পৃথিবীর শন্তিকামী মানুষ কখনো যুদ্ধ চায় না। কারন যুদ্ধের ফল ধ্বংশাত্বক এবং বিয়োগান্ত্বক। গত শতাব্দীতে অনেক ভয়াবহ যুদ্ধের বিভীষিকায় কোটি কোটি মানুষ প্রান হারিয়েছে, পৃথিবীর আর্থ-সামাজিক অবকাঠামো ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেছে, লক্ষ কোটি মানুষ হয়েছে উদ্বাস্তু। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ আর হিরোশিমা-নাগাসাকির মর্মান্তিক ভয়াবহতার কথা কেউ ভুলতে পারে নি বরং এখনো অনেকেই আৎকে উঠে। যুদ্ধ একটি সামাজিক ঘটনা। ইতিহাস জুড়ে দেখতে পাই বুদ্ধিজীবি আর চিন্তাবিদরা এ যুদ্ধের ভয়াবহতায় কতোটুকু চিন্তিত। সুশীল সমাজ এবং বুদ্ধিজীবিদের ভূমিকা সামাজিক অগ্রগতি এবং সমৃদ্ধিতে অপরিসীম। তাই তাদের আচরণ, মনোভাব এবং বিশ্বাস তাদের প্রকৃত কর্মে ও চিন্তায় প্রতিফলিত করা উচিত। কিন্তু, দুঃজনক হলেও সত্য যে, অনেক তথাকথিত রাজনৈতীক এবং একাডেমিক বুদ্ধিজীবী আছেন যারা সত্যটাকে সঠিকভাবে উপস্থাপনা করা থেকে ইচ্ছাকৃত ভাবে বিরত থাকেন। বাস্তব তথ্যকে হরহামেশাই ফিল্টার করে বা নতুন তথ্য বানানোর মাধ্যমে তাদের নিজস্ব মতাদর্শকে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেন; অনেক ক্ষেত্রে, তারা ইচ্ছাকৃতভাবে ব্যক্তিগত বিশ্বাসের বিপরীতে অবস্থান নেন শুধু মাত্র কোন দল বা গোষ্ঠীকে খুশী করার জন্যে বা স্বীয় কোন স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্যে নতুন এক বাস্তবতা তৈরি করেন। অষ্ট্রীয়ান দার্শনিক শুমপেটারের মতে, “কোন কোন বুদ্ধিজীবী প্রয়োজনে অনেকদুর এগিয়ে যেতেও দ্বিধা করেন না এবং এমনকি তাদের আদর্শকে জলান্জলী দিয়ে সত্যকে মিথ্যা বলতেও সংকোচ বোধ করেন না”। তারা তাদের বা তাদের মিত্রদের পছন্দের মতো উপযোগী তথ্য উপাত্ত তৈরি করে যে কোন ঘটনাক নিজেদের সুবিধামতো পরিবেশন করবেন। কিংবা প্রকৃত সত্যকে বিকৃত করবে অথবা শব্দ, লাইন বা বাক্যগুলির অসুবিধাজনক অর্থ ও তাৎপর্য খুঁজে বের করবে যাতে করে সত্যতার পিঠে অসত্যের প্রলাপ লাগানো যায়।
রাশিয়া-ইউক্রেইন সংকটকে ঘিরে আমরা আজ পশ্চিমা রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক বুদ্বিজীবি সহ সুশীল সমাজের একটা বড়ো অংশকে এই জাতীয় নৈতিবাচক চেতনার বহিঃপ্রকাশ দেখতে পাচ্ছি, সত্যকে বিকৃত করার এক ঐক্যবদ্ধ সার্বিক প্রয়াস, যেন জনগন আসল সত্যতার হদিস খুঁজে না পায়। এ যেন রাশিয়ার বিরুদ্ধে পশ্চিমা বুদ্ধিজীবিদের এক পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র। সত্যিকারের বুদ্ধিজীবীরা যথাযথ পদ্ধতিতে এবং অখণ্ডতার সাথে কাজ করেন। মানুষের স্বাধীনতা ও জ্ঞানকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য