পর্ব-২২
Summary:
অতঃপর অপূর্বর লন্ডন যাওয়ার অপেক্ষায়।
কেমন একটা অস্থিরতা অনড় পাথরের মতো বুকে ভর করে আছে। স্মৃতির শহর ছেড়ে যাওয়ার কষ্টটাই একদম আলাদা।
এই প্রথমবারের মতো সে লন্ডন যাচ্ছে। তাও ট্রেনে। তার পূর্ব অভিজ্ঞতা বলতে কিছুই নেই। তাতে কি? ভাষাতো জানে? সবই শিখে নেবে, যেভাবে সোভিয়েত দেশে এসে ধীরে ধীরে শিখে নিয়েছিলো।
ঘড়ির কাটায় ঠিক ৪টা ৪০ মিনিট বাজতেই ট্রেন ছাড়লো।
দ্রত গতিতে ট্রেন চলছে-অপূর্বর চোখটা ভারী হয়ে আসছে। সামনে সেলুলয়েডের ফিতার মতো আসছে কত ছবি। সেই বাংলাদেশ থেকে আসা এক তরুন। বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা, কমিউনিস্ট সোভিয়েত ইউনিয়ন কিভাবে চোখের সামনে ভেঙে গেল। তারপর সুতপা-আরেক স্বপ্নভঙ্গের ঘটনা। সব ফেলে রেখে ছুটছে ট্রেন। দুপাশের দৃশ্যাবলীর বুক চিড়ে চলছে অপূর্ব।
এই লন্ডন যাওয়ার জন্য গত এক মাসে অপুর্বকে অনেক ঝক্কি ঝামেলা পোহাতে হয়েছে। যেহেতু ট্রেনে যাচ্ছে তাই পোল্যান্ড, জার্মানী সহ হল্যান্ডের ট্রানজিট ভিসাও নিতে হয়েছে। বিশেষ করে জার্মানীর ভিসা নেওয়ার জন্য দূতাবাসের সামনের খোলা প্রান্তরে লোটাকম্বল নিয়ে রাত কাটানোর কথা সত্যিই কখনো ভুলবে না অপুর্ব। জার্মানিরা যে কতো উগ্র, বদমেজাজী তা জার্মানিতে বসবাস না করলেও বোঝা যায়।
হিটলার যেমন জার্মানবাসীদের ছাড়া দুনিয়ার আর কোন জাতীকেই পছন্দ করতো না, অপুর্বর কাছে প্রতিটি জার্মানবাসীকেও তাই মনে হলো।
এমবাসিতে কর্মরত কর্মচারীরা খুব খারাপ ব্যাবহার করছিলো সবার সঙ্গে । মেজাজ যেন সবসময় বিগরে থাকে। অথচ সোভিয়েত ভাঙ্গনের আগে সবকিছুই কেমন অন্যরকম ছিলো। সব সময় একটা বন্ধুত্বপূর্ন ভাব। আজ সব কিছুই যেন উল্টেগেছে। পুঁজিবাদের তকমা পড়ে থাকলে মানুষের প্রতি সন্মান কমে যায় এখনকার দূতাবাসগুলির ব্যবহার সেটা যেন চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দেয়।
চারিদিকের অবস্থা দেখে অপুর্বর এমনি মনে হয়।
সোভিয়েত ভাঙ্গনের সাথে সাথেই বিদেশে যাওয়ার হিরিক পড়ে যায়। কোন কোন এমবাসির সামনে রাত থেকেই লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। অথচ আগে এমনটি কখনোই ছিলো না। লাইন দেয়াতো দূরের কথা। পাসপোর্ট নিয়ে এমবাসিতে আসলেই দু একটি প্রশ্ন করে ভিসা দিয়ো দিতো।
যাক, অনিদ্রা, দুঃশ্চিন্তা, কষ্ট আর পর্বত সমান অসহ্য ঝামেলা পেরিয়ে শেষ পর্যন্ত ট্রানজিট ভিসা পেল।
প্রথমবার যেহেতু ট্রেনে চড়ে বিলেত যাচ্ছে তাই আগে আগেই বিলোরুস্কি ট্রেন স্টেশনে চলে এলো অপুর্ব।
এখানে এসে পড়লো আরেক ঝঞ্জাটে। স্টেশনের ওয়েটিং রুমে ঢুকতে গিয়েই দেখলো ৭-৮ জন শৃগান (যাযাবর) অপুর্বকে ঘিরে ধরেছে। সোভিয়েত ভাঙ্গনের পর পর যাযাবরদের উৎপাত বেড়ে গেছে। মস্কোর রাস্তা-ঘাট, শপিং সেন্টার আর বিশেষ করে মেট্রো স্টেশনগুলিতে বেশী ঘোরাফেরা করে। শুধু হাত পেতেই ক্ষান্ত নয়, ব্যাগ নিয়ে টানা-হ্যাচড়া শুরু করে। সতর্কতার সাথে ভ্যানিটি ব্যাগ কেটে কিংবা পেছনের পেন্টের পকেট কেটে মানিব্যাগ নিয়ে পালায়। আর বিদেশী পেলেতো কথাই নাই। নানা ধরনের তাল-বাহানা শুরু করে।
অপুর্বকে দেখে একটি শৃগান মেয়ে এসে বলে উঠলো ডলার আছে? দে বেশী দামে কিনবো।
আরেকজন বলে উঠলো -তোর হাতের ঘড়িটি বিক্রি করে দে
পিচ্ছি একটি মেয়ে ভেটকী দিয়ে জিজ্ঞেস করলো-তুই কি ইন্ডিয়ান?
