মস্কোর বরফবিথী ও একজন সুতপা পর্ব-১৫


Author: ড. পল্টু দত্ত

পর্ব-১৫

Summary:

চলতি পথে হঠাৎ ঘুমের ঘোরে কারো আওয়াজ যেন খট করে উঠলো। অপুর্বর কাঁধের কাছে এবার কারো হাতের হালকা ঠেলা লাগলো-

-স্তাবাই সিচাস। উঝে পাচতি দেশিত বেচেরা (এখন উঠুন। প্রায় ১০টা বাজে)

চোখ কচলাতে কচলাতে তাকানোর চেষ্টা করলো। ওর পাশেই মেয়েটি দাঁড়িয়ে আছে। অপুর্ব কেমন জানি বোধ করলো। একটু লজ্জা লজ্জা। কিছু বলার সময় দেয় নি। আবার বলে উঠলো-

-ইজবিনি। এতা নি ইয়া। মাইয়া বাবুশখা খচেত স্তোবি তি স্ত নিবুধ সিয়েলী (দুঃখিত এটা আমি নই. আমার বাবুস্কা চায় তোমাকে কিছু খাওয়াতে)-হাসি মুখে অপুর্বর দিকে তাকিয়ে আছে মেয়েটি।

-দাবাই ছিনক। উঝে স্পাল খারাশু। তিপের স্তাবাই ই ইয়েশ স্তো নিবুধ (ভাল ঘুমিয়েছো, এখন উঠে কিছু খাও)-বৃদ্ধা মহিলাটি সামনের বেড থেকে অপুর্বর দিকে চেয়ে হাসি মুখে বলে।

অপুর্ব এবার উঠে বসলো।

-স্পাশিবা (ধন্যবাদ) দিয়ে কেবিনের দরজা খুলে টয়লেটের দিকে গেলো।

ফিরে এসে অপুর্বতো সত্যিই হতবাক।

টেবিলে অপুর্বর জন্য একটা প্লেটে একটা সসেজ এবং সালাদ দেওয়া সেন্ডুস, একটা আপেল, কলা এবং কিছু মিক্সড বাদাম সহ একটি কাঁচের গ্লাসে রং চা।

 

-ছিনক এতি দিলিয়া তিবিয়া (এগুলি তোর জন্য, বাবু)-মহিলাটি পিট পিট করে অপুর্বর দিকে তাকিয়ে বলে। বেশ বয়েস হয়েছে মনে হয় কিন্তু প্রতিটি দাঁত যেন এখনো বেশ সতেজ। তবে গলার উপরের অংশের চামড়া কিছুটা ঝুলে পড়েছে। মুখে সব সময় একটি হাসির রেশ। খুব প্রানবন্ত সুখ সুখ ভাব।

অপুর্ব মানা করতে পারলো না। ওদের সাথেই খাওয়া শুরু করলো। খেতে খেতে মহিলাটি অপুর্বকে বললো-

-কাক তিবিয়া জাবুত (তোমার নাম কি?)

-অপুর্ব

এবার মেয়েটিকে অপুর্ব নাম জিজ্ঞেস করলো-

-নাতাশা

-নাতাশা মাইয়া ব্নুচকা (নাতাশা আমার নাতনী), আনা ইজুচ্চায়েত মেডিসিনু বি মস্কোভস্কম ইউনিভেরসিতেতে। পেয়েরবি গোদ (মস্কোতে মেডিসিনে পরে। ফার্স্ট ইয়ার)-

-অচিন খারাশু (খুব ভালো)

 

এর মধ্যে খাওয়া শেষ হলো। তার পর রাত ১২টা পর্যন্ত চললো গল্প গুজব।

মহিলার পরিবার মস্কোতেই থাকে। শহরতলীতে। স্বামী বছর দশেক আগে মারা যায় এক এক্সিডেন্টে। ছেলে, ছেলের বউ আর নাতনীকে নিয়েই একসাথে থাকে। প্রায় প্রতি বছরই সামারস্কাইয়ে এই সময়ে যায়। ছোট ছেলে ঐ শহরে চাকুরি করে। প্রায় বিশ বছর ধরে। ওখানে মাস খানেক থাকবে। 