নতুন নতুন চিন্তা এবং ধারণা নিয়ে কাজ করেন পতিনিয়ত। সৎ বুদ্ধিজীবীদের উচিত সত্যবাদী হওয়া, সরকার ও তার সহযোগীদের ভুল কাজগুলোকে প্রকাশ করা, ভালো ধারণাগুলোকে লালন করা এবং সমাজের উন্নতির জন্য জনসাধারণের দৃষ্টিভঙ্গি, বিশ্বাস এবং জ্ঞানকে সঠিকভাবে প্রভাবিত ও উৎসাহিত করা। বিশ্ব নন্দিত বুদ্ধিজীবিরা সমাজের সব স্তরের শিক্ষীত জনগনকে প্রভাবিত করতে সক্ষম। যেমন নওমি চমস্কি, অমর্ত্য সেন, টমাস ফ্রিডম্যান, ডেসমন্ড টুটু, জে কে রাউলিংস, রিচার্ডস ডকিন্সের মতো শীর্ষ বুদ্ধিজীবীরা সকলের কাছে তাদের ধারণা সরাসরি ছড়িয়ে দেওয়ার এবং সমাজে গভীর প্রভাব রাখার বিশেষ ক্ষমতা রাখেন। ।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিশেষ করে ঠান্ডা যুদ্ধের সময় আমরা সবাই ছদ্ম-বুদ্ধিজীবীদের উত্থান দেখেছি। পৃথিবী দুইভাগে বিভক্ত ছিলো-পূর্ব আর পশ্চিম। একদিকে যুক্তরাষ্ট্র এবং ন্যাটোভুক্ত পশ্চিমা দেশগুলি সহ মিত্র দেশগুলি, অন্যদিকে সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং তার মিত্ররা। ইতিহাসের দিকে একটু চোখ রাখলেই সহজেই বোধগম্য হবে যে, কেমন করে বিশেষ কোন রাজনৈতিক দলের বা আদর্শের সাথে সংপৃক্ত তথাকথিত বদ্ধিজীবিরা যেনে শুনেই মিথ্যার বেসাতি করে বেড়াতো। যেন রাশিয়াতে বৃষ্টি হলে নিজের দেশে ছাতা ধরার মতো কিংবা যুক্তরাষ্ট্রের বন্যতাকে সভ্যতার আদর্শ হিসাবে চালিয়ে দেয়া। কিন্তু আমাদেরকে ভুললে চলবেনা যে আমরা আজ বসবাস করছি বিশ্বায়ন আর প্রযুক্তির যুগে যেখানে সাধারন জনগন অত্যন্ত সচেতন। এই তথ্য প্রযুক্তির যুগে সমস্ত মানুষকে বোকা বানানো সহজ কাজ নয়। আব্রাহাম লিংকনের বিখ্যাত উক্তিটির মধ্যেই তার সত্যতা পাওয়া যায় “ কিছু লোককে সর্বদা বোকা বানানো সহজ, এবং সমস্ত মানুষকে কিছু সময়ের জন্য বোকা বানানো সম্ভব কিন্তু সবাইকে সর্বদা বোকা বানানো সম্ভব নয়।" আমরা সবাই এই জাতীয় ছদ্ম-বুদ্ধিজীবিদেরকে চিনি এবং তাদের মতাদর্শ সম্পর্কে কিছুটা হলেও সচেতন। তাদেরকে সবসময় টিভি টক শো, সেমিনার, ওয়ার্কশপ, মিডিয়া ইন্টারভিউ, সোশ্যাল মিডিয়া চ্যানেলে এবং এর বাইরেও দেখতে পাওয়া যায়। তারা প্রতিনিয়ত মিথ্যার বেসাতি করে বেড়ায়। ভয়ানক ভাবে তারা সত্যটাকে বেশ কৌশলে মিথ্যা বলে প্রচার করতে কোন সংকোচবোধ করে না। কখনো কখনো অপ্রমাণিত সূত্র দিয়ে অর্ধসত্য কথা বলে। আমরা তাদের ধরন, তাদের আচরণ এবং তাদের উদ্দেশ্য জানি।তারা খুব চতুর ধুর্ত কারণ তারা জানে কিভাবে মানুষকে ম্যানিপুলেট করতে হয় এবং বিশেষ গুণাবলী ব্যবহার করে মানুষের মনকে কিভাবে প্রভাবিত করা যায় । এ জাতীয় বুদ্ধিজীবিরা অন্যদের অপমান করা সহ বিপরীত পক্ষের অযাচিত দোষ খোজার চেষ্টা করে।
