কোন ধরনের সীমাবদ্ধতা বা দমন-পীড়ন ছাড়াই অবাধে কথা বলার অধিকার যে কোন গণতান্ত্রিক দেশ বা সরকারের জন্য অপরিহার্য। কারণ বাক স্বাধীনতা যে কোন গনতান্ত্রিক রাষ্ট্রকে সত্যিকারের চ্যালেঞ্জ, দিক নির্দেশনা এবং বিতর্কের মাধ্যমে আরও ভাল আইন ও নীতি প্রনয়ন ও বিকাশে সহায়তা করে। বাক-স্বাধীনতার প্রধান শর্ত হলো সরকার কর্তৃক কোন ধরনের সীমাবদ্ধতা বা নিপীড়িত হওয়ার ভয় ছাড়াই সর্বসাধারনের স্বাধীনভাবে কথা বলার অধিকার, যাকে ব্যাক্তি স্বাধীনতার প্রথম শর্ত হিসেবে গণ্য করা হয়। গনতন্ত্রকে স্বচ্ছ এবং জনগনের স্বাধীনতার অনুকুল পরিবেশ তৈরী করার জন্য এর গুরুত্ব অপরিসীম। জনগনের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা মানে মুখের কথা, লেখা, মুদ্রণ, ছবি বা অন্য কোনো উপায়ে স্বাধীনভাবে নিজের মতামত প্রকাশের অধিকার। এই একবিংশ শতাব্দীর অভুতপূর্ব যোগাযোগ এবং শিল্প বিপ্লবের অগ্রগতির কারনে সাম্প্রতিক সময়ে এটি ব্যাপকভাবে স্বীকৃত যে মানুষের স্বাধীনভাব কথা বলার অধিকার একটি গনতান্ত্রিক সমাজের মূল ভীত্তি। তাকে রক্ষা করা আবশ্যক এবং রাষ্ট্রের দ্বায়ীত্বও বটে। একটি মুক্ত স্বাধীন এবং সভ্য সমাজের মৌলিক স্বাধীনতাগুলির মধ্যে একটি হলো মানুষের মুক্তভাবে কথা বলার অধিকার যা সমাজের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
গনতন্ত্র, বিশ্বায়ন আর স্বাধীনতার যুগে বাক-স্বাধীনতা শুধুমাত্র বিভিন্ন রাষ্ট্রের সংবিধান দ্বারাই নিশ্চিত নয়, বরং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক কনভেনশন যেমন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা, এমন্যাষ্টি ইন্টারনেশনাল এবং মৌলিক স্বাধীনতা সম্পর্কিত ইউরোপীয় কনভেনশন, নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার সম্পর্কিত আন্তর্জাতিক চুক্তি ইত্যাদি দ্বারাও নিশ্চিত করা হয়েছে। এই সংস্থাগুলি স্পষ্টভাবে বাক ও মত প্রকাশের স্বাধীনতার সুরক্ষা সম্পর্কে কথা বলে। বাক-স্বাধীনতা জাতিসংঘের মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণাপত্রে সংরক্ষিত একটি অধিকার এবং বেশিরভাগ দেশেই আইন দ্বারা আনুষ্ঠানিকভাবে এই অধিকার দেয়া হয়েছে জনগনকে। কিন্তু বাস্তবের চিত্রটা একটু অন্যরকম এবং মিশ্রও বটে। কোন কোন গনতান্ত্রিক এবং উন্নত দেশে রাষ্ট্রিয়ভাবে বাকস্বাধীনতাকে রক্ষা করা হয়, কোথাও বা শক্তহাতে দমন করা হয়, আবার কোন কোন দেশে দুইমূখী নীতি অনুসরন করার অভিযোগও মেলে হরহামেশাই। অগনতান্ত্রিক, ফ্যাসিবাদী এবং একনায়কতান্ত্রীক দেশগুলিতে অবশ্য এই বাক -স্বাধীনতার ব্যাপরটি একটু গোলমেলে যেখানে সীমাব্ধতা এবং দমন-পীড়নই প্রজ্জল। তবে আমার আলোচনা এই জাতীয় দেশগুলির বাক-স্বাধীনতা নিয়ে নয়।