মস্কোর বরফবিথী ও একজন সুতপা-পর্ব-২০


Author: ড. পল্টু দত্ত

পর্ব-২০

Summary:

সুতপা এবার দু’হাত দিয়ে মুখটি চেপে ধরলো। বির বির করে ভারী কন্ঠে বলতে লাগলো-

-আমি কি দোষ করেছিলাম তোমার সাথে? কেন আমার সাথে প্রতারনা করলে? ভেতরে ভেতরে এত বড় ঘটনা, একটু জানালে কি হতো। আমি না হয় এত কাছে আসতাম না। অপুর্ব এটা কেন করেছো- আমার এখনো বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় । আমার কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে আসে। আমার সঙ্গে শেষ পর্যন্ত তুমি এটা করবে আমি ভাবতে পারি না। বলো অপূর্ব-মিথ্যে করে হলেও বলো সব মিথ্যে।

 

একা একা বলতে বলতে সুতপা কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে।

উচ্চস্বরে তার এই কান্না মস্কোর হিমেল বাতাসে যেন ধাক্কা খায়। সুতপা কাঁদতে থাকে। ভীষন ভেঙ্গে পড়েছে সুতপা । অনেকক্ষন পর আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ালো। চোখের জলে মুখটা কেমন লেপ্টা লেপ্টা লাগছে। লিপিস্টিক দেয়া ঠোঁটগুলি চোখের কাজলে মিশে একাকার। কান্না জড়িত কন্ঠেই বাথরুমে ঢুকলো।

আয়নায় মুখটা পড়তেই আবার ডুকরে কেঁদে উঠলো। একসময় চোখ মুখ ধুয়ে এসে বালিশে মাথাটা এলিয়ে দিয়ে শুয়ে পড়লো। টেরও পায়নি কখন যে তিনটা বেজে গেছে। শুয়ে শুয়েই ভাবলো তার জীবনের ভালোবাসার গল্পের ইতি এখান থেকেই শুরু। জীবন থেমে থাকার জন্য নয়। এগিয়ে চলাই জীবনের ধর্ম। তাই সুতপাও এগিয়ে চলবে। অতীতকে ধীরে ধীরে ভুলে যাবে। পড়াশুনায় বেশী করে মনোযোগ দেবে। তাই আজ থেকে আর কোনদিন অপুর্বর সাথে দেখা করবে না। এ কথা ভাবতে ভাবতে আবারো চোখে জল এসে গেলো। উড়নার আঁচলে চোখ দুটি মুছে নিলো। সারা মন জুড়ে কেমন একটা চাপা কান্নার যেন বেদনা বিষাদে আর্তনাদ-করছে।

 

আজ এই মুহুর্তে সুতপার মায়ের কথা মনে পড়লো। বুকে টেনে নিয়ে মায়ের কথাগুলো- ‘ওই ছেলের কথা মাথায় আনবি না। ভালো করে পড়াশুনা করে দেশে ফিরে আয়। তুই রাজরানী হবি”।

কেমন একটা জড় অসারতা জড়িয়ে ধরেছে সুতপাকে। এতোক্ষন কান্নার পর মনে হচ্ছে কোন ব্যথা নেই, দুঃখ নেই, সুখ নেই, আনন্দ নেই, রাগ নেই, হিংসা নেই. কেমন অসাড়তা। হঠাৎ করেই যেন সব কিছু ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেল। এতোদিনের গড়া সুখের জতু গৃহ অবিশ্বাসের তাপ লেগে শেষ। সুতপার মনের মনিকোঠায়, যাকে নিয়ে বেঁধেছিলো স্বপ্নের মন্দির,  পিতামাতার পরে যে ছিলো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানুষ, সে আজ কোন সুদুরে মিলিয়ে গেল এক নিমিষে।

 