ইউক্রেনের সাম্প্রতিক ঘটনা এবং যুদ্ধের বাস্তববাদী চিন্তাধারার ইতিহাসের প্রতিফলন, যুদ্ধের বুদ্ধিবৃত্তিক প্রতিক্রিয়া এবং সশস্ত্র সংঘাতের সাথে সামাজিক চিন্তার আন্তঃসম্পর্ক নিয়ে ইদানীং পশ্চিমা বুদ্ধিজীবিরা বেশ সরব হয়ে উঠেছেন এবং প্রতিনিয়তই আলোচনা করেছেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় তাদের আলোচনায় সত্যিকারের বুদ্ধিজীবিদের দার্শনিক শুদ্ধ চিন্তাশীলতার প্রতিফলন দেখতে পাইনা। তাই বিরক্তির সাথেই এক চ্যানেল থেকে অন্য চ্যানেলে ঘুরপাক করি। কিন্তু একই দশা। যা লাউ তাই কদু। বিশ বছর আগে, ডোয়াইট ম্যাকডোনাল্ড জনগণের দায়িত্ব এবং বিশেষ করে বুদ্ধিজীবীদের দায়িত্ব নিয়ে রাজনীতিতে একটি ধারাবাহিক নিবন্ধ প্রকাশ করেছিলেন। এক ইংরেজ বন্ধুর পরামর্শে বেশ কয়েকটি প্রবন্ধ পড়ার সুযোগ হলো। বিশেষ করে এই সংকট কালীন সময়ে এই প্রবন্ধগুলি পড়ার উপলক্ষ্যটা ছিলো বেশ সময়োপযোগী। ম্যাকডোনাল্ড যুদ্ধের অপরাধের প্রশ্নে বেশ উদ্বিগ্ন ছিলেন। তাই তিনি সরাসরি প্রশ্ন রেখেছিলেন যে, জার্মান বা জাপানি জনগণ তাদের সরকারের দ্বারা সংঘটিত নৃশংসতার জন্য কতটা দায়ী ছিল? কিংবা বেসামরিক নাগরিকদের ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসী বোমা হামলার জন্য ব্রিটিশ বা আমেরিকান জনগণ কতটা দায়ী, যা পশ্চিমা গণতন্ত্র দ্বারা যুদ্ধের কৌশল হিসাবে নিখুঁতভাবে প্রয়োগ করা হয়েছিলোবিভিন্ন দেশে। হিরোশিমা এবং নাগাসাকিতে যে নিশংস হত্যাকান্ড হয়েছিলো তা কি সবাই ভূলে গিয়েছে? গত একশ বছরে সারা পৃথিবীতে ঘটে গেছে ভয়াবহ নিশংসতা, হত্যাযজ্ঞ, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, ১৯৩০-এর দশকের ভয়াবহতা, ইথিওপিয়ার যুদ্ধ, রাশিয়ান নির্মূল অভিযান, স্প্যানিশ গৃহযুদ্ধ, নাৎসি নৃশংসতার ঘটনা। এই সমস্ত ঘটনাগুলির প্রতি পাশ্চাত্যে বুদ্ধিজীবিদের প্রতিক্রিয়া এবং আংশিকভাবে তাদের মধ্যে মতাদর্শের জটিলতা—বিশেষ তাৎপর্য বহন করে।
ইউক্রেইনের সংকটকে কেন্দ্র করে পৃথিবী যেন আজ দুইভাগে বিভক্ত। ইউক্রেইনের পক্ষে এবং রাশিয়ার বিরুদ্ধে। ইদানীং পশ্চিমা বুদ্ধিজীবিদের মানবিক দায়িত্ব নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। যে কোন যুদ্ধে ক্ষয়ক্ষতি এবং নিশংস ভয়াবহতা দুক্ষের দ্বারাই সংঘঠিত হয়। যুদ্ধের পর থেকে আজ পর্যন্ত কোন পশ্চিমা সংবাদ মাধ্যমে কোন বুদ্ধিজীবিদের দ্বারা রাশিয়ার বদনাম আর ইউক্রেইনের প্রশংসা ছাড়া আর কিছুই শোনা যায় নি দুই একটি ব্যাতিক্রম ছাড়া। বুদ্ধিজীবীরা যে পশ্চিমা সরকারের মিথ্যাচারকে সমর্থন করা সহ প্রায়শই লুকানো উদ্দেশ্য অনুসারে সংকটের প্রক্ষাপটকে বিশ্লেষণ করার দৃঢ় অবস্থান নিয়েছে। বিকৃত ও ভ্রান্ত উপস্থাপনা, আদর্শ ও শ্রেণীস্বার্থের আড়ালে লুকিয়ে থাকা সত্য অনুসন্ধানের অনীহা, কিংবা সত্যকে গলাটিপে রুদ্ধ করে দেয়ার সমষ্টিগত প্রচেষ্টা লক্ষনীয়। এই সংকট কালীন সময়ে বুদ্ধিজীবীদের দায়িত্ব যে কত গভীর তা পশ্চিমা বুদ্ধিজীবিদের কথা-বার্তায় তার প্রতিফলন নেই বললেই চলে। পশ্চিমা বুদ্ধিজীবিদের মতে ইউক্রেন সংকটের জন্য রাশিয়ার আগ্রাসনকে প্রায় সম্পূর্ণরূপে দায়ী করা যেতে পারে। ইউক্রেইন বা পশ্চিমা দেশ গুলির কোন ভূমিকা নেই। একটি বিশেষ মতবাদের প্রেক্ষিত কার্যত পরিলক্ষিত। এই জাতীয় বুদ্ধিজীবিদের ধারনা রাশিয়ার রাষ্ট্রপতি ভ্লাদিমির পুতিন, সোভিয়েত পুনরুজ্জীবিত করার দীর্ঘস্থায়ী আকাঙ্ক্ষা থেকে ক্রিমিয়াকে সংযুক্ত করে এবং দনবাসের সংকটকে সৃষ্টি করে। অথচ পশ্চিমা বিশ্ব ছাড়া সাড়া বিশ্বের অনেকের কাছেই এইটা খুব পরিস্কার যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার ইউরোপীয় মিত্র দেশগুলিই এই সঙ্কটের জন্য বেশিরভাগ দায়ি। তাদের মতে সংকটের মূল কারন ন্যাটোর পূর্ব ইউরোপে পরিবর্ধন ।
১৯৯০-এর দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে, রাশিয়ান নেতারা ন্যাটোর পূর্ব ইউরোপে সম্প্রসারনের তীব্র বিরোধিতা করে আসছিলো, এবং সাম্প্রতিক বছরগুলিতে, তারা এটা আরো স্পষ্ট করে দিয়েছে যে রাশিয়ার নিরাপত্তার কারনেই ইউক্রেইনকে ন্যাটোভুক্ত করা যাবে না। কিন্তু লিবারেল গনতন্ত্রের ছত্রছায়ায় বেড়ে উঠা আর রাশিয়াকে ধ্বংশ করার দীর্ঘমেয়াদীর ষড়যন্ত্র প্রনয়নকারী পশ্চিমা বিশ্ব রাশিয়ার অভিযোগ এবং নিরাপত্তার প্রস্তাবনা গুলিকে মোটেও আমলে নেননি বরং ইউক্রেইনকে রাশিয়ার বিরুদ্ধে উসকিয়ে দিয়েছে। তারা বিশ্বাস করে যে বাস্তববাদের যুক্তির প্রাসঙ্গিকতা অতি সামান্য। ওয়াশিংটন কিংবা পশ্চিমাদের মস্কোর অবস্থান পছন্দ নাও করতে পারে, কিন্তু এর পেছনের যুক্তিটা বুঝা জরুরী ছিলো বিশেষ করে আইনের শাসন, অর্থনৈতিক পরস্পর নির্ভরতা এবং গণতন্ত্রের মতো উদার নীতির ভিত্তিকে মজবুত করার লক্ষে। পশ্চিমা বিশ্ব যখন ইরাক, লিবিয়া, আফগানিস্থান, শ্লোভাকিয়া কিংবা সিরিয়াতে ধ্বংশের তান্ডবলীলা চালিয়েছিলো তখন তো এই বুদ্ধিজীবিরা সমষ্টিগত ভাবে এক সুরে ন্যাটো বা যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কথা বলে নি? তা হলে আজ কেন আদর্শগত দ্বন্দ? কারন খুব পরিস্কার। অর্থাৎ যারে দেখতে নারি তার চলন বাকা। রাশিয়াকে কোনঠাসা করাই যে পশ্চিমা বিশ্বের মহান উদ্দেশ্য। তাই এই যুদ্ধে রাশিয়ার পক্ষে বলা মানে পশ্চিমা গনতান্ত্রিক নীতি আর আদর্শের বিরুদ্ধ ঝান্ডা তোলা!