মস্কোর বরফবিথী ও একজন সুতপা পর্ব-২৬


Author: ড. পল্টু দত্ত

পর্ব-২৬

Summary:

গত কয়েক মাসে মস্কোর নদীতে অনেক জল গড়িয়েছে। প্রকৃতিতে এসেছে নানা পরিবর্তন।

গ্রীষ্ম গিয়ে শীত এলো, শীতের বাতাসে নেতিয়ে পড়া গাছের হলুদাভ পাতাগুলো ধীরে ধীরে ঝড়ে গেলো। শীতের আগমনে সব কিছুতেই যেন তারুন্যের ছোঁয়া এলো, ঠান্ডায় কেমন ধ্যানমগ্ন চারিদিক।

এবারের এই শীতের পুরো মৌসুমটা ছিলো সবচেয়ে অন্ধকারাচ্ছন্ন। এমনটি আগে কখনো দেখেনি কেউ। পুরো নভেম্বর-ডিসেম্বর মাস দুটো রাশিয়ার রাজধানীতে সূর্যদেব কোথাও যেন লুকিয়ে ছিলেন তাই আলো জ্বালাতে ব্যর্থ হয়েছেন। পুরো ডিসেম্বরে মাত্র কয়েকঘন্টার জন্য সূর্যালোকের রেকর্ড-ব্রেকিং। সারা শহরটা যেন অন্ধকারের চাদরে মুড়ি দিয়ে ছিলো।

প্রকৃতির নানা পরিবর্তন দেখতে দেখতে এক সময় শীতও বিদায় নেয়। ধীরে ধীরে সুতপাও নিজকে সামলিয়ে নেয়। কিন্তু শরীর-মন দুইই ভেঙ্গে পরে।

 

সেদিনের পর থেকে নিজের মধ্যে যে বিষাদের অসারতা ভর করেছে নানা চেষ্টা করেও যেন দূর করতে পারেনি। সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙ্গনের মতোই যেন সুতপার বর্তমান ভবিষ্যতের সব স্বপ্ন-আশা-আকাঙ্খা কোন এক ভয়ানক ঝড়ের তান্ডবে দুমড়ে মুচড়ে ভেঙ্গে খানখান হয়ে যায়। অবশিষ্ট যা বাকি আছে তা যেন প্রানহীন অসার দেহটা। তাকে টেনেই এগিয়ে চলেছে সুতপা।

 

বেশ কিছুদিন যাবৎ পেটের ব্যাথাটা আবারো বেড়েছে।

দু একবার অবশ্য পলিক্লিনিকে গিয়ে ডাক্তার দেখিয়েছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পেইন কিলার দিয়ে কিছু উপদেশের বাক্য ছেড়ে বিদায় করে। কেন ব্যাথা করে তার কারন বলার প্রয়োজন বোধ করে নি।

 

একদিন এক শনিবারের অলস বিকেলে সুতপা নিজের রুমে বসেই পুরনো এলবামে চোখ বুলাচ্ছিলো। ছবিগুলো দেখতে দেখতে কেমন জানি একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়ছিলো। চোখের পাতা ঝাঁপসা হয়ে আসে। আকাশের কালো মেঘেদের মতো মুখটা কালো হয়ে গম্ভীর দেখায়। মনের পর্দায় একের পর এক অতীতের স্মৃতিগুলো ভেসে উঠছিলো। হঠাৎ দরোজায় ঠক ঠক করে কেউ যেন শব্দ করছিলো। অনিচ্ছা সত্বেও উঠে এসে দরোজাটা খুলে দিলো। দড়জা খুলেই জাকির ভাইকে দেখে অবাক হয়ে যায়। সাথে সেলিমও ছিলো

-জাকির ভাই, আপনি? -অবাক চোখে সুতপা জিজ্ঞেস করে।

-খুব অবাক হইলা না? কতোদিন পর তোমার এখানে আসা।

-অবাকই হওয়ার কথা। কতোদিন আপনি এখানে আসেন না। আমার কথা একেবারে ভুলেই গেছেন। এক সময় প্রতি সপ্তাহে আসতেন।

-না, না। ভুলবো কেন। আসলে গত কয়েক মাসে খুব ঝামেলার মধ্যে ছিলাম। তোমাকে একদিন সব বলবো। এখন বলো তুমি কেমন আছো?

