Summary:
পর্ব-২
এস্ট্রোনমিতে ছাড়পত্র পেয়ে অপূর্ব যেন হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছে। ছাড়পত্রের ঘটনাটা একদম অপ্রত্যাশিত ভাবে ঘটে যাওয়া ছিলো মেঘ না চাইতে বৃষ্টির মতো। দেশ ছেড়ে বিদেশ বিভুঁইয়ে এসে যে অর্জনগুলি সেটা পাই টু পাই বুঝতে কষ্ট হয় না। এত পরিশ্রমের পর একটি ফল এভাবে অনায়াসে এবং অপ্রত্যাশিতভাবে চলে আসাটা যেন আজকের সূর্যস্নাত সকালের মতো ফিনফিনের রোদের মতো আবেশ ছড়ানো। আজ মস্কোর প্রকৃতি জুড়ে কনকনে শীত থাকলেও আকাশটা ছিলো খুব পরিস্কার। মায়ের আলাচাল ধোয়া হাতের মতো পরিস্কার করপুটের মতো স্বচ্ছ আকাশ- ঘন নীল চাদরে মোড়ানো। বৃষ্টি শেষে সমুদ্রের উপরের আকাশের মতো নীলময়।
সূর্য দেবীও আজ বেশ প্রচ্ছন্ন। বসন্তের নতুন পাতার মতো নরম রোদের আলোর ঝটকায় প্রকৃতির বুকে লেপ্টে থাকা সান পাথরের মতো সফেদ বরফের উপর দোল খেয়ে যাচ্ছে কি অপরূপ সৌন্দর্য। প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের মেজাজের সাজুয্যতা এখানে অনেকটাই টের পাওয়া যায়!
নিকোলাই ভ্লাদিমিরভিচ খুব সহজ কয়েকটি প্রশ্ন করেছিলেন। উত্তর দিতে তেমন কোন সংকটের মুখোমুখি হতে হযনি অপূর্বর। ফিজিক্স ডিপার্টমেন্টের শিক্ষকদের মধ্যে এই ফুর ফুরে মেজাজের শিক্ষকটি ছিলেন সবচেয়ে সুদর্শন এবং স্মার্ট। চোখ-মুখ সব সময় কেমন একটা পবিত্রতা স্থির হয়ে থাকে। কাশ্মীরী আপেলের মতো কপালের রং দৃষ্টি সীমার ভেতরে আসার মতো। ছাত্রীরাও অনায়াসে দৃষ্টি নন্দন স্মার্ট এই শিক্ষকের কাছে নানা বাহানায় চলে আসতে পছন্দ করে। একটু গা ঘেঁষে বসতে পছন্দ করে অনেকেই।
খুব বিনয়ী ছিলেন নিকোলাই ভ্লাদিমিরভিচ-তার জন্য জন্য অপ্রাপ্তির কিছু নয়।
জীবন বাস্তবতা যে কতো কঠিন হতে পারে তার কিছুটা ইঙ্গিত দিলেন শিক্ষক। কথাগুলো অপূর্বর খুব ভালোই লেগেছে। অবশ্যই ছাড়পত্র পাওয়ার উচ্ছ্বাসের কারনেই বটে। তবে কথাগুলো শুনার পর কেন জানি অপুর্বকে খুব অসহায় মনে হচ্ছিলো। মনে হচ্ছিল এই প্রাপ্তির পরেও কি ভেবে যেন এক অন্ধকার বলয়ে হাবুডুবু খাচ্ছে সে। সেখান থেকে কোন কিছু হাতড়ে ধরে উঠে আসা দুঃসাধ্য। খুব তাড়াতাড়িই ঘুম থেকে উঠেছিল আজ অপুর্ব। পরীক্ষা না থাকলে আজি সে উঠতেই চাইতো না। এলার্মের আওয়াজেও সে উঠতো না। কিন্তু সমস্যা হয়ে দাঁড়ালো রেডিওটা। রেডিওর শব্দে সে উঠে বসেছিলো। রেডিওটা অপুর্বর খুব পছন্দের। বাংলাদেশের স্মৃতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত এই রেডিওটা। দেশের বাড়ি কুমিল্লার স্কুলে পড়াকালীন সময়ে বাড়ীতে ছোট্ট একটা রেডিও ছিলো ছোড়দাদা কুমিল্লা শহর থেকে থেকে কিনে এনেছিলেন এটা। তখন সিনেমার গানের জনপ্রিয়তা খুব। পড়ার মাঝে সিনেমার গান শুনতো অপূর্ব।
