মস্কোর বরফবিথী ও একজন সুতপা-পর্ব-১৪


Author: ড. পল্টু দত্ত

পর্ব-১৪

Summary:

বিফল মনোরথে একটা ট্যাক্সি নিয়ে মিখলুখা মাখলায়ায় ফিরে আসে অপুর্ব।

মনটা যেন বিধ্বস্ত, আহত- সুর শেষ না হওয়া কোন তীরবেঁধা পাখির মতো। তার অশান্ত ভাবনার আকাশে অশান্তির কালো মেঘ। সুতপা এর আগে কতবার ফিরে গেছে তখন মন খারাপ হলেও তা ছিলো অব্যক্ত । কিন্তু এবারের চলে যাওয়ার মধ্যে বিশেষত্ব হলো দুজনের প্রকাশ। যা তাকে জ্বলন্ত ধুপে পরিণত করেছে ।

সুতপার চলে যাওয়া - তার বেদনার্ত কান্না যেন তার অন্তর্গত ভেতরে বিষাদের জ্বালা বাড়িয়ে দিয়েছে। পেটে ক্ষুধাা অনুভব করলেও খাওয়ার ইচ্ছে করছে না। মনের ভিতরে এত শুন্যতার  শোক নিয়ে কোথাও না গিয়ে সোজা নিজের রুমে চলে আসে। জুতাটা কোন রকম খুলেই বিছানায় শুয়ে একটা সিগারেট মুখে গুঁজে দিল। পকেট থেকে লাইটারটা বের করতে গিয়ে চিরকুটটা হাতে পড়লো। তাড়া তাড়ি বেড় করলো দু’আঙ্গুলে চেপে।  রঙীন প্যাডের কাগজে লেখা। ভাঁজ করা চিরকুট উন্মুক্ত করেই অপূর্ব দু’হাতে চোখের সামনে নিয়ে অস্ফুট উচ্চারনে পড়তে লাগলো-

আমার সুনীল আকাশ,

যে মুহূর্ত থেকে আমি তোমাকে প্রথম দেখেছিলাম, সেদিন থেকেই আমি একটু একটু করে নদী হতে থাকি, তোমার ছায়া প্রতিনিয়ত বিম্বিত হতো আমার চোখের চতুষ্কোনে ।

আমি আমার অজান্তে তোমাতে হারিয়ে কি এক হরিয়াল হয়ে যাই। অন্তর-বাইরে থেকে আমি এক পড়ন্ত শীতের অপেক্ষা করতে থাকি। অপেক্ষায় থাকি দর্শনের উষ্ণতার। বহুকালের অপেক্ষার পর আমি অহল্যার মতো তোমার স্পর্শে পাথর থেকে মানবী হওয়ার স্বপ্নে বিভোর। আমার ভেতরে জমাট রাত্রি কাটে না, দিন কাটে না। যতবার আমি তোমার চোখের দিকে তাকিয়েছি আমার হৃদয়ের স্পন্দন  শুনতে পেয়েছি। সারা দেহ-মনে বয়ে গেছে আনন্দের ঝর্নাধারা। তোমাতেই সুপ্ত  হয়েছিলো আমার ঠিকানা আজ যাকে খুঁজে পেলাম। এতটুকু সময়ে এই জীবন যেন অনন্ত কালের চাতক তেস্টার- তৃপ্তির পেখম মেলেছিলো। আমি যে জগতের সন্ধান কোন কালে পাইনি তার দেখা পেয়ে আমি পরিপূর্ণ। আমি বুঝতে পেরেছি আমার জীবনের পরিপূর্নতার ঠিকানা তুমি।  তুমিই আমার  নির্ভরতা, সুন্দরের পথে এগিয়ে চলার সঙ্গী ভাবতে ভাবতে আমি সত্যি যে নদী ছিলাম আজ তা তরঙ্গায়িত। বুঝতে পারিনি কখন যে আমার অনুভূতিগুলি এতো গভীর হয়ে গেল। কখন যে আমি একটু অন্যরকম হয়ে গেলাম, কখন যে আমি পরগাছাদের কাছ থেকে দূরে সরে গেলাম। অন্ধকারের পাহার ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে কখন যে আমি নদীর পথে হাঁটতে শুরু করলাম। আমার যাত্রা এখন সমুদ্রের দিকে, পাহাড়ের পথ ঘেরা আকাশের দিকে সেই আকাশটাকে ছেড়ে থাকা একদম শ্বাসরুদ্ধকর মনে হচ্ছে। তোমার স্বরলিপির ব্যঞ্জনা, খুব গভীর এবং উজ্জ্বল, যেন তারকা খচিত, খুব আবেগের বন্যা, বাসন্তী হাওয়া আমাকে বাইরি বাতাস বানিয়েছে।

