Summary:
সেন্ট পিটার্সের গীর্জায় ঘন্টা বেজে উঠলে যে নীরবতা ছড়িয়ে পড়ে গোটা এলাকায়, বরফের ভিতর দিয়ে নীরবতা ভেদ করে বয়স্ক লোকেরা জুতার মিহিন অনুরণন তুলে চলে যায় গীর্জায়- সেদিন ইরিনা সেতুর ফ্লাটেও তেমন নিরবতা লেপ্টে ছিলো।
ফ্লাটে সেদিন আর কেউ ছিলো না, ইরিনা আর মজিদ ছাড়া।
ইরিনা সেতুর জান। খুব ভালোবাসে ওকে। বছর খানেক হলো ওদের পরিচয়। পেশায় একজন নার্স। মস্কভিচ। কয়েক প্রজন্মের বাস মস্কোতেই। খুব সুন্দর করে কথা বলে। আস্তে আস্তে বলে। যেন আশে পাশে কেউ থাকলেও টের না পায়। বিরক্ত না হয়। মানবিক গুনটা খুব বেশী। সেতুকে প্রায় সময়ই বলতে শোনা যেত-
-জাচেম তাক গ্রমকা গাবারিত? নি মঝেস গাবারিত মেদলেন না (এতো জোড়ে কথা বলো কেন? আস্তে আস্তে কথা বলতে পারো না?)
-ইয়া মেদলেন্না গাবারিও। ই কাক মেদলেনা ইয়া বুদু এতা গাবারিত (আস্তেইতো বলি। আর কতো আস্তে বলবো)-সেতু বিরক্তির সুরে উত্তর দিত।
-পাচতি ভ্সিয়ে বাসে স্ত্রানে গাবারিত তাকঝে, গ্রমকা, কাক তিবিয়ে (তোদের দেশের প্রায় সবাই জোড়ে শব্দ করে কথা বলে, তোর
মতো)
এবার সত্যি সত্যি সেতু রেগে যায়। তখন ইরিনা অট্ট হাসিতে গুড়োমুড়ি খায়। ফ্যালফ্যাল করে সেতুর দিকে বাঁকা চোখে পিট পিট করে তাকায়। ও মুখের ভঙ্গিটা দেখার চেষ্টা করে। কখনো সখনো ভেঙ্গচি কাটে।
-তুই রাগ করিস কেন? আমিতো এমনিই বলছি-সেতুর রাগ ভাঙ্গানোর চেষ্টা করে।
মাঝে মধ্যে ভাঙ্গা বাংলায় বলে-
-আমি তোমায় ভালবাসি। আমার সঙ্গে রাগ নেই।
পিক করে তখন সেতু হেসে উঠে। ইরিনাকে জড়িয়ে ধরে। আদর করে।
সেতুর মতোই ইরিনা। খুব শান্ত স্বভাবের। সহজ সরল। আবার সেকেলেও বলা যায়। আধুনিকতার ছোঁয়া চোখে-মুখে নেই বললেই চলে।
তবে ভেতরে যেন সৌন্দর্যের সাক্ষাৎ প্রতিমা। চলনে-বলনে-চাহনিতে এক অমলিন সুন্দরতা ভর করে থাকে-যে সুন্দরের বর্ননা করা যায় না । শুধু অনুভবের জায়গা থেকে উপলব্ধি করতে হয়। তার কথায় যেন সড়কবাতির নির্যাসের মতো দেদীপ্যমান। কখনো কারো সাথে কোন উচ্চ বাক্য নেই। ভালোবাসা আর ভালোলাগার মানুষ প্রতিমা যেন নিজের হাতে ইরিনাকে বানিয়েছে। সবাইকে খুব তাড়াতাড়ি আপন করে নেয়। এটাই যেন তার সহজাত অভ্যাস। কখনো কোন উচ্চাকাংক্ষা পোষন করে না। অহেতুক স্বপ্নের মরিচিকায় নিজকে সঁপে দেয় না। নিজের যা কিছু আছে তা নিয়েই বেশ সুখী। সমাজের জন্য কিছু করতে চায়, প্রয়োজনের পাশে দাঁড়াতে চায়। তাই খুব যত্ন করে নার্সিংটা শেষ করেছে। এখন বছর তিনেক ধরে হাসপাতলে চাকরি করে।
