পর্ব-১৬
Summary:
জীবন যেন এক বহতা নদী।
পিছনে তাকানোর কোন ফুরসৎ নেই। এগিয়ে চলাই এর নিয়ম। সময়ের বিবর্তনে এগুতে থাকে নানা প্রতিকুলতার মধ্যে।
অপুর্ব নদী আর মানুষের সাযুজ্য খোঁজে। মানুষ আর নদী আসলেই কি সময়ের সমান্তরাল এগিয়ে চলে? প্রশ্ন দেখা দেয় অপূর্বর মনে।
আজ আর অপূর্বর এতসব ভাবার সময় নেই। সময় যেন খুব সীমিত। তার মনে শুধু প্রশ্ন আর প্রশ্ন। কবি বলেছিলেন, ‘ভালোবাসলে নারী হয় নরম, নদী আর পুরুষ জলন্ত কাঠ’ কবির কল্পনাই কি আসলে সত্য। প্রতিটি নদীই তার নিজস্ব একটি গল্প । যা প্রায়শই এই সুন্দর পৃথিবীর মৃত্তিকা ও মায়ের বুকে অপার মহিমায় হামাগুড়ি দিয়ে এঁকে বেঁকে চলে সর্পিলাকারে। যার কোন আদি নেই অন্ত নেই। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে লক্ষ মানুষের হাসি-কান্না-আনন্দ বেদনা, সুখ-দুঃখ আর উম্মত্ত উচ্ছ্বাসের মিথস্ক্রিয়ায় নিহিত এক অনবদ্য স্মৃতিগাঁথা। সবার আশা-আকাংখা, প্রেম-ভালোবাসা, জ্ঞান-অভিজ্ঞতা, খাদ্য, বিনোদন, শক্তি কতো কিছু অকৃপনতার সঙ্গে দিয়ে বয়ে চলে।
এ কি এক প্রাঞ্জল, ভুবনমোহিনী, তরঙ্গীনির অলৌকিক খেলা? নদীরাই কি আমাদের বেঁচে থাকার নির্ভরতা? এসব প্রশ্নের উত্তর পায় না অপূর্ব। কি এক অদৃশ্য যন্ত্রনার মধ্যে বসবাস তা ভাষায় প্রকাশ করতে পারে না সে।
কি চমৎকার সাদৃশ্য নদীদের ও মানুষের মধ্যে। বেদনার মরচেপড়া চৌকাঠে পা দিয়ে আজ তার মনে হয়- উৎস পথটা ভিন্ন হলেও চলার পথটা একই সমীকরনে বাঁধা। নদী বহতা সাগরের মোহনায় মিশেই যেন নিস্কৃতি পায়। কিন্তু মানুষ? হা, তার অনন্ত চলার পথ কখোনই কি মসৃন হতে পারে না? । আজ এই প্রশ্ন জিউসের ঈগলের মতো তাকে খুবলে খেতে থাকে। জীবনের এই সরল রহস্য কাউকে বলার নয়। কখনো খরাদাহের অস্থিরতা, কখনো বা আষাঢ়ের অঝর বৃস্টিপাত। আবার কখনো হিমাংকের নিচে শীতের কন কনে ঠান্ডা আর তুষারের ভয়ংকর হাঁড় কাঁপানো আছড়িয়ে পরা বাতাসের তান্ডব। তারপরেও সব পরিস্থিতিকে গ্রহন করেই পথ চলা। দুমড়ে গেলেও মানুষ আবার ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ায় এবং ভবিতব্যের দিকে হাত বাড়িয়ে ফের চলতে থাকে।
অপুর্ব-সুতপার জীবন যেন অদম্য প্রকৃতির সমান্তরালে এগিয়ে চলে।
ইতিমধ্যে অনেকগুলো মাস চলে গেলো। মস্কোর নদীর জলেও গড়িয়েছে অনেক জল। বরফ শীতল জল ও পাখির ডানায় যেন লেখা পরিবর্তনের সীমারেখা। এর থেকে কি কোন নিস্কৃতি নেই? সূর্য ওঠে-অস্ত যায়। কখনো সুনীল চালধোয়া আকাশ, কখনো মেঘাচ্ছন্ন। এই কি জীবনের ইতিবৃত্ত।
ভাবনার বরফ গলে বাতাবরন জমাট বাধে। তার মধ্যে মানুষ ছুটে চলে তার প্রাত্যহিক কাজে। শুধু অপূর্ব-সুতপার বেলায় বিষয়টা জীবনের স্বরলিপির পাতা উল্টে চলে। তবু অপূর্ব সুতপার জীবন খেই হারায় না। ভোলগা -লেনার গতির মতো বয়ে চলে। অপূর্ব কখনো মস্কোর সড়কে বরফের পাশে দাঁড়িয়ে নিজের প্রতিবিম্ব দেখে। সব ঠিক আছে। তবু অন্তর্গত দেনা যেন সূতোয় বাধা আপেলের মতো দোদুল্যমান। এ কেমন জীবনকে অতিক্রম করছে সে?