গ্রামের বাড়ি থেকে যখন ঢাকায় পড়তে চলে আসে তখন উঠে বড় দাদার বাসায়। রেডিওর কথা মনে করে অপুর্বর খুব মন খারাপ হতো। তবে মন খারাপের দিন আর বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। কারন কিছুদিনের মধ্যেই বড় দাদার বাসায় এবার টেপরেকর্ডার চলে আসলো। টেপরেকর্ডারের ক্যাসেট প্লেয়ারে নিজের পছন্দমতো গানের ক্যাসেট কিনে ফেললো। সময় পেলেই নিজের পছন্দের শিল্পীদের গান চালিয়ে ইচ্ছে মতো শুনতো। সে দিনগুলির কথা মনে পড়লে এই প্রবাসে মনটা খুব আবেগ প্রবন হয়ে উঠে। একলা রুমের মধ্যে ভাবতে ভাবতে চোখের দৃষ্টিপথ ঝাপসা হয়ে আসে। বুক ভিজে যায় মনের অজান্তেই। চোখের পাতাগুলো বিষাদগ্রস্থতার আবেশে নুয়ে পড়ে। মায়ের কথা, বোনের কথা এবং পরিবারের কথা সেলুলয়েডের ফিতার মতো একে একে চলে আসতে থাকতো। মনের চতুষ্কোনে জমা কতো কথা ভেসে উঠতো। পরিবারের সকলের ছোট ছিলো অপুর্ব, তাই আদরের পরিমানটা একটু বেশীই ছিলো তার জন্য। এই প্রবাসেও অপুর প্রিয় জিনিস গুলির একটি হলো রেডিও।
মস্কোর প্রতিটি হোস্টেলের রুমের দেয়ালের সঙ্গে একটি করে আকাশী রংয়ের রেডিও থাকতো। সকাল ছয়টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত বাজতো রেডিও। অপুর্ব প্রায় সময়ই ঘুমানোর সময় রেডিওটি অন করে রাখতো, বিশেষ করে কখনো যখন খুব সকালে উঠার প্রয়োজন থাকতো। সকাল ঠিক ছয়টায় রেডিওটি বাজা শুরু করতো দেশ বিদেশের খবর দিয়ে। সে সময় মস্কোর পরিবেশটাই ছিল একটু অন্যরকম। আজকের জীবন ধারা থেকে পুরোপুরি আলাদা। উদ্যম আর উচ্ছ্বাসের সেই দিনগুলোতে সবার মধ্যেই ছিল সৌহার্দ্য ও আন্তরিকতার একটা অদৃশ্য বন্ধন। পরিবার- পরিজন ছেড়ে এতো দূরে চলে আসলেও দেশীয় ভাইবোনেরা অপুর্বর একাকীত্বকে কখনোই অনুভব করতে দেন নি। প্রথম মাস দুয়েকতো রান্না করার প্রয়োজনই হতো না। সিনিয়রদের- সমসাময়িক ভাই বোনদের রুমে নেমন্ত্রনের পালা চলতো। কি মধুর সম্পর্ক ছিলো সবার মধ্যে। তা বলে শেষ করার মতো না। মিলে মিশে থাকার এক এই সামাজিক দর্শন মস্কোতে এসে প্রথম ভালোলাগার বিষয় ছিলো। ভালোবাসার যে বন্ধন-ভ্রাতৃত্বেও যে আত্মিক টান তৈরী হয়েছিলো দূর প্রবাসের দিনগুলোতে-সেইসব সোনাঝরা দিন আজও এতটাই অমলিন যে, এতোদিন পরেও অপুর্বর অনেক কিছুই এখনো বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে যায় নি। কতো ঘটনা না স্মৃতির পর্দায় ভেসে উঠে তা বলে শেষ করার মতো নয়।
