ব্যাক্তির আচার আচরন, মনোভাব এবং ব্যাক্তিত্বের প্রতিফলন হলো মার্জিত রুচি সম্পর্ন শৈলী। যে কোন পোশাকেই হোক না কেন, আমার কাছে তা হল ব্যাক্তির আত্ম প্রকাশের রুপ যার মাধ্যমে ব্যাক্তির ব্যাক্তিত্ব এবং নান্দনিক শালিনতাপূর্ন চরিত্রের বহিঃপ্রকাশ ঘটে। পোশাকের মাধ্যমেও কোন ব্যাক্তির নৈতিকতা ফুটে উঠে। তার মানে এই নয় যে আমরা নৈতিকতার পোশাক পড়ছি। সুস্থ মানানসই পোশাক মানুষের আত্মবিশ্বাসের সৌন্দর্যকে বাড়িয়ে তুলে। অনেকেই আছেন অনেক দামী উজ্জল এবং ভিন্ন মাত্রার পোশাক পড়েন, কিন্তু তবু নম্রতা, ভদ্রতা এবং সুকোমল সৌন্দর্যের ছাপ সাড়া চোখে মুখে ধরা পড়ে। প্রতিটি মানুষেরই পোশাক সম্পর্কে সঠিক ধারনা থাকা উচিৎ। পারিপার্শ্বিক পরিবেশ সহ স্বীয় অস্তিত্ব, মেজাজ, মনোভাব কিংবা সৌন্দর্যবোধের সাথে সামন্জস্য রেখেই পোশাক পড়া উচিৎ। কারন সঠিক পোশাক পরিধানের মাধ্যমে ব্যাক্তির ব্যাক্তিত্ব, চরিত্র, শৈলী এবং ব্যাক্তির আসল রুপ প্রকাশ পায়। পোশাকে শালিনতা বলতে কি বুঝায়? এই শালিনতা কিংবা অশালিনতার ব্যাপারটি নির্ভর করে আপনি কাকে জিজ্ঞস করছেন তার উপর। তবে সাধারনভাবে শালীন পোষাক পরা মানে এমন পোষাক পরা যা পরিস্থিতি এবং নির্দিষ্ট পরিবেশের জন্য সন্মানজনক এবং উপযুক্ত। যখন আমরা মানানসই এবং রুচিসন্মত পোশাক পরি তখন আমরা কেবল নিজের এবং আমাদেরই যত্ন নেই না সাথে সাথে আমাদের সংস্কৃতিরও যত্ন নিচ্ছি। আমাদের সংস্কৃতির এবং আমাদের ঐতিহ্যের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে পারি ভালো এবং শালিনতাধর্মী পোশাক পরার মাধ্যমে।
আমরা বসবাস করছি এমন একটি বিশ্বে যেখানে প্রগতি, স্বাধীনতা, স্বাধীকার, ব্যাক্তিত্ববাদ, নৈতিকতা আর গনতান্ত্রিক দার্শনিক চর্চার ছড়াছড়ি। এক ভোগবাদীয় জগতে যেন সবাই মশগুল। আর লন্ডন এই পূঁজিবাদী ভোগবাদী দর্শনের কেন্দ্রবিন্দু। বিলেতে আমরা যারা বসবাস করছি আমাদের বুঝতে হবে যে আমরা বাঙ্গালী। বাংলাদেশ আমাদের মাতৃভূমি। বাংলাদেশের জলবায়ু, মাটির সোঁদাগন্ধ আর ষড়ঋতুর বৈচিত্রময় শ্যামল প্রকৃতি এবং ঘাস-ফড়িং এর মৃদুল ছোঁয়ায় বেড়ে উঠা আমাদের ভৌগলিক অবয়বে, চেতনায়, মননে, ভাবনায় আর ব্যাক্তিত্বে মিশে আছে বাঙ্গলীত্বের ছাপ। আর্য-অনার্য আর দ্রাবিড়ীয় রক্ত বইছে আমাদের শরীরে, শিরা উপশিরায়। যতো ভাবেই নিজকে বদলানোর চেষ্টা করি না কেন, দেশী-বিদেশী নামি-দামী পোশাক আর অলংকারে নিজকে আবৃত করি না কেন, বিশ্বায়নের গড্ডালিকায় নিজকে আধুনিকরন করার চেষ্টা করি না কেন, আমাদের চোখে-মুখে, কথা-বার্তায়, চলনে-বলনে, অঙ্গভঙ্গি আর চাহনীতে বাঙ্গালীত্বের অনিন্দ সুন্দর ছাপ দৃশ্যতঃ। তাকে