মস্কোর বরফবিথী ও একজন সুতপা


Author: ড. পল্টু দত্ত

পর্ব-১৮

Summary:

সবাইকে কেমন বিধ্বস্থ লাগছিলো। ক্লান্ত-অবসন্ন। যেন যুদ্ধ শেষ করা পরাজিত সৈনিক। অপুর্ব অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলো ক্ষনকাল। যেন অজানা কোন বিপদের শংকা। বুকটা ধড়ফড় করে উঠলো। কপালের দু’পাশে পড়ন্ত বেলার রোদের আবছায়া যেন লেপ্টে আছে। ঘাম ভাসছে অবয়বে। সাহারার তাপদাহ যেন রান্না ঘরটিতে। হঠাৎ হৈ চৈ এর আওয়াজ আছড়ে পড়লো রান্না ঘরের মনোরম পরিবেশে।

 

দরজা জোড়ে ঝাঁকিয়ে কে যেন কাউকে ডাকছিলো। দূর থেকে অপূর্বর নামটাই ভাঙা ভাঙা শব্দ ভেসে আসছিলো। অপুর্বর রুমটি রান্না ঘরের কোল ঘেঁষে।

দরজার সামনে আসতেই সেলিম চিৎকার করে উঠলো-

-স্ত স্লুচিলস রহমাতব? পাচিমু বিন্ত না রুকে? (কি হয়েছে রহমাতব, তোমার হাতে ব্যান্ডেজ ক্যান?)

-গিজিয়ে অপুর্ব? (অপুর্ব কোথায়?)

এই বলেই রহমাতব সহ ওর কয়েকজন বন্ধু রান্না ঘরে হুরমুর করে ঢুকলো। সুতপা টেপ রেকর্ডারটি বন্ধ করে চুলা নিভিয়ে দিলো। ভাবতে লাগলো এত হুলস্থুল কেন? কি হয়েছে? রহমাতবের তো আজকে আসার কথা নয়। গতকাল মাত্র দুই ট্রাক গার্মেন্টস আইটেম নিয়ে অন্য শহরে রওনা দিয়েছিলো ডেলিভারি দিতে। ২-৩ দিন পরে আসার কথা। হঠাৎ রহমাতব হাউ মাউ করে কেঁদে উঠলো-

-ও নাস ব্স জাকিনচালস। প্রিস্তুপনিকি উগ্রালী শ্দারগী দুবা গ্রুজবিকা। মিনিয়া স্বিয়াজালি ই প্রাস্তুপ্লেনেই রুকু। প্রিবজিয়াত ই উয়েজয়ুত রাস্তায়াইন্নিয়া না মাশিনে। ব্স জাকিনচালস (আমাদের সব শেষ হয়ে গেছে। রাস্তা থেকে গুন্ডারা ট্রাক দুটি নিয়ে যায়। আমার মুখ বেঁধে হাতে গুলি করে। গাড়ীতে করে অনেক দুর এনে রেখে যায়। সব শেষ)। আর যেন মুখ দিয়ে কথা বেরুচ্ছিলনা রহমাতবের। ফ্লোরে বসে পড়লো। সেলিম এগিয়ে যাচ্ছিলো অপুর্বর দিকে।

এরমধ্যে সুতপার চিৎকার । সেলিম ভাই-অপুর্বকে ধরেন...

লাফ দিয়ে অপুর্বর পা`দুটি ধরে সেলিম প্রচন্ড জোড়ে এক হেচকা টান দিলো নিজের দিকে। সাথে সাথে কেউ একজন ওর মাথা ধরে ঘরের ভিতরে ঠেলা মারলো। মাত্র কয়েক সেকেন্ডের ব্যাপার। কথা শুনতে শুনতে কখন যে অপুর্বর হাত জানালার পাশের শক্ত রেলিং থেকে সরে আসছিলো যা কেউ টেরও পায়নি। বুকের ধড়ফড়ানি বেড়ে যায় মুহুর্তে। শীতল হয়ে আসে পা দু’টো। হঠাৎ মাথায় যেন বিদুৎ চমকে উঠলো। সময় মতো সেলিম না ধরতে পারলে এখানেই হয়তো শেষ হতো অপুর্বর গল্প। কিন্তু কপালের লিখন! সেই যাত্রায় অপুর্ব বেঁচে যায়।

 

