কেন পশ্চিমা উদারনীতি বিপজ্জনক

ইউক্রেনের বর্তমান সংকট নব্য-উদারতাবাদের নীতিগুলিকে বাস্তবে প্রয়োগ করার ফলাফল কতটা বিপর্যয়কর হতে পারে তার একটি চমৎকার দৃষ্টান্ত। যখন একটি জাতি তার অর্থনৈতিক কৌশল হিসাবে নব্য-উদারতাবাদকে (neo-liberalism) অনুসরণ করার সিদ্ধান্ত নেয়, তখন রাষ্ট্রীয় অবকাঠামোর বান্ধবপূর্ন পরিবেশের কারনে বহুজাতিক কর্পোরেশন এবং বিদেশী আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলির দেশে প্রবেশের এবং তার অর্থনীতির নিয়ন্ত্রণ গ্রহণের পথকে প্রসস্থ করে। এই নিবন্ধটিতে বর্তমান ইউক্রেন সংকটের পরিস্থিতিকে দৃষ্টান্ত হিসাবে ব্যবহার করে আলোকপাত করার চেষ্টা করবো যে তথাকথিত পশ্চিমা উদারতাবাদের ধারণাটি অনেক ক্ষেত্রেই একটি বিভ্রম ছাড়া আর কিছুই নয় এবং তা সমাজে ও রাষ্ট্রে বৈষম্য আর অশান্তির মাত্রা বাড়িয়ে দিচ্ছে। কপটতা, নৈরাজ্যতা এবং ভয়ানক দ্বি-মূখী নীতি উদারতার বৈশিষ্ট্যগুলিকে সংজ্ঞায়িত করছে, যা বিশ্ব জুড়ে নানাবিধ সংকটের কারনে এর প্রকৃত রহস্য এবং সত্যিকারের দার্শনিক লক্ষনগুলি উন্মোচিত হচ্ছে সকলের সামনে। যুক্তরাষ্ট্র সহ ন্যাটোভুক্ত পশ্চিমাদেশগুলি বিক্ষোভকারীদের সরাসরি সমর্থন করেছিল যারা ইউক্রেইনের প্রাক্তন প্রসিডেন্ট ভিক্টর ইয়ানুকোভিচের বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছিল, আন্দোলনর নামে কিয়েভের রাস্তায় এবং ময়দান স্কোয়ারে চালিয়েছিলো নিশংস হত্যাযজ্ঞ আর সহিংসতা, গনতান্ত্রীকভাবে নির্বাচিত সরকারের পতন ঘটানো সহজ অগনতান্ত্রীকভাবে তাও আবার উদারতাবাদের ধ্বজাধারী পশ্চিমাদের সরাসরি মদদে। সিরিয়ার সংকটকালীন সময়ে পশ্চিমারা যে উদ্ধত্বপূর্ন আচরন দেখিয়েছিল তা ছিল ভয়ানক। একজোটে বাশার আল-আসাদকে ক্ষমতা থেকে অপসারণের আহ্বান জানিয়েছিল, সমস্ত শক্তি প্রয়োগকরে চেষ্টা করেছিল সরকার পতনের, কিন্তু  শান্তি ও স্থিতিশীলতা আনতে কিছুই করার চেষ্টা করেনি। রাশিয়ার শেষ মুহুর্তে হস্তক্ষেপের কারনে সিরিয়াকে ইরাক আর লিবিয়ার মতো ধ্বংসস্তুপে পরিনত হতে হয়নি। ইউক্রেনের ক্ষেত্রে পশ্চিমারা রাশিয়ার বিরুদ্ধে ঝান্ডা তুলে ধরতে এবং ইউক্রেনের সরকারকে তার উদ্দেশ্য পূরণের জন্য দৃঢ় সমর্থন প্রদানের জন্য বেশী আগ্রহ প্রদর্শন করেছে। এটি সম্ভবত এই কারণে যে পশ্চিমা বিশ্ব সিরিয়ার চেয়ে ইউক্রেনকে বেশি কৌশলগত গুরুত্ব দেয়। ইউক্রেনে পশ্চিমাদের গৃহীত পদক্ষেপের ফলে রাশিয়া এবং পশ্চিমের মধ্যে আস্থা তীব্রভাবে হ্রাস পেয়েছে এবং স্নায়ুযুদ্ধ পুনরায় শুরু হওয়ার সম্ভাবনাকে ত্বরান্বিত করেছে।