সোভিয়েত ইউনিয়নে আসার প্রথম দিনের অনুভূতি আর সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে যাওয়ার বেদনার সেইসব স্মৃতির কথা ভাবতেই ইটের টুকরোর মতো যেন সব ঝর ঝর করে পড়তে থাকে। হৃদয়ের এফোঁড়-ওফোঁড় করার বেদনা অন্তহীন-পানেই যার –কিনারা নেই। কেমন করে সব কিছু ওলট- পালট হয়ে গেলো সব বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো। এক ভয়ানক ঝড় এসে যেন সব কিছু এক লহমায় তছনছ করে দিয়ে গেলো চোখের সামনেই । সব প্রত্যক্ষ করা ছাড়া আর কারো কিছু করার ছিলো না। জীবনের বার বার বাঁক বদল অপুর্বকে যেন এক ঝড়োমানব করে তোলে। একবার গ্রাম ছেড়ে ঢাকায় আসা, ঢাকা থেকে মস্কো, মস্কোর ভাঙন সব ঝড় যেন অপূর্বকে তাড়া করছে। অপূর্ব ছুটছে আর ছুটছে। এই ছোটার শেষ কোথায়? তা সে জানে না। অপুর্ব গ্রাম থেকে এস সোভিয়েত সমাজটাকে খুব ভালো বাসতো। সব কিছুই কেমন সাজানো গুছানো ছিলো। নান্দনিকচেতনায় মানুষ ছিলো খুব উৎফুল্ল।
চারিদিকে ছিলো দক্ষিনা হাওয়ার মতো এক স্বর্গীয় অনুভূতি। যেমনটি ছিলো সুতপার চোখে। সমুদ্রের বিশালতা, আকাশের ব্যাপকতা আর হৈমন্তী-গৌধূলীর পূর্ণতা। সুতপা যেন অপুর্বর জীবনের এক সুন্দর ভোরের কাব্য, গৌধূলীর অস্তরাগের সমীরন, অলকানন্দার জলে ভেসে বেড়ানো শুভ্র হাঁসেদের শব্দের জলসিঁড়ি।
অপুর্ব ভাবতে লাগলো সেই দিনগুলিতে, সোভিয়েত ইউনিয়ন তার নাগরিকদের উপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ রাখতো, তাতে সন্দেহ নেই। তবে নাগরিক সুযোগ সুবিধা দেওয়ায় রাষ্ট্র ছিলো প্রতিশ্রতিবদ্ধ। অপুর্ব বলতো বরং পশ্চিমা স্বাধীনতা আর গনতন্ত্রে বন্দিত্বের বেদনা থাকে তীব্র। স্বাধীনতার কথা বলে কিন্তু আদতে কেউ স্বাধীন নয়। সমাজতান্ত্রিক সমাজ ব্যাবস্থাটা ছিলো সাজানো গুছানো একটি বাগানের মতো। রাষ্ট্র সে বাগানের ভরন-পোষনে সদা নিয়োজিত। আর বাগানের গাছগুলো উপযুক্ত পরিবেশ পেয়ে নিজের মতো করে বেড়ে উঠতো। ফুটতো সে বাগানে নানা রং এর ফুল। ফুলের বাগান হতো গর্বিত। ফুলের সুভাষ ছড়িয়ে পড়তো চারিদিকে।
