মস্কোর বরফবিথী ও একজন সুতপা-পর্ব- ১


Author: ড. পল্টু দত্ত

Summary:

পর্ব-১

আজ সোমবার। ইংরেজী বছরের প্রথম দিন। অনেকদিন পর নতুন বছরে  কোন পার্টি ছিলো না, আড্ডার মাতোয়ারা হওয়ার কোন আয়োজন ছাড়াই শুরু হলো বছর শুরুর প্রহর। আড্ডা, হইচইয়ের কোন আয়োজন না করে একদম সাদামাটাভাবে পরিবারের সাথে কাটানোর মজাটাই ছিলো অন্যরকম। দুই ছেলের আব্দারে এবার পরিবারের সাথে নিউ ইয়ারস ইভটা কাটানোর প্রতিশ্রতি দিয়েছিলো অপূর্ব। শনিবারটা শপিংএ ব্যস্ত থাকলেও দরকারি কাজগুলো তালিকা থেকে বাদ পড়েনি। সকালে  ব্রেকফাস্ট শেষ করেই লেখার কাজ নিয়ে বসা যথারীতি।  লেখাটা শেষ করার তাড়া খুব। আগামী দু’ তিন দিন  তেমন কোন কাজ হবে না। সব ভেবেই লেখার কাজটা নিয়ে এত ব্যস্ততা।

‘বড়ো সাইজের একটা টার্কি এনো কিন্তু। পারলে একটু তাড়াতাড়ি শপিং যেও।’

সুতপার গলার আওয়াজে অপূর্বর মনোযোগে একটু ভাটা পড়লো যেন।

‘ঠিক আছে, ঠিক এগারটায় শপিংয়ে যাবো, কি কি আনতে হবে, একটু লিস্টটা করে রেখ।’

এরপরে সুতপার আওয়াজ আর শোনা না গেলেও রান্না ঘরের বাসন-কোসনের অব্যক্ত সালাপিকতায় মনে হলো, রান্না ঘরটা ব্যস্ত-ব্যস্ততা জুড়ে আছে সুতপাকে। রান্নাঘরের এক্সট্র্যাক্টর ফ্যানটা বড্ডো জোরে আওয়াজ দিচ্ছে। কেউ জোরে কথা বললেও আওয়াজটা কান পর্যন্ত এসে পৌঁছায় না। বায়ুমন্ডল ভেদ করতে না পারা পাখি ডানার শব্দ বাতাসে মিলিয়ে যাওয়ার মতো অনেকটা মনে হয়।

 

ইদানীং কেন যেন অপূর্বর তেমন কিছু মনে থাকেনা। লিস্ট বিহীন শপিং তার পক্ষে একদম অসম্ভব। অনেক সময় কোন নতুন আইটেম থাকলে তার আবার কায়দা করে ছবি তুলে নিতে হয়। বিশ্বায়ন আর তথ্যপ্রযুক্তির এই আধুনিক যুগের বিভিন্ন ডিভাইসের ব্যবহারের প্রচলিত ধারনার ভিতরে থেকেও তার ভুল হয়ে যায়। সাপ্তাহিক শপিংটা ছাড়া যদিও ঝক্কি ঝামেলার তেমন কিছু নেই। তারপরও কিভাবে যেন ঘন্টা দুয়েক হুট করে পার হয়ে যায়। প্রতি শনিবারেই অপূর্ব সাপ্তাহিক শপিং এর কাজটা করে।

ইদানিং সুপারস্টোরগুলোও বড্ডো পাজি হয়ে গেছে। কয়দিন পর পরই সেলফের জিনিসগুলো কেন যেন জায়গা পরিবর্তন করে ফেলে। মর্ডান মার্চেনডাইজিং। এতে নাকি বিক্রি বেড়ে যায়। অদ্ভুত ভোক্তা আচরণ। মাঝে মাঝে অপূর্বও তা করে। যা কেনার দরকার তা না কিনে অপ্রয়োজনীয় জিনিস কিনে নিয়ে আসে। আর জিনিসগুলির রদবদলের কারনে অপূর্বকে বেশী সময় ধরে খুঁজতে হয়।

গত সপ্তাহে যে কান্ডটা না ঘটালো। ভাগ্যিস সুতপার সাথে ঘর সংসার। অন্য কেউ হলে লংকা কান্ড বেঁধে যেত। বার বার বলে দিয়েছিলো একটা বিশেষ ধরনের ইনস্ট্যান্ট কফি নিয়ে আসতে। এই বিশেষ কফিটা ছাড়া ছোট ছেলে অর্ক অন্য কোন কফি পান করবে না। অপুর্বর জন্য এটা যেন একটা বাড়তি ঝামেলা। ভুল হয়ে যাওয়ার বাতিক থাকায় কফির ছবি তুলে নিয়েছিলো সে যেন কেনার সময় ভূল না হয়। সুতপাই কফির পুরনো বোতলটি এগিয়ে দিয়েছিলো ছবি তোলার জন্য। কিন্তু শেষ রক্ষা তাতেও হয়নি।

