আমরা যখন আধুনিক সমাজে বুদ্ধিমান বা বুদ্ধিশালীদের (যার ইংরেজী হলো ইন্টেলেকচুয়াল যা বাংলায় বুদ্ধিজীবী হিসেবেই সবচেয়ে বেশী পরিচিত) ভূমিকা নিয়ে কথা বলি, তখন তাকে অল্প কথায় কিংবা সহজ ভাবে ব্যক্ত করা অথবা সংজ্ঞায়িত করা এত সহজ কাজ নয়, বরং কেন জানি এটি একটি সবচেয়ে জটিল বলেই মনে হয়। অন্ততঃ আমার কাছেতো বটেই। আজকের ক্রমবর্তমান প্রযুক্তি এবং বিজ্ঞানের উন্নতির যুগে আমাদের সকলের জন্যেই সময়ের সাথে সামঞ্জস্য রেখে দৈনন্দিন জীবনের চাহিদা সঠিকভাবে পূরন করার জন্য প্রয়োজন হয়ে পড়েছে দুই ধরনের জ্ঞান। প্রথম জ্ঞানটি হলো জাগতিক-আধ্যাত্মিক এবং আর্থিক জ্ঞান যা প্রাত্যাহিক জীবনকে সহজ এবং বাঁধাহীনভাবে পরিচালিত করার জন্য অতীব গুরুত্বপূর্ন। আর্থিক সচেতনতা না থাকলে আমাদের জীবন নানা ধরনের সমস্যায় জর্জরিত হতে পারে এবং অনেক ক্ষেত্রে শোষিতরা শোষকদের রোষানলে সহজেই পরতে পারে। আর আমাদের প্রথম জ্ঞানটিকে সঠিক ও যথাযথভাবে প্রয়োগের নিমিত্তে প্রয়োজন খুব সুক্ষ এবং ধারালো বুদ্ধি। আমার আজকের আলোচনার মূল বিষয় তথাকথিত বুদ্ধিশালীদের ভূমিকা নিয়ে। কারন দিন দিন বিশেষ করে তথাকথিত বুদ্ধিমানদের (বুদ্ধিজীবি!) আনাগোনা এবং দাপট্য বেড়েই চলেছে লাগামহীন ঘোড়ার মতো। তবে এটা স্পষ্ট করে নেওয়া ভালো যে, আজকের দ্রুত আধিপত্যবাদী এবং অসম সমসাময়িক সমাজে, সত্যিকারের বুদ্ধিমানদের (তারা কিন্তু বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে নন, বরং বুদ্ধিশালী!) সমালোচনামূলক দৃষ্টিভঙ্গী এবং উৎপাদনশীল বাস্তব ভূমিকার প্রভাব অনস্বীকার্য। এই জ্ঞানী ব্যক্তিদের বিভিন্ন জ্ঞান, গভীর বোঝাপড়া এবং প্রজ্ঞা আছে বলেই সমাজ এবং সমাজ ব্যবস্থা এগিয়ে চলেছে। ইতিবাচক সামাজিক মূল্যবোধ এবং দৃষ্টিভঙ্গি চালানোর ক্ষমতা তাদের আছে। অতএব, সেই অর্থ তারা সত্যিকারের বুদ্ধিদ্বীপ্ত এবং প্রভাবশালী। আমার আজকের আলোচনা তথাকথিত বুদ্ধিশালীদের নিয়ে অর্থাৎ যারা সত্যিকার অর্থে বুদ্ধিশালী নন কিন্তু সর্বদা তার মুখোশ পরে সর্বত্র দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন। এরাই হলেন আমাদের সকলের পরিচিত বুদ্ধিজীবি যার সহজ মানে হলো বুদ্ধি ব্যবহার (নাকি বিক্রি!)করে জীবকা অর্জন করা।
বুদ্ধিশালীরা (intellectual) হলেন বিভিন্ন প্রজ্ঞা, জ্ঞান এবং নিরপেক্ষ অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন একজন দূরদর্শী দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারী। তারা সামাজিক অগ্রগতি এবং সমৃদ্ধিকে উৎসাহিত করতে পারেন এবং সর্বদা তাদের বিশ্বাস, দৃষ্টিভঙ্গি এবং ধারণার পরিবর্তন করে সমাজকে জাগ্রত করার জন্য কাজ করে থাকেন। তাদের আরও বেশি জ্ঞানী, ধার্মিক এবং নৈতিক হওয়ার জন্য মানুষকে অনুপ্রাণিত করার তীব্র ক্ষমতা রয়েছে। তারা মানুষকে সুপথে চলার নির্দেশনা দেন