পর্ব-২৮
Summary:
তিন দিনের গরম আবহাওয়ার পরে, আজ লন্ডনে কিছু স্বস্থির নেমে এসেছে। গতকাল এক পশলা বৃষ্টির পর লন্ডন যেন নতুন আমেজে সেঁজেছে।
আজ বেশ অনিন্দ সুন্দর সকাল। সপ্তাহের এ দিনটি অপুর্বর বরাবরই প্রিয়।
গরম আবহাওয়া অপুর্বর একেবরে অসহ্য। সিরিয়াসলি, গরম আবহাওয়ায় হল নরকের চূড়ান্ত বৃত্ত। কিছুক্ষন হাঁটলেই শরীর থেকে থেকে ঘাম ঝরে, শরীর প্যাক প্যাক করে আর অতিরিক্ত গরমে সারা শরীর ঘামে চুলকাতে থাকে। প্রতিদিন অফিস থেকে ফিরে আবার সাওয়ারে ঘষা-মাজা করে শরীরে লেপ্টে থাকা ঘামের গন্ধের গুষ্টি উদ্ধার করতে হয়।
ভাগ্যিস ভালো, অপুর্বর অফিসটি বেশী দুরে নয়। ডিস্ট্রিক লাইনে দুইটা ষ্টেশন। প্রয়োজনে হেঁটেও যাওয়া যায়। একটু জোড়ে হাঁটলে পঁচিশ মিনিট লাগে।
বেশ গরমে আবার ট্রেনে চেপে বেশী দূর যাওয়াটা একটা অমানবিক শাস্তি।
বেকারলু লাইন নাকি এত খারাপ হতে পারে যে লোকেরা প্রায়শই অজ্ঞান হয়ে যায় সামারের অতিরিক্ত গরমে। বাদামী লাইনের ট্রেনগুলি ভয়ানক গরম থাকে সেই সময়ে। কোন কোন ষ্টেশনে ভিতরে নামা মানে একটি খোলা চুলার দরজার সামনে দাঁড়ানোর মতো। সান্ধ্য ভিড়ের সময়ে অক্সফোর্ড সার্কাস থেকে হোয়াইটচ্যাপেল পর্যন্ত গ্রীষ্মের মাঝামাঝি যাত্রায় মাত্র কয়েক দিনে যে ঘাম ঝরিয়েছে তা অপুর্ব মস্কোতে থাকা কালীন সময়ে পুরো সামারের তিন মাসেও ঝরায়নি।
অপুরব আন্ডারগ্রাউন্ড ম্যাপে জোন দুইএ থাকে এবং অফিসটা হলো জোন একএ।
উষ্ণ আবহাওয়া কয়েক দিনের জন্য চমৎকার। তারপর, সবকিছুতেই পরিবর্তন হতে শুরু করে...
সামারের সকালে প্রায় সময়ই অপুর্ব হেঁটে অফিসে যায়। অফিস বিল্ডিংটা লিভারপুল ষ্ট্রিট আর অলগেইটের মধ্যে অবস্থিত। এক পাশে কিছুদুর হেঁটে গলেই চোখে পড়বে লন্ডনের বুক চিড়ে বয়ে যাওয়া থেমস। বিখ্যাত টাওয়ার ব্রিজটি তখন নজর কাড়বে।
অপুর্ব যেখানে থাকে এর আশেপাশের এলাকায় প্রচুর পার্কল্যান্ড রয়েছে। তবে অপুর্বের ফ্লাটটি ব্রিক লেইনের পাশেই ওয়েন্টওয়ার্থ ষ্ট্রীটের মাথায় ওল্ড মনতাগ রোডের শেষ প্রান্তে ভেলেন্স রোডের একপাশে ঠিক ভেলেন্স গার্ডেনটির গাঁ ঘেষে অবস্থিত লমাস ষ্ট্রীটের প্রথম পাঁচ তলা বিল্ডিংএর চতুর্থ তলায়।
আজ শুক্র বার। জুলাই মাসের ৯ তারিখ। আগামী ১২ তারিখ অর্থাৎ সোমবর অপুর্বর বিবাহ। ইষ্টহামের এক মন্দিরেই বিবাহের কাজ সম্পর্ন হবে। সে উপলক্ষে পুরো সপ্তাহটা অফিস থেকে ছুটি নিয়েছে।