আজ আর কোন কিছুই ভাবতে ভালো লাগছিলো না সুতপার।

দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়।

কিন্তু সুতপার সময় যেন কোথায় কোন এক বাঁকে এসে থেমে যায়। শরীরটা বেশ দূর্বল লাগছে। এখনো কিছুই খায়নি। সেই যে সকালে একটু খেয়েছিলো তারপর পেটে আর কিছুই পড়েনি। খেতেও কিছু ইচ্ছে করছে না। বুকটা এখনো ধরফর করছে।

 

এদিকে অপুর্ব সুতপার অপেক্ষায় থাকতে থাকতে কেমন অস্বস্তিতে ভুগছে, একটা আশংকা কাজ করছে। আসলে সুতপা অসুস্থ হলো নাতো? সারাটা সকাল পড়াশুনায় ব্যাস্ত ছিলো। বিকেলে সুতপার সাথে কাটাবে, এক সাথে খাবে। দুইটার পর থেকেই সুতপার আসার প্রতীক্ষা। এমনটি কখনো আগে হয়নি। সুতপার সময় জ্ঞান খুবই প্রখর। কখনো সময়ের হের ফের হয়নি।

অপেক্ষা করতে করতে যখন চারটা বাজে তখন অপুর্ব চিন্তায় পরে যায়। এবার সে সিরিয়াস হয়ে যায়-কোন সমস্যা হয়নি তো সুতপার? কোন অসুখ-বিসুখ? আবোল-তাবোল ভাবতে লাগলো। এর মধ্যে দুই দুইবার হোস্টেলের রিসিপসনে ফোন করে সুতপাকে ডেকে দিতে রিকোয়েস্ট করেছিলো। কিন্ত দুই বারই সুতপা রুমে নেই বলে জানিয়েছে। এতে করে দুঃশ্চিন্তাটা আরো বেড়ে যায়। একটু পর পরই ট্রাম স্টেশন পর্যন্ত হেঁটে যায়। কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে সিগেরেট ফুঁকে। আবার চলে আসে।

রুমে এসে আনমনে পায়চারি করে।

 

নাতালিয়া অপুর্বর অস্থিরতা যেন বুঝতে পেরেছে। তাই এক সময় জিজ্ঞেস করলো-

-তুই কি কোন কিছু নিয়ে ভাবছিস? তোকে খুব চিন্তিত লাগছে বলে মনে হয়

-হ্যা, সুতপার আসার কথা ছিলো দুইটার পর, কিন্তু‘ এখনো এলো না। তাই একটু চিন্তিত।

-তুই না হয় একবার হোস্টেলে যা, হয়তো কোন সমস্যা হয়েছে

-আমি হোষ্টেলে ফোন করেছিলাম। জানালো সুতপা রুমে নাই। তাই ভাবনাটা আরো বেশী।

-চিন্তা করিস না। তুই তো মনে হয় সাড়াদিন কিছু খাসনি। একটু স্যুপ আর কাটলেট দিয়ে রুটি খেয়ে নে। একটু আগেই রান্না করেছি। খেয়ে দেয়ে হোস্টেলে যা

-তাই করবো ভাবছি।

নাতালিয়া টেবিলে খাবার নিয়ে এলো। খেতে বসে অপুর্ব তেমন কিছু খেতে পারেনি। একটু স্যুপ এক পিস রুটি দিয়ে খেল।

অপেক্ষার সময় যেন পার হয় না। মনে হচ্ছে আজ আর আসবে না। এখন রাত ৮টা। এতো দেরীতে সুতপা কখনো আসেনি। কিন্তু কেন এমন হলো ভেবে অপূর্ব কুল-কিনারা পায় না। তাই নাতালিয়াকে বলে অপুর্ব এক সময় হোস্টেলের উদ্যেশ্যে বেড়িয়ে পড়লো।

নাতালিয়াকে বলে যায়-

-আমার আসতে আসতে একটু লেইট হবে। তুমি চিন্তা করো না। আমি চাবি নিয়ে গেলাম। আর বেশী দেরী হলে আমি আজ রাতে সেখানে থেকে যাবো।