সুতপার পুরো আযোজনটাই ভেস্তে গেছে। সেটা বোঝা গেল সুতপার হঠাৎ আওয়াজে। এই আওয়াজে ধরপর করে উঠলো অপূর্বর বুকটা । সুতপা একটু বিরক্তির স্বরে বলে ওঠে:

-বার বার বলে দিলাম এই কফিটা আনতে, অথচ তা না এনে এইটা কি আনছো তুমি? মুখের সামনে পুরনো কফির বোতলটা সুতপা তুলে ধরলো।

-কেন কফিটাতো ঠিকই এনেছি? এইটাইতো আমি ছবি তুলে নিছিলাম।

-ভালো করে দেখতো? কতোবার বলেছি ডিক্যাফি লেখা থাকলে সেই কফি আনবে না। মনটা তোমার কই থাকে?

 

সুতপা এবারে একটু রাগের সুরেই কথাগুলো বললো। তবে রাগ না বলে বিরক্তিটাই মানান সই হবে। কারন বড়ো কিছু না হলে সুতপা রাগ করে না। সুতপা রাগ করলে অপূর্বর দিকে আর তাকানো যায় না। গ্রহনের শেষে চাঁদের মতো কেমন একটা কালো মেঘ এসে ভর করে মুখে। আত্মশ্লাঘা ভুগতে থাকে সে। অভিমানের মাত্রাটা বেড়ে যায়। বড়ো রকমের ভূল যে হয়েছে অপূর্ব বুঝতে পারে। এবারে সে মোবাইলে তোলা ছবিটা ভালো করে দেখতে দেখতে লজ্জায় পড়ে গেলো।

- আমি এইটা ফেরৎ দিয়ে অন্যটা নিয়ে আসবো? -একটু আমতা আমতা করে অপূর্ব সুতপাকে বললো।

 

-তুমি কচু ফেরৎ দিবা, ভালো করেই জানা আছে। একটু পরেইতো অর্ক কফি চাবে, তখন আমি কি দেবো-সুতপা অন্য দিকে চেয়ে কথাগুলো বললো। অপূর্ব চুপচাপ জিনিসগুলো ফ্রিজে রাখছে। পুনর্বার কিছু বলার সাহস আর সে পেলো না।

আবার সুতপার কন্ঠ। এবার কন্ঠটা অন্যরকম। বিরক্তির তো বটেই। সাথে অসহ্যের মাত্রাটা যুক্ত হয়েছে। ঝাঁজের পরিমানটা একটু বেশী।

-তোমাকে কে বলছে এতো বড় অরেঞ্জের বক্সটা আনতে। ডেটটাও ভালো কইরা দেইখা আন না।

-দেখলাম হাফ-প্রাইস আর মিষ্টি অরেঞ্জ- হিম ঝরানো গলায় অপূর্ব জবাব দেয়।

-কাইল শেষ দিন, তাই সস্তা। আর পচা অরেঞ্জগুলি একটু দেইখা আনবা না?

-আসলে ডেটটা ভালো কইরা দেখি নাই- প্রতুত্তরে অপূর্ব।

-দেখবা কেমনে? চশমা ছাড়াতো চোখে কিছু দেখ না? বির বির করে আরো অনেকক্ষন কি সব বলে গেলো সুতপা।

 

অপুর্ব টিপ টিপ পায়ে চলে এলো তার অফিস ঘরে। কিছুক্ষনের জন্য পরিবেশটা একটু বিরতি নিক। এত গর্জনের পর একটু হিম-শীতল সময় কাটানো যেতেই পারে। এরমধ্যে সব আবার এক পশলা বৃষ্টি শেষে জিভ লকলক করা সূর্যালোকের মতো দেখা গেলে খারাপ কি! অপূর্বের এতো দিনের সংসার। এর অম্ল-মধুর দিকগুলোর স্বরলিপি সবই তার মুখস্ত। এটা ভেবে সে স্বস্তির বাতাসে গা এলিয়ে দেয়। পর্বত প্রমান এক নির্ভরতা যেন তার সামনে এসে দাঁড়ায় যার নাম সুতপা। সুতপার সব সারল্যের কথা তার পরম-নিষ্ঠা, অতীতের সুখ-দুঃখের স্মৃতি হাতড়ে অপুর্বর চোখ ভিজে ওঠে। এমনিতেই অপূর্ব এবং সুতপা দুজনেই যেন বিনয়ের চাদরে ঢাকা দুটি সাধারন মানুষ। সুখী দম্পত্তির সঠিক সংজ্ঞাটি এদেরকে দেখলেই মনে হয়।

