দনবাস: ইউক্রেনের যুদ্ধের ময়দান

দনবাসের গল্প শুরু হয় দুই হাজার বছর আগে, যখন এলাকাটিতে স্লাভিক উপজাতিরা বসতি স্থাপন করেছিল। অঞ্চলটি তার উর্বর মাটি এবং খনিজ সম্পদের জন্য পরিচিত ছিল, যা সমগ্র ইউরোপ থেকে বসতি স্থাপনকারী এবং ব্যবসায়ীদের আকৃষ্ট করেছিল বিশেষভাবে। দনবাস বহু শতাব্দী ধরে অটোমান সাম্রাজ্যের নিয়ন্ত্রণেও ছিল। উনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে, দনবাস একটি গুরুত্বপূর্ণ এলাকা হয়ে উঠে। ইউক্রেনের দনবাস অঞ্চলটি দেশের পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত এবং এর একটি দীর্ঘ ও জটিল ইতিহাস রয়েছে। বহু শতাব্দী ধরে এই অঞ্চলটি বিভিন্ন সংস্কৃতি ও ধর্মের আবাসস্থল এবং বিভিন্ন সাম্রাজ্য ও দেশের একটি অংশ ছিল। ইউক্রেইনের এই পূর্ব অঞ্চলটিতে বর্তমান সংঘাত ২০১৪ সালে শুরু হয়েছিল, যখন রাশিয়াপন্থী বিচ্ছিন্নতাবাদীরা এই অঞ্চলের কিছু অংশের নিয়ন্ত্রণ দখল করে এবং এলাকাটিকে স্বাধীন দানিয়েস্ক এবং লুহানস্ক গণপ্রজাতন্ত্র ঘোষণা করে। সেই থেকে আজ পর্যন্ত এই সংঘাতের ফলে প্রায় ১২০০০ হাজারেরও  বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে, ১.৫ মিলিয়নেরও বেশি লোক বাস্তুচ্যুত হয়েছে এবং এলাকাটির অনেক গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো ধ্বংস হয়ে গেছে পুরোপুরি। বর্তমান সংকটের কারনেই দনবাস নামটি বিশ্ববাসীর কাছে সবচেয়ে পরচিতি লাভ করে। অথচ সংকটের আগে এই এলাকাটি সম্পর্কে অনেকেই তেমন কিছু জানতেন না। এমন কি আমি দীর্ঘ সাত বছর প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়ের রাজধানী মস্কোতে পড়াশুনার নিমিত্তে বসবাস করার পরও দনবাস সম্পর্কে তেমন কিছু জানতাম না। দানিয়স্ক আর লুহানস্ক হিসেবেই  এই এলাকাটি পরিচিত ছিলো। ২০১৪ সাল থেকে দনবাস হয়ে উঠে ইউক্রেনীয় সরকার এবং রাশিয়াপন্থী বিচ্ছিন্নতাবাদীদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের স্থান-যেন এক প্রজ্বলিত আগুনের শিখা।

 

কেন দনবাসে আজ এতো রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ? কি করে এই সংকটের সৃষ্টি হলো কিংবা কারা এই সংঘাতের জন্য দায়ী? এই জাতীয় নানা প্রশ্ন এসে মাথায় ভর করে। তার কোন সহজ উত্তর নেই। পশ্চিমা বিশ্বের দেশগুলিতে যারা বসবাস করছেন তাদের কাছে মনে হচ্ছে দনবাসের সংকটের জন্য দায়ী রাশিয়া এবং পুতিন। তার বেশ কিছু কারনও আছে। পশ্চিমা জনগনের রাজনৈতিক এবং সামরিক বিষয়ের চিন্তাধারা শক্তিশালী গোটা কয়েক সংবাদ মাধ্যমের অপপ্রচার দ্বাড়া প্রভাবিত বিশেষ করে ব্যাপারটা যখন রাশিয়া বা পশ্চিমাদের শত্রুদের বিরুদ্ধে হয়। যতো বাক স্বাধীনতা বা গনন্ত্রের কথাই বলুক না কেন পশ্চিমারা আসলে গনতন্ত্র বিরোধী এবং নিজেদের গনতান্ত্রীক দর্শন বা মতামতকে অন্য দেশের উপর চাপিয়ে দেওয়ার প্রবল মানষিকতা রয়েছে। অন্যদিকে শান্তি নয় বরং যুদ্ধ আর ধ্বংশের সৃষ্টিই গতো কয়েক দশক ধরে বিশ্বব্যাপী যুক্তরাষ্ট্র সহ ন্যাটোভুক্ত দেশগুলি চালিয়ে যাচ্ছে। আফগানিস্তান, ইরাক, লিবিয়া কিংবা সিরিয়া এই সব যুদ্ধংদেহী মনোভাবেরই ভয়ানক পরিনতি। একের পর এক ধ্বংশ যজ্ঞ চালিয়েছে এ সব দেশগুলিতে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙ্গনের পরও এ পশ্চিমা দেশগুলি থেমে থাকেন। বরং আরো মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে উন্মাদনার তান্ডবতায়। তাই এই লেখায় আলোকপাত করার চেষ্টা করবো যে দনবাসের বর্তমানে সংকটের জন্য যুক্তরাষ্ট্রসহ ন্যাটোভুক্ত পশ্চিমা দেশগুলিই মলতঃ দায়ী। তবে তার আগে দনবাসের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস, সংস্কৃতি এবং ভৌগলিক অবস্থান নিয়ে কিছুটা আলোচনা করার প্রয়াস রইলো।