আমি এখন চিলেকাটা ঘুড়ি হয়ে উড়তে পারি। আমার ভাবনার শিরা-উপশিরার বহ্নি দহন, তোমার শব্দের জল সিঁড়িতে আমি খুঁজে পেলাম পৃথিবীর রূপ। তোমাকে অনন্তকাল ধরে ধারন করেছি, অন্বষন করেছে-গেঁথে নিয়েছি জীবনে চলার পথে । আমার ভবিতব্য যেখানেই নিয়ে যাক না কেন জেনে রাখবে যে আমি তোমাতেই আবিষ্ট। ফড়িংয়ের, দোয়েলের এ জীবন এভাবেই কেটে গেলে মন্দ কি!

জুন মাসে রুস্তভে আসবে।

বেশী সিগারেটে পুড়বে না কিন্তু। নিজের যত্ন নিও

অনেক ভালবাসা - আরাধনার সঙ্গে

সুতপা

অপুর্ব নিশ্চল পাথরের মতো শব্দহীন। লেখার শব্দে শব্দে যেন সমুদ্রের বিশালতা, উদ্ভাসিত এবং নান্দনিক ঢেউয়ের উপচানো জল, প্রগাঢ়, গন্ধকমলের মতো সুভাষিত গন্ধ আশে পাশের চারিদিক।

অলকানন্দার বলাকা জলে পা দেওয়ার মতো শির শির শীতল অনুভূতি সারা শরীরে যেন আনন্দের সুখ ঢেলে দিলো। হঠাৎ করেই আছড়িয়ে পড়লো অপুর্বর হৃদয়, চোখে-মুখে ধলপ্রহরের শেষ চন্দ্রিমার আলতো আলো। অনুচ্চারিত শব্দের গভীরতাহীন প্রানের প্রগাঢ় জলে ভাসতে লাগলো সুন্দর রাজহাঁস, যেন মেঘ ছুঁতে চায় পরম আহ্লাদে। অপুর্বর হৃদয় আজ উচ্ছসিত। উদ্বেলিত মন সুর তুললো-

নীল আকাশের বুক ছুঁয়েছে কোন ফাগুনের মেলা?

চঞ্চল মন সুর তুলেছে বনস্পতির দোলে

কোন সে ভ্রমর নাচ তুলেছে দোলন চাঁপার কোলে?

আকাশ বলছে মেঘ আসছে

বাতাস যেন মন্দিরা লয়

নদীর বুকে দুধ সাদা জল, ঘাস-ফরিংএর খেলা।

নীল আকাশের বুক ছুঁয়েছে কোন ফাগুনের মেলা?

সত্যিই অপুর্বর মনটা উচ্ছ্বাসে উন্মনা। চিঠির প্রতিটি অক্ষরে যেন খুঁজে পেল জীবনে পথ চলার এক নান্দনিক চেতনা। এক নতুন জীবনের ঠিকানা, ভালোবাসায় সিক্ত। পর পর চিঠিটা পড়ছে অপূর্ব। এ চিঠির আদি নেই, অন্ত নেই। যতোই পড়ছে ততোই এক অমলীন উৎফুল্লতায় মনটা ভরে উঠছে। 

সেই রাতে সুতপার রান্না করা শেষ খাবারটুকু খেয়েই অপুর্ব শুয়ে পড়লো। জীবনের পাতাগুলি একের পর এক উল্টোতে থাকে। আকাশের মেঘেরাও ভাসতে থাকে দুর থেকে বহু দুরে, নদীর জল গড়াতে থাকে সমুদ্র থেকে মহাসমুদ্রে। সময় এগুতে থাকে। সুতপা যাওয়ার পর বেশ কয়েকবার টেলিফোনে কথা হয়েছে। চিঠিও লিখেছে। অপুর্বও লিখেছে সুতপাকে। গত ফোনে সুতপা বলেছিলো-