 

অপূর্ব বলে বিনয় নাকি সুস্থ ভাবে বেঁচে থাকার নির্ভরতা, সার্বিক সাফল্যের চাবিকাঠি।  অনেক বিজ্ঞ জনের মতে বিনয় মানুষের একটি মহৎ গুন। সত্যিকার অর্থে বড়ো মানুষ হওয়ার গুন। প্রাজ্ঞতার লক্ষন। ঈশ্বরের সাথে বিনয়ীদের সবচেয়ে বেশী বন্ধুত্ব। কারন বিনয়ীদের কোন অহংকার নেই, কোন দাম্ভিকতা নেই। বিনয়ীরা অন্যকে সন্মান করে এবং অন্যকে নিজের থেকেও বেশী ভালোবাসে। বিনয় একটি সমাজকে অনেক উপরে নিয়ে যেতে পারে এবং গড়তে পারে সুখী ও সমৃদ্ধির সমাজ। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই বিনয়ী লোকদের সবচেয়ে বেশী প্রয়োজন। অপূর্বর বাবা সব সময় ছেলেকে বলতো পারলে বিনয় হওয়ার চেষ্টা করো।

 

আজ মস্কোর দিনগুলোর কথা অপূর্বর খুব মনে পড়ছে। ১৯৯০ সালের ইংরেজী নতুন বছরের প্রথম দিনটাও ছিলো সোমবার। মস্কোতে সেদিন খুব ঠান্ডা ছিলো। তাপমাত্রা মাইনাস পনের বা তারো নীচে। এই সময় মস্কোতে তখন এমন ঠান্ডাই থাকতো। তার আগের কয়েক দিন খুব ধুন্ধুমার বরফ পড়েছিলো। রাস্তাঘাট বরফে ঢেকে গিয়েছিলো। ঠান্ডায় বরফগুলো রাস্তার সঙ্গে সিমেন্টের মতো লেপ্টে আছে। হাঁটা যে কোন সময় বড় বিপদ ডাকতে পারে। আস্তে আস্তে টিপে টিপে অতি সাবধানে না হাঁটলে পিছলে পড়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে।

 

মস্কো শহরের সৌন্দর্য যেন আরো মাত্রা পায় এই শীতে। ঐতিহ্যময় একটি সংস্কৃতির শহর যা শতাব্দী ধরে বিদ্যমান। প্রতিটি ঋতুই যেন শহরে বিশেষ কিছু উপহার নিয়ে আসে। নতুন রুপে সাঁজে শহরের রাস্তা ঘাট, আকাশ, বাতাস, পাতা ঝড়া সারি সারি গাছগুলো। এর ঐতিহ্যবাহী স্থাপত্য থেকে শুরু করে শহরের ব্যস্ত নাইটলাইফ এবং প্রাণবন্ত সাংস্কৃতিক দৃশ্য সবকিছুই যেন নতুন কিছু নিয়ে আসে মস্কোর শীতের মাসগুলিতে প্রত্যেকের জন্য। তুষার-ঢাকা রাস্তাগুলি বিশ্বের অন্য যে কোনও জায়গার থেকেও বেশী সুন্দর লাগে তখন এবং একটি মনোরম পরিবেশ  তৈরি করে।  সেন্ট বেসিল ক্যাথেড্রালের গম্বুজগুলি সাদা পটভূমির বিপরীতে দাঁড়িয়ে থাকে সুউচ্চ গিরী শৃঙ্গের মতো। রেড স্কোয়ার পাশ দিয়ে বরফে ঢাকা মস্কো নদীর তীর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে মনে হয় রূপকথার কোন এক রাজকন্যার হারিয়ে যাওয়া স্বর্গীয় বাগানে হেঁটে চলেছি। উচ্ছ্বাসের হাওয়া বয়ে যায় চোখে মুখে। আর সময়টা যখন ক্রিসমাসের সময় হয় তাহলে তো কথাই নাই। পুরো শহরটি সেই সময় উৎসবের আলোক সজ্জায় আলোকিত হয়।  সেই দিনগুলিতে  যে কেউ চারপাশের সমস্ত সৌন্দর্য  দেখতে  দেখতে ভূলে যাবে যে বাইরে কন কনে শীতকাল আর বরফের রাজত্ব চলছে। সকাল হলেই তুলোট মেঘের মতো চোখের চতুষ্কোন আটকে রাখে বরফের আস্তর।