কাল আরিফ ভাইকে নিয়ে কিছু কেনা কাটা করবে। অফিস থেকে একটু তাড়াতাড়ি বেড়িয়ে যাবে। যাওয়ার পথে আরিফ ভাইকে ব্রিক লেইনের বাসা থেকে নিয়ে যাবে। আজ সন্ধ্যেটা এক সাথে কাটাবে অপুর্বর বাসায়।
তাই অফিসে আজ একটু তড়াতাড়ি রওনা দেয়।
হোয়াইটচ্যাপের মেট্রো ষ্টেশনে না গিয়ে বরং ওল্ড মনতাগ ষ্ট্রীট দিয়ে হাঁটা শুরু করলো। বেশ ফুর ফুরে সাত সকাল। বেশ সকাল থাকায় গাড়ীর মাথা নষ্ট করা আওয়াজ এখনো শুরু হয়নি।
ওল্ড মনতাগ ষ্ট্রীটের এক পাশে ছোট ছোট বাড়ীগুলোকে বেশ ভালো লাগছিলো। ডান পাশে সাড়ি সাড়ি হাইরেঞ্জ বিল্ডিগুলোর বাসিন্দাদের অধিকাংশই বাঙালী।
এক সময় কমারসিয়াল ষ্ট্রীট পার হয়ে টয়েনবি ষ্ট্রীটের এক পাশে ওল্ড ক্যাসল ষ্ট্রীট ধরে কিছুক্ষন হেঁটে এসে বিশ তলা বিল্ডিং এমপাওয়ার হাউজের আট তলায় লিফ্ট চেপে এসে পৌঁছালো। কাটায় কাটায় ঠিক তখন নয়টা বাজতে দশ মিনিট বাকী।
সোজা চলে যায় কিচেন এন্ড রেষ্ট রুমে। অফিস তখনো বেশ ফাঁকা। নয়টার বাজার সাথে সাথেই সবা হরমুর খেয়ে ঢুকবে। পাঁচ দশ মিনিটের মধ্যেই অফিস হলটি জমজমাট হয়ে উঠবে। সবাই হুরমুর খেয়ে পড়বে টেবিলে। ব্যস্ততায় কাটবে সময়।
চা নিয়ে এসে অপুর্ব নিজের টেবিলে বসে।
বেশ কিুছু কাজ জমা পড়ে আছে।
-ছুটিতে যাওয়ার আগে সব কাজ গুছিয়ে যেতে হবে-এই বলে সতর্ক করেছিলো অপুর্বর লাইন ম্যানেজার ডেভিড ক্লিমসন। বেশ অল্প কথার মনুষ ডেভিড। একজন খাঁটি ইংরেজ। সময়জ্ঞান খুব প্রখর। নিজে সব সময় ঠিক নয়টার আগেই অফিসে চলে আসে তাই কাউকে দেরীতে আসতে দেখলে অপছন্দ করেন। কখনো সখনো চিরকুট পাঠিয়ে সতর্ক বার্তা পাঠান। সব চিরকুটেই একটি লাইন লেখা থাকে-“we are not a salvation army, Office starts at 9 am”.
আজ সব কিছু চারটার মধ্যে শেষ করতে হবে।
তাই টেবিলে বসেই কাজে মনোনিবেশ। কোনদিকে তাকানোর যেন সময় নেই। চায়ে চুমুক দিতে দিতে কাজ করছে। এক সময় চাও শেষ। কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। একের পর এক ফাইল অপেন করছে আর কাজ শেষে ক্লোজ করছে। হঠাৎ কারো ডাকে ঘাড় ঘুড়িয়ে তাকায়। লাইন ম্যানেজারের অফিস সেক্রেটারী ফ্লোরেন্স-
-তোর ফোন এসেছে
-কোত্থেকে?
-সামওয়ান ফ্রম মস্কো
মস্কোর কথা শুনে বেশ অবাক হলো। তাড়াতাড়ি দৌড়ে এসে ফোনটা ধরলো।
-হ্যালো, আমি অপুর্ব বলছি। কে বলছেন?