 

দনবাস হল পূর্ব ইউক্রেনের একটি ঐতিহাসিক এবং ভৌগলিক অঞ্চল। দনবাস অঞ্চলের জনসংখ্যা ৪.৫ মিলিয়নেরও বেশি এবং এই অঞ্চলটি কয়লা খনি, ইস্পাত এবং মেশিন উত্পাদন সহ বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ শিল্পের আবাসস্থল। দানিয়েস্ক এবং লুহানস্ক অঞ্চলগুলি ইউক্রেনের সবচেয়ে ভারী শিল্পোন্নত অঞ্চলগুলির মধ্যে দুটি। এই অঞ্চলটি ইউক্রেনের সবচেয়ে বেশি জনবহুল অঞ্চল। দনবাস অঞ্চলটিতে দেশের বৃহত্তম ইস্পাত উৎপাদক মেটিনভেস্ট গ্রুপের আবাসস্থল। এখানে বিপুল সংখ্যক ভারী এবং প্রতিরক্ষা শিল্প রয়েছে, যা এই অঞ্চলের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার মূল কারণ। এই অঞ্চলটির ইতিহাস একটি দীর্ঘ সংঘাতময়র ইতিহাস। রাশিয়ান সাম্রাজ্য থেকে সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং পরবর্তীতে বর্তমান ইউক্রেনীয় সরকার পর্যন্ত বহু শতাব্দী ধরে অঞ্চলটি বিভিন্ন গোষ্ঠীর দ্বারা যুদ্ধ এবং নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে। ১৮ শতকে দনবাস এবং কৃষ্ণ সাগরের উপকূল রাশিয়ান সাম্রাজ্য দ্বারা তাতার এবং তুর্কিদের কাছ থেকে দখল করা হয়েছিল এবং নভোরোসিয়া (নতুন রাশিয়া) নামে পরিচিত হয়েছিল। ইউরোপীয় উপনিবেশবাদীরা - রাশিয়ান, ইউক্রেনীয়, রোমানিয়ান, সার্ব, গ্রীক - সেখানে বসতি স্থাপন করতে উত্সাহিত হয়েছিল। কিন্তু ১৯ শতকের শেষের দিকে শিল্প বিপ্লবের হাত ধরে, দনবাসে মূলত রাশিয়ান শ্রমিকরা বসতি স্থাপন করে। ১৯১৩ সালের মধ্যে, এই অঞ্চলটি রাশিয়ান কয়লার প্রায় ৯০ শতাংশ উত্পাদন করেছিল।


