নিউ ইয়র্ককে বলা হয় চতুর্থ বাংলাদেশ। অসংখ্য বাংলাদেশীদের আনাগোনা আর বাংঙ্গালীর কৃষ্টি সংস্কৃতি আর খাদ্য-রসনার বাঙ্গালীপনার এক অপূর্ব মেজাজের বাংলাদেশকে যেন খোঁজে পাওয়া যায় ঢাকা থেকে প্রায় তের হাজার কিলোমিটর দূরের উত্তর-পূর্ব মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই শহরটিতে যা সুউচ্চ নায়াগ্রা জলপ্রপাতের জন্য পরিচিত। এই নিউ ইয়র্ক সিটির প্রানকেন্দ্র ম্যানহাটনে রয়েছে এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিং, টাইমস স্কয়ার এবং সেন্ট্রাল পার্কের মতো দৃষ্টি নন্দন জায়গাগুলো। ব্রুকলিন ব্রিজ ম্যানহাটনকে ব্রুকলিনের বরোর সাথে সংযুক্ত করেছে। নিউইয়র্ক হারবারে দাঁড়িয়ে আছে আইকনিক স্ট্যাচু অফ লিবার্টি। পূর্বে, লং আইল্যান্ডে সমুদ্র সৈকত, রিজি হ্যাম্পটন এবং ফায়ার আইল্যান্ড। নিউইয়র্ক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে জনবহুল শহর। কারও কারও কাছে এটি 'দ্য বিগ অ্যাপেল' বা 'শহর যা কখনও ঘুমায় না' নামে পরিচিত। জাতিসংঘের সদর দপ্তরের আবাসস্থল, নিউইয়র্ক আন্তর্জাতিক কূটনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। ম্যানহাটনের সুউচ্চ অট্টালিকা আর চোখ ধাঁধানো নানা রঙ্গে সজ্জিত সুদৃশ্য নামী-দামী বিপনী-বিতান আর মুগ্ধকর জনপদ যেমন অনেক দিক থেকে এটিকে একটি আনন্দের শহরে রুপান্তরিত করে, এবং অনেকের জন্য আত্মবিশ্বাসের বহিঃপ্রকাশ ঘটায়, ঠিক তেমনি অন্য দিকে নগরবাসীর অনেকের জন্য সৃষ্টি করছে প্রকৃত অবহেলা এবং বঞ্চনার গ্লানি। এটি একটি বৈপরীত্যের শহর, যেখানে লোকেরা গ্র্যান্ড সেন্ট্রাল স্টেশনের ঐশ্বর্য আর নিছক চকচকে পরিবেশ দেখে বিস্মিত হয়, অপর দিকে নিউ ইয়র্ক সাবওয়ের জরাজীর্ণ প্রকৃতি আর অনেক পথচারীর মানষিক ব্যাধির বহিঃপ্রকাশ দেখে হতবাক হয়।
পিউ রিসার্সের তথ্যানুসারে ২০১৯ সালে আমেরিকায় বংলাদেশীদের সংখ্যা প্রায় দুই লক্ষ্য দশ হাজার এবং তার মধ্য লক্ষাধিক বাংলাদেশী সম্প্রদায়ের আবাসস্থল হলো নিউ ইয়র্ক। বেশিরভাগ বাংলাদেশীরাই কুইন্স এবং ব্রুকলিনের বরোতে বসবাস করে। সবচেয়ে বড় বাংলাদেশিদের সমাগম কুইন্সের জ্যাকসন হাইটসের ৭৩ তম স্ট্রিটটিতে। সেইসাথে কুইন্সের হিলসাইড এভিনিউতে এবং পার্কচেস্টার, ব্রঙ্কসেও রয়েছে অনেক বাংলাদেশীদের বসবাস। ভারতীয়দের পাশাপাশি, বাংলাদেশিরাও ব্রুকলিন এবং কুইন্সে অনেক রেস্তোরাঁর মালিক। সম্প্রতি জ্যাকসন হাইটসে এসেছিলাম আমার শ্রদ্ধাভাজন সোভিয়েত ফেরৎ কয়েকজন বন্ধুর সাথে দেখা করার জন্য। রুজভেল্ট সাবওয়ে থেকে বেড় হওয়ার সাথে সাথেই শুনতে পেলাম বাংলায় মাইকিং এর আওয়াজ। চোখে পড়লো দুইকোটি মানুষের পরিবেষ্টিত