Summary:
বেশ ফুর ফুরে চমৎকার পরিবেশ।
লেখার জন্য উপযুক্ত সময় বটে! উপযুক্ত পরিবেশ ছাড়া অপূর্বর যেন কিছুই হয় না। কিন্তু অপূর্ব আজ কিছুতেই কিছু লিখতে পারলো না। মাথায় কিছু আসছে না। সব ভাবনারা এক জায়গায় এসে জড়ো হয়েছে। সুতপাই এখন অপূর্বর ভাবনায় বেশ জাঁকিয়ে বসেছে। চলছে খুনসুটি। এই মুহুর্তে অন্য কিছু নিয়ে ভাবা যায় না, ভাবলেও যেন কোন লাভ নেই। ভাবনার আকাশে এখন অন্যমেঘের আনাগোনা। এমন এক গুমোট পরিবেশের জন্য আজ তিনদিন যাবৎ কিছুই লেখা হয়নি অপূর্বর। কিছুটা অলসতা, কিছুটা সময়ের স্বল্পতা এবং অবশ্যই কিছুটা নীরব পরিবেশের অভাব। এই যে, এই মুহুর্তে রুমে কেউ নেই। রেকর্ড প্লেয়ারে বাজছে চিত্রা সিংয়ের গান। টেবিল ঘড়িটা টিক টিক টক টক আওয়াজ করে তার ব্যস্ততার জানান দিচ্ছে। মাথার উপরের লাইটটা অফ করে দিয়ে টেবিল ল্যাম্পটা অন করে রেখেছে অপূর্ব। শান্ত ছিম ছাম লাগছে চারিদিক। জানালার পাশের রাস্তা থেকে দু’একটি মানুষের আনাগোনার শব্দ শোনা যাচ্ছে। শীতের প্রকোপ কিছুটা ভাটার দিকে। রাস্তায় হাঁটতে গেলেই প্যাক প্যাক আওয়াজ হয়। এই সময় থেকেই বরফগুলো গলতে থাকে। বরফ কাদা জলে রাস্তাগুলো থক থক করে। তাই সাবধানে পা ফেলতে হয়।
সুতপা এসেছে আজ চারদিন।
আজ সন্ধ্যায় ওর ইয়ারমেট হাবিব এসে ৬নম্বর ব্লকে ওকে নিয়ে যাওয়ার কথা।
ওরা একই বছর বাংলাদেশ থেকে সোভিয়েত ইউনিয়নে এসেছে। হাবিব মস্কোতে থাকে। পেট্রিস লুমুম্বায় মেডিসিনে পড়ছে। আর সুতপা চলে যায় রুস্তভে। বন্ধুত্বের ভাবটা ওদের মধ্যে খুব প্রবল, নির্মল ও অমলিন। একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও আত্মীকতার বন্ধন যে এতোটুকু বড় মাপের হতে পারে সোভিয়েত ইউনিয়নে না গেলে হয়তো অপূর্ব বুঝতেও পারতো না। সমাজতন্ত্রে সকলেই মানবিক, অল্পতে সবাই খুশী। সবাই সবাইকে ভালোবাসে, শ্রদ্ধা করে,স্নেহ করে। বন্ধুত্বপূর্ন ভাব। সবাই যেন একই সমতলে। সমাজের এই নিয়মটাই অপুর্বকে মুগ্ধ করে।
সুতপা মস্কোতে-এই খবরটা যেন খুব দ্রত ছড়িয়ে পড়েছিলো পেট্রিস লুমুম্বার বাংলাদেশী ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে।
তখন এক শহর থেকে অন্য শহরে কোন বাংলাদেশী ভাই-বোনেরা কোন কারনে গেলেই বেশ হৈ চৈ পড়ে যেত। বিশেষ করে মস্কো থেকে কেউ অন্য কোন শহরে গেলেতো কথাই নেই। আদর-আত্তির ব্যাপারটাই ছিলো একটু অন্যরকম। চমৎকার একটা পরিবেশের মধ্য দিয়ে সবাই বেশ হৈ চৈ করে দিনরাতগুলি কাটিয়ে দিতো। একে অপরের পাশে ছিলো সবসময়। নিঃস্বার্থ ভালোবাসার এই যেন এক ভিন্ন ক্ষেত্র- এ জায়গাকে ভালোবাসার নন্দনকানন বললেও ভুল হবে না। এখানে এলে হোমসিকের ব্যাপারটাই উবে যেতে বাধ্য।