 

সর্বজনীন আদর্শের উদার ধারণার ব্যর্থতা এবং বিপর্যয়ের প্রধান কারন হল, দেশজ কৃষ্টি-সংস্কৃতি, সভ্যতা ও ইতিহাসের বৈচিত্র্যের তাৎপর্যকে উপেক্ষা করে নিজস্ব ধারনা এবং দার্শনিক ভাবধারাকে গড্ডালিকা প্রবাহের মতো অন্যের উপর চাপিয়ে দেওয়া। ইউক্রেনের উপর তাদের গণতন্ত্রের মডেল চাপিয়ে দেওয়ার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রচেষ্টার প্রত্যক্ষ ফলস্বরূপ, সেই জাতি বর্তমানে একটি সহিংস গৃহযুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে রয়েছে। পশ্চিমা পন্ডিত এবং রাজনৈতিক নেতাদের মতে, রাশিয়ান ফেডারেশন সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর থেকে যে দেশগুলি একসময় সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশ ছিল তাদের উপর তার আধিপত্য পুনরুদ্ধার করার জন্য সংগ্রাম করে আসছে। এটি একটি ভুল ধারনা, কারণ রাশিয়া ন্যায্যতা এবং সুষম প্রতিযোগীতামূলক ক্ষেত্রের উপর ভিত্তি করে একটি বহুমুখী বিশ্ব তৈরির পক্ষে বেশি বদ্ধপরিকর এবং সেই সাথে নিজস্ব আঞ্চলিক নিরাপত্তার ব্যাপারে খুব সচেতন। এ কারণে অত্র এলাকায় একাধিকবার সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। ইউক্রেনের এই সংকটময় পরিস্থিতি ইউরোপীয় ইউনিয়নের উদারনীতির প্রত্যক্ষ প্রভাবেরই পরিনতি।  ২০১৩ সালের নভেম্বরে, ইউক্রেনের রাষ্ট্রপতি ভিক্টর ইয়ানুকোভিচ রাশিয়ার সাথে বন্ধুত্বপূর্ন সংযোগ গড়ে তোলার পক্ষে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাথে একটি অ্যাসোসিয়েশন চুক্তি স্বাক্ষর করতে অস্বীকার করেছিলেন। এই সিদ্ধান্তই ছিলো বর্তমান সংকটের প্রেক্ষাপট। এই সিদ্ধান্তটি অনেক ইউক্রেনীয়দের ক্ষুব্ধ করেছিল, যারা চুক্তিটিকে তার নিজের জাতির স্বার্থের চেয়ে রাশিয়ার প্রতি ইয়ানুকোভিচের পছন্দের প্রমাণ হিসাবে ব্যাখ্যা করেছিল। পরবর্তীতে তুমুল বিক্ষোভের ফলে অবশেষে ফেব্রুয়ারী ২০১৪ সালে ইয়ানুকোভিচকে উৎখাত করা হয় এবং পশ্চিমা স্বার্থের প্রতি সহানুভূতিশীল একটি নতুন সরকার প্রতিষ্ঠা করা হয়। এই পুরো ব্যাপারটাই ছিলো পশ্চিমাদের মদদপুষ্ট পরিকল্পিত এবং অগনতান্ত্রিক ভাবে সরকার পতনের ষড়যন্ত্র যা পশ্চিমা উচ্চমাত্রার নব্য-উদারনীতিরই ফল।

 

 