সেই সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি হোস্টেলের রুমের থাকা রেডিওতে সোভিয়েত ইউনিয়নের বাইরের বর্তমান ঘটনাগুলির খবর এবং তথ্য পাওয়ার খুব সহজ উপায় ছিল এই রেডিওগুলি। এটি হোস্টেলে বসবাসকারী শিক্ষার্থীদেরকে আভ্যন্তরিন সংবাদ সহ বৈশ্বিক রাজনীতি এবং অর্থনীতির পাশাপাশি আন্তর্জাতিক সংস্কৃতি এবং জীবনধারার প্রবণতা সম্পর্কে অবগত থাকতে সাহায্য করতো। বিদেশী সংবাদ এবং সঙ্গীতের অ্যাক্সেস প্রদানের পাশাপাশি, অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের হোস্টেলে শিক্ষার্থীদের-চালিত রেডিও স্টেশনগুলিও ছিল যে গুলি স্থানীয় বিষয়বস্তু যেমন বক্তৃতা, বিতর্ক এবং দিনব্যাপী ক্যাম্পাসের সংবাদ আপডেট সম্প্রচার করত। এই স্টেশনগুলি ছাত্রদের মধ্যে যোগাযোগের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হিসাবে কাজ করতো। এই রেডিওতেই সোভিয়েত সংগীতের রানী আল্লা পুগাচভার গান তন্ময় হয়ে শুনতো অপুর্ব। প্রথম দিকে গানের অর্থ না বুঝলেও পরে সব কিছুই কেমন রপ্ত হয়ে গেলো। শ্রদ্ধেয় নিকোলাই ভ্লাদিমিরভিচ খুব কষ্ট পেয়েছিলেন সোভিয়েত ভাঙ্গনে।
‘এতা ট্রাগিজিয়া, এতা অচিন প্লখা, এতা পারাঝেনিয়ে চেলাভিস্তেবা (এইটা ট্র্যাজেডি, এইটা খুব খারাপ, মানবতার পরাজয়)”-খুব ভারাক্রান্ত হৃদয়ে আমার দিকে চেয়ে এই কথাগুলো বললেন।
আমি শুধুচেয়েই থাকলাম।
“প্রাবিতেলসতবা দিয়েলানা বলশুয়ু আশিবকু, নি প্রাসিব লুদেই (জনগনের মতামত না নিয়ে সরকার একটা বড়ো ধরনের ভুল করেছে)”।
একজন শিক্ষকের কাছ থেকে এমন কথা আগে কখনোই শুনেনি অপুর্ব।
অপুর্ব ভাবতে লাগলো-হায় ঈশ্বর! তুমি সর্বেসর্বা! তুমি মহান প্রতিপালক, অধীশ্বর! শক্তি দাও আমায়। আমি যেন এই অন্ধকার বলয় ভেদ করে আলোর বর্তিকা নিয়ে ভবিষৎতের দিকে এগুতে পারি। আমি জীবনে কিছু চাই না। চাই মানুষের মতো মানুষ হতে। আমি কি পেলাম না তা নয়, আমি কি পেলাম তা নিয়ে যেন সন্তুষ্ট থাকতে পারি।
মাথার ভিতরে কতো স্মৃতিই না ভেসে বেড়াচ্ছে। ভাবতে লাগলো। নিজ দেশে আত্মীয় পরিজন রেখে হাজার মাইল দুরে আজ আমি। যে উদ্দেশ্যে সাময়িক ভাবে হলেও গুরুভার বেদনার বোঝা নিয়ে এসেছি সেটা যেন সফল সমাপ্তির রূপ পায়। হে ঈশ্বর! তুমি আমাকে পথ দেখাও। অতীতকে নিয়ে আর ভাবতে চাই না। সামনের দিকে এগুতে চাই।
এক নম্বর ব্লকের বুফেতে সকালের ব্রেকফাস্টটা সেরে নিলো। এই বুফেতটার সাথে অপুর্বর যেন একটা পরম আত্মীয়তার সম্পর্ক। অপুর্ব থাকে দুনম্বর ব্লকের চার তলায়। তার ব্লকে কোন রেস্টুরেন্ট নেই। আর এক নম্বর ব্লকটি একেবারেই তার ব্লক ঘেঁষে। তাই সব সময় সকালের খাবারটা এখানেই খায়। খাবারও খুব রুচিপূর্ন। মাত্র ৬৬ কোপেকে সকালের রাজকীয় খাবার যাকে ইংলিশ ব্রেকফাষ্ট বলা হয়। শশেজের সাতে ডিম, মাশরুম আর সবুজ বিনস দিয়ে বানানো এবং সাথে থাকে দুপিস কালো রুটি, যাকে বলে জম্পেস খাবার। আপেলের ফ্রেস জুসতো থাকবেই। রান্না ঘরের সবাই যেন তার পরিচিত।
