সাড়া পৃথিবী আজ এক ভয়াবহ পরিস্থিতির সন্মূখীন। একদিকে রাশিয়ার মিসাইল আর রকেট হামলায় জ্বলছে ইউক্রেইন, ধ্বংশযজ্ঞে পরিনত হচ্ছে শহরের পর শহর, মরছে সাধারন মানুষ, তছনছ হয়ে যাচ্ছে জাতীয় অবকাঠামো, উদ্বাস্ত হচ্ছে লক্ষ লক্ষ মানুষ, প্রানের ভয়ে নিজের হাতে গড়া বাড়ী-ঘর ছেড়ে পালাচ্ছে ইউক্রেনবাসী। যুদ্ধ শুরু হওয়ার শুধু প্রথম সপ্তাহেই প্রায় এক মিলিয়নেরও বেশী শরনার্থী সীমানা অতিক্রম করে। তাকিয়ে আছে বিশ্ববাসী অবাক চোখে নির্বাক হয়ে। আর অন্যদিকে পশ্চিমা বিশ্ব মেতে আছে রাশিয়াকে একের পর এক নিষেধজ্ঞার বেড়াজালে জব্দ করার প্রমত্ততায়। যুদ্ধ থামানোর পরিকল্পনা বা কোন সদিচ্ছা যুক্তরাষ্ট্র সহ ন্যাটোভুক্ত দেশগুলির কারো মধ্যেই নেই।বরং আগুনের মধ্যে ঘি ঢালার ব্যাপক প্রস্তুতি। এই সংকটকে কেন্দ্র করে তিনভাগে বিভক্ত এই বিশ্বায়ন আর প্রযুক্তির আধুনিক বিশ্ব। একদিকে যুক্তরাষ্ট্র এবং ন্যাটো দেশভুক্তসহ তার মিত্র দেশগুলি যারা ইউক্রেনের পক্ষে এবং রাশিয়ার পরাজয়কে নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সব ধরনের অর্থনৈতিক, সামরিক আর মানবিক সহায়তা দিচ্ছে, অন্যদিকে রাশিয়ার এই যুদ্ধকে ন্যায্য বলে সমর্থন করছে অনেক দেশ যার মধ্যে চীন, বেলারুশ, ইরান, কাজাকস্থান, কিরগিজস্থান, আর্মেনিয়া, ক্রোয়েশিয়া, সিরিয়া, কিউবা সহ আরো বেশ কিছু মিত্রদেশ। জনসংখ্যার বিচারে এই দেশগুলো পৃথিবীর জনসংখ্যার পঞ্চাশ শতাংশেরও বেশী। নিরপেক্ষ দেশগুলির মধ্যে আছে ইন্ডিয়া, আরব আমিরাত সহ বেশ কিছু দেশ। যেখানে পৃথিবীর এক-চতুর্থাংশ জনগনের বাস। সুতরাং রাশিয়া-ইউক্রেইনের এই যুদ্ধে ইউক্রেইন সহ পশ্চিমা বিশ্ব এবং তার মিত্র দেশগুলির সমর্থন শুধুমাত্র এক-চতুর্থাংশ জনগনের। অর্থাৎ সাড়া বিশ্ব পশ্চিমাদের সাথে নেই। অথচ এই যুদ্ধকে ঘিরে ন্যাটোভুক্ত দেশগুলির তর্জন-গর্জনের কমতি নেই। তার একমাত্র কারন সম্পদ আর প্রাচুর্যে ভরা পশ্চিমা দেশগুলির কাছে অন্য দেশগুলির কোন সম মূল্যায়ন নেই কিংবা কোন গুরুত্বপূর্ন নয়। কারন পৃথিবী যে জোর যার মূল্লুক তার নিয়মেই চলছে। মানুষ, মানবতা, সভ্যতা, ভদ্রতা আর নম্রতা সবই অপ্রয়োজনীয় অন্ততপক্ষে সাম্রাজ্যবাদী আর পুঁজিবাদীদের কাছে। সভ্যতায় কি বন্যতা! এক অসহনীয় বেঁচে থাকার পুঁজিবাদী দর্শন! কিন্তু কেন? কেন এই বিভীষিকা? দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউক্রেইনের এই যুদ্ধ নিয়ে আসছে ইউরোপের সবচেয়ে বড় সংকট যা ১৯৯০ সালের বলকান যুদ্ধের বিভীষিকার মাত্রাকেও ছাড়িয়ে গেছে ইতিমধ্যে। বর্তমান গতি যদি বজায় থাকে তা হবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সবচেয়ে বড়ো শরনার্থী সংকট। এই ভয়াবহ পরিস্থিতিকে একটু ভালো করে বুঝতে হলে আমাদেরকে একটু পিছনে তাকাতে হবে।