হঠাৎ অপুর্ব লক্ষ করলো মেয়েটি ওর দিকে তাকিয়ে আছে। মিট মিট করে হাসছে। মাঝে মধ্যে ঠোঁটে দাঁত চেপে ধরছে। কেমন একটু দুষ্টু দুষ্টু ভাব। ভাসা ভাসা চোখ দুটি দিয়ে কিসের দহন টের পেল অপুর্ব। কি সুন্দর তীর চোখা নাক। এই বয়সটাই এরকম। ভাল লাগার বয়স। নতুন কাউকে দেখলেই মনের মাঝে অন্যরকম ভাবসাব দেখা দেয়। কিন্তু অপুর্বর সারা মন জুড়ে অন্য কারোর বাসন্তী হাওয়া। তাই নতুন করে ভাবসাবের ফুরসৎ নেই। অপুর্ব না দেখার ভান করে একটা বই হাতে নিয়ে নিজের বেডের আলোটা জ্বালিয়ে দিয়ে কাত করে বালিশে হেলান দিলো।

 

মহিলাটিও ঘুমানোর পায়তারি করছে। নাতনিকে উপরের বেডে গিয়ে শুতে বললো। এক সময় কেবিনের আলোটা নিবিয়ে দেওয়া হলো।

মধ্যরজনীর সামারের প্রথম লগ্নে রাতের নিস্তব্ধতা ভেদ করে এগিয়ে চলেছে ট্রেন।

যখন ঘুম থেকে উঠলো তখন প্রায় ৭টা। বাইরে তখন ফকফকা সকালের রোদ। কিছুক্ষন পরই ট্রেন এসে থামলো সামারস্কাইয়ে। বিদায় জানিয়ে ট্রেন থেকে নেমে পড়লো ওরা। কেবিন থেকে বেরুনোর সময় নাতাশা এক পলক ঘাড় বাঁকা করে অপুর্বর দিকে তাকাল। মুখে একটা ভালো লাগার হাসি। সে হাসিতে অনেকেরই বুকের হৃদপিন্ড কেঁপে উঠবে। কেমন একটা ভলোবাসার ধড়ফড়ানিতে ভরা।

হঠাৎ করেই নাতাশা একটা চোখ টিপে অপুর্বর দিকে একটু অন্যভাবে তাকিয়ে তাড়াতাড়ি মুখটা ফিরিয়ে নিলো। কিছু বুঝার আগেই হন হন করে দাদীমার সাথে নেমে গেল।

অপুর্ব ছাড়া ট্রেনে আর কেউ নেই। আরো প্রায় ৮ ঘন্টা।

অপুর্ব একটি বই নিয়ে জানালার পাশে বসলো। ট্রেনটি আবার বাঁশী বাজিয়ে চলা শুরু করলো।

যে মুহুর্তে ট্রেনটি রোস্তভ এরিয়াতে এসে পোঁছুয় তখন হঠাৎ সবকিছু বদলে যায়। রং বদলাতে শুরু করে। বাইরের বৈচিত্র্যতা বদলাতে থাকে। নতুন মানুষের সন্ধান মেলে। রোস্তভ-অন-ডনের কাছে আসলেই কসাকদের সন্ধান পাওয়া যায়। এখনো অনেক কসাক পরিবার এই এলাকায় বসবাস করে। তাদেরকে চেনার সহজ উপায় হলো তাদের পোশাক। তাদের ঐতিহ্যবাহী পোশাকের মধ্যে রয়েছে হাঁটু দৈর্ঘ্যের বুট, গোড়ালি দৈর্ঘ্যের ট্রাউজার এবং লম্বা শার্ট। ট্রেনটি যখন নানা গ্রাম আর শহরগুলির মধ্যদিয়ে যাচ্ছিল, অপুর্ব তখন এই কসাকদের দেখে খুব বিস্মিত হচ্ছিলো।

 