সুতপা মস্কোতে এসেছে প্রায় দেড় বছর হয়ে গেলো। প্রথম বর্ষ শেষ হলো। দ্বিতীয় বর্ষের অর্ধেক শেষ। সেপ্টেম্বরে শুরু হবে তার তৃতীয় বর্ষ।
এর মধ্যেই সোভিয়েত সমাজে এসেছে নানা ঝড়-ঝাপটা, পরিবর্তন আর ভাঙ্গনের জোয়ার। সোভিয়েত সাম্রাজ্য কাঁচের চুরির মতো ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে গেলো চোখের সামনে। গত ডিসেম্বরের ২৬ তারিখ অর্থাৎ ১৯৯১ সাল যেন বিশ্বের ইতিহাসের একটি কালো দিন। সোভিয়েতবাসী দেখলো এক অভাবিত নক্ষত্রের পতন। সোভিয়েত ইউনিয়নের শেষ দিন। ভেঙ্গে পনেরটি নতুন রাস্ট্রের সুচনা হলো। সেই দিন রাশিয়ার অনেকেই যেমন ভবিতব্যকে না জেনেই ক্ষনিকের মোহে উল্লাসে তান্ডব নিত্যে মেতেছিল, ঠিক তেমনি অনেকে আবার অশ্রুশিক্ত বদনে বুক চাপড়িয়ে কেঁদেছিলেন। বুঝতে পারছিলেন খুব শিঘ্রই সমাজে নেমে আসবে ভয়াবহ কৃষ্ণপক্ষ।
রুস্তভে প্রিপারেটরি শেষ করে সুতপা মস্কোতে ট্রান্সফার হয়।
সে বছর সামারে দেশ থেকে ঘুরে আসার পর অপুর্বই ওকে ওর হোস্টেলে নিয়ে যায়। আগ থেকেই সব ব্যাবস্থা করে রেখেছিলো অপুর্ব। সুতপার হোস্টেলটি প্লানেরনায়া মেট্রো স্টেশনের কাছেই। তবে মস্কোর এক প্রান্তে। সেরমিটেয়েভা ইন্টরন্যাশনাল এয়ারপোর্টের খুব কাছাকাছি। হোস্টেলের চারিদিক সবুজে ঘেরা। ঠিক পেছনেই রয়েছে একটি বিশাল পার্ক। মাইল খানেক দুর দিয়ে চলে গেছে মস্কোর রিং রোডটি। খুব শান্ত পরিবেশ। মিখলুখ মাখলায়া থেকে বেশ দুর। প্রায় দেড় ঘন্টার মতো লাগে বাস-ট্রেন ধরে যেতে। তবে হোস্টেলটি মেট্রো থেকে হাঁটার দুরত্বের মধ্যে। বাসে দুইটা স্টপিজ। এই হোস্টেলে সুতপা একাই বাংলাদেশী। কিছু ইন্ডিয়ান স্টুডেন্ট রয়েছে। ইন্টারন্যাশনাল ডিপার্টমেন্টের ডীন নিকোলাই দিমিত্রিভিচ ঝুকভ কথা প্রসঙ্গে অপুর্বকে বলছিলো-
-আগে দু-একজন বাংলাদেশী এখানে ছিলো। তবে গত দু-তিন বছর কোন বাংলাদেশী স্টূডেন্ট এখানে পড়তে আসেনি।