বদলাবো কি করে? বাঙ্গালীত্বই আমাদের পরিচয়। বাংলার শিল্পকলা, বিশ্বাস, কৃষ্টি সহ সমস্ত ক্রিয়াকলাপ যা আমাদের জীবনের সাথে গেঁথে আছে প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম ধরে, আমাদের সার্বিক সামাজিক জীবনধারা-এই আমাদের সংস্কৃতি। আমাদের শিষ্টাচার, পোষাক, ভাষা, ধর্ম, আচার-ব্যাবহার আর শিল্প সবকিছুই এ সংস্কৃতির অন্তর্ভুক্ত। তবে বিদেশী সংস্কৃতিকে অস্বীকার নয় বরং নানা দেশের সংস্কৃতির ভালো দিকগুলিকে সঠিকভবে গ্রহন করতে পারলেই আমাদের সাংস্কৃতিক জীবন হবে আরো বেগবান এবং সমৃদ্ধ।
ইদানীং একটা ব্যাপার খুব দৃশ্যতঃ যে আমরা কেমন জানি হয়ে যাচ্ছি। শৈলিতা আর অশৈলিতা, সংস্কৃতি আর অপসংস্কৃতি, ভালো আর খারাপের মধ্যে আর কোন তফাৎ খুঁজে পাচ্ছি না। এক অন্যরকম পৃথিবী এবং অন্যরকম তার মানুষগুলো। যতোক্ষন পর্যন্ত না নিজকে সমকালীনের দোঁড়গোড়ায় নিয়ে যেতে পারছি, ততক্ষন পর্যন্ত মনে হচ্ছে আমরা যেন অযোগ্য, অসত্য, অনাধুনিক কিংবা সমাজে বসবাসের অযোগ্য এক ক্লীব। কি দ্রুত সংস্কৃতি আর অপ-সংস্কৃতির রুপ পাল্টাচ্ছ। আমরা যাকে সংস্কৃতি বলি সমাজের কিছু লোক তাকে বলে অপ-সংসকৃতি। ভালো আর মন্দের সংজ্ঞা যেন বদলে যাচ্ছে। অনেক সময় কেমন যেন সবকিছু এলোমেলো মনে হয়। একি সভ্যতায় বন্যতা! নাকি সভ্যতারই আরেক রুপ যা উন্মাদনা আর উন্মত্ততার। সভ্যতার এক নতুন সংজ্ঞা। ইদানীং বিলেতে বাঙ্গালীদের মধ্যেও এই সংস্কৃতি আর অপ-সংস্কৃতির এক দ্বান্দিক সংঘর্ষ দেখতে পাচ্ছি। দিন দিন অপ-সংস্কৃতিই যেন সত্যিকারের সংস্কৃতিতে পরিনত হচ্ছে। পাল্টে যাচ্ছে সামাজিক এবং দেশজ রীতি নিতী। বদলে যাচ্ছে মানুষের আচরিক ধ্যান ধারনা। যেখানে যাই না কেন যেমন ধর্মীয় উৎসব, পূজা-পার্বন কিংবা বাচ্চাদের জন্মদিন, গৃহ প্রবেশের পার্টি বা বিবাহ বার্ষিকীর কোন আয়োজনে সব কিছুতেই যেন স্ব-প্রচারের প্রতিযোগীতা। অনুষ্ঠানটা হয়ে গেছে গৌন। সব কিছুতেই চলে এসেছে এক ধরনের স্থুলতা, বেমানান পরিবেশের উপস্থিতি য অনেকের জন্য এক শ্বাসরুদ্ধ পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। পার্টি মানেই আনন্দের ফোয়ারা। অস্বীকার করছি না। শুধু ভাবছি আনন্দ পাওয়ার উপাদানগুলিকে নিয়ে। যেমন ধরুন শিশু সন্তানের জন্মদিনে যখন উচ্চস্বরে সঙ্গীত বাজানো হয় এবং বড়দের বাহারী নাচের হট্রগোল পড়ে যায় তা ছোট ছোট অতিথিদের জন্য আনন্দদায়ক না হওয়ারই কারন। এই জাতীয় নাচ-গান সম্ভাব্য যে কোন সংঘাত ঘটাতে পারে। তাই শিশুদের জন্মদিনের পার্টিতে উচ্চস্বরে সঙ্গীত এবং অপ্রাসঙ্গিক নাচ সর্বদা সেরা পছন্দগুলির মধ্যে না থাকাটাই সত্যিকরের ব্যাক্তিত্ব এবং শৈলিতার