-কেমন থাকবো আর। বেশী ভালো না। শরীরটা খুবই খারাপ। কোনভাবে পরীক্ষাগুলো শেষ করলাম।

-শরীরের কি দোষ বলো। মনটা ভালো না থাকলে শরীরটা যে ভালো থাকতে পারে না। আমি সবই জানি। সেলিম আর বেয়াইর সাথে মাঝে মধ্যে দেখা হয়। ওদের কাছে সবই শুনেছি। এতোবড়ো ধকল তোমার উপর দিয়ে যাবে আমি বিশ্বাসও করতে পারিনি। এতোদিন হয়ে গেলো অপুর্বর চলে যাওয়া। কোন খবর পাইছ?

অপুর্বর কথা শুনতেই সুতপা হঠাৎ করেই গম্ভীর হয়ে যায়। সেলিম যেন সেটা টের পায়। তাই পরিস্থিতিটাকে স্বাভাবিক করার জন্য হাসতে হাসতে বলে উঠলো-

-আমরা কি দরোজায় দাঁড়াইয়া দাঁড়াইয়া কথা বলবো? এতোদিন পর জাকির ভাই আমাদের হোস্টেলে আইছে, ভিতরে নাও। নাকি তোমার রুম মেইট আছে?

-সরি জাকির ভাই। ছি ছি, প্লিজ ভেতরে আসেন। রুমে কেউ নাই। পরীক্ষার পর থেকে আমি একাই রুমে। আর থাকলেও অসুবিধা নাই।

রুমে এসে ঢুকতে ঢুকতে জাকির ভাই সুতপাকে বলে-

-এতোবড়ো একটা ঘটনা ঘটে গেলো অথচ আমাকে একবার জানালে না। জানলে আমি অন্ততঃ অপুর্বকে বুঝাতাম

-আর বইলেন না জাকির ভাই। শিক্ষিত মানুষ যে এতো ভুল করতে পারে আমার জানা ছিলো না। যাক এসব বাদ দেন।

-সব কিছুকে তো এতো সহজে বাদ দেওয়া যায় না। চাইলেও যায় না। এতো সুন্দর একটা সম্পর্ক এভাবে ভেঙ্গে যাবে ছোট্ট একটা

ভুলের জন্য।-সেটা তো ঠিক না? কি বলো সুতপা?-সুতপার দিকে তাকিয়ে উৎসুক দৃষ্টিতে যেন উত্তরের প্রতিক্ষায় থাকে।

-আমার কিছু বলার নেই। নিজের ভুলের মাশুল যে দিতে হবে। এটাই নিয়ম। শুধু দুঃখটা এখানেই যে শেষ পর্যন্ত আমার ভুলটাকে আর জানাতে পারলাম না।

-আমার দৃঢ় বিশ্বাস অপুর্ব আবার ফিরে আসবে। আমি অন্ততঃ যতোটুকু ওকে চিনেছি ও এতো বড়ো ভুল করতে পারে না।

-আমার তো তা মনে হয় না। এতোদিন হইয়া গেলো একটা খবরও দিলো না। স্কুল জীবন থেইক্যা আমরা এক সাথে বড় হইছি, সব কথা অন্ততঃ আমারে বলতো-কিন্তু অহন পর্যন্ত একটা ফোন করারও প্রয়োজন মনে করলো না। মানুষ এতো বেঈমান কেমনে হয়-খুব রাগের সুরেই সেলিম কথাগুলি বলে।

