পর্ব-১৭
Summary:
অপুর্বর ব্যবসা শুরুর প্রায় দেড় বছর পার হলো।
মস্কোতে তখন সকলেই পড়াশুনার পাশাপাশি কিছু না কিছু করছে। সুতপার বাড়ি থেকে ফেরার পরের মানসিক সংকট যেন কাটিয়ে উঠতে পারছিলো না অপূর্ব। নানা কারনেই সে ব্যবসার কথা ভাবতে শুরু করে। পারিবারিক ব্যবসার কথা মনে করে এ চিন্তা তাকে জেঁকে ধরে। বিশেষত গত সামারে দেশ থেকে ফিরে আসার পর থেকেই ব্যাবসার পোকা মাথায় কিল বিল করতে থাকে। কিছু একটা না করলে যেন চলছে না অপুর্বর। স্টাইপেন্ডের টাকায় চলা খুব মুস্কিল। প্রতি মাসেই ধার-দেনা করতে হয়। দুটি টিউশনি করছে। তাও যেন চলছে না। সব কিছুর দাম যেন হু হু করে বেড়ে যাচ্ছে। গত বার দেশে বেড়াতে গিয়ে মাথাটা একটু বিগড়ে যায় অপুর্বর।
একদিন সকালে বৌদির কথায় মাথায় টনক লাগে-
-বাংলাদেশ থেইক্কা এখন নাকি কতোলোক রাশিয়া যাইতাছে। ওরা নাকি ব্যাবসা করে অনেক টাকা পইসা কামাইতাছে। আপনি পারেননা, ছোরদা? কতো দিন ধইরাতো ঐ দেশে আছেন। পড়ার ফাঁকে ফাঁকে কোন সুযোগ পান না?
বৌদির কথায় অপুর্ব বেশ অবাক হয়। এতো কিছু এরা জানে? ভাবতে লাগলো। চুপ হয়ে রইলো কিছুক্ষন। কোন উত্তর দেয়ার প্রয়োজন বোধ করলো না।
-চুপ কইরা আছেন কা? নাকি আমি কিছু মন্দ বললাম? -বৌদি অপুর্বর দিকে উত্তরের আশায় তাকিয়ে আছে আর টেবিলে সকালের খাবারটা রেডি করছে। গলায় একটা গামছা পেছানো।
সকালে উঠে স্নানটা আগে সেরে নেয় বৌদি। চুলগুলো ভিজে লেপ্টে আছে। দাদা দোকানে চলে গেছে। অপুর্বকেও বেরুতে হবে। টিকেটটা রি-কনফার্ম করতে হবে। যেতে হবে এরোফ্লতের অফিসে। তাই রেডি হচ্ছিলো। শার্টের বোতামগুলি লাগাতে লাগাতে অপুর্ব জবাব দিলো-
-তুমি ঠিকই বলছো বৌদি। মস্কোতে এখন সবাই ব্যাবসা করছে। অনেক টাকা -পয়সা বানাচ্ছে। বাড়ি-গাড়ি কিনছে। বড়লোকি ফুটাচ্ছে। কিন্তু আমার দ্বারা যে তা হবে না বৌদি।
-হইতো না কা? সবাই পারলে আপনিও পারবেন।
-কিন্তু আমি যে পড়াশুনা করতে গেছি। এই ধান্দা করলে পড়াশুনা যে লাটে উঠবে। দাদা শুনলে তো আস্তা রাখবে না।
-কেডা কইছে। আপনার বন্ধুরাতো সবাই ব্যাবসা করতাছে, পড়া-লেহা করতাছে। এইতো গেল মাসে আপনার বন্ধু, যে মুহম্মদপুরে
থাকতো হে নাকি ধানমন্ডিতে কয়েক লাক টেহা দিয়া বাড়ী কিনছে। ঘন ঘন দেশে আইয়ে। মাসে মাসে নাকি সিঙ্গাপুরেও যায়। ওর বড়ো ভাই আর চাচারে নিয়ে গেছে মস্কোতে। অনেকে দেশ থেকে লোক নিয়াও নাকি পইসা বানাইছে। আপনিও তো আপনার বাইডারে নিয়া যাইতে পারেন। পড়াশুনা শেষ কিন্তু টু টু কইরা ঘুইরা বেড়ায়। কোন কিছু করে না। আপনার দাদা একলা আর কতো করব।
-তুমি এতো খবর জানো কইত্থেকে?
-আমাগো নীচতলার এক ভাবির ছোড ভাই দুই বছর আগে নাহি আপনাগো ঐ দেশে গেছে। হেতেও নাকি অনেক টেহার মালিক। মিরপুরে নাকি কাপরের ফ্যাক্টরী দিছে। কয় দিন পর পরই দেশে আইয়ে। ভাবির কাছ থেকেই সব হুনছি।
-তা না হয় বুঝলাম। কিন্তু আমার বন্ধুর কথা জানলা কইত্থেকে? অপুর্ব বিস্ময়ে তাকায় তার বৌদির দিকে।
-আপনি আসার কয়দিন আগেইতো বংশালের খালাম্মা আইছিলো। আপনার কলেজের বন্ধুর মা। তাসনিমার ভাই। খালাম্মাই সব বলছে। তাসনিমার ছোট ভাইডাও নাকি ছয় মাস ধইরা মস্কোতে। দুই ভাই মিইল্যা নাহি ব্যাবসা করে। খালাম্মারা এহন ওয়ারীতে ফ্লাট কিনছে। খালাম্মার কাছেই আপনাদের অন্য বন্ধুদের খবর পাইছি
-ঠিকই বলছ, সবাই এখন ব্যাবসা করছে। রাশিয়া এখন ব্যাবসার জায়গা। চারিদিকে শুধু টাকা উড়ছে। শুধু ধরতে জানতে হয়। কিন্তু আমার দ্বারা মনে হয় এই সব হবে না
-এতো চিন্তা কইরেন কা। একবার চেষ্টা কইরা দেহেন। আমার মনে হয় আপনি পারবেন।
-দেখি কি করা যায়
-তবে এবারই আপনার ভাইডারে নিয়ে যান।
-হুম, অপুর্ব একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো।
সেই বছরই অপুর্ব তার ছোড়দাকে নিয়ে আসে, সাথে কসাইটুলির ছোড়দার এক কলেজ বন্ধুকেও।
এই খবরটা যেন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে অপুর্বর গ্রামের বাড়ী সহ আশে পাশের এলাকায়। শুরু হয় মস্কোতে আসার হিড়িক। কয়েক মাসের মধ্যেই বেশ কয়েক জনকে নিয়ে আসে। ভর্তি করায় সুতপার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে।
হঠাৎ করেই সব কিছু কেমন ওলোট-পালোট হয়ে গেলো অপুর্বর।
ভর্তির সুবাদে সখ্যতা বাড়ে প্রফেসর জুকভের সাথে। ধীরে ধীরে বেশ অন্তরঙ্গতা।
সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙ্গনের সাথে সাথে সব কিছুতেই যেন ধ্বস নামে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে নতুন করে স্কলারশিপ দেওয়া বন্ধ হয়ে যায়। শুরু হয় পশ্চিমা কায়দায় সেল্ফ ফাইনান্সে পড়াশুনার সুযোগ। রাশিয়ার পাড়ি দেওয়ার হিড়িক পড়ে যায়। ভর্তি হয় পড়াশুনার জন্য কিন্তু উদ্দেশ্য অন্য। এক দল আসছে ইউরোপে পাড়ি দেওয়ার উদ্দেশ্যে আর অন্যরা রাশিয়ায় ব্যাবসা করার জন্য।
যে কোন ইউনিভার্সিটি বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে এডমিশন হওয়ার কনফার্মেশন পেলেই ভিসার জন্য এপ্লাই করা যেত। ভর্তির
ফিও ছিলো খুবই অল্প। অনেকে ইউনিভার্সিটির সাথে কন্ট্রাক সাইন করতো স্টুডেন্ট রিক্রুটমেন্ট এজেন্ট হিসেবে। অপুর্বও তাই
করে। প্রফেসর জুকভ ইন্টারনেশানাল ডিপার্টমেন্টের ডীন। অপুর্ব ওকে হাত করে নেয়। বিবেকের পতন হয়েছে সর্বত্র।
পরিবর্তনের দমকা হাওয়ায় সমাজের ভীতটা দুমড়ে-মুছড়ে ভেঙ্গে পড়লো। অনেকের মধ্যেই ন্যায়-নীতি, বিবেক -বুদ্ধি, মনুষ্যত্ব
আর মানবায়নের ভারী ভারী নীতি বাক্যগুলি চুপষে গেলো। নতুন নতুন বুলি আওরাতে থাকে চাচা আপন প্রান বাঁচার মতো।
চারিদিকে কেমন এক পান্ডুরতা। অস্থিরতা সকলের মধ্যে। হঠাৎ করেই সকলে কেমন ব্যাস্ত হয়ে পড়লো। দৌড়া-দৌড়ি, ছুটা-ছুটি।
সব খানেই এক ছন্দ পতন। ছন্দপতন এসেছে প্রফেসর জুকভের মধ্যেও। আর তাইতো অপুর্বকে কন্ট্রাকটা দেওয়ার আগে সব কিছু ঠিক-ঠাক করে নিয়েছে। পরে যেন পস্তাতে না হয়। আর তাইতো বলতে কোন দ্বিধা ছিলো না-
-কয়জন স্টুডেন্ট প্রতিমাসে আনতে পারবি, অপুর্ব?
