স্মৃতিতে একাত্তর

১৯৭১ সালে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে দেশটির বিজয়কে স্মরণীয় করে রাখতে প্রতি বছর সারাদেশে ব্যাপক আড়ম্বর ও অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে বিজয়ের মাস পালিত হয়এ উপলক্ষে সকল সরকারি-বেসরকারি ভবনে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়। দিবসটি উপলক্ষে কুচকাওয়াজ, র‌্যালি ও অন্যান্য অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।  এবারও তার প্রস্তুতি চলছে। ১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ পাকিস্তানি সেনাবাহিনী দেশের বিভিন্ন স্থানে বাংলাদেশীদের ওপর হামলার মধ্য দিয়ে শুরু হয় যুদ্ধ। নয় মাস ধরে এক রক্তক্ষয়ী ও নৃশংস যুদ্ধ চলে মার্চ থেকে ডিসেম্বর ১৯৭১ পর্যন্ত। ত্রিশ লাখেরও বেশি মানুষ শহীদ হন। লক্ষাধিক নারী ধর্ষিত হয়। এক ভয়ানক এবং জঘন্যতম হত্যাযজ্ঞের তান্ডবলীলা চালিয়েছিলো পাকিস্তানের নরপশুরা। সাথে যুক্ত হয়েছিলো এই মাটিরই শীতল ছায়ায় বেড়ে উঠা বর্বর আলবদর আর রাজাকারের দল। ষড়যন্ত্র করেছিলে বাংলার মানুষ এবং বাঙালীর চেতনাকে হত্য করার। ঘটিয়েছিলো বাংলার আনাচে-কানাচে পৃথিবীর ইতিহাসে নজীর বিহীন গনহত্যা। খুলনার ফুলতলা, দেবীতলা, বাদামলা সহ বাগেরহাটের শাঁখারীকাঠি, গাইবান্ধার হেলাল পার্ক, যশোহরের কেশবপুরের মঙ্গলকোর্ট বাজার, নাটোরের ছাতনী গ্রাম, খুলনার চুকনগর, ঢাকা এবং আরো অসংখ্য জায়গায় চালিয়ছিলো নারকীয় হত্যাযজ্ঞ এবং গনহত্যা। সেই সময়ে আমার আশে পাশের অনেক আত্মীয় প্রিয় স্বজনেরাও নিহত হন। আমার বড়দিদি কোন রকমে বেঁচে যায় পাকিস্তানিদের লক্ষবিদ্ধ গুলি থেকে।  আমাদের পরিবার  এক লহমায় অন্ধকারে নিমজ্জিত এমন এক পৃথিবীতে ডুবে গেলো। আমরা জানতাম না কোথায় গিয়ে দাঁড়াবো বা কি করতে হবে। কিন্তু আমরা একা ছিলাম না। আমাদের সাথে ছিলো সাড়া বাংলার কোটি মানুষের আত্মিকতা সৌভাত্রের বন্ধন। আমরা একে অপরের মধ্যে শক্তি খুঁজে পেয়েছিলাম। ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বাংলাদেশীদের কাছে আত্মসমর্পণের মাধ্যমে যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে। বাংলা হলো স্বাধীন, পেলাম একটি স্বাধীন স্বার্বভৌম রাষ্ট্র এবং সবুজ আর রক্তে রাঙ্গানো পতাকা। আমাদের বিজয়। কি এক পরম আনন্দের মাহেন্দ্রক্ষন। রম সুখ ও স্বস্তির মুহূর্ত। ধীরে ধীরে আমরা হলাম সমৃদ্ধ এবং ঋজু। তারপর থেকে, যারা আমাদের দেশের জন্য জীবন উৎসর্গ করেছেন তাদের স্মরণে প্রতি বছর আমরা বিজয়ের মাস উদযাপন করি।

 