আজকের এই লেখায় ২০১৪ সালে ইউক্রেইনের রাজধানী কিয়েভের স্বাধীনতা চত্বরে যা ইউরো ময়দান নামে সুপরিচিত গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত নিরপেক্ষ সরকারকে প্রতিস্থাপন করা সহ কিভাবে একটি তীব্র রুশ-বিরোধী সরকার গঠন এবং একটি সহিংস অভ্যুত্থান সূত্রপাত হয়, যেখানে শতাধীক মানুষ প্রান হারায় সেই সম্পর্কেই আলোকপাত করবো। পশ্চিমা বিশ্বের মধ্যে একটি মিথ রয়ছে যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং রাশিয়ার মধ্যে 'নতুন কোন ঠান্ডা যুদ্ধ' শুরু হয়নি। ইউক্রেন থেকে ক্রিমিয়া এবং ডনবাসকে বিচ্ছিন্ন করার ক্ষেত্রে রাশিয়ার জড়িত থাকার ব্যাপারটি কোন আকস্মিক ঘটনা নয়। ২০১৪ সাল থেকেই ইউক্রেইনের রাশিয়ার প্রতি তীব্রভাবে শত্রুতা লক্ষ্য করা যায়। ময়দান বিপ্লব নিছক কোন জনগনের বিপ্লব নয় বরং এই অভ্যুত্থান মার্কিন সরকার দ্বারা সংগঠিত হয়েছিলো। সেই সময় থেকেই বলা যায় মার্কিন সরকার 'নতুন করে ঠান্ডা যুদ্ধ' শুরু করেছিলো। আমরা সবসময়ই দেখেছি রাশিয়ার সরকার আমেরিকার আগ্রাসনের প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিলো বার বার। ১৯৬২ সালে কিউবান ক্ষেপণাস্ত্র সংকটের সময় আমেরিকার সীমানা থেকে ১০৩ মাইল দূরে সোভিয়েত পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্রগুলি যেমন ভয়ের কারণ ছিলো মার্কিনীদের কাছে। ঠিক তেমনি, ২০১৪ সালে আমেরিকার ইউক্রেনীয় অভ্যুত্থানের পর, রাশিয়ার একই পরিস্থিতি হওয়াটাই সঙ্গত যেহেতু ন্যাটো পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্রগুলি রাশিয়ার সীমান্তের কাছাকাছি রাখার এক সুদূর প্রসারী পরিকল্পনা করছিল যুক্তরাষ্ট্র। ময়দান অভ্যুত্থানে যুক্তরাষ্ট্রের সরসরি মদদই তার প্রমান।
ইউক্রেইন-রাশিয়া সংঘাত এখন একটি বিপদজনক পর্যায়ে রয়েছে। রুশ প্রসিডেন্ট বার বার ন্যাটোভুক্ত দেশগুলিকে সতর্ক করে আসছিলো যে ইউক্রেইকে যেন ন্যাটো সদস্যপদ দেওয়া থেকে বিরত থাকে এবং কোন ধরনের সামরিক স্থাপনা নির্মান করা না হয় এবং তার লঙ্ঘন মানে রেড লাইন ক্রস করার সামিল। পুতিনের দাবীক উপেক্ষা করে বরং ন্যাটোভুক্ত দেশগুলি রুশ প্রসিডেন্টকে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র ইউক্রেইনে প্রভাব বিস্তারের লক্ষ্যে ইউক্রেইনে সীমান্ত সংকট উসকে দেওয়ার পালটা অভিযোগ করে আসছিলো। পশ্চিমাদের দাবী ইউক্রেইনের জনগন ময়দান বিপ্লবের মাধ্যমেই তদানীন্তন রাষ্ট্রপতি ভিক্টর ইয়ানুকোভিচকে ক্ষমতাচুৎ করার পর রাশিয়া অন্যায়ভাবে ক্রিমিয়া দখল করে এবং রুশ প্রক্সিদের সহায়তায় ডনবাসের বিদ্রোহীদের সাথে ইউক্রেইনের একটি ভয়াবহ যুদ্ধ বাধিয়ে দেয়। পশ্চিমারা মনে করে যে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে ইউক্রেইনের পুরো অধিকার রয়েছে ইইউ এবং ন্যাটোতে যোগদন করার। অন্যদিকে রাশিয়া মনে করে যে ২০১৪ সালের পর থেকে ইউক্রেইন ন্যাটো বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের অঙ্গুলী হেলনে চলছে এবং ডনবাসকে একটি স্বাধীন অঞ্চল বলে মনে করে।