-কয়জন তোমাদের চাই?
-তোকে আমরা এক্সলুসিভ এজেন্ট দিতে চাই। তোদের দেশ থেকে যে কেউ ভর্তি হতে চাইলে তোর মাধ্যমেই ভর্তি হতে হবে। এতে তোরই লাভ হবে।
এই কথাটা শুনে অপুর্ব মনে মনে খুশীই হলো। এই যে না চাইতেই পাওয়া। সেই সময় মস্কোতে অসংখ্য ভর্তিচ্ছু লোকদের
আনাগোনা। অনেকেই আসছে জাপান থেকে তাইপে হয়ে, কেউ আবার চীন দেশ থেকে। ইউরোপে পাড়ি দেওয়া ট্রানজিট পয়েন্ট হয়ে উঠে মস্কো। কিন্তু সকলের চাই বৈধ ভিসা। তাই যে কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হওয়ার প্রয়োজনীয়তা বেড়ে যায়।
অপুর্ব এ প্রস্তাবে আর দেরী করে নি-
-মিনিমাম দশজন স্টুডেন্ট। তবে প্রতি স্টুডেন্ট প্রতি দু`শ ডলার আমাকে দিতে হবে। ক্যাশ। কেউ যেন জানতে না পারে। ভর্তি ফি হবে খুবই মিনিমান।-একেবারে সোজা-সাপ্টা প্রস্তাব প্রফেসর জুকভের।
-আমি রাজি, তুমি কন্টাক্ট রেডি করো। তবে আমার একটা রিকুয়েস্ট আছে-
-কি?
-তোমাদের হোস্টেলে আমার জন্য একটা রুম বরাদ্দ করতে হবে, তা হল আমার সুবিধা হবে -অপুর্ব প্রফেসর জুকভকে বলে।
অপুর্বর কথায় প্রফেসর জুকভ একটু ভাবলো। তারপর কাকে যেন ফোন করলো।
-ঠিক আছে। আগামী সপ্তাহ থেকেই তোমার জন্য দুই রুমের একটা ব্লক দেওয়া হবে। এক রুমে তুমি থাকবে এবং অন্যটাতে তোমার পরিচিত অন্য শিক্ষার্থীরা-এই বলেই একটা প্রাঞ্জল হাসি দিয়ে হাতটি বাড়িয়ে দিলো অপুর্বকে।
সেই থেকেই শুরু হলো অপুর্বর টাকা কামানোর হাতে খড়ি।
শিপ্ট হলো প্লানেরনায়ায় সুতপার হোস্টেলে। তাও আবার একই ফ্লোরে।
অল্প কয়েক মাসের মধ্যেই অপুর্ব বেশ কামিয়েছে। আর তা ওর চলনে-বলনে, কথা-বার্তায় টের পাওয়া যায়। গলায় এখন টাই লেগেছে। সিরিয়ার তৈরী কালো স্যুট-কোর্ট পড়ে মিটিং-এ যায়।
হাতে একটা বাদামী রংয়ের এক্জিকিউটিভ ব্রিফকেস। ঘন ঘন মিটিং। পেজারও নিয়েছে একটা। টিং টিং করে ঘন ঘন মেসেজ আসে। সবই ব্যাবসা সংক্রান্ত। নানা কাজে এখন খুব ব্যাস্ত মানুষ। ইউনিভার্সিটিতে এখন কম যাওয়া হয়। আর বছর খানেকের মধ্যেই পড়াশুনার পাঠ শেষ হবে। তা যতোটুকু দরকার সেই ভাবেই পড়াশুনাটা চালিয়ে যাচ্ছে। মাঝে মধ্যে প্যাকেট গুঁজে দেয় ভাইস-ডীনের হাতে। সবাই খুশী। দেখেও না দেখার ভান করে থাকে।