 
দনবাস ১৯২২ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশ হয়ে ওঠে এবং ইউক্রেনীয় সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের সাথে সংযুক্ত ছিল। ১৯৯১ সালে, যখন সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যায়, তখন দানিয়েস্ক এবং লুহানস্ক একটি স্বাধীন ইউক্রেনের অংশ হয়ে ওঠে। সোভিয়ত ইউনিয়নের প্রথম দিকে ১৯৩০-এর দশকে, জোসেফ স্ট্যালিন এই অঞ্চলে জমি একত্রিত করতে শুরু করেন। এতে করে স্থানীয় কৃষকরা প্রতিরোধ এবং প্রতিবাদে লিপ্ত হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তদানীন্তন সরকারের তোপের মুখে কৃষকদের প্রতিবাদ থেমে যায় এবং প্রতিবাদী কৃষকদের শ্রম শিবিরে পাঠানো হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে এই অঞ্চলটি জার্মানদের দখলে ছিল। যুদ্ধের শেষে যখন সোভিয়েত ইউনিয়ন এই অঞ্চলটি পুনরুদ্ধার করে, তখন সোভিয়েত সরকার রাশিকরণের একটি অভিযান শুরু করে, যার লক্ষ্য ছিল স্থানীয় জনগণকে তাদের প্রাথমিক ভাষা হিসেবে রাশিয়ান ভাষা গ্রহণ করতে হবে এবং তাদের সোভিয়েত ইউনিয়নে একীভূত করতে বাধ্য করা হয়। দানিয়স্ক এবং লুহানস্ককে একত্রিত করা হয়েছিল একটি একক প্রশাসনিক ইউনিট হিসেবে, দানিয়েস্ক ওব্লাস্ট নামে। ওব্লাস্টকে প্রাথমিকভাবে ছয়টি জেলায় বিভক্ত করা হয়, কিন্তু ১৯৫৯ সালে এটি বারোটিতে উন্নীত করা হয়েছিল। আঞ্চলিক রাজধানী ছিল দানিয়েস্ক শহর, আর লুহানস্ক শহরটিকে ওব্লাস্টের গ্রামীণ এলাকার প্রশাসনিক কেন্দ্র হিসেবে কাজ করত। ইউক্রেনের ২৭টি অঞ্চলের মধ্যে দানিয়েস্ক এবং লুহানস্ক ওব্লাস্ট একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান। একসাথে এই অঞ্চলটি ইউক্রেইন ভূখণ্ডের প্রায় ৯ শতাংশ এবং নগরায়িত এলাকা। যুদ্ধের আগে, ইউক্রেনের মোট জনসংখ্যার প্রায় ১৬ শতাংশ এই দুই ওব্লাস্টে বসবাস করতো। একসাথে দনবাস ওব্লাস্টি ইউক্রেনের সমস্ত শহরের প্রায় বিশ শতাংশ ধারণ করে। 

 

দনবাস নামের এই ঐতিহাসিক এবং সাংস্কৃতিক অঞ্চলটি সাম্প্রতিক বছরগুলিতে ইউক্রেনের উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক ও সামরিক সংঘাতের উত্স হয়ে উঠেছে। দনবাসে সংঘাতের সূত্রপাত ১৯৯০ এর দশকের গোড়ার দিকে খুঁজে পাওয়া যায়, যখন অঞ্চলটি ইউক্রেনীয় এবং রাশিয়ান সরকারের মধ্যে উত্তেজনার কেন্দ্রস্থল হয়ে ওঠে। ইউক্রেন রাশিয়ার কক্ষপথ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে একটি সম্পূর্ণ স্বাধীন রাষ্ট্র হতে চেয়েছিল, যা রাশিয়া ইউক্রেনের অবস্থানকে একটি কৌশলগত আঘাত হিসাবে দেখেছিল যা এই অঞ্চলে তার প্রভাবকে হ্রাস করতে পারে। তারপর দুই দশকেরও বেশী কোন ধরনের সমস্যা ছাড়াই দুইটি স্বাধীন রাষ্ট্র আন্ত-রাষ্ট্রীয় সুসম্পর্ক বজায় রেখে আসছিলো। কিন্তু ২০১৪তে এসে সবকিছু যেন থমকে যায়। ইউক্রেইনের আসল রুপটি ধরা পরে রাশিয়ার কাছে। আজ, দনবাস অঞ্চলটি বিপুল সংখ্যক বাস্তুচ্যুত মানুষের আবাসস্থল, সেইসাথে ইউক্রেনের সরকারী বাহিনী এবং রাশিয়ান-সমর্থিত বিচ্ছিন্নতাবাদীদের মধ্যে চলমান সংঘর্ষের স্থান। সোভিয়েত এবং সোভিয়েত-পরবর্তী সময়ে, দনবাসের শহরগুলি মূলতঃ জাতিগত এবং ভাষাগতভাবে রাশিয়ান ছিল। ইউক্রেনের ২০০১ সালের আদমশুমারিতে দেখা গেছে যে জাতিগত ইউক্রেনীয়রা লুহানস্ক ওব্লাস্টের জনসংখ্যার ৫৪ শতাংশ এবং দানিয়েস্ক ওব্লাস্টের ৫৬.৯ শতাংশ; জাতিগত রাশিয়ানরা যথাক্রমে ৩৯ শতাংশ এবং ৩৮.২ শতাংশ। এটি ক্রিমিয়ার পরে ইউক্রেনের সবচেয়ে জাতিগতভাবে রাশিয়ান অঞ্চলে পরিণত হয়েছে। দানিয়েস্কে, রাশিয়ান ছিল প্রায় ৭৫ শতাংশ অধিবাসীদের প্রধান ভাষা; লুহানস্কে, এই সংখ্যা ছিল ৬৮.৯ শতাংশ। ২০০৪ এবং ২০১০ সালের নির্বাচনে, রাশিয়াপন্থী প্রার্থী ভিক্টর ইয়ানুকোভিচ (একজন স্থানীয় দানিয়েস্ক বাসী) দনবাসে বিপুল ভোটের ব্যাবধানে জয় লাভ করেছিলেন; তিনি ২০১০ থেকে ২০৪ সালে ইউরোমাইডান সংকট পর্যন্ত রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন।