২০১৪ সালের মার্চ মাসে ক্রিমিয়ার রাশিয়ান অধিভুক্তি এবং পূর্ব ইউক্রেনের সাথে সশস্ত্র যুদ্ধ ইউক্রেনীয় সমাজের মধ্যে বিদ্যমান গভীর বিভাজনের পাশাপাশি দেশের নতুন নেতৃত্বের অনিশ্চিত মনোভাব ছিল শান্তির প্রতিকুলে, যা পশ্চিমা স্বার্থের সাথে ছিল সংযুক্ত। ইউক্রেনে রাশিয়ার হস্তক্ষেপের কারনে ইউরোপের ভবিষ্যত এবং বিশ্বে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান সম্পর্কে নতুন করে ভাবনার সৃষ্টি হয়েছে। ইউক্রেনের সঙ্কট কেবল পশ্চিমা উদারনীতির ব্যর্থতার উপরই বর্তায়নি বরং একমুখী বিশ্বে বসবাসের বিপদজ্ক অবস্থানকেই জানান দেয়। অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা এবং কূটনৈতিক প্রচেষ্টার সংমিশ্রণ ছিল ইউক্রেনের সংকটে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার ইউরোপীয় মিত্রদের প্রতিক্রিয়া। ক্রিমিয়া এবং পূর্ব ইউক্রেনে রাশিয়ার কার্যকলাপের জন্য রাশিয়াকে কোনঠাসা করে তার অর্থনীতিকে ধ্বংশ করার নিমিত্তে মরিয়া হয়ে উঠে এবং কিয়েভে সরকারের প্রতি দৃঢ় সমর্থন প্রদর্শন করে। শুরু থেকেই, পশ্চিমাদেশগুলির সার্বিক কার্যকারিতা নিয়ে ব্যাপক সংশয় ছিল এবং অনেকের দ্বারাই প্রশ্নবিদ্ধ হয়। নিষেধাজ্ঞাগুলি অকার্যকর হওয়ার জন্য সমালোচিত হয়েছে এবং অনেকেই বিশ্বাস করে যে সদিচ্ছার অভাবে কূটনৈতিক প্রচেষ্টাগুলিও ব্যর্থ হবে। এই নিবন্ধে আমি আলোকপাত করার চেষ্টা করবো যে ইউক্রেনে পশ্চিমাদের উদারপন্থী ব্যবস্থা পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে এবং এই সংকট এইটাই প্রমান করে যে এই ধরণের উদারনীতির ব্যাবস্থা জোর করে চাপিয়ে দেওয়া যায় না, তাতে হিতে বিপরীত হওয়ার সম্ভাবনাই বেশী। । আমি যুক্তি দিয়ে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করবো যে এই ইউক্রেইন সংকট থেকে এটা সহজেই অনুধাবন করা যায় যে একটি ভিন্ন ধরনের আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার প্রয়োজন রয়েছে।

 

শুধ ইউক্রইনের সংকটই নয়। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পরপরই পশ্চিমাদের এই উদারতাবাদ যেন সংক্রমনের মতো মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে বিশ্ববাপী। শান্তি আর স্থিতিশীলতা নয় বরং দেশে দেশে এই উদারতাবাদ নাটকীয় পরিস্থিতি সহ অস্থিতিশীলতা আর বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেছে। ইউকে যখন ইউরোপ থকে বেড়িয়ে আসার জন্য ব্রেক্সিট ভোটের ঘোষনা করে তখনও  ইউরোপের দেশগুলিতে উদারতাবাদে সঙ্কট লক্ষ্য করা যায় তীব্রভাবে। গত তিন দশক ধরে এ সংকটের পূনরাবৃত্তি দেখছি পৃথিবীর নানাদেশে যেমন ২০১৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে উদারতানীতির ধারক হিলারি ক্লিন্টনকে হারিয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্পের জয়, ইউরোপের অনেক দেশেই পপুলিস্ট সরকার নির্বাচন, স্পেনের কাতালান বিদ্রোহ, রাশিয়া, চীন, উত্তর কোরিয়া এবং ইরান সহ অনেক দেশেই উদারনীতির প্রত্যাক্ষান। পশ্চিমা উদারতাবাদের যাঁতাকলে আবার পিষ্ঠ হয়ে ধ্বংশে পরিনত হয়েছে ইরাক, লিবিয়া আর ইয়েমেনের মতো অনেক দেশ। বর্তমান বিশ্ব সংকট এই উদারতাবাদেরই পরিনতি। এখানে এই উদারতাবাদের দার্শনিক বৈশিষ্টগুলি নিয়ে একটু আলোকপাত করা প্রাসঙ্গিক।

 

