২৬শে মার্চ বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষের জন্য একটি পবিত্র, আনন্দ, উচ্ছাস আর সংকল্পের দিন। আমাদের স্বাধীনতা, মুক্তি আর স্বাবলম্বী হওয়ার দিন। এই দিনটির সাথে জড়িয়ে আছে বাঙ্গালীর আশা, কৃষ্টি এবং সংস্কৃতির এক সমৃদ্ধির ইতিহাস, আমাদের স্বপ্ন আর বেঁচে থাকার আগ্রহ, আমাদের ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস আর গর্জে উঠার প্রেরনা। এই দিনটিতেই আমরা খুঁজে পেয়েছিলাম আমাদের সত্যিকারের অস্তিত্বকে। স্বাধীনতা দিবস আমাদের সকলের জন্য এক প্রতিশ্রুতি আর সম্ভাবনার দিন। তাই এই দিনটিকে আমরা স্মরন করি গভীর শ্রদ্ধায়। যে কোন জাতীর স্বাধীনতা প্রাপ্তির সাথে ওতোপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকে মৃত্যু, রক্তপাত, অনিশ্চয়তা, মানষিক যন্ত্রনা আর অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবকাঠামোর বিপর্যয়। আমরাও এই মহা সংকটের মধ্য দিয়ে পাড় হয়েছি। এই ভুখন্ডের মানুষেরা সত্যি সৌভাগ্যবান যে আমাদের মহা সংকটে আমাদের হৃদয় এবং আত্মা ধারন করেছিলো এমন একজন বলিষ্ঠ দৃঢ় প্রত্যয়ী মহান নেতাকে যিনি আমাদেরকে দেখিয়েছিলেন নতুন করে বেঁচে থাকার স্বপ্ন, উঠে দাঁড়াবার শক্তি, শত্রুর বিরুদ্ধে গর্জে উঠার প্রেরনা। আমাদেরকে বুঝিয়েছিলেন, মরতেই যদি হয় কুকুরের মতো নয়, মানুষের মতোই মরবো। জাতীর পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর বলীষ্ঠ নেতৃত্বের মাধ্যমে জাতীকে দেখিয়েছিলেন সত্যকারের মুক্তির পথ।
একটি নৃশংস ভয়াবহ যুদ্ধের বিভীষিকা থেকে একটি নতুন রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছিলো, যার মধ্যে একাধিক চ্যালেঞ্জ থাকার মধ্যেও আমরা ছিলাম দুর্জয় গিরির মতো অটুট এবং একতা ছিল আমাদের পথ চলার দিশারী। বাংলাদেশের মানুষ সব সময় ধর্ম, জাতি এবং গোষ্ঠি নির্বিশেষে একে অপরের প্রতি অত্যন্ত শ্রদ্ধাশীল, সহনশীলতা এবং মুক্ত চিন্তার মনোভাব দেখিয়েছে। অনেক জাতীয় সংকটের বছরগুলিতে আমরা সবাই একসাথে পথ চলেছি, একসাথে লড়াই করেছি এবং একসাথে দেশের মঙ্গলের জন্য কাজ করেছি। জাতীর পিতার উদার এবং বলিষ্ঠ কন্ঠের আহব্বানে সমস্থ দেশবাসী ঝাঁপিয়ে পরেছিলো স্বাধীনতার যুদ্ধে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ (১৯৭১), যা নয় মাস স্থায়ী হয়েছিলো, তা ছিল অত্যন্ত ভয়াবহ। এই যুদ্ধে লক্ষ লক্ষ মানুষ প্রান হারিয়েছিলো, লক্ষ মা-বোনেরা ইজ্জত দিয়েছিলো এবং সারা দেশের সামাজিক এবং অর্থনৈতিক অবকাঠামোকে পঙ্গু করে দিয়েছিলো পশ্চিম পাকিস্তানের শাষকগোষ্ঠী। আমাদের স্বাধীনতা হলো বাংলা ভাষা ভাষীর এই ভূখন্ডের মানুষদের ঐক্য এবং ভালোবাসার ইতিহাস। এক অসীম প্রত্যয়ের ইতিহাস। বঙ্গবন্ধুর গতিশীলতা এবং বাস্তববাদীতা তাঁকে চরম সংকটের মধ্য দিয়ে একটি নতুন জাতীকে পরিচালনা করতে সক্ষম করেছিলো। আমরা অনুধাবন করতে পেরেছিলাম