এই ঘটনায় সুতপা হতভম্ব। শরীরটা যেন ঠান্ডা হয়ে আসছে। হাত-পা গুলি কাঁপছে। তাড়াতাড়ি এসে অপুর্বকে বুকে চেপে ধরে। -অপুর্ব ঠিক আছো? কি হলো তোমার? কোন কিছু নিয়ে চিন্তা করো না প্লিজ। সব ঠিক হয়ে যাবে। অপূর্বকে শান্তনা দেয়ার অনেক কথা বললো সুতপা। সুতপা অপুর্বর ভারী শরীরটা নিয়ে বসে থাকতে পারছিলো না। তাই সেলিম ভাইকে ডেকে সুতপা বলছিলো –

-অপূর্বকে আপনি একটু ভালো করে ধরুনতো। ওকে ওর রুমে নিয়ে যাই।

এরপর রহমাতবের দিকে তাকিয়ে সুতপা বললো-

-রহমাতব ভাই, তুমি কেঁদো না। যা হয়ে গেছে তাতে কারো হাত নেই। তোমার যে কোন বড়ো ক্ষতি হয়নি তার জন্য ভগবান সহায়। তুমি এখন বিশ্রাম নাও। দেখ, আজ কি হতে পারতো। অপুর্বকে এখন রুমে নিয়ে যাই।

-চল ওকে নিয়ে যাই।-এই বলে রহমাতবও অপুর্বকে শক্ত করে ধরলো। অপুর্বর বা হাতটি রহমাতবের গলা পেঁচিয়ে ধরে অপুর্বকে ডান হাত দিয়ে নিজের গাঁয়ের সাথে শক্ত করে চেপে ধরলো। অন্য পাশে সেলিম। আস্তে আস্তে রুমে এনে সোফা বেডে অপুর্বকে শুইয়ে দিলো।

-সুতপা, আমি এখন যাই। পরে আসবো-এ বলে রহমাতব দরোজার দিকে পা পাড়ায়

-ঠিক আছে, রহমাতব ভাই। অপুর্ব একটু ভালো ফিল করলে আপনাকে জানাবো।-সুতপা বলে উঠে।

অপুর্বর পা থেকে জুতাগুলি খুলতে খুলতে জিজ্ঞেস করে-

-খুব খারাপ লাগছে তোমার?

অপুর্ব একেবারেই চুপ। কোন কিছু বলছে না। চোখ দুটি সামনের দেয়ালে স্থির হয়ে আছে। এর মধ্যেই অপুর্বর বন্ধুরা অনেকেই রুমে এসে ঢুকলো। । সবাইকে খুব চিন্তিত লাগছে।

-আপনারা প্লিজ একটু পাশের রুমে বসেন। সেলিম ভাই, জানালাগুলি একটু খুলে দিন, রুমটায় কেমন একটা ভ্যাপসা গরম। আর দরোজাটাও খোলা থাক। একটু বাতাস আসুক।

-তোমরা ঐ রুমে যাও। অথবা রান্না ঘরে যাও। আমিও আসছি।-এই বলে সেলিম জানালাগুলি খুলতে এগিয়ে যায়। জানালা খোলার পর বেশ নির্মল বাতাস আছড়ে পড়লো সারা রুমটাতে।

-সুতপা আমি একটু রান্না ঘরে যাই। তুমি এখানে থাকো। কিছু লাগলে আমাকে ডেকো----এই বলে সেলিম রুম থেকে বেরুতে যাচ্ছিলো। পেছন থেকে সুতপা বললো-

-সেলিম ভাই, চুলার জিনিসগুলো নিয়ে আসবেন। আজকে আর রান্না হবে না।

-তুমি এই নিয়ে চিন্তা করো না। তুমি এদিকটা সামলাও। আমি ওদেরকে নিয়ে তাড়াতাড়ি রান্নার কাজটা শেষ করে নেই। -সেলিম সুতপাকে বলে।

-ঠিক আছে সেলিম ভাই। আপনি একটু বেয়াইকে ডেকে নিবেন।

-ওকে ডাকতে হবে না। বেয়াই এখানেই আছে। রান্না ঘরে।-উত্তরে সেলিম

বেয়াই মানে জাহাঙ্গীর ভাই। সকলে বেয়াই বলেই ডাকে। সবার প্রিয়। রাশিয়ায় আসে ইউরোপে পাড়ি দেওয়ার আশায়। কিন্তু এখনো সুযোগ করে উঠতে পারে নি। অপুর্বর কাছেই থাকে। অপুর্বর কাজে সাহায্য করে। এই জন্য বেয়াই খুব কৃতজ্ঞ। নানা ভাবে তা প্রকাশ করেছে। অপুর্বর অসুস্থতায় সেও চিন্তিত।