কি এক মহা ঝামেলার মধ্যে পড়লো।
অপুর্বর সাথে দুটি ব্যাগ। তাড়াতাড়ি নিজকে সতর্ক সংকেত দিয়ে ওদেরকে পুলিশ ডাকবে বলে ধমক দিয়ে উঠলো। কি বজ্জাতের হাঁড়িরে। ইচ্ছে করছে দুগালে ঠাস করে থাপ্পর কষিয়ে দেয়।
ওদের মধ্যে একটি ১৮-১৯ বছরের মেয়ে এসে অপুর্বর গা ঘেঁষে দাঁড়ালো। অপুর্বর দিকে তাকিয়ে ঠোঁট দুটি বাঁকা করে একটু মুচকি হেসে বলে উঠলো-
-তুমি পুলিশ ডাকবে? ডাকো না। দেখ তোমাকে কি মজা দেখাচ্ছি। তুমি আমার সাথে কি করেছ সব পুলিশকে বলে দেব।
অপুর্ব এবার একটু ভয় পেয়ে গেল। কি সাংঘাতিক মেয়েরে! লজ্জা-শরমের বালাই নেই। সত্যি সত্যি যদি একটা অঘটন ঘটিয়ে দেয়। অপুর্ব আর কথা বাড়ায়নি। অপুর্ব ধীরে ধীরে এগিয়ে চললো ট্রেনের দিকে। নিজের কেবিনের নির্দিষ্ট আসনে বসলো। বুকটা হঠাৎ করেই ভয়ে ধড়ফড় করছিলো। আসনে বসেই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো।
ট্রেনটি এবার ঠক ঠক করে এগিয়ে চললো।
মস্কোর উঁচু উঁচু বহুতল বিল্ডিং, সারি সারি পাইন, বার্চ, বাবলা, ম্যাপল আর নাম না জানা নানা জাতীর গাছগুলোকে পিছনে ফেলে দ্রতগতিতে এক অপুর্ব ছন্দের তালে তালে ট্রেনটি এগিয়ে চলেছে। অপুর্ব জানালার পাশে বসে তাকিয়ে দেখছিলো।
হঠাৎ করেই বুকে একটা চাপা কান্না অনুভব করলো। সত্যি সত্যি অপুর্ব আজ এই চেনা শহরকে ছেড়ে চলে যাচ্ছে কোন অজানার উদ্দ্যেশ্য। অজানাইতো বটে। কিছুই জানে না সেখানে গিয়ে সে কি করবে, কোথায় যাবে, কার কাছে যাবে। যে সুখের খেলাঘর গড়ে তুলেছিলো সুতপার সাথে, স্বপ্নের মন্দির রচনা করেছিলো তা জতু গৃহের মতো মুহূর্তে পুড়ে গেল।
কেমন করে তা ভেঙ্গে গেল সেটা অবিশ্বাস্য! এত গভীর ভালোবাসায় অবিশ্বাস আর সন্দেহ জায়গা পেলে সেটা আদৌ ভালোবাসা ছিলো কিনা ভাবতে গেলে অপূর্ব অশান্ত মন নদীতে ঝড়ে পড়ার মতো এলোমেলো হয়ে যায়। এই ছাড়াছাড়ির যন্ত্রনা বড় ভয়াবহ। তার দাবদাহ দুজনকেই বইতে হবে নিরন্তর। খুব কষ্ট পাচ্ছিলো অপুর্ব। ভাবনার কন্ঠে তখন বির বির করে উচ্চারিত হচ্ছিলো বিবর্ন বিষাদের পংত্তিমালা-
অবশেষে এক লক্ষ মৃত পথ বিছিয়ে রেখে চলে যাওয়া বড় কষ্টকর।
যতগুলো ক্যাকটাস বেড়ে ওঠে তোমার উঠোনো সব কাঁটাগুলি
আমাকে লক্ষ করে চলে আসে- এই পথ ভুল হয় না।
তোমার চলে যাওয়া কিছুতেই শেষ হয় না।
