পর্ব-২৩
Summary:
গত দুদিন ধরে সুতপার পেটের ব্যাথাটা খুব বেড়েছিলো।
খাওয়া-দাওয়া ঠিকমতো হয়নি। এক অসারতা সারা মন জুড়ে। হঠাৎ করেই যেন পৃথিবীটাকে অচেনা অচেনা লাগছে। বিষন্নতা আর হতাশারা যেন এক অসহ্যকর দহনের চাদর বিছিয়ে দিয়েছে সারা শরীরে। কোন কিছুতেই মন বসছিলো না।
কিভাবে যে কয়েকটা মাস কেটে গেলো টেরও পায়নি। নিজকে নানা ব্যাস্ততার মধ্যে ডুবিয়ে রাখার চেষ্টা করেছিলো। অপুর্বকে ভুলতে চেয়েছিলো, কিন্তু পারেনি।
দুঃশ্চিন্তা আর ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া না করতে করতে সুতপার শরীর ভেঙ্গে পড়েছিলো। এর মধ্যেই দ্বিতীয় টার্মের সবগুলো পরীক্ষা শেষ করে। সেই জন্য রাত জেগে পড়াশুনাও করতে হয়েছে। সব কিছু মিলে সুতপার শরীর মন সবই বিপর্যস্ত। বেশ ধকল গিয়েছে গত কয়েকটা মাস।
কিন্তু যেদিন সুতপা জানতে পেরেছিলো যে অপুর্ব সত্যিই কোন দোষ করেনি এবং সেদিন জবা মেয়েটির সাথে সত্যিই ওর কোন সম্পর্ক নেই, সেদিন থেকে নিজের অপরাধ আর অমল বিশ্বাসে গড়া অমলীন ভালবাসাকে অপবাদ দিয়ে প্রত্যাখ্যান করায় ভীষন দহনে দগ্ধ হচ্ছে সুতপা।
সেইসব দিনগুলো-অপূর্বকে অস্বীকার করার সময়গুলো যেন কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে তাকে। আত্মশ্লাঘায় ভুগে কতবার সে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছে। জীবনের যে বসন্ত জীবনকে দোলায়িত করে তাকে অস্বীকার করার কষ্টও ভীষন, সুতপা সেটা যেন হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করছে।
সেদিন সুতপার বিষাদের কান্নার আওয়াজ অপুর্বর কানে এসে পৌঁছেনি। ঘুনাক্ষরেও সে জানতে পারলো না সুতপা সব জানতে পেরেছে, ও বুঝতে পেরেছে যে সে সত্যিই অপুর্বকে ভালোবাসে। যা হয়েছে তা ছিলো ভুল, না জানা আর জানতে না চাওয়ার ভুল।
সব কিছু কেমন গোলমেলে লাগছিলো সুতপার।
সে কোন কিছুর কিনারা করতে পারছিলো না। সেলিমের অনুরোধে সুতপা অপুর্বর রুমে যায় ।
অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে যাওয়ার আগের দিন।
অনেক দিন অপুর্ব তার রুমে আসেনি। দুজনের মধ্যেও অনেকদিন কোন যোগাযোগও নেই। সেলিম অনেকবার জানতে চেয়েছিলো সুতপার কাছ থেকে আসল ঘটনাটা। এমন কি হলো যে অপুর্বর সাথে সুতপার কোন দেখা-দেখি নেই। কিন্তু বার বারই সুতপা এড়িয়ে গেছে। কোন কিছু কখনোই প্রকাশ করেনি।
অপুর্বর কথা শুনলে সুতপা কেমন অন্যরকম হয়ে যেত। কিছুটা বিরক্তিকর। পুড়ে যাওয়া রুটির মতো মুখটা কালো হয়ে যেতো। তাই কখনো চাপ দেয় নি। ভেবেছিলো একদিন হয়তো সুতপা নিজেই বলবে।
অপুর্ব সব কিছুই রুমে রেখে গেছে। কোন কিছুই নিয়ে যায়নি। অপুর্বর একটা বড়ো স্যুটকেস ছিলো। প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিংবা টাকা পয়সা সেখানেই যত্ন করে রাখতো। সব সময় ছোট্ট একটা তালা দেওয়া থাকতো। একদিন হঠাৎ সেলিমের নজরে পড়লো যে স্যুটকেসটা খোলা। কোন তালা নেই। তাই সুতপাকে একটু স্যুটকেসটা দেখার জন্য অনুরোধ করে।
প্রথমে সুতপা একটু রেগে যায়। মনে হলো তুষের আগুনে যেন হঠাৎ দমকা হাওয়া লেগেছে।
-আমাকে ওর স্যুইটকেস দেখতে হবে কেন? আপনি ওর রুমে থাকেন। আপনি দেখতে পারেন না?
-আহা তুমি রাগ করছো কেন? আমিতো দেখতেই পারি। তবে তুমি দেখলে আমি একটু নিশ্চিন্ত হই। প্লিজ-
- কি মনে করে সুতপা আর রাগ করতে পারলো না-
-চলেন যাই। রুমে ঢুকে সেলিম ওয়ারড্রপের উপর থেকে স্যুইটকেসটা নামিয়ে ফ্লোরে রাখে। সুতপাকে দেখতে বলে চায়ের কেটলিতে জল ভরতে যায়।
-আমি চা বানিয়ে আনি। তুমি ভালো করে দেখে নাও।
সুতপা স্যুইটকেসটার কাছে এসে ফ্লোরে বসে পড়লো। বেশ ধুলো লেগে আছে স্যুইটকেসটিতে। বুঝা গেলো অনেকদিন খোলা হয়নি।
স্যুইটকেসটি এবার সুতপা খুললো। কেমন একটা পারফিউমের গন্ধ বেড়িয়ে আসলো। বেশ বড়ো সাইজের স্যুটকেসটি। তবে অর্ধেকটাই খালি। বেশ কিছু চিঠি এলোমেলো পড়ে আছে। কয়েকটি বই। কিছু জামা প্যান্ট আর বেশ কয়েকটি পারফিউমের বোতল। চার্লি, পয়জন, হুগো বস আর কয়েকটি বডি স্প্রে। কয়েকটি ফিতে দিয়ে বাঁধা ফাইল। একটা পলিথিন ব্যাগে কিছু রুবল এবং বাংলাদেশী টাকা। কয়েকটি এলবাম।
একটি এলবাম হাতে নিয়ে খুলে দেখলো। সবই অপুর্বর আর সুতপার ছবি। মস্কোতে প্রথমবার যখন এসেছিলো। প্রতিটি ছবির নীচে তারিখ সহ স্থানের নাম লেখা আছে। কি সুন্দর করে যত্ন করে থরে থরে সাঁজিয়েছে এলবামটি।
হঠাৎ নজড় কাড়লো একটি লাল বক্স। হাতে তুলে নিলো বক্সটি। আস্তে আস্তে খুললো। ভিতরে একটি ছোট্ট কার্ড আর একটা খুব সুন্দর নেকলেস। কার্ডে লেখা আছে--আমার গ্র্যাজুয়েশন ডে তে সুতপার জন্য।
চোখের কোন কেমন জাপসা হয়ে আসলো। চিন চিন করে একটা ব্যাথা অনুভব করলো বুকের বাম পাশে। নিজের অজান্তেই চিবুক বেয়ে চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়লো নেকলেসটার উপরে। বক্সটা বন্ধ করে রেখে দিলো। চিঠিগুলো এবার একসাথে জড়ো করলো। বেশ কিছু চিঠি সুতপার লেখা রুস্তভ থেকে। অপুর্বকে লেখা প্রতিটি চিঠি কি যত্ন করে স্যুইটেসে রেখে দিয়েছে। বেশ কিছু চিঠি মা আর অপুর্বর দাদার কাছ থেকে পাওয়া।
স্যুটকেসের এক পাশে একটি চোট্ট পলিথিনে আরো কিছু চিঠি চোখো পড়লো। ব্যাগটি থেকে চিঠিগুলো এবার বেড় করলো। জবা নামটা চোখে পড়তেই বুঝতে পারলো অপুর্বকে লেখা জবার চিঠি। তার মধ্যে একটি চিঠি খোলা আর বাকীগুলো বন্ধ। সে চিঠিগুলো এখনো পড়াই হয়নি। পোস্ট অফিসের সীলটা চোখের কাছে এনে তারিখগুলো দেখার চেষ্টা করলো। খোলা চিঠিটা প্রায় সাড়ে তিন বছর আগের। অর্থাৎ সুতপার সাথে পরিচয় হওয়ার অনেক আগে। বাকী চিঠিগুলো গত তিন বছরে বিভিন্ন সময়ে পোস্ট করা।
এবার সুতপা হঠাৎ গম্ভীর হয়ে গেলো। ভাবতে লাগলো। তার মানে অপুর্ব জবার সাথে আর কোন যোগাযোগ করেনি। এবার তাড়াতাড়ি খোলা খাম থেকে চিঠিটি বেড় করে আনলো। পড়তে শুরু করলো-
প্রিয় অপুর্ব
তুমি যে এতো বদলে যাবে আমি কখনো কল্পনাও করতে পারিনি। দেশে থাকতে তুমিই প্রথম আমাকে লিখেছিলে। আমার ঠিকানা পেয়েছিলে পত্রমিতালী ম্যাগাজিনে। আমিও তোমার লেখা পেয়ে নিজকে সামলাতে পারিনি। উঠতি বয়স তখন। সেলোয়ার কামিজ পড়ে হাইস্কুলে যাই। মনটা স্বপ্নের ঘোরে-বেঘোরে পাখা মেলতো। তোমাকে কখন যে ভালো লেগে যায়। কিন্তু এক বছর যেতে না যেতেই তুমি মস্কো চলে গেলে। আমি পাগলের মতো তোমাকে লিখতাম। কিন্তু তুমি খুব কম চিঠির উত্তর দিতে। অনেক দিন পর তোমার চিঠিটি পেয়ে খুব খুশী হয়েছিলাম। কিন্তু চিঠিটি খুলে তেমনি খুব কষ্ট পেয়েছিলাম। মাত্র কয়েকটি লাইন। তাও আবার যেন বিষ ঢেলে দিলে। তুমি লিখেছ, তুমি আমাকে কখনো ভালোবাসনি। শুধুই বন্ধুত্ব। আমাকে চিঠি লিখতে বারন করেছ। আমি সত্যি সত্যিই তোমার উপর খুব রাগ করেছি। আমিতো কোন দোষ করেনি। মস্কোতে গিয়ে একটা ছবি পর্যন্ত আমাকে পাঠালে না। তুমি না লিখলেও আমি কিন্তু তোমাকে লিখে যাবো।এতেই আমার আনন্দ।
যদি পারো আমাকে লিখবে।
ইতি তোমার হতভাগিনী
জবা
সুতপা চিঠিটা পড়েই উঠে দাঁড়ালো। চিঠিটা তখনো হাতে। শরীরটা কেমন কাঁপছে। বুকটা যেন ফেটে যাচ্ছে। নিঃশ্বাস ভারী হয়ে আসছে। পাশের চেয়ারটা টেনে বসে পড়লো। মাথাটা বেশ ভার ভার লাগলো। এমন সময় সেলিম দু`কাপ চা নিয়ে রুমে ঢুকলো।
-সেলিম ভাই, আপনিতো অপুর্বর খুব কাছের বন্ধু। দেশে এক সাথে পড়েছেন স্কুলে। সবসময় কাছাকাছি ছিলেন। কলেজে পড়তেও আপনাদের সম্পর্ক ছিলো অটুট। অপুর্ব কি আপনাকে জবা নামের কোন মেয়ের কথা বলেছে?
সুতপার কথা শুনে সেলিম যেন আকাশ থেকে পড়লো। হঠাৎ এই প্রসঙ্গ।
-কেন এই কথা বলছো?
-বলেন না প্লিজ-সুতপার তাড়া
-জানবো না কা। কলেজে থাকতেই পত্রমিতালী । কিন্তু মস্কো আসার পর তো ওর সাথে কোন যোগাযোগ নাই। প্রথম দিকে থাকলেও গত কয়েক বছর ধরেতো কোন সম্পর্কই নাই। আমিতো তাই জানি। কেন, কি হইছে?
- কিছু না বলে সুতপা চুপ থাকে। তার ভেতরে যেন ঝড় বইতে থাকে। সে কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বলতে থাকে-
- সেলিমভাই আমি সত্যিই বুঝিনি-এই বলে সুতপা ফুঁফিয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো।
-আরে তুমি কাইন্দনা। আমারে একটু খুইল্যা বড়ো কি হইছে-সেলিম সুতপাকে শান্ত করার চেষ্টা করে।
সুতপা কান্না জড়িত কন্ঠেই সেলিমকে সব কিছু খুলে বলে। সব শুনে সেলিম এবার একটু রেগে যায়-
-তোমাদের মান-অভিমানটা খুব বেশী। অন্ততঃ আমারেতো বলতে পারতে। তাহলেই আজ এতো কিছু হইতো না। আমার সাথে পর্যন্ত অপুর্বর দেখা হয়না কতোমাস। তোমাকে কতোবার বলছি ব্যাপারটা খুলে বলতে। এখন বুঝছো। তবে বড্ডো দেরী কইরা ফালাইসো।
-সেলিম ভাই, প্লিজ আমার সাথে চলেন। ওর ফ্লাটে যাবো। এখনি।
-এখনতো অনেক রাত হইছে। আমরা বরং কাল সকালে যাই। -সেলিম সুতপাকে বলে
-ঠিক আছে সেলিম ভাই, বরং কাল দুপুরের আগে যাই। সকালে আমি একটু রান্না করবো। ওর জন্য নিয়ে যাবো। আপনি ওর স্যুটকেসটা আগের জায়গায় রেখে দেন। এক সময় এসে আমার রুমে নিয়ে যাবো এই বলে সুতপা ওর রুমে ফিরে এলো।
হঠাৎ করেই যেন রাতের আকাশের তারারা সুতপার মনের আকাশে জ্বলতে লাগলো। বাইরে তখন সামারের পূর্নিমার আলো জাঁকিয়ে বসেছে। হালকা বাতাসের দোলা চারিদিকে। চাঁদের আলো এসে পড়ছে সুতপার রুমে। কি অপুর্ব এ রাত!
খুব সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে আজ সুতপা ৮টায় দোকানে গিয়ে কিছু কিনে নিয়ে আসবে। রান্না হবে একটা শব্জি, ল্যাম্ভ ভুনা আর ডাল। সাথে একটু পায়েস বানিয়ে নিয়ে যাবে। মনটা বেশ উৎফুল্ল। ১২টার মধ্যেই অপুর্বর ফ্লাটে যাবে। মনের ভেতর কি এক আনন্দ। বর্ষা শেষে ভোর বেলার সজী দূর্বা ঘসের মতো ফুরফুরে মেজাজ।
কিন্তু সব চাওয়া কি সব সময় পূর্ন হয়? সেটা যেন খুশীর উচ্ছ্বাসে বেমালুম ভূলেই গিয়েছিলো সুতপা।
দোকান থেকে একহাতে একটি ব্যাগ নিয়ে হেঁটে আসছিলো সুতপা। বেশী দূর নয় বলে বাসের জন্য আর অপেক্ষা করেনি। কিন্তু হাঁটতে গিয়ে হঠাৎ টের পেলো পেটের ব্যাথা। আস্তে আস্তে বাড়তে লাগলো। হাঁটার গতি বাড়িয়ে দেয়। এক হাতে পেট চেপে ধরে আছে। মাথাটা কেমন ঝিম ঝিম করতে লাগলো। এর মধ্যেই হোস্টেলে চলে আসে। কোন রকমে ভিতরে ঢুকে।
সামনেই রিসেপ্সনের মহিলাটি বসা ছিলো। কেমন ঝাপসা ঝাপসা লাগছিলো সুতপার। চোখে সব অন্ধকার লাগছিলো। তারপর আর কিছুই ঠাহর করতে পারেনি। আস্তে করে সিড়ির সামনেই হেলে পড়ে।
রিসেপ্সনের মহিলাটি দৌড়ে এসে সুতপাকে ধরে। এর ম্ধ্যেই সুতপা ফ্লোরে লুটিয়ে পড়ে। তাড়াতাড়ি কাউকে দিয়ে অপুর্বর রুমে খবর পাঠায়। সেলিম খবরটি শুনেই দৌড়ে নীচে নেমে আসে। এম্বুলেন্স কল করে। এক সময় এম্বুলেন্সে করে হাসপাতালে নিয়ে আসে।
যখন জ্ঞান ফেরে তখন সুতপা হাসপাতালের বেডে।
চার দিন পর হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে হোস্টেলে ফিরে আসে সুতপা। সেলিম সঙ্গে ছিলো। দীর্ঘদিন অনিয়ম আর দুঃশ্চিন্তা থেকে বলাড প্রসার খুব কমে যায়। দূর্বলতা বেড়ে যায়। নানা ধরনের পরীক্ষা নিরিক্ষা চলে হাসপাতালে। বিশ্রাম নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছে ডাক্তার। সাথে কিছু ঔষধ। তবে এখন একটু ভালো লাগছে। দুর্বলতাটা আর তেমন নাই। হাসপাতালে খাবারে বেশ নিয়ম ছিলো।
লিফ্ট ধরে সোজা ৮ তলায় চলে আসে।
সেলিম ও সুতপার সাথে সাথে আসে সুতপার রুমে। সুতপা ব্যাগ থেকে রুমের চাবিটি বেড় করে দরোজাটি খুলে।
সকালের শেষ প্রহর। বাইরে বেশ রৌদ্র। পরিস্কার আকাশ। দুপুরে নীচের বুফেতেই খেয়ে আসবে। বিকেলে রান্না করে সেলিমকে নিয়ে অপুর্বর কাছে যাবে এমনটাই ইচ্ছে। আর যেন দেরী সহ্য হচ্ছে না। অপুর্বকে দেখার এক তীব্র বাসনা সুতপার সারা মন জুড়ে।
দরোজা খুলতেই কেমন একটা ভ্যাপসা গন্ধ নাকে এসে লাগলো। মনে হলো কোন রুমেই কেউ নাই। সামার ভেকেশান। সবাই ছুটিতে আছে। জানলা-দরোজা না খোলাতেই ভ্যাপসা ভাবটা।
ভেতরে ঢুকতেই একটা খাম নজড়ে পড়লো। সুতপা এক হাতে খামটা তুলে নিল। খামের উপরে শুধু সুতপা নামটা রাশিয়ান ভাষায় লেখা ছিলো। লেখাটা সুতপার খুব চেনা। অপুর্ব লিখেছে। খামটা দেখেই যেন আনন্দের বিদ্যুৎ সারা শরীরে বয়ে গেলো। যেন সব অসুস্থতা শেষ হয়ে গেছে। মনটা লাফাতে লাগলো। তাড়াতাড়ি ভিতরের দড়জাটা খুলে নিজের রুমে ঢুকে।
-সেলিম ভাই, অপুর্বর চিঠি। আপনি একটু বসেন।
সেলিম ব্যাগগুলি পাশে রেখে গভীর আগ্রহে সুতপার দিকে তাকিয়ে আছে। টের পেলো সুতপার চোখে মুখে খুশীর ঝলকানি। বেশ উৎফুল্ল।
তাড়াতাড়ি খাম থেকে চিঠিটি বেড় করলো। দু`ভাঁজ করা। হাতটা কেমন আনন্দে কাঁপছে। ভাঁজ খুলে একটু চোখ বুলালো। ছোট্ট কয়েকটি লাইনে লেখা। নিচে তারিখটা দেখলো। গত পরশুদিনের তারিখ দেয়া। এবার পড়া শুরু করলো-
সুতপা
খুব আশা করে তোমার সাথে দেখা করতে এসেছিলাম। কিন্তু তোমাকে পেলাম না। বড্ডো অভিমানী তুমি। তোমার ভূল ভাঙ্গানোর জন্য কিছুই বলবো না। তুমি অনেক জ্ঞানী, ভালো বোঝাপড়া তোমার,অনেক মেধাবী তুমি-শুধু যেটুকু বোঝনি তার নাম-অপূর্ব । না, তুমি ভূল করোনি। প্রত্যাখ্যান মানুষকে মহান করে। প্রথম দিকে একটু কষ্ট হলেও পরে সব ঠিক হয়ে যাবে। পৃথিবীর কোনকিছুই খুব জরুরি না। অনেক চেষ্টা করেছিলাম রাশিয়াতে থেকে যাবো। তীর বেঁধা পাখির গতি থাকে। এক অজানা ভবিতব্যকে সঙ্গে নিয়ে আমি আগস্টের ২ তারিখ থেকে লন্ডনের আকাশের নীচে জায়গা খুঁজবো। তোমার সঙ্গে স্বাভাবিকভাবে আর কখনো দেখা না হলেও তোমার জন্য শুভ কামনা নিরন্তর।
ভালো থেকো।
ইতি
অপুর্ব
১.৮.১৯৯২
শেষ কয়েকটি লাইন ভালো করে পড়তে পারেনি। চোখের জলে সব কিছু ঝাপসা ঝাপসা লাগছিলো। হার্টটা যেন ট্রেনের গতিতে উঠা-নামা করছিলো। এক সময় হাত থেকে চিঠিটা ফ্লোরে পড়ে যায়।
-অপুর্ব একি করলে তুমি-বলেই সুতপা নীচে বসে পড়ে। হাউ মাউ করে কাঁদতে শুরু করে।
সেলিম তাড়াতাড়ি এসে চিঠিটা কুড়িয়ে নেয়। এক নজড় চোখ বুলিয়েই সুতপাকে সান্তনার দেওয়ার চেষ্টা করে-
-দেখবা একদিন সব আবার ঠিক হইয়া যাইবো।
-সেলিম ভাই আমি আর পারছি না-আবার কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে সুতপা।
সুতপার মন তখন অশান্ত সাগড়ের আথালি পাথালী ঢেউয়ের উন্মাদ তরঙ্গের ঝাপটা। বুকটা যেন ফেটে যাচ্ছে। বাইরের সোনালী রোদ যেন সাহারার মরুর তাপদাহ হয়ে চোখে মুখে আছড়িয়ে পড়ছে, এর মধ্যেই বার বার অপুর্বর প্রত্যাক্ষিত অসহায় অবয়ব সুতপার মনের আয়নায় ভেসে উঠছে। সকালের শেষ প্রহরে যেন সারা পৃথিবীর বিষাদের নোনাজল সুতপার সারা গায়ে লুটিয়ে পড়ছে।
(চলবে---)
Read full book here: Click here to download the PDF file