তিনজনের সংসার। বাবা-মা আর সে। এক একসিডেন্টে বাবা পঙ্গু বেশ কয়েক বছর যাবৎ। রোজগারের মানুষ বলতে ইরিনা একাই। যা পায় তা দিয়েই সংসারটা ভালোই কেটে যায়। বাবা-মায়ের পেনশনের টাকায় হাত দিতে হয় না। বলা যায় বেশ সুখেই আছে ওরা। সেতুর সাথে পরিচয় হওয়ার পর প্রতি সপ্তাহে সেতু অন্তত একবার হাসপাতালে দেখা করতে যেত। মাঝে মধ্যে অপুর্বকেও নিয়ে যেত। কাজের শেষে ইরিনা আসতো। বেড়িয়ে পড়তো। একসাথে সন্ধ্যায় কোন রেঁস্তোরায় বসে খাওয়া -দাওয়া হতো। তারপরে কোন আন্ডারগ্রাইন্ডে পৌঁছিয়ে দিয়ে আসতো। ওরা খুব ভালো বন্ধু। পরিচয় থেকে ভালোবাসা। একদিন আরম্ভর করে বিয়ে সাদী হলো। অপুর্ব সে বিয়েতে খুব মজা করেছিলো।
বাঙালি স্টুডেণ্টদের মধ্যে বেশ হৈ চৈ পড়ে গিয়েছিলো।
তিন তিনটি কালো লিমোজিন ভাড়া নিয়ে নানান রংয়ের ফুল দিয়ে গাড়ীগুলি সাজানো হয়েছিলো। বিশিষ্টদের জন্য নেয়া হয়েছিলো একটা লিমোজিন। অপুর্ব সেতুর গাড়ীতেই বসেছিলো।
রাশিয়ানদের স্টাইলে বিয়ে। আগে কখনো দেখেনি। প্রথমবার দেখার মজাটাই একটু অন্যরকম। সাদা শার্টে কালো কোর্ট প্যান্ট। দামী কালো টাইয়ে খুব স্মার্ট লাগছিলো সেতুকে।
বাঙালী হিন্দুদের বিয়ের সাথে কোন কোন জায়গায় মিল পাওয়া যায়। বিয়ে চলে কখনো দুদিন আবার কখনো সাতদিন। ধুম ধামে নানা আয়োজনে সাজানো হয় প্রতিটি দিন। নানা ধরনের আচার ও সংস্কৃতি। তার মধ্যে একটি হাস্যকর ঐতিহ্য হলো দা ব্রাইড এবং মুক্তিপণ । মূল অনুষ্ঠানের আগে, কনের পরিবার বা বন্ধুরা কনেকে বরের কাছ থেকে চুরি করার ভান করে। তাকে ফিরে পাবার জন্য মুক্তিপণ দাবী করে। তা না দিলে কনেকে ছাড়া হবে না। কখনও কখনও দেয়ার পরেও কনের সাজে অন্য একটি মেয়েকে বরের কাছে পাঠায়। বরকে প্রকৃত কনের জন্য আরও বড় মুক্তিপণ দাবী করে। নানা দর কষাকষির পর শেষ পর্যন্ত কনেকে মুক্তি দেয়া হয়। তবে বর সবসময় বেশ সতর্কে থাকে যেন কনেকে আর কেউ চুরি না করতে পারে।
সেতুর কাছেও সেদিন অনেক বড় অংকের মুক্তিপন দাবী করেছিলো ইরিনার বান্ধবীরা। কোন উপায় নেই। মু্ক্তিপন আদায় করেই কনেকে ছাড়া হয়েছিল।
বিয়ের প্রথমেই প্রায়শই রাশিয়ান দম্পতিরা রেজিস্ট্রি অফিসে যায়। সাথে দুপক্ষের সাক্ষী সহ পরিবারের লোকজন থাকে। বিয়ের রেজিষ্ট্রশনের পন্থাটি পশ্চিমা দেশগুলির মতোই। অনেকে আবার রেজিষ্ট্রশনের পর রাশিয়ান অর্থোডক্স গির্জাতেও যায়। অর্থোডক্স চার্চেই রাশিয়ানরা সাধারনত যায়। প্রায় ঘন্টা দুয়েকের অনুষ্ঠান। অর্থোডক্স চার্চে বিবাহের একটি প্রথা হল দম্পতিদের মাথায় মুকুট পড়া। আরো কয়েকটি ঐতিহ্যবাহী অনুষ্ঠান হলো ভিনোক (যেখানে দম্পতির মাথায় ফুলের পুষ্পস্তবক