মস্কোর বরফবিথী ও একজন সুতপা পর্ব-২১


Author: ড. পল্টু দত্ত

পর্ব-২১

Summary:

কখন কিভাবে যে বাসায় এসে পৌঁছলো অপুর্ব টেরও পায়নি।

নাতালিয়া বাসায় ছিলো না। ঘরে ঢুকেই সোজা নিজের রুমে চলে আসে। হঠাৎ করেই কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো। অনেকক্ষন বেডে শুয়ে ছিলো। বার বার চোখ দুটি সজল হয়ে উঠছিলো। অতীতের কথা মনে পড়ছিলো। হঠাৎ করেই যেন জীবনের সব সৌন্দর্যের দরোজাগুলি ঝড়ের তান্ডবে ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেলো।

 

অনেকক্ষন ধরে ভাবতে ভাবতে অপুর্ব নিজকে সামলিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলো। নিজকে একটু শক্ত করার চেষ্টা করলো। মনে মনে বিড়বিড় করতে লাগলো-

-বল দাও মোরে বল দাও, প্রানে দাও মোর শক্তি- আাহ্ কি দারুন রবীন্দ্রনাথ।

বিপদ-আপদ-আনন্দের আশ্রয়। অপূর্ব সব কষ্ট ঝেড়ে ফেলে নিজকে নতুন ভাবে তৈরী করতে চায়। যাকে হাতের কাছে পাওয়া যাবে না তাকে পাওয়ার দুরন্ত বাসনা ত্যাগ করার চেয়ে মঙ্গলের আর কিছু নেই।

অপুর্ব, নিজের জন্য আস্তে আস্তে একটু জায়গা করে নিলো। সুতপাকে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করলো কিন্তু কোন মতে হয়ে উঠে না। শত চেষ্টায় সুতপাকে সে মন থেকে মুছে দিতে চেষ্টা করলেও পারছে না। ওর সঙ্গে কিছু দিনের জন্য আর দেখা করার চেষ্টা করেনি তবে ওকে নিয়ে ভাবনার দরজাটা একেবারে বন্ধ করে দেয়নি।

 

নিজেকে ব্যস্ততার মধ্যে পুরোপুরি সমর্পন করলো। পড়াশুনায় খুব মনোযোগ দিলো। আর কয়েক সপ্তাহ পরেই থিসিস ডিফেন্স, করবে। তাই অন্যদিকে মনোযোগ দেওয়া থেকে নিজকে বিরত রাখলো। সবকিছু থেকে গুটিয়ে নিয়ে একাকীত্ব আর  নিঃসঙ্গতাকে বরণ করে নিলো।

 

একাকীত্ব হল নিজের দারিদ্র্য, আবার এই একাকীত্বই হল নিজের সমৃদ্ধি, সাচ্ছন্দ এবং বেঁচে থাকার অমলিন প্রেরনা। এতেই কিছুটা যেন স্বস্তি মেলে।

এই ভাবেই সময় এগিয়ে চলে অপূর্বর।

 

ইদানিং কারো সঙ্গে তেমন কথা হয় না। শুধু সপ্তাহে একদিন পত্রিকা অফিসে যায়। সারাদিন শেষে আবার ঘরে ফেরা। ব্যক্তিগত বিষয়ে কাউকে কিছু বলেনি। কেউ জানতে পারেনি অপুর্ব এক দহনের যন্ত্রনা বয়ে বেড়াচ্ছে। নিজকে সবসময় স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করেছে। এমনকি নাতালিয়াকে কিছু বুঝতে দেয়নি।

 

ইদানিং অপুর্ব পড়াশুনা করতে করতে খুব গান শুনে। চিন্ময়ের রবীন্দ্র সংগীত ইদানিং খুব পছন্দ করে। এই সন্ধ্যার শেষ বেলায় নিজের পড়ার টেবিলে পড়তে পড়তে শুনছে রবীঠাকুরের গান। চিন্ময়ের মধুর কন্ঠে টেপ রেকর্ডারে বাজছে- ‘ভালোবেসে যদি সুখ নাহি/তবে কেন,তবে কেন মিছে ভালোবাসা/মন দিয়ে মন পেতে চাহি/ওগো কেন/ওগো কেন মিছে এ দুরাশা’