-সুতপা ছাড়া আর কেউ নেই? অপুর্ব জানতে চেয়েছিলো
-আপাততঃ নেই-সুন্দর হাসিতে জবাব দিয়েছিলো প্রফেসর ঝুকভ। এই পর্যন্ত বেশ কয়েকবার অপুর্বর কথা হয় প্রফেসর ঝুকভের সাথে। আস্তে আস্তে বেশ বন্ধুত্বপূর্ন সম্পর্ক গড়ে উঠে। তার ব্যবহার বেশ অমায়িক। ধীরে ধীরে কথা বলেন প্রফেসর ঝুকভ। বেশ লম্বা। কুঁকড়ানো মাথার চুলে বেশ সুঠাম দেহী।
-নিয়েত প্রিচিন দ্লিয়া বেচস্পাইকইস্তভা। নি বুদেত নি কাখিক ত্রুদনস্তি (চিন্তার কোন কারন নাই। কোন অসুবিধা হবে না)
অপুর্বকে আস্বস্ত করলেন। সাথে সাথে এও বললেন-
-সুতপা প্রবাদিত্সা বি বালসই কোমনাতে। এতা কোমনাতা আবিচনা রাস্চিতানা না ত্রয়িখ। নো আনি স্তায়িতসা দবইয়ম (সুতপাকে বড় রুমটিতে দেওয়া হয়েছে। ওই রুমটি সাধারনত তিনজনের জন্য। তবে ওরা দুইজন থাকবে।)
-ইজ কাকই স্ত্রানী ব্তারায়া জেবুশকা (দ্বিতীয় মেয়েটি কোন দেশ থেকে এসেছে)? -অপুর্ব জিজ্ঞেস করেছিলো
প্রফেসর ঝুকভ জবাব দিয়েছিলো-মাদাগস্কারের।
-অচিন খারসায়া জেবুশকা (খুব ভালো মেয়ে)
ইউনিভার্সিটিতেও সুতপা একাই বাংলাদেশী। তাই এই নতুন পরিবেশে নিজকে অভ্যস্থ করতে বেশ কিছুদিন লাগে।
প্রথম প্রথম এখানে থাকতে চাইতো না। বেশ কান্না-কাটি করতো। একা একা লাগতো। যেখানে ক্লাশ করতে যেত সেটাও হোস্টেল থেকে বেশ দুরে। সেন্ট্রাল মস্কোতে। মেট্রোতে প্রায় ঘন্টা খানেক এর পথ। হোস্টেল থেকে হেঁটে প্রথমে মেট্রো স্টেশনে যেতে লাগে পনের মিনিট।
গরমের সময় অবশ্যই হেঁটে যাওয়াতেই আনন্দ। কিন্তু সমস্যা হতো শীতকলে। মাঝে মধ্যে প্রচন্ড শীতে তুষার পাতের হীম শীতল সকালে হেঁটে যাওয়া ভীষন কষ্টকর মনে হতো সুতপার। ধব ধবে সাদা শক্ত বরফের উপর দিয়ে হাঁটতে গিয়ে বেশ কয়েকবার পা পিছলে রাস্তায় পড়ে বেশ আঘাতও পেয়েছে। একবারতো হাসপাতালে সপ্তাহখানেকের অবস্থান। তাই শীত আসলেই বেশ বিষন্নতা আকড়ে ধরতো।