 

বিল্ডিং থেকে বেড়িয়েই অপুর্ব একটা সিগারেট ধরালো। চারিদিকে ধীরে ধীরে রাতের অন্ধকার যেন চাদর বিছিয়ে দিচ্ছে। ফকফকা নিয়ন বাতিগুলো মাথার উপরে জ্বলছে। আকাশটা এখন বেশ পরিস্কার। আর বৃষ্টি আসার সম্ভাবনা নেই। ট্রাম স্টেশনে আসতে আসতেই একটা ট্রাম পেয়ে গেলো। অপুর্ব সেই ট্রামেই চেপে বসলো। ট্রামটি একেবারে ফাঁকা ফাঁকা। যখন হোস্টেলে এসে পৌঁছায় তখন কাটায় কাটায় ঠিক সাড়ে নয়টা বাজে। তাড়াতাড়ি লিফ্ট ধরে সোজা ৮ তলায়। নিজের রুমে না গিয়ে সোজাসুজি সুতপার রুমে। জোড়ে জোড়ে নক করতে লাগলো। বেশ কয়েক বার নক করার পর যখন কোন সাড়া পেলো না, তখন অপুর্ব নাম ধরে ডাকা শুরু করলো। সুতপা-সুতপা আমি অপুর্ব দরোজা খোল--নাহ্ কোন সাড়াশব্দ নেই ভেতর থেকে।

কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে থেকে অপুর্ব তার রুমে ফিরে এলো। সেখানে সেলিম আর বেয়াই ছিলো। ওদের দুজনকেই খুব চিন্তিত মনে হলো। ভেতরে ঢুকেই সেলিমকে অপুর্ব বললো-

-সেলিম তোর সাথে আজ সুতপার দেখা হয়েছে?

-হইছে। সকালেও দেখা হইছে। আর সন্ধ্যর পরেও দেখা হইছে। একটু আগেই ওর রুম থেকে খাইয়া আইছি। তখনই জানলাম সুতপা আজ তোর ঐখানে যায়নি।

-কিন্তু কেন আসেনি, কিছু জানিস। আর আমিতো অনেকবার দড়জায় নক করলাম। দড়জাতো খুললো না। তুই কি কিছু জানিস, কি হয়েছে।

এর মধ্যে বেয়াই অপুর্বকে বললো-

-সারা সকালটাই আমি বেয়াইনের সাথে ছিলাম। আপনার ঐখানে যাবে বলে রান্না বান্না করলো। মনটা খুব ভালো ছিলো সকালে।

আমাকে জোড় কইরা খাওয়াইয়া পর্যন্ত দিছে। কিন্তু সেলিম ভাই এসে চিঠিগুলো দেওয়ার পর থেইক্কাই মনে হয় কিছু একটা হইছে।

-চিঠি, অবাক চোখে তাকালো সেলিমের দিকে।

-আমি আজ সকালে মিখলুখা মাখলায়া গেছিলাম। তোর হোস্টেল থেকে তোর কাছে আসা চিঠিগুলো এনে সুতপাকে দেই। তোর দেশ থেকে কয়েকটা চিঠি এসেছে। রাতে ওর রুমে ঢুকে আমি একটু আঁৎকে উঠি। ওকে কেমন কেমন লাগছিলো। বিমর্ষ, অসুস্থ। চোখগুলো বেশ ফোলা ফোলা। মনে হয় খুব কান্না-কাটি করেছিলো। মনটা ভীষন খারাপ ছিলো। তবে আমি এখনো বুঝতে পারছিনা ওর মন খারাপের কারনটা কি।

-কিছু বলেছে কেন আমার এখানে যায়নি?