ক্যানাডিয়ান ডাইমেনশনে প্রকাশিত ইভান কাটচানভস্কির (২২ শে জানুয়ারী ২০২২) লেখা এক প্রবন্ধের তথ্যানুসারে কয়েক ডজন প্রসিকিউশনের সাক্ষ্য সমেত প্রায় শতাধীক আহত বিক্ষোভকারীর সাক্ষ্য, সরকারী ফরেনসিক এবং মেডিক্যাল পরীক্ষানুসারে ২০শে ফেব্রুয়ারী ময়দানে অবস্থানরত অতি ডানপন্থী বিরোধীদলীয় সদস্যদের দ্বারা গনহত্যা সংগঠিত হয়েছিলো। গনতান্ত্রীক ভাবে নির্বাচিত সরকারের হিংসাত্মক অপসারনের কারনেই আমরা দেখতে পাই দনবাসের সংকট। গত আট বছরে প্রায় পনের হাজারেরও বেশী মানুষ নিহত হয়েছে। পশ্চিমা বিশ্বের সরাসরি মদদে, এবং আর্থিক সহায়তায় এই ময়দান অভ্যুত্থান হয়েছিলো যার ধারাবাহিকতা অভ্যুত্থান পরবর্তী ঘটনাগুলো। ভিক্টোরিয়া নুল্যান্ড, ন্যাটোর একজন প্রাক্তন মার্কিন রাষ্ট্রদূত এবং ২০১৩ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন এবং ইউক্রেইন অভ্যুত্থানের খলনায়ক। শুধুমাত্র ইউক্রেনীয় প্রো-রাশিয়ান সরকারকে উৎখাত করার ক্ষেত্রেই নয়, বরং তীব্রভাবে রুশ-বিরোধী মনোভাব তৈরী করা সহ নতুন নির্বাচনের মাধ্যমে প্রো-ন্যাটো বা ইউরোপীয় পন্থী সরকার প্রতিস্থাপন করার ক্ষেত্রে নুল্যান্ডসহ আরো অনেকেই গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা পালন করেছিলো। জানুয়ারীর ২৭তারিখ ২০১৪ সালে নুল্যান্ড এবং ইউক্রেনে আমেরিকার রাষ্ট্রদূত, জেফ্রি পাইটের মধ্যে ফোন-কথোপকথনটি ছিল একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা যা বিবিসিতে ফেব্রুয়ারীর চার তারিখ ইউটিউবে আপলোড করা হয়েছিলো। সেই কথোপকথন থেকেই পরিস্কার হওয়া যায় যে যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেইনে একটি পুতুল সরকার বসিয়ে কিভাবে রাশিয়াকে অস্থিতিশীল রাষ্ট্রে পরিনত করার সুদূর প্রসারী পরিকল্পনা নিয়েছিলো। তাই ময়দানে যা ঘটেছিলো তা ছিলো একটি পরিকল্পিত অভ্যুত্থান এবং মোটেও গণতান্ত্রিক বিপ্লব' ছিল না। গণহত্যা ছিল পরিকল্পিত যা সরকারকে উৎখাত এবং ক্ষমতা দখলের লক্ষ্যে পরিচালিত হয়েছিল।
ভিকটর ইয়ানুকোভিচ ইউরোপীয় ইউনিয়নে যোগ না দেওয়ার এক চুক্তিতে সই না করার প্রেক্ষিতে ২০১৩ সালের নভেম্বরের শেষের দিকে ইউক্রেইনের রাস্তায় রাস্তায় প্রতিবাদ মিছিল শুরু হয়। রাজধানী কিয়েভের ইউরো ময়দানে এই প্রতিবাদ সভা আরো বেগবান হতে থাকে এবং বিক্ষোভকারিরা ময়দানেই অবস্থান শুরু করে। যার পরিপ্রেক্ষিতে বিক্ষোভকারীদের উপর দমন পীড়ন শুরু হয়। সরকার জানুয়ারীর ১৬ তারিখ সুশীল সমাজ এবং প্রতিবাদ করার নাগরিক অধিকারকে সীমিত করার জন্যে বেশ কিছু আইন