এবং যে কোন ধরনের মূর্খ এবং ভুল কাজ কিংবা ভ্রান্ত চিন্তাভাবনা এড়াতে সকলকে সাহায্য করেন। এই বিচক্ষণ ব্যক্তিরা সর্বদা সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনা, পর্যবেক্ষণ, প্রতিফলন এবং গবেষণার মাধ্যমে বিভিন্ন সামাজিক সমস্যাগুলিকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য সর্বদা নিযুক্ত থাকেন। কিন্ত দূর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি যে, সমাজের অনেক বুদ্ধিশালী আছেন (আসলে তথাকথিত বুদ্ধিজীবি!) যারা ভাল কাজের জন্য কিছু করতে বাধ্য বোধ করেন না, এবং কোন সামাজিক ও নৈতিক দায়িত্ব আছে বলেও বলে মনে করেন না। অথচ অর্থের বিনিময়ে যত্র তত্র মিথ্যার বেসাতী করতে কারো তোয়াক্কা করেন না। কারন এটাই যে তাদের পেশা এবং নেশাও বটে। এই তথাকথিত পণ্ডিতদের সম্বোধন করার জন্য, আইনস্টাইন একটি চমৎকার এবং শিক্ষনীয় উক্তি করেছিলেন: "পৃথিবী একটি বিপজ্জনক জায়গা বটে। কিন্তু যারা মন্দ কাজ করছে তাদের কারনে নয়, বরং তাদের জন্য যারা দেখে এবং শুনে কিছুই করছে না বা বলছে না"। অতএব, সত্যিকারের বুদ্ধিজীবীদের তাদের গভীর জ্ঞান এবং প্রজ্ঞা দিয়ে সমাজের উন্নতির জন্য সামাজিক আদর্শকে লালন করা একটি নৈতিক ও নাগরিক দায়িত্ব। তারাই মানবজাতির অর্থপূর্ণ উপায়ে উন্নতি করতে সহায়ক হতে পারে কারণ তারাই ইতিবাচক পরিবর্তনের প্রাথমিক এবং নির্ভরযোগ্য এজেন্ট।
ইতিহাস বলছে, সারা বিশ্বে বুদ্ধিজীবীদের সঠিক হস্তক্ষেপের কারণে অনেক সামাজিক পরিবর্তন এবং বিপ্লব ঘটেছে। ফরাসি পণ্ডিতরা ব্যাপক রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবর্তনের সময় ফরাসি বিপ্লবে বিশেষ অবদান রেখেছিলেন (১৭৮৯-১৭৯৯)। তাদের বিপ্লবী এবং আমূল সামাজিক পরিবর্তনের ধারণা মানুষের মনোভাব এবং বিশ্বাসের উপর বিরাট প্রভাব ফেলেছিল, যা তাদের অধিকার আদায়ের জন্য তাদের সংগ্রাম করতে সাহায্য করেছিলো। রুশো, ভলতেয়ারের মতো ফরাসি বুদ্ধিজীবীরা জনগণকে নৈরাজ্য ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করতে অনুপ্রাণিত করেছিলেন। রাশিয়ায় ভ্লাদিমির ইলিচ উলিয়ানভ লেনিনের (Vladimir Ilyich Ulyanov Lenin) নেতৃত্বে ১৯১৭ সালের অক্টোবর বিপ্লব এবং তার বুদ্ধিজীবী কমরেডরা বলশেভিক আন্দোলনের মাধ্যমে জারিস্ট সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই করে এবং ক্ষমতা দখল করেন। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলন এবং ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের সময়, বাঙালি বুদ্ধিজীবীরা অনেক ফ্রন্টে যুদ্ধে নিযুক্ত ছিলেন এবং অসম সাহসের সাথে বর্বর পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর মুখোমুখি হয়েছিলেন। সাংস্কৃতিক ও ভাষাগতভাবে পূর্ব বাংলাকে প্রভাবিত করার জন্য পশ্চিম পাকিস্তানের প্রচেষ্টাগুলি এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছিলো যে শেষ পর্যন্ত পূর্ববাংলার জনগন স্বাধীন ও মুক্ত হওয়ার দাবি করেছিলো। বাঙ্গালী ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো স্বাধীনতা সংগ্রামে। মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন এই শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ চিন্তাবিদ, শ্রেষ্ঠ বাঙ্গালী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁর সামাজিক ধারণা, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সমস্যা সম্বন্ধে সম্যক জ্ঞান এবং উপলব্ধি এবং জনসাধারণকে জাগ্রত করার অসীম ক্ষমতা পাকিস্তানের অন্যায় ও বর্বর নিপীড়নের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য জনসাধারণের অনুপ্রানিত করেছিলো এবং শেষ পর্যন্ত একটি স্বাধীন রাষ্ট্রে পরিণত করে। স্বাধীনতা যুদ্ধে জাতি তার সেরা এবং সর্বশ্রেষ্ঠ বুদ্ধিজীবীদের হারিয়েছে, যারা বিভিন্ন পেশা থেকে এসেছিলো। তারাই ছিলো জাতীর সত্যিকারের বুদ্ধিশালী এবং চিন্তাবাদ। সত্যিকারের বুদ্ধিজীবি।
বুদ্ধিজীবীরা সবসময় সমাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। তারা সকলেই হয়তো সুশীল সমাজের সদস্য, লেখক, সাংবাদিক, আইনপ্রণেতা, শিক্ষাবিদ বা রাজনৈতিক। সামাজিক বিবর্তন ও সমৃদ্ধির উপর তাদের প্রভাব অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য। এই প্রবন্ধটি সেইসব বুদ্ধিজীবীদের উপর ফোকাস করবে না যারা রাষ্ট্রীয় মতাদর্শ এবং তাদের নিজস্ব ধারণার প্রচার করতে আগ্রহী এবং , অনেক ক্ষেত্রে, সমাজে বিভেদ এবং সমস্যা সৃষ্টি করে থাকে। প্রবন্ধটি মূলত সেইসব বুদ্ধিশালীদের উপর মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করবে যারা রাজনৈতিক বা কোন নির্দিষ্ট মতাদর্শের মাপকাঠির মধ্যে নেই এবং যারা প্রতিনিয়ত কোন পক্ষপাত এবং জল্পনা ছাড়াই সত্য খুঁজে বের করার চেষ্টা করে, মূলতঃ একাডেমিক বুদ্ধিজীবীরা। এই ধরণের বুদ্ধিজীবীরা সাধারণত কোন বিশেষ মতাদর্শের পক্ষপাতী হন না বা কোন নির্দিষ্ট ধারনাকে অন্ধভাবে সমর্থন করেন না। কোনধরনের, পৃষ্ঠপোষকতা, কুসংস্কার, অহংকার বা বাহ্যিক চাপ তাদের ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত, জ্ঞান এবং বোঝাপড়াকে পরিবর্তন করতে পারে না।
কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, বর্তমান বিশ্ব ছদ্ম-বুদ্ধিজীবীদের দ্বারা পরিপূর্ণ। এগুলো হলো মুক্তবাজার অর্থনীতির ফসল এবং বিশ্বায়নের সাথে বেড়ে উঠা পচে-ওঠা পুঁজিবাদী মতাদর্শ। এই ছদ্ম-বুদ্ধিজীবীরা আমাদের জীবনের সব অংশে খুব সক্রিয়। ১৯৫৪ সালে “অর্থনৈতিক বিশ্লেষণের ইতিহাস” বই-তে, জে এ শাম্পিটার (J. A Schumpeter) তথাকথিত বুদ্ধিজীবীদের মানসিকতা এবং তার সময়ের অসুস্থ অর্থনৈতিক দূরাবস্থার মনোভাব ব্যাখ্যা করতে