-কেন যায়নি সেটা বলেনি। তবে আমি যখন তোর এখানে গিয়েছে কিনা জিজ্ঞেস করতেই কেমন রেগে গেলো। এই প্রথম সুতপার এমন একটা রুপ দেলাম। কন্ঠটা কেমন ভারী ভারী। অন্যদিকে তাকিয়ে একটু কঠিন সুরে বললো-

-না আমি যাইনি। আর কোনদিন যাবোও না। আপনার বন্ধুকে বলবেন আমার সাথে যেন আর কোনদিন ভুলেও দেখা না করে। আমিও সব কিছু ভুলে যাবো। ওর সব স্মৃতিকে আমি মুছে দেবো

এই কথা বলতে বলতে সুতপা কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে।

সেলিম একেবারে হতবাক। যে সুন্দর সকালকে দেখে সে বেড়িয়েছিলো সারাদিন এমন কি ঘটেছিলো যে সুতপার এমন চেহারা, এমন অস্থিরতা। এমন কথাতো সে কখনো আগে শুনেনি? একি কোন রসিকতা নাকি সত্যি সত্যিই। না শোনার ভুল? তাই আবার জিজ্ঞেস করলো-

-তুমি এভাবে কথা বলছো কেন, সুতপা? তোমাদের মধ্যে কি কিছু হয়েছে? আর তোমাকে এতো অসুস্থ লাগছে কেন? আমাকে খুলে বলো। তোমার ভাবনায় অপুর্বতো আবার অস্থির হয়ে উঠবে।

-আমার কিচ্ছু হয় নাই। আমাকে নিয়া আর কাউকে ভাবতে হবে না। আপনি শুধু একটু কষ্ট করে আপনার বন্ধুকে বলে দিবেন আমার সাথে যেন আর কখনো দেখা না করে

-আচ্ছা সেটা না হয় বললাম। কিন্তু‘ কারনটা কি? -সেলিম সুতপার দিকে চেয়ে চেয়ে কথাগুলি বলে।

তারপরে সুতপা এ প্রসঙ্গে আর কিছুই বলেনি। এক সময় একটা প্লেটে করে খাবার নিয়ে আসে সেলিমের জন্য। সেলিমও অবস্থাটা ঠাহর করতে পেরে আর কিছুই বলেনি। চুপ চাপ খাওয়া শেষ করে বেড়িয়ে যায়।

অপুর্বর মাথায় কিছুই ঢুকছেনা। খুব অস্থির অস্থির লাগছে। যে সুতপা অপুর্বর পায়ের শব্দ পেলেই উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠতো আজ

এতো নক করার পরেও একটুও সাড়া শব্দ করেনি। ব্যাপারটা একটু খটকা খটকা লাগছে। কি হয়েছে সুতপার?

 

-তুই এতো চিন্তা করিস না। আজ এখানেই থেকে যা। কাল সকালে দেখা করিস। কালতো রবিবার। কোথাও যাবে না-সেলিম অপুর্বকে বলে

-ঠিক আছে।-এই বলেই অপুর্ব ওয়াড্রপটা খুলে একটা লুঙ্গি আর গেঞ্জি বের করে।

-বেয়াই রান্না করছে। একটু খাইয়া নে-সেলিম অপুর্বকে বলে।

-নাহ্ খাবো না। খেতে ইচ্ছে করছে না। -অপুর্ব লুঙ্গিটা পড়তে পড়তে বলে।

অপুর্ব এবার একটা এক লিটারের এবসলোট ভদকার বোতল ফ্রিজ থেকে বেড় করলো। সাথে কিছু বরফ আর বাদাম, কোক এবং

তিনটি গ্লাস নিলো।

-সেলিম, গ্লাসে ঢাল।-এই বলে অপুর্ব টয়লেটে গেলো।

অনেক রাত পর্যন্ত চললো মদের আড্ডা।

একের পর এক পেগ গিলেই যাচ্ছিলো অপুর্ব। মাথাটা কেমন ঝিম ঝিম করছিলো। মুখ দিয়ে কেমন আবোল তাবোল বকে যাচ্ছিলো।