সুতপা চায়ের আয়োজন করতে করতে ফোড়ন কাটলো-

-যাক সেলিম ভাই মাথা খারাপ কইরেন না। ও আসলে আমাদের কথা ভুইলা গেছে। ভালোবাসা আর সম্পর্ক বলে কিছুই নাই। পৃথিবীটা এখন অবাস্তব।

-আরে শোন! কয়দিন আগেই অপুর্ব আমাদের পত্রিকা অফিসে ফোন করে। আমি তখন বাংলাদেশে ছিলাম। অফিসের জিয়া ভাই ফোনটা রিসিভ করে। অপুর্ব ওর অফিসের নাম্বারটা দেয়। গত সপ্তাহে জিয়া ভাই এই খবরটা দেয় আমাকে। তাড়াহুরার জন্য আমি সেদিন জিয়া ভাইর থেকে নাম্বারটা নিতে পারি নাই। এ সোমবারেই নিয়ে নেব। এই খবরটা দেওয়ার জন্যই আজ তোমার সাথে দেখা করতে আসি। প্রায় দু‘মাসের মতো দেশে ছিলাম। তার আগে অনেক ঝামেলার মধ্যে ছিলাম। এর মধ্যে কতো কিছু ঘটে গেলো।

-তাই নাকি? অপুর্ব ফোন করছিলো? -অবাক হয়ে সেলিম জিজ্ঞেস করে-তয় আর কি বললো?

-তেমন নাকি বেশী কথা হয় নাই। আমাকে চাইছিলো সরি বলার জন্য। অফিস জব নাকি পাইছে। এখন লন্ডনেই থাকে। প্রথম দিকে নাকি অন্য কোন শহরে ছিলো। রেস্টুরেন্টে কাজ করতো।

-সরি কেন?-সেলিম জিজ্ঞেস করে।

-হঠাৎ করেই অফিসে যাওয়া বন্ধ করে দেওয়ার খেস্তি-খেউরি আর কি! তবে ও অফিসে না যাওয়ায় আমরা একটু অবাক হইছিলাম। অনেক জায়গায় খোঁজ নিয়েছিলাম। কিন্তু কিছুই জানলামনা। পরে তো বেয়াই আর তোমার মুখেই সব কিছু শুনলাম।

 

অপুর্ব টেলিফোন করেছে শুনে সুতপা একটু নড়েচড়ে বসে। বেশ মনোযোগের সাথে ওদের কথোকপথন শ্রবন করছিলো। চায়ের সাথে কিছু বিস্কিট আর চানাচুর মেখে এনে ফোল্ডিং টেবিলটাতে রাখে-

-জাকির ভাই-নিন, সেলিম ভাই আপনিও নিন।

-আজ এতোদিন পর জাকির ভাই আইছে। তুমি কি চা খাওয়াই বিদায় করতে চাও নাকি।-সেলিম হাসতে হাসতে সুতপাকে বলে আর জাকির ভাইয়ের দিকে তাকায়।

জাকির ভাই তখন চায়ের কাপে মাত্র ফু দিয়ে চুমুক দিচ্ছিলো। সেলিমের কথা শুনে জোড়ে হাসি দিয়ে উঠলো। সাথে সাথে দুই ঠোঁটের মাঝ থেকে চায়ের অংশ ছিটকে এসে পড়লো টেবিলের উপর।-বলতে লাগলো-

-সেলিম, তুমি কি কখনো দেখেছ এখানে এসে কখনো না খেয়ে গেছি? আজ প্রয়োজনে আমি রান্না করবো।

-কি বলেন সেলিম ভাই! আমি কিন্তু ফ্রিজ থেকে চিকেন বেড় করে ভিজিয়ে রেখেছি। চা চক্রের পরই রান্না করবো। কোন চিন্তা

করবেন না।-সুতপার সোজা-সাপ্টা উত্তর।

-দেখছ সেলিম? একেই বলে বোনের কর্তব্য। সুতপা আজ কিন্তু চিকেন ভুনাটা আমি করবো

-আর আমি সালাদ বানাবো। সুতপা তোমার কাজ ঝাল করে আলু ভর্তা আর ডাল-সেলিমের আদেশ

-আর ভাত?-সুতপা বলে।

-তোমার কাছে চিকন চালটা আছে নি? তাহলে আমি পোলাও বানাবো। একটা জম্পেস ডিনার হোক-জাকির ভাইয়ের উৎসুক দৃষ্টি

-খুব ভালো চাল আছে জাকির ভাই। ভালোই হবে।

কথা বলতে বলতে চায়ের পর্বটা শেষ হয়।

এক সময় হৈ চৈ করে এক সাথে রান্না-বান্না করে সবাই। যখন খেতে বসে তখন প্রায় রাত আটটা। টেবিলে সব সাঁজিয়ে নেয় সুতপা একে একে। এর মধ্যে সেলিম নিজের রুম থেকে একটা ওয়াইনের বোতল নিয়ে আসে। দুটি ওয়াইন গ্লাসে ঢেলে নেয়।

বেশ মজা করেই তিন জনে খাওয়া শেষ করলো। কথা বলতে বলতে পুরো ওয়াইনের বোতলটি সাবাড় করে দেয়।

 

অপুর্বর চলে যাওয়ার পর এমন করে সুতপা আর খায়নি। মনে হঠাৎ করেই ধল প্রহরের গ্রীস্মের মৃদু বাতাসের দোলা আছড়িয়ে

পড়লো যেন। কেমন আনন্দ আনন্দ লাগছিলো সব কিছুতেই। বিশেষ করে অপুর্বর ফোন করার সংবাদটি পেয়ে। উদাসী বাউল প্রান যেন পেখম মেলেছে। পেটের অসারতা কেটে যেন ক্ষুদার তাড়নাটা বেড়েছে। তাই খেয়েছেও অনেক। শরীরের দূর্বলতাটাও যেন কেটে যায়।

 

খাওয়ার পরেও অনেকক্ষন গল্প চলে।

এক সময় চলে যাওয়ার সময় এসেছে। বার বার ইচ্ছে থাকা সত্বেও সুতপা আর বলতে পারলো না জাকির ভাইকে ফোন নাম্বরটি দেওয়ার জন্য। তবে বিদায় নেওয়ার সময় জাকির ভাই সুতপাকে বলে যায়-

-তুমি কোন চিন্তা করো না। আমার বিশ্বাস একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে। আমি ফোনটা নিয়ে অপুর্বকে ফোন করবো

-আমি কি আপনার অফিসে আসবো? ফোনটা পাইলে আমিও একটা ফোন লাগাইতাম। জিজ্ঞেস করতাম এতো নিষ্ঠুর হইলো কেমনে? বন্ধুত্ব কি এতোই ঠুনকো-সেলিমের চোখে মুখে বিরক্তের ভাব।

-থাক, এতো রাগ কইরেন না। আপনি অফিসে আসেন। সুতপা তুমিও আসো। পারলে তুমিও একটা ফোন কইরো। আমার মনে হয় এইটা উচিৎ হবে-জাকির ভাই এবার সুতপার দিকে তাকায়। সুতপা চুপ করে থাকে। কিছু বলছে না।

-চুপ করে আছো কেন? এখনতো পরীক্ষা শেষ। অনেক সময় হাতে। এদিকে একটু আসলে তোমারও ভালো লাগবে।আর আগামী

উইকেন্ডে না হয় আমার বাসায় আসো। আমার এখানে দুপুরে খাওয়া দাওয়া করে সিনেমা দেখতে যাবো। একটা নতুন হিন্দি ছবি আইছে শুনলাম। আমাদের পাশের সিনেমা হল জেনিতে। -এই বলেই জাকির ভাই সেলিমের দিকে তাকায়-কি বলেন সেলিম, ফ্রি থাকলে সুতপাকে নিয়ে চলে আসেন।

-আমিতো সব সময়ই ফ্রি। আমার কোন অসুবিধা নাই। আগামী শনিবরে আমরা আইয়াম। ভালোই অইবো।-সেলিমকে উচ্ছ্বাসিত মনে হলো।

-ঠিক আছে জাকির ভাই, আসবো। আর সোমবারে সেলিম ভাইকে নিয়ে আপনার অফিসেও আসবো-এবার সুতপা মুখ খুললো।

-ঠিক আছে। তাহলে সোমবারে অফিসে দেখা হবে, চলো সেলিম, এখন আমার বেরুতে হবে। যেতে ঘন্টা খানেক লাগবে

-চলেন-এই বলে ওরা দুজনে বিদায় নিলো।

দরোজায় দাঁড়িয়ে সুতপা গলা বাড়িয়ে হাঁক ছাড়লো-আবার আসবেন কিন্তু জাকির ভাই।

হাঁটতে হাঁটতে পেছনে ঘাড় ফিরিয়ে উত্তর দেয়-আসবো।

 

পরের দিন বেশ দেরী করেই ঘুম থেকে উঠে সুতপা। রবিবারটা বেশ অলসতার দিন। বিশেষ করে সামার ভেকেশনে। সোমবারে

ইউনিভার্সিটিতে যাওয়ার কোন তাড়া থাকে না। পুরো জুলাই অগাষ্ট মাস বন্ধ। সেপ্টেম্বরে আবার সেমিস্টার শুরু।

 

এখন দিনগুলি খুব বদলাত শুরু করেছে।

জুনের শেষ দিকটায় চারিদিক কেমন ফক-ফকা লাগে। আকাশ সব সময় পরিস্কার থাকে। মেঘেরাও যেন তখন ছুটি কাটায়। সব সময় নীলাকাশ।

সুতপার কাছে কখনো কখনো জুন মাসটিকে মস্কোতে বছরের সবচেয়ে রোমান্টিক সময় বলে মনে হয়। চরিদিকে নানা রংয়ের প্রস্ফুটিত ফুল, উষ্ণ সোনালী রোদের ঝিলিক আর মৃদু-মদীরা বাতাস সব কিছুতেই কেমন জানি মন মাতানো সুখ সুখ ভাব। সপ্তাহান্তে ছুটির দিনের সন্ধ্যা যেন রোমান্টিক হয়ে উঠে।এই সময় নদীর ধারে শান্তভবে কারো সাথে হাঁটতে হাঁটতে একথা সে কথায় ডুবে থাকতে খুব ভালো লাগে।

কতো বার এমন ছুটির দিনের সন্ধ্যা কাটিয়েছে অপুর্বর সাথে। হেঁটে বেড়িয়েছে মস্কো নদীর তীর ঘেঁসে। কতোনা ভালো লাগতো অবিস্মরণীয় মস্কোর স্কাইলাইনের দৃশ্য দেখায়।

 

আজ সুতপা ঘুরতে বেরুবে। মনটা বেশ ফুর ফুরে। অথচ গত এক বছরে এমনটি কখনো হয়নি। পুরো পৃথিবীটাই যেন কেমন বদলে যায় সুতপার সামনে। অসারতার বিশাল এক পাথর চাপায় যেন আর্তনাদে মরে গিয়েছিলো সুতপার প্রানটা। আজ এতোদিন পর গত রাত থেকে এই বদলে যাওয়া পৃথিবীটাকেই কেমন আপন আপন মনে হচ্ছে। সব কিছুতেই কেমন একটা সুখকর ভাব।

 

ঘুম থেকে উঠেই সোজা প্লানেরনায়ায় চলে আসে।

অনেক দিন ঠিক ভাবে কেনা কাটা হয়নি। তাই আজ কিছু কেনাকাটা করবে। দুপুরে রান্না করবে। তবে আজ সেলিম ভাই আর বেয়াইকে বলবে। এক সাথেই দুপুরে খাবে। তাই যাওয়ার পথে সেলিম ভাইকে দুপুরের খাওয়ার কথা বলে যায়।

সুতপাকে উৎফুল্ল দেখে সেলিমের খুব ভালো লাগে। অনেক দিন পর সুতপাকে এতো খুশী লাগছে-

-বেয়াইন, আমি আপনার লগে আইতামনি? -কম্বলের নীচ থেকে মাথাটা কচ্ছপের মতো বেড় করে বেয়াই জিজ্ঞেস করে

-বেয়াই আপনি এখনো ঘুমাচ্ছেন-সুতপা বলে

-কিতা কর্তাম বেয়াইন। আজ খুব অলস লাগতাছে। কি ব্যাপার? আপনি আজ ঘটা কইরা বাজারে যাইতাছেন কা? বেয়াইর কোন খবর পাইছেন নাকি? সেলিম ভাই বললো জাকির ভাই নাকি আইছিলো? অপুর্ব নাকি ফোন করছিলো-এই জন্যই আপনার মনটা আজ ভালা বুঝি?

-না বেয়াই। কতোদিন ঠিক ঠাক মতো বাজার করি নাই। তাই ভাবলাম একটু বাজারে যাই-সুতপার উত্তর

-আইতমনি আপনার সাথে

-না না আসতে হবে না। বেশী দুর যাবো না। কাছ থেকেই কিছু শব্জী আর কয়েকটা চিকেন আনবো। বাসে করেই চলে যাবো।

-ঠিক আছে, রান্না করার সময় ডাইকো। এক লগেই রান্না করবো।-সেলিম সুতপাকে বলে

-ঠিক আছে-এই বলেই সুতপা বেড়িয়ে যায়।

 

রাস্তায় আসতেই বাসটা পেয়ে যায়। মাত্র দুইটা স্টপিজ। এমন সুন্দর দিনে হেঁটেই যাওয়া যেতো। চারিদিকটা কি শান্ত। রাস্তায় কোন মানুষজন নাই। রাস্তা দিয়ে গাড়ী গুলো সাঁ সাঁ গতিতে চলে যাচ্ছে। মৃদু বাতাসে রাস্তার দুধারের গাছের পাতাগুলো তির তির করে নাচছে। সাদা পাখিগুলো মাথার উপর দিয়ে শব্দ করে পত পত করে উড়ে যাচ্ছে। রোদ্রটা বেশ নরম। চোখে মুখে বেশ আরাম লাগছে নরম রোদের আলোয়।

বাসটা থামতেই বাসে চেপে বসলো। মেশিনে পাঞ্জ করে টিকেটটা কেটে নিয়ে একটা খালি সীটে গিয়ে বসলো।

বাসে তেমন লোকজন ছিলো না। জানালার পাশের সীটটায় বসে বাইরে তাকিয়ে দেখছিলো। পাশের দালান আর সাড়ি সাড়ি গাছগুলোকে পিছনে ফেলে বাসটি এগিয়ে চলছে।

কেন জানি সুতপার এখন খুব ভালো লাগছে। কোথায় জানি মনটা হরিয়ে গেছে।হঠাৎ করেই একটা ঝাঁকুনি দিয়ে বাসটা খ্যাচ করে থামলো। সুতপা এখানেই নামবে।

প্লানেরনায়ার খোলা বাজার। খুব অল্পদাম মোটামুটি সবকিছুই পাওয়া যায়। শব্জী থেকে শুরুকরে মাছ-মাংস। বাজারের এক দিকটায় তরি তরকরি আর মাছ-মাংস বিক্রি হয়। অন্য পাশে সারি সারি কাপড়ের দোকানগুলি। ছড়িয়ে ছিটিয়ে বেশ কয়েকটি টং এর মতো ছোট ছোট খাবারের দোকান রয়েছে। বাজারের পাশেই বাস স্টেশন। একটু হেঁটে গেলে প্লানেরনায়া মেট্রো ষ্টেশন।

 

আজ বাজার যেন বেশ জমেছে। অসংখ্য মানুষেরা ভীর।

ঘুরে ঘুরে সুতপা বাজার করতে থাকে। সব কেনাকাটি করে হোস্টেলে ফিরতে প্রায় ঘন্টা খানেক লাগে।

 

 

বেশ হৈ চৈ করেই সবাই মিলে এক সাথে রান্নার কাজটা শেষ করলো।

তবে সব কিছুর দায়িত্ব বেয়াই আর সেলিমই নেয়। আজ সুতপার ছুটি।

অনেক দিন পর ওরা তিনজন একত্রে রান্না ঘরে জড়ো হয়েছে। সুতপার মনটা ভালো বলে অন্যদেরও ভালো লাগছিলো। সবার মধ্যে কেমন একটা প্রান খোলা ভাব। আনন্দ আর উচ্ছ্বাসে সবাই টগবগ। যেন খই ফোটার মতো।

মাঝে মাঝে সুতপা খুনসুটি করছিলো। ওদের আনন্দে যেন বাইরে সব পাখিদল উল্লাসে সামিল হয়েছে। ছন্দের তালে কিচির মিচির করে কোথায় উড়াল দিচ্ছে পাখিরাও জানেনা।

সোভিয়েত সমাজের এই আরেকটি ভালো দিক। নিসর্গ সৌন্দর্য আর মানুষের মধ্যে অমলীন ভালোবাসা আর নিবিড় বন্ধুত্বের বন্ধনে বাঁধার কি এক অপুর্ব সামাজিক ও নান্দনিক দর্শন। এইতো ভালোবাসা যা বিশ্বাস আর অমীয় চেতনার জঠরে বেড়ে উঠা অন্যের প্রতি শ্রদ্ধা ও বুঝার ক্ষমতা। যেখানে ধর্ম-বর্ন-গোত্র আর সামাজিক পরিচয়ের কোন মূল্য নেই, মানবতা আর মানবিক গুনই যেখানে মূখ্য।

 কি সুন্দর সম্পর্ক ওদের মধ্যে। যেন একই বৃন্তে তিনটি কুড়ি।

খেতে খেতে তিনজন অনেক গল্প করলো। অতীতের বুকে হামাগুড়ি দিয়ে অনেক কিছু তুলে এনেছিলো। সোভিয়েত ইউনিয়ন, গর্ভাচেভ, পেরেস্ত্রইকা, গ্লাসনস্থ, সোভিয়েতের ভাঙ্গন, রাশিয়ার অর্থনৈতিক মন্দা, ব্যাবসা, অপুর্ব ইত্যাদি।

অপুর্বর কথা আসতেই সুতপা কেমন চুপ করে যায়। চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ায়। ধীরে ধীরে জানালার পাশে এসে দাঁড়ায়। জানালার এক পাশের গরাদে হাত রেখে সোজা তাকিয়ে আছে দূর আকাশের দিকে। সুতপার বনলতা কেশী ঢেউ খেলানো লম্বা চুলগুলি কোমড় পর্যন্ত খোলা। চুলের মুঠিটা খুলে দিলে হয়তো পা পর্যন্ত আসতো। বড়ো একটা লাল টিপ দেয়া দুই ভ্রুর মাঝখানে। চিকন এক রোদের রেশ ঐখানে পড়ে ছিটকে পড়ছে ড্রেসিং টেবলের গ্লাসটায়।

 

কি অপলক দৃষ্টি সুতপার। হঠাৎ হাতটা দিয়ে বাম পেটে চেপে ধরলো সুতপা। মুখ থেকে বেড়িয়ে আসলো

-বেয়াই-----

সেলিম আর বেয়াই তখলো নন স্টপ কথা বলে যাচ্ছিলো। বেয়াই ডাক শুনে জানলার দিকে তাকাতেই বিস্ময়ে হতবাক দুজনে।

 

(চলবে---)



Read full book here: Click here to download the PDF file