গিয়ে লিখেছিলেন যে “অনেক মার্কসীয় এবং কেনেসিয়ান বুদ্ধিজীবী আছেন যারা কখনো মার্ক্সের বা কেনেসিয়ানের কোন লেখার একটি লাইনও পড়েননি ”। কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মার্ক লিলা ২০০১ সালে তার "বেপরোয়া মন: রাজনীতিতে বুদ্ধিজীবী" (Reckless Mind: Intellectuals in politics) -এ একটি উল্লেখযোগ্য মন্তব্য করেছিলেন যে এখানে অনেক মহৎ অধ্যাপক, লেখক, সাংবাদিক এবং প্রতিভাধর ব্যক্তি রয়েছেন যারা আধুনিক অত্যাচারীদের ধারণাকে বিশ্ব মঙ্গলের সহায়ক বলে সমর্থন করছে এবং তাদের অনৈতিক অপরাধকে সমর্থন করছে মহৎ কর্ম হিসাবে।
সমাজের অনেক মূর্খ ও অনৈতিক বুদ্ধিজীবীরা জনসাধারণের মধ্যে ক্রমাগত গোলযোগ ও বিভ্রান্তি সৃষ্টি করছে, বেশিরভাগই ইচ্ছাকৃতভাবে। অতএব, প্রজ্ঞা বা জ্ঞান সবসময় বুদ্ধি হয় না। পশ্চিমা বিশ্বের অনেকের জন্য, কার্ল মার্ক্সের ধ্রুপদী বই "দ্য ক্যাপিটাল" 'শ্রম' এবং 'উৎপাদন' ধারণার একটি মৌলিক ভুল ব্যাখ্যা হিসাবে বিবেচিত হয়ে আসছে দীর্ঘদিন ধরেই। একটি ক্ষয়িষ্ণু পুঁজিবাদী মতাদর্শের পক্ষে এই জাতীয় ধ্রুপদীয় ধারণা সঠিক হিসাবে পশ্চিমারা গ্রহন না করলেও, কার্ল মার্ক্সের ধারনা সমাজ এবং লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবনে গভীর প্রভাব ফেলতে সক্ষম হয়েছে। আজকের সবচেয়ে বিশৃঙ্খল বৈশ্বিক পরিবেশে, যখন পুঁজিবাদের বর্তমান অবস্থা সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ, মার্কসবাদী ধারণাগুলি আগের চেয়ে আরও গুরুত্বপুর্ন এবং প্রয়োজনীয় হয়ে উঠেছে।
আমি জানি পশ্চিমের বর্তমান বুদ্ধিবৃত্তিক মানসিকতা গত শতাব্দীর চেয়ে আলাদা নয়। সমসাময়িক পুঁজিবাদ মিডিয়া, শিক্ষাবিদ, সরকার এবং রাজনীতিতে অত্যন্ত সক্রিয় বুদ্ধিজীবীদের সাম্রাজ্য তৈরি করেছে। আজকের অনেক পণ্ডিতের বুদ্ধির কোন উপাদান নেই বরং তোষামোদ আর স্তুতির আস্ফালনে পরিপুর্ন। আর এই কারনেই আমাদের সমাজ আরো দুর্বল হয়ে পড়ছে দিন দিন। সাধারন জনগন তাদেরকেই অন্ধের মতো অনুসরণ করে, এবং এই বুদ্ধিজীবীরাই মানুষের আচরণ, দৃষ্টিভঙ্গি এবং বিশ্বাসকে পরিবর্তন করতে পারে দ্রুত। একজন সত্যিকারের বুদ্বিশালী ব্যক্তির অবশ্যই বুদ্ধি এবং বিচারের অধিকারী হতে হবে। কিন্তু আজকের বুদ্ধিশালীদের (তথাকথিত বুদ্বিজীবি!) আমাদের আজকের বুদ্ধিজীবীদের অনেকেই বুদ্ধিহীন এবং জ্ঞানহীন বুদ্ধিজীবী, যা একটি সমাজের জন্য বিপজ্জনক। জ্ঞানের জন্য, একজন ব্যক্তির প্রয়োজন বিশ্বের বাস্তবতা এবং স্ব-শৃঙ্খলা বোঝার ক্ষমতা। মূর্খতা হলো প্রজ্ঞার বিপরীত, আর নিস্তেজতা বুদ্ধির বিপরীত। সমাজে নিস্তেজতা এবং মূর্খতায় পরিপুর্ন অনেক বুদ্ধিজীবী আছে যারা সমাজের জন্যে অত্যন্ত ভয়ানক।