লিবেরালিজম বা উদারতাবাদ হলো একটি রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক দর্শন যা একজন ব্যক্তির অধিকার, সুযোগের সমতা,স্বতন্ত্র স্বায়ত্বশাসন  এবং স্বাধীনতাকে সমর্থন করে এবং তাকে রক্ষা করার উপর গুরুত্ব আরোপ করে। এই দার্শনিক মতবাদটি অনেক ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধেও প্রয়োগ করা হয়। উদারতাবাদ তত্বটি এই ধারণার উপর প্রতিষ্ঠিত যে, সমাজে প্রতিটি ব্যাক্তিই যুক্তিবাদী এবং নিজের জন্য যে কোন সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম এবং সরকারকে মানুষের জীবনে যতটা ন্যুনতম দরকার ততোটাই হস্তক্ষেপ করা উচিত। বহু শতাব্দী ধরে, উদারতাবাদ পশ্চিমা বিশ্বের প্রধান রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক দর্শন হিসেবে সমাজে বিস্তৃত হয়ে আসছে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই মতাদর্শের প্রসারে বিশেষভাবে প্রভাব রেখেছে। উদারপন্থীরা মনে করে যে এই মতাদর্শটি  প্রতিটি সমাজে সমানভাবে প্রয়োগ করা উচিত। গণতন্ত্রও , যাকে জনগণের জন্য উপযুক্ত এবং ফলপ্রসু শাসন হিসাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়, এই উদারপন্থীদের ধারণ করা আরেকটি রাজনৈতিক দর্শন। এই উদারতাবাদ দর্শনকে বেশী মাত্রায় সমাদৃত করেছেন ইংরেজ দার্শনিক জন লক (১৬২৩-১৭০৪) এবং স্কটিশ অর্থনীতিবিদ এবং চিন্তাবিদ আ্যাডাম স্মিত (১৭২৩-১৭৯০)। জন লকের মতে প্রতিটি মানুষের জন্মগতভাবে স্বতন্ত্র অধিকার রয়েছে। অন্যদিকে আ্যাডাম স্মিত মনে করতেন স্বতন্ত্র ব্যাক্তি স্বাধীনতার কারনে যখন কোন ব্যাক্তির নিজের স্বার্থ অন্বেষনের মাধ্যমে নিজের উন্নতির চেষ্টা করে তখনই সমাজ উন্নতি লাভ করতে পারে। এই জাতীয় অর্থনৈতিক ব্যাবস্থা উৎপাদনের মাধ্যমগুলি এবং প্রতিযোগীতামূলক বাজারের উপর ভিত্তি করেই প্রতিষ্ঠিত। যেখানে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রন থাকবেনা এবং সরকারের কর্তৃত্বকে সীমাবদ্ধ করা হয়। উদারপন্থীরা মনে করেন যে প্রত্যেকে, তাদের বর্ণ, ধর্ম, বা আর্থ-সামাজিক অবস্থান নির্বিশেষে, আইন অনুসারে একই আচরণের যোগ্য। নাগরিক স্বাধীনতা, প্রায়শই মৌলিক অধিকার এবং স্বাধীনতা হিসাবে পরিচিত, এমন কিছু যা উদারপন্থীরা দৃঢ়ভাবে সমর্থন করে এবং বিশ্বাস করে যে প্রত্যেকের অধিগমন থাকা উচিত। উদারতাবাদীরা অর্থনৈতিক উদারতায় বিশ্বাস করে যে অবাধ বাজার এবং অনিয়ন্ত্রিত বাণিজ্য হল অর্থনৈতিক সম্প্রসারণ করার সবচেয়ে কার্যকর উপায়।

 

এই উদারতাবাদই ইউক্রেনের বর্তমান পরিস্থিতির জন্য দায়ী। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর ন্যাটো একে একে পূর্ব ইউরোপের দেশগুলিতে সমপ্রসারন করতে থাকে এবং ইউরোপ এ দেশগুলিকে নিজেদের বলয়ে নিতে সক্ষম হয়। শুধু তাই নয়, যুক্তরাষ্ট্র সহ ন্যাটো এবং ইইর নজর পরে রাশিয়ার পার্শবর্তী দেশ ইউক্রেইনের উপর। উদার গনতন্ত্র আর বাক-স্বাধীনতার পূজারী পশ্চিমের দেশগুলি, বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য হওয়ার জন্য ইউক্রেনের উপর চাপ প্রয়োগ করতে থাকে নিলর্জের মতো। তার ফলাফল আজ আমরা সকলেই দেখতে পাচ্ছি। উদাতারবাদের দিকে ঠেলে দেওয়ার ধাক্কায় ইউক্রেনে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে। দেশের পূর্বাঞ্চলের জনগন, যা সাধারণত রাশিয়ার সমর্থক, তাদের ধারণা যে তাদের এমন একটি জীবনধারা গ্রহণ করতে বাধ্য করা হচ্ছে যা তাদের মূল বিশ্বাস এবং নীতির সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। এর ফলে ইউক্রেনের বর্তমান সংকট দেখা দিয়েছে, যেখানে পূর্বের লোকেরা তাদের নিজস্ব দেশ থাকার অধিকারের জন্য লড়াই করছে, যেখানে তারা তাদের নিজস্ব নীতি অনুসারে জীবনযাপন করতে পারবে এবং পশ্চিমের দ্বারা নিপীড়ন থেকে মুক্ত হতে পারবে।

