পর্ব-১২
Summary:
ঘুম মানুষের যতটা প্রিয় কাল রাত তার চেয়ে প্রিয় ছিলো অপূর্ব-সুতপার কাছে। দুজনেরই ঘুম হয়নি। অপুর্ব- সুতপা কারোই না। একসঙ্গে এক রুমে। পাশাপাশি বসেছিলো। কখনো চেয়ারটা টেনে মুখোমুখি। এই প্রথম ভালোলাগার মানুষটির সাথে একা একা রুমে ছিলো। মুখোমুখি। চোখাচোখি। কখন যে কয়েক ঘন্টা সময় চলে গেল কেউ টের পায়নি।
অনেক কথা হলো সুতপার সঙ্গে। কিছু মুখের কিছু চোখোর ভাষায় আর কিছু করস্পর্শে।
রাত তিনটা পর্যন্ত চললো আলাপচারিতা। চোখেও ঘুম ছিল না। কথা বলতেই ভালো লাগছিলো। এই রাত যেন শ্রাবস্তী নগরীর গাঁথা- ভালোবাসার উপাখ্যান। অর্ফিয়ুসের বাঁশীর সুরের মূর্ছনায় রাতের আকাশ, বাতাস, গাছ-পালা। জীবনের চাঞ্চল্যের রাত। এমন ধ্রপদীয় সুখকর রাত অপুর্বর জীবনে কখনো আসেনি আর, হয়তো কখনো আসবেও না। মানুষ রাতে যেমন ধীরে ধীরে ঘুমের ঘোরে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে, ঠিক তেমনি অপুর্বও যেন এই রাতে ধীরে ধীরে সুতপার জীবনের সঙ্গে নিমজ্জিত হয়ে যায়। গভীর রাতকে সাক্ষী রেখে এত দিনের সঞ্চিত যত কল্পনা সব যেন বকের সারির মতো উড়াল দেয়। দুজনেই দুজনকে মস্কোর বরফের স্তুপের হিমেল হাওয়ার এক দূর থেকে ভেসে আসা অলৌকিক অন্তর্গত এক ভায়োলিনের সুরের ভেতরে যেন ডুবে যায়।
মাঝে মধ্যে সুতপা অপুর্বর দিকে কেমন এক তন্ময়ভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।
ডাগর ডাগর চোখ। চোখ যেন বৃষ্টির ছাঁটে জলের রেনুর ছোঁয়ায় নরম তুলোট হয়ে আছে। এ চোখে কাজলের কোন প্রয়োজন নেই। এইু চোখ কত কাল ধরে অপূর্ব যেন হৃদয়ের অন্তরীক্ষে বয়ে বেড়াচ্ছিলো।
এতদিনে সেই চোখের সংগে দেখা। কি ভরাট দৃষ্টি। নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকলে চোখ ভরেতো প্রান ভরে না। এ এক উদাসী স্বভাব। চোখের চাহনিতে অপুর্বর অন্তঃপুর যেন ভুমিকম্পে কেঁপে উঠে। বুকটা কেমন ধক ধক করে উঠে। সারা শরীরে কেমন এক আনন্দ অনুভূতির জোছনা প্লাবন বয়ে যায়। এই অনুভুতিকে যেন প্রকাশের কোন ভাষা নেই কোথাও।
রাত বাড়তে থাকে। রাতের নিস্তব্দতায় অপুর্বর মাথার কোষে কোষে এক মাদকতার বাতাস বয়ে চলে। জগতের সবকিছুই যেন সুন্দর মনে হয়। অপুর্ব সুন্দর, যেন ভালোবাসা আর শান্তির নন্দনকানন। কথার মধ্যে একসময় অপুর্বর হাতগুলো ভাষা পায়, ক্রমশ তা এগুতে থাকে, এগুতে থাকে। তার পাঁচটি আঙ্গুল সুতপার মাথায় চলে যায়। উজ্জয়নী নগরী থেকে যেন মেঘ চলেছে সুতপার চুলে স্নান করতে। তার চুলে উড়ো মেঘ যেন বসে আছে। কালো কেশী লম্বা চুলে উদভ্রান্তের মতো সাঁতার কাটতে থাকে অপুর্বর আঙ্গুলগুলি। চুলে বিনুনি কাটে। সুতপার লম্বাচুলগুলি কি এক অশ্রুত ছন্দে দোলা দেয়, এলোমেলো হয়ে আছড়ে পড়ে অপুর্বর চোখে মুখে। অলকানন্দার ঢেউয়ের বুদ বুদ শিহরন তোলে।