অর্পণ করা হয়), ভেনচানিয়ে (যেখানে স্বামী ও স্ত্রীর মধ্যে আংটি বিনিময় করা হয়) এবং অবশেষে ঝিজনেনয় (গুরুজনদের দেয়াা একটি আশীর্বাদ) যা তাদের বিবাহিত জীবনের আনুষ্ঠানিক সূচনা করে। তারপরে, তারা অতিথিদের একটি কক্ষে প্রবেশ করে যারা তাদের এই নতুন জীবনের জন্য অভিনন্দন জানায়। তখন অনেকেই নানা ধরনের ঐতিহ্যগত দিক নিয়ে আসে। যেমন এক কাপ জল থেকে তিনবার পান করা (স্বাস্থ্য, সম্পদ এবং দীর্ঘ জীবনের প্রতীক), মধুর কেক খাওয়া (মিষ্টির প্রতীক), মুদ্রা অদলবদল করা (ভাগ্যের প্রতিনিধিত্বকরে), শস্য ঢালা (প্রাচুর্যের প্রতিনিধিত্ব করে), রুটি ভাঙ্গা (ঐক্য নির্দেশ করে), ঝাড়– দিয়ে লাফ দেয়া (উর্বরতা প্রচার করা), বিয়ের নথিতে স্বাক্ষর করা (আইনি স্বীকৃতি) এবং আরও অনেক কিছু।
আনুষ্ঠানিক অনুষ্ঠানটি সম্পন্ন হওয়ার পরে বর এবং কনে তাদের নিকটতম বন্ধুদের সাথে, ছবি তুলে। শ্যাম্পেন হাতে তুলে নেয়। তারপর এলাকার ঐতিহাসিক স্থানগুলিতে যান।
মস্কোতে দেখার জন্য সবচেয়ে জনপ্রিয় সাইটগুলির মধ্যে রয়েছে রেড স্কোয়ার, অজানা সৈনিকের সমাধি এবং বিজয় পার্ক।
সেদিন অপুর্বও লিমোজিনে ক্রেমলিনের রেড স্কয়ারে এসেছিলো।
রাস্তার দুপাশে হেঁটে চলা মানুষজন ওদের গাড়ীগুলোকে দেখছিলো। পাশ দিয়ে চলে যাওয়া বাসের জানালা দিয়ে অনেকে উঁকি মারছিলো, হাত নাড়াচ্ছিলো। খুব ভালো লাগছিলো অপুর্বর।
ঐতিহ্যবাহী রাশিয়ান বিবাহ যে এতো সুন্দর এবং স্মরণীয় ইভেন্ট হতে পারে অপুর্ব ভাবতেও পারেনি। সবসময় ভাবতো বাংলা অঞ্চলের হিন্দু বিবাহের মজা বুঝি অন্যরকম। দুটি অমলিন প্রেমের সন্ধিক্ষনের কি চমৎকার উদযাপন। প্রাচীন প্রথা এবং ঐতিহ্যের এ নিয়ম-কানুন প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে চলে আসছে। নিজের চোখে অপুর্ব বর ও কনের এ বিয়েকে কাছ থেকে দেখতে পেরে খুব ভাগ্যবান মনে করছে। বিয়ের সকালে, বর এবং কনে তাদের পরিবার এবং বন্ধুদের সাথে আলাদাভাবে তাদের বিশেষ দিনের জন্য প্রস্তুত করবে। বরকে একটি স্যুট বা কাফতান পরানো হবে, কনে সাধারণত সোনার সূচিকর্ম সহ একটি সাদা পোশাক এবং কোকোশনিক নামক একটি হেডড্রেস পরবে।
সেদিন ইরিনাকে এই বধুবেশে স্বর্গের অপ্সরা মনে হচ্ছিল। যেন ডানা কাটা পড়ি। বড় বড় চোখে কালো কাজলে বেশ ডাগর ডাগর লাগছিল। কোকোশনিকটি ছিল মুক্তা আর সাদা পাথরে তৈরী।
সেতু তখন মোটামুটি ভালো পয়সা কামিয়েছে।তাই খরচে কোন অসুবিধা হয়নি।