ইদানীং খাবারের জন্য অপুকে আর কিছুই বলতে হয় না। তাকে দেখলে ওরা বুঝতে পারে। এটাই যেন ওর নিত্যদিনের সকালের খাবার।
এই যে মধ্যবয়সী খুব হাসি খুশী, স্কার্ট পড়া, মুখে দুটো সামনের দিকে সোনার দাঁত বাঁধানো, পা দুটি মোটা মোটা কলাগাছের মতো, মখে সব সময়ই হাসির একটা প্রশান্তির রেখা উদ্ভাসিত ওর নাম মেরিনোভা। মারিনা বলেই ডাকি।
আমাকে দেখলেই বলবে:
ছিনক, কাক দেলা (কেমন আছো ছেলে?)।
এই ছিনক বা ছেলে বলে সম্বোধন করাটাকে অপু খুব পছন্দ করতো। মায়ের পরশ যেন সারা গায়ে ছড়িয়ে পড়ে। কি এক স্বর্গীয় সুখ অনুভব করে অপুর্ব-তখন মায়ের কথাটাই তার চোখে মুখে দিব্য হয়ে উঠে।
অচিন খারাশো (খুব ভালো আছি)-প্রতুৎত্তরে অপুর্ব
আ কাক বাসে দেলা (আপনি কেমন আছেন)? -অপু জিজ্ঞেস করতো।
খুব একটা প্রানবন্ত সোনালী দাঁতের মুখ থেকে বেড়িয়ে আসতো
“মি তোঝে অচিন খারাশো (আমিও খুব ভালো আছি)”।
“দাবাই শেস্ত জেসিয়াত সেস্ত কোপেক (৬৬কোপেক দাও)”। পয়সা দেওয়ার জন্য বলতো।
কি খাবো কিছুই জিজ্ঞেস করতো না। সে জানতো অপুর্ব কি খায়।
পয়সা দিয়ে অপুর্ব টেবিলে গিয়ে বসলো ডাকের আশায়।
ঠিক বিশ মিনিটে খাবার শেষ করে অপুর্ব বেড়িয়ে পড়লো। তবে বুফেত থেকে বেরুনোর আগে মারিনাকে “দাসফিদানিয়া” (অর্থাৎ বিদায়) বলতে ভুলে নাই।
বেড় হয়েই রওনা দিলো ইউনিভার্সিটির উদ্দেশ্যে। যেতে হবে দানস্কায়া যেখানে অপুর্বর ফিজিক্স ডিপার্টমেন্ট। ঘন্টা খানেক লাগবে।
ভাড়া মাত্র ৫কোপেক। কি সস্তা ছিলো মস্কোর পাতালরেল ব্যাবহার। প্রথমে যেতে হবে বিলায়েভা মেট্রো ষ্টেশনে। সেখান থেকে পাতালরেল ধরে সাবলবস্কায়া অথবা তার আগের ষ্টেশন লেনিনস্কী প্রসপেক্ট। দুই ষ্টেশন থেকেই ট্রাম বাসে করে গন্তব্যে যাওয়া যায়। তবে অপুর্ব বেশীর ভাগ সময়ই লেনিনস্কী প্রসপেক্ট হয়ে ইউনিভার্সিটিতে যায়। তার একটা বিশেষ কারনও আছে। এইখানেই গগনচুম্বী গ্যাগারিনের মূর্তি। আর জায়গাটার মধ্যে একটা সামুদ্রিক বিশালতা আছে। বেশ প্রশস্থ এবং খোলামেলা জায়গা। মাজ দিয়ে চলে গেছে মস্কোর সবচে দীর্ঘ লেনিনস্কী প্রসপেক্ট যার এক মাথায় অপুর্বর ইউনিভার্সিটির (পিপলস ফ্রেনডশীপ ইউনিভার্সিটি) প্রধান ভবন এবং ইউনিভার্সিটির প্রধান সড়ক মিখলুখা মাখলায়া অবস্থিত। আর এই রাস্তার পাশ দিয়েই থরে থরে সাঁজানো হয়েছে হোস্টেল গুলো। ১১টা বিল্ডীং। তার মধ্যে ৮টা বিল্ডিং ৫তলা বিশিষ্ট আর বাকিগুলো ২০তলা বিশিষ্ট। অন্য প্রান্তে বিশ্বখ্যাত ক্রেমলিন, রেড স্কয়ার।