“রাশিয়ার চিঠিতে” রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও সোভিয়েত সমাজব্যবস্থায় মানুষের মধ্যকার সৌহার্দ্যপূর্ন সম্পর্ককে বেশ প্রসংশা করেছেন।
সোভিয়েত ইউনিয়নে লেনিনের নেতৃত্বে অক্টোবর বিপ্লবের পর মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে নতুন সোভিয়েত সরকার তার নাগরিকদের মধ্যে শ্রেণীগত বৈষম্য এবং ধর্মীয় বিভাজন ধ্বংস করে সকল নাগরিকদেরকে একটি অভিন্ন লক্ষ্যে একসঙ্গে কাজ করতে উৎসাহিত করেছিল, তা নিজের চোখে দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন ঠাকুর।
সেটা ১৯৩০ এর কথা। সোভিয়েত বিপ্লবের তের বছর পরেই তিনি সোভিয়েত রাশিয়ায় সফরে যান। কি আমুল পরিবর্তন সোভিয়েত সমাজে। একটি পর্যুদস্ত দেশ কি করে তর তর করে উপরে উঠে গেল, ঐতিহ্যগত সীমানা অতিক্রম করে একটি ঐক্যবদ্ধ জাতিতে রুপান্তরিত হলো। তা দেখে তিনি অবাক হয়েছিলেন। আর মনে মনে ভাবতেন আমাদের ভারত মাতা কেন এখন অব্দি উঠে দাঁড়াতে পারছে না।
সোভিয়েত রাশিয়ায় কতো মতাদর্শের লোকদের বসবাস ছিলো, ছিলো ধর্মীয় গোড়ামী। দরিদ্রতায় একেবারে নরবড়ে সমাজ। অথচ সব বাধা বিপত্তিকে অতিক্রম করে ধর্ম-বর্ন-পেশা নির্বিশেষে সব লোকদের মধ্যে কি বন্ধুত্বময় আত্মীয়তার সম্পর্ক তৈরী করতে সক্ষম হয়েছে সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যাবস্থা। সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে চলছে সমাজের সব কিছু।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রাশিয়া সফরের সময় যা দেখেছিলেন তাতে তিনি অত্যন্ত মুগ্ধ হয়েছিলেন এবং আশা করেছিলেন যে অন্যান্য দেশগুলিও সোভিয়েত সমাজ ব্যাবস্থা থেকে শিখতে পারবে। ভালো করে বুঝতে পারবে কিভাবে তারা সমগ্র বিশ্বে বৃহত্তর শান্তি ও সমৃদ্ধি অর্জনের জন্য একত্রে কাজ করার সঙ্গে সঙ্গে তাদের নিজের জাতির মধ্যে ঐক্য তৈরি করছে। সুশীল বন্ধুত্বপূর্ন সম্পর্ক ও জাতিগত ঐক্যই সমৃদ্ধির হাতিয়ার। এখানেই সকলেই যেন খুব সুখী, সহজ এবং সরল। অপূর্বও সোভিয়েত সমাজ ব্যবস্থায় খুব মুগ্ধ ছিলো। এখনো সেই সময়গুলো নিয়ে ভাবনায় বুঁদ হয়ে থাকে। কি ছিল আর কি হলো।
সুতপার সাথে এ কয়দিন দেখা না হলেও ওর খোঁজ খবর নিয়েছে রীতিমতো।
হাবিবদের ব্লকেই আজ ওর বন্ধুরা জড়ো হয়েছে। ওখানেই খাওয়া-দাওয়া হবে। এ কয়দিন ও একটু অসুস্থ ছিলো। তবে তেমন চিন্তার কিছু না। তাপমাত্রা একটু বেড়ে গিয়েছিল, সঙ্গে এলার্জি। মস্কোতে আসার দুদিন পর থেকেই অর্থাৎ ২৫শে মার্চ ও একটু অসুস্থবোধ করছিলো। তৃতীয় দিনে সেটা বেড়ে একেবারে শয্যাগত। পুরো দিন দুয়েক বিছানাতেই ছিলো।