 

পূর্ব ইউক্রেনে বা দনবাস অঞ্চলে সশস্ত্র যে সংঘাত ২০১৪ সালে শুরু হয়েছিল সেই সংঘাতে ২০২২সাল পর্যন্ত ১৪০০০ বেশী মানুষের মৃত্যু হয়েছে এবং এখনো প্রতিদিন মারা যাচ্ছে। আট বছর ধরে, ইউক্রেনের সরকারী বাহিনী রাশিয়ান-সমর্থিত বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সাথে লড়াই করেছে দানিয়েস্ক এবং লুহানস্কের দুটি ভারী শিল্পোন্নত অঞ্চলে। ২০১৪-২০১৫ সালে ভয়ঙ্কর যুদ্ধ বেঁধেছিলো এবং বিদ্রোহীরা এই অঞ্চলের এক তৃতীয়াংশ দখলকরে নেয় । যুদ্ধ চলাকালিন সময়েই সেপ্টেম্বর ২০১৪ এবং ফেব্রুয়ারী ২০১৫ এর মধ্যে, রাশিয়া, ইউক্রেন, ফ্রান্স এবং জার্মানি তথাকথিত মিনস্ক চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছিল, যা অবশেষে যুদ্ধ উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস করে। কিন্তু চুক্তিগুলি কখনই সফলভাবে বাস্তবায়িত হয়নিযার ফলে সংঘর্ষ চলতেই থাকে। আর যুদ্ধকে প্রলম্বিত করার জন্য যুক্তরাষ্ট্র সন পশ্চিমা দেশগুলি অর্থনৈতিক এবং সামরিক সাহায্য দিয়ে যাচ্ছিল। এই ভয়াবহযুদ্ধের কারনে এলাকার অর্থনীতি এবং ভারী শিল্প একেবারেই ধ্বংসের মুখে, লক্ষ লক্ষ লোক হয়েছে বাস্তুহারা এবং বিরোধপূর্ণ অঞ্চলটিকে বিশ্বের সবচেয়ে খনি-দূষিত এলাকায় পরিণত করেছে। সংকটটি নভেম্বর ২০১৩ সালে একটি অভ্যন্তরীণ ইউক্রেনীয় সংকট হিসাবে শুরু হয়েছিল, যখন রাষ্ট্রপতি ভিক্টর ইয়ানুকোভিচ ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাথে বৃহত্তর একীকরণের জন্য একটি চুক্তি প্রত্যাখ্যান করেছিলেন, গণ বিক্ষোভের জন্ম দেয় ত্বরিৎগতিতে এবং এই সংকটকে আরো ঘনীভূত করা হয় যখন যুক্তরাষ্ট্র সহ পশ্চিমাদেশগুলি সরাসরি সমর্থন জানায় সরকার বিরোধী বিক্ষোভকারীদের যা পরবর্তিতে হিংসাত্মক এবং সাংঘর্ষিক হয়ে পড়ে। পশ্চিমাদের সরাসরি মদদে শেষ পর্যন্ত প্রসিডেন্ট ইয়ানুকোভিচকে ক্ষমতাচুৎত করা হয়। এই পরিস্থিতিতে রাশিয়া চুপকরেথাকতে পারেনি। রাশিয়া সংকটে ইয়ানুকোভিচকে সমর্থন করেছিল। রাশিয়ার হস্তক্ষেপে শেষ পর্যন্ত ক্রিমিয়ার জনগন গনভোটে রাশিয়ার সাথে যুক্ত হওয়ার জন্য ভোট দেয় এবং রাশিয়ার সাথে যুক্ত হয়। সাথে সাথে হুকারে গর্জে উঠে যুক্তরাষ্ট্র সহ পশ্চিমা বিশ্ব।