 

শীতকালীন মস্কো শুধু মনোরম দর্শনীয় স্থানই নয়; উপভোগ করার জন্যও সেরা। এখানে শীতে কতো কিছু করার  আছে তা ভেবে শেষ করার মতো নয়। আইস স্কেটিং রিঙ্কগুলি ডিসেম্বর এবং জানুয়ারি জুড়ে খোলা থাকে। অনেক দুঃসাহসিক মস্কোবাসী হিমায়িত নদীতে বরফ মাছ ধরার আনন্দে মাতোয়ারা হয়। কত  রোমাঞ্চকর ব্যাপার স্যাপার আছে অল্প কথায় যা বলে শেষ করার মতো নয়। বহিরাঙ্গন ক্রিয়াকলাপ ছাড়াও, মস্কোর অনেক থিয়েটার বা সিনেমার একটিতে কনসার্ট বা শো দেখার অপার আনন্দে উদ্বেলিত হতেই হয়। অফুরন্ত আনন্দের খোরাক যেন প্রাঞ্জল থাকে মস্কো শহরের এ পাশ থেকে ওপাশ অবধি ।

 

আজ অপূর্বের খুব মনে পড়লো সেই দিনটার কথা। সেদিন  সোমবার ছিলো। নতুন বছর আসলেই সকলের মতো অপূর্বও নতুন বছরের রেজিউলেশন নেয়। সেই দিনও ভেবেছিলো নতুন বর্ষের শুরুতে জীবনটাকে একটু ঘষামাজা করে অতীতের সব দুঃখ-ক্লেদ-গ্লানি, বিবর্ন ঘটনাগুলির জঞ্জাল ঝেড়ে মুছে নতুন আঙ্গিকে একেবারে সদ্য প্রস্ফুটিত গোলাপ কোড়কের মতো ধীরে ধীরে সাঁজাবে। কি লেখাপড়ায়, কি সাহিত্য চর্চায়, কি খাওয়া দাওয়ায়, হাসিতে খুশীতে সারাক্ষন মেতে থাকবে। জীবনটাকে সু্ইটকেসে সাঁজানো জিনিস পত্রের মতো বহুমাত্রিক সৌন্দর্য কলায় থরে থরে সাঁজিয়ে নেবে।

কিন্তু মানুষ যা চায় তার কতোটুকু জীবনে পূর্নতা পায়?

অপূর্বর বেলায় যেন এক শতাংশও পূর্ন হয় নি। বরং এইভাবে বললেই হয়তো ভালো হবে, স্থির বিন্দু থেকে সামনের দিকে নয় বরং পিছনের দিকেই যেন জীবনের গতিপথ।

আজ এমন একটি দিন যে দিন তাবৎ পৃথীবীর মানুষ জন নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখে। কিন্তু অপূর্ব? পারলো না। মনে হচ্ছে নববর্ষটা যেন অপূর্বর জীবনে এক ভয়ানক দুঃসময়ের রনক্ষেত্র। আর কয়েকদিন পরেই তার ইউনিভার্সিটিতে প্রথম সেমিস্টারের পরীক্ষা শুরু হবে। অথচ এখন অব্দি তিনটা সাবজেক্টে ছাড়পত্র পায়নি। আর ছাড়পত্র না পেলে ফাইনাল পরীক্ষায় অবতীর্ন হওয়া যায় না।

 

নববর্ষ উপলক্ষে সকলেই নানা ভাবে অনুষ্ঠান পালনের ব্যবস্থা নিয়েছে। অপূর্বও বেশ কয়েক জায়গা থেকে নেমন্তন পেয়েছে। কিন্তু নিঃসঙ্গ সে পান্থবিহীন পথচারীর মতোই যেন হেঁটে চলেছে। ইদানিং বড়ো ধরনের ভিড়ভাট্টা অপূর্বর আর সহ্য হয় না। তাই কোথাও গেল না। শেষ পর্যন্ত কবি ফরহাদ ভাইয়ের ৭ নম্বর ব্লকের রুমে নিউ ইয়ারস ইভে রাত ৮টায় গিয়ে উপস্থিত হলো। ফরহাদ ভাই একজন উদীয়মন কবি। ডাক্তারী লাইনে তার পড়াশুনা । খুব বিনয়ী ও সৎ। রাজনীতি, সমাজনীতি এবং সাহিত্যে বেশ দখল আছে। কথায় বার্তায়ও তা চোখে পড়ে। সুযোগ পেলেই অপূর্ব চলে আসে এখানে । সাহিত্য সহ সমসমায়িক বিষয়াদি নিয়ে বেশ কথা বার্তা হয়। কখনো নিজেদের সদ্য লেখা কোন কবিতা পড়ে শুনানো হয় এবং তার উপর গুরু গম্ভীর আলোচন হয়। ফরহাদ ভাইয়ের এই রুমে সৃষ্ট হয় শনিবারের সাহিত্য আড্ডা নামে একটি গ্রুপ। মস্কোতে প্রবাসী বাংলাদেশী শিক্ষার্থীদের অনেকে সাহিত্য নিয়ে ভাবতো বা কেউ কেউ লেখার সাথেও জড়িত ছিলো। তাদের অনেকেই এই আড্ডায় শরীক হতো। খুব অল্প দিনের মধ্যেই এ আড্ডাটি খুব জম জমাট হয়ে ওঠে।