প্রথামতো অনুষ্ঠানের পরে নববধূ তার মুখের উপর একটি লাল রঙের ঘোমটা পরে। মুখট অর্ধ ঢাকা। সে ঘোমটাটি কিছুক্ষন পর কনের মা অথবা কোন নিকট আত্মীয় তুলে নেয়। এতে নাকি কনের মঙ্গল হয়। কনে বিশ্ব জ্যোতি দেখতে পায়। সারা জীবন পূর্ন থাকে আলোতে। অন্ধকার থেকে মুক্ত পাওয়ার উপায়।
তবে বিয়ের শেষের অভ্যর্থনা এবং ভোজপর্বটি বেশ দারুন উপভোগ করছিলো অপুর্ব। এমন অনুষ্ঠান আগে কখনো দেখেনি। দেখবেই বা কী করে। বাংলা ভুখন্ডেতো এমন বিয়ে আর হয় না। সবই বাঙালীদের নিয়ম-কানুন। রাশিয়ান বিয়ের এ অনুষ্ঠানটির নাম স্বাদেবকা। যেখানে অতিথিরা ভদকা শট বা মেডোভিনেউখা পানীয় সহ বোর্শট স্যুপ, পেলমিনি ডাম্পলিংস, ব্লিনিস ক্রেপস, শাশলিক কাবাব স্কিভার ইত্যাদির মতো বিভিন্ন খাবারে ভুড়িভোজন করেন। সেই অনুষ্ঠানটি চলে গভীর রাত পর্যন্ত। মাঝে মধ্যে উপস্থিত সকলে নবদম্পতির চারপাশে বৃত্তাকারে প্রেমের লোকগান গাইতে হাত মেলাচ্ছিল, হেলে দুলে নাচছিল। সেই সময় নব বধুকে সকলে উপহার দেন।
ঠাস কলে স্টিলের দরজাটা মুখের উপর খুলে গেল।
অপুর্বর ভাবনায় যেন হঠাৎ করেই একটা ঠাস করে ঢিল মারলো।
-শালা তোদের এতো সময় লাগছে কা? মিখলুখা মাখলায়া থেকে অল্প একটু রাস্তা।-মজিদ ফোস করে উঠলো। অপুর্ব সেতুর দিকে তাকালো-
-আরে সুতপা মস্কোতে আইছে। কতো লোক ওর লগে দেহা করতে আসে। আর এই শালাও বইয়া বইয়া গল্প করতে থাহে। শালাতো সুতপাকে নিয়ে আইতেই চাইছিলনা। ধইরা নিয়ে আইছি।-সেতু রুমে ঢুকতে ঢুকতে বলে। এর মধ্য ইরিনা রান্না ঘর থেকে বের হয়ে আসলো।
-দবরি বেচের (শুভ দিন)
-কাক দেলা (কেমন আছো)
এই বলেই সুতপাকে হাত ধরে রুমে ঢুকালো।
-তুই ব্যাটা এই কয়দিন সুতপাকে কই লুকাইয়া রাখছিলি-মজিদ প্রশ্ন করে
-একটা খবর দেওয়ার দরকার ছিল না? -আবার বিস্ময় প্রকাশ করে।
-সব কিছু এতো তাড়াতাড়ি ঘইটা গেছে, কিছু ঠাহরও করতে পারি নাই-অপুর্ব কাচু মাচু করে বলে।
-থাক থাক, আর এক্সপ্লেইন করতে হবে না-এ বলেই মজিদ সুতপাকে বলে-
-কেমন আছো, সুতপা
-ভালো আছি ভাইয়া, এখন অনেকটা ভালো
-অনেকটা ভলো মানে? শরীর খারাপ ছিল নাকি?
সুতপা কিছু বলার আগেই সেতু উত্তর দিলো
গত কয়দিন ও খুব অসুস্থ ছিলো। আজ সকালে শালা ওরে সুশীলদার রুম থেকে নিয়ে আইছে। এ কয়দিন ঐদিকেই ছিলো। এও জানতো না সুতপা কার রুমে আছে। কাইল জানতে পারছে সুতপা অসুস্থ।
-এখন কেমন লাগছে সুতপা। কোন অষুধ খাচ্ছো-মজিদের উদ্ভিগ্নের স্বর
-আজ সকাল থেকে বেশ ভালো আছি ভাইয়া। সকালে থেকে শুধু ব্যাথার ঔষধ নিচ্ছি। শুধু একটু দূর্বল লাগছে।
-কয়দিন মনে হয় ঠিকমতো খাওয়া দাওয়া হয় নাই-মজিদের ফের প্রশ্ন
-খাওয়ার রুচি ছিল না ভাইয়া। শরীর খারাপ থাকলে আমার কিছু খাইতে ইচ্ছে করে না
-আর কয়দিন আছো মস্কোতে?