 

ঐতিহাসিকভাবে, ক্রিমিয়া সবসময়ই কি রাশিয়ার অংশ ছিলো, সেই নিয়ে দ্বিধার কোন অবকাশ নেই। বেশিরভাগ ক্রিমিয়ান জাতিগতভাবে রাশিয়ান, ইউক্রেনীয় নয়। যদিও ক্রিমিয়া কয়েক শতাব্দী ধরে আঞ্চলিক শক্তিগুলির মধ্যে হাত পরিবর্তন করে চলেছে, গত ২০০-এর বেশি বছর ধরে এটি রাশিয়ার অংশ ছিল। সাড়া বিশ্ব প্রায়শই এটিকে ঐতিহাসিকভাবে রাশিয়ান হিসাবেও দেখে।  সংকট শুরু হওয়ার পর থেকে ক্রিমিয়ানরা রাশিয়ায় পুনরায় যোগদানের আহ্বান জানিয়ে মস্কোপন্থী সমাবেশ করছে। ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে, একটি জরিপে দেখা গেছে যে ৪১ শতাংশ ক্রিমিয়ানরা এই অঞ্চলটিকে রাশিয়ার অংশ হতে চায়। রাশিয়ার জন্য ইউক্রেন ছেড়ে যাওয়ার বিষয়ে ক্রিমিয়ার মার্চের গণভোট দৃশ্যত ৯৭ শতাংশ সমর্থন অর্জন করেছিল। এই সবকিছুর জন্যই মূলতঃ দায়ী পশ্চিমা মদদপুষ্ঠ "ইউরোময়দান" এর সরকার বিরোধী বিক্ষোভ। সমস্ত ইউক্রেনীয়রা বিক্ষোভ বা তাদের এজেন্ডাকে সমর্থন করেনি; অনেকেই রাশিয়ার বেলআউট চেয়েছিলেন এবং ইয়ানুকোভিচকে থাকতে চেয়েছিলেন। ইউরোময়দানের সাথে সরাসরি সংপৃক্ত ছিলো বেশ কয়েকটি অতি-ডান এবং হিংস্র জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠীও।  দীর্ঘ দিনেও ইউক্রেনীয়রা তার রাশিয়া-মুখী পূর্ব এবং ইউরোপ-পন্থী পশ্চিমের মধ্যে জাতীয় পরিচয় সংকটের সমাধান করতে পারেনি যা ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে স্বাধীনতার মাধ্যমে উদ্ভূত হয়েছিল। বর্তমান সঙ্কটটি বিভিন্নভাবে, তাদের দেশের পরিচয় সম্পর্কে সেই অভ্যন্তরীণ এবং বাহ্যিক বিবাদের একটি সম্প্রসারণ এবং সম্ভবত চূড়ান্ত পরিণতি। এটি অধিকাংশ রাশিয়ানদের বিশ্বাসেরও চূড়ান্ত পরিণতি যে পূর্ব ইউক্রেন আসলে একটি পৃথক অঞ্চল নয়, বরং যথাযথভাবে রাশিয়ারই একটি অংশ। ইউক্রেনের পূর্ব এবং পশ্চিমে এত মৌলিকভাবে মতানৈক্য যে তারা কি ধরনের দেশ রাখতে চায় তা নিয়ে, একটি বড় অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক দ্বন্দ রয়েছে। উদাহরণ স্বরূপ, ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাণিজ্য চুক্তি যা এই সমস্ত কিছুর জন্ম দিয়েছিল তার প্রতি প্রায় ৪৩ শতাংশ ইউক্রেইন জনগনের সমর্থন ছিল, আর অন্যদিকে ৩১ শতাংশ ইউক্রেনীয় রাশিয়ার নেতৃত্বাধীন কাস্টমস ইউনিয়নের সাথে একটি বাণিজ্য চুক্তির প্রতি সমর্থন দিয়েছিল। ইয়ানুকোভিচ যখন ইইউ চুক্তি প্রত্যাখ্যান করেছিলেন, তখন অনেক পশ্চিম ইউক্রেনীয়রা এটিকে বিশ্বাসঘাতকতা হিসাবে দেখেছিল এবং বিক্ষোভকারীদের সমর্থন করেছিল।