বহিঃপ্রকাশ। এই জাতীয় পার্টিতে যাদের জন্য জন্মদিন পালন করা হয় সেই ছোট বাচ্চারাই আনন্দ উপভোগ করতে পারে না। উপরন্তু, এটি অন্যান্য অতিথিদের জন্যও বিরক্তির কারন হতে পারে যারা এই জাতীয় উদযাপনে আগ্রহী নন কিংবা পছন্দ করেন না। উচ্চস্বরে সঙ্গীত এবং নাচও ছোট বাচ্চাদের জন্য অস্বস্থিকর, অপ্রতিবোধ্য এবং ভীতিকর হতে পারে। বরং বাচ্চাদের পছন্দের সঙ্গীত বাজানো কিংবা ওদেরকে গানের সাথে গান গাওয়া এবং হাততালি দেওয়ার মতো সাধারন ক্রিয়া কলাপে অংশ গ্রহন করতে পারে কিংবা এমন কিছু যেখানে বাচ্চাদের অংশগ্রহন থাকবে বেশীমাত্রায়।
সংস্কৃতি হলো বিশ্বাস, প্রথা, কৃষ্টি এবং ঐতিহ্য যা কোন সমাজ কিংবা গোষ্ঠীর মানুষের মননে এবং চেতনায় ধারন করে। সংস্কৃতি মানুষের ভাবনায়, চলনে-বলনে, ব্যক্তিত্বে প্রস্ফুটিত হয়। আর অপসংস্কৃতি তার উল্টোটা। সংস্কৃতির নেতিবাচক রুপ হলো অপসংস্কৃতি। একটি জাতী বা গোষ্ঠীর চিন্তা, কর্ম, স্বীয় ঐতিহ্য, কৃষ্টি, সভ্যতা এবং সৃষ্টি তার নিজস্ব সংস্কৃতির বাহন। ব্যক্তি জীবনের মানবীয় গুনাবলী ও সুশীল জীবন যাত্রার মধ্য দিয়ে স্বীয় পরিবেশ ও সমাজকে সমৃদ্ধ, সুরুচিসম্পর্ন এবং মানবীয় গুনে বিকশিত করার যে প্রয়াস তার মধ্যে সুপ্ত সংস্কৃতিচেতনা বিদ্যমান। এ জাতীয় চেতনা ব্যাক্তি বা সমাজকে করে নান্দনিক, প্রাজ্ঞ এবং জীবন বিকাশের সহায়ক। আর যা এই মানবীয়গুনের পরিপন্থী যা মানুষকে অসুস্থ চিন্তার আর সুস্থ জীবন বিকাশের অন্তরায় তাই হলো অপসংস্কৃতি। এই অপসংস্কৃতির প্রভাব ব্যাক্তি জীবনে মারাত্মক ক্ষতিকারক। একটি জাতীর সংস্কৃতিই হলো তার প্রানকেন্দ্র। নানা জাতীর কিংবা সমাজের সুস্থ সংস্কৃতির আদান প্রদানের মাধ্যমেই গড়ে উঠে একটি সমৃদ্ধ সংস্কৃতি। যে কোন সমাজের নুন্যতম গুরুত্বপূর্ন দিক হলো তার সংস্কৃতি। তবে কোন কোন ক্ষেত্রে সংখ্যাগরিষ্ট সংস্কৃতির মূল্যবোধ ও রীতিনীতি সংখ্যালঘু সংস্কৃতির মূ্ল্যবোধ ও রীতিনীতির সাথে সাংঘর্ষিক হতে পারে। অপসংস্কৃতির ধারা শিল্প, সঙ্গীত, আচর-ব্যাবহার, সংস্কৃতিক এবং ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদি সহ পোশাক কিংবা ফ্যাশনের মাধ্যমে প্রকাশিত হয়। এই জাতীয় সংস্কৃতির ধারক এবং বাহকরা সবসময়ই মূলধারার সংস্কৃতিকে প্রত্যাক্ষান করে। এই অপ-সংস্কৃতির ধারা মূলতঃ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ষাটের দশকে হিপ্পি আন্দোলনের মাধ্যমে শুরু হয়। এই জাতীয় সংস্কৃতির ধারকরা মূল ধারার সংস্কৃতির পরিবর্তে বিকল্প ধারার জীবন দর্শন ও বিশ্বাসকে গ্রহন করেছিলো। এ জাতীয় সংস্কৃতি আজ অনেক পশ্চিমা দেশেই সার্বিকভাবে বছরের পর বছর ধরে বিকশিত