 

১৯৯০ এর দশকের শুরুতে, সোভিয়েত ইউনিয়নের বিলুপ্তি এবং একটি সার্বভৌম জাতি হিসাবে ইউক্রেন প্রতিষ্ঠার সাথে, অনেক বিশ্লেষক পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে একটি নতুন, আরও উদার শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনার বিষয়ে আশাবাদ ব্যক্ত করেছিলেন। কিন্তু, তিন দশক পরে ইউক্রেনের বর্তমান সঙ্কট থেকে এইটাই প্রতীয়মান হয় যে সেই উদারনীতির দার্শনিক চিন্তাধারার ব্যাপারটি কতটা ভঙ্গুর ছিলো এবং তা যে বিশাল জনগোষ্ঠীর থেকে একেবারে বিচ্ছিন্ন ছিল। উদারপন্থী মতাদর্শের বিরোধিতাকারীরা দাবি করে যে ইউক্রেনের সংকট বৃদ্ধির জন্য পশ্চিমা সরকারের নীতিগুলি দায়ী। তারা দাবি করে যে স্ব-নিয়ন্ত্রণের উদার ধারণাকে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত একটি সরকারকে অপসারণ এবং সেইসাথে রাশিয়ান সামরিক বাহিনীর পরবর্তী হস্তক্ষেপকে বৈধতা দেওয়ার জন্য ব্যবহার করা হয়েছে। বাস্তবতা সত্ত্বেও যে উদারতাবাদ প্রকৃত অনুশীলনে খুব বেশি সফল হয়নি এবং এমনকি নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে দেশগুলির জন্য ক্ষতিকারক হতে পারে। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে উদারতাবাদ দর্শনটি তত্ত্বের ক্ষেত্রে একটি ভাল আদর্শ। কিন্তু তাকে যত্রতত্র জোড় করে চাপিয়ে দিতে গেলেই বিপর্যয় আসবে। তার বেশ কয়েকটি কারন রয়েছে।

 

প্রথমত, উদারতাবাদ যুক্তিবাদী ব্যাক্তি ধারণার উপর প্রতিষ্ঠিত। মানুষ যুক্তিবাদী প্রাণী নয়, তাই এই ধারণাটি ত্রুটিপূর্ণ। যেহেতু আমরা প্রধানতঃ আবেগপ্রবণ প্রানী এবং যৌক্তিকতা হলো গৌন, উদারতাবাদ তাই বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে প্রায়শই খারাপ পরিণতির সৃষ্ট করে। দ্বিতীয়ত, উদারতাবাদ একটি উন্মুক্ত সমাজের ধারণার উপর ভিত্তি করে। এই ধারণাটিও ভ্রান্ত। উন্মুক্ত সমাজ এই ধারণার উপর প্রতিষ্ঠিত যে লোকেরা মৌলিকভাবে শালীন এবং তারা যা সঠিক তা করার জন্য তাদের স্বাধীনতা ব্যবহার করতে পারে। স্বতন্ত্রতা মানুষের জন্মগত অধিকার। তাই সবকিছুতেই প্রতিটি মানুষের নিজস্ব সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার আছে। এই দার্শনিক মতবাদেও ত্রুটি আছে। কারন একদিকে মানুষ সমাজবদ্ধ এবং সমাজের অন্যদের সাথেই বসবাস করতে হয়। তাই ব্যাক্তিগত সিদ্ধান্ত যেন অন্যের ক্ষতি করতে না পারে সে দিকেও নজর রাখতে হবে। অন্যদিকে  এটাই সত্য যে সব মানুষ ভালো নয়, ভালো মন্দ বিচার করার বিবেক,বুদ্ধি বা প্রাজ্ঞতা অনেকের মধ্যেই নেই এবং সমাজের অনেকেই আছেন সুযোগ পেলে তাদের স্বাধীনতাকে নেতিবাচকভাবে ব্যবহার করবে তাতে সন্দেহ নেই। ইউক্রেনের সংকট থেকেই আমরা বুঝতে পারছি যে মুক্ত গণতন্ত্র কতোটুক বিপর্যয় হতে পারে। উপরন্তু, উদারনৈতিকতা ব্যক্তিদের সরকারের কাছ থেকে রক্ষা করে এবং একটি সামাজিক পরিবেশ তৈরি করে যেখানে সরকার জনগণের কাছে দায়বদ্ধ। সাম্প্রতিক বছরগুলিতে, আমরা লক্ষ্য করেছি যে উদারপন্থীরা ব্যক্তিগত অধিকারের প্রতি অত্যধিক মনোযোগী এবং বৃহত্তর কল্যাণের জন্য অপর্যাপ্তভাবে উদ্বিগ্ন। সমালোচকদের মতে, ব্যক্তি অধিকারের উপর এই জোর দেওয়া সামাজিক সংহতির অবনতি এবং সামাজিক সমস্যা বৃদ্ধিতে অবদান রেখেছে।