-অপুর্ব, আমি জাকির বলছি মস্কো থেকে
-আরে জাকির ভাই? কেমন আছেন?-অপুর্বর কথায় বিস্ময়ের ছাপ।
-কেমন আশা করেন। এই যে গেলেন একটা খবরও দিলেন না। যাওয়ার সময়ও বলে আসলেন না।
-সরি জাকির ভাই। একদিন আপনার অফিসে কিন্তু ফোন দিয়েছিলাম। কিন্তু—
-যাক কোন ব্যাখ্যা দিতে হবে না। অপুর্বকে যেন থামিয়ে দিলো জোর করে। আবার বলতে শুরু করলো-
-এখন যে কারনে ফোন করছি তা একটু মনোযোগ দিয়ে শুনুন। সুতপা খুব অসুস্থ। গতকাল ওর পরপর দুটি অপারেশন হয়। এখন হসপাতালে আছে। অনেকদিন হাসপাতালে থাকতে হবে। একমাস পরে আর একটা অপারেশন হবে। ওর শরীর ভীষন খারাপ। মস্কোতে আপনিই ছিলেন ওর কাছের। কাউকে যদি ভালোবেসে থাকে সেটা আপনি। সুতপা ওর ভুল বুঝতে পেরেছে। কিন্তু আপনাকে আর বলতে পারেনি। এর আগেই ওর জীবনে অনেক কিছু ঘটে যায়। এর মধ্যে আপনিও অভিমান করে মস্কো ছেড়ে চলে গেলেন। একবারও ওর সাথে আর যোগাযোগ করেন নাই। ভালোবাসার পরিনাম যদি এইরকম হয় তাহলে কেউ আর কখনো কাউকে ভালো বাসবে না। আপনি যদি সত্যি ওকে ভলোবেসে থাকেন তা হলে ওর এই দুঃসময়ে ওর পাশে এসে দাঁড়ান। আপনিই একমাত্র ওর বেঁচে থাকার ভরসা।
টিং টিং……
হ্যালো, হ্যালো, হ্যালো জাকির ভাই। আমাকে শুনতে পারছেন?-অন্য পাশ থেকে অপুর্বের ভেজা ক্লান্ত কন্ঠের উচ্চারন জাকির ভাইয়ের কর্নে এসে আর পৌঁছায়নি।
জাকির ভাই আর কিছু বলতে পারলো না। টেলিফোন বক্স থেকে ফোনটি করছিলো। কয়েন শেষ হয়ে যায় বলে লাইনটি কেটে যায়। আবারো ফোন করার মতো কোন কয়েনও অবশিষ্ট নেই।
ফোনের রিসিভারটি অপুর্ব আস্তে আস্তে টেলিফোনের হ্যান্ডসেটের উপর রাখে। হাতটি কাঁপছিলো। হঠাৎ বিদ্যুত চমকানোর মতো মাথাটা ছ্যাৎ করে উঠলো। সারা রুমটা যেন চোখের সামনে চক্কর কাটছে। কেমন এক অসারতার সারা শরীর জুড়ে ছড়িয়ে পড়ছে। অবশ হয়ে আসছে হাত-পা। শরীর থেকে সমস্ত শক্তি কে যেন অসুর হাত দিয়ে টিপে টিপে বেড় করে নিয়ে গেছে। কিছুই ঠাহর করতে পারছে না। শুধু চোখের সামনে সুতপার অসুস্থ মুখটা ভেসে উঠছে। মুখ ফসকে বেড়িয়ে এলো-`সুতপা¬। এ বলেই পাশের লেদারের চেয়ারে বসে পড়লো।
পাশের ডেস্কে বসে থাকা ফ্লোরেন্স অপুর্বকে লক্ষ করছিলে। ওর অবস্থা দেখে বুঝতে পারছিলো কিছু একটা ঘটেছে। সম্ভবতঃ কোন দুঃসবাদ। অপুর্বকে আগে কেউ বিদেশ থেকে ফোন করেনি। আজই প্রথম।
চেয়ার থেকে উঠে এসে অপুর্বর কাছে আসে। বেশ আস্তে করে জিজ্ঞেস করে-
-আপুর্ব, আর ইউ ওকে? এনি প্রবলেম।
অপুর্ব কোন সারা দিলো না। মাথায় দুহাত দিয়ে এক দৃষ্টিতে ফ্লোরের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। শরীরে কোন নড়াচড়া নেই।
-আপুর্ব, আর ইউ অলরাইট? ইজ দেয়ার এনি প্রবলেম?
অপুর্ব এবার চোখ তুলে ফ্লোরেন্সের দিকে তাকালে। চোখের কোনে ভাসা ভাসা জল কনা।
-আমি ওকে, থ্যাংকিউ ফর আস্কিং-অপুর্বর ঠান্ডা উত্তর
-সুড আই গেট ইউ সাম ওয়াটার
-প্লিজ-অপুর্বের সংক্ষিপ্ত উত্তর
ফ্লোরেন্স তাড়াতাড়ি এক গ্লাস জল নিয়ে আসলো। গ্লাসটা হাতে নিয়ে ঢক ঢক করে একটানে অপুর্ব পান করলো। এয়ারকন রুমেও কপালে ভোরের দূর্বাঘাসের শিশিরের মতো ঘাম জমা হতে শুরু করলো। ফ্লোরেন্সকে একটা থ্যানকিউ দিয়ে চেয়ার থেকে উঠলো।
-আই থিংক ইউ আর নট ফিলিং ওয়েল। হোয়াই ইউ ডোন্ট গো হোম।-ফ্লোরেন্স অপুর্বকে শুধায়
-ডোন্ট অরি। আই উইল বি ফাইন। এনি ওয়ে আই এম লিভিং আরলি টুডে। থ্যাংক ইউ সো মাচ
-ডোন্ট অরি ইফ ইউ নিড টু লিভ। আই উইল লেট ডেভিড নো দেট ইউ ডোন্ট ফিল গুড-ফ্লোরেন্স আবারো আস্বস্থ করে।
-থ্যাংকস-এই বলে অপুর্ব রুম থেকে বেড়িয়ে আসে।
ধীরে ধীরে এসে নিজের চেয়ারে বসে। ডেস্কে বেশ কয়েকটি ফাইল খোলা রয়েছে। মনোযোগ দেওয়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু মাথায় কোন কিছু ঢুকছে না। মগজের কোষে কোষে কেমন টান টান লাগছে। বুকটা এখনো ধরপর করছে। হঠাৎ ওর ভাবনায় কে যেন উঁকি মারছে। বিদ্রুপের ভাব। তীক্ষ্ণ ভাবে তাকিয়ে যেন অপমানের সুরে বলছে-
-অপুর্ব তুই একটা অপদার্থ। মনটা টলমলে। অশান্ত ভাবনারা তোর পুরুষত্বকে চিবিয়ে চিবিয়ে খাচ্ছে। শিড়দাঁড়াকে শক্ত কর। যাকে ভুলে গেছিস তাকে নিয়ে ভেবে আগামীর সৌন্দর্যকে নষ্ট করিস না। পৌরষত্বহীন ভাবে বেঁচে থাকা মৃত্যুর সমান। তুই মূর্খ—হা-হা-হা
-না-আমি মুর্খ নই। আমি অপদার্থ নই-এই বলে মাথায় দুহাত চেপে চীৎকার করে উঠে।
অপুর্বর হঠাৎ উচ্চ আওয়াজে আশে পাশের সবাই ওর দিকে তাকিয়ে থাকে। অনেকে অবাক হয়। আগে কেউ এমনটি দেখেনি। ডান পাশের একজন সহকর্মী জিজ্ঞেস করে-
-অপুর্ব, আর ইউ অলরাইট?