বেয়াই এবার মদের বোতলটা সরিয়ে নেয়। অপুর্ব এবার চীৎকার করে উঠলো-

-বোতলটা কই? আমাকে আরো দাও

-বোতল শেষ-সেলিম ভাঙ্গা ভাঙ্গা কন্ঠে বললো

-কি করে শেষ হলো। ফ্রিজ থেকে নিয়ে আস। আমি আরো খাবো।-এই বলে অপুর্ব কাঁদতে লাগলো।

সেলিম আর বেয়াই এসে অপুর্বকে সোফায় শুইয়ে দিলো। কিছুক্ষনের মধ্যেই অপুর্ব ঘুমিয়ে পড়লো। বেয়াই লাইটটা বন্ধ করে নিজের বেডে শুইয়ে পড়লো। সেলিমও বিছানায় এলিয়ে পড়লো।

 

ঐদিকে সুতপা ঘরেই ছিলো। পাশের রুমের সবাইকে বলে রেখেছিলো যেন সুতপাকে কেউ ডাকতে আসলে দরোজা না খুলে।

 

অপুর্ব যখন ডাকছিলো সুতপা তখন রুমেই ছিলো। এক অসহ্য যন্ত্রনায় ছটপট করছিলো। নিজকে সামলিয়ে নেয়। তাও অপুর্বর ডাকে সাড়া দেয়নি। সারাটা রাত্রে ঘুমাতে পারেনি। বিছানায় শুয়ে এপাশ -ওপাশ করেছে। বেশ কয়েকবার উঠে জল পান করেছে। পেটে প্রচন্ড ক্ষুধা অনুভব করছিলো। কিন্তু কিছুই খেতে ইচ্ছে করছিলো না। শেষ পর্যন্ত শেষ রাতের দিকে ঘুম আসে।

 

কখন যে ঘুমিয়ে পড়ে টের পায়নি। ঘুম থেকে যখন উঠে প্রায় দশটা বেজে যায়। চারিদিক বেশ ফর্সা। রাতে জানালার পর্দাটা টেনে দিতে ভুলে যায়। সকালের রোদের আলো এসে আছড়িয়ে পড়ে সারা রুমটিতে। ঘুম থেকে উঠতে গিয়েই রোদের ছিটকানি এসে লাগে চোখে মুখে। শরীরটা কেমন ম্যাজ ম্যাজ করছিলো। খুব দূর্বল লাগছিলো। উঠতে গিয়ে পড়ে যাচ্ছিলো। পাশে রাখা চেয়ারটায় হাতটা চেপে ধরে। এবার আস্তে আস্তে সোজা হয়ে দাঁড়ায়। রুমের দরজাটা খুলে বাথরুমে যায়। মনে হলো পাশের রুমে কেউ নেই। ছুটির দিন, হয়তো বেড়িয়েছে। রুমে ঢুকে চেয়ারটায় বসলো।

 

হঠাৎ দরোজায় ঠক ঠক করে কেউ যেন শব্দ করলো।

বেয়াইন বেয়াইন বলে ডাকছে। সম্ভবত বেয়াই। অনিচ্ছাসত্বেই উঠে গিয়ে দরোজাটা খুলে দিলো। হুর মুর করে বেয়াই রুমে এসে ঢুকলো। কোন কিছু ঠাহর করার আগেই অপুর্ব ভিতরে ঢুকে দরোজাটা বন্ধ করে দিল।

-আমি সরি বেয়াইন। এছাড়া আমার কোন উপায় ছিলো না। যতো বকাবকি করতে চান পরে কইরেন। এখন বেয়াইর সাথে কথা বলেন।-এই বলেই বেয়াই তাড়াতাড়ি রুম থেকে বেড়িয়ে যায়। অপুর্ব পেছন থেকে দড়জাটা বন্ধ করে রুমে এসে দাঁড়ায়-

-তোমাকে কাল এতো ডাকলাম, অথচ তুমি দরোজা খুললে না। সারাটাদিন তোমার প্রতিক্ষায় ছিলাম অথচ তুমি এলে না। বলবে, কি হয়েছে তোমার?