বরং আমার আলোচনায় তথাকথিত গনতান্ত্রিক মুক্ত পশ্চিমা বা উন্নত বিশ্বের দেশগুলির বাক-স্বাধীনতার প্রসঙ্গেই মূলত আলোকপাত করা। যেখানে দুমুখী বাক স্বাধীনতার মুখোশধারীরা খুবই সক্রিয় কিন্তু কথা-বার্তায় দাদা গিরীর আস্ফালন। কথায় বলে কোন কিছুতেই বাড়াবাড়ি ভালো নয়। গনতন্ত্র আর মুক্তনীতির বাড়াাড়িতে পশ্চিমা বিশ্বের আজ প্রসব বেদনা শুরু হয়ে গেছে। আজ ইউক্রেইনের মহা সংকটকে ঘিরেই দেখতে পাচ্ছি তার প্রতিফলন। দিশেহারা পশ্চিমা বিশ্ব। এক ক্ষমতাবান রুশ প্রেসিডেন্টকে জব্দ করার জন্য বাক স্বাধীনতা, মূল্যবোধ আর সামাজিক চেতনার কি ভয়ানক কুপোকাত! আজকের সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে যখন বাকস্বাধীনতার নামে ক্ষতিকর ভুল তথ্য ছড়ানো সহ অন্যদের সরাসরি ধমক দেওয়া, ঘৃণা ও অসহিষ্ণুতা প্রচার করার অনুমতি হিসাবে দেখা যায়, তখন স্বভাবতই উদ্বেগের ব্যাপার এবং তখনই স্পষ্টতঃ মনে হয় যে বাক স্বাধীনতা কখনও কখনও ভালোর চেয়ে বেশি ক্ষতি করতে পারে কিনা।
ইউক্রেইনে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর পরই সারা পশ্চিমা বিশ্ব রাশিয়াকে আগ্রাসীর ভূমিকায় দাঁড় করিয়ে একের পর এক লাগাতার অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা শুরু করলো। প্রথমেই আঘাত হানলো “রাশিয়া টুডে-র উপর। যুক্তরাজ্যের পার্লমেন্ট সহ ইউরোপীয়ান পার্লামেন্ট, যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেস এবং প্রধান শক্তিধর মিত্র দেশগুলির রাষ্ট্র প্রধানরা একেবারে সরব হয়ে উঠলো রাশিয়া কেন্দ্রিক সংবাদ সংস্থাগুলির বিরুদ্ধে। নির্দিষ্ট রেগুলেটরী কতৃপক্ষকে কোন নিয়ম নীতির তোয়াক্কা না করেই নির্দেশ দেয়া হলো রাশিয়া টুডের ব্যাপারে দ্রুত হস্তক্ষেপ করার। আসলে একেবারে বন্ধ করে দেয়ার এক পাকা বন্দোবস্ত। বাক-স্বাধীনতার কি ত্রাহী ত্রাহী অবস্থা! কোন সন্ত্রাসবাদী কিংবা ফ্যাসীবাদী রাষ্ট্রে নয়, খোদ গনতন্ত্র আর বাক-স্বাধীনতা পূর্ন ভূমিতেই! একেই বলে রক্ষক যখন ভক্ষক। তাহলে কি আমরা ধরে নেব যে সম্প্রচার নিয়ন্ত্রকদের কোন নিজস্ব মতামত নেই এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রচারকদের ব্যাপারে রাষ্ট্রের সরাসরি হস্তক্ষেপই ন্যায্য? যদি যুক্তরাজ্যে সহ ইউরোপীয়ান দেশগুলির নিজস্ব সম্প্রচার রেগুলেটরী কতৃপক্ষ রাশিয়া টুডে সহ অন্যান্য রাশিয়া কেন্দ্রিক প্রচার মাধ্যমগুলিকে বন্ধ করার বিষয়ে গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করে, তবে তার নিজের থেকে সেই সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত ছিলো, রাজনীতিবিদদের দ্বারা চাপ সৃষ্টি করা কোন গনতান্ত্রিক চর্চার মধ্যে পড়ে না বরং তা সংবাদ মাধ্যমের বাক-স্বাধীনতার অন্তরায়। আমরা সকলেই সেই সমস্ত টিভি চ্যানেলগুলিকে বেছে নেওয়ার বিষয়ে আশ্চর্য হয়েছি, কারন রাশিয় টুডে অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি সংবাদ মাধ্যম যার দর্শক সংখ্যা ৭০০ মিলিয়নের বেশী। তাই পশ্চিম বিশ্বের রাষ্ট্রপ্রধান থেকে শুরু করে তথাকথিত রাজনীতিবিদরা যখন গনতন্ত্র আর বাক-স্বাধীনতার বুলি ছড়ান যত্র তত্র তখন সচেতন জনগনের ভ্রু কুঁচকানো ছাড়া কোন উপায় থাকে কি? তবে তাদের পর্দা ফাঁস করাটা সম্ভবত সামাজিক দায়িত্বের মধ্যেই পরে।