অল্প দিনের মধ্যেই নতুন অফিস হলো। অফিসে সেক্রেটারি আসলো। পার্টনারে কোম্পানি রেজিস্ট্রি হলো। নতুন গাড়ি কেনা হলো।
অপুর্ব গাড়ির সামনের সিটে বসে মারলবরোতে সুখ টান দেয়। কখনো কখনো কুন্ডুলী পাঁকিয়ে ধোয়া ছাড়ে। পাশে ড্রাইভারের হাত স্টিয়ারিংএ। সব কিছুকে পেছনে ফেলে এগিয়ে চলছে। জগৎটাকে অন্য রকম মনে হয়। অপুর্বর দিন পাল্টিয়ে যাচ্ছে।
এতো সব কিছুতে অপুর্বর জীবনে সুখের রামধনু দেখা দিলেও সুতপার যেন কিসের শংকা। ও কেন জানি অপুর্বর নতুন জীবনটাকে মেনে নিতে পারছিলো না। কোন এক অজানা ভাবনায় সুতপা চিন্তিত। অপুর্বর পড়াশুনায় কোন ক্ষতি হোক সুতপা তা চায় না। প্রথম প্রথম কিছু না বললেও এক সময় সুতপা মুখ খুলে-
-তোমার দাদা তোমাকে পাঠিয়েছে পড়াশুনার জন্য। ব্যাবসাটা তোমার ঠিক যায় না। তুমি বরং পড়াশুনায় ধ্যান দাও, এতেই সকলের মঙ্গল।
-আমিতো পড়াশুনা ছেড়ে দেই নি। সবইতো করছি। এখন তো কেউ বসে নাই। আর সুযোগতো সব সময় আসে না। একটু কষ্ট করে যদি ভালো থাকা যায় তাতে দোষের কি?-অপুর্ব সুতপাকে বুঝানোর চেষ্টা করে।
-ইদানিং তুমি কেমন জানি একটু অন্য রকম। সারাক্ষন ব্যাবসা নিয়ে ব্যাস্ত। ইউনিভার্সিটিতেও নিয়মিত যাও না। একই বিল্ডিংএ
একই ফ্লোরে থাকি অথচ উইকেন্ড ছাড়া আমাদের দেখা হয় না। দিন দিন তোমার ব্যাস্ততা আরো বাড়ছে।
-নতুন ব্যাবসা। সব কিছু একটু গুছিয়ে নিতে হচ্ছে তাই একটু ব্যাস্ত। আর কয়টা দিন। সব কিছু ঠিক ঠাক মতো সেট আপ করতে
পারলে আর এতো ব্যাস্ততা থাকবে না।
-সেটা যেন হয়। তবে আমার কেন জানি ভালো লাগছে না। কই তোমার পার্টনার তো তোমার মতো এতো ব্যস্ত থাকে না। সে তো
সারাক্ষন হৈ চৈ করে থাকে। শুধু তুমি দৌড়া দৌড়ি করে মরছো
-সবাইকে দিয়ে তো আর সব কিছু হয় না। আর গার্মেন্টসের ব্যাবসাটা যেহেতু আমার দেশের সাথে তাই এই দিকটা আমাকেই
সামলাতে হয়।
-তবু, আমি চাই না তুমি ব্যাবসা নিয়ে এতো ব্যাস্ত থাকো। আর মাত্র একটা বছর। ভালোভাবে পড়াশুনাটা শেষ করো।
-তারপর?