-সব কিছুর জন্যই কি আমাকে কৈফিয়ত দিতে হবে নাকি? আমার ইচ্ছে করেনি তাই যাইনি। আমার এখন কথা বলতে ভালো লাগছে না। তুমি এখান থেকে চলে যাও-শেষ কথাটা সুতপা একটু কঠিন সুরে বললো।

-চলে যাবো? কিন্তু কেন? আমি কি দোষ করেছি। আর এই একদিনে এমন কি হলো যে তুমি আমার সাথে কথা বলতেও চাচ্ছো না। আর কি আবোল তাবোল সেলিমকে বলেছো? কেন তুমি আমার সাথে আর দেখা করতে চাও না? দেখ আমাকে খুলে বলো। অন্ততঃ আমি জানি আমার অপরাধটা কি? চুপ করে থেকো না।

এবার সুতপা যেন অগ্নিমূর্তি হয়ে উঠলো। চোখ দুটি যেন রুদ্ররোষে ভরা। সারাটা শরীর যেন থর থর করে কাঁপছে। রাগ হলে সুতপার এই রকম হয়। চীৎকার করে বলতে লাগলো-

-অপরাধ? কার অপরাধ? তুমিতো কোন অপরাধ করতে পারো না। তুমিতো ছেলে। তোমরা তো কখনো অপরাধ করতে পারো না। সব দোষ আমাদের। আমাদের জন্য এতো সব অশান্তি। তুমি এখন এখান থেকে বেড়িয়ে যাও। তোমার মুখ আর আমি দেখতে চাই না। আমাকে আমার মতো থাকতে দাও।-বলতে বলতে সুতপা যেন হাঁপিয়ে উঠছে। চেয়ারটায় হাতটা ধরে মুখ ঘুরে দাঁড়ালো।

অপুর্ব একেবারে হতবাক। এমন রুপ সুতপার আগে আর কখনো দেখেনি।

-তুমি এতো উত্তেজিত হয়ো না। প্লিজ লক্ষীটি। আমার সাথে আর এভাবে কথা বলো না। আমি আর পারছিনা। আমাকে একবার শুধু খুলে বলো কি হয়েছে। যদি আমি কোন অপরাধ করে থাকি যা শাস্তি দেবে তাই আমি মাথা পেতে নেবো-এই বলেই অপুর্ব সুতপাকে ধরতে যায়।

এক ঝটকায় সুতপা অপুর্বর হাতটি সড়িয়ে নিয়ে প্রচন্ড জোড়ে অপুর্বকে একটি ধাক্কা মারে। কিছু বুঝার আগেই অপুর্ব সোফার

পাশের পড়ার টেবিলটিতে গিয়ে পড়ে। মাথাটি ঠং করে টেবিলের কোনায় লাগে। অপুর্ব ও মা বলে হাত দিয়ে মাথাটি চেপে ধরে। সুতপার ঐদিকে কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। তর্জনী উঁচু করে রুক্ষস্বরে অপুর্বকে শাসাতে লাগলো-

-খবরদার আমাকে ছোঁবে না। তোমার অপবিত্র হাত যেন আমার শরীরে না লাগে।

অপুর্ব তখনো নিজকে সামলাতে পারেনি। মাথাটি হাত দিয়ে চেপে ধরেই উঠতে উঠতে খুব কান্না জড়িত কন্ঠে বলতে লাগলো-

 

-আমি অপবিত্র? কি বলছো তুমি। তুমি একথাটা কি করে বলতে পারলে? আমি এমন কি করেছি যে আজ হঠাৎ করে আমি অপবিত্র হয়ে গেলাম?