রাশিয়া টুডে একটি স্বায়ত্তশাসিত, অলাভজনক সংস্থা যা রাশিয়ান ফেডারেশনের বাজেট থেকে প্রকাশ্যে অর্থায়ন করা হয়, আট বছর ধরে যুক্তরাজ্যে সম্প্রচার করছে। পাঁচটি ভাষায় এ চ্যানেলটির কার্যক্রম। মূল ইংরেজি-ভাষায় চ্যানেলটি ২০০৫ সালে চালু হয়েছিল। এটি একটি পাবলিক টেলিভিশন নেটওয়ার্ক যা বিনামূল্যে খবর সহ নানা রকমের তথ্যচিত্র এবং প্রোগ্রাম পরিবেশন করে আসছিল। গত কয়েক বছরে সংবাদমাধ্যম জগতে রাশিয়া টুডে একটি বিশেষ শক্তিশালী অবস্থান তৈরী করতে সক্ষম হয়েছিলো। বিশ্বায়নের আগ্রাসনের কারনে আমরা দেখেছি বিশ্ব সংবাদ পরিবেশনে শুধুমাত্র কয়েকটি সংবাদ মাধ্যম কতৃত্ব করে আসছিলো। তার মধ্যে সি এন এন, বি বি সি, স্কাই নিউজ, আল জাজিরা, ইউরো নিউজ, সি সি টিভি এবং ফ্রান্স ২৪ মূলতঃ প্রধান। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে চাইনিজ সিসিটিভি ছাড়া বাকী সবগুলো চ্যানেলেই পশ্চিমা ভোগবাদী আর মত ও নীতি প্রচারের উপর ভিত্তি করেই পরাচালিত, যেখানে প্রকৃত সত্যকে কখনোই খুঁজে পাওয়া যায় না। কখনো সখনো পশ্চিমা দেশগুলির রাষ্ট্রিয় প্রচার মাধ্যম বলেই মনে হয় (যেমন বিবিসি)। যে সমস্থ ঘটনাগুলি রাষ্ট্রর বিরুদ্ধে যায় সে জাতীয় নিওজ পরিবেশনা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অনুপস্থিত। যেমন ইউক্রেন এবং সিরিয়ার মতো দেশ সম্পর্কিত সংবাদ প্রতিবেদনের ক্ষেত্রে, শ্রোতারা যদি তথ্য পেতে চান তবে বিবিসি এবং সিএনএন-এ তা সঠিক ভাবে পরিবেশন করা হয় না। গত কয়েক বছরে দনবাসের নিশংস হত্যাযজ্ঞ নিয়ে কোন তথ্যহুল সংবাদ এই জাতীয় সংবাদ মাধ্যমে ছিলো অনুপস্থিত। সেক্ষেত্রে আর টি মৌলিক সংবাদ পরিবেশনে সর্বদা তৎপর ছিলো। দীর্ঘ দিন যাবৎ তথ্য নির্ভর এবং বিশ্বের সার্বিক খবর জানার জন্য আমার মতো পশ্চিমা বিশ্বের লক্ষ লশ মানুষ এই চ্যানেলটিকেই বেছে নিয়েছিলো বিশেষ করে রাশিয়া সহ পশ্চিমাদের দুমূখী নীতি সংশ্লিষ্ট তথ্য সমৃদ্ধ সংবাদ জানার জন্য।
সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকেই রাশিয়া-যুক্তরাজ্য সম্পর্ক বেশ খারাপের দিকে মোড় নিয়েছে এবং রুশ-বিরোধী রাজনীতিকরা বেশী মাত্রায় মাথাচারা দিয়ে উঠেছিলো। ইউক্রেন ইস্যু উত্থাপিত হওয়ার পর থেকে তা যেন দা-কুমড়ো সম্পর্কে এসে দাঁড়ায়। BBC এবং CNN এর মত মূলধারার মিডিয়া প্ল্যাটফর্মে আর টির বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে অবরোধ শুরু করে। যে সকল রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ কিংবা একাডেমিক ব্যক্তিত্ব যারা নিয়মিতভাবে আর টি-তে সাক্ষাতকার দিতে আসেন তাদেরকে কালো তালিকাভুক্ত করা হয়। হংকং থেকে শুরু করে, সম্প্রতি ক্যানাডার