সেদিন অর্থাৎ ২৫ তারিখ অপুর্ব সাড়াটা দিন তার রুমেই ছিল। ওর জন্য অপেক্ষা করছিলো। এর আগের দিন রাতে নাসরিনের সাথে ১১ নম্বর ব্লকে গিয়েছিলো। ঐ ব্লকেই নাসরিন থাকে। যাওয়ার সময় নাসরিন অপুর্বকে বলে গিয়েছিল সকালে সুতপাকে অপুর্বর ব্লকে নিয়ে আসবে। কিন্তু সাড়াটা দিন কেউ এলো না। কেমন ছটফট করছিলো অপুর্ব। ভালো লাগছিলো না। দিন গিয়ে সন্ধ্যা হলো, বাড়তে থাকলো রাতের গভীরতা। বুঝতে পারলো আজ আর কেউ আসবে না। তাই পরদিন সকালে অপুর্ব যাওয়ার আবশ্যকতা বোধ করলো। এর মধ্যে অপুর্বর বন্ধু মাসুদ এসেছে ক্রাসনাদার থেকে। পরদিন সকালে মাসুদকে নিয়ে এক সিনিয়র দাদার বাসায় যেতে হলো মাসুদের পীড়াপীড়িতে।
ব্লক থেকে বেড়িয়েই একটা ট্যাক্সি নিলো।
যেহেতু সুতপাকে দেখতে আবার যেতে হবে তাই ট্যাক্সিটা আপ-ডাউন ভাড়া করলো।
সোজা চলে গেল সিনিয়র দাদার বাসায়। কাজটা অবশ্য মাসুদের।
তবে এসে দেখে সেই দাদা ঘরে নেই। দাদা আবার বেশ বড়ো ব্যাবসায়ী। সিঙ্গাপুর থেকে কম্পিউটার এনে মস্কোতে বিক্রি করে বেশ পয়সা কামিয়েছেন। তাই হোস্টেলে আর থাকেন না। যদিও ইউনিভার্সিটির দেয়া হোস্টেলের রুমটি এখনো আছে। এই দাদা পড়ছেন কেমিস্ট্রিতে। একই ডিপার্টমেন্টে বলে দুনম্বর ব্লকেই ছিলো তার রুম। অপুর্বর চার তলায় আর তিনি তিন তলায়। এখন তিন রুমের বাসা ভাড়া নিয়েছেন। অর্থনৈতিক উন্নতির সাথে সাথে সামাজিক স্ট্যটাসটা খুব জরুরি।
ইদানিং এ ব্যাপারটা মস্কোতে খুব স্পষ্ট।
সবাই একটু একটু অন্যরকম হয়ে যাচ্ছে। টাকার পিছনে অনেকের ব্যাস্ত সময় কাটাচ্ছে। টুক টাক এটা সেটা করছে। গত দু’এক বছরে অনেক বাঙালি ছাত্রই বেশ টাকার পাহাড় গড়ে তুলেছে। অনেক টাকা। ছাত্র বয়সে এতো টাকা কেউ হয়তো আগে কখনো দেখেনি। আর টাকার সঙ্গে সঙ্গে বদলে যাচ্ছে ওদের অবয়ব। রঙিন দামী সান গ্লাসের ভেতর দিয়ে চক্ষুদয় যা দেখে চারিদিকে সব কিছুই কেমন চকচকে রঙীন মনে হয়। তাই অনেকে দুহাতে খরচ করছে। এতে স্ট্যাটাস হয়ে যায় গুরুত্বপূর্ন।
তবে সেটা বংশানুক্রমিক। সামাজিক বিবর্তনের ধারা। সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ।
অনেক ভারতীয় সামাজিক মর্যাদাকে অর্থনৈতিক স্বাধীনতা অর্জনের উপায় হিসাবে দেখে-অর্থাৎ, তারা বিশ্বাস করে যে যদি তারা শিক্ষা বা অন্যান্য উপায়ে সমাজে তাদের অবস্থান উন্নত করতে পারে, তাহলে তারা আরও অনেক কিছুর অ্যাক্সেস পাবে। এই ধারণাটি সময়ের সাথে সাথে জনপ্রিয় সংস্কৃতিতে পরিনত হয়েছে। সামাজিক স্ট্যাটাস প্রাপ্তি তারই লক্ষন। সামাজিক মর্যাদাকে আমরা অনেকেই বেশি মূল্যদেই। তবে মস্কোর বাঙালী শিক্ষার্থীদের মধ্যে এর প্রভাবটা খুব বেশী লক্ষনীয়।
সারা রাশিয়া জুড়েই এই পরিবর্তনের ফোসকা ছত্রাকের মতো ছড়িয়ে পড়ছে।