 

চারিদিকে কি এক নিস্তব্ধ রাতের গভীরতা। কালো নিসর্গ নিদ্রাচ্ছন্ন। থমথমে ভাব ছড়িয়ে আছে গাছ- গাছালি আর রাতের বাতাসে। সব ইট পাথরের দালান বাড়িগুলো যেন নিকষ অন্ধকারের পোশাক পরেছে। কি নিঃসঙ্ক মানুষের জীবন। অথচ সব নিস্তব্ধতা আর নিঃসঙ্গতার সামিয়ানা ভেদ করে ভাবনায় বেদনার এক বিষাদের বিউগল বাজিয়ে যাচ্ছে রবি ঠাকুর। অন্ধকারের বুকে হামাগুড়ি দিয়ে ঘোরে বেড়ায় এই মন। মাঝে মাঝে ভাবতে ভাবতে চোখ দুটি ঝাপসা হয়ে আসে। জলে ভরে যায়। গাল বেয়ে পড়তে থাকে। বুকটায় কেমন পাথর চাপা অনুভব করে। সুতপাকে নিয়ে ভাবে আর চিন্তা করে।

 

এমনি করে এগিয়ে চলে সময়। মস্কোর বরফ কাঁদা জল দেখতে দেখতে সুন্দরের শ্যামলিমায় ভরে উঠে চারিদিক। গাছগুলিতে যেন প্রান ফিরে এসেছে সবুজের মহামিলনে। আকাশে নীলের বাহার দিনের বেশীটা সময়। চারিদিক এখন আলোকের বন্যা। এ নতুন রুপে যেন সেঁজেছে পৃথিবীটা।

জুন মাসটা আসলেই অপুর্বর মনটা উৎপল হয়ে উঠে। মস্কোর সামরটাই একটু অন্যরকম।

 

একদিন অপুর্ব থিসিস ডিফেন্স করলো। গ্র্যাজুয়েশনে অংশ নেয়।

গ্রাজুয়েশননের দিনে ইউনিভার্সিটিতে একা একাই অপুর্ব গিয়েছিলো। মনটা খুব খারাপ লাগছিলো। ভুলতে চাইলেও ভুলতে পারেনি। সুতপার কথা খুব মনে হচ্ছিলো। কেমন আছে সুতপা? এই দিনটি সবার জন্য আনন্দ এবং উদযাপনের দিন। এই দিনটি এক দীর্ঘ এবং কঠিন যাত্রার সমাপ্তি যা জীবনের একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা চিহ্নিত করে। অনেকের জন্য, এটি তাদের জীবনের অন্যতম স্মরণীয় দিন, গর্ব, কৃতিত্ব, স্বস্তি এবং উত্তেজনার মতো আবেগে ভরা। প্রত্যেকেরই গর্বিত হওয়ার কিছু না কিছু কারণ রয়েছে।

ইউনিভার্সিটির বছরগুলিতে অসংখ্য পরীক্ষা এবং অ্যাসাইনমেন্টের পরে, অবশেষে এই দিনটিতেই বলতে পারে যে তারা তাদের জীবনে এই মাইলফলক অর্জন করেছে, এই অনুভূতিটি অন্য কোন কিছু দ্বারা প্রতিস্থাপিত করা যায় না।

উপস্থিত প্রত্যেকেই ঐতিহ্যবাহী পোশাক যেমন গাউন বা স্যুট পরে সেই দিন। অপুর্বও স্যুট-কোট পরে যায়। গাউনে খুব সুন্দর লাগছিলো। প্রতিটি গ্র্যাজুয়েট তাদের ডিপ্লোমা গ্রহণ করার সময় তাদের নিকট বন্ধু এবং প্রিয়জনরা উল্লাস আর করতালিতে অভিনন্দন জানাচ্ছে।

 

সবাই একত্রিত হয়েছে জনাকীর্ণ অডিটোরিয়ামে।

কিন্তু সেদিন অপুর্বর আনন্দে উল্লসিত হওয়ার মতো কেউ ছিলো না।

 