-মনে হয় তুমি ভাজা মাছটা উল্টিয়ে খেতে জানো না? এই বলেই বালিশের নীচ থেকে চিঠিটা এনে অপুর্বর মুখে ছুড়ে ফেললো। সুতপা টের পায়নি যে চিঠিটার সাথে একটা খোলা বল পেন ছিলো। বলপেনটা সরাসরি অপুর্বর চোখের এক কোনে এসে লাগে। অপুর্ব চিৎকার করে উঠে যন্ত্রনায়। কিন্তু সুতপা তখনো গালি গালাজ করে যাচ্ছিলো-

-ভন্ডামির একটা সীমা আছে। ভালোবাসবে অন্যজনকে আর প্রেম করবে আরেক জনের সাথে। কতো বড় প্রতারক! এই বলেই আবার চিৎকার করে উঠে-

-তোমার সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই। আজ থেকে তুমি আর কখনো দেখা করতে আসবেনা। এতোদিন যা ছিলো সবই ভুল, একটা দিবা স্বপ্ন।

এবার অপুর্ব চিঠিটা হাতে নিয়ে চোখের সামনে নিলো। নামটা দেখেই সব বুঝতে পারলো। কিন্তু কি করে বুঝাবে যে এই চিঠির কোন মানে নেই। মস্কো আসার পর দুই একবার চিঠি বিনিময় হয়েছিলো প্রথম দিকে। দেশে পত্রমিতালীর মাধ্যমে পরিচয়। কিন্তু ওর সাথে অপুর্বর কোন সম্পর্ক নেই। দেশ থেকে মাঝে মধ্যে ওই এক তরফা চিঠি লেখে। অপুর্ব গত তিন বছরে কোন চিঠির উত্তর দেয়নি।

এবার অপুর্ব নিজকে একটু সামলে নিলো। অন্তত সুতপার রাগের কারনটা যেহেতু জানে এবার ওকে ব্যাপারটা খুলেই বলবে।

সুতপাকে এবার বললো-

-এই চিঠিটা পেয়েই বুঝি রাগ করেছ? -অপুর্ব আর শেষ করতে পারেনি

-তুমি আর সাফাই গাইতে হবে না। তুমি এখন এখান থেকে বেড় হও। আমি না হয় চিৎকার করবো।-বিড় বিড় করতে করতেই অপুর্বকে ঠেলে রুম থেকে বেড় করে দিয়ে ভেতর থেকে ঠাস করে দরোজাটা বন্ধ করে খিলটা লাগিয়ে দেয়।

অপুর্বকে বলারও সুযোগ দেয়নি।

অপূর্ব অনেকক্ষন দরোজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকলেও সুতপা আর ভ্রক্ষেপ করেনি।

রাগে ক্ষোভে অপমানে, লজ্জায় এক সময় সেখান থেকে চলে যায়। আর কোনদিন এই হোস্টেলের আট তলার ৮১৬ নম্বর দরোজায় এসে ঠক ঠক করেনি। সেখান থেকে সোজা চলে আসে নাতালিয়ার বাসায়। এমনকি আর কোনদিন প্লানেরনায়ার এই হোস্টেলে ফিরে আসেনি অপুর্ব।

আকাশে বেশ ঘোর ঘনঘটা। হিমের হাওয়া বইছে। কি এক হাহাকার ভেসে আসছে কোথা থেকে। পরানের গহীনে যেন যন্ত্রনার বুদ বুদ ওঠে। ককেসাসের চ’ড়ায় জিউসের ঈগল যেন সাঁই সাইঁ করে উড়ছে। অপূর্ব একটা সিগারেটে আগুন জ্বেলেছিলো বেশ আগে। সিগারেটটা পুড়তে পুড়তে এসে হাতে লাগে। অপূর্ব সিগারেট ছিটকে ফেলে আকাশে নক্ষত্রের গতিপথ দেখা খুঁজতে থাকে, নাঃ সিরাস, কানোপাস, ভেনাস তারাগুলো কোথাও নেই। পাখির ডাক নেই। কেমন ভদকার একটা গন্ধ ভাসছে বাতাসে-অপূর্ব হেঁটে চলে।

(চলবে---)



Read full book here: Click here to download the PDF file