যে,দূর্যোগ আর জাতীয় সংকটে প্রত্যয়ী এবং উদ্যমী দূরদৃষ্টিসম্পর্ন নেতৃত্বের অপরিহার্যতা অপরিসীম যারা অন্যদেরকে জাগিয়ে তুলতে এবং উজ্জীবিত করতে পারে। জাতীর পিতা স্বাধীনতা সংগ্রামকে আলিঙ্গন করেছিলেন গভীর ভালোবাসায় একজন পিতা হিসেবে। অঙ্গীকারবদ্ধ ছিলেন, যে কোন মূল্যেই বাংলাকে মুক্ত করবেন। এই স্বাধীনতা দিবসে আমাদের সশ্রদ্ধ প্রনাম এবং শ্রদ্ধা এই মহান নেতা এবং জাতীর পিতার প্রতি।
এই পবিত্র স্বাধীনতা দিবসে কেবল তিঁনি যা করেছেন তার জন্যই শুধু কৃতজ্ঞতা বা ধন্যবাদ জানালেই সত্যিকারের শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করা হবে না। জাতী হিসেবে সমগ্র বাংলাদেশ তাঁর আদর্শ আর নীতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল কিনা তার সত্যিকারের প্রয়োগ চিন্তা এবং কাজে প্রতিফলিত হলেই সত্যিকারের শ্রদ্ধা জানানো হবে এই মহান পিতার প্রতি। তিনি শুধু বাংলার মানুষেরই প্রিয় নেতা নন, বরং সাড়া বিশ্বের সকল মেহনতী মানুষের বলীষ্ঠ কন্ঠস্বর এবং চেতনার উৎস। জাতী হিসবে স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশ যে অসাধারন সামাজিক-অর্থনৈতিক উন্নতি সাধন করেছে তার প্রতিফলন চিন্তা এবং কর্মে ঘটানোই হবে শ্রেষ্ট কাজ। স্বাধীকার আদায়ের পথ চলায় যারা নিজের জীবনকে করেছেন উৎসর্গ, যারা বেঁচে আছেন সংগ্রামের কষ্ট আর বেদনাকে বুকে ধারন করে তাদেরকে যেন কখনো না ভুলি। আর যারা আমাদেরকে পিষ্ট করতে চেয়েছিল, গলা টিপে হত্যা করতে চেয়েছিল আমাদের প্রিয় স্বাধীনতাকে, তাদেরকে যেন চিনতে পারি, শাস্তির কাঠগড়ায় বসাতে পারি। তাই হবে স্বাধীনতার তৃপ্তি। মুক্তি যুদ্ধ এবং মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি আমরা যে সত্যিকার অর্থে ঋনী তা নিশ্চিন্ত করার জন্য আমাদের সকলকেই এক সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে একটি অন্তর্ভূক্তিমূলক সমৃদ্ধ জাতী গঠনে কাজ করার দৃঢ় অঙ্গীকারদ্ধ হতে হবে।
স্বাধীন বাংলাদেশ উপহার দিয়েছিলো একটি শক্তিশালী সংবিধান চারটি মূলনীতির উপর ভিত্তি করে- জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা। সরকার এমন একটি গনতান্ত্রিক,নিরপেক্ষ এবং সমৃদ্ধ রাষ্ট্র সৃষ্টিতে বদ্ধপরিকর ছিলেন, যেখানে আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং স্বাধীনতা, সাম্য ও ন্যায়বিচার, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক অধিকার সব নাগরিকের জন্য সুরক্ষিত থাকে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো স্বাধীনতার এতো বছর পরেও আমরা অনেক কিছুই পাই নি। জাতী হিসাবে যাকে নিয়ে গর্ভ করা যায় সেই ধর্ম নিরপেক্ষতা আর অসাম্প্রদায়িক চেতনাই যেন দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে। ধর্ম নিরপেক্ষতা বন্ধুত্ববাদের অন্তর্নিহিত মূল্যকে স্বীকৃতি দেয় যা সামাজিক, রাজনৈতিক বিশ্বাস এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে সংপৃক্ত। আধুনিক সমাজ ব্যাবস্থায় ধর্মীয় স্বাধীনতা সম্পর্কে আমাদের মূল উপল্দ্ধি হলো সরকারী নিরপেক্ষতা। এর ফলশ্রুতিতে সরকারকে কোন ধর্মীয় গোষ্ঠীর প্রতি বিশেষ অনুকুল আচরন থেকে বিরত রাখে। এটাই ধর্মনিরপেক্ষতার মূল নীতি। যার ফলে প্রতিটি মানুষই তার স্বীয় ধর্মকে লালন-পালন এবং আচারিক কার্যক্রম কোন ধরনের বাধা বা সীমাবদ্ধতা ছাড়াই পালন করতে পারে। যেহেতু ধর্মীয় চেতনা জাতীয় অগ্রগতি এবং মানুষের মানবিক মূল্যবোধকে প্রভাবিত করার চালিকা শক্তি সেহেতু ধর্মীয় স্বাধীনতা সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য অতীব গুরুত্বপূর্ন। কিন্তু দূর্ভাগ্যের বিষয় গনতন্ত্র আর ধর্ম নিরপেক্ষতাকে শক্তিশালী করার জন্য যে নৈতিক, মানবিক এবং প্রজ্ঞায় মজবুদ নাগরিক সম্প্রদায় গড়ে উঠা প্রয়োজন তা বেড়ে উঠতে পারে নি এখনো পর্যন্ত। তাই সত্যিকারের ধর্মীয় চেতনা বা মানুষের নাগরিক অধিকার সম্পর্কে সাধারন জনগন আলোকিত নয়।
স্বাধীনতা উত্তর যে গনতন্ত্র এবং অসাম্প্রদায়িক চেতনায় আমরা দেশটাকে গড়ে তুলেছি তাতে বেশীর ভাগ মানুষের আশা আকাঙ্খা প্রতিফলিত হয়নি। গত তিন দশক ধরে বিভিন্ন পর্যায়ে ভয়ানক সাম্প্রদায়িক সহিংসতা থেকে শুরু করে সংখ্যালঘুদের শত শত বাড়িঘর ভাঙচুর করা, নানা সময়ে ধর্মের উস্কানি দিয়ে সংখ্যালঘুদের উপর হামলা চালানো, সম্পত্তি দখল, মন্দির ভাঙ্গচুর করা মাত্রাধীক ভাবে বেড়েই চলেছে। এই কি ধর্ম নিরপেক্ষতার চেতনা? স্বাধীনতার চেতনা? মানবতা আজ সত্যি বিপন্ন, দেশবাসী আজ বিপন্ন। এ লজ্জা সারা দেশ বাসীর, বিশ্ব মানবতার। একে রক্ষা করা আমাদের সকলের নৈতিক এবং সামাজিক দায়িত্ব। এই ধর্মীয় উন্মাদনার কারনে ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা দিন দিন সংকুচিত হয়ে আসছে, যা জাতী হিসেবে সত্যিই উদ্বেগের ব্যাপার। রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ আসে অজ্ঞতা থেকে। অর্ধশিক্ষীত এবং কুশিক্ষীত সহ কুচক্রী এবং ধর্মের ধ্বজাধারীদের ব্যাপারে আমাদের সকলকেই সতর্ক থাকতে হবে। কারন তারাই প্রগতীর অন্তরায়। স্বাধীনতা এবং নিরপেক্ষ ধর্মীয় মূল্যবোধকে জাগিয়ে তুলতে প্রয়োজন একটি নৈতিক শিক্ষা ব্যবস্থা যা আমাদের অজ্ঞতা এবং অহিষ্ণুতাকে দুর করতে সহায়ক হবে। সত্যিকারের শিক্ষিত সমাজই পারবে ধর্ম, বর্ন, পেশা নির্বিশেষে সব ধরনের অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে।