কৈশরে বৃষ্টি হলে নদীর প্রার্থনা ছিলো তোমাতেই
আফ্রিদিতির ভাসা চোখে তুমি এসে বসতে বনলতা সেন
তারপর আমার ঘরে আর সূর্য ওঠেনি।
ঘর দোর বারান্দা বাগান ঢেকে গেলো অস্বচ্ছ কুয়াশায়।
সেখানে ভীনদেশী বাতাস এখন বয়ে যায়
অবলীলায় ভাবনায় তোলে ঢেউ, চলে যায় অজানা গন্তব্যে।
ভাবতে ভাবতে কখন যে চোখে জল এসে গেলো বুঝতেও পারেনি। মন মানছে না। কিন্তু উপায় কি? ভবিতব্যের হাতে নিজকে সঁপে দিয়ে অপুর্ব এগিয়ে চললো।
অপুর্বর কম্পার্টমেন্টে অপুর্ব ছাড়া আর কোন এশিয়ান ছিলো না। ঘুরে ঘুরে অন্যান্য কম্পার্টমেন্টে দেখলো। যদি কাউকে পেয়ে যায়। দেখলো কোন বাঙালী আছে কিনা। কিন্তু কাউকেই পেলো না। তবে পাশের কম্পার্টমেন্টে দেখা হলো তিনজন আফ্রিকান স্টুডেন্টের। মস্কোতেই পড়াশুনা করছে। আফ্রিকার গায়েনার। ওদের সাথেই আলাপ জমিয়ে দিলো।
বেশ ভালোই কাটছিলো সময়টা। ট্রেন সাঁ সাঁ করে এগিয়ে চলছে। একসময় বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা এলো। ধীরে ধীরে অন্ধকার নেমে এলো। বাইরো জোৎস্নার আলো ছায়া। চাঁদের আলো এসে জানালা দিয়ে ঠিকরে পড়ছিলো। বিস্তীর্ন প্রসারিত মাঠ। মাঠের শেষ প্রান্তে শুধু উঁচু উঁচু গাছগুলো ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। কি অপুর্ব সুন্দর প্রকৃতি। মনে হয় রাতের পৃথিবীটা মায়াময় হয়ে ধরা দিয়েছে। এমন রাতেই ধ্যানমগ্ন হয়ে রুমে থাকা যায়-কাব্যের ধ্যানে, প্রকৃতির ধ্যানে। কিন্তু এই অপার সৌন্দর্যের মধ্যেও হঠাৎ কেন জানি কবি সুকান্তের একটি কবিতার কয়েকটি লাইন অপুর্বর কাছে কঠিনভাবে ধরা দিয়েছে-
“ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়
পূর্নিমার চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি”।
সত্যিই সত্যিই প্রচন্ড ক্ষুধায় প্রকৃতির এই নিটোল সৌন্দর্য অপুর্বর কাছে ভালো লাগছিলো না।
কিন্তু কিছু খাওয়ার মতো এমন কিছুই অপুর্বর কাছে ছিলো না। ব্যাগে কয়েকটি ছোট পেপসির বোতল আর কিছু আপেল আছে। কিন্তু তা দিয়ে কি আর বাঙালী ছেলের পেটের ক্ষুধা মেটে? ইচ্ছে হচ্ছিলো কাঁচা মরিচ, পেঁয়াজ আর ডালের বড়া দিয়ে পানতা ভাত খেতে। কিন্তু ইচ্ছে করলেই কি সব পাওয়া যায়। কখনো কখনো তা সম্ভব নয়।
হঠাৎ অপুর্বর মনটা খারাপ হয়ে যায়।
ভাবনায় অতীতের উদাস পাখিরা তির তির করে উঠতে থাকে। কতোদিন সামারের প্রচন্ড গরমের দুপুরে যখন হোস্টেলের রুমে আসতো তখন সুতপা পান্তা ভাতের থালা নিয়ে উপস্থিত হতো। কাঁচা মরিচের সাথে কয়েকটি শুকনো মরিচ তেলে ভেজে রাখতো। তেলে ভাঁজা কুচ কুচে কালো মরিচ দিয়ে পাঁচ আঙ্গুলের কসরতে ভালো করে পান্তা ভাত ডালের বড়ার সাথে মেখে মুখে পুরতো।
কি যে আনন্দ হতো ঝাল করা ভাতগুলো খেতে। একটু বেশি করেই মাখতো। সেখান থেকে আলাদা করে একটি বাটিতে সুতপাকে দিতো। অপুর্বর মাখা পান্তাভাত সুতপা খুব তৃপ্তি সহকারে খেত। ভাতের জলটা চুমুক দিয়ে আস্তে আস্তে খেত।
কতো না সুন্দর ছিলো সেই দিনগুলি।
শেষ পর্যন্ত পর পর দুটি আপেল খেয়েই রাতের ক্ষুধা নিবৃত করলো। পকেটের দৈন্যতা আছে বলেই কিছু কিনে খাওয়ার সাহস হলো না। একসময় সিটে বসেই ঘুমিয়ে পড়লো। পয়সার জন্য লোকাল ট্রেন নিয়েছে বলে স্লিপিং বেডে ঘুমানোর ঐশ্বর্যতা ছিলো না। পরদিন ঠিক সকাল ৭টায় ট্রেনটি বেলারুশের পার্শবর্তী দেশ পোল্যান্ড ঘেঁষা বর্ডার শহর ব্রেস্তে এসে পৌঁছলো।
ছোট শহর ব্রেস্ত। মস্কো থেকে ১৮০০ কিলোমিটার দূর। ট্রেনে আসতে সময় লাগলো প্রায় ১৪ ঘন্টা। ছোট ছোট বিল্ডিং, পরিস্কার পরিচ্ছন্ন রাস্তা-ঘাট। রাস্তার দুপাশে বিচিত্র তরু সজ্জা-বেশ তন্ময় হয়ে অপুর্ব দেখছিলো ট্রেন থেকে।
ব্রেস্তে আসার সাথে সাথেই একজন ভদ্র মহিলা মালামাল এবং টিকিট চেক করতে কম্পার্টমেন্টে ঢুকে। সাথে একজন ইমিগ্রেশন অফিসার।
অপুর্বকে নীচে নিয়ে যায় পাসপোর্ট এবং ভিসা চেক করতে।
অপুর্বর কাছে তেমন কোন মালামাল ছিলো না ছোট্ট একটা ব্যাগ, সামান্য কাপড়-চোপড় এবং অন্য একটি পলিথিন ব্যাগে কিছু আপেল আর কয়েকটি পেপসির বোতল। সুতরাং চেক করার কোন প্রয়োজন বোধ করেনি। পাসপোট আর ভিসা দেখেই অপুর্বকে ছেড়ে দেয়। তবে অপুর্বর কাছে কিছু রুবল ছিলো। সেগুলোকে সঙ্গে নিতে দেয়নি। ব্যাংকে জমা দিয়ে যেতে হবে।
অপুর্বর কম্পার্টমেন্টের পাশের সিটে ছিলো আরেক ভদ্রমহিলা। রাশিয়ার নাগরিক। কিন্তু বর্তমানে পশ্চিম জার্মানিতে বসবাস করছেন। হলিডেতে বেড়াতে এসেছিলেন মস্কোতে। আবার চলে যাচ্ছেন।
ঐ মহিলার সাথে বেশ কয়েকটি বড়ো সাইজের লাগেজ পেটরা ছিলো। কাস্টমস অফিসারদের নজর ঐই মহিলার দিকে। ওর লাগেজগুলো চেক করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।
অপুর্ব ব্যাংকে টাকা জমা দেওয়ার জন্য ব্যাংকের উদ্দেশ্যে রওনা দিলো।
ব্রেস্তে ট্রেন প্রায় দুঘন্টার মতো অবস্থান করবে। তাই তাড়াহুড়ার প্রয়োজনবোধ করলো না হাঁটা শুরু করলো। হাঁটতে হাঁটতে যেখানে এসে পোঁছালো সেটা মেইন রেল স্টেশন এবং ট্রেন যেখানে থেমেছে তার থেকে প্রায় আধা মাইল দূরে। সেখানেই নির্দিষ্ট ব্যাংকটি। এই ব্যাংকেই টাকা জমা দিতে হবে।
সোভিয়েত সমাজের উপর অপুর্বর বড্ডো জেদ হলো। শেষ পর্যন্ত অনেক খোঁজাখোঁজির পরও ব্যাংকটি আর খুঁজে পেলো না। হঠাৎ অপুর্বর নজরে পড়লো কয়েকটি দোকান। দোকানগুলির দিকে এগিয়ে গেলো। ব্যাংকে আর টাকা জমা দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করলো না। দোকান থেকে এক ব্লক আ্যামেরিকান মারলবরো কিনলো।
সিগারেট কেনা হলো কিন্তু পেটের জন্য কিছু করা উচিৎ। পেট যে আর মানছে না। ক্ষুধা যেন তুষের আগুন জ্বেলেছে পেটে। যার জ্বালায় জ্বলছে অপূর্ব। বেশ দূর্বল দূর্বল লাগছে। লাগবেইতো। গতকালও তেমন কিছু খাওয়া হয়ে ওঠেনি।
যাহোক এখানে খাওয়ার দোকানে কিছু না কিছু খেতেই হবে অপুর্বকে। তাই একটু এগিয়ে গেলো।
কিন্তু বিধি বাম!
রেষ্টুরেন্ট ঠিকই পেলো কিন্তু সকাল ৮টার আগে খুলবে না। ৮টা বাজতে আরো কুড়ি মিনিট।
এই এক ঝামেলা। এখানে কাটায় কাটায় সব কিছু চলে। এখানে সময়ের সাথে সাথে তাল মিলিয়ে না চলতে পারলে বড়ো বিপদ। কি আর করবে? ক্ষুধা যেহেতু লেগেছে অগত্যা অপেক্ষা ছাড়া আর কোন উপায় নেই।
খাওয়া-দাওয়া শেষ করে বেরুতে বেরুতে প্রায় সাড়ে আটটা বেজে যায়। তাড়াতাড়ি হাঁটা শুরু করলো ট্রেনের দিকে।
ট্রেনের কাছে এসে হতভম্ব। এখানে কোন ট্রেন নেই। হঠাৎ বুকটা ধপাস করে উঠলো। তা হলে কি ট্রেন চলে গেছে? তা হলে এখন কি হবে? টাকা-পয়সা, কাপড়-চোপড়, ক্যামেরা সবইতো ব্যাগের ভিতর। অস্থির দুঃশ্চিন্তায় যখন পাগলের মতো এদিক-ওদিক তাকাচ্ছিলো তখন সামনে আরো কয়েক জনকে পেলো। ওদেরও একইদশা।
সবাই মিলে এবার খোঁজাখোঁজি শুরু করলো। অনেক খোঁজাখোজির পর শেষ পর্যন্ত ট্রেনের কাছে এসে পেঁছাতে পারেলো। শরীর থেকে যেন ঘাম ছুটে গেল। সবাই বেশ গালিগালাজ করতে থাকে। এ কেমন অসভ্যতা! যেখানে ট্রেন থেমেছিলে সেখান থেকে অনেক দূরে ট্রেনটিকে নিয়ে আসা হয়েছে। অন্তত একবার ঘোষনা দেওয়ারও প্রয়োজনবোধ করলো না। এটা মগের মুল্লুক নাকি?
অপুর্বর দলের সকলেই প্রথমবারের মতো লন্ডনে যাচ্ছে। তাও আবার ট্রেনে করে। শেষ পর্ন্ত ট্রেনটিকে খোঁজে পেয়ে সবার মধ্যে স্বস্তি ফিরলো।
অপুর্ব সোজা ট্রেনের কেবিনে গিয়ে বসলো।
কেবিন ঢুকেই অপুর্ব থ খেয়ে যায়। সে কি এক মহাকান্ড। অপুর্বর পাশের সীটের ভদ্র মহিলাটি কাঁদছেন এবং তার সবগুলি লাগেজ-পেটরা কড়িডোরে পড়ে আছে। কাস্টমস এর দীর্ঘাকায় মোটা মহিলাটি তার সাথে উচ্চ স্বরে কথা বলছে এবং একজন মহিলাকে ট্রেন থেকে নেমে যেতে বলছে। অপুর্বকে দেখে ভদ্র মহিলাটি লাগেজ পেটরাগুলি নীচে নামিয়ে রাখতে সাহায্য করতে বললেন। অপুর্ব বুঝতে পারলো মহিলা এই ট্রেনে আর যেতে পারছেন না। অপুর্ব মহিলাকে বাক্স পেটরাগুলি নামাতে সাহায্য করলো। তারপর নিজের কেবিনে ফিরে এলো। কেবিনে অপুর্ব এখন একা। বেশ ভালোই লাগছিলো। এক সময় ট্রেন আবার ধীরে ধীরে এগিয়ে চললো।
বাইরে রৌদ্রের প্রখর উজ্জ্বলতা। দিগন্ত প্রসারিত মাঠের বুক চিরে ট্রেনটি এগিয়ে চলেছে। কেবিনের জানালায় স্থির হয়ে আছে অপুর্বর চোখ দুটি। তন্ময় হয়ে দেখছে বাইরের মনোরম সবুজের নকশী কাঁথার মতো প্রকৃতি।
কিছুক্ষন পরই ট্রেনটি পোল্যান্ডের সীমানায় ঢুকতে যাচ্ছে। নিজের ভেতর একটা প্রচন্ড উচ্ছ্বাসের অনুভূতি টের পেল। ভালো লাগছিলো অপুর্বর। হঠাৎ ঘোষিত হলো যে ট্রেনটি কিছুক্ষনের মধ্যেই পোল্যান্ডের TERESPOL বর্ডারে এসে পৌঁছাবে।
ঠিক পনের মিনিট পর TERESPOL এসে পৌঁছালো। আবার ইমিগ্রেশন অফিসার এলেন। পাসপোর্ট চেক করলেন। তারপর পাসপোর্টে একটা সীল বসিয়ে চলে গেলেন।
এবার এলেন কাস্টমস অফিসার। খাটো খর্বাকৃতির এক মহিলা। কমলালেবু চোখ। চোখে কালো ফ্রেমের চশমা। অপুর্বর ব্যাগটা দেখেই কিছু জিজ্ঞেস না করেই চলে গেলেন।
TERESPOLবর্ডারে থামার ঠিক এক ঘন্টার পর ট্রেনটি আবার ছাড়লো।
ছাড়ার ঠিক ছয় ঘন্টার পর পোল্যান্ডের রাজধানী Warsaw (ওয়ারসো) মধ্য দিয়ে ট্রেনটি এগিয়ে চললো।
সোভিয়েত ইউনিয়ন আর পোল্যান্ডের মধ্যে তেমন কোন পার্থক্য চোখে পড়লো না অপুর্বর। সেই উঁচু উঁচু অট্টালিকা আর রাস্তার দুপাশে ঢাকার মিন্টু-বেইলি রোডের থরে থরে সাঁজানো তরুসজ্জা। প্রকৃতির দানে যেন এতোটুকু কৃপনতা নেই। তবে জৌলুসময় চাকচিক্যের দৈন্যতা মারাত্মতভাবে পরিলক্ষিত হয়।
একসময় ট্রেনটি Frankport এ এসে পোঁছালো।
আবারো কাষ্টমস আর ইমিগ্রেশন। ট্রেন এগিয়ে চললো জার্মানীর ভিতর দিয়ে। হঠাৎ করেই চোখের পর্দায় ব্যাতিক্রমীর ছোঁয়া ভেসে উঠলো। উঁচু উঁচু বিল্ডিং এর জায়গা দখল করে নিল ৬/৭ তলার সুন্দর সুন্দর বিল্ডিং। প্রত্যকটি ফ্লাটের বারান্দায় থরে থরে সাঁজানো নানা প্রজাতীর ফুল।
সৌন্দর্য প্রিয় জার্মানবাসীরা ফুল খুব ভলোবাসে। সন্ধ্যা ৮টায় ট্রেন এসে থামলো Zoologischer Garten station-এ।
সেখান থেকে হল্যান্ডের ট্রেন ধরার জন্য অপুর্ব মেট্রোতে চেপে বসলো। প্রায় ৪০ মিনিট পরে নির্ধারিত ট্রেন ষ্টেশনে এসে পোঁছালো। আর দুই ঘন্টা পর ট্রেন ছাড়বে। তাই ষ্টেশনেই বসে পড়।