-আই এম সরি-এই বলে আবার কাজে মন দেয়।
প্রায় দুঘন্টা কাজ করার পর মোটামুটি বেশ কিছু কাজ শেষ করে অপুর্ব। আর যেন পারছে না।
মাথাটা এখনো টন টন করছে। এক সময় কিচেনে যায়। ব্যাগ থেকে দুপুরের লান্স বক্সটা সঙ্গে নিয়ে যায়।
খাওয়া শেষ করে এক গ্লাস জল আর এক কাপ ব্লাক কফি নিয়ে এসে টেবিলে বসে। ব্যাগ থেকে দুটো প্যারাসিটামল বেড় করে জল দিয়ে গিলে।
কি করবে বুঝতে পারছে না। সোমবারে বিয়ের সব ঠিক ঠাক। কিন্তু জাকির ভাইয়ের ফোনটা পেয়ে সবকিছু যেন ওলোট পালোট হয়ে যায়। ভাবনারা ভীষন এলো মেলো। অতীতের স্মৃতিগুলো মনের পর্দায় একে একে ভেসে উঠছে। প্লানেয়রনায়া, মিখলুখামাকলায়া, দুম ট্যুরিষ্ট, ইগো জাপাদনায়া, দানেস্কায়া, রেড স্কয়ার, রোস্তব অন ডন, মস্কো নদী ইত্যাদি ইত্যাদি বিরামহীন ভাবে সেলুলয়েডের ফিতার মতো মনের পর্দায় দৌড়ে বেড়াচ্ছে। একেবারে অস্থির মন।
এমনি নানা ভাবনায় যখন মসগুল তখনি কে যেন ভাবনায় একটা ধাক্কা দিলো। অফিস আর ব্যাস্ত নগরীর এতো সোরগোলের মধ্য থেকে যেন ভেসে আসলো কারো শব্দ। অনুনয়ের আর কাতরতার। প্রজ্বলিত মোমবাতীর শিখার মতো হৃদয়ের শূন্যতা পূরণের আশ্বাস, বিচ্ছেদের অনুভবে মিন্ময়ীর তান।-
-ভাবনার কিছুই নেই। অতীতেই তোর অস্থিত্ব, জীবনের গন্ধমাদন। অতীতেই ফিরে যা। যা কিছু ভবিতব্য সবই ভ্রম, ক্ষনস্থায়ী। ভালবাসা চিরন্তন, অসীম এবং সীমাহীন। ভালোবাসায় থাকে উষ্ণতা এবং সর্বদা ক্ষমাশীল। ভালোবাসায় প্রতিদানের প্রত্যাশা নেই। বিশুদ্ধ ভালবাসা অমীয়-দেনা-পাওনার উর্ধে। তাই তুই ফিরে যা। সুতপাই তোর অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যত। সুতপা তোকে ভালোভেসে আজ অসুস্থ। ওকে সুস্থ করে তোলা তোর ভালোবাসার দায়। আর ভাবিস নে। আজ ভুল করলে জীবনে তা সুধরানোর সময় পাবিনা। অতীত তোকে ছাড়বেনা। সুতপার প্রেম বিশুদ্ধ, বিশাল, অন্তহীন সমুদ্রের মতো। সুতপাই তোর জীবন------
আর কিছু শুনতে পেলো না।
অপুর্ব উঠে দাঁড়ালো। রাকসাকটা তুলে নিয়ে কাঁধে ঝুলালো। সোজা ডেভিডের রুমে। কিন্তু ডেভিড রুমে ছিলো না বিধায় ফ্লোরেন্সকে বলে হন হন করে লিফ্ট ধরে নীচে নেমে এলো।
মাথায় শুধু এখন মস্কো আর সুতপা।
অফিস থেকে বেড়িয়ে হাঁটা শুরু করলো। জোড়ে জোড়ে। পা যেন থামছে না। দশ মিনিটেই ব্রিক লেইনে সোনালী ব্যাংকের সামনের এরোফ্লটের মেইন অফিসে ঢুকলো। তেমন ভীর ছিলো না।
-আমার একটা টিকেট চাই। লন্ডন টু মস্কো। রিটার্নটা ওপেন থাকবে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। কাল, পরশু----যতো তাড়াতাড়ি। প্লিজ।
-একটু বসেন-সামনের টেবিলের ভদ্রলোকটি বললেন।