 

এছাড়াও অনেক ধরনের সমস্যায় আক্রান্ত এ উদারতাবাদের নীতি এবং নানা সময়ে সমালোচিত হচ্ছে উদারপন্থীদের অসাধু অর্থনৈতিক নীতির। সমালোচকরা বিশ্বাস করেন যে এই নীতিগুলির ফলে বিশাল জনসংখ্যাকে পিছনে রেখে সম্পদ এবং ক্ষমতার কেন্দ্রীভূত হয়েছে কয়েকজনের হাতে। কিছু বিশ্লেষক ইউক্রেন সঙ্কটের প্রেক্ষাপটে যুক্তি দিয়েছেন যে, ইউরোপীয় ইউনিয়নের অবাধ অর্থনৈতিক নীতিগুলি এই অঞ্চলের বর্তমান অস্থিতিশীলতার জন্য দায়ী। সমালোচকরা দাবি করেন যে ইইউ-এর উন্মুক্ত-সীমান্ত নীতিগুলি অলিগার্খ এবং অন্যান্য দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের ইউক্রেনের সম্পদ লুট করতে সক্ষম করেছে, যা দেশটির বর্তমান আর্থিক বিপর্যয়ে অবদান রাখছে। উপরন্তু, নিওলিবারাল অর্থনৈতিক পরিবর্তনের উপর ইউরোপীয় ইউনিয়নের জোরাজুরি ব্যাপক দারিদ্র্য এবং সামাজিক বৈষম্যের সৃষ্টি। নভেম্বর ২০১৩ সালে, তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ভিক্টর ইয়ানুকোভিচ ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাথে একটি অ্যাসোসিয়েশন চুক্তিতে স্বাক্ষর করতে অস্বীকার করেছিলেন, যা ইউক্রেনের সঙ্কটের জন্ম দেয়। এর ফলে বিক্ষোভ দেখা দেয়, যা শেষ পর্যন্ত পূর্ণাঙ্গ বিপ্লবে পরিণত হয়। পশ্চিমাপন্থী নতুন সরকার দ্রুত ইউক্রেনকে ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং ন্যাটোর সাথে মিত্রতার আগ্রহ পোষন করায় রাশিয়া অসন্তুষ্ট হয় এবং পরবর্তী ঘটনা দ্রুত বিবর্তিত হতে থাকে যর পরিনতি বর্তমান সংকট। পশ্চিম উদারনীতি যে কতোটুকু ত্রুটিপূর্ন তা ইউক্রেইন সংকট থেকেই অনুধাবন করা যায়। প্রথমত, পশ্চিমারা তাদের স্বার্থ রক্ষার জন্য সামরিক পদক্ষেপ নিতে অনিচ্ছুক। যেহেতু রাশিয়া ক্রিমিয়া দখল করেছে এবং পূর্ব ইউক্রেনে বিচ্ছিন্নতাবাদী বিদ্রোহীদের অর্থায়ন করেছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্ররা অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা ছাড়া সরাসরি রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয় নি। কারন একটি পরাশক্তির বিরুদ্ধ যুদ্ধের পরিনতি হবে ভয়ানক। এমনকি ইউক্রেইনকে ভারী অস্ত্র দিতেও রাজী হয়নি। যুক্তরাষ্ট্রের এই মনোভাব সার্বিয়ার মন্টিনিগ্রো দখলের জন্য ২০০৮ সালের ন্যাটোর প্রতিক্রিয়ার সম্পূর্ণ বিপরীত ছিল। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন টেলিভিশনে সম্প্রচারিত ভাষণে বলেছিলেন যে কসোভোর স্বাধীনতা যদি বৈধ হয়, তাহলে আবখাজিয়া এবং দক্ষিণ ওসেটিয়ার স্বাধীনতাও বৈধ। উদারতাবাদের এই দ্বৈত দার্শনিক পদ্ধতি সত্যিই ভয়ানক এবং ভঙ্গুর।