মাঝে মধ্যে সুতপার কাঁধের চারপাশে আড়ম্বরপূর্ণ তরঙ্গে দোল খেয়ে যায়। বেশ ভালো লাগছিলো অপুর্বর। খুব ভালো। হৃদয়ের অতলে সুখ সুখ স্পন্দন টের পেলো। সুতপা কিছু বলছেনা। একেবারে শান্ত। ধল প্রহরের দূর্বার শিশির ধোঁয়া সমীরনের হালকা অনুভূতি সারা শরীরে দোল খেলে যেমন লাগে ঠিক তেমনি সুতপার দেহ-মন-প্রান। এ যেন মিশরীয় দেবী আইসিস এর সেই রাত। মাদকীয়, সবুজ ঘেরা পাহাড়ের বুক চিড়ে ঝর্না ধারার অশ্রুত শব্দের জলসিঁড়ি। কি নিবির ভালোবাসায় শিক্ত আইসিস রাতের বুকে মাথা রেখে আকাশের তারাদের সাথে খেলা করছে। এমন রাত যে ভোলা যায় না। নাকি কেউ কখনো ভুলতে পারে?
মিশরের রাজা ঐশিরিসকে নিয়ে তারাভরা রাতে চারটি স্বেত অশ্বে টানা একটি সুন্দর রথে এগিয়ে যাচ্ছে আইসিস সমুদ্র-সৈকতে। মাইলের পর মাইল বিস্তৃত পাম গাছগুলি রাস্তার দুপাশে দাঁড়িয়ে যেন দোল খাচ্ছে গভীর মমতায়। বালি দ্বারা বেষ্টিত নির্জন সৈকত। ঢেউয়ের শব্দে মাতোয়ারা রাতের আকাশ বাতাস। মন্ত্রমুগ্ধ পৃথিবী ধ্যানে মগ্ন। বাহুপাশে আবদ্ধ আইসিসের মাথা কি নিশ্চিন্তে হেলে থাকে ঐশিরিসের প্রশস্থ বুকে। সূর্য দিগন্তে অস্তমিত অনেকক্ষন। কিন্তু কমলা রঙ তৈরি করে আকাশে এঁকে দিয়েছে গোলাপী আর বেগুনি রঙের উজ্জ্বল রঙের সামিয়ানা শিল্পির রং তুলিতে। সমুদ্রের জলে আছড়িয়ে পড়ছে সেই রং থেকে এক জাদুকরী আলো। গোলাপের পাপড়ি দিয়ে কে যেন বিছিয়ে রেখেছে একটি বিছানা মাটিতে। আর ওরা দুজন নরম চাদরের নিচে শুয়ে আছে পৃথিবীর সমস্ত সুখকে বুকে নিয়ে। সমুদ্রের ঢেউ থেকে আসা শীতল হাওয়া কাছাকাছি উপকূলরেখায় আছড়ে পড়ছে পরম তৃপ্তিতে।
আজকের এই রাত যেন সেই রাতেরই সুখ।
টেপ রেকর্ডারে আস্তে আস্তে বেজে চলছে লতা মঙ্গেস্করের মন মোহনা বাদে ঝুঠে গানটি। কি এক অমলীন মোহনীয় শ্রাবস্তীর
রাত। সে রাতেই আদরে অপুর্ব সুতপাকে কাছে টেনে নেয়। দুহাতে জড়িয়ে ধরে। সুতপাও ওর মুখটা অপুর্বর কাছাকাছি নিয়ে আসে নিঃশ্বাস ভারী হয়ে আসছে। উদাস করা দৃষ্টিতে অপুর্বর চোখের উপর রাখলো। যেন বলছে-আমাকে আরো শক্ত করে ধরো। আমি যে তোমাকে ভালোবাসি
অপুর্বও দুহাতে ওকে জড়িয়ে ধরলো। গালে চুমু কাটলো। চোখে, মুখে, কপালে, ঠোঁটে কি ভীষন উন্মাদনা। সুতপার ঠোঁট দুটি কাঁপছে।
এলো মেলো চুলে অপুর্ব মুখ লুকালো।
অপুর্বর মুখ দিয়ে অস্ফুট স্বরে বেড়িয়ে এলো-
-আমি তোমাকে চাই। আমায় ভালোবাসতে পারবে?