অবশেষে, অত্যাশ্চর্য দৃশ্যাবলীর মধ্য দিয়ে ভ্রমণের দীর্ঘ দিন কাটানোর পর ট্রেন রোস্তভের প্রধান রেল স্টেশনটিতে এসে থামে। শেষ হয় একটি অবিশ্বাস্য ভ্রমণের সমাপ্তি। ট্রেন থেকে নীচে নেমেই ওর চক্ষুদ্বয় যেন কাকে খুঁজছে। তবে বেশীক্ষন নয়। মাত্র কয়েক সেকেন্ড।

-অপুর্ব আমি এখানে।

অপুর্ব ডান পাশে ফিরে দেখে সুতপা সাথে কাউকে নিয়ে আসছে। পরনে খুব সুন্দর একটা সেলোয়ার- কামিজ। এই পোশাকে সম্ভবত এই প্রথম সুতপাকে দেখছে।

-কেমন আছো সুতপা?

-আমি ভালো, তোমার ট্রেন জার্নি কেমন হলো? পথে কোন অসুবিধা হয়নি তো?

-কিচ্ছু অসুবিধা হয়নি। এ বলে অপুর্ব পাশের লোকটির দিকে তাকাল।

-উনি আমাদের দাদা। মেডিসিনে পড়ে। উনার রুমেই তুমি এ কয়দিন থাকবে। সুতপা দাদার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়।

স্টেশন থেকে বেড়িয়েই একটা ট্যাক্সি নিলো।

-আমরা এখন দাদার রুমে যাবো। সেখান থেকে আমাদের হোস্টেলে। সেখানে খাওয়া-দাওয়া করে তুমি আবার রাতে এখানে চলে আসবে-সুতপা অপুর্বকে বলতে থাকে।

-তুমি কোন চিন্তা করো না। আমাদের এখন সামার ছুটি। তোমার সঙ্গে আমি প্রায় সময়ই থাকবো। শহরটা তোমার খুব ভালো লাগবে-দাদা অপুর্বকে সামনের সিট থেকে ঘাড় ঘুরিয়ে বলছে।

-আপনই কি নিখিল দা, যদি ভুল না করে থাকি? -অপুর্ব বলে

-হ্যা, আমিই নিখিল। আমাকে কি কোথাও দেখেছ এর আগে?

-দেখিনি। তবে আপনার কথা খুব শুনেছি।

-শুনেছ?

-হ্যাঁ, আপনি খুব ভলো ছাত্র। মেডিসিন ফ্যাকালটির বাংলাদেশিদের গর্ব। সবাই আপনকে নিয়ে গর্ব করে। খুব খুশী হলাম, দাদা। ভাবিনি আপনার সাথে এই ভাবে দেখা হয়ে যাবে। খুব ভালোই হলো। আপনার সান্নিধ্যে কয়েকদিন থাকবো

-দাদা আমরা রুস্তভে আসার পর থেকে সব সময় দেখাশুনা করেছেন। সুতপা মাঝখানে কৃতজ্ঞতার সুরে বলে

এমনকি আমাদের পড়াশুনার ব্যাপারেও অনেক হেল্প করেছেন

-থাক থাক, এতো বাড়িয়ে বলতে হবে না।-দাদার হাস্যময় উক্তি

 

অপুর্ব যখন রোস্তভ পৌঁছায় তখন প্রথম যে জিনিসটি লক্ষ্য করে তা হল এর অনন্য স্থাপত্য। এর অনেক ভবনে সুন্দর ভাস্কর্য এবং বিশদ অলঙ্করণ সহ অলঙ্কৃত সম্মুখভাগ। গাড়ীতে বসে কথার ফাঁকে ফাঁকে জানালা দিয়ে বাইরের দৃশ্য দেখছিলো। রাস্তাঘাট গুলো অনেকটা ঢাকা শহরের আধুনিক রাস্তাগুলির মতো। শুধু ঢাকার মতো অশান্ত নয়। এখানে ঢাকার মতো ট্রাফিক জ্যাম নেই, কালো ধুয়া নেই, শব্দ দুষন নেই, অসংখ্য লোকের অসতর্কিত হাঁটা চলার ব্যাত্যয় নেই। চারিদিক ছিমছাম পরিচ্ছন্ন। সবকিছুতেই একটা ব্যাঞ্জনা প্রাঞ্জল সুন্দর যেন ছুঁয়ে আছে।