 

অসংখ্য পন্ডিত ইউক্রেন সংকটের বিষয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের মনোভাবের সমালোচনা করেছেন দৃঢ় ভাবে যেমন নোয়াম চমস্কি, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী জন মারশেইমার, সাবেক যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন। অনেকের মতে ইইউ ইউক্রেনের নিওলিবারেল অর্থনৈতিক সংস্কারকে সমর্থন করার কারনে দেশটিকে গুরুতর দারিদ্র্য, দূর্নীতিগ্রস্থ  এবং সামাজিক অবিচারের দিকে পরিচালিত করছে। ইউক্রেনীয় সংকট পশ্চিমা উদারনৈতিকতা এবং রাশিয়ান রক্ষণশীলতার মধ্যে গভীর মতাদর্শগত ব্যবধানকে তুলে ধরেছে স্বচ্ছভাবে। পশ্চিমারা রাশিয়ার আগ্রাসনের বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান নেওয়া সত্ত্বেও, সমালোচকরা ইইউকে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের প্রচার এবং প্রসারকে ভন্ডামী ও উন্মাদনার সাথে তুলনা করেছেন। পশ্চিমাদের দ্বারা প্রচারিত গণতান্ত্রিক এবং স্বাধীনতাবাদী আদর্শগুলি ইউক্রেনের জনগণের সর্বোত্তম স্বার্থের প্রতিকুলে ছিলনা যেখানে বছরের পর বছর দুর্নীতিগ্রস্ত প্রশাসন ক্ষমতার শিখরে ছিল। উদারতাবাদের সমসাময়িক বৈশিষ্ট্য গুলির কারনে অনেক সমালোচকরা মনে করেন যে উদারতাবাদ সাধারণ কল্যাণের মূল্যে ব্যক্তি স্বাধীনতাকে অত্যধিক মাত্রায় উন্নীত করে। তাদের বক্তব্য হলো উদারতাবাদ ঐতিহ্যগত মূল্যবোধ এবং সামাজিক সংহতিকে দুর্বল করে এবং আত্মকেন্দ্রিক, বস্তুবাদী ভোগবাদকে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করে। নৈতিক অবক্ষয়, সামাজিক অপরাধ, এবং অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা সহ আজ অনেক সমস্যাই সমাজে বিরাজ করছে এবং এই জাতীয় সমস্যার অন্তর্নিহিত উৎস হিসেবে উদারতাবাদকে দেখা হয়। উদারনীতির বিরোধীরা দাবি করেন যে মুক্ত বাজার এবং মানুষ ও ধারণার অবাধ প্রবাহ নৈতিক মূল্যবোধের অবনতি এবং অপরাধ বৃদ্ধিতে অবদান রেখেছে। গত তিন দশক ধরে সেই অস্থিতিশীলতার আলামত আমরা আজ সাড়া বিশ্বে দেখতে পাচছি। এই জাতীয় নব্য-উদারনীতি দার্শনিক মডেল অনেক সমাজের জন্যই উপযুক্ত নয়। একটি ভিন্ন কৌশল বা দার্শনিক তত্বের প্রয়োজন যা হবে স্থানীয় প্রেক্ষাপটের সাথে সামন্জস্যপূর্ন এবং যা ব্যাক্তি কেন্দ্রীক নয় বরং সার্বজনীন ভালোর উপর গুরুত্ব দিবে, ভোগবাদী দর্শনে নয় বরং নান্দনিক আধ্যাত্মিকতা যার ভিত্তি, মুক্ত বাজার নয় বরং একট সুষম অর্থনৈতিক মতবাদের উপর ভিত্তি করে। তা ন হলে এই উদারতাবাদের অশুভ দর্শন একটি পারমানবিক এবং অস্থিতিশীল সমাজ তৈরি করবে যেখানে ব্যক্তিতন্ত্র হবে পুজিত, প্রতিটি মানুষ তার নিজস্ব চাহিদা এবং আকাঙ্ক্ষা নিয়েই সারাক্ষন উদ্বিগ্ন থাকবে যা হবে মানবজাতীর কল্যানের পরিপন্থী।

Leave your review