্দে বিভোর হয়েছে।

 

তবে বেশীর ভাগ সময়ই সায়নী কাটায় পোকামাকড়ের সাথে। ছোট ছোট পোকামাকর দেখলেই ও আনন্দে লাফিয়ে উঠে। পা ছড়িয়ে মাটিতে বসে পড়ে। বড়ো বড়ো চোখ তুলে পোকামাকড়ের হাঁটা চলা গভীর মনোযোগের সাথে দেখে। কখনো হাত দিয়ে ধরে। এই ক্ষুদ্র প্রানিদের সাথেই যেন তার বন্ধুত্ব। গভীর ভালোবাসা। ওদের কোন মান-আভিমান নেই। কারো সাথে রাগ করে না। খুব নিরীহ প্রানী এরা।

 

সায়নী পিঁপড়া, লেডিবাগ, মৌমাছি, বিটল, লাঠি পোকা, ফায়ারফ্লাইস এবং প্রজাপতির অদ্ভুত আচরণগুলি খুব সূক্ষ্মভাবে লক্ষ্য করে। ওদেরকে নিয়েই ওর অবসর সময় কাটে। তবে পিঁপড়ে আর ফায়ারফ্লাইস সায়নীর খুব পছন্দ। ফায়ারফ্লাইসের ঝলকানি আলো ওর খুব প্রিয়। ওর কাছে সবচেয়ে পরিশ্রমী ছোট প্রানী হলো পিঁপড়ে। ছোট হলেও মানুষের মতো অলস নয়। কখনো ঘুমিয়ে সময় নষ্ট করে না।

তবে সায়নী বুঝতে পারে কোন কোন পিঁপড়ে বেশ অলস। এরা নিজের ভারটাও সহ্য করতে নারাজ। এ সব অলস পিঁপড়ারা একসাথে দলা বেঁধে ঘোট পাকিয়ে থাকে। এরা সায়নীর দুচোখের বিষ।

 

ছোট কাল থেকেই সায়নীর পছন্দ আরেকটি অদ্ভুত ক্রিয়েচার। যার নাম টিকটিকি। ইংরেজীতে যার নাম লিজার্ড।

টিকটিকির সবচেয়ে আকর্ষণীয় বৈশিষ্ট্যগুলির মধ্যে একটি হল এদেরকে দেখতে কুমীরের মতো মনে হলেও কুমিরের সাথে এদের কোন সম্পর্ক নেই। দেয়াল যতোই মসৃন হোক না কেন টিকটিকিরা তর তর করে দেয়াল বেয়ে চলাচল করতে পারে।  সায়নী টিকটিকি নিয়ে বেশ কয়েকটি ডকুমেন্টারি দেখেছে। ইউটিউবে। বাংলাদেশে এক প্রজাতীর টিকটিকি আছে `উরুক্কু` নামের। এক গাছ থেকে অন্য গাছে লাফিয়ে বেড়ায় উরুক্কুড়া। গিরগিটির মতো গায়ের রং বদলায় পরিবেশের সাথে।

 

শিশুকাল থেকেই সায়নী টিকটকির এই রং বদলানোর যাদুগরীতে অবাক হতো। রং বদলানোর রহস্য অন্বেষনে গভীর ভাবে টিকটিকিকে মনযোগের সাথে পর্যবেক্ষন করতো।  টিকটিকিরাও যেন সায়নীকে পছন্দ করতো। ওকে দেখলেই মায়াবী চোখে টিকটিকিরা ওর দিকে থাকতো। স্থির হয়ে বসে থাকতো। নড়াচড়া করতো না।

 

একদিন এক ছোট্ট টিকটিকিকে জানালার পাশ থেকে হাত দিয়ে তুলে এনে নিজের পড়ার টেবিলে এসে বসে। টিকটিকিটি বেশ নীরব ও লাজুক প্রকৃতির। বেশ চুপ করে ওর হাতের মুঠির মধ্যে লুকিয়ে আছে। চোখ দুইটি জ্বল জ্বল করছিলো। এমন সময় সায়নীর মা এসে রুমে ঢুকলো। সায়নীর বয়স তখন আট। গভীর মনোযোগ দিয়ে সায়নীকে কিছু দেখছে দেখে জিজ্ঞেস করলো-

-সায়নী, কি করছো? হাতে এইটা কী?

সায়নী হঠাৎ করে মাকে দেখে ভয় পেয়ে যায়। হাতের মুঠিটি নিজের অজান্তেই খুলে যায়। সাথে সাথে টিকটিকিটি লাফিয়ে মায়ের বুকের মধ্যে শাড়ীতে গিয়ে পড়ে। মা এটি দেখে ভয়ে লাফিয়ে উঠে। জোড়ে `ও মাগো` বলে চীৎকার করে উঠে। মুর্ছা যায় মুহুর্তের মধ্যে। চীৎকার শুনে বাসার সবাই দৌড়ে আসে।

তার পর আর কি? এক ঝাট চলে সায়নীর উপর। পাশ থেকে দাদীমা এসে সায়নীকে বুকে জড়িয়ে নেয়।

-একটু চুপ করো তোমরা। এতো একটা টিকটিকি। এতো লংকাকান্ড বাঁধাচ্ছো কেন। ওকে এতো বকছো কেন? -দাদীমা বেশ রাগের স্বরেই শাষিয়ে দিলেন।

 

সায়নীর প্রতি সবাই একটু বিরক্ত। ওর স্বভাবের বৈচিত্রতার কারনে।

কোথাও বেড়াতে গেলে সংগে করে নিয়ে যাওয়াটাও খুব লজ্জ্বার ব্যাপার হয়ে দাড়িয়েছে সবার জন্য। কাউকে দেখলেই একের পর এক প্রশ্ন ছুড়ে মারবে। অবান্তর সব প্রশ্ন। ছোট হলেও বেশ বড়োদের মতোই হাবভাব। কয়দিন আগেই সায়নীর বাবার এক বন্ধু, তার স্ত্রী আর তাদের এক ছেলে সায়নীর বয়সীই হবে এসেছিলো সায়নীদের বাসায়। কি কান্ডটাই সেদিন করেছিলো সায়নী। বাবার বন্ধু না হয়ে অন্য কেউ হলে হয়তো তুলকালাম কান্ড ঘটে যেতো সেদিন।

 

ঘরে ঢুকেই সোফায় এসে বসেছে। এমন সময় সায়নী এসে উপস্থিত।

-হ্যালো সায়নী। কেমন আছো তুমি-বাবার বন্ধু আসাদ আংকেল সায়নীকে জিজ্ঞেস করে।

-আমি ভালো আংকেল। তুমি কেমন আছো?

-খুব ভালো? তোমার পড়াশুনা কেমন চলছে?

-ভালো। তুমি স্কুলে যাওনা আংকেল-হঠাৎ সায়নী জিজ্ঞেস করে। পাশে সায়নীর বাবা আর আংকেলের ছেলে তপুও বসা ছিলো। আসাদ আংকেল ওর কথায় হেসে উঠলো। তপুও হাসলো।

-না না। আমি স্কুলে যাই না। আমিতো অনেক বড়ো। তোমার বাবা কি এখন স্কুলে যায়। স্কুল তো তোমাদের জন্য।

-তবে তোমরা কোথায় যাও?

-আমরা কাজ করতে যাই

-কি কাজ করতে যাও?

এবার আসাদ আংকেল একটু অবাক হয়। এমনতো কখনো দেখেনি? তবুও উত্তর দিলো

-তোমার বাবার মতো আমাদেরও ব্যাবসা আছে। সেখানে যেতে হয়

-কিসের ব্যাবসা?

-চাউলের ব্যাবসা, লোহার ব্যাবসা আরো অনেক কিছু

-কেন ব্যাবসা করো?

-ব্যাবসা না করলে খাবো কি? টাকা পাবো কোথায়?-এবার যেন একটু বিরক্ত হলেন আংকেল আসাদ। বাবাও ধমক দিয়ে উঠলেন।

-সায়নী যাওতো এখান থেকে এখন। বিরক্ত করো না। -যাও, তপুকে নিয়ে যাও সাথে। এক সাথে গল্প করো।

 

সায়নী আর কথা বাড়ায়নি। তপুকে সংগে নিয়ে চলে আসে। সোজা ছাদে চলে আসে। ঐখানেই দুজনে অনেকক্ষন কাটায়। ছাদে একটা বল নিয়ে তপু নিজমনে খেলছিলো। এমন সময় সায়নী একটি টিকটিকি ধরে এনে তপুর বুক পকেটে ঢুকিয়ে দেয়। তপু ভয়ে চীৎকার করে উঠে। কোন রকমে পকেট থেকে টিকটিকিটি ছুড়ে ফেলে দিয়ে সায়নীকে একটা জোড়ে ধাক্কা মেরে কাঁদতে কাঁদতে নীচে চলে আসে।

ছেলের অবস্থা দেখে আসাদ আংকেল ও আন্টি বেশ ক্ষেপে যায়। তপু তখনো ভয়ে কাঁপছিলো। জ্বল জ্বল রাগমাখা চোখে সায়নীর দিকে তাকাচ্ছিলো।

আর না বসেই হর হর করে বাসা থেকে বেড়িয়ে পড়ে আংকেল -আন্টি।

সেদিন সায়নীকে বাবা-মা দুজনেই বেশ বকেছিলো। চুলের মুঠি ধরে দুই গালে বেশ কয়েক ঘা মেরেছিলো সায়নীর মা। আর বকতে লাগলো-অসভ্য মেয়ে কোথাকার…

আঙ্গুলের দাগ লেগে সায়নীর গাল দুটি ফুলেছিলো বেশ কয়েক দিন। সেদিন সায়নীর দাদীমাও বাঁচাতে পারেনি। তারপর থেকে আসাদ আংকেল এই বাসায় আর কখনো আসেন নি।

 

এক একা সময় কাটে সায়নীর। দাদীমা ছাড়া যেন কেউ তার আপন নয়। পুরাতন ঢাকার এই ঘিঞ্জি এলাকাটিতে ছোট কাল থেকে বড়ো হয়েছে।

 

আরমানিটোলা স্কুলের মেইন গেইটের পাশ দিয়ে চলে যাওয়া রাস্তাটির শেষ অংশে যেখান শরৎ চন্দ্র চক্রবর্তী রোড ঠিক তার থেকে রাস্তা ধরে কিছুদূর হেঁটে গেলেই হাতের ডান দিকে রাস্তা ঘেঁসা চারতলা একটি বাড়ী নজরে পরবে। এলাকাটি বেশ পুরনো হলেও বাড়ীটি বেশ নতুন এবং আধুনিক নির্মান শৈলী দৃশ্যতঃ। এই রকম সুন্দর সান বাঁধানো বাড়ী অত্র এলাকায় আর একটি নাই। বাড়ীর নীচ তলায় গেইটের পাশেই সায়নীদের বেশ বড়ো তিনটি গাড়ী রাখার ব্যাবস্থা আছে। তিনটি গাড়ীই ওদের। একটি সারাক্ষন সায়নীর জন্য।

 

এই এস সি সি রোডের এক পাশে মাহুতটুলী আর অন্যপাশে কসাইটুলী।

এই এলাকাটি বেশ ঘিঞ্জি। রাস্তায় হাঁটতে গেলে সবসময় নাক চেপে হাঁটতে হয়। ম্যানহোল থেকে ভেসে আসা পচা ডিমের গন্ধে গা কিল বিল করে উঠে। তবে এই অঞ্চলের মানুষদের এইটা এখন অভ্যাসে পরিনত হয়ে গেছে। নাক চেপে না ধরলেও তেমন কোন ক্ষতি হয় না। ধুলো, বালি, ময়লা-আবর্জনা, গন্ধ-দুর্গন্ধের সাথেই যেন ওদের বসবাস।

 

তবে সায়নী খুব অসুবিধা হয়। তার গন্ধের প্রতি অতিসংবেদনশীলতা সাধারনের চেয়ে একটু বেশী। তাই পথ চলতে গিয়ে হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরে। যদিও বেশীরভাগ সময়ই নিজেদের গাড়ীতেই চলাফেরা করে। তবে কখনো সখনো হাঁটতে হলে ভীষন অসুবিধা হয়।

 

এই সুন্দর বাড়ীটির দুই আর তিন তলায় বাস করে সায়নীরা।

এই সুন্দর কিশোরীর বয়স এখন বারো। ক্লাশ সিক্সে পড়ে নতুন ঢাকার এক অভিজাত স্কুলে।  পুরো বাড়ীটিই সায়নীদের। সংসারে বাবা-মা, দাদী, ও একটি ফুট ফুটে ছোট ভাই। তিন তলায় সায়নী আর দাদামী থাকে। দুতলায় বাবা-মা আর কয়েকটি গেষ্ট রুম। বাবা-মায়ের পাশের রুমটিতে থাকে ছোট ভাই তমাল। অন্যান্য তলার রুমগুলি দখল করে আছে ভাড়াটিয়ারা।

 

সায়নী খুব শান্ত স্বভাবের, চুপ-চাপ, ধীর-স্থির। গায়ের রংটা বেশ ফর্সা। মুখটা খুব মায়া মাখানো। হাসলে মুখ থেকে ঠোঁট বেয়ে যেন মুক্তো ঝরে। গাল দুটি ডেবে যায়। গাল টোশ পরে। চোখ দুটিতে সকালের বাতাসে পাপরি ঝরার উৎচ্ছ্লতা। খুব লক্ষী-সামন্ত মেয়ে। একবার দেখলেই ভালো লাগে।

 

কিন্তু বাড়ীর কেউ সায়নীকে ভালোবাসে না। মা সব সময় সায়নীকে বড়ো বড়ো চোখে দেখে। ধমক দেয় এবং কোন কিছু জিজ্ঞেস করলেই বিরক্ত হয়, শাষানী দেয়। মনোযোগ দিয়ে ওর কথা শুনার যেন কোন সময় নেই। সারাক্ষন আট বছরের ছোট ভাইকে নিয়েই ব্যাস্ত।

দাদীমা বলতো সায়নীর মা নাকি খুব আধুনিক। স্বাস্থ্য সচেতন। তবে খুব পাঁজী। স্বাস্থ্য ভেঙ্গে যাবে বলে সায়নীকে নাকি বুকের দুধ খেতে দিতো না। গাল শক্ত করে ধরে জোড় করে চামচ দিয়ে গুলানো ডানো দুধ মুখে ঢুকিয়ে দিতো। আর সায়নীও না খাওয়ার জন্য হাত পা ছুটা-ছুটি করতো।

সায়নীর মা সপিং করতে খুব পছন্দ করে। সময় পেলেই অভিজাত সপিং মলে চলে যায়। ব্যাগ ভর্তি নানা প্রসাধনী সামগ্রী বিদেশী ব্র্যান্ডের কাপড়-চোপর কিনে আনে। মা নিজের কাজে সারাক্ষন মেতে থাকে। তাই সায়নী মায়ের কোলে শুয়ে কোন পড়ন্ত বিকেলে ময়ের মুখ থেকে কোন রাজকুমারের গল্প শোনার ভাগ্য হয়নি।

 

বাবার সাথেতো প্রায় সময়ই দেখা হয় না। খুব সকালেই বেড়িয়ে যান। আর অনেক রাতে আসে। কখনো সখনো যদি ভাগ্যক্রেমে দেখা হয়ে যায় তখন সায়নীর অনবরত প্রশ্নে বিরক্ত হয়ে রাগ করেন।

তখন সায়নী মন খারাপ করে। আর মন খারাপ করলেই হাতের তর্জনী চড়কীর মতো মুখের সামনে এনে ঘুরাতে থাকে। বাবা আরো রেগে যায়। জোড়ে ধমক দেয়। ঠিক তখন দাদীমা এসে সায়নীকে বুকে চেপে ধরে গালে মুখে চুমু দেয়। এতে সায়নীর রাগ কমে।

 

যেদিন থেকে বাসার সবাই জানতে পারলো সায়নী অটিজমে ভুগছে সেদিন থেকে সবাই সায়নীকে একটু আলদাভাবে দেখতে শুরু করে। তখনও ছোট ভাইটির জন্ম হয়নি। বছর খানেকের মধ্যেই ছোট ভাইটি সংসারে এলো। সাথে সাথে বদলাতে থাকে সব।

 

যদিও ডাক্তার স্পষ্ট করে বুঝিয়ে দিয়েছিলো যে-

-আপনারা এখন থেকে সায়নীর সাথে সহানুভূতি ও ধৈর্য্যের সাথে কথা বলবেন। ওর সব সময়ের চাহিদা ও পছন্দ সম্পর্কে জানার চেষ্টা করবেন। কখনো রাগ করে কথ বলা চলবেনা ইত্যাদি আরো কতো কি।

 

কিন্তু কেউ আর ডাক্তারের কথা মনে রাখলেন না। সবই মানা হলো তবে ছোট ভাইয়ের বেলায়। পরিবারের সবাই ছোট ভাইটিকে বেশ ভালোবাসে। সায়নীও ভলোবাসে। শুধু সায়নীকে কেউ ভলোবাসে না।

 

বাসায় যেন সায়নী একা। স্কুলেও একা। আত্মীয় স্বজনদের কাছেও একা। ইংরেজী মিডিয়ামে পড়ে বলে কেউ ওর সাথে কথা বলতে আসতো না।  সব সময় নিজের মধ্যেই কুন্ডুলী পাঁকিয়ে থাকে।

 

স্কুলে সায়নীকে কেউ পছন্দ করে না। কেউ ঠিকমতো ওর সাথে কথাও বলে না। তার সহপাঠীদের থেকে সে একটু ভিন্ন। সায়নী বিশ্বটাকে একটু অন্যভাবে দেখে। কারন সায়নী অন্যদের চাইতে একটু ভিন্ন। সব দিকেই। স্কুলে সবসময়ই সায়নী একা। ক্লাশ চলাকালীন সময়েও সহপাঠিরা ওর পাশে বসবেনা। খেলার সময় কেউ ওকে হাত বাড়িয়ে খেলতে ডাকবে না। সবাই ওকে এড়িয়ে চলতে চায়। কেউ ওকে বোঝার চেষ্টা করে না। কেউ জানতেও চায় না সায়নীর সমস্যর কথা।

 

আসলে সায়নী এক অটিস্টিক কিশোরী।

 

বয়েস যখন তিন তখন থেকেই পরিবারের সবাই সায়নীর এই সমস্যার ব্যাপারটা জানতে পারে।

একদিন সায়নীর দাদী সায়নীর সাথে খেলছিলো। আদর করে ওর গালে মুখে নাক দিয়ে ঘষা-ঘষি করছিলো। হঠাৎ করেই সায়নী জোড়ে কান্না-কাটি এবং চীৎকার শুরু করে। মাথাটাকে এপাশে-ওপাশে দোলাতে থাকে।

এই দেখে দাদী ভয় পেয়ে যায়। ডাকতে থাকে

-সায়নী, সায়নী। দাদী ভাই আমার। এই রকম করে না। কি হয়েছে তোমার?

দাদী সায়নীকে শান্ত করার আপ্রান চেষ্টা করে যাচ্ছে। কিন্তু কিছুই হচ্ছেনা। বরং সায়নীর উত্তেজনার মাত্রাটা যেন আরো বেড়ে যায়। এবার সায়নী ডান হাতের তর্জনী ঘুরাতে শুরু করলো। চোখ দুটি অনবরত এদিক ওদিক ঘুরাচ্ছে। হাত-পা গুলি জোড়ে জোড়ে নাড়াচ্ছে।

সায়নীর চীৎকার চেচামেচি শুনে সায়নীর মা রান্না ঘর থেকে দৌড়ে আসেন। দেরী না করেই পারিবারীক ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায়।

সেখানেই সব কিছু পরীক্ষা নিরিক্ষা করে ডাক্তার সায়নীর অটিজমের কথা জানালেন। সায়নীর বাবাও ফোনটা পেয়ে মিটফোর্ডের অফিস থেকে তাড়াতাড়ি চলে আসেন।

 

সায়নী নিজের মধ্যেই সব সময় ডুবে থাকতে পছন্দ করে। তার সহপাঠীরা, তাকে বুঝতে অক্ষম। তাই স্কুলে সহপাঠীদের সাথে সায়নীর একটা অনাকাঙিত দূরত্ব সৃষ্টি হয়।

 

এই নিয়ে সায়নী খুব মন খারাপ করতো।

সবসময় ভাবতো একটি সুন্দর স্কুলের কথা। যেখানে সায়নী সহপাঠীদের সাথে এক সাথে খেলে বেড়াবে, হৈ চৈ করবে এবং সবাই বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিবে। সব শিক্ষকরা হবে বাবা-মায়ের মতো। ভূল হলে ধমক দিবে না। আদর করে কাছে টানবে। ওর কথাগুলো শোনার জন্য মনোযোগ দিবে।

 

তার স্বপ্ন ছিল সহজ কিন্তু গভীর - তার সহপাঠীদের ভালোবাসা পাবার, তাদের জগতের সাথে মিশে যাওয়ার। কিন্তু তার স্বপ্নের কথা কেউই জানে না। আর কেউ জানতেও চায় না।

 

 

ঘরের বাইরে সায়নীর জীবন খুব একাকীত্বের।

 

কোলাহলপূর্ণ পুরাতন ঢাকার এই এলাকার দুঃসহ ঘিঞ্জি পরিবেশের নগর জীবনের কোলাহল সবকিছুকেই যেন ঘিরে রেখেছিল। কিশোরী সায়নীর প্রতিদিনের জীবন যেন ঘড়ির কাঁটার মতো কোথাও আটকে আছে। চলার কোন ব্যাঞ্জনা নেই। না আছে কোন চাঞ্চল্যতা।

 

অথচ তার দ্বীপ্তময় হাসির বিচ্ছুরন গভীর অন্ধকারাচ্ছন্ন দিনগুলিকেও আলোকিত করতে পারে।  তার চোখের তারার জ্বলজ্বলে লুকিয়ে থাকে ভালোলাগা-ভালোবাসার গভীরতা। এ সবই  তার একান্তই আপন ও নিজস্ব।

 

সায়নী তার ক্লাসের অন্য সহপাঠীদের মতো ছিল না।

তার মন ছিল রঙ, আবেগ এবং ধারণার এক অনবদ্য সিম্ফনি। যার ছিলো নিজস্ব একটি সুর।  একটি সুরেই বাজত অবিরত যা কেবল ছোট্ট কিশোরী সায়নীই শুনতে পেত। সায়নী দৃষ্টিভঙ্গি একটি বৈচিত্রময় যাদুর বক্সের মাধ্যমে বিশ্বকে দেখতে পেত। যারা কখনো তার প্রাণবন্ত ভাষা বুঝতে পারেনি তাদের কাছে সায়নী এক অদ্ভুত ধরনের মেয়ে। হাবা-গোবা, বোকা-সোকা কিংবা অসুস্থ স্বভাবের ভয়ানক বিরক্তিকর একজন কিশোরী।

 

তার সহপাঠীরা কৌতূহলী ছিলো বটে কিন্তু অনিশ্চিয়তার ছোঁয়ায় জড়িয়ে থাকতো সবসময়। প্রায়ই তাকে দূর থেকে পর্যবেক্ষণ করত তির্যক দৃষ্টিতে। তারা বুঝতে পারেনি কেন সায়নী কখনো কখনো রাগে উত্তেজিত হয়ে তার আঙ্গুল ঘুরিয়ে দেয়। অথবা কখনো কখনো কিছু কিছু শব্দ তাকে বিরক্ত করে বলে মনে হয়। মাঝে মধ্যে অনেক মানুষের সোরগোলে ওর চোখ দুটি ছানাবড়া হয়ে যায়। ক্রমাগত মাথা নাড়াতে থাকে এপাশ ওপাশ।

এই সব দেখে অনেক সহপাঠিরা ভয়ে দৌড়িয়ে পালাতো। কেউবা শিক্ষকের রুমে গিয়ে ক্লাশ মেডামের কাছে সায়নীর এ সব কর্মকান্ডের জন্য নালিশ করতো।

 

একারনে সায়নী খুব কষ্ট পেতো। কতোদিন একা একা সবার অজান্তে টয়লেটে গিয়ে আয়নার সামনে গিয়ে কেঁদেছে। মাঝে মধ্যে মনে হতো স্কুলে আর কখনো না আসে। শুধু সহপাঠীরাই নয়। স্কুলের শিক্ষকরাও তাকে সহ্য করতে পারে না। আদর করাতো দুর ছাই! এমনকি কিছু কিছু শিক্ষক ওকে কটাক্ষ করে খারাপ খারাপ কথা বলতো। একবার এক শিক্ষক পড়া রেডী করেনি বলে ওকে সবাইর সামনে দাঁড়াতে বলে। তারপর বেশ তীর্যকের সুরে বলে উঠে-

-তুকে দিয়ে কিচ্ছু হবে না। তুই যে একটা বুদ্ধির ঢেকি। মাথায় গোবড় ছাড়া আর কিচ্ছু নেই। অপদার্থ মেয়ে কোথাকার

এই কথায় সবাই যেন মজা পেয়েছিলো। হা হা করে হেঁসে উঠেছিলো সহপাঠিরা

 

রাগে ক্ষোভে লজ্জায় মুখটা লাল হয়ে উঠেছিলো। নাকের উপরের পাতলা চামড়া তর তরকরে কাঁপছিলো। হঠাৎ ওর ডান হাতের তর্জনী মুখের উপর নিয়ে অনবরত ঘুরাতে শুরু করলো। বড়ো বড়ো চোখ দুটি তর্জনী বরাবর এপাশ ওপাশ করতে লাগলো। ওর এই ভয়ানক অবস্থা দেখে সহপাঠীরা যেন আরো মজা পেয়ে গেলো। অপেক্ষায় আছে শিক্ষকের তাৎক্ষনিক প্রতিক্রিয়া দেখার জন্য।

 

অগ্নিমূর্তি হয়ে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালেন ইতিহাসের শিক্ষক মোমতাজ হোসেন। কর্কস স্বরে শাষিয়ে উঠলেন-

-সায়নী, একি অসভ্যতা? বন্ধ করো বলছি।

 

স্কুলের কেউ বুঝতে পারেনি যে সায়নীর অদ্ভুততার পিছনে একটি অন্য রকম পৃথিবী আছে, একটি স্বপ্ন এবং আকাঙ্ক্ষায় ভরা একটি পৃথিবী।

 

সায়নীর স্বপ্ন ছিল সহজ কিন্তু গভীর - তার সহপাঠীদের কাছে প্রিয় ও গ্রহণযোগ্যতা পাওয়া।

তাই সে সবসময় সেই দিনের জন্য অপেক্ষায় ছিল যখন সে সবার একজন হবে। ওর সহপাঠীরা ওকে বুঝতে পারবে, চিনতে পারবে, ভালোভাবে জানতে পারবে এবং,  তার মধ্যে অনুরণিত সুন্দর সুরকে চিনতে পারবে। প্রতি রাতে, যখন সে বিছানায় শোতে যায় সায়নী স্বপ্নের রাজ্যে পালিয়ে যেতো যেখানে তার সহপাঠীরা তাকে আলিঙ্গন করছে, আদর করছে, কথা বলছে, এক সাথে  টিফিন বক্সের খাবার ভাগ করে খাচ্ছে।

দিন বদলায়। সময়ের বুকে হামাগুড়ি দিয়ে মানুষ এগিয়ে চলে এই শহরে। একদিন সায়নীর মনের আকাশেও জেগে উঠবে সোনালী সূর্য। নরম রোদের সোনালী আলোয় উৎপল হবে সায়নীর জীবন। এইটাই সায়নীর স্বপ্ন।

চলবে---)



Read full book here: Click here to download the PDF file