এই আনন্দ আর বেদনার বিজয়ের মাসকে নিয়েই ভাবছিলাম বাংলা থেকে হাজার মাইল দুরে বিলেতের থেমসের শহর লন্ডনের বাসায় বসে। ছুটির দিনের কিছুটা অলস মুহুর্তে দেখছিলাম বাংলাদেশের খবর। ঢাকা আবারো উত্তাল, ভিষন ভয়ানক অবস্থা। এ যেন যুদ্ধের নগরীই মনে হচ্ছে। তবে বিদেশী শত্রুর বিরুদ্ধে নয়। এবার স্বদেশীয় অপশক্তির উন্মাদনা। এ এক নতুন ধরনের খেলা। নতুন ষড়যন্ত্র। স্বাধীনতা শক্তির বিরুদ্ধে অপশক্তির সর্বনাসা পায়তারা, প্রগতীর বিরুদ্ধে পশ্চাদগমনের লড়াই, স্বাধীন মূল্যবোধের বিরুদ্ধে দাসত্বের ষড়যন্ত্র। বাংলার রাজনৈতিক মঞ্চ আবারো উত্তাল। আমরা একটি ভয়ানক যুদ্ধের ভয়াবহতা দেখেছি, আমরা লক্ষ ধর্ষিতা মা-বোনের নির্বাক অবয়বে সাড়া পৃথিবীর ভয়ানক ক্রন্দনের বিলাপ শুনেছি, লক্ষ মানুষের বুক ঝাঁঝড়া করা খান্ডব রক্তের দহন স্বচক্ষে দেখেছি, লাশের গন্ধে এখনো বাংলার বাতাস ভারী হয়ে আছে। আর কোন ষড়যন্ত্র নয়। এই কথাগুলো ভাবতে ভাবতে আমার ছেলে বেলায় আমি ফিরে গেলাম। সেই ৭১এর রক্তঝড়া দিনগুলিতে।

 

সেই দিনটার কথা কি করে ভুলি? যদিও বয়সে ছোট ছিলাম। গরীব ছিলাম বলে তখনো স্কুলে যাওয়া হয়নি। সমবয়সী সকলেই স্কুলে যেতো। মাঝে মাঝে ওদের সাথে আমিও যেতাম। তবে স্কুলে নয়। গেইট পর্যন্ত। সেদিন আমরা যখন স্কুলে পৌঁছলাম, আমরা লক্ষ্য করলাম যে আমাদের স্কুলের চারপাশে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি মানুষের আনাগোনা ছিল। আমরা তাই বলে খুব একটা বিচলিত হইনি এবং বন্ধুরা সকলেই শ্রেণীকক্ষে চলে গেলো। কিন্তু কিছুক্ষন পরেই সবাই আবার ফিরে আসলো। আজ নাকি ছুটি। শিক্ষকরা বললো বাড়ী চলে আসতে। স্কুলের গেট থেকে বের হওয়ার সাথে সাথেই আমরা গুলির শব্দ শুনতে পেলাম। থানা শহর থেকেই ভেসে আসছিলো। তখনই আমরা বুঝতে পারলাম কী ঘটছে- বাংলাদেশ আক্রমণের মুখে!কয়দিন ধরেই বড়রা বলাবলি করছিলো দেশে নাকি বর্গিদের হানা পড়েছে। পাকিস্থানীরা নাকি বঙ্গবন্ধুকে মারতে চায়, বাঙালী জাতীকে পিষ্ঠ করতে চায়। আমরা যত দ্রুত সম্ভব বাড়ি ছুটে গেলাম। যখন বাড়িতে পৌঁছলাম, তখন আমার বাবা-মা আমাদের জিনিসপত্র গুছিয়ে নিচ্ছিলেন। খুব চিন্তিত মনে হচ্ছিল বাড়ীর সবাইকে। পরিস্থিতি শান্ত না হওয়া পর্যন্ত আমরা কাছাকাছি একটি নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নিতে যাচ্ছিলাম। মা আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। তার গাল বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। আমার দূর্বল হাত দিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদো কাঁদো স্বরে বললাম “আমাগো কি অরা মারতে আইতাছে?” আমি মাকে এত ভয়ে আগে কখনো দেখিনি। আমার বড়দা, সেজদা, ছোড়দা সবাইকে খুব চিন্তিত লাগছিলো। পরের কয়েকটা দিন ছিল ঝাপসা। আমরা আমাদের বেশিরভাগ সময় সেই স্থানে একসাথে কাটাতাম, শুধুমাত্র খাবার এবং জলের প্রয়োজন ছাড়া  বেরুতাম না। পাশের থানা শহর থেকে গোলাগুলির শব্দ অবিরাম শোনা যেত এবং কখনও কখনও মনে হতো যেন পুরো পৃথিবী বিস্ফোরণে কাঁপছে। এই দুঃসময়ের মধ্যে হঠাৎ এসে হাজির হলেন আমার কালো দাদু মোবারক হোসেন। 