প্রনয়ন করেন যার কারনে ময়দান বিক্ষোভ আরো মাথা চাড়া দিয়ে উঠে এবং হিংসাত্মকে রুপ নেয়। শতাধীক বিক্ষোভকারী প্রান হারায় স্নাইপারদের গুলিতে। ময়দান বিক্ষোভে অভ্যন্তরীণ বিরোধী দল বা ওয়াশিংটন এবং তার ইউরোপীয় ইউনিয়নের মিত্রদের জঘন্য আচরনের কারনেই আমরা দেখতে পাই ইউক্রেনের ময়দানে 'স্নাইপারদের গণহত্যা'। যুক্তরাষ্ট্র সহ পশ্চিমা দেশগুলি ইইউ চুক্তি অনুমোদন না করলে তারা ইয়ানুকোভিচকে মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই অপসারণ করতে বিক্ষোভকারীদের প্রচেষ্টাকে সমর্থন করেছিলেন। সেনেট আর্মড সার্ভিসেস কমিটির র্যাঙ্কিং রিপাবলিকান জন ম্যাককেইন ইউরোময়দান বিক্ষোভকারিদের সাথে সংহতি প্রকাশ করতে কিয়েভে গিয়েছিলেন। ম্যাককেইন বিরোধী নেতাদের সাথে একসাথে ভোজন করেন, যার মধ্যে অতি-ডানপন্থী সোভ্বোদা পার্টির সদস্যরাও ছিলেন এবং পরে ময়দান স্কোয়ারে একটি গণ সমাবেশে মঞ্চে উপস্থিত হন। তিনি সোভ্বোদা নেতাদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। তাই যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমা দেশগুলি যখন স্বাধীনতা, স্বার্বভৌমত্ব আর আঞ্চলিক অখন্ডতা নিয়ে কথা বলে বা অন্যকে লেকচার দেয় তখন ভূতের মূখে রাম নাম জপার মতোই মনে হয় না কি?
এই লেখাটি যখন লিখছি স্কাই নিওজে শুনছি ইউরোপের সর্ববৃহৎ পারমানবিক বিদুৎ কেন্দ্র আক্রান্ত এবং রাশিয়ান সৈন্যদের দখলে। আতংকে গোটা বিশ্ব। আর এই সময়েই বার বার মনে পড়ছে আমার এক অগ্রজ অত্যন্ত বিনয়ী, নম্র একজন দক্ষ প্রকৌশলী যিনি দীর্ঘদিন যাবৎ বাংলাদেশে বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের ব্যাবস্থাপনার পদে নিয়োজিত ছিলেন এবং বর্তমানে অনেকদিন যাবৎ যুক্তরাজ্যে বসবাস করছেন তার কয়েকটি কথা। খুব বিষন্নভাবেই বলছিলেন-যুদ্ধ মানেই মানুষের প্রাণহানি, মানুষের দুর্ভোগ, রোগের বিস্তার, মানুষের বাস্তুচ্যুতি এবং পরিবেশের ধ্বংসের কারণে অর্থনৈতিক ক্ষতি। ১৯৭১-এ আমি যুদ্ধের বিভীষিকা দেখেছি, এখনো বুলেটের শব্দ কানে বাজে। তাই আর যুদ্ধ নয়। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের একটা নিয়ম ছিলো। এখনকার যুদ্ধে কোন নিয়ম নেই শুধু ধ্বংশযজ্ঞ আর জীবন কেড়ে নেওয়া ছাড়া। সত্যেই তাই। সুস্থ মানুষ কখনো ধ্বংশ চায় না। আমরা কেউ যুদ্ধ চাইনা। শান্তি এবং সাম্যতাই হোক শান্তিপ্রিয় মানুষের একমাত্র কাম্য। পৃথিবীর কোন বলিষ্ট নেতার কি আদৌ আবির্ভাব হবে? যিনি প্রত্যয়ের সুরে বিশ্ববাসীকে শান্তির বানী শুনাবেন এবং কবি সুকান্তের মতো দীপ্ত কন্ঠে উচ্চারন করবেন “তবু আজ যতক্ষন দেহে প্রান আছে, প্রানপণে পৃথিবীর সরাব জন্জাল, এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাবো আমি-নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার”