মস্কোর বরফবিথী ও একজন সুতপা পর্ব-২৪


Author: ড. পল্টু দত্ত

পর্ব-২৪

Summary:

জীবন অজেয় কখনও থেমে থাকে না।

সব দুঃখ-কষ্ট, বাধা-বিপত্তি আর দুঃসময়ের দুর্গম-গিরি অতিক্রম করে এগিয়ে চলে সামনের দিকে। তাকে বহন করেই চলে সংকুল পথ। জীবনে চলার পথে বাঁধা আসবে। সংকুল পথ ধরেই জীবনের নিরন্তর সংগ্রামের পথে ছুটে চলে জীবনের ভেলা।

 

জীবনের ফেনিল তরঙ্গায়িত পথে এগিয়ে চলে সময়ের বাঁক- কখনও বাঁক বদলায়, কখনও পাড়ি দিতে হতে হয় বিক্ষত এভাবেই অপরাজেয় এগিয়ে চলে সামনের দিকে।

দিন যায়, রাত যায় তারমাঝেই সমুদ্র যাত্রার পথে এগিয়ে চলে জীবন নামের এই দোলায়িত যাত্রা পথ। তবু ফিওে যাবার কোন সমীকরন এখানে কাজ করে না। সেভাবেই এগিয়ে চলে অপুর্ব। নতুন সত্যকে কষ্ট হলেও ধীরে ধীরে সে সব বাস্তবতাকে নিয়ে জীবনের সব সংকট পাড়ি দিয়ে পথ চলতে মানিয়ে নিয়েছে জীবনের হার-জিতের চিরায়ত নিয়মকে।

 

কিভাবে যে দশটি মাস চলে গেছে তা সে ভাবতেও পারে না । তবুও জীবন যুদ্ধের কঠিন বাস্তবতার মাঝে অপুর্ব কিভাবে চলে এসেছে এত পথ তা নিজেও জানে না।

মস্কোর জীবন ছেড়ে লন্ডনে এসে তার নতুন অভিজ্ঞতা অর্জন হলেও সব কিছু কি ভুলে থাকা যায়? কুমিল্লার ছায়া-ঢাকা পাখি ডাকা গ্রাম,আল ভাঙা পথ ছেড়ে রাজধানী শহর ঢাকা তারপরে সোভিয়েত দেশ। একদম আলাদা প্রকৃতি-সেখানে পড়াশুনার মধ্যেই  সুতপার সঙ্গে পরিচয়। স্বপ্নের আলপথ পেরিয়ে চলতে চলতে একদিন তাও ভেঙে যায়। তারপর লন্ডন যাত্রা। সেখানে বাংলাদেশীদের প্রানকেন্দ্র ব্রিক লেইনে তার জায়গা করতে হয়।

 

ব্রিক লেইন বাংলাদেশীদের কাছে খুব পরিচিত। বাংলা টাউন নামেই যাকে চেনে। লন্ডনের এই জায়গাটি বহু প্রজন্ম ধরে বাঙালিদের কাছে জনপ্রিয় গন্তব্যস্থল। এই এলাকা এবং তার আশেপাশে যুক্তরাজ্যের বৃহত্তম বাংলাদেশী সম্প্রদায়ের আবাসস্থল। এটা অভিবাসীদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ গন্তব্য হিসাবে পরিনত হয়েছে।

 

বাংলাদেশীদের এ এলাকায় বসতি স্থাপনের ইতিহাস ১৯৫০ এর দশক থেকে শুরু হয়েছিল। যখন দেশভাগের পরে পূর্ব বাংলার অনেক মানুষ পাড়ি দিয়েছিলো ভারতে পরে বিলেত খ্যাত যুক্তরাজ্যের লন্ডন শহরে। কারন- অকারনের ভেতর দিয়ে এই এলাকাটি লন্ডনের সবচেয়ে প্রাণবন্ত এবং বৈচিত্র্যময় এলাকা হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠেছিলো।

মস্কো থেকে স্টুডেন্টসরা যখন সামার ভ্যাকেসনে লন্ডনে আসতো, তখন বাংলাদেশীদের বসবাস এই ব্রিক লেইনে আসতো স্বচক্ষে প্রবাসে বাংলাদেশের জীবনাচারকে এক নজর দেখার জন্য।

অপুর্ব এক নজর দেখতে নয়, জীবন সংগ্রামেই পাড়ি দিয়েছিলো মস্কো থেকে লন্ডনে। অপুর্ব জেনে এসেছিলো ব্রিকলেইনের প্রিন্সলেট স্ট্রিটের জব সেন্টারের কথা।

লন্ডনে চলে আসার পর অপুর্ব নটিংহিল গেইট আন্ডরগ্রাউন্ডের খুব কাছেই চব্বিশ প্রেমব্রিজ গার্ডেনে অবস্থিত বাংলাদেশ সেন্টারেই প্রথম রাত্রটা কাটায়। পরদিন সকালেই চলে আসে জব সেন্টারে। সেদিন বিকালেই এসেক্সের এক বাংলাদেশী রেস্টুরেন্টে কাজ পেয়ে যায় ওয়েটার হিসেবে। কাজটা পেয়ে অপুর্ব খুশীতে আত্মহারা। পকেটের অবস্থা তেমন ভালো নয়। দুই এক দিন দেরী হলে বিপদ হবে। শুধুমাত্র রাত কাটাতে বাংলাদেশ সেন্টারে বিশ পাউন্ড গুনতে হবে। তার পর খাওয়া দাওয়া।

 

বিশটা পাউন্ড জব সেন্টারকে দিয়ে রেস্টুরেন্টের সব ডিটেল্স নিয়ে সেদিন বিকালে অপুর্ব রওনা দেয় রেস্টুরেন্টের উদ্দেশ্যে। লিভারপুল স্টেশন থেকে ট্রেন ধরতে হবে। রেলী ট্রেন স্টেশনে নামতে হবে। তার পর বাসে সাউথ বেনফ্লিট।

সব কিছুই তাকে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন জব সেন্টারের ছানু মামা। সবাই উনাকে মামা বলে ডাকে। কেন ডাকে অপুর্বর তা জানা নেই। তবে সবার মতো সেও ডাকে।

-আউগ্যা, কোন চিন্তা কইরুন না। সমস্যা অইলে ফোন দিয়োন যেন-ছানু মামা অপুর্বকে বলে।

-ঠিক আছে মামা-এই বলে অপুর্ব বিদায় নেয়।

 

সেখানেই প্রথম ছয়টা মাস কাজ করে চলে আসে লন্ডনে। খুব কষ্টের কাজ। কারাগারের মতো জীবন।

তারপর থেকে লন্ডনেই কাজ করছে সেইলস পারসন হিসেবে একটা বহুজাতিক কোম্পানিতে। নয়টা-পাঁচটার চাকুরী। ধীরে ধীরে আর্থিক সাচ্ছন্দ্য এলো। আয় বাড়লো। একটা ফ্লাট ভাড়া নিয়ে থাকার সক্ষমতা এলো। কাজ থেকে এসে রান্না-বান্না করা, এদিক-সেদিক ঘোরাফেরা করা, এই ভাবেই কেটে যাচ্ছে দিন।

এই কাজটি নেওয়ার পর একদিন অপুর্ব লন্ডনে জাকির ভাইকে ফোন করে। ইচ্ছে ছিলো পত্রিকা অফিসে না যাওয়ার কারনটা বলবে এবং সাথে ক্ষমাও চেয়ে নিবে। কিন্তু জাকির ভাইকে পেলো না। জিয়া ভাইয়ের সাথে কথা হলো অনেকক্ষন।

 

অপুর্ব এখন লন্ডনে। জাকির ভাইয়ের কাছ থেকে একথা শুনেছেন জিয়াভাই। সেকথা জিয়া ভাই অপুর্বকে জানালো-তারপর বলতে লাগলো-

-যদিও -জাকির ভাই অনেক পরে শুনেছে আপনার লন্ডন যাওয়ার কথা। তবে আমার সঙ্গে কয়েকবার সেলিম ভাইয়ের দেখা হয়েছিলো। উনার কাছে শুনেছি সুতপার শরীর প্রায় সময়ই খারাপ থাকে। জাকির ভাই আপনার লন্ডনের টেলিফোন পাওয়ার জন্য অনেকের সাথে যোগাযোগ করেছে। কিন্তু কেউ আপনার কোন খবর দিতে পারলোনা। আপনার নাম্বরটা একটু দিন। জাকির ভাইকে দেবো।

 

অপুর্ব অফিসের নাম্বারটা দিলো। বললো-

-অফিসে যেই ধরুক না কেন বলবেন অপুর্বকে দিতে-এই বলে ফোনটা রেখে দেয়।

 

একদিন সন্ধ্যায় অপুর্ব ব্রিক লেইনে আসে সব্জি কিনতে। এখানেই রাস্তায় হাঁটতে গিয়ে পরিচয় হয় আরিফ ভাইয়ের সাথে। রাস্তার দুপাশের বাংলাদেশী নানা রকমের দোকান আর দোকান থেকে ভেসে আসা বাংলা-হিন্দি গান শুনতে শুনতে অন্যমনস্ক হয়ে অপুর্ব হাঁটছিলো। হঠাৎ করেই শুনতে পেল কে যেন বাংলায় কিছু বললো-

-আপনি কি বাঙালী ভাই?

অপুর্ব দাঁড়িয়ে যায়। সামনেই দাঁড়িয়ে আছে বেশ সুন্দর ত্রিশোর্ধ মাথা ভর্তি ঘন কালো চুল আর হাতে একটা ব্যাগ নিয়ে এক ভদ্রলোক। শরীর আর অবয়ব দেখে মনে হলো ভদ্রলোক বাঙালি। লোকটার পেটটা বেশ ভাসা ভাসা। মনে হচ্ছে শার্টের বোতামটা জোড়ে নিঃশ্বাস নিলে ঠাস করে খুলে যাবে। দাঁত বেড় করে বোকার মতো ভদ্র হাসিতে অপুর্বর দিকে তাকিয়ে আছে।

-হ্যাঁ, আমি বাঙালী-অপুর্ব উত্তর দেয়

-বাংলাদেশের না পশ্চিমবঙ্গের বাঙালী?

-বাংলাদেশের

-আমার নাম আরিফ, ব্রিক লেইনেই থাকি। প্রায় দশ বছর হয়ে গেলো। আপনার নাম?

-অপুর্ব?

-কোথায় থাকেন?

-হোয়াইটচ্যাপেল। তবে বেশী দিন হয়নি। আগে এসেক্সে ছিলাম

-কি করতেন সেখানে

-রেস্টুরেন্টে কাজ।

-এর আগে কোথায় ছিলেন?-ভদ্রলোকটির কৌতুহল দেখে অপুর্ব অবাক হয়

-মস্কোতে। সেখানে পড়াশুনা করতাম

-আরে, বলেন কি? আপনি মস্কোতে ছিলেন?-উচ্ছ্বসিত কন্ঠে বলেন আরিফ নামের ভদ্রলোকটি

-আপনি মনে হয় একটু অবাক হলেন?-অপুর্ব জিজ্ঞেস করে

-আরে, একটু না, অনেক - অপুর্বদা। আমি অনেককে চিনি-জানি যারা মস্কোতে পড়াশুনা করে। লন্ডনে অনেকে আসে রেস্টুরেন্টে কাজ করতে। মাস দুয়েক কাজ করে আবার চলে যায়।

-তাই নাকি?

-হ্যাঁ, আর সবচেয়ে মজার ব্যাপার কি জানেন? সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে আমার একটা আত্মার সম্পর্ক। আমার বাবা সারাজীবন ছিলেন বাম রাজনীতির সাথে যুক্ত। বাংলাদেশে যখন ইউনিভার্সিটিতে পড়তাম আমি বাম ছাত্র রাজনীতিতে ছিলাম। তাই মস্কোর কথা শুনলেই আমার খুব ভালো লাগে। বুকটা প্রশমিত হয়ে উঠে

-খুব খুশী হলাম আরিফ ভাই। ভালোই হলো আপনার সাথে পরিচয় হয়ে।

-আমারও ভালো লেগেছে। কোথায় যাচ্ছেন এখন?-আরিফ ভাই জানতে চায়

-একটু বাজার করবো

-চলুন। বাজার করে এখন আপনি আমার সাথে আমার ফ্লাটে যাবেন। সেখানেই খাবেন। এই দেখেন ইলিশ মাছ কিনে আনছি। এক সাথে রান্না করবো। মস্কোর গল্প শুনবো।

 

কেন জানি অপুর্ব না করতে পারলোনা। এ নতুন পরিচিত লোকটির সাথে তার ফ্লাটে যায়। যাওয়ার পথে পাশের দোকান থেকে

বাজারটা করে নেয়।

আরিফ ভাইকে পেয়ে অপুর্বকে বেশ সতেজ তাজা ফুলের মতো লাগছিলো। মনের সমস্ত ভাবনাগুলি মৃদুমন্দ বাতাসে সপ্ত ডানা মেলে মুক্ত বিহঙ্গের মতো এদিক সেদিক বিক্ষিপ্তভাবে ছুটাছুটি করছিলো।

রাত্র ৮টার মধ্যেই ইলিশ মাছ দিয়ে দিব্যি পেট ভরে খাওয়া দাওয়া শেষ হলো। তারপর চললো আড্ডা। অনেক গল্প বললেন আরিফ ভাই। জীবনের গল্প। ভালোবাসার গল্প। একসময় সাহিত্য চর্চা করতেন। বিবিসি বাংলা চ্যানেলে মাঝে মধ্যে প্রোগ্রাম করেন। বিবিসির জন্য বাংলাদেশী গানের উপর একটা ডকুমেন্টারি ফিল্মে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন। অপুর্বকে পেয়ে নিজের জীবন কাহিনী থেকে শুরু করে প্রেম কাহিনী, বিয়ের কাহিনী কোনটিই বাদ দেননি। মাঝে মধ্যে শ্যাম্পেইনে চুমুক দিয়ে সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে কুন্ডুলি পাকিয়ে ধোঁয়া ছাড়ছিলেন। কথা বলতে বলতে একটু অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছিলেন।

 

গল্প করতে করতে কখন যে রাত ১০টা বেজে গেল অপুর্ব টেরও পায়নি। অপুর্ব উঠে দাঁড়ালো যাওয়ার জন্য। আরিফ ভাই হঠাৎ ভেজা ভেজা কন্ঠে বলে উঠলো-

-অপুর্বদা, আরো একটু বসেন। আপনার কথাতো কিছুই শুনলামনা। এবার একটু আপনার কথা শুনি

-আমার কথা? সবতো বলাই হলো। নতুন করে আর কি বলবো।-অপুর্ব বিস্ময়ে তাকায়

-আরে অতীতের কথা না। এখন একটু ভবিষ্যতকে নিয়ে ভাবি

অপুর্ব একটু অবাক হয়-ভবিষ্যতকে নিয়ে?

-ঠিক ধরেছেন। ভবিষ্যতকে নিয়ে। আপনার সামনের দিনগুলি নিয়ে। এখন যেহেতু আপনার সাথে আমার পরিচয় হয়েছে একজন বন্ধু হিসেবে আপনাকে নিয়ে আমাকেও ভাবতে হবে। ঠিক বলেছি কিনা।

-তা ঠিক। কিন্তু আমিতো কিছুই বুঝতে পারছিনা। কি বলতে চাচ্ছেন?

-তা হলে তো আপনাকে বসতে হয়

-তা না হয় বসলাম। কিন্তু আমাকেতো আবার যেতে হবে। রাততো অনেক হলো।

-আরে বসেন মশাই। কালতো শনিবার। অফিসের ঝামেলাতো নেই। না হয় আজ রাতটা এখানেই কাটাবেন। ছেলেদের আবার রাত কি?

অপুর্ব কি যেন ভাবলো। তারপর আবার চেয়ারটা টেনে বসে পড়লো।

-বলেন আরিফ ভাই-অপুর্ব অতি আগ্রহে আরিফ ভাইয়ের দিকে তাকায়

-তার আগে একটু গ্লাসে ঢালি? একটা সিগারেট দেন।

অপুর্ব সায় দিয়ে সিগারেট প্যাকেটটা এগিয়ে দিয়ে নিজে গ্লাসে শ্যাম্পইন ঢাললো। নিজেও একটা সিগারেট ধরালো। এর মধ্যে

আরিফ ভাই সিগারট ধরিয়ে লম্বা করে একটি টান দিয়ে বেশ কায়দা করে নাক দিয়ে ধোঁয়াটি বেড় করে গ্লাসটা হাতে নেয়। অপুর্বর দিকে তাকিয়ে আস্তে করে বলে উঠলো-

-আপনার জন্য একটা বিয়ের ব্যাবস্থা করবো। আমার অনেক জানাশুনা হিন্দু ফ্যামিলী আছে। অনেকেই আমাকে বলে রেখেছে ভালো ছেলে পেলে খবর দিতে-কি বলেন?

-আমার বিয়ে? কি বলেন? তা কেমন করে হয়।-বিস্ময়ে তাকায় অপুর্ব

-আপনি আমার উপর ছেড়ে দেন। তিন মাসের মধ্যেই আপনার বিয়ের ব্যবস্থা করছি। আর বিয়ে করলেই আপনার এ দেশে থাকার আর কোন চিন্তা নেই।

অপুর্বর মনটা হঠাৎ করেই ধক করে উঠলো। কিছুক্ষনের জন্য যেন অতীতে চলে গেলো। আবছা আবছা সুতপার মুখটি চোখের

সামনে ভেসে উঠলো। মনে মনে কি যেন বির বির করতে লাগলো।

-কেমন আছো তুমি? ভালো? নাকি ডন-ভলগার বলাকা শুভ্র উর্মিমালার মতো দেশীয় প্রানচাঞ্চল্যের বল্গাহীন সময়ের বুকে নিজকে এলিয়ে দিয়েছ? তোমার সুন্দর উচ্ছ্বাসময় জীবনের ফাঁকফোকরে কখনো কি আমাকে মনে পড়ে? আমিতো তোমার হৃদয়টাকেই ছুঁতে চেয়েছিলাম, শরীরটা নয়। তাইতো আমার ভালোবাসায় কোন খাঁদ ছিলোনা । অথচ---

 

হঠাৎ ভাবনায় ছেদ পড়ে। বড্ডো অভিমানী হয়ে উঠে। মনের গহীনে দ্রোহের উন্মাদনা টের পায়। যাকে ভালোবেসে প্রত্যাখ্যাত তাকে মনে না রাখাই ভালো।

-ঠিক আছে, আরিফ ভাই। আপনি দেখুন। এই যদি আমার এদেশে থাকার উত্তম সমাধান হয় তা হলে আমি রাজী। এক সময়তো বিয়ে করতে হবে-অপুর্ব কথাগুলো বলে যেন একটু হাল্কা বোধ করলো।

-এইতো হলো কাজের কথা। শিরদাঁড়াকে সোজা করার মতো উত্তম কথা। আপনি কোন চিন্তা করবেন না। আমার উপর সব ছেড়ে দিন। সব ব্যাবস্থা হয়ে যাবে।

অপুর্ব আর কিছুই বলেনি। আরো কিছুক্ষন গল্প করে এখানেই শুয়ে পড়ে।

পড়দিন সকালে একটু দেরী করেই দুজনে ঘুম থেকে উঠে। ছুটির দিন। তাই তেমন কোন তাড়া নেই।

 

বিলেতে আসার পর এই প্রথম এমন একটি চমৎকার সন্ধ্যা অপুর্ব কাটিয়েছে। একাকীত্বের কারগারের জীবনে কেমন জং ধরে গিয়েছিলো। একপেশে জীবনে কোন ছন্দ নেই, উৎচ্ছ্বলতা নেই, বন্ধু নেই, সামাজিকতা নেই, শুধু কাজ আর কাজ। সাথে অস্থির মনের অসহ্য দহন। হঠাৎ করেই যেন মেঘের ফাঁক দিয়ে সোনালী রোদের কিরন বিচ্ছুরিত হলো। অপুর্বর আকাশে উদিত হলো পূর্নিমার চাঁদ। অমাবস্যার গাঢ় অন্ধকার যেন কোন এক আলোকের ঝটকা এসে উড়িয়ে নিয়ে গেলো।

অপুর্ব এ কথাগুলো ভাবতে ভাবতে এক সময় নিজের ফ্লাটে এসে পৌঁছলো। আসার সময় আরিফভাইকে অপুর্বর ঠিকানাটা দিয়ে আসতে ভুলেনি।

-আমি কিন্তু মাঝে মাঝেই চলে আসবো। আর আপনিও আসবেন।-আরিফভাই অপুর্বকে অগ্রিম জানান দিয়ে দিলো।

 

তারপর থেকেই ঘন ঘন দেখা হতো দুইজনার। কখনো অপুর্ব আরিফভাইয়ের কাছে যেত, কখনো আরিফভাই অপুর্বর ফ্লাটে। আবার কখনো কোন এক পড়ন্ত বিকেলে পার্কে বসে জম্পেস আড্ডায় বুঁদ হয়ে থাকতো।

অপুর্র জীবনে এখন আনন্দের ঝরনা, আর উদ্যাম উচ্ছ্বাস। বেশ ভালোই কেটে যাচ্ছে দিনগুলি। তাই ধীরে ধীরে সুতপার স্মৃতিগুলো কখন যে শীতের হলুদ রংএর পাতাগুলোর মতো একে একে ঝড়ে গেল, বুঝতেও পারেনি। সময়ের সাথে সাথে সব বদলে যায়। দুঃখ-কষ্ট, বেদনা আনন্দ-উচ্ছাস সবই ক্ষনস্থায়ী। শুধু চলাটাই ধ্রুব।

 

অপুর্বও আজ এগিয়ে চলেছে এক নতুনের পথে। অপুর্বর আকাশে এখন ভীনদেশী বাতাসের আনাগোনা। তাই ভাবনায় এখন অন্যকিছু। বর্তমান আর ভবিষ্যতকে নিয়েই তার ভাবনারা এখন ব্যাতি-ব্যাস্ত। অতীত যেন সেখানে মৃত।

 

এমনি করেই কেটে গেলো বেশ কয়েকটি মাস।

একদিন সন্ধ্যায় অপুর্ব নিজের রুমে বসে চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে একটি পুরনো দিনের উত্তম-সুচিত্রার বাংলা ছবি ‘পথে হলো দেরী’ খুব মনোযোগ দিয়ে দেখছিলো। কিছুক্ষন আগেই অফিস থেকে এসেছে। আজ রান্না করার কোন তাড়া নেই। গতকাল রান্না করেছে। তাই নিজকে একটু হালকা লাগছে। তাছাড়া আগামীকাল অফিস নেই। শুক্রবার সন্ধ্যেটা ইদানীং অপুর্বর সবচেয়ে প্রিয়। পরদিন সকালে উঠার কোন তাড়া নেই, তাড়াতাড়ি ঘুমুতে যাওয়ারও কোন প্রয়োজন নেই। অনিয়ম করার জন্য কি চমৎকার সন্ধ্যা! আর মাঝে মাঝে অনিয়ম করায় কোন দোষ নেই। তাই শুক্রবার রাতেই অপুর্ব সব সময় পুরনো দিনের ছবি দেখতে খুব পছন্দ করে। অনেক রাত পর্যন্ত জেগে থাকে। কখনো কখনো পর পর দুইটা ছবি এক সাথে দেখে। সিগারেটের ধোঁয়ায় রুমটা অন্ধকার হয়ে যায়। মাঝে মাঝে উঠে জানালা-দরজা খুলে দেয়, সুগন্ধী স্প্রে করে সব খানে।

 

এই সন্ধ্যাটা পানীয় পান করার জন্য খুব উপযুক্ত। তাই হাতের কাছেই কাঁচের গ্লাসে এক সাথে দুই পেগ ভোদকার সাথে কোক মিশিয়ে রেখে দেয়। এক টুকরো লেমন আর ফ্রিজ থেকে তুলে বরফ ছুড়ে দিতেও ভুলে না।

তবে তার আগে এক কাপ চা পান করাটা যেন ইদানিং একটা অভ্যাসে দাঁড়িয়েছে। বেশ গভীর মনোযোগ ছবির ডায়ালগে। ছবির কোন সিরিয়স মুহূর্তে অপুর্ব কারো দ্বারা বিরক্ত হতে চায় না।

হঠাৎ কলিং বেলটা বেজে উঠলো। বেশ বিরক্ত হয়েই উঠে দড়জাটা খুলতে হলো। দড়জা খুলতেই আরিফভাইয়ের দাতঁ বের করা একটা অমলিন হাসি চোখের সামনে স্থিরহয়ে আছে। খিল খিল করে বলতে লাগলো-

-আপনার নীচের দড়জাটা খোলা ছিলো তাই ডোর ইনটারকমটায় রিং করতে হলো না। কেমন আছেন অপুর্বদা?

-ভালো, আসেন আরিফ ভাই। আপনি কেমন আছেন?

-আমার মতো ভালো আজকে আর কেউ নাই। এই দেখেন আস্ত তন্দুরি চিকেন নিয়ে এসেছি। গরম গরম। এক সাথে খাবো। আপনি শুধু

একটু গ্লাসের ব্যাবস্থা করেন।

-সব ব্যাবস্থা আছে, আপনি বসুন-বলে অপুর্ব কিচেনে যায়।

এর মধ্য আরিফ ভাই ভিতরে এসে বসেন। রিমোট দিয়ে টিভি আর ভিসিয়ারটা বন্ধ করে দেন। সামনের টেবিলে পড়ে থাকা প্যাকেটটা থেকে একটা সিগারেট বেড় করলেন। কিচেনের দিকে তাকিয়ে বলতে লাগলেন-

-অপুর্বদা, এখন প্লেট আনার প্রয়োজন নেই। আগে একটু পেটে জল পড়ুক তার পর মজা করে খাওয়া যাবে। আপনি শুধু বরফ দিয়ে গ্লাসটা নিয়ে আসুন তাড়াতাড়ি। খবরটা না শেয়ার করে আর পারছি না।

-কিসের এতো তাড়া আরিফভাই? কি খবর নিয়া আইছেন?-কিচেন থেকেই অপুর্ব একটু গলা হাঁকিয়ে বলে

অপুর্ব এবার এসে ওর বেডের উপর বসলো। ভোদকার গ্লাসটা এগিয়ে দিলো-বলেন, কি খবর নিয়ে আইছেন?

-বলবো? খুব জব্বর খবর

-কিন্তু খবরটা কি?

-রবিবার বিকেল চারটায় আপনাকে আমার সাথে যেতে হবে।

-যাবো, কিন্তু কোথায়?-অধির আগ্রহে অপুর্ব শুনার জন্য তাকিয়ে আছে

-মেয়ে দেখতে? গতকাল মেয়ের মায়ের সাথে সাক্ষাৎ হলো। অনেক আগেই আপনার ছবি সহ ডিটেলস দিয়ে রেখেছিলাম। মেয়ের বাবা নেই। এক বড় ভাই আর মা। বড় ভাই এবং মেয়ে আপনার ছবি দেখেছে। ওরা আপনাকে দেখতে চায়। রবিবার সবাই থাকবে। লিভারপুলে মেয়ের এক কাকা থাকেন। সে কাকাও আসবে।

এই বলে অপুর্বর দিকে মিট মিট তাকায় আর মুচকি হাসে-

-কি ভাবছেন, অপুর্বদা? বলিনি, আমি যখন আছি একটা হিল্লি হবেই। খুব শীঘ্র পিড়িতে পা দিবেন

অপুর্ব কথাগুলো শুনছিলো আর কি যেন গভীরভাবে ভাবছিলো। এতো তাড়াতাড়ি মেয়ে খুঁজে পেলো? হঠাৎ ভাবনায় ছেদ পড়লো।

-আরে মহাশয় বোবা হয়ে গেলেন নাকি? কিছু দেখবেন না?-এই বলেই পকেট থেকে একটা ছবি বেড় করে অপুর্বর চোখের সামনে রাখলো।

অনেকক্ষন ধরেই অপুর্ব ছবিটা দেখলো। শাড়ি পড়া একটা রঙিন ছবি। সোফায় বসে থাকা। চুলগুলো স্টাইল করে ঘার অব্দি কাটা। কপালে একটা চিকন টিপ। গায়ের রংটা বেশ ফর্সা। দেখতে রুচি সন্মত, মার্জিত বলেই মনে হয়। অপুর্বর পছন্দ সই।

 

হঠাৎ কেমন অন্যরকম। অপুর্বর চোখে তখন উচ্ছ্বাসের ফেনা বুদ বুদ করছে। স্বপ্নের প্রজাপতি পত পত করে উড়ে বেড়াচ্ছে। মনের আকাশে উদাসী বকেরা দিক বিদিক ঘুরে বেড়াচ্ছে। আহা কি আনন্দ! কতোদিন পর এ অনুভূতি। জানালা দিয়ে তাকিয়ে রইলো সুদুর আকাশের দিকে। চোখের সামনেই জানালার গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা গাছের পাতাগুলি রাতের বাতাসে তির তির করে দুলছে। আকাশের তারাগুলি কি সুন্দর তাকিয়ে আছে। পূর্ন চাঁদের আলোতে কি মাতমে মেতেছে ধরিত্রির মায়াবী রাত। চারিদিক থেকে যেন ভেসে আসছে কি অপূর্ব মন মাতানো ব্যাথা হরন এপোলোর সুরের মূর্ছনা। চমৎকার এই রাত। এ রাতের গভীরতায় অপূর্ব কান পেতে রইলো।

শীতের তুহিনে ভেজা শ্রাবস্তীর কোন এক রাতের বরফের কান্না আর শুনতে পেলো না। শুধুই বেজে উঠছে আশার আর উচ্ছ্বাসের, স্বপ্ন আর আনন্দের বীনা।

 

বিস্ময়ে হতবাক দুজনে।

(চলবে---)



Read full book here: Click here to download the PDF file