-এখন কেমন লাগছে? -সুতপা তাকিয়ে আছে অপুর্বর দিকে। হঠাৎ টের পেলো অপুর্বর চোখের কোন দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে

-একি করছো? তুমি কাঁদছো কেন? তুমিই তো বলো-জীবন একটি যুদ্ধ ক্ষেত্র। বিপদ থাকে পদে পদে। যা হবার তো হয়ে গেছে। তুমি কাঁদলে তো আর হারানো ধন ফিরে আসবে না। বরং এখন শান্ত হও-সুতপা অপুর্বকে বুঝানোর চেষ্টা করে।

-এবার শেষ সম্বলটাও হারালাম।

-কিছুই হারায়নি। তোমার সবই আছে। তুমি, তোমার স্বপ্ন-আর কি চাই-এখন একটু চুপ করো, সুতপা অপুর্বকে আদরের সুরে বলে।

-ভেবেছিলাম এবার দেনাগুলো আস্তে আস্তে মিটাতে পারবো, টুক টাক করে কোন রকমে চলে যেতে পারবো।-আর হবে না, একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো অপুর্ব

-কি বোকার মতো কথা বলছো। এটাই কি তোমার স্বপ্ন ছিলো?  তুমি তো করবে পড়াশুনা। তোমার স্বপ্ন মানুষ হওয়ার। এখন যা কিছু করছিলে তা একটা দিবা স্বপ্নের মতো। ক্ষনিকের ভ্রম। তাকে ভুলে যাও। মনকে শক্ত করো।-সুতপা অপুর্বর মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলতে থাকে

-ভুলতে চাইলেই কি সব ভোলা যায়?-অপুর্বর কন্ঠে উদ্বিগ্নতা

-এই সময় মনকে শক্ত করতে হয়। বিপদে ভেঙ্গে পড়লে চলবে না। এতে বেশী অমঙ্গল হয়

-আর কতো অমঙ্গল হবে। যা হবার তো হয়েই গেছে-অপুর্ব এবার সুতপাকে দু`হাতে জড়িয়ে ধরলো।

-বিপদ যখন আসে তখন সব এক সাথেই আসে। কাউকে জানান দিয়ে আসে না।-সুতপা বিজ্ঞের সুরে সান্তনা দেয়।

-আমি জানি না আমি কি করবো। চারিদিকে শুধু অন্ধকার দেখছি।

 

এক সময় অপুর্ব সুতপার কোলে মাথা রেখে ডুকরে কেঁদে উঠলো। সুতপা কিছু বললো না। জানালার কাঁচ দিয়ে শেষ বিকেলের আকাশটাতে সে কি যেন খুঁজছে। হাতের আঙ্গুলগুলি অপুর্বর ঘন কালো চুলে উদভ্রান্তের মতো নড়াচড়া করছিলো। মাঝে মধ্যে কপোলে টিপা-টিপি। অপুর্বর কান্নাকে থামানোর যেন কোন চেষ্টা নেই।

 

কিছুক্ষনের মধ্যেই ভারী নিঃশ্বাসে সুতপার ভাবনায় ছেদ পড়লো। অপুর্ব ঘুমিয়ে পড়েছে। কোল থেকে মাথাটা দুহাত দিয়ে নামিয়ে ঠিক মতো বালিশের উপর রাখলো। গায়ের উপর হালকা একটা চাদর এলিয়ে দিলো। দড়জাটা হালকা করে ভিজিয়ে দিয়ে রান্না ঘরের দিকে এবার পা ফেললো। রান্না ঘর থেকে গানের কোন আওয়াজ না আসলেও সকলের কথা-বার্তার আওয়াজ বেশ সরব। এক সময় রান্না-বান্না হলো।

এর মধ্যে অপুর্বরও ঘুম ভাঙ্গলো। হাত-মুখ ধুয়ে সকলের সাথে এক সাথে খেতে বসলো। চোখ দুটি যেন জবা ফুলের মতো লাল। দু’পাশটা ফোলা। খেতে খেতে হঠাৎ বেয়াই বলে উঠলো-

-বেয়াই কোন চিন্তা কইরেন না। সব দেখবেন ঠিক হইয়া যাইবো। সবই আল্লার ইচ্ছা।

-তাতো বুঝলাম বেয়াই। কিন্তু ইনকামের যে সব রাস্তা বন্ধ হইয়া গেলো। দেনাগুলার কি অইবো? কয়দিন পরেইতো সবাই হোস্টেলে আইসা ধরবে। তহন কি করবো?