জানালা দিয়ে সুন্দর ভাস্কর্য খচিত বিল্ডিংগুলো দেখার সাথে সাথে শতাব্দী প্রাচীন অতীতে যেন ফিরে যায় অপুর্ব।

একসময় ট্যাক্সি এসে থামলো।

 

এক বিশাল হোস্টেল। ভেতরে ঢুকতেই অপুর্বর আইডি দেখতে চাইলো। স্টুডেন্ট আইডিটি বেড় করে দেওয়ার সাথে সাথেই একটি বড়ো রেজিস্টার বের করে অপুর্বর নামটি খুঁজে বেড় করে তার পাশে সিগনেচার দেওয়ার জন্য অপুর্বকে রিসেপশনের মধ্যবয়সী মহিলাটি বলেন। অপুর্ব বুঝতে পারলো ওর থাকার বন্দোবস্ত ভালোভাবেই হয়েছে। আগ থেকেই হোস্টেল কতৃপক্ষকে জানিয়ে রেখেছে এবং যথারীতি পারমিশন নিয়ে রেখেছে যেন কোন ধরনের সমস্যা না হয়।

সোভিয়েত সিস্টেমে অপুর্ব বার বার মুগ্ধ হয়। কোন ফি ছাড়াই হোস্টেলে বসবাসরত শিক্ষার্থীরা তাদের বন্ধু-বান্ধবী বা কাছের কাউকে তাদের সাথে সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য আনতে পারে যদি পারমিশন থাকে। তবে এতে রুমমেটের কোন অবজেকশন না থাকলেই হয়।

তিনজনেই সিঁড়ি বেয়ে তিনতলার ৩১২ নম্বর রুমটিতে ঢুকে। নিখিলদার রুমমেট একজন নেপালী। পরীক্ষার পরদিনই দেশে চলে যায়। আসবে অগাস্টের শেষে। খুব নাকি ভালো ছেলে। দাদার মুখেই শুনেছে। এই হোস্টেলের রুমগুলি ব্লক সিস্টেম। প্রতিটি ব্লকে দু’টি রুম ও একটি বাথ রুম। মনে হলো পাশের রুমে কেউ নেই। তবে জিজ্ঞেস করতে হলো না। দাদাই বললো-

-পুরো ব্লকেই আমি এমনি একা। পাশের রুমের সবাই বাড়িতে গেছে।

- এখন তোমার ব্যাগটি রেখে হাত-মুখ ধুয়ে আসো। এতো ঘন্টার জার্নি। তুমি নিশ্চয়ই ক্লান্ত।

-না না দাদা। আমি একদম ঠিক। ৬ ঘন্টার বেশী ট্রেনে ঘুমিয়েছি একটানা।-অপুর্ব হাসতে হাসতে বলে।

-আমি একটু চা বানাই। চা পান করেই আমরা তোমাদের ঐদিকে যাই-কি বলো সুতপা? -দাদা সুতপার দিকে তাকায়।

-তাই হবে আমি চা টা বানাচ্ছি-সুতপা এই বলে চায়ের কেটলিটা নিয়ে জল ভরতে যায়।

-তোমার বানানো চা কি বেশী মিষ্টি নাকি সুতপা? বলেই হেসে লুটিয়ে পড়ছে দাদা। হাসিতে সবাই যোগ দিল।

 

এক সময় বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামে। সুতপার হোস্টেলে যখন পৌঁছাতে রাত ৮টা। তবে অন্ধকারের বালাই নেই। এখনো রৌদ্রের আলো নিভে যায় নি। সারা শহর সামারের ফর্সা আলোয় আলোকিত। ১০ টার আগে এ সময় অন্ধকার নামেনা।

সুতপারা পাঁচ বান্ধবী এবং ২জন বাংলাদেশী ছেলে একই হোস্টেলে থাকে। ওরা সবাই প্রিপারেটরীতে শেষ করলো। এখন সেপ্টেম্বর থেকে নির্দিষ্ট ফ্যাকাল্টির হোস্টেলে যাবে। আজ এখানে সবাই। পুরো রান্না ঘরটা যেন ওদের দখলেই। সবাই হুর হুর করে দৌড়ে এলো। তার পরের ঘটনা আশা করি কিছুটা হলেও আন্দাজ করা যাচ্ছে।