সেই রাতে অপূর্ব সাথে নিয়ে গেলো দুটি স্যাম্পেইন। ফরহাদ ভাই অপূর্বকে দেখে যেন হাতে চাঁদ পেলো। দুজনে বসে বেশ জম্পেস করেই নিউ ইয়ারস ইভটা কাটাতে পারবে। রান্না বান্না করে খাওয়া দাওয়া হলো তার পর চললো আড্ডার পালা। ঐখানে রাতটা পার করে দিলো। পরের দিন দুপুর ১টায় নিজের রুমে ফিরে এলো। আবার একটা ঘুম। গতকাল তেমন ভালো ঘুমুতে পারে নি। অপূর্বর শরীরটা বেশ ম্যাজ ম্যাজ করছিলো। বুঝতে পারছিলো শরীরটা ভালো নয়, খারাপ, বড্ডো খারাপ। হওয়ারই কথা।

 

-  বোতল কিন্তু শেষ। অনেক পেটে পরেছে, এখন ঘুমুতে হবে। সকাল হয়ে গেলো বটে- ফরহাদ ভাইয়ের কথাগুলো ফিস ফিস করে অপূর্বর কানে বাজছিল।

-কি বলেন ফরহাদ ভাই? এখনো তো রাতই শুরুই হয় নি। বোতল শেষ হয় কি করে? খাওয়া তো শুরুই করিনি এখনো-জরানো কন্ঠে কথাগুলো খুব ধীরে ধীরে বললো অপূর্ব।

অপূর্বের এ এক অভ্যাস। পেটে কিছু পড়লে আর হুঁশ থাকে না। নিজের নামটাও যেন ভূলে যায়। বন্ধুরা এ নিয়ে কতোনা হাসি ঠাট্টা করে।

এখন বুঝতে পারছে শরীরটা খারাপ লাগছে কেন।

-না আজ আর কোথাও যাবো না। কাল পরীক্ষা আছে। পড়াশুনা করতে হবে। সন্ধ্যায় বুফেতে গিয়ে কিছু একটা খেয়ে নেব। অস্পষ্ট স্বরে বির বির করে কথাগুলো বলে গেলো নিজের মনেই। টেবিল লাইট জ্বালিয়ে বসে পড়লো বই খাতা নিয়ে। বাইরে শীতের তুহিন ঢাকা প্রকৃতি শীতল আবছায়ায় বুঁদ হয়ে আছে। পাখিদের কণ্ঠস্বর কানে আসছে না। মানুষের ছায়া চোখে পড়ছে না। এক পাথর নিরবতা চারদিকে যেন ভাষাহীনতার গান গাইছে। অন্ধকারের চাদরে আস্তে আস্তে ঢেকে যাচ্ছে দিবসের শরীর। পৃথিবীটা কেমন নিস্তব্ধ হয়ে আসছে। এরমধ্যে রুমে বসে বাইরের কনকনে শীতের নিরবতাকে  উপলদ্ধি করা যায় না। মস্কোতে ঘরের ভিতরে সব সময় রুম  টেম্পারেচার থাকে। রাশিয়ার বিদ্যুতব্যাবস্থা আর সেন্ট্রাল হিটিং নিয়ে অপূর্ব বরাববরই গর্ববোধ করে। বিশ্বের আর কোন দেশে এতো উন্নতমানের হিটিং সিস্টেম আছে বলে অপূর্বর মনে হতো না।

এইসব ভাবতে ভাবতে কখন যে গ্রীক দেবতা হাইপনস এসে ঘুমের দেশে পরম মমতায় অপূর্বকে টেনে নিয়ে গেল অপূর্ব টেরই পায়নি।

 

(চলবে---)



Read full book here: Click here to download the PDF file