প্রথম দিন হোস্টেলে আসার পর নিজের রুমটি বুঝে নিয়ে সব কিছু গুজগাছ করে নেয় সুতপা। ২০ তলার বিশাল বিল্ডিং এর ৮ তলায় রুমটি পেয়ে বেশ খুশী খুশী লাগছিলো। কাঁচের বিশাল জানালা দিয়ে দুরে মাটিতে মিশে থাকা আকাশটাকে ভারী মিষ্টি লাগে। একটি ব্লকে দুটি রুম। একটি কমন বাথ রুম। প্রতিটি ফ্লোরে আছে বেশ বড় সাইজের একটি কমন রান্না ঘর। সুতপার রুমের বেশ কাছেই উল্টোদিকে। বড় রুমটিতেই সুতপার থাকার ব্যবস্থা হলো। তার রুম মেট একজন মাদাগাস্কারের মেয়ে। হারাসুয়া মেয়েটির নাম। মুখে একটি অর্ধ চাঁদাকৃতি হাসি যেন সব সময় ফুটেই থাকে। আফ্রিকান হলেও গায়ের রংটা বেশ শ্যমলা,কালো কোকড়ানো ঘন চুলে বেশ ভালো লাগে।
প্রথম দেখাতেই বেশ জমিয়ে ফেলেছিলো। সেও দ্বিতীয় বর্ষে পড়ে। তবে অন্য ডিপার্টমেন্টে। সুতপাকে পেয়ে ও যেন বেশ খুশী হয়েছে। পাশের ছোট রুমটিতে দুজন রাশিয়ান মেয়ে। যদিও প্রথম দিন ওদের সাথে দেখা হয়নি। তবে ধীরে ধরে সুতপার সাথে ওদের বেশ সখ্যতা তৈরী হয়।
প্রথম দিন সুতপাকে অপুর্বই হোস্টেলে নিয়ে যায়। সবকিছু গুছিয়ে নিতে একটু সময় লাগে। আগস্টের শেষ দিন। সেই সময়টা হলো মস্কোতে ইন্ডিয়ান সামার। চমৎকার আবহাওয়া। নীলাকাশে মেঘের কোন আনাগোনা নেই। লম্বা দিন। রৌদ্রে ভরপুর চারিদিক। নরম বাতাসের হলকা আমেজে পরিবেশটা একেবাওে ফুরফুরে। দুজনেই বেশ ক্লান্ত। তাই নিচে নেমে এসে বুফেতে খেয়ে নিলো।
খাওয়া দাওয়ার পর হোস্টেলের আশে পাশে কিছুক্ষন ঘোরাঘুরি করে জায়গাটাকে একটু ভালো করে দেখে নিল। পাশা-পাশি চারটা বিল্ডিং। সবগুলিই ২০ তলার। হোস্টেলের সামনেই খোলা প্রান্তর। তার পাশ দিয়েই রাস্তাটি চলে গেছে প্লানেরনায়া মেট্রো পর্যন্ত।
এক সময় অপুর্ব রওনা দিলো নিজের হোস্টেলে ফিরে আসার জন্য। হঠাৎ পিছন থেকে তার হাতটি চেপে ধরলো সুতপা-
-আমি তোমার সাথে যাবো
-কোথায়?
-কোথায় আবার? মিখলুখা মাখলায়া?
-কেন?
-আমি এখানে একা একা থাকতে পারবো না?
-একা কোথায়? তোমার রুমমেটতো আছে?