-তহন না হয় দেহা যাইবো। বিপদতো আপনি ইচ্ছে করেই আনেন নাই। আর বিপদতো বিপদই। এতে কারো হাত নাই। পরে আপনার পার্টনারের লগে ভেবে-চিন্তে কথা বইলা একটা উপায় বেড় কইরা নিবেন।

 

এবার সুতপা একটু ধমকের সুরে বললো-

-বেয়াই, এই সব কথা-বার্তা এখন রাখেন। এই সব নিয়ে পরে আলাপ করা যাবে।

 

ধীরে ধীরে আকাশটা যেন অন্ধকারের চাদরে ঢেকে যায়। রাস্তার বাতিগুলো জ্বলে উঠলো। যার যার রুমে সবাই চলে যায় এক সময়। সুতপা ও সেলিম অপুর্বর সঙ্গে আছে। রহমাতবও আর আসেনি। ইচ্ছে করেই সুতপা আর খবর পাঠায়নি। পরে এসব নিয়ে কথা-বার্তা বলাই ভালো হবে এই ভেবে।

 

তার পর অনেকগুলো মাস কেটে গেলো। আর কয়েক মাস পরেই অপুর্ব ইউনিভার্সিটি শেষ করবে। জুন মাসেই থিসিস ডিফেন্স করতে হবে। পড়াশুনায় তাই একটু মনোযোগ। ঘন ঘন ক্যাম্পাসে যায়। এর মধ্যে গাড়িটাও বেচে দিয়েছে। ড্রাইভারকে পয়সা দেওয়ার অবস্থা আর নেই। তাই আন্ডারগ্রাউন্ডেই চলা ফেরা করে। ব্যাবসা একেবারে বন্ধ। যা কিছু গোডাউনে ছিলো তা সব কাছের এক বন্ধুর গোডাউনে রেখেছে। সেলিম এবং বেয়াই সেগুলি আস্তে আস্তে বিক্রির ব্যাবস্থা করছে। বাজার থেকেও পাওনা টাকা আসা একেবারেই বন্ধ। আসার সম্ভাবনা একদম নেই। স্টাইপেন্ড আর হাতে যা কিছু আসে তাই দিয়েই কোন মতে চলে যাচ্ছে। দেশে টাকা পাঠানোও বন্ধ। অপুর্বর দাদাও দেশে চলে যায়। দেশেই ব্যাবসা শুরু করে।

-যা চলে যায় তা আর ফিরে আসে না। অতীতে বুঁদ হয়ে থাকার চেয়ে বর্তমানকে সন্মান করাতেই মঙ্গল।

বর্তমানকে নিয়ে ভাবনার মধ্যেই নিহীত সুখ, জীবনে আনন্দ এবং স্বাচ্ছন্দ্যে। থাকে ভবিষ্যতের সম্ভাবনা, নান্দনিকতা এবং মনকে নিয়ন্ত্রন করার ক্ষমতা। তাই বর্তমান পরিস্থিতিকে মেনে নিয়ে তার উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করাই উত্তম। বর্তমানটাই ধ্রুব সত্য।-এ কথাগুলি সুতপা একদিন অপুর্বকে শোনায়। অপুর্ব মন্ত্রমুগ্ধের মতো সেদিনের কথাগুলি শুনছিলো। আবার যেন নতুন করে আবিস্কার করলো সুতপাকে। আগ থেকেই সুতপা সতর্ক করেছিলো অপুর্বকে। কিন্তু চাপ দেয়নি। পাছে অপুর্ব কষ্ট পায়। এবার সুতপার কথামতই সব কিছুকে ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করলো।

 

রহমাতবের সাথে এ নিয়ে আর কোন সিরিয়াস আলোচনা করেনি। ব্যাবসার যৌথ দায় দায়িত্ব চুকে নেয় কোন ধরনের হাঙ্গামা ছাড়াই। তবে তার পর থেকে রহমাতবের সাথে তেমন কোন সম্পর্ক রাখেনি। অপুর্ব ভালো করেই বুঝতে পারছিলো যে পুরো ব্যাপারটাই ছিলো একটি সাজানো ঘটনা। প্রতারণার নিপুণ কারসাজিতে  সাজানো একটি বিষয়।