 

বেশ ফুর ফুরে মেজাজেই অপুর্বর সময় কাটে। দেশীয় স্টাইলে চলে ভুড়ি ভোজন। মনে রাখার মতো একটি সন্ধ্যা। 

 

কয়েকটি দিন যে কিভাবে চলে গেলো অপুর্ব টেরও পায় নি। আজ বিকেলেই আবার বিদায়ের পালা। এ কয়েক দিন বেশ গোরাঘুরি হয়েছে। অনেক জায়গায় গিয়েছে। সব সময় সুতপা ও বন্ধু-বান্ধবীরা থাকতো। নানা কথা হতো। ঠাট্টা-তামাশা চলতো একের পর এক। অনেক সময় অপুর্ব অনেক ঠাট্টা-তামাশার মানে বুঝতো না। তখন সবাই হা হা করে জোরে হেসে উঠতো। 

 

তবে গতকাল সকালে সুতপা দাদার হোস্টেলে এসে অপুর্বকে নিয়ে যায়। দাদা রুমে ছিলো না। চাবিটা অপুর্বকে দিয়ে বলেছিলো আসতে আসতে সন্ধ্যা হবে। ওরা দুজনে বেড়িয়ে পড়ে। বাস ধরে অনেক দুর। সেখান থেকে হাঁটতে হাঁটতে নদীর ধারে।

-এটাই ডন নদী-সুতপা অপুর্বকে বলে- বলতে বলতে অপুর্বর হাতটি ধরে টানে-

-চলো এখানে বসি। তুমি কাল চলে যাবে, আমার ভলো লাগছে না-সুতপার মাথাটি অপুর্বর ঘায়ে আলতো করে এলিয়ে দেয়। হাতের আঙ্গুল দিয়ে অপুর্বর পাঁচটি আঙ্গুল পেঁচিয়ে ধরে আছে।

-আমাকে তো যেতেই হবে। বরং গিয়ে তোমার সব ব্যাবস্থা করি। আর কয়দিন পরেতো তুমি আসছোই। -অপুর্ব সান্তনা দেয়

এক সময় অপুর্বর হাতের আঙ্গুল গুলি সুতপার চুলে এলো মেলো সাঁতার কাটতে থাকে। সুতপা চুপ করে আছে। অনেকক্ষন কিছুই বলে নি। আশে পাশে খুব নিরব। ডনের বুকে ঢেউয়ের ছলাৎ ছলাৎ শব্দ কানে এসে বাজছে মাঝে মধ্যে। নানা পাখিদের কুজনের কলরব চারি দিকে। ছোট ছোট ইঞ্জিন চালিত নৌকাগুল ভট ভট আওয়াজ তুলে ডনের বুকে ঢেউ খেলে এগিয়ে যাচ্ছে। আশে পাশে অনেকেই বসে ডনের সৌন্দর্য দেখছে। ডন নদীর সৌন্দ্যর্যে অপুর্বও বিমোহিত।

 

রোস্তভ-অন-ডনের ডন নদীটি শহরের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত একটি সুন্দর শান্ত স্রোতের নদী। রাশিয়ার বৃহত্তম নদীগুলির মধ্যে একটি। বহু শতাব্দী ধরে রোস্তভের ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ এই ডন। নদীটি দক্ষিণ রাশিয়ার ভলগোগ্রাদের কাছে অবস্থিত লেক বাসকুনচাক থেকে উৎপন্ন হয়েছে। এই ডন নদির পাশে বসেই নোবেল বিজয়ী বিখ্যাত লেখক মিখাইল শোলোখভ লিখেছিলন জনপ্রিয় উপন্যাস “ধীরে বহে ডন.”