-জানি না, সুতপার উত্তর
-আমি যে তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছি। আমি শুধু তোমাকে চাই।
-আমিও যে তোমাকে ভালোবাসি। বুঝতেও পারলাম না কিছুই, কখন কি হয়ে গেলো।
অপুর্ব ফিস ফিস করে কি যেন বলছিলো-
আমার হৃদয় এখন অমরাবতীর ঢেউয়ের উপচানো পাত্র, গোলাপের পাপড়িতে ঢাকা সারা দেহ-মন। তোমার সন্মোহনি চোখের মদীরা জলে দিব্য আমি সাঁতার কাটি। তোমার ভালোবাসার শীতল জলে আমি হারিয়ে গেছি। আমায় একটু আগলে ধরো। তোমার বিশুদ্ধতায় আমাকে কচি বলাকা হয়ে উড়তে দাও। এই রাত যেন আর শেষ না হয়---
-তুমি কিছু বলছো-সুতপা বলে
ছিঃ সরি দাদা
-ছিঁ কেন? দাদা নয়, তুমিই বলো। এ যে বড়ো আপন। এমনি করে ডাকো।
কোন উত্তর দিল না। দেওয়ার কোন প্রয়োজন বোধও করলো না। জীবনের সমস্থ সংশয়, ধোঁয়াশা, অব্যাক্ত শব্দেরা যেন ঠিকানা
খুঁজে পেল। খুঁজে পেল নতুন করে জীবনকে নিয়ে ভাববার। চলার পথে পেয়ে গেল এক নতুন সারথী, বেঁচে থাকার, এক পরম নির্ভরতা।
-কিছু বলবে না, সুতপা?
সুতপা তখন দুহাত দিয়ে অপুর্বকে শক্ত করে ধরে আছে। মাথা নেড়ে কিছু বলার চেষ্টা করছে।
অপুর্ব দুহাত দিয়ে ওর মুখটি তুলে ধরলো-
-কিছু বললে, সুতপা
-নাহ্। আর কিছু না। অনেক রাত হলো।
প্রায় চারটার দিকে অপুর্ব সুতপাকে রুমে রেখে বেড়িয়ে যাবে, এমন সময় সুতপা বলল:
-আপনি কোথায় ঘুমাবেন?
-তুহীনের রুমে। তুমিয়ে ঘুমিয়ে পড়ো। আবার আপনি বললে যে?
স্মিত হাসলো। মুখটা একটু ঘুড়িয়ে নিল।
-আমার ঘুম আসবেনা। আরো কিছুক্ষন বস না। আর তোমার রুমমেটটাকে আজ দেখলাম না তো। ও রাতে এখানে আসবে না?
-না, ও আসবে না। ওকে বলে রেখেছি। তুমি ফিরে যাওয়া পর্যন্ত ও অন্য যায়গায় থাকবে, ওর বন্ধুর রুমে। এখানে শুধু তুমি থাকবে।-
অপুর্বর উত্তর
-তা হলে আরেকটু বসো না। আরো কিছুক্ষন প্লিজ।
এইতো চায় অপুর্ব। যদি না যেতে হতো তা হলে আরো ভালো হতো। কিন্তু এটা সম্ভব নয়।
সুতপার দেহ-মন-প্রান আর অবয়বে স্থির হয়ে আছে খাঁটি বাঙালীত্বের তিলক। চেতনায় ধরে আছে ঐতিহ্যের সংস্কৃতিকে। তাকে
অস্বীকার করবে কী করে?