কোলাহলপূর্ণ এবং বিশৃঙ্খল শব্দ আর শক্তির বুদবুদের নগরী ঢাকার মতো এক উচ্ছৃঙ্খল পরিস্থতির নমুনা। এ যেন সুদুর নিউ ইয়র্কে এক মিনি পুরাতন ঢাকা। এক লহমায় সাড়া ইন্দ্রিয়ে এক প্রশান্তির পুলক অনুভব করলাম। কিছুক্ষনের জন্যে হারিয়ে গেলাম বাংলার কোন এক অজ পাড়াগাঁয়ে যার মাটির সেঁদো গন্ধ আর শিতের তুহিনে ভেঁজা দূর্বাঘাসের মৃদু সমীরন আমার সাড়া গায়ে আজো দোল খেয়ে যায়। বারবার যেন জানান দিয়ে যায় তোমার চোখে মুখে লেগে আছে বাঙ্গালীত্বের ছোঁয়া, তোমার কন্ঠে বেঁধে আছে বাংলার স্বরবর্ন, চিন্তায় চেতনায় আর মননে গেঁথে আছে বাংলার অবয়ব যেখানে বঙ্গালী খুঁজে পায় সাড়া পৃথিবীর সুখ।
সত্যিই তাই। বাঙ্গালী পোষাকে বিশেষ করে পায়জামা, পাঞ্জাবি, শাড়ী এবং শালওয়ার কামিজের মতো ঐতিহ্যবাহী পোশাকে রাস্তায় বাংলাভাষী 'দেশি' নারী-পুরুষের ঘোরাফেরা আর পুরাতন ঢাকার মতো রাস্তাঘাটে বাংলাদেশী মালিকানাধীন রেস্তোরাঁ এবং মুদি দোকানে আপনার পছন্দের 'দেশি' শাকসবজি, হালাল মাংস এবং শিঙ্গাড়া, ফুচকা, প্রিয় ডালপুরি থেকে শুরু করে নানা জাতীয় দেশী খাবার দেখলে বাঙ্গালীর প্রান ভরে যাওয়াই স্বাভাবিক। আর সময়টা যদি রমজানের মাস হয় তা হলেতো কথাই নেই। ঠিক ঢাকার মতোই মনে হচ্ছিলো ইফতারের সময়টা। দেশে যখন ছিলাম কিংবা পরবর্তিতে যখন মস্কোতে চলে আসি উচ্চ শিক্ষার জন্য তখন মুসলিম বন্ধুদের সাথে কতোনা ইফতার করেছি এক সাথে। জ্যাকসন হাইটসের বাংলাদেশ প্লাজার ঠিক উল্টোদিকে বাংলাদেশী মালিকানাধীন এক রেষ্টুরেন্টেই ইফতারের আয়োজন করা হয়েছিলো। ইফতারের কতো রকমের ভোজন প্রিয়াসু বাঙ্গালীর মুখরোচক খাবার। পিয়াজু, বেগুনি, জিলাপি, বুন্দিয়া, পাকোড়া, খিচুরী,চপ, কাটলেট, মুড়ি, হালিম, খেজুর, সমোসা, ডাল পুরি, ছোলা, মুগলাই পরাঠা, কাচ্চি বিরিয়ানি, তেহারি, এবং ভাত-মাছ-ভর্তা, পিঠা, দই, ফালুদা সহ নানা ধরনের ঐতিহ্যবাহী বাঙালি মিষ্টি এবং বিভিন্ন ধরণের ফল এবং ফলের জুস, এ যেন পিছনে ফেলে আসা বাংলার একটি তাৎক্ষণিক অনুস্মারক নিউ ইয়র্কের জ্যামাকার জ্যাকসন হাইটসে।
আমাদের সাথে আরো ছিলো শ্রদ্ধেয় নাজিম ভাই। পুরো নাম নাজিম চৌধুরী, যিনি ১৯৭৪ সালে সোভিয়ত ইউনিয়নের আস্ত্রাখানে ইন্জিনিয়ারিং পড়তে যান। বর্তমানে দীর্ঘদিন যাবৎ নিউ ইয়র্কে বসবাস করছেন। বিল্লু ভাই পড়াশোনা করেন মস্কোর বিখ্যাত প্যাট্রিস লুমুম্বা ইউনিভার্সিটি থেকে। যেখানে আমিও পড়াশুনা করি। আর আমাদের আড্ডার মধ্যমনি এবং ইফতার পার্টির আয়োজক প্রিয় শ্রদ্ধাভাজন লুৎফর সরকার। অত্যন্ত বিনয়ী, ধীশক্তি এবং বিজ্ঞত্বের অধিকারী। ১৯৭৩ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নে