 

একটি অসাধারণ রাশিয়ান মাস্টারপিস। যুদ্ধ এবং বিপ্লবের পেষনে পিষ্ঠ কসাক জনগণের অশান্ত ভাগ্যকে পরিবর্তন করতে যারা লড়াই করেছিলেন তাদের একজন গর্বিত এবং বিদ্রোহী গ্রেগর মেলেখভ। তাঁতারের মেলেখভ পরিবারের চারপাশে আবর্তিত হয়েছে উপন্যাসের প্লট। এই পরিবারটি কসাকের বংশধর। ক্রিমিয়ার যুদ্ধের সময় এই উপন্যাসের মুল নায়ক মেলেখব একজন তুর্কি বন্দীকে স্ত্রী হিসাবে গ্রহন করে। কিন্তু তিনি মেলেখভের কুসংস্কারাচ্ছন্ন প্রতিবেশীদের দ্বারা মানসিকভাবে নির্যাতিত। জাদু বিদ্যার অভিযোগে অভিযুক্ত। প্রতিবেশীরা তাকে হত্যা করার চেষ্টা করে। তাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায় তার স্বামী। দৈনন্দিন জীবনের বিশদ বিবরণের মাধ্যমে, এই রচনাটি সেই সময়ে গ্রামীণ রাশিয়ায় বাস করতে কেমন ছিল তার একটি অসাধারণ চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। রোস্তভ-অন-ডন সত্যিই একটি আশ্চর্যজনক জায়গা - ইতিহাসে ঠাসা কিন্তু আধুনিক জীবনের সাথে বিস্ফোরিত। ঠিক কাটায় কাটায় ৪ টায় ট্রেনটি ছাড়ে।

 

সুতপা এসেছিলো তার কয়েকজন বান্ধবী ও বন্ধুদেরকে নিয়ে।

সুতপা চুপচাপ। মনটা খুব খারাপ। অপুর্বরও যেতে ইচ্ছে করছে না। কিন্তু যেতে হবে। এটাই নিয়ম। বিদায় জানানোর মুহূর্তটিই যেন খুব বেদনাদায়ক। অন্তত কিছু সময়ের জন্য বিচ্ছেদের দুঃখ ও আবেগে ভারাক্রান্ত মন হয় উদ্বেলিত। কারো অনুপস্থিতিতে একে অপরের সাথে যোগাযোগ করতে না পারার উদ্বেগের তাড়না সামলানো কঠিন অনেকের জন্য।

 

সুতপার চোখের দুকোন যেন অশ্রুসিক্ত। মধ্য আকাশটিও কেমন ঘোলাটে। কালো মেঘেদের কেমন দাপাদাপি। বৃষ্টি আসবে আসবে ভাব।

হঠাৎ করেই যেন সবকিছুতেই নিশ্চলতা অনুভব করলো অপুর্ব।

-ভালো থেকো। রাতে ঘুমাবে। আর ব্যাগে কিছু খাবার আছে-এ কথা বলেই সুতপা মুখটা অন্যদিকে ঘুরিয়ে নিল।

অপুর্বর বুকটা কেমন ছ্যাৎ করে উঠলো। নিঃশ্বাস কেমন ভারী হয়ে আসছে। কেউ যেন গলায় দুহাতে চেপে ধরছে। অপুর্ব সুতপার কথায় কেমন অন্যরকম হয়ে গেল। মনটা যেন আরো বেশী খারাপ হয়ে গেল। বিদায়ের মুহুর্তে দুঃখ প্রকাশ করার একি এক বিমুর্ত প্রতিফলন ভালবাসার শব্দগুলির মাধ্যমে।

 

অপুর্ব কিছুই বলতে পারলো না। সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে অপুর্ব ট্রেনের কম্পার্টমেন্টের দিকে পা বাড়ালো। ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে। রেকসাকটা কাঁধে ঝুলানো। এমন সময় দৌড়ে এসে সুতপা ওর হাতটি ধরলো-

-এই কয়েক দিনের কথা আমি কখনো ভুলবো না-সুতপার কন্ঠে আদ্রতা

-আর আমাকে?

-একথা তুমি বোঝ না?

 -ভালো থেকো-এ কথা বলে তাড়াতাড়ি অপুর্ব মুখটি ঘুড়িয়ে নিয়ে ট্রেনের ভেতরে ঢুকে। চোখের কোন অশ্রুশিক্ত।

 



Read full book here: Click here to download the PDF file