 

সোভিয়েত সমাজ পতনের এও এক অনবদ্য দৃষ্টান্ত সেটা বার বার ভাবছিলো অপূর্ব। নৈতিকতাভ্রষ্ট মানুষের সঙ্গে গন্ডগোল করে তেমন কোন ফল হয় না সেটা জানতো অপুর্ব। এতে বরং বিপদ বাড়তে পারে। তাই ভবিতব্যের হাতেই নিজকে সঁপে দিলো। অর্থনৈতিকভাবে অপুর্ব বেসামাল। জুনে পরীক্ষার জন্য প্রিপারেশন নিচ্ছে। কিন্তু পাওনাদারদের কারনে সারাক্ষন একটা ভয়ের মধ্যে থাকতো। অপুর্বর এই অবস্থার কথা কেউ বিশ্বাস করতো না। সবাই ঠাট্টা বলে উড়িয়ে দিত। তাই নিজের অবস্থানকে নিজের মধ্যে রেখেই দিন অতিবাহিত করতে লাগলো।

কিন্তু এভাবে বেশীদিন আর থাকতে পারলো না হোস্টেলে। 

 

এক রাশিয়ান বন্ধু একটি ফ্ল্যাট বাড়িতে থাকার ব্যাবস্থা করে দেয় অপুর্বকে। এক বৃদ্ধা একাই দুই বেড রুমের ফ্ল্যাটটিতে একাই থাকেন। নাতালিয়া চেরেস্কভা- নাম ফ্ল্যাটের মালিকের। বয়েস প্রায় আশির কোঠায়। কিন্তু এখনো বেশ ভালোভাবেই চলা-ফেরা করতে পারেন। নিজের কাজ নিজেই সব করেন। জায়গাটা মস্কোর হোয়াইট হাউসের খুব কাছাকাছি। কাছের আন্ডারগ্রাউন্ড থেকে ট্রামবাইয়ে ১০মিনিট। নিরিবিলি জায়গা।

অপুর্ব ওখানেই একদিন চলে আসে। বরং অপুর্বর বিনয় এবং আন্তরিকতায় মুগ্ধ মহিলা যেন খুশিতে এতটাই আত্মহারা হয়ে যান যে তিনি বলেই দেন যে অপূর্বকে কোন ভাড়া দিতে হবে না।

 

এত খুশীর ভিতরে একজনই খুশী হতে পারেনি। যেদিন নতুন জায়গায় চলে যায় সেদিন সুতপা খুব মন খারাপ করেছিলো। সারাদিন কিছুই খায়নি। খুব কান্না-কাটি করেছিলো। এতোদিন চোখের সামনে ছিলো। ভালো-মন্দের খোঁজ-খবর পেতো। মনের কথা হতো। বেশ সাচ্ছ্বন্দেই কেটে যাচ্ছিলো দিনগুলো। এমন ছন্দপতন কাম্য ছিলো না। কাছের মানুষ যখন দুরে চলে যায় মনটা কেমন বিষাদে ভরে উঠে। যদিও দুরত্বের ব্যাবধান ভালোবাসায় গভীরতা জায়গায়, কিন্তু তার পরেও মন মানতে চায় না।

 

সুতপা এসেছিলো অপুর্বর সঙ্গে প্রথম দিন। থাকার জন্য সঙ্গে বেশী কিছু আনেনি। পরীক্ষা পর্যন্ত থাকবে। আর সুতপার হোস্টেল থেকেও বেশী দুরে না। এক ঘন্টা সব মিলিয়ে। যে কোন প্রয়োজনে সুতপাও আসতে পারবে। প্রথম দিন সুতপাকে দেখে নাতালিয়া অবাক হয়ে ওর দিকে দীর্ঘক্ষণ তাকিয়েছিলো । ওর আদ্যোপান্ত যেন বেশ খুটিয়ে দেখছিলেন তিনি। তরপর একটি হাসি দিয়ে জিজ্ঞেস করলো-

-মেয়েটি কে?