হয়েছে এবং সমাজের একটি বিরাট অংশ এই জাতীয় সংস্কৃতিকে সাদরে গ্রহন করছে বিশেষ করে তরুন সমাজ। নিজকে আধুনিক হিসাবে জাহির করার এ যেন এক নতুন সামাজিক রুপ। আর এ জাতীয় পশ্চিমা সংস্কৃতির ধারা-উপধারাকে আমরা প্রাচ্যের সমাজের অধিকাংশরা চোখ বুঝে গ্রহন এবং প্রয়োগ করছি। আমাদের কাছে প্রাচ্যাতের সভ্যতা মানে সবকিছুই সুন্দর, গনতন্ত্রের সিদ্ধ পুরুষ, জ্ঞন-বিজ্ঞানের উৎগাতা আর সভ্যতার লীলাভূমি। তাই প্রাচ্যাত্যর সবকিছুই গ্রহনযোগ্য। কখনো ভাবনার চেষ্টাও করছিনা যে এই জাতীয় সংস্কৃতির লালন এবং পালন আমাদের জন্য কতোটুক উপযুক্ত। বনেরা বনে সুন্দর আর শিশুরা মাতৃক্রোড়ে এই বিখ্যাত উক্তিটির বিশেষ মর্মার্থ যেন আমরা বেমালুম ভুলে গেছি।
আমর কি সত্যি সত্যি আত্মবিস্মৃত এবং আত্মবিস্মৃতপ্রবন সমাজের একটি অংশ? কি করে আমরা ভুলে যাই আমাদের শেকর, আমাদের অতীত এবং নদী মাতৃকার জল হাওয়ায় বেড়ে উঠা আমাদের আত্মপরিচয়। আধুনিকতার নামে আমরা দিন দিন কেমন জানি হয়ে যাচ্ছি। নিজস্ব যা কিছু আছে তাকে ঠেলে দিয়ে আঁকড়ে ধরছি বিদেশী সংস্কৃতিকে, বিদেশী নানা রঙে যেন আমরা প্রতিনিয়ত রাঙিয়ে যাচ্ছি যা আমাদের সাথে বেমানান। আমরা অন্যরকম মানুষগুলো কখনো উচ্চাভিলাসী, কখনো বা হিনমন্য কিংবা কখনো আবার আত্মপরিচয়ের সংকটে বিভ্রান্ত। বিলেতের মাটিতে বসবাস করে আমরা অনেকেই হয়ে গেছি একেবারে বাংলিশ। একেবার অচল, কোনরকমের বেমনান আধুনিক। আর আমাদের দেশের এই জাতীয় মানুষগুলো হয়ে গেছে সভ্যতার জঠরে বেড়ে উঠা এক উদ্ভট ক্লীব। বাংলার জলবায়ুতে বেড়ে উঠা যেন বিদেশী মুখোশ। না বাঙ্গালী না বিদেশী। স্কুলে পড়াকালীন সময়ে বার্ষিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে পরিবেশিত কবি ও গীতিকার আবু জাফরের লেখা সে বিখ্যাত গানের দুটি লাইন আমাকে এখনো মনে করিয়ে দেয় আমার স্বদেশ এবং শেকড়ের কথা: “এ পদ্মা, এই মেঘনা, এই যমুনা সুরমা নদী তটে, আমার রাখাল মন গান গেয়ে যায়।“ এই গানের মধ্যেই যেন খুঁজে পাই আমার আবেগ, আত্মপরিচয় এবং নদী-নালা, খাল-বিল আর হাওরে বেড়ে উঠা চেতনার এক বিশেষ অনুভব। নানা ভাবে আমরা আমাদের ঐতিহ্য এবং সাংস্কৃতিকে আগামী প্রজন্মের জ্ন্য রেখে যেতে পারি। আমাদের বিশ্বাস, দর্শন, ধ্যান-ধারনা কিংবা সত্যিকারের সংস্কৃতির বাহন হতে পারে আমাদের আচার-ব্যাবহার, পোশাক-পরিচ্ছেদ এবং নিত্য-নৈমত্তিক ক্রিয়া-কর্ম। বাঙ্গালীর আত্মপরিচয়ের সংকট তখনই মোচন হবে যেদিন আমরা বিদেশী অপ-সংস্কৃতির প্রভাব বলয় থেকে মুক্তি পাবো যা আমাদের সমাজচৈতন্যে দৃঢ় ভাবে দীর্ঘ উপনিবেশিক শক্তি, নব্য আধুনিকতা আর বিশ্বয়নের কারনে দৃঢ়ভাবে গেঁথে আছে।