অটোয়ায় ট্রাক অবরোধের পুলিশী নির্যাতন, ইউক্রেন এবং সিরিয়া সম্পর্কে আর টি-এর রিপোর্টিং মিডিয়া রেগুলেটরী কতৃপক্ষ দ্বারা বারবার তদন্ত করা হয়েছিল, যা পক্ষপাতদুষ্ট । মূলত আর টি পশ্চিমা দেশ গুলির দুমুখী নীতির পর্দা ফাঁসে তৎপর ছিলো বলেই পশ্চিমা রাজনৈতিক এবং সরকারের রোষানলে পরে। তাই ইউক্রেইনের বর্তমান সংকটে পশ্চিমা বিশ্ব বেশ ঘাবড়ে যায় এবং এই সংবাদ মাধ্যমটি যাতে জনগনের উপর কোন নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে না পারে যা পশ্চিমা সরকারের প্রতিকুলে যাবে সেই প্রেক্ষাপটেই মূলত আর টির উপর ইউরোপীয়ান দেশ সহ মিত্র দেশগুলির এই অগনতান্ত্রিক নিষেধাজ্ঞা। শুধু সেখানেই শেষ নয়, সব ধরনের রাশিয়া কেন্দ্রিক সংবাদ মাধ্যমগুলিকে পশ্চিমা দেশগুলির সমস্থ প্লাটফর্ম থেকে বাতিল করা হয়। চোখের সামনে ইউরোপ থেকে এই শক্তিশালী সংবাদ মাধ্যমটিকে বন্ধ করে দেয়া হয়। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো আর টির উপর ইউরোপীয়ান দেশগুলির নিষেধাজ্ঞার কারনে রাশিয়ায়ও BBC ও ডয়েচ সহ বেশ কিছু সংবাদ সংস্থার বিরুদ্ধে যখন টিট-ফর-ট্যাট এর ব্যবস্থা নেয় তখন এক যোগে পশ্চিমা সংবাদ মাধ্যমে রাশিয়ায় বাক-স্বাধীনতার দমন পীড়নের চিত্র তুলে ধরার হীরিক পড়ে যায়। অথচ নিজেদের মুখটাকে একটু আয়নায় দেখার কোন প্রয়োজন বোধ করলো না। একে বলে দুমুখো সাপ। যেন গায়ে মানেনা আপনি মোড়ল। রাশিয়ান চ্যানেলগুলিকে নিষিদ্ধ করে জনগণের পছন্দকে হ্রাস করা সহ তথ্যে অবাধ অ্যাক্সেসের অধিকারকে লঙ্ঘন করেছে পশ্চমা বিশ্ব।
এই নিষেধাজ্ঞার মাধ্যমে মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে আপস করার একটি অনন্য উদাহরণ সৃষ্টি হলো যা পশ্চিমে অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত এবং গৌরবান্বিত উদার গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার একটি মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী । এটা শুধু সংবাদপত্রের স্বাধীনতা লঙ্ঘনই নয়, রাশিয়াকে কোন ঠাসা করার দীর্ঘমেয়াদী এক ষড়যন্ত্র! মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ফক্স নিউজ এবং সিএনএন-এর মতো কেবল নেটওয়ার্কগুলি কখনও কখনও একে অপরকে বিভ্রান্তি ছড়ানোর জন্য অভিযুক্ত করেছে, কিন্তু কেউই অপরটিকে নিষিদ্ধ করার আহ্বান জানায়নি। এ থেকেই পরিস্কার যে রাশিয়ার প্রশ্নে বাক-স্বাধীনত বা গনতন্ত্রের লঙ্গনও ন্যায্যতার মধ্যে পরে। পশ্চিমা বিশ্বের এই দুমুখী নীতি গনতান্ত্রীক ও মানবীক সমাজের অগ্রগতির অন্তরায়। একজন ইংলিশ লেখক এবং দার্শনিক ইভলিন বিট্রিস হল ১৯০৬ সালে ফরাসি দার্শনিক ভলতেয়ারের উদ্দেশে বলেছিলেন “আপনার কথার সাথে আমি হয়তো একমত হতে পারছি না তবে আপনার বলার অধিকার আমি আমৃত্যু রক্ষা করবো”। এটাই বাক স্বাধীনতা এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতার মূল মন্ত্র।