সুতপার চেতনায় গেঁথে আছে সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ, ঐতিহ্যের বাঁধন। ধর্মীয় বিশ্বাস আর সামাজিক রীতি-নীতিতে গড়া ওর জীবন
দর্শন। তাই এতোদিন বিদেশে থেকেও ভুলে যায়নি বড়দের প্রতি শ্রদ্ধা, পিতামাতার নির্দেশনা, সততা এবং অহিংসার রীতিগুলো।
ঐতিহ্যের বাতাবরনে ঢাকা সুতপার জীবন বিদেশী চাকচিক্যে হেলে পরেনি এখনো। আর এতেই যেন তার সৌন্দর্য তার সম্পূর্ণ
সম্ভাবনায় আধুনিকতাকে আলিঙ্গন করে। পাশাপাশি ধর্মীয় নীতিগুলিকেও সমুন্নত রেখেছে পরম যত্নে। এই আপস না করার
আধুনিকতার জন্যও সুতপাকে আরো ভালো লাগে অপুর্বর। এটাই যেন সে চেয়েছিলো। যার মননে-চেতনায় থাকবে নান্দনিকতার
ছোঁয়া।
অপুর্ব আবার চেয়ারটা টেনে বসলো।
কথা চললো আরো অনেকক্ষন। অতীতের কথা, বর্তমানের হালচাল এবং ভবিতব্যকে নিয়ে। জীবনের এক নতুন অধ্যায়ের যেন সুচনা হলো। নতুন করে স্বপ্ন দেখার এক মাহেন্দ্রক্ষন রাতের গভীরতায় প্রকাশিত উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতো।
এবার অপুর্ব উঠে দাঁড়ালো। একটু না ঘুমালে সারাটা দিন খারাপ যাবে। সারা শরীর ম্যাজ ম্যাজ করবে। সকালে আবার স্কুলে যেতে
হবে।
-এবার তুমি ঘুমিয়ে পর। সকালে তোমার সাথে দেখা হবে না। আমি সরাসরি স্কুলে চলে যাবো। তুমি বুফেতে গিয়ে কিছু খেয়ে এসো।
স্কুল থেকে এসে এক সাথে স্তালোভায়ায় খেয়ে আসবো-অপুর্ব সুতপাকে বলে
-ঠিক আছে। তবে যাওয়ার সময় দরজায় টোকা দিও-সুতপার উত্তর
-তখন ত তুমি ঘুমাবে? জাগানো ঠিক হবে না
-তবু দেখা করে যেও। আমার এখন এমনিতেই ঘুম আসবে না। তুমি বরং এখন যাও। একটু ঘুমিয়ে নাও।
এবার গুড নাইট বলে অপুর্ব রুম থেকে বেড়িয়ে গেলো। যাওয়ার সময় ভেতর থেকে রুমটা বন্ধ করে দিতে বলে গেলো। রুমের একটা চাবিও ওর হাতে তুলে দিলো। বাইরে তখন আবছা আবছা ভোরের আলো উঁকি মারছে।
তেমন ঘুমুতে পারলোনা অপুর্ব। আর কিছুক্ষন পরেই স্কুলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে হবে। এলার্মটা দিয়েই রেখেছিলো। তবে বাজার
আগেই ও উঠে যায়। তুহিন আপাতত একাই থাকে রুমে। ওর রুমমেট কয়েক দিন হলো বাড়ীতে গেছে। সাইবেরিয়ার ছেলে। এক মাস পরে আসবে। জরুরি কাজে যেতে হলো।
তুহিন দরজাটা লক করেনি। ঠেলা দিতেই খুলে গেলো। রুমে ঢুকেই তুহিনকে ঘুমুতে দেখলো ওর রুমমেটের বেডে। খুব আস্তে করে দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে বেডে গিয়ে শুয়ে পড়লো।
শীতের সকাল। ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশী ছিল না। ঘন্টা দুয়েক এর বেশী ঘুমাতে পারেনি। ৭টার মধ্যেই তরিঘড়ি করে চোখ কচলাতে কচলাতে ঘুম থেকে উঠে যায়। বাইরে এখনো ছিমছাম নিস্তব্দতা। পুরো শহরের মানুষজন যেন কম্বলের উষ্ণতার নীচে ঘুমিয়ে আছে এখনো।
হঠাৎ মনে পড়লো, আজ অপুদা আর রুমানা আপুর বিয়ে। ঐখানে যেতে হবে। অনেকেই যাবে। তুহিন আগ থেকেই বলে রেখেছে সন্ধ্যায় এক সাথে যাবে। তুহিন ইউনিভার্সিটিতে যাবে। দুটার মধ্যেই চলে আসবে। তাই দুপুরের খাবারটাও এক সাথে খাবে।
কিন্তু এক সাথেই খাওয়া হলো। তবে স্তালোভায়ায় নয়। রুমেই তিনজনে এক সাথে বসে খাওয়া দাওয়া করলো। রান্না করেছে সুতপা।
অপুর্ব স্কুলে চলে যাওয়ার অনেকক্ষন পর সুতপা ঘুম থেকে উঠে। বুঝতে পারলো ভোরবেলায় ঘুমটা আসে। আর টের পায়নি। যখন ঘুম ভাঙ্গে তখন অলরেডি মধ্য সকাল। প্রায় সাড়ে দশটা। হাত মুখ ধুয়ে আসতে আসতে ১১টা বাজে। এখন বুফেত বন্ধ।
সকালে তেমন খেতেও ইচ্ছে করছে না। কেটলীতে জল গরম করে বিস্কিট আর চায়ে ব্রেকফাস্টটা সেরে নিল সুতপা।
হঠাৎ মাথায় ঢুকলো রান্না করার। ঘরে চাল-ডাল পেঁয়াজ, মসলা সবই আছে। একটা চিকেন হলে মন্দ হয় না। বেড়িয়ে পড়লো মিখলুখা মাখলায়ার ম্যাগাজিনের (রাশিয়ান ভাষায় দোকানকে ম্যাগাজিন বলে) উদ্দেশ্যে।
রান্না হলো ডাল, ভাত, আলু ভর্তা আর মাংস। রান্না শেষ করতে করতে প্রায় দুটা বেজে যায়। হঠাৎ কারো কন্ঠের আওয়াজে সুতপা রান্না ঘর থেকে করিডোরে উঁকি মারে। রান্না তখন প্রায় শেষ। তুহিনকে দেখতে পায় দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে।
-ভাইয়া, আমি রন্না ঘরে-সুতপা হাঁক ছাড়ে
সুতপাকে রান্না ঘরে দেখে তুহিন অবাক হয়
-তুমি রান্না ঘরে কি করছো? -তুহিনের উচ্চ কন্ঠ
-এখানে আসেন না। দেখবেন কি করছি-সুতপার প্রত্যুত্তর।
তুহিন রান্না ঘরে এসে থ খেয়ে যায়।
-তুমি এতো কিছু করলে কি করে? চল চল রুমে নিয়ে যাই। উনি আবার চলে আসবে। পেট আর মানছে না। থ্যাংক ইউ। ভালো হইছে।
মজা করে খাওয়া যাবে। এর মধ্যে অপুর্বও এলো।
বিকেলের দিকে অপুর্ব, সুতপা আর তুহীন এক সাথে বেড়িয়ে পড়লো। দুপুরে স্কুল থেকে ফেরার পথে একটা উপহার কিনে এনেছিলো।
ওটাও নিতে ভুলেনি।
অনেকে এসেছে বিয়েতে। বেশ বড়ো সড়ো হল রুম। সকলেই পরিচিত। অপরিচিত সুতপাকে দেখে অনেকেই ওর সাথে কথা বলছিলো।
পরিচিত হচ্ছিলো। গল্প করছিলো।
বিয়েতে অপুর্ব শ্যাম্পেইন গিলছিলো।
সুতপা তা লক্ষ করছিলো। অনেকদিন যাবৎ কোন অ্যালকোহল জাতীয় জিনিস অপুর্ব ছোঁয়নি। আজ অনিচ্ছা সত্বেও কোম্পানি
দেওয়ার জন্য সকলের সাথে কয়েক ডোজ মেরে দিলো। তবে প্রচুর সিগারেট টেনেছে।
সুতপা অন্য পাশের একটি চেয়ারে চুপচাপ বসেছিলো। মাঝে মাঝে দুজনার চোখা-চোখি হচ্ছিলো। এক সময় শুরু হলো নাচের পালা।
সব নাচিয়েরা নাচছে। নানা ভঙ্গিতে নানা তালে। রাশিয়ান মিউজিক বাজছে। মাঝে মধ্যে বলিউডের গান। বেশ জমে উঠেছে। এক সময় মেয়ে নাচিয়েরা পালায় যোগ দিলো। কয়েকজন আবার সুতপাকে নাচার দলে সামিল করার জন্য পীড়াপীড়ি শুরু করতে লাগলো। টানা-হেচড়া শুরু করলো। শেষ পর্যন্ত ওকে কাবু করতে পারেনি। একটা পাশের চেয়ারে বসেছিলো। মনে হচ্ছে বেশ খারাপ লাগছিলো ওর।
রাত ১০টার দিকে সুতপাকে নিয়ে অপুর্ব বেড়িয়ে পড়লো। বিয়ের হৈ চৈ তখনো চলছে-
সুতপার মুখটা বেশ গম্ভীর, বেশ ভার ভার। চুপচাপ অপুর্বর পেছনে হেঁটে চলেছে। কোন কথা বলছে না। ওর নীরবতা ভাঙ্গানোর জন্য অপুর্ব প্রশ্ন ছুড়লো-
-কেমন লাগলো অনুষ্ঠান
কিন্তু কোন উত্তর পেলোনা। ঠোঁট বাঁকা করতে যেন টের পেলো।
অপুর্ব বুঝতে পারলো সামথিং ইজ রঙ। কোথাও কোন ভুল হয়েছে।
রাস্তায় আসতেই হাত দিয়ে একটা ট্যাক্সি থামালো। মিখলুখা মাখলায়া বলতেই বললো
-জেসিত রুবল (দশ রুবল)
-দাবাই (চল)
সারা পথ ট্যাক্সিতে একেবারে চুপচাপ পাশাপাশি পেছনের ছিটে বসেছিলো। কোন টুশব্দটিও নেই।
এক সময় সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে আসলো। রুমে ঢুকলো। সুতপা এখানেই বাকী দিনগুলি থাকবে। আর দুদিন পরেই রুস্তভ ফিরে যাবে।
কিছুক্ষন আবার নীরবতা। এবার অপুর্ব নীরবতা ভাঙ্গলো:
-তুমি চুপ চাপ আছো কেন? কেউ কি কিছু বলেছে? সারাটা পথ একেবারে চুপচাপ ছিলে
মুখটা অন্যদিকে ফিরিয়ে নিলো কিছু বললো না
-তুমি কি কোন কিছু নিয়ে রাগ করেছ?
এবারও কোন উত্তর নেই। অপুর্বর ভালো লাগছিলো না। মাথাটাও কেমন চিন চিন করে ব্যাথা করছিলো। বুকটা কেমন ধক ধক করছে।
কোন ভুল ভাল করেনিতো?
আবারো জিজ্ঞেস করলো-
-তুমিতো এখনও কিছু বলছো না। তুমি কি আমার সাথে কথা বলবে না? আমার কি কোন ভুল হয়েছে?
নাহ্ কোন উত্তর নেই।
এবার অপুর্বর জেদ হলো। নিজের বেডে বসেই অন্যদিকে উদাস দৃষ্টিতে ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে আছে। কারো কোন কথা নেই।
নিস্তব্দ রুম। একেবারে পিন ড্রপ সাইলেন্স। রুমে যে দুজন বসে আছে মনে হচ্ছে না।
একসময় নীরবতা ভেঙ্গে সুতপা বলে উঠলো-
-আপনি আজ এতো মদ খেলেন কেন?
Read full book here: Click here to download the PDF file