কিছুক্ষন বসলো। প্রায় বিশ মিনিট পর ভদ্রলোকটি বললো-
-কাল সকাল সাড়ে নয়টা। দুপুর একটায় মস্কো সেরমিটিয়েভা এয়ারপোর্টে ল্যান্ড করবে। ঠিক আছে তো।
-প্লিজ বুক করুন।
টিকেটটা নিয়েই সোজা টেলিফোন বুথে চলে যায়। জাকির ভাইয়ের অফিসে ফোন করে। উনিই টেলিফোনটি ধরেন। দুই এক মিনিটের মধ্যেই প্রয়োজনীয় কথা সেরে নেয়। জাকির ভাইকে এয়ারপোর্টে আসার জন্য অনুরোধ জানায় এবং অপুর্বর আসার কথা যেন কাউকে না জানায়। অপুর্ব এয়ারপোর্ট থেকে সরাসরি হাসপাতালে যাবে।
সেখান থেকে সোজা নিজের ফ্লাটে চলে আসে।
হাত মুখ ধুয়ে এক কাপ চা নিয়ে এসে বসলো। একটা সিগারেট ধরালো। আজ সারাদিন কোন সিগারেট টানেনি। মাথার টান টান ব্যাথাটা আর নেই। কাল মস্কো যাবে। সকাল ছয়টায় রওনা দিতে হবে। অনেক কাজ বাকী। তবে মস্কো যাওয়ার ব্যাপারটা কাউকে জানাবে না। সন্ধ্যায় আরিফ ভাইকে সব খুলে বলবে। মস্কো আর সুতপা ছাড়া এখন আর কিছু ভাবতে পারছে না।
আরিফভাই প্রথম কথাটা শুনে যেন আকাশ থেকে পড়লেন।
-বলেন কি? আপনি কাল মস্কো যাচ্ছেন? এখানে যে সব ঠিক ঠাক? না না এটা হয় না। এটা ঠিক না।
-আমি জানি না কোনটা ঠিক আর কোনটা বেঠিক। তবে একটা জিনিষ পরিস্কার সুতপাই আমার অস্তিত্ব। আজ এই অসময়ে আমাকে ওর সবচেয়ে বেশী প্রয়োজন। আজ যদি আমি না যাই তাহলে সারা জীবন আমি নিজকে নিজে ক্ষমা করতে পারবো না। আপনি প্লিজ সব কিছু খুলে বলবেন মেয়ের মাকে।
আরিফ ভাই কিছুক্ষন চুপ করে থাকলেন। কি যেন গভীর ভাবে ভাবলেন। তার পর আবার মুখ খুললেন-
-সবই বুঝলাম।
-প্লিজ আরিফ ভাই।
-ঠিক আছে। আপনি যান। আপনার যাওয়াটাই সবচেয়ে মঙ্গল হবে। সবার জন্যই। আমি কালই যাবো। এইটাই জীবনের সত্য। তাকে অস্বীকার করাটাই হবে পাগলামী কিছু ভাববেন না। সব ঠিক হয়ে যাবে।
-থ্যাংক কিউ আরিফ ভাই। একদিন আপনি বলেছিলেন আপনি আমার বড়ো ভাই। সেদিন যেমন আমার ভবিষ্যতের ভাবনায় আপনি চিন্তিত ছিলেন, উচ্ছ্বসিত হয়েছিলেন এবং আমার জন্য খুঁজে বেড় করেছিলেন নতুন ভাবে চলার প্রেরনা। আজ ঠিক তেমনি কোন এক অসময়ের বাঁকে দাঁড়িয়ে আমাকে আবারো আমার অস্থিত্বকে স্বীকার করতে, বাস্তবতাকে আলিঙ্গন করতে দিয়েছেন দুহাত বাড়িয়ে। আপনার এই অমীয় বিশ্বাস আর ভালোবাসার কথা আমি কখনো ভুলবোনা। আপনি সত্যিই বড়ো ভাইয়ের কাজটি করে আবারো দেখালেন।
এই বলেই অপুর্ব আরিফ ভাইয়ের চরনে লুটে পড়ে এবং হাউ মাউ করে কাঁদতে থাকে।
-আরে, আরে কি করছেন। প্লিজ পা ছাড়েন। একি সর্বনাস! কাঁদছেন কেন। আপনি না পুরুষ মানুষ। আজতো আনন্দের দিন। আসুন আমার বুকে।-এই বলে অপুর্বকে তুলে দুহাতে আরিফ ভাই বুকে তুলে নেয়। আবার বলতে থাকে-
-আমি আজ আপনাকে নিয়ে গর্বিত। সত্যিকারের ভালোবাসা মানুষকে মানবিক করে তুলে। ক্ষনিকের মান-অভিমান যতোই ভালোবাসার মানুষটিকে দুরে ঠেলে দিক না কেন একদিন নদীর জলের মতো মোহনায় মিশবেই। আপনি ফিরে যান। প্রার্থনা করি সুতপা তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠুক। আপনারা সুখী হবেন।
কিছুক্ষন পরেই অপুর্ব আরিফ ভাইয়ের ঐখান থেকে নিজের বাসায় চলে আসার জন্য বিদায় নেয়।
রাস্তায় তখনো মানুষের হাঁটা-চলা। ব্যাস্ত নগরীর ব্যাস্ত গাড়ীগুলো নিয়ন বাতীর আলোতে এগিয়ে চলছে। সব পাখিরা ফিরে গেছে নীড়ে। শুক্রবারের নগরীর ক্লাবগুলোতে মানুষের ভীর। কি পরিস্কার আকাশ। থেমসের তীর ঘেঁসে গড়ে উঠা টাউয়ার হ্যামলেটসের বাতাসে যেন অলকানন্দার বুক থেকে ভেসে আসা মৃদু শীতল বাতাসের উচ্ছ্বাস। মনের ভেতর যেন কোকিলের সুর বিতান। অপুর্ব হেঁটে চলছে একাগ্র চিত্তে এক আনন্দের ভাবনার দোলায়।
ঠিক কাটায় কাটায় একটার সময় মস্কো সেরমিটিয়েভা এয়ারপোর্টে এসে বিমানটি ল্যান্ড করে। সিকিউরটি, ইমিগ্রাশন পার হয়ে ব্যাগ কালেক্ট করতে করতে প্রায় ঘন্টা খানেক লেগে যায়। বেড় হয়েই এরাইভাল গেইটের সামনেই জাকির ভাইকে দেখতে পায়।
সেখান থেকে সোজা বেড় হয়ে একটা ট্যাক্সি নিয়ে রওনা দেয়।
অপুর্ব চুপচাপ গাড়ীতে বসে আসে। পাশের জানালা দিয়ে তাকিয়ে আছে দূর আকাশের দিকে। সামারের জুলাইর রোদ্রের উজ্জ্বলতা চারিদিকে।
ভাবনারা মাথায় চসে বেড়াচছে। অনেকদিনের বিচ্ছিনতা। আজ সে তার ভালোবাসার কাছে ফিরে যাচ্ছে। অনুপস্থিতি হৃদয়কে অনুরাগী করে তোলে। আজ অপুর্বর জন্য এক চরম মুহূর্ত। এমন এক হৃদয়স্পর্শী মুহূর্ত যখন প্রতিকূলতা কাটিয়ে উঠার পরে মিলিত হয় আনন্দ ধারায়। এ যেন বিজয় এবং সুখের প্রতীক।
এতোদিন ভুলে থাকার পরও আজ অপুর্ব উপলব্ধি করতে পারলো কোনও সময় এবং স্থান কাউকে একান্ত ভালোবাসার লোকটির জীবন থেকে আলাদা করতে পারে না। এ যে স্বাত্বিক ভালোবাসার চিরন্তন বিজয়।
যদিও মান অভিমান করে কেটে গেছে একটা বছর। বিচ্ছেদের যন্ত্রনায় কেটেছে সময় কিন্তু আজকের মস্কোর বাতাসে উত্তেজনা যেন স্পষ্ট।
এ যেন থেমে যাওয়া সময়ের কাটা, থেমে যাওয়া সম্পর্ক, থেমে যাওয়া মুহূর্ত এবং হারিয়ে যাওয়া সময়ের প্রতীক। ঘড়ির কাঁটাটি যেন আবার টিক টিক করে চলতে শুরু করেছে। আবারো সচল হতে শুরু করেছে অপুর্বর হৃদয়, মন ও ভালোবাসা। পুরনো শহরের স্মৃতিগুলো একের পর এক ভেসে উঠছে। আজকের এই মুহুর্ত তাদের হারিয়ে যাওয়া সম্পর্কে নিয়ে এসেছে শ্রাবস্তীর জোস্না স্নাত রাতের প্রশান্তি।
হঠাৎ জাকির ভাইয়ের আওয়াজে অপুর্বর ভাবনায় ছেদ পড়লো। খ্যাচ করে ট্যাক্সিটি থেমে পড়লো।