-তারপর আবার কী? তখন না হয় এ দিকে ভালোভাবে মনযোগ দিও।
-আর আমাদের বিয়েটা?
-আগে পড়াশুনাটা শেষ করো। তা ছাড়া আমার বাবা-মাকে মানানো যাবে না। এমনিতেই রাজী নয়। আর যদি জানতে পারে তোমার কোন ডিগ্রী নেই তা হলেই শেষ। আর রক্ষা নেই।
-ডোন্ট অরি। সব ঠিক হয়ে যাবে। ভবিতব্যকে নিয়ে এতো ভাবনা কেন। বর্তমানটাকে নিয়েই একটু ভাবো না। জীবনটাকে একটু এনজয় করো। ভবিষ্যতের ভাবনায় অযথা বর্তমানটাকে নষ্ট করো না।
-কিন্তু ভবিষৎ যে বর্তমানের উপর দাঁড়িয়ে আছে। তাকে নিয়ে ভাবাইতো আমাদের সবচেয়ে বেশী প্রয়োজন। কথায় আছে না
কর্মই ফল। তাই বর্তমানটাকে ঘষা মাজা করে নিজের মতো গড়ে তোলার মাধ্যমেই ভবিষ্যতের ভিত শক্ত করা যায়
-তোমার এতো দার্শনিক কথা বার্তা আমার মাথায় ঢুকেনা।-অপুর্ব সুতপার মাথায় হালকা করে ধাক্কা দেয়
-এতো কিছু বুঝার দরকারও নাই আপনার-সুতপা এবার হা হা করে হেসে উঠলো। অপুর্বও হাসির সঙ্গে আরেকমাত্রা যোগ করলো।
-তবে একটি সুস্থ জীবনের জন্য অতীত এবং ভবিষ্যত নিয়ে চিন্তা করার জন্য কিছু সময় অতিবাহিত করা অপরিহার্য, বুঝলেন
মহাশয়। শুধু টাকার পেছনে দৌড়ালেই চলবে না। এখন থেকে এটা যেন মনে থাকে।-সুতপা বলতে বলতে এবার উঠলো
-ঠিক আছে। আমি একটু রান্না-বান্না করব। সন্ধ্যায় এক সাথে খাবো।
এই বলে সুতপা এবার ওর রুমের দিকে রওনা দিলো।
সব কিছু ভালোই চলছিলো।
অপুর্বর বিজনেস পার্টনার একজন আজারবাইজানী। সে যে এক সময় কাল হয়ে দাঁড়াবে অপুর্ব তা ভাবতেও পারেনি। এক দিকে
স্টুডেন্ট রিক্রুটমেন্ট আর অন্যদিকে গার্মেন্টসের ব্যাবসা দু’টাকেই সামাল দিচ্ছে বেশ ভলোভাবেই। বিজনেস পার্টনারের
দায়িত্বে ছিলো অফিস ম্যানেজম্যান্ট আর সেইলস এন্ড মার্কেটিং। প্রতি মাসেই এক দু`টি কন্টেইনার গার্মেন্টস আইটেম
আসতো।
সব সময় খুব ভালো ব্যবহার করতো। মিষ্টিভাষী শান্ত স্বভাবের। অপুর্বকে যথাসাধ্য সাহায্য করতো সবসময়।
রহমাতবের বউ বিলকিস অপুর্ব এবং সুতপাকে খুব পছন্দ করতো। প্রায় সময় বলতো-
-সুতপা ইজ মাইয়া সিস্ত্রা (সুতপা আমার বোন।
অপুর্ব তখন দুস্টুমী করে বলতো-
-ই ইয়া (আর আমি)
-তি মই ব্রাত (তুই আমার ভাই)-বলে হা হা করে হেসে উঠতো।
খুব সুন্দরী ছিলো বিলকিস। বেশ লম্ব কালো কেশ। সাধারনত ওদের মধ্যে এমনটি দেখা যায় না। কালো ভাসা ভাসা চোখ দুটিতে যেন পৃথিবীর রুপ ধরা দেয়। ওর চোখ দুটি যেন সমুদ্রের মতো গভীর, তারকাময় রাতের মতো স্বপ্নময়, পদ্মের পাপড়ির মতো সুন্দর, সূর্যোদয়ের মতো মন্ত্রমুগ্ধ, সকালের শিশিরের মতো নির্মল, কৌতুহলপূর্ণ, কিন্তু শিশুর হাসির মতো নিষ্পাপ। এমন সুন্দর চোখ অপুর্ব খুব কম দেখেছে। ঠিক যেন সুতপার চোখ।