পড়াশুনা করতে যান। বেলারুশের পিনস্ক শহরে। পিনস্ক শহরটি বেলারুশের ব্রেস্ট অঞ্চলে পিনা নদী এবং প্রিপিয়াত নদীর সঙ্গমস্থলে অবস্থিত। ইলেকট্রিক্যাল ইন্জিনিয়ারিং নিয়ে পড়াশুনা শেষ করে চলে যান ইরাকে। কাজ করেন ইলেক্ট্রোম্যাকানিকেল প্রজেক্ট ইনচার্জ হিসেবে ইরাকের হাদিদাতে। কয়েক বছর কাজ করার পর আবার চলে আসেন বেলারুশের রাজধানী মিনস্ক শহরে ইলেক্ট্রিক্যাল সিষ্টেম এন্ড নেটওয়ার্ক নিয়ে উচ্চতর ডিগ্রী নিতে। আমার সহধর্মিনী বন্যাও ছিলো আমাদের সাথে। সেও পড়াশুনা করে সোভিয়েত ইউনিয়নে, প্রথমে রুস্তভ শহরে এবং পরে মস্কোতে। মেন্ডেলিভ ইউনিভার্সিটি অব ক্যামিকেল ইন্জিনিয়ারিং থেকে ক্যামিকেল ইন্জনিয়ারিং নিয়ে পড়াশুনা করে। সোভিয়ত ইউনিয়নের স্মৃতি চারন করতে আমাদের খুবই ভলো লাগে। নষ্টালজিয়ায় আমরা সকলেই সুখী বোধ করি, উচ্চ আত্মসম্মানবোধ করি, মনে হয় যেন প্রিয়জনের খুব কাছাকাছি আছি এবং বেঁচে থাকার মধ্যে প্রকৃত আনন্দ আর অর্থ অনুভব করি। নানা বিষয়েই আলোচনা হলো। তবে ইউক্রেইনের সংকট প্রসঙ্গটাই বেশী প্রাধান্য পেয়েছে। ধর্ম এবং মানবিকতার ব্যাপারটিও বাদ যায়নি। তবে আজকের এই লেখায় ধর্মীয় চেতনা নিয়েই কিছুটা আলকপাত করবো। কারন সোভিয়েত দেশে থাকা কালিন সময়ে আমরা কেউ কখনো ধর্মীয় সংকটে পড়িনি। ধর্মীয় চেতনা ছিলো মানবিকতার বৈশিষ্ট এবং সম্পূরক। আজ দীর্ঘদিন পর ইফতার করতে এসে বার বারই মনে হচ্ছিলো সত্যিকারের ধর্মীয় প্রজ্ঞা এবং চর্চা মানুষকে সত্যিকার অর্থে মানবিক করে তুলে।
পিউ রিসার্সের এক গবেষনার সূত্রমতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সক্রিয়ভাবে ধার্মীক প্রাপ্তবয়স্কদের এক-তৃতীয়াংশেরও বেশি নিজেদেরকে খুব সুখী বলে বর্ণনা করেছেন। মোট বারটি দেশের জরিপের তথ্য বিশ্লেষণ করে গবেষনায় দেখা যায় যারা সত্যিকার অর্থে ধর্মীয় কর্মকান্ডে সক্রিয় তারা অধার্মিক বা অসংলগ্নদের তুলনায় বেশি সুখী। বিশেষকরে সামাজিক সম্পর্কন্নয়নে বেশী মাত্রায় সম্পৃক্ততা, স্বাস্থ্য সম্পর্কে অধিক সচেতনতা, অন্যের প্রতি শ্রদ্ধা, বেশী মাত্রায় মানবিক গুনাবলী সহ সর্বদা সুখ ও শান্তি অনুভব করে। কিন্তু যারা ধর্মীয়ভাবে নিষ্ক্রিয় বা কোন ধর্মীয় অনুষঙ্গ নেই তাদের চেয়ে ধর্মীয়ভাবে সক্রিয় লোকেরা কি ভালো? এই প্রশ্নের সঠিক উত্তর খোঁজে পাওয়ার জন্য, গবেষকরা জরিপ গ্রহণকারীদের তিনটি বিভাগে বিভক্ত করেছেন: "সক্রিয়ভাবে ধার্মিক", যারা একটি ধর্মের সাথে পরিচিত এবং নিয়মিত ধর্মীয় উপাসনালয়ে উপস্থিত হন, "নিষ্ক্রিয়ভাবে ধার্মিক", যারা একটি ধর্মের সাথে পরিচিত কিন্তু ধর্মীয় উপসনালয়ে কদাচিৎ উপস্থিত হন; বা আচরিক ব্যবস্থাগুলি সবসময় প্রয়োগ করেন না এবং প্রয়োগ করলেও অসংলগ্ন , আর তৃতীয় ধারাটি হলো যারা কোন ধর্মের সাথে সংপৃক্ত নন। জরিপে দেখা যায় প্রথম ধারার ব্যাক্তিরা বেশী পরিমান সুখ অনুভব করেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সংবিধানের প্রথম সংশোধনী অনুসারে যুক্তরাষ্ট্রে প্রত্যেকেরই তার নিজের ধর্ম পালন করার অধিকার আছে। মার্কিন সংবিধানের প্রথম সংশোধনটি গৃহীত হয়েছিলো ১৫ই ডিসেম্বর ১৭৯১ সালে। এই সংবিধানের মাধ্যমে গির্জা এবং রাজ্যের মধ্যে পৃথকীকরণ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিলো, একজন ব্যক্তির ধর্মীয় বিশ্বাস বা অনুশীলনে হস্তক্ষেপ করা থেকেও নিষিদ্ধ করা হয়।
নিউ ইয়র্কের জ্যাকসন হাইটসের “লিটল বাংলাদেশের” এক বাংলাদেশী রেষ্টুরেন্টে ইফতার শেষে যখন কথা হচ্ছিলো ধর্মীয় আর অসাম্প্রদায়িক চেতনা নিয়ে তখন বিজ্ঞানের শিক্ষক হৃদয় মন্ডলকে খুব মনে পড়লো। বাংলার মাটি, জল, বাতাস আর ষড় ঋতুর স্বকীয় বৈশিষ্ট্যেই আমরা বেড়ে উঠেছি, আযানের ধ্বনী আর সন্ধ্যায় মঙ্গল কীর্তনের শঙ্খের আওয়াজে শ্রাবস্তীর মতো আনন্দে পুলকিত হয়েছি। এইতো অসাম্প্রদায়িক চেতনার বাংলাদেশ, যেখানে শুয়ে আছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সৈয়দ মুজতবা আলী, কাজী নজরুল ইসলাম, কবি জসিম উদ্দীন, জীবননন্দ দাস, লালন শাহ, বঙ্গবন্ধু শেখমুজিবুর রহমান, আমার পিতা, পিতামহ, প্রপিতামহ কি নিবির প্রশান্তিতে চির নিদ্রায়। হৃদয় মন্ডলের বিরুদ্ধে এই নব্য ষড়যন্ত্র আমাদের সবাইকে ভাবিয়ে তুলে। আমাদের সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নতি তখনই স্বার্থক হবে যখন বাংলার সব মানুষ বসবাস করবে এক সাথে সুখে শান্তিতে, যখন আর ভাবতে হবেনা আমাদের ধর্মীয় চেতনায় কোন অনাকাংঙ্খিত আঘাত আসতে পারে। জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের চিন্তায় চেতনায় এই আদর্শকেই ধারন এবং লালন করেছিলেন-যার মূল ভিত্তি একটি সুখী সমৃদ্ধ বাংলাদেশ যার সাংবিধানিক দর্শন চারটি মূলনীতির উপর প্রজ্বলিত এবং গৌরবান্বিত:জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষতা। সত্যিকারের ধর্মীয় চেতনায় মানব জীবন হয় প্রশস্থ, নৈতিক, এবং সকলের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। ধর্মীয় বিশ্বাস এবং অনুশীলন ব্যক্তিগত নৈতিক মানদণ্ড এবং সঠিক নৈতিক বিচার গঠনে যথেষ্ট অবদান রাখে। আর তার জন্য প্রয়োজন একটি সার্বজনীন নৈতিক শিক্ষা কাঠামো যা শিক্ষার প্রতিটি স্তরে প্রয়োগ করা যায় এবং তার জন্য প্রয়োজন আমাদের সকলের সামাজিক দ্বায়বদ্ধতার উপলদ্ধি। তবে তার উদ্যোগটা সরকারকেই নিতে হবে।