-তাও, তুমি না হয় আজ থেকে যাও।
অনেক বুঝিয়ে সুজিয়ে অপুর্ব সেদিন চলে আসে।
তার পর ওদের আসা যাওয়া বাড়তে থাকে। সাপ্তাহিক ছুটির দিনগুলিতে সুতপাই বেশী সময় অপুর্বর ঐখানে চলে আসতো। কখনো সখনো একে অপরকে সার্পাইজ দিবে বলে হুট করেই চলে আসতো ক্লাশের পরে। এক সাথে চলতো রান্না-বান্না। সন্ধ্যায় ঘুরে বেড়াতো পাশের লেকে কিংবা পেছনের পার্কে।
এভাবেই বাড়তে লাগলো ওদের ভালোবাসা, অন্তরঙ্গতা আর একে অপরের প্রতি মানসিক দূর্বলতা। দ্রুত পার হতে থাকে সময়। আনন্দে-বিলাসে, উৎফুল্ল মেজাজে। কখনো বা উন্মাদ-উত্তেজনায় উদাসী প্রান পেখম মেলে। অপুর্বর কবিতা লেখায় যেন প্রান ফিরে পায়। সুতপার কন্ঠে সে কবিতা হয়ে উঠে জীবন্ত।
কিন্তু বিধি বাম!
জীবন যেন নীলাকাশ নয়।
মাঝে মাঝে কালো মেঘেদের চলে আনাগোনা। কোন এক কাল বৈশাখী ঝড়ের তান্ডবে তছনছ করে দেয় মানুষের জীবন, আশা আকাঙা, স্বাধ-আহল্লাদ আর ভবিতব্যের কোলে সুখের নীড় গড়ার স্বপ্ন।
এমটিই যেন ঘটে গেলো সুতপা-অপুর্বর জীবনে। জীবনে দুঃখের পাত্র এতোই উপচানো থাকে যে প্রতিটি মানুষকে কিছু না কিছু দুঃখ বহন করতে হয়। কিন্তু জীবনের কোন এক বাঁকে এসে জীবনের উপর দিয়ে যে এতো ঝড় বয়ে যাবে অপুর্ব তা ভাবতেও পারেনি। মানুষ যেন তার বিষাদের চিতা নিজের অজান্তেই নিজের হাতেই সাঁজায়। আর সেই চিতার তীব্র দহনে সব পুড়ে ছাই হয়ে যায়। তাই যেন হলো।
ধীরে ধীরে খন্ড খন্ড মেঘ জমা হতে শুরু করলো জীবনের আকাশে। বাতাস ভারী হতে থাকে। এক সময় প্রবল গর্জনে বর্ষন শুরু। সব যেন ভেসে যায় যায়। প্রথম কালো মেঘের অশনি সংকেত শুরু হয় সুতপা যখন প্রথমবারের মতো দেশে যায়। এক সময় বাড়ির সবাই অপুর্বর সঙ্গে সুতপার সম্পর্কের ব্যাপারে জানতে পারে। সুতপার বাবা প্রচন্ড রেগে যায়-
-ছেলেটি কে? -কঠিন সুরে সুতপার বাবা জানতে চায়।
-মস্কোতে পড়াশুনা করে। আমাদের দু’বছরের সিনিয়র। সুতপার যেন ভয়ে গা কাঁপছে। আগে কখনো এমন ভাবে বাবার সামনে দাঁড়াতে হয়নি। এ যেন বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়ানোর মতো।
-ব্রাহ্মন না অন্য কোন সম্প্রদায়ের?-ভয়ানক কন্ঠ-সুতপা কিচ্ছু বলছে না। মাটির দিকে চোখ দু’টি স্থির
-কবে থেকে ওকে চেন?
-উত্তর দিচ্ছো না কেন? তোমাকে কি মস্কো পাঠিয়েছি প্রেম করার জন্য? এতসব ছাড়, পড়াশুনা করতে গিয়েছ, পড়াশুনা শেষ করে আসো।-আবারো কঠিন মেজাজে বলে উঠে-
-ওদের পদবী কী?