কথা বলে খুব সুন্দর করে। হাসলে মনে হয় লাল কমলা লেবুর রসে ভরা ঠোঁট দিয়ে সৌন্দর্যের পাঁপড়ি ছড়িয়ে পড়ে চারিদিকে। অনেক দিন বিলকিস আর রহিমাতবের রুমে খাওয়া-দাওয়া করেছে অপুর্ব-সুতপা। খুব টেষ্টি পেরসিয়ান বিরিয়ানী বানাতে পারে বিলকিস।
একবার খেলে অনেক দিন এর স্বাদ লেগে থাকে জ্বিহ্বায়।
স্টুডেন্ট হিসেবে খুব ভালো ছিলো বিলকিস। ডিপার্টমেন্টে সকলের পরিচিত
একই বিল্ডিংএ থাকতো বলো প্রায় সময়ই আসা যাওয়া হতো, একসাথে কখনো-সখনো পাশে বেডমিন্টন খেলতে যেত।
অপুর্বর দিনগুলি কেটে যাচ্ছিলো এমনি করেই-আনন্দ আর ভালোবাসার নাগর দোলায়। সব কিছুতেই ছিলো ভালোলাগার ছোঁয়া। প্রাঞ্জল উচ্ছ্বলতা।
সকালের নরম রোদ দেখে হতো উচ্ছ্বসিত, ধলপ্রহরের শিশির ধুয়া দূর্বায় হেঁটে যেতে যেতে পৃথিবীর রুপে হতো মুগ্ধ। ভোরের বাতাস থেকে শক্তি নিয়ে এগিয়ে যেতো দুপুরের তাপদাহ রোদের বুক চিড়ে। চারিদিকে ছিলো এক মনোরম মন কারা শ্যামলিমার নির্মলতা।
হঠাৎ করেই যেন একদিন নির্মল আকাশে মেঘেদের আনাগোনা শুরু হলো। ভারী কালো মেঘেদের। উন্মাদনার ছুটাছুটি। কিন্তু এতো তাড়াতাড়ি যে প্রবল বর্ষনে সাজানো বাগান ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যাবে অপুর্ব ভাবতে পারেনি।
১৯৯১ এর ডিসেম্বরের সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙ্গনের আগ থেকেই রাশিয়ার আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতির চরম অবনতি ঘটে। হু হু
করে বাড়তে থাকে জিনিস পত্রের দাম। সরকার নিয়ম করে ক্রয়-বিক্রির মাধ্যম হবে শুধু রুবল। সেই সময় রুবলের পতন হতে থাকে প্রতিদিন। অস্থির বাজার। ডলারের ভীষন অভাব। বিদেশী কারেন্সী ক্রয়ের হিড়িক পড়ে যায়।
বাজার থেকে গার্মেন্টস বিক্রির টাকা আসা বন্ধ হয়ে যায়। ব্যাবসার অর্ধেকের বেশী টাকা আটকা পড়ে যায় বাজারে। টাকা
পরিশোধ করতে না পারায় গার্মেন্টস ইম্পোর্ট করাও প্রায় বন্ধ হয়ে গেলো। আর রুবলের পতনে বিক্রির টাকা হয়ে যায় মূল্যহীন।
সবারই প্রায় একই অবস্থা। অনেকেই ব্যাবসা করে সর্বশান্ত হয়েছে। অনেকে আবার আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ। দু`এক জন আবার
অর্থের সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছে। মস্কোর রাস্তা-ঘাটে ওদের ব্যাবসার বিলবোর্ড নজর কারে।