-আমি মস্কো আসছি

কি যে আবেগ, আনন্দ আর উৎফুল্লতা ওর কন্ঠে ছিলো অপুর্ব তা ভাষায় প্রকাশ করতে পারবে না। যেন এক মহান তৃপ্তির অনুভূতি, উচ্ছ্বাস, এবং পরম সুখে পূর্ন।

-আমি গতকালই কনফার্মেশন লেটারটা পেলাম। অগাস্টেই মস্কো আসবো ইউনিভর্সিটি অব মেন্ডেলিভ। ক্যামিক্যাল ইন্জিনিয়ারিঁং। আমার কি যে ভালো লাগছে! চিঠিটা পেয়েই তোমাকে টেলিগ্রামটা করি আজকের ফোনের জন্য। তোমাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে। তুমি কিন্তু জুন মাসে আসবে। না না জুনে না তোমার পরীক্ষা যেদিন শেষ হবে তার পরের দিন। আমার কিন্তু মে মাসের ২০ তারিখ শেষ পরীক্ষা----

-দাড়াও, দাঁড়াও, এবার একটু থামো। সত্যিই খুব খুশীর সংবাদ, আমি ভীষন খুশী-অপুর্ব শেষ করার আগেই সুতপা আবার বলে চললো-

-ডাক্তারি পড়তে পারিনি, তাতে কী? ইন্জিনিয়ারীং পড়বো-খুব খুশী। মস্কোতে পড়বো, তোমার পাশেই থাকবো----

-তুমি দেশে যাবে কবে?

-জুলাই মাসে।

-কতোদিন থাকবে?

-ছয় সপ্তাহ। অগাস্টের পনের তারিখ।

-টিকিট কিনেছ?

-এরোফ্লটে বুকিং দিয়েছি। জুলাইর ২ তারিখ যাবো। জুনের শেষ দিকে আমি মস্কো চলে আসবো কিন্তু। দেশে যাওয়ার আগে ইউনিভার্সিটিতে গিয়ে সব ভর্তির কাজগুলি করে নিতে চাই। হোস্টেলে রুমটাও নিতে চাই। তা হলে দেশ থেকে এসে ঐখানেই উঠে যাবো।

-ঠিক আছে-অপুর্ব বলে। তুমি কনফারমেশনের চিঠিটা আমাকে পাঠিয়ে দিও। আমি তা হলে ইউনিভর্সিটির ফ্যাকালটির ডীনের সাথে আলাপ করে সব ব্যাবস্থা করে আসবো।

-আমি আগামীকাল অরজিনাল কপিটা পাঠিয়ে দেবো।

-অরজিনাল কপিটা বরং তোমার কাছে রেখো। আমাকে ফটোকপিটা পাঠালেই চলবে-অপুর্ব সুতপাকে বললো।

-ঠিক আছে

খবরটা শুনার পর থেকেই অপুর্বর খুব ভালো লাগছিলো।

টেলিফোন বুথ থেকে যখন বেড় হলো তখন হঠাৎ করেই চারিপাশটা শেষ সকালের রোদে খুব মিস্টি লাগছিলো। সোনালী রোদের সুতোর মতো চিকন আলো ওর চোখে এসে পড়লো, হঠাৎ তাকাতে পারছিলনা। মুখে যেন মেখে দিলো আলোর আল্পনা। কয়েকটি পাখি ওর মাথার উপর দিয়ে মিস্টি আওয়াজে উড়ে গেলো। সাদা-কালো মেঘেরা যেন নকশী কাঁথার সামিয়ানা টেনে আনন্দে উড়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে, নেই কোন তাড়া। কি অনিন্দ সুন্দর চারিপাশ। ভালোবাসার মানুষটির খুশির আনন্দে মন যে এতো উচ্ছ্বসিত হয় অপুর্ব আগে কখনো এমন করে বুঝতে পারেনি।

 

এখন ওর ডিংডিং করে নাচতে ইচ্ছে করছে। ছোট বয়সে যেমন হাঁটার সময় লাফ দিয়ে দিয়ে চলতো, কিছুটা অপেশাদার নাচিয়ের মতো, ঠিক তেমনি। তার পর দেখতে দেখতে প্রায় দুটি মাস শেষ হয়ে গেলো। অপুর্বর পরীক্ষাও শেষ। সুতপা ওকে রুস্তভ যাওয়ার জন্য বার বার বলছে। সেও ওকে বলেছিলো জুনের প্রথম সপ্তাহে যাবে। ৪-৫দিন থাকবে। এক বন্ধুকে দিয়ে ট্রেনের একটা টিকেট কেটেছে। গতকাল টেলিফোনে সুতপাকে কনফার্ম করেছে।