অন্ততঃ সুতপার কথাই অপুর্বর বেশী মনে পড়ছে। সব কিছু কেমন ওলোট-পালোট হয়ে গেলো। কাউকে অপুর্ব এই দিনটির কথা বলেনি। কেউ জানতো না কখন অপুর্বর গ্রাজুয়েশন। সুতপাও না। ইচ্ছে করেই অপুর্ব কাউকে জানায়নি। সব কিছুকে ধীরে ধীরে ভুলে থাকতে চায়। এ ছাড়া যে তার কোন উপায় নেই। কোন মুখে গিয়ে দাঁড়াবে সুতপার সামনে? এতো অপবাদ আর অপমানের পর কেমন করে অপুর্ব আবার ফিরে যাবে, বুঝানোর চেষ্টা করবে? না, তা হয় না। অভিমান করে দ্বগ্ধ হয়েছে দিনের পর দিন কিন্তু যাকে এতো ভালোবেসেছিলো তার অনুভূতিকে চ্যালেঞ্জ করার স্পর্ধা অপুর্বর ছিলোনা। তাই নিজের দহনের চিতা নিজের হাতে সাঁজিয়েছে, দ্বগ্ধ হয়েছে কিন্তু নিজের পক্ষে সাফাই গাইতে সুতপার কাছে ফিরে যায়নি। বড্ডো অভিমানী ভালোবাসার মন!

 

কিন্তু এমনি করে যেন আর জীবন চলছে না। কোন কিছুতেই আর মন বসছে না। হাতে টাকা-পয়সাও নেই। এবার কিছু একটা করতে হয়।

 

একদিন অপূর্ব সত্যি সত্যি সিদ্ধান্ত নেয় লন্ডন চলে যাবে।

কারন একটা বিষয় নিয়ে ভাবতে যেন সব ম্যাড়মেড়ে হয়ে যাচ্ছে। তাছাড়া যে ভালোবাসে সে একটা ঘটনায় একদম নেগেটিভ হয়ে দাঁড়াবে কোন কিছু না শুনেই? এ কেমন ভালোবাসার বুনিয়াদ? এই ব্যাপারটা তাকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছিলো। তাছাড়া জীবনটাতো ফুলের কাঁটা নয় যে ইচ্ছে করেই ছেটে ফেলা যাবে।

 

জীবন এক মহাজগত-মহা অসীমের প্রান্তে তার বসবাস। সেখানে অপূর্বকে ছাড়াও অনেক কিছু তৈরী হবে। তাই  যেভাবে সুতপা তাকে প্রত্যাপখ্যান করেছে- সেভাবেই সে এমন জায়গায় পাড়ি জমাবে যেখানে সুতপা ইচ্ছা করলেও তাকে দেখতে পাবে না। যদিও এ মুহূর্তে অপূর্বর হাতে টাকা-পয়সা নেই। মস্কো থেকে সে ট্রেনে চলে যাবে লন্ডন। সবকিছু মিলে বেশ কিছু টাকা লাগবে।

 

টাকার অভিযানে বেড়িয়ে পড়ে। বন্ধুদের কাছে যায়নি পাছে কথাটা জানাজানি হয়ে যাবে। পরে একদিন এক সিনিয়র ভাইয়ের কাছ থেকে পাঁচশত ডলার নিয়ে আসে। ভিসার খরচ, ট্রেনের টিকেট আর ইউকে ইমিগ্রেশনে দেখানোর জন্য কিছু থাকবে। যদিও কম কিন্তু এতেই চলবে।

যেমন কথা তেমন কাজ। মাস খানেকের মধ্যেই ইউকের ভিসা নিয়ে নেয়। টিকেট কাটে ট্রেনের।

 

আগস্টের ২ তারিখ রওনা দেবে লন্ডনের উদ্দ্যেশ্যে। মনটা ভীষম খারাপ। যতোই দিন ঘনিয়ে আসছে ততই বুকটা ধরফর করতে লাগলো। লন্ডন যাওয়ার ব্যাপারটা নাতালিয়াকে জানায়। ঘরে যা কিছু ছিলো প্রয়োজনীয় দু’একটি জিনিস ছাড়া সব ফেলে দেয়।

 

এখন ইউনিভার্সিটির পাঠ চুকে গেছে বলে মিখলুখা মাখলায়ার হোস্টেলটির রুমটিও একদিন ছেড়ে দিতে হয়। রুমে যা ছিলো সব ফেলে দেয় । কোন কিছুর জন্য মায়া করেনি। কি হবে প্রানহীন বস্তুর জন্য মায়া করে?