১৯৮৯ সাল থেকেই সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে পড়ার আলামত দেখা যাচ্ছে। হঠাৎ করেই সবকিছু কেমন বদলে যেতে থাকে। সব কিছুর দাম বাড়তে থাকে হু হু করে। বেতনের টাকায় চলা মুস্কিল হয়ে পড়ছে অনেকের জন্য। বিদেশী শিক্ষার্থীরা স্টাইপেন্ড পেত। অপুর্ব মাসে পেত ৯০ রুবল। তাতে দিব্যি চলে যেত মাসটা। এমন কি মাস শেষে কিছু টাকা জমাতো। ইদানীং এটা কল্পনাতীত। বরং প্রতি মাসেই ধার-দেনা করতে হয়। পড়াশুনা ছাড়া অন্য কিছু চিন্তা করাও দুরূহ। রাশিয়ার এই পরিবর্তনের সাথে সাথে নানা ধরনের ব্যাবসার সুযোগ আর রঙীন দুনিয়ার হাতছানি আসতে থাকে। কাড়ি কাড়ি টাকা, ভোগ-বিলাসের ইশারা আসতে থাকে। অধিকাংশ মানুষের সম্পত্তি কিছু মানুষের হাতে যাওয়ার সব আয়োজন যেন তৈরী। কাংঙ্খিত সাম্যের সমাজে ক্ষয় যেন তরান্বিত হতে থাকে।
অনেকেই ব্যাবসায় জড়িয়ে পড়ে। ইউনিভার্সিটি কর্তৃপক্ষ সব দেখেও যেন না দেখার ভান করছে। সব জায়গায়ই খুব তাড়াতাড়ি দুর্নীতি ঢুকে গেছে। বিদেশীরা একটু বেশী সুবিধা পাওয়ার জন্য উপরি দেয়ার কৌশল চালু করে। এতে দুপক্ষই যেন খুশী।
রাতারাতি মস্কো হয়ে উঠে ব্যাবসায়ি কার্যকলাপের জন্য একটি হটস্পট। বিদেশী শিক্ষার্থীরা এই সুযোগটা লুফে নেয়। দেশের অর্থনৈতিক সমস্যা উচ্চাকাঙী শিক্ষার্থীদের শিক্ষার বদলে অর্থ উপার্জন এবং ব্যবসা গড়ে তোলার সুযোগ তৈরি করে। তবে এই ব্যাবসায়িক সুযোগের অগ্রভাগে বাংলাদেশী আর ইন্ডিয়ার শিক্ষার্থীরাই ছিলো।
হিরিক পড়ছে সিঙ্গাপুরে গিয়ে কম্পিউার আনার। নিজের জন্য নয়, বিক্রি করার জন্য। সোভিয়েত পরিবর্তনে সুযোগ হয় অনেকের জন্য ছোট বা মাঝারি উদ্যোক্তা হওয়ার। আধুনিক বানিজ্যের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে চাই আধুনিক অফিস টেকনোলজি। চাহিদা বাড়লো হোম ও অফিস কম্পিউটারের। ৪৮৬পি সি তখন সবার মুখে মুখে। সাথে সাথে নানা ধরনের প্রিন্টার এবং ইলেকট্রনিক্স সামগ্রির চাহিদা তুঙ্গে।
তখন বাঙালি ছাত্রদের মধ্যে যাওয়ার হিরিক পড়লো। সিংগাপুরের সিম লিম স্কয়ারে অবস্থিত বিশাল কম্পিউটার আর ইলেকট্রনিক্সের সপিং মল। সেখান থেকে নিয়ে আসতো কম্পিউটার। মস্কোতে তখন কোন ট্যাক্স ছিলো না। বিমানের প্রথম ক্লাশে এরোফ্লতে যাতায়াত। চল্লিশ কেজি আনা যেত সহজেই। তাই সবাই ফার্স্ট ক্লাসেই যেত। মস্কোতে নিয়ে আসলেই বিক্রি। এমন কি অনেকেই আবার এয়ারপোর্ট থেকেই কিনে নিয়ে যেত। একটা কম্পিউটারে লাভ হতো প্রায় কয়েক হাজার ডলার, সব খরচ বাদ দিয়ে। কখনো কখনো ভালো খরিদ্দার পেলে আরো বেশী।
ব্যাবসা যেন জমজমাট।
কেউ দুই তিনটা কম্পিউটার বিক্রি করতে পারলেই ব্যাবসায়ী। অনেক টাকা হাতে এসে যায়। তখন সব খরচ পাতি দিয়ে অন্যদেরকে পাঠাতো। ফার্স্ট ক্লাসে বিমানের টিকেট, ভালো হোটেলে তিন চারদিন থাকার ব্যাবস্থা, হাত খরচের টাকা, খাওয়া-দাওয়ার ব্যাবস্থা তার পরও একদেড় হাজার ডলার দেয়া হতো। তার বিনিময়ে শুধু সিঙ্গাপুর থেকে কম্পিউটারটা নিয়ে আসা। সিঙ্গাপুরের একটা নির্দিষ্ট দোকান থেকে নিয়ে আসতে হবে। আগে থেকেই সব কিছু ঠিক ঠাক করে রাখা হয়। শুধু ক্যাশ টাকা দিয়ে কেনা জিনিসটা গ্রহন করা।