-সত্যিই তুমি জুনের ২ তারিখ আসছো? খুব মজা হবে। আমার সব বান্ধবীরাও খুশী হবে। আমরা সবাই একই হোস্টেলে থাকি। ওরা সবাই তোমার কথা জানে। উচ্ছ্বসিত কন্ঠে জানায় সুতপা ।

-তুমি সরাসরি হোস্টেলে আসবে কিন্তু। আমি স্টেশনে থাকবো। সুতপার আবার বলে চললো।

-হোস্টেলে থাকার কোন অসুবিধা হবে না? অপুর্বর উদ্বিগ্নতার প্রশ্ন

-না না কোন অসুবিধা নাই। তখন আমাদের সামার ভেকেশান। হোস্টেলে অনেকেই থাকবে না। আমি সিনিয়র দাদাদের সাথে কথা বলে রেখেছি। তুমি মেডিসিন হোস্টেলে এক দাদার রুমে থাকবে। ওখানে শুধু ঘুমাবে।

-আর খাওয়া দাওয়া? অপুর্বর হালকা বিস্ময়ে প্রশ্ন

-আমাদের হোস্টেলে। সকালে ঘুম থেকে উঠেই এখানে চলে আসবে আর সারাদিন আমাদের সাথে আমাদের হোস্টেলে থাকবে-সুতপা বুঝিয়ে বলে।

-আমি কিন্তু রওনা দিচ্ছি জুনের ২ তারিখ। বিকেল ২টায় টিকেট। পরের দিন ৩ টায় পৌঁছাবো। তাই লেখা আছে টিকেটে। ২৫ ঘন্টা

-তুমি আসলে খুব মজা হবে, অনেক জায়গায় ঘুরবো। আর এখানে কিন্তু বাংলাদেশের মতো তাজা মাছ পাওয়া যায়। আর ওয়েদরটাও বাংলাদেশের মতো। তোমার ভালো লাগবে-সুতপার উচ্ছল বর্ননা।

সেদিন থেকেই রুস্তভে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে অপুর্ব।

জুনের ২ তারিখ আজ। মনটা বেশ ফুর ফুরে। আবার কিছুটা ভয়ও। এতো দুরের রাস্তা। তবে ভালোবাসার মানুষটির কাছে যাওয়ার আনন্দটাই যেন বেশী। একটি রেকসাক কাঁধে ঝুলিয়ে মধ্য দুপুরের রোদকে ভেঙ্গে রওনা দিল রুস্তভের উদ্দেশ্যে।

প্রথমে যেতে হবে লেনিনগ্রাদস্কি রেলওয়ে স্টেশনে। মিখলুখা মাখলায়া থেকে ট্রাম ধরে সোজা বিলায়েভা মেট্রো স্টেশন। প্রায় ৫০ মিনিট পর ট্রেন স্টেশনে যখন এসে পৌঁছায় তখন প্রায় ১টা বাজতে চললো। হাতে এখনো এক ঘন্টা সময় আছে। বিশাল ট্রেন স্টেশন। লোকে লোকারন্য। মস্কোর লেনিনগ্রাদস্কি রেলওয়ে স্টেশন রাশিয়ান রেলওয়ের একটি প্রধান কেন্দ্র। এখান থেকে সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্যান্য অনেক শহরে যাওয়া যায়।

এবার প্লাটফর্মের দিকে হাঁটা শুরু করলো অপুর্ব। সারিবদ্ধ ভাবে ট্রেনগুলি দাঁড়িয়ে আসে একের পর এক। কোনটা এগিয়ে চলছে দুরের কোন গন্তব্যে। আবার কোনটা অন্য কোন শহর থেকে এসে ঢুকছে স্টেশনে। ট্রেনের সামনের ইঞ্জিন থেকে কালো ধোঁয়া অনবরত নির্গত হচ্ছে বুদ্ বুদ্ করে। আর অনেক চলন্ত ট্রেনের 'চু' 'চুগ' এবং 'চফ আওয়াজে অশান্ত সারা স্টেশনটি। ছুটন্ত মানুষ জনের অস্বাভাবিক ব্যাস্ততা নজর কাড়ে অপুর্বর। অনেকেই খবরের কাগজ পডায় ব্যস্ত। কেউ কেউ স্টেশনের ভেতর ছোট ছোট বইয়ের স্টলে নিজের পছন্দের বই খুঁজছে। চারিদিকে কোলাহল আর কোলাহল। এদিক-ওদিক ছুটছিল মানুষ। শতো মানুষের শব্দে গম গম পুরো স্টেশনটি। সত্যিই অদ্ভুত।

 

ট্রেন স্টেশনে জীবন খুব দ্রুত গতিতে চলছে বিরামহীন ভাবে। মাঝে মধ্যে কিছু আবেগের দৃশ্যও অপুর্বর চোখে পড়লো। অনেকেই আত্মীয় স্বজনদের বিদায় জানাতে স্টেশনে এসেছে। ট্রেনের বাঁশী বাজার সাথে সাথে যখন ট্রেনটি ধীরে ধীরে চলা শুরু করে তখন অনেকেই অশ্রুসিক্ত। কেউ কেউ জোরে শব্দ করে কাঁদছে। আবার অন্যদিকে যারা মস্কোতে আসছে তাদেরকে যারা স্টেশন থেকে নিয়ে যেতে এসেছে তাদের সকলের মুখে হাসি আর আনন্দের উচ্ছ্বাস। অপুর্ব হাঁটছে আর ভাবছে জীবনটা সত্যিই বৈচিত্রে পূর্ন। হাসি-কান্নার দোলায় দুলতে দুলতে জীবন এগিয়ে চলে। একে গ্রহন করাতেই সকলের মঙ্গল।

এক সময় অপুর্ব রুস্তভ যাওয়ার রেড এরো ট্রেনটিতে উঠে পড়লো। দূর পাল্লার সব ট্রেনই ¯স্লিপিং ট্রেন। প্রতিটি কেবিনেটে চারজন যাত্রী। উপরে নীচে চারটি সাঁজানো বেড। অপুর্বর বেডটি এক পাশের নীচের দিকে। ভিতরে ঢুকেই আরো দু’জনকে দেখতে পায়। এক বয়স্ক মহিলাও তার সাথে ১৮-১৯ বছরের একটি মেয়ে।

-দ্রাস্তবইচিয়ে-মহিলাটি অপুর্বকে হ্যালো বলে সম্বোধন করলো।

-দবরি দিন (শুভদিন)-একই সাথে উঠতি বয়সের মেয়েটিও বললো। মুখে কি অমলিন হাসি। সামনের দুধ সাদা কয়েকটি দাঁত হাসির সাথে যেন মুক্তার অনিন্দ সুন্দর বিচ্ছুরন ছড়িয়ে দিল। কি অপুর্ব সুন্দর লাগছিলো মেয়েটিকে।

-দবরি দিন-অপুর্ব উত্তরে বললো।

অপুর্ব ঢুকেই তার বেডটিতে ব্যগটা রেখে বসলো।

-কুদা বি ইয়েজিয়েস (তুমি কোথায় যাবে?)-মহিলাটি অপুর্বকে প্রশ্ন করে। উত্তরে অপুর্ব বলে-

-রুস্তব অন ডন।

-অচিন খারাশু (খুব ভালো)। আমরা যাবো সামারস্কইয়ে।)

-গিজিয়ে এতা (কোথায় এই জায়গাটা?)

-১২০০ কি.মি। এটা জাইমত ১৬ চাসব (যেতে ১৬ ঘন্টা লাগবে।)

-হুম

রাশিয়ান ¯স্লিপিং ট্রেনে ভ্রমণ সত্যিই অন্য যে কোনো অভিজ্ঞতার মতো নয়।

অপুর্বর মনে হলো  এ যেন বাড়ির আরামদায়ক অনুভূতির সাথে ট্রেন ভ্রমণের সহজতা। রাশিয়ান ঘুমন্ত ট্রেনে দুরের কোন শহরে যাওয়ার আনন্দটাই অন্যরকম। বেডের উপর খাস্তা সাদা চাদর, তুলতুলে বালিশ এবং সাদা ডুভেট দেখে অপুর্বর মনট খুশীতে ভরে গেল। কেবিনগুলিতে আছে বেশ বড়ো কাঁচের জানালা। বিছানাটা বেশ আরামদায়ক। প্রতিটি বিছানার উপরে রয়েছে পৃথক পড়ার আলো। লাগেজের জন্য রয়েছে প্রচুর স্টোরেজ স্পেস। কিছু কেবিনে নিজস্ব বাথরুম আছে। এছাড়াও প্রতিটি পাশের বেডে ছোট ছোট টেবিলও রয়েছে খাওয়া দাওয়া বা পড়া-শুনার জন্য।