এবার সুতপা মুখ খুললো-
-ওরা ব্রাহ্মন না, ক্ষত্রিয়। তবে ছেলেটি খুব ভালো বাবা
-তুমি ভালো মন্দের কি জান? আর ভালো কি মন্দ তাতে আমাদের কী? তুমি কি করে ভাবলে তোমার এ সম্পর্ক আমরা মেনে নেব? মাথা থেকে ওর ভাবনা তুলে ফেল। এতেই তোমার মঙ্গল।
সুতপার মুখ তখন বৈশাখী লালচে গুমোট আকাশের মতো গম্ভীর। কান দুটি লাল, বাজারে একটু দর কমানোর জন্য মধ্যবিত্তের চোখ-মুখ লজ্জায় যতোটা লাল হয় ততোটা। ঠোঁট দু’টি ভয়ে কাঁপছে। নাকের উপরের পাতলা চামড়া তির তির করে কেঁপে উঠছে। কিন্তু কিছু বলতে পারছে না।
হঠাৎ সুতপার মায়ের কাঁপা কাঁপা কন্ঠস্বর-
-ওকে যতোই বুঝাও লাভ নাই। ঐই ছেলেই ওর কাছে সব। এতো কষ্ট করে যে ওরে বড়ো করলাম তার কোন দাম নাই। এই এক বছরেই ওর এতো পরিবর্তন-ভাবা যায়? কথা না শুনলে ওকে আর মস্কো পাঠানোর দরকার নাই। এখানেই পড়াশুনা করুক।
সুতপার বাবা আবার উত্তেজিত-
-কথা না শুনলে ওর অবস্থাও ওর পিসির মতো হবে। এইটা ওকে বুঝিয়ে দাও।
এমন সময় সুতপার বড়ো বৌদি এসে সুতপাকে তার ঘরে নিয়ে যায়।
সুতপার পিসি হেমাঙ্গিনী কলেজ পড়াকালিন সময় কোন এক মৃনাল নামের ছেলেকে ভালো বাসতো। তবে ছেলেটি ব্রাহ্মন নয় বলে ওদের সম্পর্কে কেউ মেনে নেয়নি।
কিন্তু ভালোবাসা যে প্রগাঢ়, অকতোভয়, বাধাহীন। ভালবাসা যুদ্ধের মত।
ভবিতব্যকে বাজী রেখেই একদিন সবার অজান্তেই হেমাঙ্গিনী আর মৃনাল পালিয়ে যায়। আর কখনো ফিরে আসেনি।
সুতপার দাদু থানায় ডায়রি লিখেন। লোক দিয়ে অনেক খোঁজ খবর করেন। কোন সন্ধান পেলেন না। ঠিক এক মাসের মাথায় উকিল এনে হেমাঙ্গিনীকে ত্যাজ্য করেন। সেই দিন থেকে কেউ আর ওর নাম ঘরে-বাইরে উচ্চারন করেনি। ওর সাথে জড়িয়ে থাকা কাপড়-চোপড় সহ সব কিছু উঠোনে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ফেলা হয়। অনেক দিন হেমাঙ্গিনীর মা ফুফিয়ে ফুফিয়ে কেঁদেছেন, চোখের জলে শাড়ির আচল ভিজিয়েছেন, বুকে পাথর চাপা কান্না সহ্য করেছেন কিন্তু স্বামীকে এক দন্ডও বুঝতে দেয়নি।
বাবার কথায় সুতপা এবার কিছুটা ঘাবড়ে গেলো।
কখনো বাবার অবাধ্য হয়নি। ঘরের ছোট মেয়ে বলে সকলের আদর একটু বেশী পেতো। বাবা রাগী হলেও সুতপা কখনো তা অনুভব করেনি। পিসির কথা মনে আসায় আজ বেশ অসহায় বোধ করলো।
বৌদির রুমে ঢুকেই সুতপা হাউ মাউ করে কেঁদে উঠে। সাড়াটা দিন সুতপা সেদিন কেঁদেছিলো। খাওয়া দাওয়া বন্ধ। শুধু ভাবছে কী করবে। কোন সমাধান যেন পাচ্ছে না। বৌদি অনেক বুঝালো। মাও এসে বুকের কাছে টেনে নিলো। আদর করলো। অনেক কিছু বললো।
মায়ের কোলে মাথা গুজে ফুঁসে ফুঁসে কাঁদছিলো। কুন্ডুলির আকৃতি হয়ে শুয়ে থাকলো কিছুক্ষন।
মা বলেই চলছে-
-এই ঘরে তুই সবার ছোট। কিন্তু বুদ্ধিতে আর আচার-আচরনে তুইতো সবার বড়ো। আজ পর্যন্ত তুই কারো অবাধ্য হসনি। তুই কি
করে ভাবলি তোর বাবা এই ব্যাপারটা মেনে নিবে? এখন চোখ-মুখটা ধুয়ে নেয়। খিছু খেয়ে নে। এই নিয়ে আর কিছু ভাবিসনে যেন। ভালো করে পড়াশুনাটা শেষ করে আয়। তুই রাজ-রানী হবি। আয় মা।
কিন্তু অনেক কিছুই যেন সুতপার কানে ঢুকছিল না। মন যখন অশান্ত, দুঃশ্চিন্তায় ভরপুর তখন কান অনেক কিছু শুনতে পায় না।
চোখের সামনে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলিও ঠিকমতো দেখতে পায় না। শুধু ভাবছে কি করবে?