অপুর্বর ভাবনায় আবার ভর করলো লেনিনস্কি প্রসপেক্ট আর ইউরি গ্যাগারিন।
১২ই এপ্রিল, ১৯৬১ সালে, সোভিয়েত মহাকাশচারী ইউরি গ্যাগারিন মহাকাশে ভ্রমণকারী প্রথম মানুষ হয়েছিলেন। ভস্টক ১-এ তার ঐতিহাসিক ১০৮-মিনিটের ফ্লাইট মানবতার জন্য এবং বিশেষ করে সোভিয়েত ইউনিয়নের জন্য একটি বড় মাইলফলক হিসেবে চিহ্নিত। এই কৃতিত্বকে স্মরণ করার জন্য, মস্কোর লেনিনস্কি প্রসপেক্টকে গ্যাগারিন এবং তার অবিশ্বাস্য যাত্রার জন্য উত্সর্গীকৃত একটি স্মৃতিস্তম্ভের স্থান হিসাবে বেছে নেওয়া হয়েছিল। তাইতো এই রোডটি অপুর্বর এতো পছন্দ। এখানে আসলেই অপুর্বর মনটা বিশাল হয়ে যায়। কতোবার এই লেনিনস্কি প্রসপেক্টে এসছিলো সুতপাকে নিয়ে তার হিসেব নেই। মূর্তির পাদদেশে বসে কতো স্বপ্নের আল্পনা একেছে।
ইউরি গ্যাগারিনের স্মৃতিস্তম্ভটি মস্কোর লেনিনস্কি প্রসপেক্ট এবং আকাদেমিকা কোরোলেভা স্ট্রিটের সংযোগ স্থলের কাছে অবস্থিত। এটি ১৪ মিটার লম্বা এবং প্রায় ৫০ টন ওজনের, এটিকে সমগ্র রাশিয়ার সবচেয়ে চিত্তাকর্ষক স্মৃতিস্তম্ভগুলির মধ্যে একটি করে তুলেছিল। স্মৃতিস্তম্ভটিতে গ্যাগারিনকে ৪-মিটার লম্বা রকেটের উপরে বসে তার বাহু আকাশের দিকে প্রসারিত করে দেখানো হয়েছে - এটি তার অগ্রগামীচেতনা এবং সংকল্পের প্রতীক যা তাকে মহাকাশে প্রথম মানুষ হতে পরিচালিত করেছিল।
কি চমৎকার স্ট্যাচু। চোখে না দেখলে কল্পনায় আনা একটু কষ্টসাধ্য ব্যাপার।
ভাস্কর আনাতোলিনোভিকভ স্মৃতিস্তম্ভটি ডিজাইন করেছিলেন এবং ২৭ অক্টোবর, ১৯৮০ - গ্যাগারিনের স্মৃতিসৌধটি তার মহাকাশ যাত্রার ১৯ বছর পরে উন্মোচন করা হয়েছিল। এটি তখন থেকে সারা বিশ্বের পর্যটকদের কাছে একটি জনপ্রিয় স্পট হয়ে উঠে যারা ইতিহাসের অন্যতম সেরা স্বপ্নদর্শীকে শ্রদ্ধা জানাতে আসতেন। এর আশেপাশের অঞ্চলটি মহাকাশ অনুসন্ধানের সাথে সম্পর্কিত আরও কয়েকটি স্মৃতিস্তম্ভের আবাসস্থল, যার মধ্যে সের্গেই কোরোলেভ (ভোস্টক ১ এর পিছনে প্রধান ডিজাইনার) এবং ভ্যালেন্টিনা তেরেশকোভা (প্রথম মহিলা মহাকাশ যাত্রী)। পর্যটকদের আকর্ষণের পাশাপাশি, ইউরি গ্যাগারিনের স্মৃতিস্তম্ভটি মহাকাশ অনুসন্ধানে রাশিয়ার অগ্রণী ভূমিকার একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুস্মারক।
এখানে আসলেই অপুর্বর মনে হতো সে যেন ইতিহাসের বুকে হামাগুড়ি দিয়ে ইতিহাসকে উপলদ্ধি করছে।