সুতপা উত্তর দেয়

-আমি সুতপা

-ও আমার খুব কাছের মানুষ কিন্তু, নাতালিয়া চেরেস্কভাকে সঙ্গে সঙ্গে অপুর্ব বলে উঠে

একটি স্মিত হেসে জবাব দিয়েছিলো-আমি বুঝতে পেরেছিলাম, বিয়ে করবে কবে?

-খুব তাড়াতাড়ি। আগে ইউনিভার্সিটিটা শেষ করি -অপুর্ব উত্তর দেয়

-ইউনিভার্সিটি শেষ হবে কবে? আর বিয়ে করতে ইউনিভার্সিটি শেষ করতে হবে কেন? -বলেই হা হা করে হেসে উঠে।

 

বয়েস হলেও রসিকতার জায়গাটা একদম স্বচ্ছ। সুতপার চুলের অনেক প্রশংসা করেছিলো সেইদিন নাতালিয়া। হাত দিয়ে ধরেও দেখেছিলো আসল চুল কিনা। নাতালিয়া সাফ সাফ অপুর্বকে জানিয়ে দিয়েছে-তোকে রান্না করতে হবে না। আমি সব করবো। আমি একা মানুষ। তুই আমার সঙ্গেই খাবি।

-না, না আমি বেশী রান্না করবো না। তুমি এই নিয়া ভেবো না

-সুতপা যদি এখানে থাকতে চায়, সেও থাকবে। খুব ভালো হবে-এই বলেই সুতপার দিকে তাকায়। মুখে বৃত্তাকার একটি হাসি। গলার চামড়াগুলিতে বেশ ভাঁজ পড়ে গেছে। নুয়ে পড়েছে বয়সের ভারে। কিন্তু আন্তরিকতায় পূর্ন সারা অবয়ব।

-আমি এখানে থাকবোনা। আমি হোস্টেলেই থাকবো। -সুতপা আগ বাড়িয়ে বলে। তবে মাঝে মধ্যে আসবো তোমাকে বিরক্ত করতে-বলেই সুতপা হেসে উঠলো।

তারপর অনেকক্ষন গল্প হলো। তিনজনে একসাথে খেলো। খুব সুস্বাদু একটা স্যুপ বানিয়েছিলো নাতালিয়া। কালো রুটি আর কাটলেট সহ স্যুপ। সাথে সালাদ। খাওয়া দাওয়া শেষ করতে করতে প্রায় মধ্য বিকেলে পদার্পন। সুতপা এবার রওনা দিলো হোস্টেলের উদ্যেশ্যে। অপুর্বও এলো ট্রামবাই পর্যন্ত। হাঁটতে হাঁটতে অনেক কথা হলো। এক সময় ট্রাম এলো। ট্রাম ছাড়লেও যতোদুর পর্যন্ত অদৃশ্যের বোবারেখা মিলিয়ে না যায় অপূর্ব দেখতে থাকে জানালার পাশে স্কাই কার্ডিগান পরা সুতপাকে। ঠাঁয় দাঁড়ানো  অপুর্বর চোখ ঝাপসা হয়ে ওঠে ততোক্ষনে। মনে মনে বিড় বিড় করে বলে যাচ্ছিলো: -

 কহর দৃশ্যমা থেকে অদৃম্য হয়ে মিলায়, তবু সবখানে তোমার অবয়ব।

গড়কের মাড়ে মাড়ে তোমার সন্তপ্ত মুখশ্রী-আর তোমার হাসিতে ভরা শহরের মানচিত্র।

এক পশলা বৃষ্টি, স্নিগ্ধতা তোমার দৃষ্টি পথে রেখা এঁকে দিয়েছে কবে

তুমি জানো না। তবু সকালের কলুই শাকের ডগায় মুক্তা দানার মতো চিল্কানো সকালে

তোমার কাজল রেখা চোখ-আমি যেদিকে তাকাই আমাকে ইশারার স্বরলিপি শেখায়। যতদূরে যাও-কত দূরে?

গৌধূলীর আবছা আঁধার, দু’চোখের পাতায়-তোমার আলোকছবি।

ক্লান্তি, অবসাদ শেষে শুশুকের মতো ভেসে ওঠা- প্রত্যাশা তুমি-

ট্রামটা ততোক্ষনে দৃষ্টির আড়ালে চলে যেতে যেতে এক সময় দৃশ্য থেকে অদৃশ্য হয়ে যায়।

(চলবে---)



Read full book here: Click here to download the PDF file