 

যে মানুষটিকে ভালোবেসেছিলো এতোদিন, অমল বিশ্বাসে সঁপে দিয়েছিলো জীবন-মন-প্রান সেই যখন ক্ষনিকের ভুল বুঝাবুঝিতে ফেলে দিলো পুজার বেঁদিকে। সেখানে এই জিনিস পত্রের মূল্যই বা কতোটুকু।

 

সবকিছু চুকে-বুকে ফিরে আসে নাতালিয়ার বাসায়।

 

এক সময় যাওয়ার দিন ঘনিয়ে আসে। দুই দিন পর রওনা দিবে। মনটা আর মানছে না। মনের আকাশে কেমন আষাঢ়ের ঘনঘটা। বৃষ্টির দাপাদাপি। অসাড়ত্বের চাদরে ঢেকে আছে সবকিছু। তারপরও মন থেকে সুতপার মুখটা কোন কিছুতেই সরাতে পারছে না। ভেসে উঠছে বার বার। মায়াবী কি অসহায় মুখটা। অপুর্বর চোখ দুটি ছল ছল করে ওঠে। এক চাপা কান্নার আর্তনাদ সারাটা বুক জোড়ে।

 

আর মাত্র মাঝে একটা দিন। অপুর্ব চলে যাবে। সুতপা মস্কোয়। একটু জানতেও পারলো না সম্পর্কে ভূল করা অভিমানের পরিনতি কতো ভয়ানক। অপুর্ব কিছুতেই স্থির হতে পারছিলো না। সারাটা দিন ছট ফট করেছে। রাতে দু’চোখের পাতায় ঘুম নেই। কি করবে বুঝতে পারছে না।

সিদ্ধান্ত নেয়, সুতপার সাথে দেখা করবে। কাল। এই একটি দিনই হাতে আছে। সুতপাকে বুঝাবে যে এই এক নিছক ভুল।

সুতপাই অপুর্বর ধ্রব সত্যি। সুতপা যদি বুঝে, অপুর্ব আর লন্ডন যাবে না। নতুন করে আবার সব গোছাবে।

 

মধ্যরাতে উঠে খাতা-কলম নিয়ে বসে। চিঠি লিখবে। সব কিছু লিখে যাবে। যদি সুতপাকে না পায় তাহলে এই চিঠিটি রেখে আসবে। অন্ততঃ মনের কথাগুলো বলার একট শেষ সুযোগ। কিছুটা হলেও সান্তনার খোড়াক পাবে।

 

সকালে ঘুম থেকে উঠতে একটু দেরী হয়ে যায়। ছোট্ট একটি ব্যাগে প্রয়োজনীয় জিনিস পত্রগুলি গুছিয়ে নেয়। কাল রওনা দিবে।

 

সুতপার সাথে দেখা করবে বলে রওনা দেয় প্লানেরনায়ার উদ্দ্যেশ্যে।

আকাশটা বেশ পরিস্কার। চিঠিটা একটা খামে ঢুকিয়ে প্যান্টের পকেটে গুঁজে নেয়। অন্য কোথাও যাবে না। এমন কি নিজের রুমেও না। সোজা সুতপার কাছে যাবে। সব বুঝিয়ে বলবে। মাথায় কতোকিছু কিলবিল করছে। এলোমেলো ভাবনারা দাপাদাপি করছে। ভাবছে দেখা হলে কেমন করে বলবে। আর যদি দেখা না হয়! বেশী কিছু ভাবতে পারছে না। কেমন একটা ব্যাথা অনুভব করছে। দহনের যন্ত্রনা যেন সারা মন প্রান আচ্ছন্ন করে আছে।

 