যেহেতু পারসনাল ব্যাবহারের জন্য আনা হতো তাই কোন ট্যাক্স দিতে হতো না। জিরো ট্যাক্স।
শুধু ইউনিভার্সিটি থেকে বিদেশ ভ্রমনের একটা পারমিশন বের করাটা ছাত্রটির দায়িত্ব। নানা কারন দেখিয়ে পারমিশনের ব্যবস্থা করতো।
কেউ কারন দেখাতো বিশেষ প্রয়োজনে যেতে হবে, কারো বা মা-বাবা অসুস্থ, কারো আবার ফ্যামেলিতে কেউ মারা গেছে ইত্যাদি ইত্যাদি বলে ভ্রমনে যাওয়া।
এমনও দেখা গেছে মাস ছয়েকের মধ্যে অনেকে ২/৩ বার বিদেশ ভ্রমনের দরখাস্ত জমা দিতো। একজন তার ঠাকুর দাদা মারা যাওয়ার কথা বলে দুবার ছুটিতে উল্লেখ করেছে। ওকে ডেকে নিয়ে ইউনিভার্সিটির ফরেন অফিস জিজ্ঞেস করে- -
-প্রশলম জয়াব্লেনিয়ে ভী স্কাজালি,স্তো বাসদেদুস্কা উমের, ভী নাপিশালিতোঝে সাময়ই বেতত রাজ, কাকই দেদুস্কা উমের বেতত রাজ? (তুই গত এপ্লিকেশনেও বলেছিলি তোর দাদু মারা গেছে, এবারও তাই লিখেছিস। তোর কোন দাদু এবার মারাগেছে?) -কথাগুলি বলে বিস্ময়ে ওর দিকে তাকিয়েছিলো লুদমিলা ইভানভনা।
এই ভদ্রমহিলাকে এক সময় অনেকেই ভয়পেতো। খুব মনে হতো নীতিবাদী, সৎ এবং আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। সব সময় বেশ স্মার্ট থাকতো। মুখে কখনো হাসি দেখা যেত না। আর কখনো হাসলেও সেটা বেশ নিয়মের মধ্যেই থাকতো।
সেদিন ও ছাত্রটিও সুন্দর একটি জবাব দিয়েছিলো-
-তিপের আতিয়েচ মাইই মাতেরি উমের (এবার আমার মায়ের বাবা মারাগেছে)
এতো বড় অংকের টাকা কামানোর জন্য মুখে মুখে কাউকে মৃত্যুর কোঠরে পাঠিয়ে বা দোষ কী? এতে তো আসলে কেউ মারা যাচ্ছে না?
তবে সময়ের সাথে সাথে সব কিছুই বদলে যায়। লুদমিলাও বদলে গেছে। সে সবই জানে। ছাত্র-ছাত্রীরা ঘন ঘন বিদেশে যায় কেন। সেও বুঝতে পারলো, চারিদিকে এখন পরিবর্তনের বাতাস। এটা আর থামবে না। তাই চোখ বন্ধ রেখে যদি কিছুটা বাড়তি পাওয়া যায় তাতেই মঙ্গল। অনেকের সাথেই তার এখন ভাব । মুখে এখন হাসির মাত্রাটাও, বেড়েছে। তবে সবার বেলায় না। ইদানিং আবার নতুন লাদা গাড়ী কিনেছে। সবদিকেই যেন সমৃদ্ধি উপচে পড়ছে। দেশ গোল্লায় যাক। তাতে কার কি? কথায় বলে-নিজে বাঁচলে বাপের নাম।
ধন্য, ধন্য, গর্ভাচেভ। তুমিই পারবে আমাদের ভাগ্য বদলাতে।
যতো পারো গ্লাসনস্ত আর পেরেস্ত্রইকার দোহাই দিয়ে বকবক করে যাও, বদলে দাও সব কিছু। তছনছ করে দাও সমাজতন্ত্র। অনেক কমরেডও এমনই ভাবতো। রাতারাতি এরা গায়ের রং বদলাতে পারে, নতুন নতুন বুলি আওরাতে পারে। যেন আসল গিরগিটি। গিরগিটিরা তাদের রঙ বদলাতে পারে। তারা কখনো নীল, লাল এবং কমলার মতো রং তৈরি করতে পারে। সোভিয়েত রাশিয়ায় ঠিক এমন একটি পরিস্থিতিই চলছিলো তখন।
সোভিয়েতের অচলাবস্থা অনেকের সচলতা। অনেকের জন্য এ অস্থির অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আসছে নতুন ব্যাবসায়িক সুযোগ। সাথে সাথে দুর্নীতি আর অনৈতিক কার্যকলাপ। অনেক আন্তর্জাতিক ছাত্র-ছাত্রীএই পরিস্থিতিকে কাজে লাগিয়ে আঙ্গুল ফুলে কলা গাছ হয়ে যায়। এরা কম্পিউটার কেনা-বেচা থেকে শুরু করে খুব রাতারাতি ছোট রেঁস্তোরা সহ নানা ধরনের কম্পিউটার ও ইলেকট্রনিক্সের দোকান, সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট ফার্ম খোলা শুরু করে।
অল্প সময়ের মধ্যেই অনেক বাঙালী শিক্ষার্থী মিলিয়ন ডলারের মালিক বনে যায়। নামী দামী ফ্লাট বাড়ী, গাড়ী, আসবাবপত্র দখল করে নেয় সোভিয়েত সমাজের ঐতিহ্যের আদলে গড়া হোস্টেলের আটপৌরে জীবন ধারা। এই সুযোগের সদ্ব্যবহারকারী একজন ছাত্র ছিলেন দিমিত্রি গ্রিশিন। অপুর্বর ক্লাশমেট। প্রিপারেটরীতে থাকার সময় একই রুমে থাকতো। তিনি ইউক্রেন থেকে এসেছিলেন এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙ্গনের সাথে সাথেই "গিটার ক্যাফে" নামে একটি ছোট রেঁস্তোরা শুরু করে। যেটি দ্রত স্থানীয় এবং প্রবাসীদের মধ্যে একইভাবে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। দুই বছর ধরে সফলভাবে রেঁস্তোরাটি চালানোর পর, তিনি তা বেঁচে দিয়ে গ্রিশিন রোবোটিক্স নামে একটি সফ্টওয়্যার ডেভেলপমেন্ট ফার্ম চালু করে। মস্কো শহরে তার নাম ছড়িয়ে পড়ে। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই গ্রিশিন ধনীদের কাতারে চলে যায়। খুব দামী কালো রং এর ভলগা গাড়ীতে চলতো।
অপুর্বর চোখের সামনেই সব ঘটনাগুলো ঘটে গেল।
১৯৮৭ সাল থেকে কতো কিছুই না দেখেছে এই সুন্দর সাঁজানো দেশটাতে। সব কিছুই স্বপ্ন পুরীর মতো মনে হতো।
লোভ-লালসা আর পুঁজিবাদের প্রাপ্তির তীব্র বাসনা মানুষকে কতো তাড়াতাড়ি বদল করতে পারে। ভাবতেও অপুর্বর খারাপ লাগে।
তার চোখের সামনে দিয়েই মার্কিন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যানের গাড়ীটি মিখলুখা মাখলায়ার এক পাশে ১ নম্বর ব্লকের পাশ দিয়ে মস্কোর সবচেয়ে দীর্ঘ রোড লেনিস্কি প্রসপেক্ট ধরে আস্তে আস্তে এগিয়ে চললো ক্রেমলিনের দিকে।
রাস্তার দুপাশে ইউনিভার্সিটির সব ছাত্র-ছাত্রী কর্মচারী সহ অসংখ্য মানুষ রাস্তার দুপাশে দাঁড়িয়ে সাদরে অভ্যর্থনায় হাত নাড়াচ্ছিলে। সেদিন অপুর্বও খুব উচ্ছ্বাস নিয়ে লোকেদের কাতারে সামিল হয়েছিলো। চোখের সামনে দিয়ে বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ট প্রেসিডেন্টকে দেখতে পাবে সেটা কি কম কথা? সত্যিই ভাগ্যের ব্যাপার।
অপুর্ব সেদিনগুলিতে যেন কিছুক্ষন ফিরে গেলো। স্মৃতি থেকে হাতরিয়ে কিছু খোঁজার চেষ্টা করলো-
(চলবে---)
Read full book here: Click here to download the PDF file