সমাজের সব শিক্ষীতরাই বুদ্ধিজীবী নন, যদিও তারা প্রকৌশলী, চিকিৎসা ডাক্তার, আইনজীবী এবং প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞদের মতো জটিল এবং পেশাগত কার্যকলাপের সাথে মোকাবিলা করতে পারে। লেখক, সাংবাদিক, শিক্ষাবিদ এবং সমমনা পেশাজীবীদের মতো প্রাথমিক পেশা হিসেবে বা ধারণা নিয়ে যারা কাজ করেন এমন যে কেউই বুদ্বির প্রধান এজেন্ট। অতএব, বিশাল মস্তিষ্কের শক্তি, উদ্ভাবন ক্ষমতা, প্রতিভা কিংবা বিল গেটস, অ্যালন মাস্ক, রিচার্ড ব্র্যানসন বা জ্যাক মা -এর মতো বিশ্বব্যাপী সাফল্য সত্ত্বেও, বিশ্বের শীর্ষ পাবলিক ব্যক্তিত্বরা বুদ্ধিজীবী নন। অন্যদিকে, অ্যাডাম স্মিথ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, জোসেফ শুমপেটার, কার্ল মার্কস, এবং টমাস ফ্রিডম্যান হলেন সবচেয়ে বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী।যারা তাদের কাজ শুরু করেন এবং শেষ করেন ধারণা এবং ধারনার প্রচারের মাধ্যমে। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে চিন্তা এবং নতুন নতুন ধারনার বিন্যাস একাডেমিক জগতের মূল এবং বুদ্ধিজীবীদের কাজের মূল চাবিকাঠি। অতএব, যদি এই ধারণাগুলি কিংবা চিন্তা-চেতনাগুলিকে ভালভাবে পরিচালনা না করা হয়, তবে এটি সবার জন্য বিপজ্জনক হতে পারে। এটা আমরা সবাই গত কয়েক দশক ধরে দেখছি, বিশেষ করে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার বা কমিউনিজমের পতনের পর।
ছদ্ম-বুদ্ধিজীবীরা আজকের সমাজে বেশি সক্রিয়। একাডেমিয়া এখন ছদ্ম-বুদ্ধিজীবীদের দ্বারা পরিপূর্ণ যারা তাদের বিভ্রান্ত, অগভীর, অনৈতিক, অসাধু এবং বিপদজনক ধারণার মাধ্যমে সমাজের ব্যাপক ক্ষতি করছে। যেহেতু বুদ্ধিজীবীরা সমাজকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে, বুদ্ধিজীবীদের অবশ্যই কোনো ধরনের পক্ষপাত বা দুর্নীতিগ্রস্ত উদ্দেশ্য ছাড়া আচরণ এবং কাজ করতে হবে। তাদের আচরণ, মনোভাব এবং বিশ্বাস তাদের প্রকৃত পরিচয় প্রতিফলিত করা উচিত। কিন্তু, দুঃজনক হলেও সত্য যে, অনেক তথাকথিত একাডেমিক বুদ্ধিজীবীরা বাস্তব তথ্য ফিল্টার করে বা নতুন তথ্য বানানোর মাধ্যমে তাদের নিজস্ব বাস্তবতা তৈরি করে; অনেক ক্ষেত্রে, তারা ইচ্ছাকৃতভাবে ব্যক্তিগত বিশ্বাসের বিপরীতে করে শুধু মাত্র কোন দল বা গোষ্ঠীকে খুশী করার জন্যে বা স্বীয় কোন স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্যে। শুমপেটারের মতে, কিছু বুদ্ধিজীবী আরও অনেকদুর এগিয়ে যাবে এবং এমনকি তাদের আদর্শকে জলান্জলী দিয়ে সত্যকে মিথ্যা বলতে দ্বিধা করবে না। তারা তাদের বা তাদের দোষরদের উপযোগী নমুনা নির্বাচন করবে, প্রকৃত ঘটনাগুলিকে দমন করবে অথবা শব্দ, লাইন বা বাক্যগুলির অসুবিধাজনক অর্থ ও তাৎপর্য খুঁজে বের করবে।