আজ অপুর্ব লেনিনস্কি প্রসপেক্টের মেট্রো ষ্টেশনেই নামলো। ঘড়ির দিকে তাকালো এক নজর। এখনো আটটা বাজেনি। পরীক্ষা শুরু হবে নয়টায়। মৌখিক পরীক্ষা। মেট্রো থেকে বেড় হওয়ার সাথেই তুলোর মতো হালকা তুষারের হাওয়া চোখে মুখে আছড়িয়ে পড়লো।
কিন্তু সকালে কোন তুষারপাত ছিলো না। শালার শীত! বিরক্ত হয়ে বির বির করতে লাগলো। ঠক ঠক করে হাঁটা শুরু করলো ট্রাম বাস ষ্টেশনের উদ্দেশ্যে। ৫ মিনিটের রাস্তা। তবে বাইরে যতোই কন কনে ঠান্ডা আর তুষারপাতের উপদ্রপই থাকুক না কেন অপুর্বর কোন ভয়নেই। সারা শরীর একেবারে পা থেকে মাথা পর্যন্ত আচ্ছাদিত।
হাঁটতে হাঁটতে অপুর্ব আবার পাতাররেল (যাকে মেট্রো বলেই সবাই জানে) এর কথা ভাবতে লাগলো। প্রথম প্রথম উঠতে খুব ভয় পেতো। এসকেলেটরে দাঁড়িয়ে থাকাটা এক ভয়ানক ব্যাপার মনে হতো। খুব নীচুতে থাকতো পাতালরেল। এসকেলেটরে দঁড়িয়ে নীচের দিকে তাকালে অপুর্বর যেন মাথা ঘুরাতো। বড়োদের কাছে শুনেছে কোন এক সিনিয়র ভাই সরকার দাদা নাকি ছয় বছরের সোভিয়েত জীবনে কোন দিন এসকেলেটরের ভয়ে মেট্রো ব্যবহার করেন নি। যদি এসকেলেটর ভেঙ্গে পড়ে যায়!
মস্কো মেট্রো এক অসাধারন যাত্রী পরিবহন। ১৯৩৫ সালে নির্মাণের পর থেকে এইমেট্রো মস্কোর জীবনের একটি প্রধান যানবাহনে পরিনত হয়। বিশ্বের সবচেয়ে দক্ষ পাবলিক ট্রান্সপোর্ট সিস্টেমগুলির মধ্যে একটি হিসাবে ডিজাইন করা হয়েছিল, এবং আজো অব্যাহত রয়েছে। তবে ১৯৮০-এর দশকে, মস্কো মেট্রোতে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আনা হয়েছিল মস্কো বাসিদেরকে আরো উন্নত মানের সেবা প্রদানের লক্ষ্যে। ১৯৮৫ সালে, মস্কো মেট্রো দক্ষতা বাড়াতে এবং অতিরিক্ত ভিড় কমাতে তাদের ভূগর্ভস্থ ব্যবস্থার উন্নতি করতে শুরু করে। পরিকল্পনার মধ্যে ছিলো আট বছরের ব্যবধানে লাইনের সংখ্যা ১৩ থেকে ২২-এ বৃদ্ধি করা,শহর জুড়ে নতুন স্টেশন সংযোগ করা, এবং পিক সময়ে আরও যাত্রী পরিবহন করার জন্য ট্রেন পরিষেবা বৃদ্ধি করা। সমস্ত স্টেশনগুলিতে আরও ভাল আলো এবং সুরক্ষা ক্যামেরা যুক্ত করে সুরক্ষা ব্যবস্থাগুলিকে উন্নত করা হয়েছিল সেই সময়ে।
মস্কোর মতো এতো চমৎকার পাবলিক ট্রানসপোর্ট সিস্টেম পৃথিবীর আর কোথাও চোখে পড়েনা। সারা শহরটাকে সর্পিলাকারে আষ্টে পিস্টে গোলকার মতো জড়িয়ে আছে মস্কো মেট্রোর কয়েকশ’ স্টেশন আর উপরে অবিরত পরিষেবা দিয়ে যাচ্ছে লম্বা দুইস্তর বিশিষ্ট ট্রলিবাস, বাস, ট্রাম বাস। বিরামহীন ভাবে মস্কোবাসীকে দিনরাত টেনে নিয়ে চলেছে গন্তব্যে।
শুধুই কি তাই? মস্কো নদীও কি কম যায়?