সেখানেই পরিচয় হয় তিনজন ইন্ডিয়ান স্টুডেন্টের সাথে। ওরাও মস্কোতে পড়াশুনা করে।
স্টেশনে বসে বসে অপুর্ব এক বিচিত্র অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করলো। মনে হলো পুরো বার্লিন শহরটাই মাস্তান আর বখাটে ছেলে-মেয়েদের দখলে। বিশেষ করে স্টেশনগুলিতে ওদের উৎপাত বেশী। যাযাবরদের উৎপাতও সাংঘাতিক। দল বেঁধে বেঁধে জড়ো হয়ে বসে আছে এখানে সেখানে। ওদের ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা সবার কাছে হাত পাতছে। পয়সা চাচ্ছে। কখনো কখনো পকেটে হাত ঢুকিয়ে দিচ্ছে। নোংরা এক অস্বাস্তকর পরিবেশ সাড়া স্টেশন জুড়ে। মাঝে মধ্যে বিচিত্র রকমের বেশ -ভূষা, স্কিন হেড, লম্বা লম্বা চুল এমন কি শুধূ জাঙ্গিয়া পরে ছেলে মেয়েরা নানা ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকে, কখনো কখনো চিৎকার করে ওঠে।
অপুর্বর কেমন জানি ভয় ভয় লাগছিলো। এই সব বিচিত্র জিনিস দেখতে দেখতে কখন যে সময় ফুরিয়ে গেলো অপুর্ব টেরও পায়নি।
শেষে একসময় ট্রেনে এসে বসলো।
যেহেতু লোকাল ট্রেন কোন কেবিনে সিট খালি ছিলো না। মহা বিপদে যেন পড়লো অপুর্ব। বার্লিন থেকে হল্যান্ডের Hook van Holland যেতে কম করে হলেও ১৪/১৫ ঘন্টা লাগবে। এতোক্ষন দাঁড়িয়ে যেতে হবে ভাবতেও কষ্ট লাগছিলো অপুর্বর।
কি আর করা? দাঁড়িয়ে থেকেই কাটালো ৬/৭ ঘন্টা।
হল্যান্ডের সীমানায় ঢুকতেই কিছু লোক নেমে যায়। অপূর্ব তাড়াতাড়ি একটা সিটে বসে পড়ে। এবার একটু আরাম বোধ করলো। ঘুমঘুম পাচ্ছিলো। এক সময় ঘুমিয়ে পড়লো।
কারো ডাকে ঘুম থেকে জেগে উঠে। চোখ খুলেই দেখতে পায় ইমিগ্রেশন অফিসার। ফ্যাল ফ্যাল করে অপুর্বর দিকে তাকিয়ে আছে। অপুর্ব বুঝতে পারলো বন্দর শহর হুক ভ্যান হল্যান্ডে চলে এসেছে। এখন জাহাজে করে পাড়ি দিতে হবে ইংলিশ চ্যানেল।
ইমিগ্রাশন শেষ করে এক সময় জাহাজে এসে বসলো।
এই ইংলিশ চ্যানেলের কথা অপুর্ব কতো শুনেছে। মনে পড়লো ব্রজেন দাসের কথা। তিনিই প্রথম বাংলাদেশী সাঁতরিয়ে যিনি ইংলিশ চ্যানেল পর পর ছয়বার অতিক্রম করেছিলেন।
বেশ ভালো লাগছিলো অপুর্বর। এতো বড়ো জাহাজে আগে কখনো উঠার সৌভাগ্য হয়নি। আট তলা বিশিষ্ট এক বিশালাকার জাহাজ। শেষ পর্যন্ত Hook van Holland থেকে জাহাজে ৭ ঘন্টায় ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দিয়ে বৃটেনের Harwich বন্দরে এসে জাহাজ থামে।
তখন সন্ধ্যা ৬টা। সেখান থেকে ট্রেন ধরে রাত ৯টার দিকে লন্ডন লিভারপুর স্টেশনে এসে পোঁছায়।
এ শহরের গঠন সোভিয়েত থেকে আলাদা। নতুন শহরে কেমন অবস্থায় থাকবে, কিছু চেনা-জানা নেই ভাবতে ভাবতে একরাশ অসহায়ত্ব নিয়ে বাঙালির এক সময়ের বিস্ময় বিলাতের পথে ঢুকে পরে।
(চলবে---)
Read full book here: Click here to download the PDF file