 
আমার এ দাদু পাশের গ্রামেই থাকতেন। খুব ধার্মিক মানুষ। আমাদের আশে পাশের এলাকায় দাদুর বেশ হাঁক-ডাক ছিলো। ছিলেন বেশ সম্ভ্রান্ত বংশের। এলাকার শালিস-দরবারে সবসময় ডাক পড়তো। ন্যায্য বিচার করতেন বলে সবাইর সন্মানের পাত্র ছিলেন। এই মোবারক হোসেন অর্থাৎ কালো দাদু আমার মাকে মেয়ে হিসেবে মানতো। সেই থেকেই উনি আমাদের দাদু হয়ে গেলেন। আর আমার মাও উনাকে উনার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বাবা বলেই ডাকতেন। মামার বাড়ী যাওয়ার মতোই এই কালো দাদুর বাড়ীতে মাকে নাইয়র নেওয়া হতো। আমরা সেখানে ৫-৬ দিন বেড়াতাম। দাদুর ছেলে -মেয়েরা অর্থাৎ মামা-মাসীরা আমাদেরকে খুব ভালোবাসতন। দিদিমা আমাদেরকে প্রতিদিন মুড়ির মোয়া বা মুড়ির সাথে তালের গুর দিয়ে সকালের খাবার দিত। কখনোই বুঝতে দেননি যে আমরা তাদের সত্যিকারের বংশের কেউ নই। আজ বুঝতে পারি সত্যিকারের সম্পর্ক সমস্থ ধর্ম, বর্ন, পেশা, গোত্র আর বংশকেও ছাড়িয়ে যায়। কতো না আনন্দ করেছি কালো দাদুর বাড়ীতে। আমি সেই দিনগুলিকে কখনই ভুলব না - যা চিরকালের জন্য আমার স্মৃতিতে গেঁথে আছে। সে দাদুর বাড়ীতেই শেষ পর্যন্ত আমরা আশ্রয় নিলাম। বেশ কয়েকদিন জম্পেস আনন্দে ছিলাম। কিন্তু বাবা-মাকে সবসময় চিন্তিত দেখতাম। তাছাড়া বড়দাকে নিয়েও খুব শংকার মধ্যে ছিলো। বড়দা মুক্তি যুদ্ধে যাওয়ার জন্য বায়না ধরলো। শেষ পর্যন্ত পরিস্থিতির কথা বিবেচনা করে মোবারক দাদু আমাদেরকে ভারতে পাঠানোর সব ব্যবস্থা করলেন। একদিন গভীর অন্ধকারে আমারা নৌকায় চেপে বসলাম এক অজানার উদ্দেশ্যে। শেষ পর্যন্ত অন্যান্য লক্ষাধিক বাংলাদেশীর সাথে আমরা সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে প্রবেশ করি। যাত্রাটি দীর্ঘ এবং কঠিন ছিল, কিন্তু আমরা দমে যাইনি। প্রথমে ত্রিপুরার উদয়পুরে, তারপরে আসামের এক শরনার্থী ক্যাম্পে আমাদের ঠাঁই হয়। শুরু হলো আমাদের নতুন জীবন আর অপেক্ষার পালা। কবে শেষ হবে এই দহনের কাল? অমাবশ্যার ভয়ংকর রাত? একদিন তার অবসান হলো। কিন্তু শরণার্থী হিসাবে, আমরা অবিলম্বে আমাদের দেশে ফিরতে পারিনি। কেমন ছিলো সেই দিনটা? বিজয়ের সংবাদটি যখন ক্যাম্পে এসে পোছলো?