-আর দুইদিন আছি। পরশুদিন চলে যাবো।
-কোথাও গেছ? মস্কোতেত মনে হয় ঘুরতে পার নাই।
-না ভাইয়া। অপুর্বদা বলছে কাল রেড স্কয়ারে নিয়ে যাবে। তুহিন ভাইয়াও যাবে বলছে। আর আমিতো মস্কোতে আসার জন্য চেষ্টা
করছি ভাইয়া। সম্ভবত এই সেপ্টেম্বরেই ট্রান্সফার হবো। আর এখন ঘুরতেও তেমন ইচ্ছে করছে না।
-কেমনে আর ভাল লগবে। এখন তো কাছের মানুষ পেয়ে গেছ। তুমি যে মস্কো আসার চেষ্টা করছ অপুর্ব আগে বলছিলো। তোমাদেরতো ভালোই চিঠি লেখা লেখি হচ্ছে। ভালোই চলছে তোমাদের।
সুতপার মুখটা যেন হঠাৎ করেই লাল হয়ে খেল। নাকের উপরের পাতলা চামড়া তির তির করে দুলতে লাগলো। কিছু বলতে পারল না।
-তুইও একটা পাগল। এইডা কি এমনে বলতে অয় নাকি। দেহসনা মাসে কতবার এহন থেকে এ শালা ওরে ফোন করে।
অপুর্বকে মজিদ এবং সেতু দুজনেই দুষ্টুমী করে শালা বলে মাঝে মাঝে ডাকে। এতে অপুর্বও কোন আপত্তি করে না।
-সুতপা, তুমি তাড়াতাড়ি মস্কোতে চইলা আস। তা না হইলে এ শালার আবার মাথা খারাপ হইয়া যাবে-এবলে সেতু অপুর্বর দিকে তাকিয়ে আবার লতে লাগলো-
-এহন মুখ বন্ধ কইরা রাখছস কা? কথা বলচ না কা?
-ও আর কি বলবে। ওতো এখন প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে-মজিদ হাসতে হাসতে বলে। এমন সময় সুতপা মজিদকে বলে-
-ভাইয়া, আপনিওতো দাদার সাথে রুস্তবে আসার কথা ছিলো। আমরা সবাই খুব আশা করছিলাম আপনারা আসবেন
-সব কি সবার ভাগ্যে হয়।-মজিদের আফসোসের কন্ঠ।
-কেন এক সময় চলে আসবেন। অপুর্ব দা জুন মাসে রুস্তবে যাবে। তখন না হয় আসবেন-সুতপার অনুরোধ।
-না এবার যাবো না। জুলাই মাসে দেশে যাবো। দেশ থেকে আইসা দেখবো তুমি মস্কোতে। তখনতো সব সময় দেখা হবেই।
-তোর না এবার দেশে যাওয়ার কথা? যাবি না-সেতু অপুর্বকে বলে।
-যাবো। অগাস্টের প্রথম দিকে। তিন সপ্তাহ থাকবো। তাই জুন মাসে রুস্তব যাইতে চাই-অপুর্ব জবাব দেয়।
-ভালোই হবে। রুস্তবটা দেইখা আস। পরেতো আর যাওয়া অইবনা। পরে মিস করবি।
-কেন আগামীবারতো ছাত্র সংগঠনের বার্ষিক সন্মেলন রুস্তবেই হবে। যাবো আবার।
-বুঝছি, তখন এক সাথে যাবি। ভালোই লাগবে। যা যা এবারও যা। মজা কইরা আইস। এখন গেলে একটু অন্য রকম মজা পাইবি। অন্য রকম আদর যত্ন।
হা হা করে সবাই হেসে উঠলো।
এমন সময় হন নন করে রান্না ঘর থেকে ইরিনা হাতে ট্রে নিয়ে ঢুকলো। চা আর বিস্কিট। সাথে বেশ কিছু কাটা আপেল।
-দাবাই, এখন কথা বন্ধ।
সুতপার দিকে তাকিয়ে বললো
-দাবাই সুতপা চাই পি (চা পান কর), স্তাবই ইস্যু নি রাজগাবারিবালা (তোর সাথে এখনো কথাই বলা হলো না)।-বলেই সুতপার পাশে এসে বসলো।
চায়ের সাথে অনেকক্ষন আড্ডা চললো। তার পর খাওয়া-দাওয়ার পালা। সেতু ইরিনাকে ফোন করে জানিয়ে দেয় যেন ডাল আর শব্জী রান্না করে। ইরিনা খুব সুন্দর করে স্ট্যালিচনি সালাদ আর স্যুপ বানায়। মজিদ ডাল আর পাঁচ মিশেলী শব্জী বানায়। খুব মজা করে সবাই খেয়েছিল। সোভিয়ত ইউনিয়নে এসে সবাই যেন পাকা রাধুনী। বেশ মুখ রোচক ছিলো খাবারগুলি। সুতপাও ভালো খেয়েছ। একেবারে চেটেপুটে খাওয়া। রুচিটা যেন ফিরে এসেছে।
স্ট্যালিচনি সালাদ, অপুর্বর খুব প্রিয় সালাদ।
সোভিয়েই ইউনিয়ন জুড়ে সকলের প্রিয় সালাদ। যে কেউ একবার খেলে বার বার খেতে ইচ্ছে করবে। এই সলাদটি রাশিয়ান সালাদ বা অলিভি নামেও পরিচিত। এটি ১৯ শতকের শেষের দিকে লুসিয়েন অলিভিয়ার নামে মস্কোর হার্মিটেজ নামক একটি রেস্তোরাঁর শেফ প্রথম তৈরী করে। প্রথম দিন থেকেই রাশিয়ান রান্নার সবচেয়ে প্রিয় খাবারের একটি হয়ে উঠে। স্ট্যালিচনি সালাদের প্রধান উপাদান হল আলু, গাজর, আচার, মটর, ডিম এবং সাধারণত নানা ধরনের মাংস যেমন হ্যাম বা মুরগি। সবজিগুলিকে সিদ্ধ করা হয় যতক্ষণ না তারা যথেষ্ট নরম হয় এবং একটি ঘন পেস্টের মতো টেক্সচারে একসাথে ম্যাশ করা যায়। তারপরে সমস্ত উপাদান মেয়োনিজের সাথে একত্রে মিশ্রিত করা হয়। এর ফলে স্বাদ বেড়ে যায়। যে কোন বিশেষ দিনগুলিতে এই সালাদটি থাকবেই। খাবারটি শুধু সুস্বাদুই নয় হৃদয়গ্রাহীও বটে। সত্যিকারের খাঁটি রাশিয়ান খাবারের অভিজ্ঞতা পেতে চাইলে, এই সালাদটি সবচেয়ে উত্তম।
ভুড়ি ভোজন শেষে চললো ম্যারাথন আড্ডা।
প্রায় রাত নটায় অপুর্ব আর সুতপা মিখলুখা মাখলায়ার উদ্দেশ্যে রওনা দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে এমন সময় সেতু বললো-
-একটু দাঁড়া। ড্রাইভার আইতাছে। তোদেরকে দিয়া আসবে।
এক সময় বিদায় নিয়ে বেড়িয়ে আসলো দুজনেই। সকলেই দরজায় দাঁড়িয়ে বিদায় দিল। মজিদ আরো কিছুক্ষন থাকবে।
চারিদিকে তখন রাতের অন্ধকার জাঁকিয়ে বসেছে।
গাড়ীটা ধীরে ধীরে ছোট রাস্তা থেকে বড় রাস্তায় ঢুকলো। নিয়ন বাতির আলো ছায়ায় পাশে বসে থাকা মস্কো শহরের সব আলো যেন সামুদ্রিক ঢেউয়ের মতো সুতপার চোখে মুখে আছড়ে পড়ছে। ফুলের গন্ধ আসছে দূর থেকে। সুনীল আকাশ যেন নীচে নেমে আসতে চাইছে। সুতপা চুপ। তার গ্রীবার ভাঁজে যেন ঘামের মতো কিছু একটা দেখা যাচ্ছে। এভাবে কতক্ষণ কাটবে ভাবছে অপূর্ব।
এমন কিছু কিছু সময় মানুষের জীবনে কত সুন্দর লাগে সেটা ভাবতে ভাবতে অপূর্ব যেন হারিয়ে যাচ্ছে অন্য জগতে।
সেই সময় পৃথিবীটাকে এত ভালো লাগছিল তা আর আজ বর্ননা করা যাবে না।
(চলবে---)
Read full book here: Click here to download the PDF file