তারপর দেখতে দেখতে কয়েকটা সপ্তাহ চলে গেলো। অপূর্বর প্রসঙ্গ নিয়ে আর কেউ কিছু বলে নি। কিন্তু সুতপার কোন কিছুতেই যেন মন বসছিলো না।
সরাক্ষন বুকটা ধরফর করতো। আশে পাশের কোন কিছুকেই আগের মতো আর ভালো লাগছিল না। মস্কো ফিরে আসার দিন গুনছে। কিন্তু মনের ভগ্ন অবস্থা কাউকে বুঝতে দেয়নি। একদিন সময় ফুরিয়ে এলো। ফিরে আসে মস্কোতে।
অপুর্ব এয়ারপোর্টে ছিলো। সুতপাকে আনতে।
অপুর্বও গত সপ্তাহে দেশ থেকে ফিরে এসেছে। কয়েক সপ্তাহ সুতপাকে দেখতে না পেয়ে মনটা কেমন আনচান করছে। দেখার এক প্রচন্ড তৃষ্ণা।
সুতপা এলো। কিন্তু ওর চোখ-মুখ দেখে অপুর্ব আঁৎকে উঠলো। বেশ বিমর্ষ দেখাচ্ছিলো সুতপাকে। রোগা রোগা মনে হচ্ছিলো।
কাছে আসতে জিজ্ঞেস করলো-
-কেমন আছো তুমি? বিমানে কোন অসুবিধা হয়নি তো?
-না-উত্তরে সুতপা
-তা হলে এতো রোগা মনে হচ্ছে কেন? শরীর ঠিক ছিলো তো? কোন অসুখ-বিসুখ?
-আমার কিছু হয় নি, আমি ঠিক আছি
কেমন অন্যরকম লাগছিলো সুতপাকে। নিথর জবাব। শুধু যেন প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছে। এখন পর্যন্ত অপুর্ব কেমন আছে সেটাও
জানতে চায়নি। অপুর্বর ভয় ভয় লাগছে। ওদের সম্পর্ককে নিয়ে বাড়িতে কিছু ঘটেনিতো। আগরম বাগরম ভাবতে লাগলো।
এক সময় একটা ট্যাক্সি নিয়ে রওনা দিলো।
সুতপা একেবারে চুপ চাপ। কিছু বলছে না। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে। কিছুটা অন্যমনস্ক। অপুর্ব আবার জিজ্ঞেস করলো-
-তুমি কিছু বলছো না যে? তোমার দেশে কেমন কাটলো?
এবার সুতপা মুখ খুললো
-ভালো
-কিন্তু তোমার কি হয়েছে? কোন সমস্যা হয়নি তো? -অপুর্ব জানতে চায়
এবার একটু রাগের সুরেই সুতপা বললো
-আমাকে নিয়ে তোমার এতো ভাবনা কিসের?