 

ইউক্রেন, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী লিওনিড পেইসাখিনের মতে, "একটি রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষার সুসংগত জাতীয় ইউনিটি ইঊক্রেইনে কখনোই  ছিল না এবং এখনও নেই।" যদিও ইয়ানুকোভিচকে বিক্ষোভকারীদের দ্বারা ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল কিন্তু এটি জাতীগত গভীর পরিচয় সংকটের সমাধান করতে পারেনি। এটি যা করেছে তা হল একটি রাশিয়াপন্থী, পূর্ব-ভিত্তিক রাজনৈতিক দল থেকে ইউরোপ-পন্থী, পশ্চিম-ভিত্তিক রাজনৈতিক দলে ক্ষমতা হস্তান্তর। এর ফলে  ক্রিমিয়া সহ দেশের পূর্ব এবং দক্ষিণে রাশিয়াপন্থী ইউক্রেনীয়দের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি হয়েছিল এবং রাশিয়ানপন্থী বিক্ষোভকারীরা নতুন সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ ঘোষনা করে। ক্রেমলিন নিঃশব্দে সেই বিক্ষোভকে সমর্থন করেছিল। যা পরবর্তীতে ক্রিমিয়র সংযুক্তি সহ পূর্ব ইউক্রেনে, রাশিয়াপন্থী বিচ্ছিন্নতাবাদী এবং ইউক্রেনীয় নিরাপত্তা বাহিনীর মধ্যে চলমান লড়াইয়ের দিকে পরিচালিত করে।

 

এই সব কিছুর জন্য আসলে দায়ী কে? রাশিয়া, ইউক্রেইন নাকি যুক্তরাষ্ট্র সহ পশ্চিমা বিশ্বর দেশগুলি? এই প্রশ্নটি আজ কতোটু প্রসঙ্গিক তা জানি না। তবে এটা সবার কাছে পরিস্কার গনতন্ত্র, বাক-স্বাধীনতা আর আঞ্চলিক অখন্ডতার দোহাই দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইইউ ময়দান বিক্ষোভকে সমর্থন করে একটি হিংসাত্মক বিপ্লবে রুপান্তরিত করে গনতান্ত্রিক ভাবে নির্বাচিত সরকারকে সরিয়ে দেয়াটা ছিলো অগনতান্ত্রীক এবং অনৈতিক। তাছাড়া ন্যাটোর পূর্ব ইউরোপে সম্প্রসারন সহ রাশিয়ার পাশের দেশ ইউক্রেইকে ন্যাটোভুক্তি করে আঞ্চলিক শান্তি নষ্ট করার পরিকল্পনা ছিলো উদ্যেশ্য প্রনোদিত এবং ভয়ানক।  তা ছাড়াও এই সংকট সমাধানে কোন চেষ্টা না করে  রাশিয়ার বিরুদ্ধে এক তরফা পশ্চিমাদের বিধ্বংশী নিশেধাজ্ঞা সহ ইউক্রেইকে অর্থনৈতীক, সামরিক এবং রাজনৈতিকভাবে সার্বিক সহযোগীতা বিশ্ব সম্প্রীতি, শান্তি এবং নিরাপত্তার জন্য হুমকি স্বরুপ। সারা বিশ্বে আজ অর্থনৈতিক মন্দায় ত্রাহী ত্রাহী অবস্থা। সংঘর্ষ এগিয়ে চলছে ইউক্রেইন সহ পুরো দনবাসে। দনবাস যেন আজ ইউরোপীয়ান ট্র্যাজিডির এক ভয়ানক রনক্ষেত্র।

Leave your review