মস্কো নদীর তীরে অবস্থিত, রাশিয়ার রাজধানী শহরটি বিশ্বের অন্যতম সুন্দর শহর। এর আইকনিক রেডস্কোয়ার, গ্র্যান্ড ক্যাথেড্রাল এবং বিখ্যাত গম্বুজগুলির তীর ঘেঁষে বয়ে যাওয়া মস্কো নদীতে ভ্রমণ ছাড়া মস্কোর উচ্ছ্বাসের আমেজ পূর্ন হবে না। মস্কো নদীতে বিশ্বের অন্যতম সেরা নদী পরিবহন ব্যবস্থা রয়েছে, যা অবসরে নৌকায় চড়া থেকে দ্রত যাত্রী ফেরি পর্যন্ত সবকিছুর এক সুন্দর অভয়ারন্য, যোগাযোগের উত্তম নদী পথ। মস্কো নদী এই প্রাণবন্ত শহরের জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এটি মস্কোর কেন্দ্রস্থল দিয়ে সর্পিলাকারে প্রবাহিত এবং এটি পিটার দ্যগ্রেট, সামার প্যালেস, ক্রাইস্ট দ্য সেভিয়র ক্যাথেড্রাল, নোভোডেভিচি কনভেন্ট এবং আরও অনেক কিছুর মতো ঐতিহাসিক স্মৃতিস্তম্ভ এবং আকর্ষণের আবাসস্থল। এর সেতুর নেটওয়ার্কের মাধ্যমে মস্কোর নানা জায়গায় বিস্তৃতসৌন্দর্যকে অন্বেষণ করা সহজ করে তোলে। মস্কোতে নদীপথে ভ্রমণের সবচেয়ে জনপ্রিয় উপায় হল হাইড্রোফয়েল বা রিভার বাস পরিষেবা। এই নৌকাগুলি ২২-৫০ কিমি/ঘন্টা গতিতে চলে হাইড্রোফয়েলগুলি শহরের মধ্যে অন্যান্য ধরণের পরিবহনের তুলনায় আরামদায়ক এবং তুলনামূলকভাবে সস্তা।
এই নদী ঘেঁষে অপূর্ব কতোবার না সুতপাকে নিয়ে হেঁটে বেড়িয়েছে। নানা আল্পনার রংধনুতে মনের কথাকে প্রকাশ করতো একে অপরকে। উদীয়মান সূর্য কখন যে অস্তরাগে আবীর ছড়াতো টেরই পেতোনা কখনো কোন সুন্দর মুহূর্তে। ভাবনার অলি গলি দিয়ে ঘুরতে ঘুরতে কখন যে নিজের ডিপার্টমেন্টে এসে পোঁছালো কিছুই ঠাহর হলো না অপুর্বর। তর তর করে একেবারে তিন তলায় চলে এলো। সরাসরি পরীক্ষার রুমে।
(চলবে---)
Read full book here: Click here to download the PDF file