-কি বলছো তুমি? আর এমন করে বলছো কেন?
-এখন থেকে আর ভাববে না, সুতপার কড়া সুর
-কিন্তু কেন? যাকে ভালোবাসি তাকে নিয়ে ভাববো না? তা কি করে হয়। তুমি কি আমাকে নিয়ে ভাবো না?
-জানি না
-জানো, বলো বলতে চাও না। কিন্তু এখন এ কথা বলছো কেন?
-আমার এখন খুব ক্লান্তি লাগছে। কথা বলতে ভালো লাগছে না।
-ভালো লাগছে না, নাকি কথা বলতে চাচ্ছো না?
-দু’টিই-সুতপার কন্ঠে আর্দ্রতা। আস্তে করেই শব্দটি বেড়িয়ে আসলো।
কোথায় যেন একটা গন্ডগোলের আভাস পেল অপুর্ব। ট্যাক্সিটি এগিয়ে চলছে প্লানেরনায়ার দিকে। বাইরে দিনান্তের সোনালী
রোদের আনাগোনা। পরিস্কার আকাশে হুপার রাজহাঁস পত পত করে পেখম মেলে উড়ে যাচ্ছে। সেদিকে অপুর্বর কোন নজর নেই। হৃদয়ে যেন সামুদ্রিক গর্জন, বুকে উথাল -পাথাল- কি যেন এক অজানা ভয় চেপে ধরেছে বুকটা।
আবার প্রশ্ন-কিন্তু খুব আস্তে, বিনয়ের সুরে
-প্রথমটা বুঝলাম, কিন্তু পরেরটা কী?
-ভয়
-কিসের ভয়?
হঠাৎ সুতপা অপুর্বর বুকে মাথা গুঁজে ঢুকরে কেঁদে উঠলো-
-আমি জানি না আমি কি করবো। আমার পরিবারের কেউ চায়না তোমার সাথে আমি আর মিশি। তোমার আমার সম্পর্ককে ওরা কখনো মেনে নেবে না। আমার বাবাকে আমি চিনি।
-ঠিক আছে, এখন না হয় এই নিয়ে না ভাবলে। মা-বাবা সবসময় সন্তানের ভালো চায়। কাউকে ভালোবাসলে দুঃখ আসবে এইতো
স্বাভাবিক। একদিন দেখবে সব ঠিক হয়ে যাবে। আমাদের সম্পর্ককে তোমার পরিবারের সকলেই মেনে নেবে। এখন তুমি শান্ত হও।
সুতপা চুপ করে আছে।
খ্যাচ করে ট্যাক্সিটা হোস্টেলের সামনে এসে থামলো।
তারপর বেশ কিছুদিন অপুর্বকে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করেছিলো সুতপা। কিন্তু বেশী দিন অভিমান করে থাকতে পারেনি। ভলোবাসার মানুষকে দুরে ঠেলে দেওয়া যায়- তাতে ভালো থাকা যায় না। যন্ত্রনা ভিসুভিয়াসের অগ্নিদহনের চেয়েও প্রবল। স্পন্দনশীল, পরিপূর্ণ ভালবাসা এমন এক ধরনের অনুভূতি যা স্বর্গ এবং পৃথিবীর মধ্যে মোহমুগ্ধকর সুরতান সৃষ্টি করে। যা সব সময় মনের গহীন ভেতরে উছলিয়ে উঠে। যতোই বিপদ কিংবা বাধাই আসুক না কেন ভালোবাসার প্রতি এতো বড়ো অন্যায় করা সুতপার পক্ষে সম্ভব হলো না।
এভাবে উপদ্রুত উপকুলের মানুষের জীবন সংগ্রামের মতো এগিয়ে যাচ্ছিলো দিন। জল পড়ে, পাতা নড়ে-দিন চলতে থাকে দিনের পথে ।
Read full book here: Click here to download the PDF file