অপুর্বদের কেবিনের পাশের কয়েকটি কেবিনের পরই কমন টয়লেট। ট্রেনগুলিতে আছে আধুনিক প্রযুক্তি। এয়ার কন্ডিশনার এবং হিটিং সিস্টেমে সজ্জিত। তাই বছরের যে সময়ই হোক না কেন, বাইরের আবহাওয়ার উপর নির্ভর করে সর্বদা শীতল বা উষ্ণ থাকে কেবিনগুলো। ট্রেনে যাত্রার সময় ক্ষুধা লাগলে তখন চিন্তা করার কোন প্রয়োজন নেই - ডাইনিং কারগুলি সারা দিন সুস্বাদু গরম খাবার পরিবেশন করে। কেবিন সর্ভিসের ব্যাবস্থাও রয়েছে। ট্রেনের বাঁশীর আওয়াজ শোনা গেল। ঠিক কাটায় কাটায় ঠক ঠক করে ট্রেনটি রওনা দিলো। বাইরে এখনো ফর্সা।

গন্তব্য রুস্তভ।

রুস্তভ -অন-ডন দক্ষিণ রাশিয়ার একটি বন্দর শহর।

বিখ্যাত ডন নদীর তীরে অবস্থিত। মস্কো থেকে রুস্তভের দুরত্ব প্রায় ১৩০০ কি.মি। ট্রেনে সময় লাগবে প্রায় ২৪-৩০ ঘন্টা। অপুর্ব সাথে করে কিছু খাবারও নিয়ে এসেছে যেন পেট পূঁজাতে কোন ধরনের ব্যাঘাত না ঘটে। ওর রেকসাকটা বেডের নীচে বক্সটাতে রেখে একটু আরাম করে বসলো।

অপুর্ব এই রুস্তভ শহরটি সম্পর্কে মোটামুটি ভালোই জানে। সুতপা ওকে অনেক গল্প শুনিয়েছে। প্রগতি লাইব্রেরি থেকে কিনে আনা একটি বইও ভালো করে পড়ে নিয়েছে এর মাঝে।  শহরটি খুব সুন্দর ও ঐতিহাসিক। আজভ সাগরের কাছে অবস্থিত। সপ্তদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে এই শহরটি একটি কৃষি বসতি হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। তারপর থেকে, এটি দক্ষিণ রাশিয়ার বৃহত্তম শহরগুলির একটিতে পরিণত হয়। প্রায় ১০ লক্ষ লোকের বসবাস এই শহরে। শহরটি মধ্যযুগীয় গীর্জা, আধুনিক আর্ট গ্যালারী এবং সোভিয়েত যুগের স্মৃতিস্তম্ভ সহ অসংখ্য ঐতিহাসিক দর্শনীয় স্থাপনার আবাসস্থল। খুব সাঁজানো-গুছানো।

 

ট্রেনে করে এই প্রথম অপুর্ব এতো দুরের কোন শহরে যাচ্ছে। এর আগে সেন্ট পিটর্সবার্গে গিয়েছিলো। কিন্তু সেটা ছিলো ৮ ঘন্টার জার্নি।

 

মস্কো থেকে রোস্তভ পর্যন্ত একটি ট্রেনে যাওয়া সে এক বিস্ময়কর ব্যাপার। রাশিয়ার সবচেয়ে সুন্দর গ্রামাঞ্চল এবং প্রাকৃতিক দৃশ্যের মধ্য দিয়ে সাঁ সা করে এগিয়ে চলছে ট্রেনটি। বাইরের বিকেলের রোদ আছড়িয়ে পড়ছে প্রশস্ত জানালার কাঁচে। দিগন্ত বিস্তৃত সারি সারি মাঠ। দূর আকাশের বুক যেন মিশে আছে মাটিতে।

 

ট্রেনটি মস্কো থেকে দূরে সরে যাওয়ার সাথে সাথেই অপুর্ব জানালার পাশে এসে বসলো। তাকিয়ে রইলো দুরের আকাশের দিকে। কখনো ক্যামেরার মতো ঘুরছে ওর চোখ এদিক সেদিক। ছোট ছোট শহরগুলি সবুজে ঘেরা। সমতল আর পাহাড়ের ল্যান্ডস্কেপ চারিদিকে। কখনো কখনো মাইলের পর মাইল হলুদ শর্ষের রঙের মেলা। গ্রামের লাল-ছাদের বাড়িগুলি ওপারের সবুজ মাঠের বিপরীতে দাঁড়িয়ে আছে। মনোমুগ্ধকর গ্রাম, শতাব্দী প্রাচীন গীর্জা এবং কান্নাযুক্ত উইলো গাছগুলোকে তন্ময় হয়ে দেখছে। ভোরোনজ, রিয়াজান সহ বেশ কিছু ঐতিহাসিক শহরকে পেছনে রেখে ট্রেনটি এগিয়ে চললো। শহরের রাস্তার উপরে উঁচুতে দাঁড়িয়ে থাকা দূর থেকে ছোট বড়ো পাহারগুলোকে দেখতে পাচ্ছিলো। কি মনোমগ্ধকর! আকাশের বুকে যেন মাথা ঠুঁকে আছে। কি সৌহার্দপূর্ন বন্ধুত্বের আলিঙ্গন। স্বর্গীয় সৌন্দর্যকেও যেন হাড় মানায়।

রাস্তার দুই ধারে ওক, বার্জ ক্রাউন পাইন এবং নানাধরনের গাছ যা শতো বছরেরও বেশি পুরানো হতে পারে, যেন আমন্ত্রনের আনন্দ বার্তা নিয়ে সবাইকে স্বাগতম জানাচ্ছে। যতোদুর চোখ যায় ততোই চোখ জুড়িয়ে যায় কি এক নৈসর্গিক সৌন্দর্যে।

এই মুহুর্তে দেশের কথা খুব মনে পড়ে গেলো অপুর্বর। ফিরে গেল মা, মাটি আর প্রিয় জন্মভূমির কাছে। কি অপরূপ মায়া আর নৈসর্গিক ভালোবাসায় বুকে ধারন করে আছে দেশ,মাটি। মনে পড়ে গেলো স্কুলে পড়া জননী জন্মভূমিকে নিয়ে পড়া সেই শাব্দিক সুরতান। কথিত আছে রামায়নে ভরদ্বাজ মুনি রামের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন: জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরীয়সী। অর্থাৎ জননী ও জন্মভূমি স্বর্গের চেয়েও শ্রেয়। বিশ্ব বিধাতা নিজের হাতে যেন  বিশ্বব্রহ্মান্ডের সকল সৌন্দর্য, সকল স্নেহ, সকল আকুলতাকে বন্দি করে দিয়েছেন পরম যত্নে আর মমতায়। সেই সৌন্দর্যকে সকলে ধারন করে হচ্ছি সমৃদ্ধ। কিন্ত তার থেকেও বড়ো সৌন্দর্য হলো আমাদের মা জন্মভূমি। আমাদের সকলের জীবনেই মা শব্দটি যেন রক্ষাকবচ। মা হীন জীবন যেন রোদেলার কান্না, সাগরের শুন্যতা আর মরুদ্বীপের যন্ত্রনা। জননী এবং জন্মভূমি পৃথিবীর সব সৌন্দর্যকেও হার মানিয়ে দেয়। স্বর্গের চেয়েও শ্রেষ্ঠ।

রাত নামার সাথে সাথে মিটমিট করে তারায় ভরা তারার মতো আকাশের দিকে নজর রাখতে খুব ভালোই লাগছে অপুর্বর। ঘূর্ণায়মান পাহাড় থেকে তুষার আবৃত স্পন্দনশীল সূর্যাস্ত থেকে ঝিলমিল হ্রদের প্রতিফলিত - এই দৃশ্যগুলি চিরকাল অপুর্বর স্মৃতিতে থাকবে।

বাইরের আলো-আঁধারিতে মনোরম সবুজের শ্যামলিমা দেখতে দেখতে কখন যে অপুর্বর ঘুম এসে গেলে টেরও পায়নি।

 



Read full book here: Click here to download the PDF file