-অপুর্ব আমরা চলে এসেছি।
-হুম
কাল সারা রাত সুতপার তেমন ঘুম হয়নি। অপারেশনের পর থেকেই শরীর বেশ দূর্বল। ওজন কমতে শুরু করেছে। প্রায় দশ কেজি ওজন কমেছে। বিছানা থেকে এখনো উঠে দাঁড়াতে পারেনি। শক্তহীন শরীর, ঘুমহীন চোখ আর অসার শরীরটার মধ্যে যেন প্রানটা কোন রকমে বেঁচে আছে।
হাসপাতালের খাওয়া-দাওয়ায় তেমন রুচি নেই।
আজ দুপুরের পর নিস্তেজ শরীরটা ঘুমে লুটিয়ে পরে। ঘুমের ঘোরে সুতপা স্বপ্নে বিভোর। হঠাৎ মনে হলো কে যেন ওকে দুহাত বাড়িয়ে বুকে তুলে নেয়। তার পর ভাসতে থাকে। উড়ে চলছে কোন দূর আকাশে। হাত বাড়িয়ে আকাশটাকে ছুঁতে চায়। কিন্তু পারছে না। ধীরে ধীরে আকাশটা ঘন কালো মেঘে ঢেকে যায়। চারিদিক অন্ধকার। আশে পাশে মৃত মানুষের লাশ ভেসে বেড়াচ্ছে। কিসের সোরগোল। ভয়ানক পাখিদের ডানা ঝাপটানোর পত পত আওয়াজ। সুতপার খুব ভয় লাগছে। হঠাৎ একটি বিশাল পাখির ধাক্কায় সুতপা আকাশ থেকে মাটিতে পড়ে যাচ্ছে। সমস্ত শক্তি দিয়ে শূন্যে ভেসে থাকার আপ্রান চেষ্টা। কিন্তু পারেনি। মাটিতে ধপাস করে লুটিয়ে পড়ে। মুখ থেকে বেড়িয়ে আসে-অপুর্ব……
ঘুমের ঘোরেই সুতপা শুনতে পেলো কে যেন বলছে-আরে অপুর্ব!
অপুর্ব দড়জার সামনে দাঁড়িয়ে। দুচোখ কাকে যেন খুঁজছে। দেয়ালের পাশ ঘেঁসে বেডে শুয়ে থাকা সুতপার দূর্বল শরীরের দিকে এবার চোখ দুটি স্থির হয়ে রইলো।
ধীরে ধীরে সুতপা চোখ মেলে তাকানোর চেষ্টা করলো। আবছা আবছা অপুর্বর মুখটি ভেসে উঠলো। সেলিম এবং বেয়াই সুতপার পাশে রাখা চেয়ারে বসে আছে। অপুর্বকে দেখে বিস্ময়ের চোখে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষন। তারপর চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালো।
সুতপা এবার অপুর্বর দিকে তাকালো। কোন স্বপ্ন নয়। সত্যি সত্যি রক্ত মাংসের প্রিয় মানুষটি আজ সুতপার সামনে দাঁড়িয়ে আছে।
অপুর্ব মনে মনে বির বির করে উঠলো-আমি আজ তোমার কাছে ফিরে এসেছি। তোমার কাছেই থাকবো।
অপুর্ব তখনো তাকিয়ে আছে সুতপার দিকে। কারো মুখেই কোন ভাষা নেই। সুতপার চোখের কোন বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়লো।
পড়ন্ত বিকেলের এই পরম মুহুর্তে অপুর্ব কিছুই বলতে পারলো না। গলায় কেমন এক আদ্রতা। চোখ দুটি জলে ভরে উঠে।
হঠাৎ কারো ডাকে ভাবনায় ছেদ পড়ে-
-তুমি এখনো অফিস রুমে বসে আছো। তুমি কাঁদছো নাকি? তোমার চোখে জল কেন?
অপুর্ব দুহাত দিয়ে চোখের জল মুছে সুতপার দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে।
(শেষ পর্ব)
Read full book here: Click here to download the PDF file