কোন কোন সত্যিকারের বুদ্ধিজীবী জনসাধারণের কাছে হয়তো বেশী পরিচিত নয় বা খুব কম পরিচিত, কিন্তু তারা এখনও সমাজকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করতে পারে, যেমন কার্ল মার্কস, ফ্রেডেরিক হায়েক, সিগমুন্ড ফ্রয়েড। তাদের অন্যান্য বুদ্ধিজীবীদের প্রভাবিত করার বিশেষ ক্ষমতা আছে, যারা তখন এই সত্যিকার বুদ্ধিজীবীদের ধারণাগুলিকে সাধারণ মানুষের কাছে তাদের মনোভাব এবং বিশ্বাসের আকার দেওয়ার জন্য ছড়িয়ে দেয়। অন্যদিকে, নওমি চমস্কি, অমর্ত্য সেন, টমাস ফ্রিডম্যান, ডেসমন্ড টুটু, জে কে রাউলিংস, রিচার্ডস ডকিন্সের মতো শীর্ষ পাবলিক বুদ্ধিজীবীরা সকলের কাছে তাদের ধারণা সরাসরি ছড়িয়ে দেওয়ার এবং সমাজে গভীর প্রভাব রাখার বিশেষক্ষমতা রয়েছে। । সত্যিকারের বুদ্ধিজীবীরা যথাযথ পদ্ধতি এবং অখণ্ডতার সাথে কাজ করে মানুষের স্বাধীনতা ও জ্ঞানকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য নতুন নতুন চিন্তা এবং ধারণা নিয়ে কাজ করে। সৎ বুদ্ধিজীবীদের উচিত সত্যবাদী হওয়া, সরকার ও তার সহযোগীদের ভুল কাজগুলোকে প্রকাশ করা, ভালো ধারণাগুলোকে বিবেচনা করা এবং সমাজের উন্নতির জন্য জনসাধারণের দৃষ্টিভঙ্গি, বিশ্বাস এবং জ্ঞানকে উৎসাহিত করা।
১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পর, আমরা সবাই বাংলাদেশে ছদ্ম-বুদ্ধিজীবীদের উত্থান দেখেছি, বিশেষ করে সাম্প্রতিক সময়ে। আমরা সবাই তাদের টিভি টক শো, সেমিনার, ওয়ার্কশপ, মিডিয়া ইন্টারভিউ, সোশ্যাল মিডিয়া চ্যানেলে এবং এর বাইরেও দেখতে পাই সবসময়ে মিথ্যার বেসাতী করে বেড়ায়। তারা ভয়ানক ধারণা ছড়াচ্ছে প্রতিনিয়ত, অপ্রমাণিত সূত্র দিয়ে অর্ধসত্য কথা বলে। আমরা তাদের ধরন, তাদের আচরণ এবং তাদের উদ্দেশ্য জানি।তারা খুব চতুর ধুর্ত কারণ তারা জানে কিভাবে মানুষকে ম্যানিপুলেট করতে হয় এবং বিশেষ গুণাবলী ব্যবহার করে মানুষের মনকে কিভাবে প্রভাবিত করা যায়া এ জাতীয় বুদ্ধিজীবিরা ইংরেজি শব্দের ঘন ঘন ব্যবহার, তাদের আলোচনায় পশ্চিমা দার্শনিকদের বেশী বেশী উদ্ধৃতি ব্যাবহার করে, অন্যদের অপমান করা সহ বিপরীত পক্ষের অযাচিত দোষ খোজার চেষ্টা করে। তারা জনগন যেভাবে তাদের কাছ থেকে শুনতে চায় সেভাবে কথা বলে কারণ তারা জনসাধারণের কাছে পরিচিত এবং তাদেরকে পাবলিক বুদ্ধিজীবী বলা হয়। তারা তাদের "গুরু", "পণ্ডিত" বা "বিশেষজ্ঞ" হিসাবে বর্ণনা করে। সম্প্রতি, এই তথাকথিত কিছু "গুরু" আমাদের মহান চিন্তাবিদ, যেমন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, পাকিস্তানিরা যেভাবে একাত্তরে আমাদের সর্বশ্রেষ্ঠ বুদ্ধিজীবীদের আক্রমণ করেছিল, ঠিক সেই ভাবেই তাদের উপর হামলা করেছিল। এই নিবন্ধে তাদের নাম শনাক্ত করার আমার প্রয়োজন নেই আমাদের সকলকে সেই ছদ্ম-বুদ্ধিজীবীদের কাছাকাছি অতিরিক্ত সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। কৌতূহলী হোন এবং বুদ্ধির মানসিকতা রাখুন; যখন প্রয়োজন হবে, তাদের চ্যালেঞ্জ করুন।জাতীয় সম্প্রীতি রক্ষার জন্য সমাজকে অবশ্যই সেই ছদ্ম-গুরুদের খুঁজে বের করতে হবে।