ভাবতে ভাবতে এক সময় এসে হাজির হয় হোস্টেলের সামনে।

তর তর করে লিফ্ট নিয়ে সোজা ৮ তলায় চলে আসে। আর যেন অপেক্ষা ভালো লাগছে না। কখন দেখা হবে। সোজা সুতপার রুমের দরজার সামনে এসে দাঁড়ায়। একটু অপেক্ষা করে। বুঝার চেষ্টা করে ভিতরে কেউ আছে কিনা। নাহ্ কারো কোন সাড়া শব্দ পাচ্ছে না।

এবার দড়জায় নক করলো। একবার, দুইবার, তিনবার তার পর বেশ কয়েকবার। কিন্তু কেউ এসে দরজা খুলছে না। এবার নাম ধরে ডাকতে লাগলো-সুতপা-সুতপা-দরজা খোল, আমি অপুর্ব।

কিন্তু কোন শব্দ নেই, কারো কোন সাড়া নেই। মন হলো কেউ নেই ভেতরে। অন্য রুমেও কেউ নেই। থাকলে এতোক্ষনে কেউ না কেউ দরজা খুলতো।

অপুর্ব ভেঙ্গে পড়লো। খুব আশা করে এসেছিলো। মনে হলো জীবনের দরজা সুতপা চিরতরে বন্ধ করে দিয়েছে। আর হয়তো কখনো দেখা হবে না।

 

অপুর্বর চোখের কোনটা একটু একটু করে পোড়াচ্ছিলো। সব সম্বরণ করে পকেট থেকে চিঠিটা বের করে দরোজার নীচের দিকের ছিদ্র দিয়ে আস্তে আস্তে ভিতরে ঢুকিয়ে দিলো। কিছুক্ষন কি যেন ভাবলো। তার পর সেখান থেকে সোজা লিফ্ট ধরে নীচে নেমে আসে।

হাঁটতে হাঁটতে প্লানেরনায়া মেট্রো ষ্টেশনে চলে আসে।

আসার সময় চোখ দুটি রাস্তার দুপাশে ঘুরছিলো। যদি সুতপার সাথে দেখা হয়। কিন্তু দেখা হলো না।

 

মেট্রো রেল ধরে সোজা নিজের জায়গায়।

আজ আর কোথাও যাবে না। লন্ডন যাওয়ার এই আগের দিনটিতে একটু একা থাকবে। নাতালিয়ার সাথে সময় কাটাবে। এই কয়েক মাসে কেমন একটা মধুর সম্পর্ক গড়ে উঠে। নিজের গ্র্যান্ড সনের মতোই দেখেছে অপুর্বকে। কতো ঠাট্টা-মসকরা করেছে। নিজের হাতে রান্না করে খাইয়েছে। কোনদিন একটি পয়সা কড়িও নেয়নি। আজ অপুর্ব নাতালিয়াকে একটি গিফ্ট দেবে। অনেক আগেই কিনে রেখেছিলো। একটি পশমের মাফলার, এবং সোয়েটার। শীতে খুব কাজে লাগবে। এর থেকে বেশী কিছু দেওয়ার ক্ষমতা নেই অপুর্বর।

বাসায় ঢুকেই নাতালিয়াকে দেখতে পায়। একটি হাসি দিয়ে জিজ্ঞেস করে-

-সকালে কোথায় গিয়েছিলে?

-আমার হোস্টেলে। সুতপার সাথে দেখা করতে

-খুব ভালো করেছো।

কিন্তু অপুর্ব বলতে পারলো না যে সুতপার সাথে আজ দেখা হয়নি। মনের ভেতরে কেমন একটা চাপা কান্না ধরে রেখেছে। কাউকে বলতে পারছে না। নিজের দহনেই নিজে পুড়ছে।

এই সময় অপুর্ব রুম থেকে গিফ্ট এর ব্যাগটা আনলো। খুব সুন্দর একটা শক্ত কাগজের বক্সে ভাঁজ করা ছিলো জিনিসগুলি।

নাতালিয়াকে দুহাত দিয়ে বক্সটি দেয়-

-এই ছোট্ট একটি গিফ্ট তোমার জন্য। তোমাকে আমি কিছুই দিতে পারিনি। এইটা নিলে আমি খুশী হবো।

নাতালিয়ার চোখে বিস্ময়ের ছাপ। ভাবতেও পারেনি অপুর্ব ভালোবেসে ওকে কিছু দেবে। খুব অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে রইলো

কিছুক্ষন। তারপর বললো-

-কি আছে এখানে?