 
উজ্জল নক্ষত্রের মতো আমার স্মৃতির আকাশে এখনো সেই দিনটির কথা ভেসে উঠে। ১৬ই ডিসেম্বর ১৯৭১। এমন একটি দিন যা অন্য যে কোনো দিনের মতোই শুরু হয়েছিল। আমি পরিবারের ছোট এবং খুব হ্যাংলা পাতলা ছিলাম। ঠিক মতো চলতে পারতাম না। অনেকে বলতো অসুখের গোষ্ঠী নাকি ভর করেছে আমার শরীরে। আসামের রিফুজি ক্যাম্প থেকে আমাকে বেঁচে ফিরে আসার আশা অনেকেই ছেড়ে দিয়েছিলো। কতো শতো লোক চোখের সামনেই কলেরায় মারা গেলো। আমার দুঃখীনি মা কতো না আঁচলে চোখ লুকিয়েছে। ডুকরে কেঁদে উঠতো মাঝে মাঝে। একদিকে আমার দিদিকে বাংলাদেশে ফেলে আসার এক অসহনীয় যন্ত্রনা। আর এখানে আমি অসুখে শয্যাগত। এক অনিশ্চয়তা আর শংকার মধ্য দিয়ে দিনাতিপাত করছি সবাই। পরিবারে আমরা সাত জন। আমি সহ আমরা পাঁচ ভাই আর আমার মা এবং বাবা। আমার বড়দা এবং বাবা ক্যাম্পেই ভলান্টিয়রের কাজ জুগিয়েছে। সেদিন সম্ভবত বৃহস্পতিবার ছিলো। কারন প্রতি সপ্তাহের এই দিনটিতেই আমার মা ব্রত রাখতেন। আমি তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠলাম। আগের দিন বড়দাদা চীৎকার করে এসে খবর দিলেন জয় বাংলা নাকি স্বাধীন হচ্ছে। ভারতের জেনারেল অরোরা নাকি নিয়াজির উদ্দেশ্যে আত্মসমর্পনের আহব্বান জানান। আজ নাকি তার ঘোষনা হবে। আমরা নাকি আবার জয় বাংলায় যেতে পারবো। দিদিকে খুঁজে বেড় করতে পারবো। এ কথা শুনে আমার মা আনন্দে কাঁদতে শুরু করলেন। মার কান্না দেখে আমি এবং আমার ছোড়দা দুজনেই কাঁদলাম। মনে হলো কান্নাটা মঙ্গল। তাহলেই জয় বাংলায় গিয়ে হারানো দিদিকে খুঁজে পাবো। বাড়ীর আঙ্গিনায় আবারো ডাঙ্গুলী, গোল্লাচ্ছুট আর কানমাছি ভোঁ ভোঁ খেলতে পারবো। আনন্দের স্বপ্নে কিছুক্ষনের জন্য হেঁটে বেড়ালাম, গাঁয়ের সবুজ-শ্যামলের ভিতর দিয়ে মেঠো পথ ধরে ক্লান্তহীন ভাবে। 

 
পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের বিজয় শুধু সামরিক বিজয় ছিল না। একটি রাজনৈতিক ও মনস্তাত্ত্বিক বিজয়ও ছিল। অনেক দিন ধরেই, পূর্ব পাকিস্তানকে পশ্চিম পাকিস্তানিরা উপনিবেশ হিসেবে বিবেচনা করে আসিলো। এ বিজয়ের মাধ্যমে বাঙালী প্রমান করলো যে আমরা শৌর্য-বির্য আর উন্নত শির বাঙালীর রক্ত বইছে আমাদের ধমনীতে এবং বাঙালিরা নিজেদের শাসন করতে সক্ষম। বিজয় এটাও প্রমাণ করে যে ইসলামকে পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদের সমার্থক হওয়ার প্রয়োজন নেই – বাঙালি মুসলমানরা দেখিয়েছিল যে তারা পাকিস্তানকে সমর্থন না করেই গর্বিত মুসলমান হতে পারে। বাংলার হিন্দু, মুসলিম, খ্রীষ্টান, বৌদ্ধের সৌভাত্রের বন্ধন আর লড়াইয়ের প্রতিক আমাদের বিজয়। একটি সুসজ্জিত এবং সংগঠিত সামরিক শক্তির বিরুদ্ধেও যে বেসামরিক লোকেরা প্রতিরোধ করতে পারে, এই বিজয় তারই সাক্ষী। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ তাই শুধু বাংলাদেশের ইতিহাসে নয়, দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাসেও একটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত। একে রক্ষা করা আমাদের সকলেরই নৈতিক দায়িত্ব। 

Leave your review