সরকারের পাশাপাশি ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা স্বকীয় অস্তিত্বকে সফলভাবে টিকিয়ে রাখার জন্য এবং একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশের গর্বিত নাগরিক হিসাবে নিজকে মর্যাদার সাথে প্রতিষ্ঠার জন্য কিছু করনীয় সুপারিশমালা যা একান্ত প্রয়োজন: (১) ব্যক্তিগত সামর্থ্য বাড়াতে আমাদের সাম্প্রদায়িক মূল্যবোধ, বিশ্বাস এবং নৈতিক শিক্ষাকে শক্তিশালী করুন। অনুভব করতে হবে আমরা সবাই এই রাষ্ট্রেরই অবিচ্ছেদ্য অংশ। সংকীর্ণ স্বার্থ ছাড়াই আমাদের সকলকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে; (২) ভুক্তভোগী পরিবারকে নৈতিক, আর্থিক এবং মানসিক উভয়ভাবেই পূর্ণ সমর্থন দেওয়াসহ তাদের মনোবল বাড়াতে সাধ্যমতো কাজ করা; (৩) সকল আন্ত--সম্প্রদায়ের সংগঠনগুলিকে আমাদের মূল মূল্যবোধ রক্ষার জন্য একসাথে কাজ করতে হবে এবং একত্রিত হওয়ার জন্য সাধারণ ভিত্তি খুঁজে বের করতে হবে এবং স্থানীয় ও জাতীয় কর্তৃপক্ষের কাছে আমাদের ঐক্যবদ্ধ আওয়াজ তুলতে হবে; (৪) সংখ্যালঘু-ভিত্তিক সংগঠন এবং অন্যান্য স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক এনজিওগুলিকে জাতিগত সংখ্যালঘুদের সামাজিক পরিচয় এবং নাগরিকত্বের অধিকার বিকাশের জন্য একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষামূলক কর্মসূচি তৈরির জন্য আমন্ত্রণ জানানো এবং তার আন্তরিক বাস্তবায়নের উদ্দোগ নিতে হবে; (৫) আন্ত-ধর্মীয় সম্প্রীতি তৈরির জন্য একটি বার্ষিক আন্তর্জাতিক সম্মেলন/সিম্পোজিয়ামের আয়োজন করা; (৬) বাংলাদেশে জাতিগত সংখ্যালঘুদের নিপীড়ন তদারক করার জন্য একটি আন্তর্জাতিক উপদেষ্টা কমিটি গঠন করার ব্যবস্থা; (৭) সংখ্যালঘুদের মানোন্নয়ন এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির উন্নয়নে বিভিন্ন ধরনের উন্নয়ন কর্মসূচী গ্রহন করা সহ প্রায়োগিক গবেষনায় মনোনিবেশ করা।
একদিকে অর্থনৈতিক উন্নতিতে আমরা যেমন এগিয়ে আছি, ঠিক অন্যদিকে দেখছি এক ভয়ানক দৃশ্য। যেখানে ক্রমাগত বেড়েই চলেছে কুশিক্ষা, দূর্নীতি, সহিংসতা, লোভ-লালসা, আত্মকেন্দ্রিকতা, উগ্র সাম্প্রদায়িকতা, হতাশা, আর ঠগবাজ কুচক্রীদের আনাগোনা। দূর্নীতিবাজ আর ঘুষ খোরদের দখলে আজ জাতী। ধনিক-বনিক শ্রেনীর স্বার্থেই কার্যতঃ রাজনীতি আর রাষ্ট্র পরিচালিত হচ্ছে। ধর্ম নিরপেক্ষতা আজ ধর্মের ধ্বজাধারী আর সুবিধাভোগীদের হাতে নিষ্পেশিত। এই সব কিছুই শুদ্ধ গনতন্ত্রের অন্তরায়। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনের মূলমন্ত্রই ছিলো অসম্প্রদায়িকতা, মানবতা আর পারষ্পরিক শ্রদ্ধাবোধ। স্বাধীনতার চেতনাই যে আমাদের অস্তিত্ব সেই হোক আমাদের উপলদ্ধি। বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষই হয়ে উঠুক বাংলার ভাগ্য নিয়ন্তা। যে ঐতিহ্য আর সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলে সমৃদ্ধ এবং বিকশিত হয়েছে এই জাতী, যুগ যুগ ধরে নানা ঐতিহ্য থেকে যে ভাবে অর্জন করেছে শক্তি আর ঋজুতা, সেই চেতনা আর ঐতিহ্যই হয়ে উঠুক স্বাধীনতা উত্তর এই বংলার সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক দর্শন। সকল সম্প্রদায়ের লোক যেন মর্যাদার সাথে বসবাস করতে পারে তার পরিবেশ তৈরীতে আমরা সকলেই যেন এগিয়ে আসি। এই স্বাধীনতা দিবসে এই হোক আমাদের অঙ্গীকার।