তবে অপুর্বর পরিস্থিতিটা একটু অন্যরকম। ব্যাবসা যখন ভালো ছিলো তখন অনেকের কাছ থেকে বেশী সুদে টাকা এনেছিলো। এখন ঋনের বোঝাটা বেশ ভারী। খরচ বেড়ে যায় কিন্তু আয় সংকুচিত। চারিদিক থেকে যেমন বিপদ ঘনিয়ে আসছে। চোখে অন্ধকার ছাড়া আর কিছু দেখছে না অপুর্ব। ভেবে পাচ্ছে না কি করবে।
বাধ্য হয়ে অফিস বন্ধ করতে হলে। খরচ কমাতে লোক ছাটাই হলো। নিজেই অনেক পরিশ্রম করছে। কোন রকমে যেন দিনগুলি কেটে যাচ্ছে। বেশ টানা-পোড়ন।
অপুর্বর এই অবস্থায় সুতপা খুব চিন্তিত। মানষিকভাবে বেশ ভেঙ্গে পড়ে। অপুর্বকে প্রায় সময়ই বুঝানোর চেষ্টা করে। কিন্তু
অপুর্বর অস্থিরতা কাটে না।
একদিন পড়ন্ত বিকেলে রান্না-ঘরে সুতপা, অপুর্ব আর অপুর্বর স্কুল জীবনের ঘনিষ্ঠ এক বন্ধু সেলিম। অনেক দিন এক সাথে
রান্না-বান্না করা হয়নি।
সেলিম অপুর্বর খুব কাছের বন্ধু। অপুর্বই ওকে মস্কোতে নিয়ে আসে। মস্কো আসার পর থেকেই অপুর্বর সাথে আছে। ব্যাবসায়
সাহায্য করছে। অপুর্বকে খুব ভালোবাসে। খুব মান্য করে। এমন কিছু কখনো করবে না যাতে অপুর্ব কষ্ট পায়। অপুর্বর এই বিপদের সময়ে সেলিমই যেন অপুর্বর শিড়দারা। সব সময় পাশে আছে। অপুর্ব যেখানে যায় সেলিম সাথে সাথে থাকার চেষ্টা করে।
সুতপা আজ রান্না করছে। স্পেশাল মিক্সড শব্জি আর চিকেন ভুনা এবং ডাল ভর্তা। অনেক দিন পর এক সাথে রান্না। ভাটার মাঝে
জোয়ারের ডাক। বিষন্নতাকে দূর করার এক দারুন মুহুর্ত। সেলিমই সকালে বাজার করে এনেছে। সাথে একটা শ্যাম্পেইন। বিল্ডিং এর সব বাঙালী বন্ধুরা জড়ো হবে। অপুর্ব তাই আজ কোথাও যায় নি। যদিও উইকেন্ড। কিন্তু ইদানীং ছুটির দিনগুলিতেও ব্যাস্ত থাকতে হয়। এক মুহুর্তের ফুরসৎ নেই।
লাল রংএর ছোট একটা টেপ রেকর্ডারে বলিউড মিউজিক বাজছে। কেয়ামত ছে কেয়ামত তক। খুব হিট ছবির গান। বেশ জনপ্রিয়। কিশোর-কিশোরীর প্রেম। শুনতে বেশ ভালো লাগে। দুবাই এয়ারপোর্ট থেকে দেশ থেকে আসার সময় অপুর্ব কিনে এনেছিলো। ওর খুব পছন্দের এই টেপ রেকর্ডারটি।
বিকেলের সোনালী রোদ জানলা দিয়ে রান্না ঘরে এসে পড়ছে। শেষ বিকেলের উদাসী বাতাস পাশের বাগান থেকে যেন ফুলের গন্ধ নিয়ে আসছে। ধব ধবে সাদা আকাশে কয়েকটি চিল ভি শেইপ এঁকে উড়ে । ঠিক উড়ো জাহাজের ডানার মতো। অপুর্ব ৮ তলার এই রান্না ঘরের খোলা জানালার পাশের রেলিং ঘেঁসে বসে আছে খুব সাবধানতার সাথে। সুতপা কয়েকবার বারন করেছে এ ভাবে না বসতে। একটু অসাবধানতায় বিপদ হতে পারে। কিন্তু অপুর্বর মন আজ অন্য রকম। মনের গহিনে কেমন একটা সুখের অনুভূতি।
প্রান খোলে যেন পড়ন্ত বিকালের এই অপার সৌন্দর্যকে উপভোগ করছে
Read full book here: Click here to download the PDF file