-তুমি খুলেই দেখ না?

হাতে নিয়ে নাতালিয়া বক্সটি এবার খুললো। উপরেই মাফলারটি ছিলো। হাতে নিয়েই তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়ায়। অপুর্বকে দুহাতে জড়িয়ে ধরে। স্পাশিবা স্পাশিবা (ধন্যবাদ ধন্যবাদ) বলে ওর দুগালে চুমু দিতে থাকে।

 

সেদিন অপুর্বর কাছ থেকে গিফ্টি পেয়ে নাতালিয়া খুব খুশী হয়েছিলো। চোখে মুখে ছিলো আনন্দ আর উচ্ছ্বাসের ঝলক। মাথায় হাত বুলিয়ে আশির্বাদ করেছিলো নাতালিয়া অপুর্বকে।

অপুর্বর চোখে একসময় জল এসে যায়। এমন সুখের আনন্দাশ্রু আগে কখনো আসেনি। দুপুরে এক সাথেই দুজনে খাওয়া দাওয়া করলো। অনেক গল্প হলো। হাসি তামাশ চললো অনেকক্ষন।

এক সময় অপুর্ব তার রুমে এসে বসলো। মনটা আবার খারাপ লাগছে। সুতপার কথা মনে পড়ছে। দেখা হয়নি বলে নানা দুঃশ্চিন্তাও মাথায় ভর করছে। কতোগুলো মাস ওর সাথে দেখা হয়নি। ভালোলাগার মানুষটিকে না দেখার, কাছে না পাওয়ার যন্ত্রনা যে কতো গভীর, বিষাদের তা কাউকে ভাষায় বুঝানো যায় না। আজ অপুর্বকে তীর বেঁধা আহত পাখির মতোই মনে হচ্ছে। যন্ত্রনায় ছটফট করছে।

মাথা থেকে ভাবনাগুলি আর মনের দহন থেকে ক্ষনিকের মুক্তির জন্য অপুর্ব এবার বিছানায় গা টা এলিয়ে দিলো। হাত দিয়ে বালিশটা টেনে তার উপর মাথাটা রাখলো। হালকা দেশ থেকে মায়ের দেয়া কাঁথাটা গায়ের উপর টেনে দিলো। কিছুক্ষনের মধ্যেই অপুর্ব ঘুমিয়ে পড়লো।

 

মধ্য বিকালে এই সময়টায় অপুর্ব মাঝে মধ্যে ঘুমাতে পছন্দ করে। কিন্তু আজকের এই ঘুম যেন নিজকে যন্ত্রনা থেকে কিছুক্ষনের জন্য মুক্তি দেওয়ার জন্য মনের বিরুদ্ধ জোর প্রয়াস।

 

বাইরে মস্কো তখনো ব্যস্ত, নগরীর বুকে হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে চলেছে মানুষ হিরন্ময় স্বপ্নের জ্যোতি বুকে ধারন করে। সারা শহরের যান বাহনগুলি ব্যস্ততার হর্ন বাজিয়ে চলেছে মানুষের স্বপ্নের সারথী হয়ে। অপূর্ব মস্কোর প্রকৃতি ভালো করে দেখতে থাকে। এ শহর তার ভালোবাসার, স্বপ্নের, মিথ্যার-বিচ্ছেদের। এই পান্ডুর সময়ের বুক চিড়ে আজ সে বিদায় নেবে। যার বিদায় জানানোর কথা ছিলো সে নেই। নাইবা থাকলো-একটা প্রত্যাশাতো থাকে। সেই প্রত্যাশার শূন্যতা আজ যেন শুধুই কষ্টের জ্যামিতি- ভাবতে ভাবতে ট্রেনের উদ্যেশে যাত্রা।

(চলবে---)



Read full book here: Click here to download the PDF file